মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯

রাজপেয়াদার রূপকথা

রাজপেয়াদার রূপকথা
-শুভাশিস ঘোষাল


-একটা রূপকথার গল্প বল না।
-বেশ, তবে শোনো, এক রাজপেয়াদার গল্প।
-যাঃ, রাজপেয়াদার আবার রূপকথা হয় না কি? রূপকথা তো হয়, রাজা, তার সাত রাণী, বীর রাজপুত্র, সুন্দরী রাজকন্যা, পক্ষীরাজ --- এই সবের।
-ঠিকই, তবে এও রাজারই গল্প। এই রাজা বড় সোজা, সুখে থাকে যত প্রজা। এই রাজা নিজেকে রাজপেয়াদা ভাবতে পছন্দ করেন।
-রাজপেয়াদা কেন?
-রাজপেয়াদার কাজটাই আসলে সবচেয়ে কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের সমস্ত সম্পদ দেখভাল করা, কেউ যাতে লুঠ করে না পালাতে পারে দেখা, কত দায়িত্ব। একমাত্র এই রাজাই সে কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই উনি নিজেকে রাজা নয়, রাজপেয়াদা ভাবতেন।
-কিন্তু যা হোক, তিনি তো রাজা। তাই না?
-হ্যাঁ, তবে এই রাজ্যে কোটি কোটি প্রজারাই রাজা ঠিক করে প্রতি পাঁচ বছরে। তাই যারা রাজা হতে চায়, তাদের প্রজাদের কাছে প্রতি পাঁচ বছর বাদে বাদে আবেদন করতে হয়। তখন যে যত নত হতে পারে, প্রজারা তাকেই পছন্দ করে। রাজপেয়াদা হওয়া মানে খুব নত হওয়া, সবার সেবা করা, তাই প্রজারা অনেকে এই রাজাকেই বেশি ভালবাসে। অবশ্য একবার রাজা হয়ে গেলে তখন আর বাধা নেই কিছু। এই রাজার দেশভ্রমণের খুব শখ তো। তাই বছরে তিনশ দিন অন্যান্য দেশ সফরে যেতেন। পোশাকের ব্যাপারেও রাজার খুব দিলদরিয়া মেজাজ ছিল। দশ লাখ টাকার একটা সোনার বর্ম বানিয়েছিলেন, সেটা খুব পরতেন।
-এসব দেখলে লোকে যদি খারাপ ভাবত, যে রাজা অন্য রাজাদের মতই বিলাসিতা করছেন?
-না, তা ভাববে কেন? পাঁচ বছর পরে আবার নির্বাচনের সময় খুলে নিলেই হল। লোকের তো মনে থাকে না অত কথা।
-আচ্ছা, বুঝলাম।
-যা হোক, শোনো। রাজকোষে তো আগে চুরি হচ্ছিল, তাই এই রাজপেয়াদা কথাটা সবার পছন্দ হল। সবাই তাই তাকেই রাজা বানানো ঠিক করল।
-তা তারপর চুরি বন্ধ হয়ে গেল?
-না, ঠিক তা হল না, কিন্তু চোররা বেশ জব্দ হয়েছিল, এই রাজা, থুড়ি রাজপেয়াদার, বুদ্ধিতে।
-কি রকম, কি রকম?
-সে তো দুটো সিঁধেল চোর রাজকোষ থেকে দুটো বড় বড় বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। যতক্ষণে জানা গেল, সে চোররা তো পগার পার। সবাই তখন বললে, এ কেমন হল রাজামশাই? আপনি তো রাজপেয়াদাও বটে।
রাজা বললেন, রোসো। চোরদুটো পালিয়েছে ঠিকই, তবে এইস্যা টাইট দিচ্ছি বাছাধনদের যে চুরির টাকা ওদের ভোগ করতে হবে না আর।
এই বলে তিনি ঘোষণা করে দিলেন, বন্ধুরা (প্রজাদের তিনি এই নামেই সম্বোধন করতেন), আজ থেকে পাঁচশো আর হাজারের সব টাকা বাতিল। এবার চোরদুটো দু বস্তা কাগজ নিয়ে যা পারে করুক। জব্দ বলে জব্দ।
প্রজারা তো মহা খুশি। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর। এবার বোঝ ঠ্যালা।
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই প্রজারা দেখল টাকার অভাবে তারাও জিনিষপত্র কিনতে পারছে না, মজুরিও পাচ্ছে না।
প্রজারা সে কথা রাজাকে জানাতেই তিনি বললেন, দুটো মাস দেখই না। সব ঠিক হয়ে যাবে। যে সব টাকা এর আগে এতদিন ধরে চুরি হয়েছে, সেগুলোও সুড়সুড় করে ফেরত আসবে। সেসব টাকা সব প্রজাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ টাকা এমনিই পেয়ে যাবে। সবাই খুব খুশি।
- এত কোটি লোকের প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ?
-হুঁ, তবেই বোঝো, এই রাজাকে লোকে ভালবাসবে না কেন? রাজা আরও বললেন, আমরা নতুন টাকা যা বানাবো না, একেবারে এডভান্স টেকনোলজি, রেডিওএক্টিভ চিপ বসানো। কালো টাকা মাটির দুহাজার ফুট নিচেও পুঁতে রাখ না কেন, বিপ বিপ সিগ্নাল দিয়ে জানান দেবে। তখন রাজপেয়াদা এসে ক্যাঁক করে ধরবে। সব চুরি চিরকালের মতো বন্ধ হবে।
