আমেরিকার নির্বাচনের
ফলাফল বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
-শুভাশিস ঘোষাল
একথা সবারই
জানা যে আমেরিকায় কিছুদিন আগে নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি রিপাবলিকান
দলের প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো
বাইডেনের কাছে পরাস্ত হয়েছেন। এই নির্বাচনের ফলাফল কি যে রকম ভাবা হয়েছিল, সেরকম হয়েছে?
আগেরবারের নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনের ফল কেমন হয়েছে? কারা কোন প্রার্থীকে ভোট
দিলেন, কি কারণে? এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য কি? করোনা ভাইরাসের প্রভাব নির্বাচনে
কতটা পড়ল? নির্বাচনের ফলের প্রতিক্রিয়া কি? বর্তমান নিবন্ধে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেবার
চেষ্টা করছি।
প্রথমে সবাই
যেটা জানতে আগ্রহী হন, তা হল, নির্বাচনের পূর্বাভাস মিলেছে কি না। এই প্রশ্নের উত্তর
দিতে গেলে প্রথমে ঠিক করতে হবে পূর্বাভাস মেলা বলতে কি বোঝানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য,
দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন জয়ী হবেন (আরও কিছু ছোট দলের বা নির্দল প্রার্থী থাকলেও তাদের
জেতার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না), তাই এই দুজনের কে জয়ী হবেন সেই পূর্বাভাস মেলাটা
খুব একটা অসাধারণ ব্যাপার নয়। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুই প্রধান প্রার্থীর
কে জয়ী হবেন, তা পূর্বাভাসের সঙ্গে প্রায় সব সময়ই মিলে যায়, শুধু ২০১৬ সালের নির্বাচনে
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে ট্রাম্প
জয়ী হয়েছিলেন, তাও প্রায় ২৯ লক্ষ ভোট কম পেয়ে। সেটা ঘটেছিল কারণ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি
ঠিক সরাসরি সাধারণ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন না, হন রাজ্যগুলির ভোটের ভিত্তিতে,
যাকে বলে ইলেক্টোরাল কলেজ। প্রতিটা রাজ্যের থেকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার ভোট আছে (সেই
রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট সংখ্যা), যা তারা রাজ্যের বিজয়ী প্রার্থীকে সবটা দিয়ে দেয়।
এই পদ্ধতি এবং বর্তমান নির্বাচনের দল এবং প্রার্থীদের সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এই পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটি নিবন্ধে করা
হয়েছিল। এবারে পূর্বাভাসে জো বাইডেন এগিয়ে ছিলেন, ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন বলা হয়েছিল,
ফলাফলেও তাই হয়েছে। এমন কি যেসব রাজ্য বাইডেন জিতবেন ভাবা হয়েছিল, তার মধ্যে ফ্লোরিডা
ও নর্থ ক্যারোলাইনা ছাড়া বাকি সব রাজ্য তিনি জিতেছেন। সেই হিসেবে ফলাফল অবশ্যই মিলে
গেছে, কিন্তু আরও খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অনেক কিছুই মেলে নি। এমন কি, এবারের পূর্বাভাসে
এক হিসেবে ২০১৬ সালের থেকেও অনেক বেশি ভুল হয়েছে।
এ কথা বলা বাহুল্য
যে এবার অতিমারির জন্য একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভোট হয়েছে। তাতে যা হতে
পারত, ভোট পড়ার হার কমে যাওয়া। কিন্তু এবার প্রায় সবাইকেই ডাকযোগে ভোট দেবার সুবিধা
দেওয়ায় ভোট দেওয়া ব্যাপকহারে বেড়েছে। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি, তার
মধ্যে ভোট দেওয়ার অধিকারী (অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান নাগরিক) প্রায় ২৪ কোটি। তবে
ভোট দেবার জন্য সবাই নাম নথিকরণ করান না, বা করালেও ভোট দিতে আসেন না। আগের বছরগুলিতে
সাধারণতঃ ৫২-৫৭% ভোট পড়ত, এবারে তা বেড়ে ৬৭ শতাংশের মতো হয়েছে। তার ফলে দুই প্রধান প্রার্থীরই ভোট ব্যাপকহারে বেড়েছে, বিশেষ করে
তৃতীয় কোনও দলের শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায়। বিজয়ী প্রার্থী জো বাইডেন ৮.১ কোটিরও বেশি
ভোট পেয়ে সর্বকালীন রেকর্ড করেছেন, যেখানে আগের কোনও ভোটে কোনও প্রার্থী ৭ কোটিই অতিক্রম
করতে পারেন নি। এমনকি পরাজিত প্রার্থী ট্রাম্পও প্রায় ৭.৪ কোটি ভোট পেয়েছেন, আগের যে
কোনও প্রার্থীর থেকে বেশি। ট্রাম্প ২০১৬ সালে নিজের ভোটের থেকে এক কোটিরও বেশি ভোট
বাড়িয়েছেন। এমনকি শতাংশের হিসেবেও ট্রাম্প নিজের ভোট প্রায় ১% বাড়িয়েছেন, ৪৬.১% থেকে ৪৬.৯%।
প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা অনুযায়ী সেটা খুবই অপ্রত্যাশিত। যদিও বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষার
ভিত্তিতে পাওয়া হিসেবের মধ্যে কিছুটা তফাৎ ছিল, তবে প্রায় সবাই ট্রাম্পের পাওয়া ভোটকে
কম আন্দাজ করেছে, ভাবা হচ্ছিল ৪১-৪৪% হতে পারে
(সমীক্ষার গড়ের ভিত্তিতে, সমীক্ষক সংস্থার গুণগত মান হিসেবে রেখে)। বাইডেনের প্রাপ্ত
ভোটের শতকরা ভাগ অবশ্য সংস্থাগুলো প্রায় ঠিকই আন্দাজ করেছিল, ৫১-৫২% ভাবা হচ্ছিল, বাইডেন
৫১.৩% পেয়েছেন। তবে সারা দেশের ভোটের শতাংশ দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ হয় না, হয় রাজ্যে রাজ্যে
পাওয়া ভোটের হিসেবে। সেখানে প্রায় কোনও রাজ্যেই দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান সমীক্ষার
সঙ্গে মেলে নি। একমাত্র কলোরাডো ছাড়া বাকি সব রাজ্যেই শতকরা হিসেবে পূর্বাভাসের তুলনায়
ট্রাম্প হারা রাজ্যে ব্যবধান কমিয়েছেন নয়তো জেতা রাজ্যে ব্যবধান বাড়িয়েছেন। মিশিগান-উইসকন্সিন-পেনসিলভ্যানিয়ায়
যেখানে বাইডেনের খুবই ভালো ব্যবধানে জেতার কথা ছিল, সেখানে বেশ লড়াই করে জিততে হয়েছে,
অ্যারিজোনা-নেভাদা জিতলেও ব্যবধান প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম হয়েছে। ফ্লোরিডায় যেখানে
বাইডেন সমীক্ষায় এগিয়ে ছিলেন, সেখানে তিনি সহজেই হেরেছেন। টেক্সাস, ওহায়ো, আইওয়া তে
বাইডেন যেরকম লড়াই দিতে পারবেন মনে হয়েছিল, তা হয় নি। সব মিলে শুধু ১৬টি ব্যাটল্গ্রাউন্ড
স্টেটের (অর্থাৎ যেসব রাজ্যগুলিতে দুই প্রার্থীরই জেতার ভদ্রস্থ সম্ভাবনা আছে) মধ্যেই
নটি রাজ্যে ট্রাম্পের পাওয়া ভোটকে যে রকম কম অনুমান করা হয়েছিল, তা সমীক্ষার ভ্রান্তির
ব্যাপ্তির বাইরে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভুল। বাইডেনের বা ট্রাম্পের নিশ্চিত রাজ্যগুলিকে ধরলে ভুল হিসেবের
সংখ্যা আরো বেশি। সেই তুলনায় ২০১৬ সালে মাত্র একটা রাজ্যেই ফল পূর্বাভাসের ব্যাপ্তির
বাইরে হয়েছিল। তবে আন্দাজে অনেক বেশি ভুল হলেও এবারে বিজয়ী আন্দাজ করতে ভুল হয় নি,
কারণ বাইডেনের এগিয়ে থাকার ব্যবধান হিলারির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। আর কেউ ৫০ শতাংশের
উপরে ভোট পেলে তাকে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে হারানো অনেক বেশি শক্ত হয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ্য
যে ইলেক্টোরাল কলেজের পদ্ধতি থাকায় রিপাবলিকান প্রার্থীর কিছুটা সুবিধা রয়েছে। অল্প
জনসংখ্যার রাজ্যগুলি, যাদের জনসংখ্যার তুলনায় ইলেক্টরাল কলেজে প্রতিনিধিত্ব বেশি, সেইসব
রাজ্যে রিপাবলিকানরা বেশি শক্তিশালী কারণ এইসব গ্রামীণ রাজ্যগুলি অনেক বেশি রক্ষণশীল।
দুই দলের প্রার্থী সারা দেশে মোটামুটি সমান সংখ্যক ভোট পেলে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয়
প্রায় অবধারিত, এমনকি দুই শতাংশের মতো ভোট কম পেলেও তাঁর জয়ের ভালই সম্ভাবনা। ব্যবধান
তিন শতাংশের উপর নিয়ে যেতে পারলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী তাঁর জয়কে মোটামুটি সুরক্ষিত
করতে পারেন, চার বা তার উপরে নিয়ে যেতে পারলে তা অবধারিত হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে
ট্রাম্পের ভোট সমীক্ষা সংস্থাগুলি ঠিক করে আন্দাজ করতে পারছে না কেন? এখানে উল্লেখ্য,
গুটিকয়েক সংস্থা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমীক্ষা করতে পারে, তবে বেশিরভাগই নামী পেশাদারী
সংস্থা, বছরের পর বছর তারা সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিতে পেরেছে, ২০১৬ সালে ট্রাম্প ভোটারদের
হিসেব করতে ভুল হবার পর হিসেবে সংশোধনী পর্যন্ত ঢুকিয়েছে, তা সত্ত্বেও এই ধরণের ব্যাপক
তফাৎ খুবই অপ্রত্যাশিত। এবং এইরকম হিসেব না মেলাটা ট্রাম্প থাকলেই হচ্ছে শুধু। ২০১৮
সালের অন্তর্বর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জয় পূর্বাভাস
ছাপিয়ে গিয়েছিল। তবে কি ট্রাম্পের অনেক নীরব সমর্থক আছে, যারা সেকথা প্রকাশ করতে লজ্জা
পেয়ে ভুল তথ্য দেয়? অনেকের তাই মত, তবে যেহেতু সমীক্ষা গোপনে হয়, কোনও ভোটারের এরকম
কিছু করার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ নেই। অবশ্য মানুষ অনেককিছুই অযৌক্তিক কাজ করে, তাই
সেই হিসেবে এটা অসম্ভব নয়, তবে যে পরিমাণে তফাৎ হয়েছে সমীক্ষার তুলনায়, তাতে অন্য দুটো
কারণের কথা বেশি মনে হয়। এক, সমীক্ষায় যেরকম নমুনা বাছা হচ্ছে, তাতে কোনোভাবে ট্রাম্পের
ভোটারদের একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব বাদ পড়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য সমীক্ষায় অংশগ্রহণ
ঐচ্ছিক ব্যাপার, সমীক্ষায় অংশগ্রহণে ট্রাম্প ভোটারদের অনীহা থাকার বেশি সম্ভাবনা হতে
পারে। দ্বিতীয়তঃ, এরা হয়তো সমীক্ষার সময় মনস্থির না করা ভোটার এবং বাইডেন বা ডেমোক্র্যাটদের
বিরোধী, ট্রাম্পের কাজেও অখুশি (ট্রাম্পের অনুমোদনের অনুপাত বরাবর ঐতিহাসিকভাবে কম)
রিপাবলিকান সমর্থক, যারা শেষমেশ ট্রাম্পকে ভোট দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হয়তো কম করের
হার বা সামাজিক রক্ষণশীল নীতি বজায় রাখার জন্য। এরকম ভাবার কারণ বিশেষ করে এই যে, যারা
বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন, তাদের অনুপাত প্রায় সঠিকভাবেই পূর্বাভাস করা গেছে সমীক্ষা থেকে।
প্রত্যাশার
থেকে কম হলেও বাইডেনের জয়কে কম ভাবার কোনও কারণ নেই। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিকে হারানো
কঠিন কাজ, বিশেষ করে ট্রাম্পের প্রথম তিন বছরে অর্থনীতির উন্নতি ঘটেছিল। অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য
সাফল্য বাইডেন পেয়েছেন --- ২০১৬ তে হিলারির পাওয়া ভোট দেড় কোটি বাড়িয়ে মোট আট কোটির
উপর রেকর্ড সংখ্যক ভোট পাওয়া, পঞ্চাশ শতাংশের উপর মানুষের সমর্থন, বহু বছর পর ডেমোক্র্যাট
প্রার্থী হিসেবে অ্যারিজোনা ও জর্জিয়া জেতা, এবং হোয়াইট হাউস পুনরুদ্ধার করার জন্য
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ডেমোক্র্যাটদের বহুদিনের ঘাঁটি মিড ওয়েস্টের রাস্টবেল্ট রাজ্য
(যেখান থেকে উৎপাদন শিল্প সরে গেছে) মিশিগান-উইসকন্সিন-পেনসিল্ভ্যানিয়া জিতে ‘নীল দেওয়াল’
গড়া (ডেমোক্র্যাটিক দলকে নীল রঙ দিয়ে চিহ্ণিত করা হয়)। ফ্লোরিডা আর দু একটি (ফলাফলের
জন্য গুরুত্বহীন) ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব রাজ্যেই বাইডেন প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়িয়েছেন।
ইলেক্টোরাল কলেজে বাইডেনের জয়ের ব্যবধান ৩০৬-২৩২, যেটা মোটেই সামান্য নয়। কাকতালীয়ভাবে
গত নির্বাচনে হিলারির বিপক্ষে ট্রাম্প ঠিক এই ব্যবধানেই জিতেছিলেন, তবে ট্রাম্প যেখানে
২৯ লক্ষ কম ভোট পেয়ে জিতেছিলেন, সেখানে বাইডেন ৭০ লক্ষ বেশি ভোট পেয়ে ঠিক একই জয় পাচ্ছেন।
এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থীরা প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় ইলেক্টোরাল কলেজে কেমন সুবিধা পান, বিশেষ করে ব্যবধান
যখন অল্প হয়।
২০১৬ সালে হিলারির
তুলনায় বাইডেন কোথায় উন্নতি করলেন যাতে তিনি জয় ছিনিয়ে আনতে পারলেন? আগেই উল্লেখ করেছি,
তেমন কোনও শক্তিশালী তৃতীয় দলের প্রার্থী না থাকায় দুই প্রধান প্রার্থীরই ভোটের অনুপাত
মোটের উপর বেড়েছে, তবে জনগোষ্ঠীভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে জয়-পরাজয়ের মূল কারণ বুঝতে সুবিধা
হবে। জনগোষ্ঠী অনুযায়ী ভোট দেবার প্রবণতা অবশ্য প্রাপ্ত ভোট থেকে হিসেব করা সম্ভব নয়
পুরোপুরি, তাই বুথফেরৎ সমীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে এবারে কোভিডের কারণে
বহু ভোটার ডাকযোগে ভোট দেওয়ার কারণে বুথফেরৎ সমীক্ষার পদ্ধতিতেও বদল করতে হয়েছে
--- টেলিফোনে সেই সব ভোটারদের যোগাযোগ করতে হয়েছে। সেই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে বাইডেন
আর ট্রাম্প দুজনেই, পুরুষ আর মহিলা, উভয় ভোটারের মধ্যেই ভোটের হার বাড়িয়েছেন, তবে বাইডেন
বেশি করে বাড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে মোটের উপর পুরুষদের রিপাবলিকানদের ভোট দেবার
আর মহিলাদের ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবার প্রবণতা বেশি, তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আলাদা করে
হিসেব করলে এই হিসেব বদলাবে। বয়স হিসেবে ভাগ করলে ১৮-২৯ বছরের সর্বকনিষ্ঠ শ্রেণীর ভোট
বাইডেন অনেক বেশি বাড়িয়েছেন, কিন্তু ৩০-৪৪ বছরের ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প ভোট বাড়িয়েছেন
বেশি। ৪৫-৬৪ বছরের ভোটারদের মধ্যে বাইডেন অনেকটা ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প খুইয়েছেন।
৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে বাইডেন কিছুটা ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প একই জায়গায়
রয়েছেন। সাধারণতঃ তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবার প্রবণতা বেশি দেখা
যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে রিপাবলিকানদের ভোট বাড়ে। এবারের ভোটে কোভিডের প্রভাব বিভিন্ন
বয়সের মধ্যে বিভিন্নরকম দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের প্রশাসন কোভিড নিয়ন্ত্রণ একেবারেই করতে
পারে নি। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানরা মাস্ক পরার মতো সাধারণ সুরক্ষাবিধি
চাপাতেও অনীহা দেখিয়েছেন, যেন কিছুই নয় এরকম একটা তত্ত্ব দিয়ে স্কুল-কলেজ-ব্যবসা সব
স্বাভাবিকভাবে খোলা রাখার জন্য জোরাজুরি করেছেন। বেশি বয়স্কদের মধ্যে কোভিডে মৃত্যুর
প্রবণতা বেশি বলে রিপাবলিকানদের জন্য নির্ভরযোগ্য এই ভোটিং ব্লক, অর্থাৎ বয়স্ক ভোটাররা,
শঙ্কিত হয়ে ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে মাঝবয়সীরা, যাদের ঝুঁকি কম, রুটি-রুজির
কারণে ব্যবসা খোলা রাখার সপক্ষে --- তারা আগের তুলনায় ট্রাম্পকে বেশি হারে ভোট দিয়েছেন,
অর্থনীতির অবনতিকে তারা কোভিডের কারণে ক্ষণস্থায়ী বলে মনে করেছেন। এর থেকে মনে হয় কোভিডের
প্রভাব কাটাকুটি হয়ে গিয়ে ভোটের ফলাফলকে মোটের উপর তেমন প্রভাবিত করতে পারে নি। একবারে অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে অবশ্য হিসেবটা একটু
অন্যরকম, গতবার এদের অনেকেই হিলারিকে অপছন্দের কারণে ব্যাপকহারে ভোটদানে বিরত ছিলেন,
তৃতীয় দলের প্রার্থী বা এমনকি ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছিলেন --- বাইডেন তাদের ভোট বেশ কিছু
ফিরে পেয়েছেন।
অন্যভাবে, জাতি
অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে ডেমোক্র্যাটদের জন্য কিছুটা দুঃসংবাদ আছে। সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গরা
এবং তুলনায় কম মাত্রায় লাতিনো (ফ্লোরিডার কিউবানদের বাদ দিয়ে) আর এশিয়ানরা, সাধারণতঃ
ডেমোক্র্যাটিক দলের বিশ্বস্ত ভোটার। কিন্তু এবারে দেখা যাচ্ছে এদের মধ্যে বাইডেনের
ভোটের হার কমেছে, ট্রাম্পের বেড়েছে, বিশেষ করে এশিয়ানদের মধ্যে এই তফাৎটা বেশ চোখে
পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় রেকর্ড হারে কৃষ্ণাঙ্গ
ভোট পেয়েছেন (যদিও সেটাও অনপেক্ষভাবে খুব উঁচু নয়)। এটা বেশ আশ্চর্যের বিষয়, কারণ ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী
মনোভাব অনেকভাবেই প্রকাশ পেয়েছে, কয়েকমাস আগে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পুলিশের অমানবিক আচরণের
বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিক্ষোভ হয়েছে যাতে ডেমোক্র্যাটরা বিশেষ
করে সামিল হয়েছে আর ট্রাম্পের প্রশাসন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মেক্সিকো, মধ্য আর দক্ষিণ
আমেরিকা থেকে আগত শরণার্থীদের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের অমানবিক আচরণও প্রচুর নিন্দিত
হয়েছে। এমনকি ইসলামি দেশ থেকে ভিসা দেওয়া আটকানোর ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা
বহুচর্চিত হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প অনেক মুসলিম ভোট পেয়েছেন। সংখ্যালঘুদের এইরকম ভোট দেবার প্রবণতার নানা ব্যাখ্যা
করা হয়েছে। সংখ্যালঘুরা সবাই এক ধাঁচের নয়, সবার সমস্যাও একই রকমের নয়। অনেকে নিজেদের
সংখ্যালঘু না ভেবে মূলধারার ভাবতে চান। ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যালঘু নীতির অনেকটাই কৃষ্ণাঙ্গকেন্দ্রিক,
‘ট্রাম্প বর্ণবিদ্বেষী’ এই প্রচার মনে হয় বহু সংখ্যালঘুর কাছে তেমনভাবে কাজ করেনি।
অনেক ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের শ্লোগান ‘ডিফান্ড দা পোলিস’ ডেমোক্র্যাটিক
দলের কথা না হয়েও তাদের সঙ্গে জুড়ে গেছে রিপাবলিকানদের সফল প্রচারে। তবে আসল কারণ খুব
সম্ভবতঃ অর্থনৈতিক। এশিয়ানদের উচ্চশিক্ষিত অংশ বাদ দিলে বাকি সংখ্যালঘুরা বেশিরভাগই
মূলতঃ ঘন্টা হিসেবে কাজে বেতন পাওয়া অল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, অথবা ছোট ব্যবসা করেন।
কোভিডে অর্থনীতি অচল হওয়াতে এরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ট্রাম্পের প্রথম তিন বছরে
অর্থনীতি সবল থাকায় এদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছিল। কোভিডে দুর্দশার জন্য ট্রাম্প
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার থেকে অর্থনীতি বন্ধ হলে সরাসরি ক্ষতি তাদের কাছে বেশি ভয়ের
মনে হয়েছে। ফ্লোরিডার লাতিনো অধ্যুষিত ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি মায়ামি অঞ্চলে বাইডেন অল্প
লিড পেয়েছেন, ওবামা বা হিলারির মতো ভোট পেলেই ফ্লোরিডার বাকি অঞ্চলে ভালো ফলের জোরে
বাইডেন ফ্লোরিডা জিততে পারতেন। টেক্সাসে মেক্সিকো সীমান্তবর্তী যেসব লাতিনো অধ্যুষিত
অঞ্চল ওবামা বা হিলারি জিতেছিলেন, বাইডেন জিততে পারেন নি। ফলে মোট হিসেবে টেক্সাসে
বাইডেন ব্যবধান কমালেও যেরকম কাছাকাছি আসার কথা পূর্বাভাসে ছিল, তা আদৌ হয় নি। অ্যারিজোনা-নেভাদাতেও
লাতিনো ভোট কম পাওয়ার ফলে বাইডেনের জয় অনেক কষ্টসাধ্য হয়েছে। নর্থ ক্যারোলাইনাতে কৃষ্ণাঙ্গ
ভোট যথেষ্ট পরিমানে না পাওয়ার ফলে, ব্যবধান কমালেও জয় বাইডেনের হাতছাড়া হয়ে যায়। জর্জিয়াতে
একই রকম পরিস্থিতি হলেও কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট নেত্রী স্টেসি আব্রামসের নিরলস চেষ্টার
ফলে অবশ্য বাইডেনের অল্প ব্যবধানে জয় এসেছে। অর্থাৎ কমলা হ্যারিস রানিং মেট হওয়া সত্ত্বেও
বাইডেনের কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান বা এমনকি মহিলা ভোট পেতেও বাড়তি কোনও সুবিধা হয় নি। কিন্তু
অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের, যারা ভোটারদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ও রিপাবলিকানদের ভরসার জায়গা,
তাদের মধ্যে বাইডেন উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছেন। ফলে তাদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে
শেষমেশ বাইডেনই জয়ী হয়েছেন। ট্রাম্পের সবথেকে বিশ্বস্ত ভোটিং ব্লক অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ
পুরুষ ভোটারদের মধ্যেও বাইডেন ভোটের হার বাড়িয়েছেন।
তবে বাইডেন আর ট্রাম্পের ভোটের যে বিশাল ব্যবধান সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছিল, আর তার ফলে
যে ‘নীল সুনামি’ হবে ভাবা হচ্ছিল, তা হয় নি
সংখ্যালঘু ভোট এতটা কমে যাবার জন্য। সংখ্যালঘু ভোট কমে যাওয়াটা যদি স্থায়ী ব্যাপার
হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় ডেমোক্র্যাটদের জন্য সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে
রইল।
আমেরিকা অনেকদিন
ধরেই রাজনৈতিকভাবে খুব বিভাজিত দেশ। সমীক্ষাতে এও দেখা যাচ্ছে যে অতিমারি, অর্থনীতির
অবনতি বা জাতিগত বিক্ষোভের মতো এতকিছু একসঙ্গে ঘটে যাবার পরও দুই দলের নথিভুক্ত ভোটাররা
দৃঢ়ভাবেই নিজেদের দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করেছেন। তবে যারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান
দলের ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেন নি, সেইধরণের স্বাধীন ভোটারদের মধ্যে বাইডেন বিরাট
সমর্থন বাড়িয়েছেন, আর ট্রাম্প সমর্থন খুইয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাইডেনকে জিততে সাহায্য
করেছে। একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে যারা নিজেদের মধ্যপন্থী বলে ভাবেন, তাদের মধ্যে। আয় হিসেবে
দেখলে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বাইডেন আর ট্রাম্প দুজনেই কিছুটা ভোট বাড়িয়েছেন, মধ্য
আয়ের মধ্যে বাইডেন ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প খুইয়েছেন, আর উচ্চ আয়ের লোকেদের মধ্যে
ট্রাম্পের ভোট উল্লেখযোগ্য বেড়েছে আর বাইডেনের কমেছে। ট্রাম্পের কর কমানোর নীতি আর
শেয়ার বাজারের ভালো অবস্থা ট্রাম্পকে উচ্চ আয়ের লোকেদের সমর্থন পেতে সাহায্য করেছে।
তবে বাইডেনের জেতার পিছনে বিরাট অবদান রয়েছে আমেরিকার শহরতলী অঞ্চলের আর মাঝারি জনসংখ্যার
শহরের ভোটারদের। শ্রেণীগতভাবে এরা বেশিরভাগই মধ্য আয়ের সংসারী মানুষ --- রিপাবলিকান
আর ডেমোক্র্যাটদের মোটামুটি সমানহারে ভোট দিয়ে থাকেন। আমেরিকায় বড় শহরের ভিতরে সাধারণতঃ
অফিস হোটেল এইসব বেশি থাকে, খুব অল্প কিছু দামী এলাকায় কিছু উচ্চ আয়ের মানুষ থাকেন,
শহরের কেন্দ্রে অ্যাপার্টমেন্টে কিছু অল্পবয়সী চাকরিজীবি থাকেন, আর বেশ কিছু দরিদ্র
অঞ্চলে অল্প আয়ের মানুষেরা থাকেন। মধ্যবিত্ত সংসারী মানুষেরা সাধারণতঃ শহরের ভিতরে
না থেকে শহরতলি থেকে যাতায়াত করেন, সেখানে আয়ত্তের দামের মধ্যে খানিকটা জায়গা নিয়ে
বাড়ি পাওয়া যায়, স্কুলগুলোও অনেক ভালো হয়, আইন-শৃংখলাও অনেক ভালো হয়। নিচের রেখচিত্র
থেকে দেখা যাচ্ছে বড় শহর, শহরতলী, মাঝারি শহর, ছোট শহর, খুব ছোট শহর আর গ্রামীন এলাকায়
ডেমোক্র্যাটদের আর রিপাবলিকানদের ভোটের হারের কিরকম বিবর্তন হয়েছে গত চারটে নির্বাচনে।
খুব ছোট শহর আর গ্রামীণ এলাকা ক্রমশঃই রিপাবলিকানদের প্রায় একচেটিয়া হয়ে গেছে, তবে
এইসব এলাকার জনসংখ্যা খুব কম। শহরতলীর ভোটারদের
সংখ্যা অনেক বেশি। এবারের ভোটে তাদের কিছুটা বাড়তি সমর্থন, বিশেষকরে শহরতলীর
মহিলাদের যারা ট্রাম্পের আচরণে অনেকেই ক্ষুব্ধ, বাইডেনের জয় সহজসাধ্য করেছে। এই প্রবণতা ২০১৮ সালের আইনসভার নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটদের
বিপুল জয় এনে দিয়েছিল।
তবে রাষ্ট্রপতি
নির্বাচনের সাথে আইনসভার দুই কক্ষ, হাউস আর সেনেটের নির্বাচন নিয়েও কিছু বলা প্রয়োজন।
হাউসে প্রতি দু বছরে সব আসনে নির্বাচন হয়। ডেমোক্র্যাটরা ২০১৮ সালে বিপুল গরিষ্ঠতা
পায়, এবারে আশা করা হচ্ছিল তারা একই রকম গরিষ্ঠতা বজায় রাখবে। ফলাফলে দেখা গেল তারা
বেশ কিছু আসন হারিয়ে অল্পের জন্য গরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে, রিপাবলিকানরা অনেক ক্ষেত্রেই
উল্লেখযোগ্যভাবে ভোট বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রিপাবলিকান প্রার্থীরা ট্রাম্পের তুলনায়
ভাল ফল করেছেন তাদের নির্বাচনী কেন্দ্রে। আসন হারানোর জন্য মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটরা
অনেকে প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের দায়ী করে বলেছেন, মধ্যপন্থী ভোটাররা তাদের ভয়ে রিপাবলিকানদের
ভোট দিয়েছেন, তাদের কর্মসূচী ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ আর ‘গ্রিন নিউ ডিল’ ধরণের ‘সমাজতান্ত্রিক
নীতি’ ভোটারদের অপছন্দ। তবে যে একশ প্রগতিশীল প্রার্থী ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ সমর্থক, তারা
সকলেই জিতেছেন। ফলে প্রগতিশীলরা দাবী করেছেন মধ্যপন্থীদের দৃঢ়তার অভাবেই তাঁরা ভোটারদের
কাছে পৌঁছতে পারেন নি। সেনেটের নির্বাচন অবশ্য
সব আসনে হয় না একসাথে, আর জনসংখ্যা নির্বিশেষে সব রাজ্যের দুই সেনেটরের নিয়ম রিপাবলিকানদের
সুবিধা করে অনেক। তবে সমীক্ষার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছিল ডেমোক্র্যাটরা সামান্য গরিষ্ঠতায়
বা ৫০-৫০ করে উপরাষ্ট্রপতির ভোটে সেনেটের দখল রাখবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা দুটি
আসন ছিনিয়ে এনেছে, একটি খুইয়েছে আর দুটি আসনে বিশেষ নিয়মের কারণে আবার নির্বাচন হতে
হবে। ফলে এই দুটিই জিতলে তবেই তারা ৫০-৫০ করতে পারবে, যা অসম্ভব না হলেও মোটেই সহজ
নয়। অন্ততঃ দুটি আসনে তাদের প্রত্যাশিত জয় না আসার ফলে ডেমোক্র্যাটরা পিছিয়ে পড়েছে।
অনেকের মতে বাইডেনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে চাইলেও ওয়াল স্ট্রিট আর ভোটারদের একটা বড় অংশ
সেনেটের দখল ডেমোক্র্যাটদের হাতে দিতে চান নি। কারণ তা হলে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের
করছাড় রদ করে করের হার বাড়াতে সফল হতে পারেন, বা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের নতুন বিধি চালু
করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সেনেটের সাহায্য ছাড়া বাইডেনের প্রতিশ্রুত নীতিগুলির বাস্তবায়ন
করা বেশ শক্ত হবে। তবে বাকি দুই আসন জিতে সেনেটের দখল নিতে পারলে হোয়াইট হাউস-সেনেট-হাউসের
দখল নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের ‘ট্রাইফেক্টা’ হবে, যা রিপাবিলকানরা ২০১৬ সালে পেয়েছিল।
নির্বাচনের
ব্যাপারে তিনটি কাল্পনিক কিন্তু কৌতুহলদ্দীপক প্রশ্ন মনে আসে, যার প্রকৃত উত্তর জানা
সম্ভব না, শুধু আলোচনা হতে পারে। প্রথম হল, কোভিড অতিমারি না হলে কি ট্রাম্প জিততেন?
এর তিনরকম উত্তর পাওয়া গেছে। প্রথম উত্তর হল, না। ট্রাম্পের অনুমোদন ভোটারদের কাছে
বরাবর খুব কম। ট্রাম্প খুব বিভাজনকারী রাজনীতিক --- সমর্থক বা সমালোচক দুই দলই তাদের
অবস্থানে খুব দৃঢ়, এত কিছু ঘটনায় ট্রাম্পের এতরকম সমালোচনাও তাঁর সমর্থকদের বিচলিত
করে নি, এমনকি কোভিডকেও অনেকে ‘ফেক নিউজ’ বা ‘চীনের ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অতিমারির
আগে গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই সমীক্ষায় তিনি বাইডেন সহ বেশ কিছু সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাটিক
প্রার্থীর থেকে কাল্পনিক লড়াইয়ে পিছিয়ে ছিলেন। অবশ্য সমীক্ষার ফল না মিলতে দেখা যাচ্ছে,
বিশেষতঃ অতদিন আগের হলে সেটা তত নির্ভরযোগ্য নয়, তাই শুধু তার ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া
যায় না। তবে গতবার ট্রাম্পের জয়ের কারণ রাস্টবেল্টের তিনটি রাজ্যে কাজ-হারাদের মধ্যে
হিলারির জনপ্রিয়তার অভাব। ফলে ট্রাম্প যা পেতে পারতেন, তিনি তাইই পেয়েছেন। দ্বিতীয়
অংশের মত হল অল্প হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে কোভিডের কারণে এবং তার ফলে অর্থনীতির
অবনতিতে কিছু ভোট ট্রাম্পের বিপক্ষে যাওয়াতেই ফলাফল ট্রাম্পের প্রতিকূল হয়েছে। নইলে
শক্তিশালী অর্থনীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্প জিততেন, তা তাঁর প্রশাসন
যতই বিতর্কিত কাজ করুক বা মানুষ হিসেবে তিনি যতই অপছন্দের হোন না কেন। তৃতীয় মত হচ্ছে,
কোভিডের ফলে ট্রাম্পের কিছুটা হলেও সুবিধাই হয়েছে। এতে ট্রাম্পের আর তাঁর প্রশাসনের
অন্যান্য দুর্নীতি ও অপদার্থতা চাপা পড়ে গেছ। কোভিডের ফলে যে লকডাউন আর বিধিনিষেধ আরোপ
করা হয়েছে মূলতঃ ডেমোক্র্যাট শাসিত রাজ্য বা শহরে, তার ফলে যারা কাজ হারিয়েছেন তারা
ডেমোক্র্যাটদেরই দায়ী করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন যে তাদের সাহায্যের জন্য প্রায় কিছুই
করেনি, সেটা তাদের কাছে তেমন পরিষ্কার হয় নি, রিপাবলিকানদের অর্থনীতি চালু রাখার চেষ্টাটাই
বড়ো প্রতিপন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্প কোভিডের বিধিনিষেধ না মেনে একের পর এক জনসভা করে
গেছেন, রিপাবলিকান স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছেন, নিয়ম মেনে ডেমোক্র্যাটরা
সেগুলো থেকে বিরত থাকায় তাদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি হয়েছে। তবে একটা ব্যাপারে একমত হওয়া
যায় যে, কোভিডের সংকটে ট্রাম্প যদি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাহলে সমর্থন বাড়িয়ে
জয়ী হবার সুযোগ তাঁর সামনে ছিল, যেমন যুদ্ধের সময় ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানরা জনসাধারনের
সমর্থন পান। তবে ট্রাম্প সেই রাস্তায় হাঁটেন নি, বা বলা ভালো, তার জন্য যে মানসিকতা
আর যোগ্যতা লাগে, তা ট্রাম্পের নেই। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল বাইডেনের বদলে যদি প্রগতিশীল
ও বামপন্থী সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি জিতে দলের প্রার্থী
হতেন (যা প্রাইমারির শুরুর দিকে বেশি সম্ভাব্য মনে হচ্ছিল), তাহলে কি ট্রাম্প জিততে
পারতেন? একথা ঠিক মধ্যপন্থী বাইডেন অনেক কম ঝুঁকির প্রার্থী, তবে স্যান্ডার্সের রাজনৈতিক
বক্তব্যগুলি অনেক বেশি সরাসরি গরীব মানুষের রুটিরুজি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কিত
--- যেমন সবার জন্য সরকারি স্বাস্থ্যবিমা ‘মেডিকেয়ার ফর অল’, যার খরচ করের টাকা থেকে
সরাসরি মেটানো হবে, ছাত্রঋণ মকুব করা হবে, ইত্যাদি। সমীক্ষায় দেখা গেছে মানুষ প্রগতিশীল
নীতিগুলি সমর্থন করেন, যদি তাতে রাজনৈতিক তকমা না দেওয়া হয়। দেশের ৭২% মানুষই ‘মেডিকেয়ার
ফর অল’ নীতিতে উৎসাহী বা আপত্তি নেই জানিয়েছেন। এছাড়া ফ্লোরিডায় ১৫ ডলার সর্বনিম্ন
ঘন্টাপ্রতি মজুরি ভোটাররা অনুমোদন করেছে ৬০% ভোটে, অথচ সেখানে ট্রাম্প এই নীতির বিরোধী
হয়েও ফ্লোরিডা জিতেছেন, বাইডেন এই নীতির সমর্থক
হয়েও তা নিয়ে প্রচার করেননি। স্যান্ডার্স প্রার্থী হলে এইসব বিষয় প্রচারে গুরুত্ব পেত।
রাস্টবেল্টেও স্যান্ডার্সের আবেদন বেশি, তাতে ওই রাজ্যগুলি জিততে বেগ পেতে হতো না,
বরঞ্চ ওহায়ো বা আইওয়া জেতারও সুযোগ থাকত । লাতিনোদের মধ্যেও স্যান্ডার্সের জনপ্রিয়তা
খুব ভালো। তবে শ্বেতাঙ্গ মধ্যপন্থী ভোটাররা যারা বাইডেনকে অনেক সমর্থন করেছেন, তাতে
হয়তো কিছু ভাঁটা পড়ত। তবে দলের তরফ থেকে সহযোগিতা পেলে অন্ততঃ রাস্টবেল্টের তিনটি রাজ্য
জিতে স্যান্ডার্স নির্বাচিত হতে পারতেন। তৃতীয় প্রশ্ন হল, লিবারেটারিয়ান প্রার্থী যদি
না থাকতেন, তাহলে কি ট্রাম্প জিততেন? যদিও গতবারের মতো এবারে শক্তিশালী লিবারেটেরিয়ান
প্রার্থী ছিল না, কিন্তু তাও চার-পাঁচটি রাজ্যে ভোটের যে ব্যবধান, তা উলটে যেত সমস্ত
লিবারেটেরিয়ান ভোট ট্রাম্পের ঝুলিতে এলে, আর তা হলেই ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হতেন।
লিবারেটেরিয়ান দল অর্থনীতির প্রশ্নে আরও প্রবলভাবে দক্ষিণপন্থী, তাই ভাবা হয় তারা রিপাবলিকানদের
ভোটই কাটছে। বাস্তবে অবশ্য তা হয় না, যারা লিবারেটেরিয়ানদের ভোট দিচ্ছেন, তারা নীতিগত
কারণেই দেন, না হলে ভোটই দিতেন না, কারণ লিবারেটেরিয়ানরা সামাজিকভাবে উদারপন্থী, প্রায়
কোনোরকম নিয়ন্ত্রণেই বিশ্বাসী নন, আর রিপাবলিকানদের যুদ্ধনীতির ঘোর বিরোধী। তাই এরকম
কোনও সহজ সমীকরণ সম্ভব নয়।
নির্বাচনের
পরে ট্রাম্পের করা কুনাট্যের কথা না বললেই নয়। এবারে ভোট যেহেতু অতিমারির মধ্যে হয়েছে,
প্রচুর মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। সেগুলো পৌঁছানোর সময়সীমা বা গণনা করার সময় বিভিন্ন
রাজ্যে আলাদা আলাদা। ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থকদের কোভিড সচেতনতা বেশি, তাই তারা অনেক
বেশি ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। যেহেতু বেশিরভাগ রাজ্যে ডাকযোগে আসা ভোট পরে গোনা হয়, তাই
নির্বাচনের ফল বেরোনোর শুরুর দিকে এক ধরণের ‘লাল মরীচিকা’ (লাল রঙ দিয়ে রিপাবলিকান
দলকে চিহ্ণিত করা হয়) হতে পারে জানাই ছিল, যাতে ট্রাম্প শুরুতে বিভিন্ন রাজ্যে এগিয়ে
থাকলেও ডাকযোগে আসা ব্যালট গোনা হলে বাইডেন এগিয়ে যাবেন। বাস্তবে ঠিক তাই ঘটল, মিশিগান,
উইসকন্সিন, পেনসিলভ্যানিয়া আর জর্জিয়ায় ট্রাম্প শুরুতে এগিয়ে যেতেই তিনি তড়িঘড়ি দাবী
করে বসেন যে তিনি আবার জিতেছেন। ক্রমশঃ ফলাফল বদলে যেতে থাকলে আবার দাবী জানান যে এই
সমস্ত রাজ্যে ভোট গণনা বন্ধ করে দিয়ে ডাকযোগে আসা ব্যালট গ্রাহ্য না করতে, কারণ তাঁর
দাবী এতে প্রচুর জাল ভোট গোনা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া
হয় সেই স্তরে গণনা বন্ধ করা হল, তাহলে বাইডেনই জিতে জেতেন। ট্রাম্প অবশ্য চাইছিলেন,
যেসব রাজ্যে তিনি পিছিয়ে, সেখানেই শুধু গণনা চলুক। আদালতেও সেইমর্মে তাঁর আইনজীবীরা
পিটিশন করেন। বলা বাহুল্য, আদালত এরকম উদ্ভট যুক্তি শুনতে চায় নি। ট্রাম্পের আইনজীবীরা
ভোটে বেনিয়ম হবার কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি। বস্তুতঃ ট্রাম্পের পুরো আইনি সেল
এক বিশৃঙ্খল ও হাস্যকর কার্যকলাপের উৎস হয়ে উঠেছে। কোনও নামী ল ফার্ম এই দায়িত্ব নিতে
চায় নি, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি এই দল পরিচালনা করছেন। জুলিয়ানি
এক সময় নিউ ইয়র্কের মেয়র হিসেবে ভালো কাজ করেছিলেন, কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর আইনচর্চা
না করা জুলিয়ানির কোনও আইনি দক্ষতা দেখা যায় নি, প্রায়ই আদালতে ভর্তসৃত হয়েছেন। এমনই
অপদার্থতা যে সাংবাদিক সম্মেলন করার জন্য ফিলাডেলফিয়া শহরে ‘ফোর সিজন’ অভিজাত হোটেল
ভাড়া করতে গিয়ে ভুল করে ওই নামে একটা ল্যান্ডস্কেপিং কোম্পানির পার্কিং এর জায়গা ভাড়া
করে ট্রাম্পের আইনি সেল। সেখানে সাংবাদিক সম্মেলন করাটা একটা চুড়ান্ত অস্বস্তিকর ব্যাপার।
ট্রাম্পের এক প্রধান আইনজীবী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তা কিছু ছদ্ম সংবাদমাধ্যম থেকে
উদ্ধৃতি দিতে থাকলে সেলের পক্ষেও সেটা থেকে দূরত্ব তৈরি করে বলতে হয় ওই আইনজীবী দলের
অংশ নন। জুলিয়ানি কাহিল অবস্থায় রোদে ঘেমে প্রায় ভাঁড় প্রতিপন্ন হন। সঙ্গত কারণেই কথা
উঠেছে, জাল ভোট পড়ার কারণে ভোটকে যদি অগ্রাহ্য করতে হয়, তবে একই ব্যালটে অন্যান্য পদে রিপাবলিকান প্রার্থীদেরও নির্বাচন
অবৈধ হয়ে যায়। ট্রাম্পের প্রায় সমস্ত পিটিশনই বিভিন্ন রাজ্যে আদালতে পরিত্যক্ত হয়েছে,
যদিও আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদেরই ব্যাপক সংখ্যাধিক্য। জর্জিয়াতে
ব্যবধান কম বলে নিয়মমাফিক পুনর্গণনা হয়, তবে পুনর্গণনাতে কখনই ব্যবধানে কয়েকশর বেশি
তফাৎ হয় না। উইসকন্সিনে ট্রাম্প কয়েকটি অঞ্চলে টাকা জমা দিয়ে পুনর্গণনার অনুরোধ করেন,
কিন্তু তাতে বাইডেনেরই ভোট কিছু বাড়ে। এত কিছু সত্ত্বেও ট্রাম্প বাইডেনের জয় স্বীকার
করে ‘কনসেসন স্পিচ’ দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর প্রশাসনের অন্যান্য ব্যক্তিরাও বাইডেনের
আসন্ন অভিষেক মসৃণভাবে হবে কি না সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে হাস্যকরভাবে দাবী
করেন ট্রাম্পই রাষ্ট্রপতি থাকছেন। অবশ্য ‘কনসেসন স্পিচ’ দেওয়া একটা সৌজন্যরীতি মাত্র,
ট্রাম্প স্বীকার না করলেও বাইডেনের অভিষেক আটকায় না, যদি সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি বাইডেনকে
তাদের রাজ্যের জয়ী বলে সরকারি ঘোষণা করে আর ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধিরা সেই নির্দেশ
অনুযায়ী ভোট দিয়ে বাইডেনকে সরকারিভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। রাজ্যগুলির জয়ীকে
শংসাপত্র দেবার সময়সীমা ৮ই ডিসেম্বর, ইলেক্টরাল
কলেজে ভোট নেওয়া হবে ১৪ই ডিসেম্বর, ৬ই জানুয়ারী কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ভোট গোনা হবে আর নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ হবে ২০ জানুয়ারী
দুপুর বারোটায়। কাজেই যাই ঘটুক, সেই পর্যন্ত ট্রাম্পই রাষ্ট্রপতি থাকছেন, যদি না আগেই
পদত্যাগ করেন।
আমেরিকার সংবিধানে
এই আড়াই মাসেরও বেশি লম্বা ‘লেম ডাক পিরিয়ড’ রাখা হয়েছিল যাতে এক প্রশাসন থেকে পরবর্তী
প্রশাসনে যাওয়া সহজসাধ্য হয়। নীতিগতভাবে এই সময়ে আগের রাষ্ট্রপতির, বিশেষকরে যিনি নির্বাচনে
প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তাঁর কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়, সবকিছু সিদ্ধান্ত
পরবর্তী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সমন্বয় করে করা উচিৎ। কিন্তু যেহেতু সংবিধানে পরিষ্কার কোনও
নির্দেশ নেই, তাই ট্রাম্প এই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন। পেন্টাগনের ও সাইবার নিরাপত্তার বরিষ্ঠ অফিসারদের সরিয়ে নিজের অনুগতদের পদে
বসিয়েছেন এই আশায় যে তাঁরা কিছু ট্রাম্পকে সুবিধা দেবেন। তা ছাড়া অভিবাসন নীতিতে উল্লেখযোগ্য
কড়াকড়ি চালু করা, আলাস্কায় সংরক্ষিত জায়গা তেল ড্রিলিং করতে খুলে দেওয়া, কোভিড ত্রাণের
বরাদ্দ টাকা পেতে বাইডেনের প্রশাসনের জন্য ইচ্ছাকৃত অসুবিধা সৃষ্টি করা, ইরানের সাথে
বিরোধ ইচ্ছা করে বাড়িয়ে নেওয়া ইত্যাদি সিদ্ধান্তও
ক্ষতিকারক হতে পারে। নির্বাচন চলাকালীন ট্রাম্পের দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের এক নতুন বিচারপতি
নিয়োগ করাও এই সৌজন্যের বিরোধী। তবে এ ব্যাপারে সব রিপাবলিকান সেনেটরকেই দায়ী করতে
হয়, কারণ তাঁদের ভোটেই এই নিয়োগ আইনসিদ্ধ হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের মনোভাবে দেশের গোপন
তথ্যের ব্যাপারে তাঁর উপর নির্ভর করা যায় কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে, বিশেষ করে ট্রাম্পের
ব্যবসার সঙ্গে যেহেতু বেশ কিছু দেশের সম্পর্ক রয়েছে।
এরকম কি হতে
পারে যে এর পরও ইলেক্টোরাল কলেজ ট্রাম্পকেই নির্বাচন করল? তত্ত্বগতভাবে সেটা সম্ভব,
দুরকমভাবে, কারণ আমেরিকার জটিল এবং সেকেলে নির্বাচন পদ্ধতি। এক হতে পারে, ইলেক্টোরাল
কলেজের কিছু নির্বাচক ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করে বাইডেনের প্রাপ্য ভোট ট্রাম্পকে দিলেন। কিন্তু
বাইডেনের যে ব্যবধান, তাতে ট্রাম্পের জিততে এরকম আটত্রিশজন ‘বিশ্বাসহীন নির্বাচক’ দরকার,
যেটা সম্পূর্ণ অলীক ব্যাপার। আর হতে পারে যদি বেশ কয়েকটি রাজ্য, নির্বাচনের ফল নির্ভরযোগ্য
নয় বলে তাদের নিজেদের রাজ্যের ভোটের ফল অগ্রাহ্য করে পছন্দমতো ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধি
বেছে তাদেরকে নির্দেশ দেন ট্রাম্পকে ভোট দিতে। সেটা হওয়া সম্ভব যদি রাজ্যের নিয়ন্ত্রক
আইনসভা আর রাজ্যপাল দুইই রিপাবলিকান দলের হন, তারা দুই পক্ষই এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অনৈতিক
কাজ করতে রাজি থাকেন আর আদালতে বাধা না পান। এরকম একাধিক রাজ্য দরকার ট্রাম্পের জিততে।
এরকম কিছু করলে দেশে-বিদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে যা আগুন নিয়ে খেলার থেকেও অনেক
সাঙ্ঘাতিক। সেইসব রাজনীতিকরাও নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এভাবে জলাঞ্জলি দিতে চাইবেন
না। আদালতে ঘা খেয়ে ট্রাম্প এই রাস্তা নিতে চাইছিলেন, মিশিগানের প্রতিনিধিদের হোয়াইট
হাউসে ডেকে তাদের অনুরোধ করেছেন ভোটের ফল অগ্রাহ্য করে তাঁকে ভোট দিতে। কিন্তু একের
পর এক রাজ্যের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিয়েছেন যে তাদের রাজ্যে নির্বাচনে কোনও বেনিয়ম হয়
নি, তাঁরা আইন অনুযায়ীই চলবেন। ফলে ট্রাম্পের আবার গদিতে বসার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
ট্রাম্প সেকথা মুখে স্বীকার না করলেও সম্প্রতি বাইডেনের প্রশাসনের প্রস্তুতিপর্বে সহযোগিতা
করতে নিজের প্রশাসনকে অনুমতি দিয়েছেন, আর বলেছেন ইলেক্টোরাল কলেজে বাইডেন নির্বাচিত
হলে তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে দেবেন। যদিও এ ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা হয় না, তবু এইটুকু
সহায়তাও অচলাবস্থা দূর করতে সাহায্য করছে, বিশেষতঃ যেখানে কোভিডের মোকাবিলা করতে পরবর্তী
প্রশাসনের পুরোপুরি প্রস্তুত থাকা ভীষণ জরুরি।
হোয়াইট হাউস
থেকে ট্রাম্পের বিদায়টাও ব্যতিক্রমী হতে পারে। সাধারণ সৌজন্য মেনে বাইডেনের অভিষেকে
উপস্থিত থেকে সবার নজর বাইডেনের উপরে পড়ছে দেখে সেটা ট্রাম্পের পক্ষে সহ্য করা মুশকিল।
হয়তো তার আগেই অলিখিতভাবে হোয়াইট হাউস ছেড়ে ফ্লোরিডায় নিজের গলফ কোর্স ‘মার-আ-লাগো’
তে ছুটি কাটাতে গিয়ে ট্রাম্প আর ফিরে আসবেন না।
মানুষের পছন্দ অস্বীকার করার ট্রাম্পের এই চেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয় আর আমেরিকার গণতন্ত্রের পক্ষে সাংঘাতিক ক্ষতিকর হলেও মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এরকম হতে পারে এই পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার নিবন্ধটিতেও উল্লেখ করেছিলাম। প্রথম কারণ ট্রাম্প একজন আত্মমোহিত, দাম্ভিক ও স্বার্থপর মানুষ, যিনি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া দেশ বা অন্য কোনও কিছু নিয়ে ভাবেন না। সঙ্গত পরাজয় স্বীকার করতে যে মানসিকতা লাগে, তা তাঁর বিন্দুমাত্র নেই। সমর্থকদের কাছে বুক ফুলিয়ে ‘আমি জিতেছি' দাবী করতে পারাটাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তবে তা ছাড়াও আরও গভীর কারণ রয়েছে। তার প্রথমটা আর্থিক। ট্রাম্পের ব্যবসায় প্রচুর দেনা, শিগগিরিই অন্ততঃ চল্লিশ কোটি ডলারের একটা বড় কিস্তি তাঁকে মেটাতে হবে পাওনাদারদের কাছে। রাষ্ট্রপতিপদে থাকতে পারলে আরও চার বছর সেটা এড়াতে পারতেন, বা পাওনাদারদের কোনোভাবে সুবিধা দিয়ে তার বিনিময়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করতেন। সেটা যখন হচ্ছে না, তখন একটা রাস্তা হচ্ছে সমর্থকদের কাছ থেকে টাকা তোলা। ভোটের প্রচারের সময় সেটা করা যায়, তবে ভোট মিটে যাবার পর অন্য রাস্তা লাগে। ভোটের ফলের বিরুদ্ধে আদালতে লড়াই করতে হচ্ছে এই অজুহাতে টাকা তোলা হচ্ছে, কিন্তু এখানেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের দল একটা অনৈতিক পদ্ধতি নিচ্ছে। ‘একমাত্র আট হাজার ডলারের উপর দানের চল্লিশ শতাংশ আইনি লড়াইয়ে ব্যয় হবে, বাকি ষাট শতাংশ বা ছোট দানের পুরোটাই যাবে ট্রাম্পের নির্বাচনের ধার মেটাতে বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সাধারণ তহবিলে’ এই শর্তটা শুধু ফাইন প্রিন্টে লেখা, বহু সমর্থক না বুঝেই টাকা দিচ্ছেন। তোলা টাকার কিছুটা অংশ রিপাবলিকান দলের সাধারণ তহবিলে যাবে বলে ওই দলের বেশিরভাগ নেতাই ট্রাম্পের এতসব কুনাট্যে চুপ হয়ে বসে আছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রপতিপদ থেকে সরে গেলেই, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি যেমন আইনি মামলা থেকে রেহাই পান, তা আর পাবেন না। ট্রাম্পের ব্যবসায় নানারকম বেনিয়ম আর কর ফাঁকির অভিযোগে তদন্ত চলছে, এ ছাড়া প্রশাসনিক দুর্নীতিও প্রকাশ পাবার সম্ভাবনা আছে। সেসব ব্যাপারে ফেঁসে গেলে ট্রাম্পের ভালোরকম কারাদন্ডও হতে পারে। ট্রাম্পের সহযোগী অপরাধে অভিযুক্ত একজনকে তিনি ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে মার্জনা করেছেন, শোনা যাচ্ছে ক্ষমতা ছেড়ে দেবার আগে নিজেকেও মার্জনা করে যেতে পারেন। সেটার আইনি ভিত্তি নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে, তবে তিনি যদি আগেরভাগে পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি মাইক পেন্সকে রাষ্ট্রপতিত্ব ছেড়ে দেন, তবে পেন্স তাঁকে আইনসঙ্গতভাবেই মার্জনা করতে পারেন। অবশ্য তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া রিপাবলিকান দলের পক্ষে খারাপ হতে পারে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ থেকে ছাড়া পেলেও রাজ্যের জন্য এই মার্জনা প্রযোজ্য নয়, নিউ ইয়র্কে আনা অভিযোগ এভাবে তিনি এড়াতে পারবেন না। তবে এই কুনাট্য করে ট্রাম্পের একটা বড় সাফল্য হয়েছে --- রিপাবলিকান দলের ভোটারদের একটা বিরাট অংশ মনে করে নির্বাচনের ফলে কারচুপির ফলেই বাইডেন জিতেছেন। এর জন্য কয়েকটি অত্যন্ত দক্ষিণপন্থী ছদ্ম সংবাদমাধ্যমকে বিশেষভাবে দায়ী করা যায়। ট্রাম্প বা রিপাবলিকান সমর্থক মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ’ কারচুপির তত্ত্বে ততটা সমর্থন না দেখানোয় তারা সম্প্রতি ট্রাম্পের চক্ষুশূল হয়েছে, আর তার পর থেকে ট্রাম্পের গোঁড়া সমর্থকদের মধ্যে ওইধরণের ছদ্ম সংবাদমাধ্যমের প্রভাব বেড়ে গেছে। এমনকি তারা এও দেখিয়েছে যে ট্রাম্প চারশোর বেশি ইলেক্টোরাল ভোট জিতে আবার ক্ষমতায় আসছেন। এইসব ভুয়ো সংবাদ অনেক ট্রাম্প সমর্থকই বিশ্বাস করে। এই বিশালসংখ্যক সমর্থকরা বাইডেনের প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করতে পারে, ট্রাম্পের ২০২৪ সালে আবার ভোটে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও খুলে দিতে পারে। সত্যি সত্যি ট্রাম্প অবশ্য ২০২৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না সন্দেহ আছে। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে লড়ে জয় পাওয়া বেশ কঠিন, যদি দেশের অর্থনীতি মোটের উপর ভালো চলে। ভালোরকম জয়ের সম্ভাবনা না বুঝলে ট্রাম্প দাঁড়াবেন না, কারণ আবার পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে সহ্য করা কষ্ট। রিপাবলিকান প্রাইমারিও তাঁকে আবার জিততে হবে। তা ছাড়া চার বছর বাদে ট্রাম্পের বয়স হবে আটাত্তর --- স্থুল চেহারা আর খারাপ খাদ্যাভাসের জন্য তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর সর্বোপরি কারাদন্ড হলে আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও থাকবে না। তবে তিনি আবার লড়বেন কথাটা ভাসিয়ে রাখতে পারলে সমর্থকদের ধরে রাখা, রিপাবলিকান দলে প্রভাব বজায় রাখা ও নির্বাচনী তহবিল থেকে ক্রমাগতঃ টাকা তোলার সুযোগ থাকছে, যেটা ট্রাম্প ছাড়তে চাইবেন না। শেষমেশ হয়তো বড়ছেলে ডনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র বা বড়মেয়ে ইভাংকা ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিতে পারেন। মোট কথা, আগামী চার বছরে ট্রাম্পের কি হয়, সেটা একটা বিরাট কৌতুহলের ব্যাপার হয়ে রইল।
==========
লেখার তারিখঃ নভেম্বর ৩০, ২০২০
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল
লেখাটি "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকার জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।