-আচ্ছা, অতদিন আগে এতসব এডভান্স টেকনোলজি ছিল? আর অত নিচ থেকে সিগ্নাল পাঠাতে পারত?
-ছিল না মানে? যখন ইউরোপে লোকে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাচ্ছে, আর আমেরিকায় তো লোকে যায়ই নি, তখন থেকেই  ওই দেশে পুস্পক রথ কোনও জ্বালানি ছাড়াই আকাশে উড়ছে, হাতির মুন্ডু মানুষের দেহে লাগানো হচ্ছে, টেস্ট টিউবে একসাথে একশ ছেলে জন্ম নিচ্ছে, আর সামান্য রেডিওএক্টিভ চিপ আর কি ব্যাপার?
-ও আচ্ছা! তাহলে প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ পেয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশি হল?
-না, মানে টাকা তো অত চট করে হাতে আসে না। সবাই ধৈর্য ধরেই ছিল। কিন্তু কাজ চালানোর মতো টাকা হাতে না পেয়ে লোকে একটু উশখুশ করতে লাগল। রাজা, মানে রাজপেয়াদার কানে সে কথা যেতেই তিনি বললেন, আরে রাজপেয়াদার কাজ কি এতই সোজা? দেখছ না, সীমান্তে কত হামলা হচ্ছে, এই সামান্য দুয়েকমাসের অসুবিধা নিয়ে অত ভাবছ কেন? টাকা এখন হাতে কম আছে যখন, তোমরা বরং মাংস খাওয়া ছেড়ে দাও। তাতে তো বেশ টাকা বাঁচে। নেহাত যদি খেতে হয়, মুরগি বা  ছাগল-ভেড়া খেও, গরু-টরু কদাপি নয়।
অনেকেই ভাবল, ঠিক কথা। মাংস না খেলেই তো হয়। আর গরু তো কিছুতেই নয়।
এদিকে হল কি, দেখা গেল চোরদুটো মোটেও কাগজের টাকা নিয়ে পালায় নি, সোনার মুদ্রা নিয়ে গেছে চালাকি করে। ভিতরের খবর ছিল বোধ হয় ওদের কাছে। উত্তরকুরু দেশে বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে, আরাম করছে। দেশে ফেরার নামও নেই।
-তবে কি হবে? কাগজের টাকা বাতিল করাটা তাহলে একেবারে মিথ্যে মিথ্যে হল?
-না তা কেন? চোরেদের অন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। হিমালয় থেকে মহা সাধু বাবা রামলক্ষণভরতশত্রুঘ্ন কে স্মরণ করা হল। বাবার এই একহাত দাড়ি, সমস্ত মন্ত্র তন্ত্র তাঁর নখদর্পণে। তিনি এসে যেই অভিশাপ ঝাড়লেন, অমনি শয়তান চোরদুটো ...
-কি, একেবারে দেশে আছড়ে পড়ল?
-না, শয়তানদুটোর সারা গা উটপাখির চামড়ায় ঢেকে গেল। সাধুর অভিশাপ বলে কথা। এমনকি মুখ বন্ধ হয়ে গেল এমন যে একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করতে পারল না। এবার সোনার টাকাই থাক আর রুপোর, কোন কাজে লাগবে তোদের? সব প্রজা চোরেদের শাস্তিতে খুব খুশি।
-বাঃ, তাহলে আবার রাজ্যে সুখশান্তি ফিরে এলো?
-হ্যাঁ, তবে আবার নির্বাচনের সময় চলে এল। পাঁচ বছর হয়ে গেছে তো ইতি মধ্যে।
-তাহলে? লোকে যে তখনও দশ-বিশ লাখ পায় নি। তারা আবার রাজাকে, মানে রাজপেয়াদাকে, আবার নির্বাচন করল?
-মানে সেটা ঠিক আমি জানতে পারিনি এখনও। নির্বাচনে তো আরও অনেকে রাজা হতে চাইছিল। তাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য একজনের নাম ছিল নেড়া।
-নেড়ার কি মাথা নেড়া?
-না তা ঠিক নয়, নেড়ার মুখে সব সময় একটা বোকাবোকা হাসি লেগে থাকত, অনেকটা সুকুমার রায়ের হজবরল-র নেড়ার মতো। তাই ওরকম নাম।
নেড়া বলেছিল, আমি প্রতি মাসে সবাইকে ছ হাজার করে দেব। রাজপেয়াদা আবার থোক টাকা দেবে দশ বিশ লাখ। সে এক জটিল অঙ্ক। লোকে তো সহজে মীমাংসা করতে পারে নি কে বেশি টাকা দেবে। তাই বহুদিন ধরে চলছিল নির্বাচন। আমার আর অত ধৈর্য থাকে নি ফলাফল জানার, তাই আর জানতে পারি নি।
-ধুর, এ কেমন গল্প? শেষটাই তো জানা হল না।


------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, এপ্রিল ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন