রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

নরকের নবজাত মেঘ




নরকের নবজাত মেঘ
- শুভাশিস ঘোষাল
এক ।।
সুধীর বটব্যাল বেশ নামজাদা প্রোমোটার। এ অঞ্চলের প্রচুর ফ্ল্যাটবাড়ি তারই তোলা। খুব ছোট অবস্থা থেকে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছেন। সুধীরবাবুর ছিল জহুরীর চোখ। কোন বাড়ির লোকের পুরোনো ভিটে বেচে দেবার কত আগ্রহ, কততে ছাড়বে, কিভাবে জমির মালিককে বশ করা যাবে, কোন ফ্ল্যাটের কেমন চাহিদা হবে, কি ডিজাইন বাজারে খাবে - এসব হিসেবে তার ভুলচুক হয় না। আর মোটের উপর সৎ ভাবেই ব্যবসা চালিয়েছেন। সিমেন্ট, চিপ, রড, মার্বেল যাই হোক, মাল খারাপ দেন নি কখনও। ফ্ল্যাট যখন দেবেন বলেছেন, মোটামুটি কথা রেখেছেন। দাম কিছুটা বেশি চাইলেও লোকে চোখ বুঁজে ভরসা করতে পারত যে সুধীর বটব্যালের কাছে টাকা মার যাবে না। আরও তো কত প্রোমোটার লোকে দেখল। সস্তায় ফ্ল্যাট করে দেবে বলে টাকা নিয়ে আজ নয় কাল নয় করে ঘোরায় ডেলিভারির সময়, বছর গড়াতে না গড়াতেই এটা ওটা কাজ করে না, রং চটে যায়, দেওয়ালে ড্যাম্প। নাঃ, লোকে তাই সুধীরবাবুর উপরই ভরসা করে। তবে ইদানিং বয়স হয়েছে, শরীরটাও বেশ খারাপ। হার্টে দু দুটো অ্যাটাক হয়ে গেছে। পেসমেকার বসানো। ধকল তো জীবনে কম যায় নি। টানা দশ-বারো ঘন্টা করে রোদ-জল-ঝড়ে কাজ করেছেন বহুবছর। আর এ ব্যবসাই এমন যে টেনশন থাকবেই। জমি পাওয়া যাবে কি না, বাজারে ফ্ল্যাটের চাহিদা কেমন দাঁড়াবে, লোনের ব্যবস্থা কি হবে, কাউন্সিলর-এম এল এ-মন্ত্রী-মিউনিসিপাল অফিসার-থানার দারোগা ---- এদের হাত করে তো আছেই, সব থেকে বড় টেনশনের ব্যাপার হল মস্তানগুলোর সাথে ডিল করা। টাকাপয়সা ওদের দিতে সুধীরবাবু আপত্তি করেন নি তেমন, যখন চাহিদাটা ওরা মোটামুটি সম্ভবের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু ইদানিং ওদের বাড়াবাড়িটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাজনৈতিক মদত পাচ্ছে বেশি করে। সুধীরবাবু তো আর পাঁচটা প্রমোটারের মতো রদ্দি মাল দিয়ে বাড়ি বানিয়ে নাম খারাপ করতে পারবেন না --- ওকে ফ্ল্যাটের দাম বাড়াতে হবে। তবে তারও তো একটা মাত্রা আছে। খুব অসম্ভব বেশি দাম চাইলে খদ্দের কিনবে কেমন করে?
হার্ট অ্যাটাকগুলো হবার পরে ডাক্তারের কড়া নিষেধ। তাই বাধ্য হয়েই নিজে তৈরির সময় তদারকি ছাড়তে হয়েছে। ভাইপো মনোহরই ইদানিং কন্সট্রাকসনের দিকটা দেখে। ভাইপোকে অবশ্য তেমনভাবে ভরসা করা যায় না, তার ছ্যাঁচড়ামির কিছু কিছু পরিচয় সুধীরবাবু সময়ে সময়ে পেয়েছেন। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কি? সুধীরবাবু নিঃসন্তান, গত কয়েকবছর ধরে বিপত্নীকও বটেন। আক্ষেপ হয় বড়, এত কষ্ট করে ব্যবসাটা গড়ে তুললেন, একটা উপযুক্ত সন্তান যদি থাকত, তো তাকে তালিম দিয়ে তৈরি করতেন। একটা বেসিক সততা ছাড়া কোনও ব্যবসা টেঁকে না। মনোহরের সেই বেসিক সততাটাই নেই। শুধু লম্বা-চওড়া ভাষণ দিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তবে সুধীরবাবু মনোহরকে শুধু কনস্ট্রাকশন তদারকির কাজেই রেখেছেন। সেখানে তার অনেকদিনের বিশ্বস্ত মিস্তিরিরা আছে, মনোহর যা খুশি করতে পারবে না। মাল সাপ্লাইয়ের দিকটা এখনও সুধীরবাবু নিজে দেখেন। ফলে নিচুমানের জিনিস কিনে সেখান থেকে লাভ করার সুযোগটা এখনও মনোহরের আয়ত্তের বাইরে।
লোটন মস্তানটা ইদানিং খুব জ্বালাচ্ছে। প্রথম প্রথম ওর পেটোয়া সাপ্লায়ারের কাছ থেকে মাল কেনার জন্য জোরাজুরি করত। নরহরি প্রামাণিক --- সুধীরবাবু জানেন তাকে। সিমেন্টে মাটি মেশায় --- চুন, সুড়কি, রড --- সব খারাপ মানের দেয়। রেট সামান্য কম করে, লোটন তাই সুধীরবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওই মাল কিনলে আর দেখতে হবে না! সুধীরবাবু তাই সটান না বলে দিয়েছিলেন। লোটন শাসিয়েছিল, "জলে বাস করে কি কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা ভাল, কাকু? এ তল্লাটের সমস্ত প্রোমোটার আমার কথামতই মাল কেনে। দেখি আপনি কদিন ব্যবসা চালাতে পারেন।"
হুমকির কথা শুনে মনোহর বলেছিল, "কাকা, আমি থাকতে লোটন মস্তান তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। তবে সীতেশ সোমও কিন্তু ভাল রেট দেয়। দেখতে পারো ওর কাছ থেকে নিয়ে। বলাই মন্ডলের কাছ থেকে তো কতদিন ধরেই নিচ্ছ। ও তোমাকে হাতের পাঁচ ভেবেছে। দাম বেশি নিচ্ছে লোকটা।"
সুধীরবাবু মনোহরের কথায় পাত্তা দেন নি। সীতেশ সোমের জিনিস কেমন তিনি জানেন। নরহরির থেকে সামান্য ভাল। ও দিয়ে কাজ হবে না। মনোহরটা কমিশন খাওয়ার তাল করছে নির্ঘাত।
দুই ।।
মিউনিসিপালিটির একটা বড় প্রজেক্ট আছে। মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হবে। দশ কোটির মত টেন্ডার ভ্যালু হবে, সুধীরবাবু হিসেব করে দেখেছেন। এক কোটির কাছাকাছি লাভের সম্ভাবনা আছে, প্রজেক্টটা যদি পাওয়া যায়। এতবড় কাজে অবশ্য সুধীরবাবু হাত দেননি আগে। শুধু লাভের ব্যাপার নয়, চ্যালেঞ্জটা নেবার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। ফ্ল্যাটবাড়ি তো অনেক বানিয়েছেন --- এবার নতুন কিছু করলে হয়। কম্পিটিশন অবশ্য থাকবে ভালই টেন্ডারের জন্য। স্থানীয় প্রোমোটাররা মনে হয় না আর কেউ এত বড় প্রজেক্টে হাত দিতে সাহস করবে। আর এলাকায় ওদের তেমন সুনামও নেই। বড় কন্সট্রাকশন কোম্পানি কিছু টেন্ডার জমা দেবে নিশ্চয়ই, তবে ওদের ওভারহেড বেশি। বারো কোটির কমে বিড দেওয়া ওদের পক্ষে মুশকিল। সুতরাং ভাল চান্স আছে। তবে শরীরটা তো ভাল নেই। এত বড় কাজ নিজে তদারক করতে পারবেন না। মনোহরের ভরসায় এগোনো টা কি ঠিক হবে? সাতপাঁচ ভাবছিলেন সুধীরবাবু। মনোহরই কথাটা তুলল।
-কাকা, দেখেছ মিউনিসিপালিটির প্রজেক্টটা? বিড দিই আমরা? কাজ পেলে ভাল প্রফিট।
সুধীরবাবু দোনামনা করলেন।
-আমার শরীরটা তো ভাল যাচ্ছে না। অত ধকল নিতে পারব না।
-সে তুমি চিন্তা কোরো না কাকা। আমি আছি তো।
-তুই পুরোটা করতে পারবি? অনেক বড় কাজ কিন্তু।
-কাকা, তুমি কি ভাব বল তো? আমি নামাতে পারব না? টেন্ডারটা পাওয়াটাই আসল। মিউনিসিপালিটিতে লোক ফিট করছি।
অনিচ্ছাসত্বেও সুধীরবাবু সম্মতি দিলেন। কাজটা না পাক, টেন্ডার প্রসেসটা অন্ততঃ শিখতে পারবে মনোহর।
- দশ-সাড়ে দশের টেন্ডার দিস। এর খুব বেশি রেট দিলে কন্ট্রাক্ট পাবি না।
-আর একটু না বাড়ালে প্রফিট থাকবে না কাকা।
-আমাদের ছোট কোম্পানি। অন্ততঃ পাঁচ-দশ পার্সেন্ট কম রেট না থাকলে আমাদের দেবে না। বড় কোম্পানিগুলো এক্সপিরিয়েন্সে প্রেফারেন্স পাবে। দশেও আমাদের মডেস্ট প্রফিট থাকবে কাজটা ঠিক করে করলে। মাল খারাপ দিলে কিন্তু ইন্সপেকশনে আটকে যাবে। হেভি পেনাল্টি দিতে হবে।
-কাকা, তুমি মডেস্টিতেই আটকে রইলে। রেট সেফলি আরও দুই বাড়ানো যাবে। আমি ভিতরের খবর সব পেয়ে যাব। আর লোক ফিট করব, বিডে হেল্প করবে।
-তুই রহমত সাহেবকে চিনিস না। খুব কড়া টাইপের লোক। বেনিয়ম কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়লে ব্যান করে দেব।
-ওঃ কাকা, তুমি বৃথাই চিন্তা করছ। বেনিয়ম কিছু হবে না, শুধু ভিতরের খবরটা বের করে নেব।
যাক গে, মনোহর যা করে করুক। সুধীরবাবুর যখন আর আগ্রহ নেই, আর মাথা ঘামাতে যাবেন না। বরঞ্চ কো-অপারেটিভ হাউসিংএর সেই প্রজেক্টটা, যা ওর অনেকদিনের স্বপ্ন, তাতেই মন দেবেন। উদবাস্তু কলোনিতে বড় খাপছাড়াভাবে বিসদৃশভাবে ঘরগুলো উঠেছে। ঘিঞ্জি জায়গা, নোংরা গলিঘুঁজি, বাড়িগুলো ভাঙ্গাচোরা, করুণ অবস্থা। সবই একতলা, কোনোটা টালির চাল, কোনোটা টিনের, কোথাও দরমার বেড়া। তবে অনেকটা জমি জুড়ে কলোনি। যুদ্ধ আর দেশভাগের পরে যখন নিরাশ্রয় মানুষগুলো এখানে চলে আসে, ফাঁকা জায়গা পেয়ে ঝোপঝাড় কেটে যে যেমন পারে বসতি বানিয়েছিল। হাতে কারুরই টাকা ছিল না, আর পরিকল্পনার কোনো বালাই ছিল না --- তার ফলশ্রুতি শ্রীহীন বাড়িগুলো। কালে কালে, অনেক ভোট পার হবার পর, বাসিন্দারা পাট্টা পেয়েছে স্থায়ী বসবাসের। তবে পরিবেশ খারাপ বলে যারা একটু পয়সা করতে পারে, বাস অন্য জায়গায় উঠিয়ে নিয়ে যায়। যারা পারে না, পড়ে থাকে। রাস্তার কলের দখল নিয়ে ঝগড়া করতে করতে আরো তিরিক্ষি হয়।
সুধীরবাবু দেখেছেন হিসেব করে, ওরা যদি কো-অপারেটিভ করে বানিয়ে চারতলার বড় বিল্ডিংএ উঠে যায়, তবে অনেকটা জমি উদবৃত্ত হবে। সবাইকে এটাচড বাথ সহ ছিমছাম দুকামরার ফ্ল্যাট দিয়ে, আর হাউসিংএর সামনে বাগান করেও বাকি জমি যা থাকবে, তার বাজার দাম অন্ততঃ কুড়ি কোটি হবে। সেই জমিটা বিক্রি করে দিলে ওই টাকাতে সবার বাড়ি হয়ে যাবে আরামসে, তাও পরেও সবার হাতে কিছু থোক টাকা থাকবে। ওরা রাজি থাকলে সুধীরবাবু এই প্রজেক্টটা করে দেখতে চান। নিজের প্রফিটের জন্য নয় --- সেটা তেমন কিছু আসবে না, বরঞ্চ নিজেকেই টাকা ঢালতে হবে আগে। আসলে সুধীরবাবু নিজেও উদবাস্তু পরিবারে জন্মেছেন, ভাঙ্গা টালির ঘরে বড় হয়েছেন। টাকা রোজগার তো জীবনে হয়েছে অনেক। ওদের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগবে।
তবে সমস্যাও কম নয়। এক তো এতগুলো টাকার ঝুঁকি, তার থেকে বড় কথা, এতগুলো পরিবারকে বুঝিয়ে রাজি করানো। এতখানি জমির উপর অনেকেরই নজর আছে। এই অঞ্চলে জমির দাম যে হারে বেড়ে গেছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আর কলোনিটার জমি স্টেশনের রাস্তার লাগোয়া বলে কমার্শিয়াল ডেভেলপমেন্ট হতে পারে। সুধীরবাবু ওদের খুবই পরিচিত লোক, তবে প্রোমোটার বাড়ি ভেঙ্গে তৈরির প্রস্তাব দিলে লোকে সন্দেহের চোখে দেখে। শুরুতে তাইই হয়েছিল। তবে সুধীরবাবু হাল ছাড়েন নি। একটু একটু করে লোককে বুঝিয়েছেন, পাড়ায় বহু মিটিং করেছেন। আস্তে আস্তে ওরা অন্য প্রোমোটারদের দেওয়া প্রস্তাবের থেকে সুধীরবাবুর প্রস্তাব যে আলাদারকম, বুঝতে শুরু করেছে। কারুর কথায় ভরসা করতে পারাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুধীরবাবু যে আজেবাজে কিছু গছিয়ে দেবেন না, তা ওরা বোঝে। তবু এতগুলো পরিবাবের ব্যাপার, পুরো দু বছর লেগে গেল সবার সম্মতি পেতে।
তা হোক, এসব ব্যাপারে ধৈর্য লাগে। এবার সইসাবুদগুলো করে ফেলতে হবে। মিউনিসিপালিটিতে গিয়ে প্রজেক্টটার ব্যাপারে একটু কথাও বলে রাখা দরকার, যাতে প্ল্যানটা তাড়াতাড়ি স্যাংশন হয়।
শীতলামন্দিরটা পেরিয়ে মিউনিসিপালিটির দিকে ঘুরতে লোটনের মুখোমুখি পড়লেন। "কাকু, একটু কথা ছিল, সঞ্জয়দার অফিসে আসবেন একবার?"
সঞ্জয় ধর প্রকৃতপক্ষে জমির দালাল। বস্তিবাড়ি বা অন্যান্য যে সব জমি একলপ্তে পাবার সম্ভাবনা আছে, সঞ্জয় সেসব জমিই হাতাতে চেষ্টা করে। লোটন, কাঁচা, চশমা --- এলাকার এসব মস্তানদের সঞ্জয় কাজে নামায়। জোরজার করে কমদামে জমি হাতায়। পুরোটাই পলিটিকাল কানেকশনের জোরে করে। অন্যান্য প্রোমোটাররা অনেকেই সঞ্জয়ের কাছ থেকে জমি নিয়ে বাড়ি বানায়। তবে সুধীরবাবুর সঞ্জয়ের জমির দরকার পড়ে নি কখনও। সরাসরি মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন। সঞ্জয়-লোটনদের তাই সুধীরবাবুর উপর রাগ সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সঞ্জয়ের অফিসটা সামনেই, তাই সুধীরবাবু না বললেন না। দেখাই যাক না ওরা কি বলে।
ঢুকতেই সঞ্জয় বলল, "আসুন দাদা, আসুন। কি খাবেন বলুন, গরম না ঠান্ডা?"
সুধীরবাবু বললেন, "ও সব কিছু লাগবে না। তুমি কি বলবে বল।"
সঞ্জয়ের একটা গুণ, বিশেষ ভণিতা করে না। বলল, "দাদা, ওই কলোনির জমিতে কো-অপারেটিভের বাড়ি বানিয়ে, ওদের সবাইকে ফ্ল্যাট দিয়ে কতটুকু প্রফিট থাকবে আপনার? এতো সমাজসেবা হয়ে যাচ্ছে। আপনি-আমি ব্যবসাদার, লাভের ব্যাপারটা তো আগে দেখব আমরা, তাই না?"
সঞ্জয় একটু থামল। সুধীরবাবু দেখলেন, সঞ্জয় তাকে আর নিজেকে এক শ্রেণীভুক্ত করতে উদ্গ্রীব।
সঞ্জয় বলতে থাকে, "আপনাকে অবশ্য অযাচিতভাবে এসব কথা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই আপনার ইচ্ছেমত প্রজেক্ট করবেন। তবে আপনি হলেন আমার দাদার মতো, আপনাকে দেখেই ব্যবসা করতে ভরসা পেয়েছি। না হলে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি, আর সবার মত একটা চাকরি জোটানোর চেষ্টা করতাম। কলোনির লোকেরা তো এতদিন জমি বেচতেই চাইছিল না। আপনি যে কি ম্যাজিক জানেন দাদা, ওদের কি করে রাজি করালেন ভাবছি। আমার কাছে শাসালো পার্টি আছে, ভালো দাম দেবে। আপনি কমিশন পাবেন যা, ও প্রজেক্টে আপনি যা প্রফিট করতে পারবেন, তার থেকে বেশি। এ ছাড়া মিউনিসিপালিটির মার্কেট কমপ্লেক্সের জন্য তো টেন্ডার দিচ্ছেন? সে ব্যাপারেও আমার পুরো মদত পাবেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদে উপর লেভেলে কানেকশন ভালই আছে দাদা, সেটা তো মানবেন?"
সুধীরবাবু একটু মনে মনে হাসেন, কথাটা ভুল বলে নি সঞ্জয়। দালালিও একটা ব্যবসা। বলতে গেলে সব থেকে সর্বব্যপী ব্যবসা। তবে সে ব্যবসা সুধীরবাবুর জন্য নয়, তিনি কিছু তৈরি করতে ভালবাসেন। তবে টেন্ডার দেবার প্ল্যানটা সঞ্জয়ের কানে এসেছে কোনোভাবে। নির্ঘাত মনোহরই বেফাঁস বলেছে কিছু কখনও।
-খবর তো সবই রাখ। তবে এটা তো বোঝো যে কলোনির লোকেরা জমি ছাড়তে রাজি হয়েছে একটা বিশেষ কারণে, আমার মুখের কথার জন্য নয়। যে কাজের জন্য জমি দেবে ওরা, সে কাজ না হলে ওরা দেবে কেন? আর জমি বিক্রির মধ্যস্ততা করাটা আমার পেশা নয়, তোমরা তো আছ তার জন্য।
দালালি কথাটা শুনতে খারাপ লাগে, তাই সুধীরবাবু মধ্যস্ততা কথাটা ব্যবহার করলেন।
-দাদা, ওরা জমি বেচতে একবার রাজি যখন হয়েছিল, চাপ দেওয়া যেত। পুরো জমিটা পেলে ভাল প্যাকেজ দিতাম, সে টাকা নিয়ে অন্য কোথাও ফ্ল্যাট কিনে নিতে পারত। বান্ধবনগরের দিকটা এখনও শস্তা আছে। ওখানে লাখ-পাঁচেক বাজেটে ছোট ফ্ল্যাট হয়ে যেত।
-না সঞ্জয়, ওরা যদি তোমার প্রস্তাবে রাজি হয় তো হবে, আমার বলার কি আছে। তবে এরকম কোনো প্রস্তাব আমি দিতে পারব না। আমি আমার প্রজেক্ট করার চেষ্টা করব, তুমি তোমারটা করার চেষ্টা কোরো।
সুধীরবাবু বেরিয়ে আসেন সঞ্জয়ের ওখান থেকে। মিউনিসিপালিটিতে সরকারবাবুর সাথে দেখাটা সেরা ফেলাটা প্রয়োজন।
তিন ।।
মনোহরের বন্ধু অমিতই প্ল্যানটা জুগিয়েছিল মনোহরকে। টেন্ডার সাবমিট করবে শুনে বলেছিল, "ও সব বড় প্রজেক্টের ঝঞ্ঝাটে যাবি কেন রে মনো? তোর কাকা যা ব্যবস্থা করেছে, টাকা তোর নিজের পকেটে ঢোকানোও মুশকিল। পয়সা কামানো নিয়ে কথা। তার জন্য অনেক সিধে রাস্তা আছে। কেজরিওয়ালের কোম্পানি টেন্ডার দেবে। তুই যদি তোর বিডটাকে ওদের থেকে বাড়িয়ে ওদের কথামতো দেখাস, ওরা তোকে হাশ মানি দেবে।"
কথাটা মনোহরের পছন্দ হয়। কাকার লাইনে উন্নতি করা শক্ত। বিশেষ করে মাল সাপ্লাইয়ের কন্ট্রোলটা না পেলে পয়সাটা সে বানাবে কি করে?
অমিত কেজরিওয়ালের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। ওর বাবা কেজরিওয়ালের কোম্পানিতে কাজ করে। ওরা বারো কোটির বিড দিত। মনোহর এগারো কোটির বিড দেবে ভেবেছিল। কেজরিওয়াল প্রস্তাব দিল, মনোহর ওর বিডটাকে তেরো করে দিক, কেজরিওয়াল তাহলে সাড়ে বারো দিয়েও পেয়ে যাবে কন্ট্র্যাক্ট। অন্য আর একটা বিড দেবে কেজরিওয়ালের একটা বেনামি ভুয়ো কোম্পানি। তিনটে টেন্ডার পড়লেই বিড আর ক্যান্সেল হবে না।
সেই মতই কাজ হয়। কেজরিওয়ালের কোম্পানি কন্ট্র্যাক্টটা পায়।
মনোহর পাঁচ লাখ পায়, অমিতও পায় কমিশন।
কাঁচা টাকা পেয়ে মনোহরের বেশ ফুরফুরে মেজাজ হয়। বন্ধুদের নিয়ে সে মদের আসর বসায়। একুশ বছরের এজড সিংগ্ল মল্ট হুইস্কি আনায় কলকাতা থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে। অমিত, অমিতের ভাই অনিল আর ওদের আর এক তুতো ভাই অরুণ এসে জোটে। অমিত করে দালালি, অনিল কি একটা ছোটখাটো দু'নম্বরি ব্যবসা করে। তবে সবথেকে রহস্যজনক হল অরুণ। সে যে কি করে, কখনও ভেঙ্গে বলে নি। তবে সেটা বোধ হয় কিছু হিসেব সংক্রান্ত। সকলে মিলে মনোহরকে প্রচুর তোল্লাই দেয়। স্তাবকতায় খুব খুশি হয়ে কল্পতরু হয়ে যায় মনোহর। দু হাতে টাকা ওড়ায়।
অনিলই জুয়াতে হাতেখড়ি করায় মনোহরের। ব্ল্যাকজ্যাক, তিনপাত্তি। সবেরই ঠেক আছে। ঘাঁতঘোঁতগুলো সব অনিলের জানা। প্রথম প্রথম অল্প স্টেকে খেলে মনোহর। বেশ কিছু জেতে, স্টেকও বাড়ায়। তারপর হারা শুরু হয়। মাঝে মধ্যে জিতলেও বেশিরভাগ সময়েই হারে। কিন্তু তাতে আরও রোখ চেপে যায়। পড়ে পাওয়া টাকায় টান পড়ে। তবু মনোহরের স্থির বিশ্বাস, সে খুব ভাল খেলে। আর খানিকটা টাকা ঢেলে খেলতে পারলে সে হারা টাকাগুলো উদ্ধার করতে পারবে।
সুধীরবাবু মনোহরকে বাঁধা টাকা মাসোহারা দেন। সে টাকা টুকটাক সাধ আহ্লাদ মেটানোর জন্য যথেষ্টর থেকে অনেক বেশি হলেও জুয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। টাকাপয়সার উপর সুধীরবাবুর তীক্ষ্ণ নজর। কিছু সরাতে গেলে ধরা পড়ার সমুহ সম্ভাবনা।
শুনে অরুণ বলে টাকাটা জোগাড় করা সমস্যা হবে না। “আরে, তোর কাকার অত সম্পত্তি, তোকে যে কোনও মহাজন সেধে টাকা ধার দেবে। আমার চেনা লোক আছে, কম সুদে টাকা পাইয়ে দেব।“
মাসিক দশ শতাংশ কড়ারে মনোহর অরুণের চেনা মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেয়। জুয়াতে তবু ভাগ্য ফেরে না। ধারের পরিমান বাড়তে থাকে। সুদের কিসব জটিল হিসেব, মনোহর কোনোমতে মাধ্যমিক উতরে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল --- ওর মাথায় সেসব জটিল অঙ্ক ঢোকে না। যখন ধার নিয়েছিল, হিসেব যে এত জটিল হয়, বোঝে নি। অরুণ বলে চিন্তা নেই, আমি হিসেব দেখছি। অরুণের কথা মত টাকা দেয় প্রতি মাসে। অঙ্কটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে, আসলও বেড়ে যাচ্ছে খালি।
সুধীরবাবু একবার মনোহরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন টেন্ডারের ব্যাপারে। মনোহর মিথ্যে করে বলেছিল, সে এগারোর টেন্ডার দিয়েছিল, কিন্তু কেজরিওয়াল সাড়ে দশের বিড দিয়ে কন্ট্র্যাক্ট পেয়ে যায়। সুধীরবাবু একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন, কেজরিওয়াল অত কমের বিড দিয়েছে শুনে।
যা হোক, ভালই হয়েছে মনোহর কন্ট্র্যাক্ট না পেয়ে, সুধীরবাবু ভাবলেন। শেষে কাজটা হাতে পেয়ে ডোবাতো হয়তো।
তবু মিউনিসিপালিটিতে গিয়ে যখন রহমত সাহেবের সাথে দেখা হল, একবার না জিজ্ঞাসা করে পারেন নি।
-স্যার, আমরা কন্ট্র্যাক্টটা পেলাম না! কেজরিওয়াল ওর থেকে কমে দিতে পারল?
রহমত সাহেব বললেন, "কি করে পাবেন বলুন তো সুধীরবাবু? আপনারা কোন আক্কেলে তের কোটির বিড দিলেন? অত মার্জিন রাখতে চাইলে কন্ট্র্যাক্ট পাওয়া যায় কখনও?"
তেরো কোটি! মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল সুধীরবাবুর। মনোহর তাহলে তাকে মিথ্যে বলেছে।
বাড়ি ফিরে মনোহরের উপর বকাঝকা করলেন খানিক। মনোহর বলল, "সত্যি বললে তো তুমি রাগ করতে, তাই বলি নি। তেরোর কমে পোষাতে পারতাম না। বেকার লস খেয়ে গেলে মুশকিল হত। না হয়ে ভালই হয়েছে।"
চার ।।
মনোহরের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফুর্তির টাকা তো দূরের কথা, কিস্তির টাকাও আর যোগাতে পারছে না। কাকার কাছে কিছু পেলে সমস্যা আর থাকত না। সে এখন বুঝে গেছে, জুয়া খেলে আর ভাগ্য ফেরাতে পারবে না। ধারের টাকাটা শোধ করে দিলেই সে আর জুয়াটুয়ার ধার মাড়াতো না। কিন্তু কাকার কাছে কিসের নাম করে টাকা চাইবে ভেবে পায় না। তারপর কাকার যদি সন্দেহ হয়, বা পাড়ায় কানাঘুষোয় কিছু জানতে পারে, তাহলে আর দেখতে হবে না। মনোহর খুব মনমরা হয়ে থাকে।
রাস্তায় হঠাৎ লোটনের মুখোমুখি হয় সেদিন। সঙ্গে কাঁচা আর চশমা। তিনজনে মিলে মাল টানছিল সন্ধেবেলায়, চড়কতলায় বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার তলায় বাঁধানো বেদীতে বসে। জায়গাটা খানিকটা অন্ধকার আর নির্জন। আর লোটনদের এড়াতেই আরো বেশি করে লোকজন ওইখানদিয়ে খুব একটা যাতায়াত করে না, মেয়েরা তো নয়ই।
লোটনই ডাকে তাকে, “এই মনো, শালা শোন এদিকে।“ তিনজনেরই চোখ লাল, মুখ দিয়ে ভক ভক করে বাংলুর গন্ধ উঠে আসছে। মনোহর এই কয়েকমাসে দামি দামি হুইস্কি খেয়ে একটা রুচি গড়ে তুলেছে, বাংলুর গন্ধটা তার অসহ্য মনে হয়।
-তোর কাকাটা কিন্তু বহুত হারামিগিরি করছে। লোকজনকে ঢপ ঢাপ খাইয়ে কলোনির জমিটা হাতাতে চাইছে। সবাইকে নাকি ফ্ল্যাট করে দেবে। তোর কাকা কি দানছত্র খুলে বসল না কি? হরসোবর্ধন? শালা সঞ্জয়দা অত ভাল প্যাকেজ দিচ্ছে, তবু মালগুলো তোর কাকার ঢপ খেয়ে গেল। কিছুতেই কোনও কথা শোনে না আর। দুই একটা পেটো ফেটো মেরে দিলে বা আগুন লাগিয়ে দিলেই সুড়সুড় করে কাজ হয়ে যেত, কিন্তু সঞ্জয়দা আবার শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই তোকে বলছি, কাকাকে বুঝিয়ে ঠিক পথে ফিরিয়ে আন। নইলে কিন্তু ওর ভুড়ি ফাঁসিয়ে দেবো। শালার উপর আমার বহুত খার আছে। আমি বারণ করা সত্বেও বিল্ডিং এর মাল কিনছে শালা সব বলাইয়ের কাছ থেকে, নরহরির কাছ থেকে না নিয়ে। আর কাকাকে আটকাতে না পারলে তুইও পার পাবি না। পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।
মনোহর বিনা বাক্যব্যয়ে সরে আসে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। লোটনদের সাথে গায়ের জোরে তার পেরে ওঠার কোনও প্রশ্ন নেই, আর তা ছাড়া ওদের কাছে হাতিয়ারও থাকে। কাকা মনোহরের কথায় কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা ছেড়ে দেবে, সেটা সম্পূর্ণ অলীক ব্যাপার। লোটন যে শুধু মুখে হুমকি দেয় নি, সেটা মনোহর ওর চোখে ঘৃণা দেখেই বুঝেছে। লোটন আগেও এক আধটা খুনের কেসে জড়িয়েছিল, সঞ্জয় ধর ওর কানেকশন ধরে ছাড়িয়ে এনেছে। তাহলে কি পুলিশকে খবর দিয়ে বাড়িতে পাহারাদার বসাবে? কিন্তু থানায় সঞ্জয় ধরের জোর অনেক, মনোহরের মুখের কথায় ওরা সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেবে না। লোটন যে সঞ্জয়ের কাজ করে, তা সবাই জানে। উলটে বরঞ্চ মনোহরের নামেই জুয়াটুয়ার কোনও কেস খাইয়ে দেবে। পুলিশ তো সবই খোঁজ রাখে।
বাড়িতে অবশ্য পাহারা বসানো বাড়ানো যায়। অনেক বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সি এখন বাড়ির নিরাপত্তার ভার নেয়। এখন একটা বুড়ো দারোয়ান আছে বটে, অনেকদিনের পুরোনো লোক, তবে সে আজকাল রাতের বেলায় ভাল দেখে না, বন্দুক টন্দুক চালানোর তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু কাকাকে কো-অপারেটিভ প্রজেক্ট থেকে আটকাতে না পারলে লোটনরা তাকেও যে পেটাতে ছাড়বে না, সেটা মনোহর ভালই বুঝতে পারে।
কি করবে সাত পাঁচ ভাবছিল মনোহর। কথাটা হঠাৎ বিদ্যুৎঝলকের মতো তার মাথায় খেলে।
ভেবে দেখলে সঞ্জয়-লোটনদের সঙ্গে তার নিজেরও স্বার্থ খুব আলাদা নয়। কাকা বসে আছে বিরাট সম্পত্তির উপর --- সে সম্পত্তির কিছুটাও যদি সে পেত, তার হেসেখেলে দিন চলে যেত। কাকা তো তেমন কিছু ভোগ করে না, আর আপন বলতে শুধু মনোহর, তাও কাকা বেঁচে থাকতে টাকাগুলো পাওয়া আটকে আছে। মনোহরের এটা খুব অবিচার মনে হয়, যে টাকা সেই পাবে কাকার অবর্তমানে, সে টাকা সে দরকারের সময় সে পাবে না কেন? কাকা এখন সবে ষাট পেরিয়েছে, হয়তো দুর্বল হার্ট নিয়েও বেঁচে থাকবে অনেকদিন। এতদিন ধরে চিকিৎসায় যে টাকাটা খরচ হবে, সেও তো মনোহরের পাওনা টাকা থেকেই। তার উপর কাকার ভীমরতি ধরেছে। কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা তো শিওর মানি লুজিং প্রজেক্ট। কাকা যদি এরকম করতে করতে সব উড়িয়ে দেয়, তাহলে মনোহরের কি হবে?
কাকা মরলে সব দিক থেকেই সুবিধা। পাঁচ-দশ বছর তো বটেই, বাকি জীবনটাই হয়তো পায়ের উপর পা তুলে কেটে যাবে।
কিন্তু তা বলে কাকাকে খুন! যে কাকা তাকে বড় করল বাবা মা মারা যাবার পর ছোটবেলায়।
ধুর, মনোহর খুন করবে কোথায়? করলে সে তো লোটনরা করবে। লোটনের সাথে মনোহরের কোনও ষড়যন্ত্র হয় নি, এমনকি কোনও যোগাযোগও নেই, বরঞ্চ একরকম বৈরিতারই সম্পর্ক বলা যায়। মনোহরকে কারুর সন্দেহ করার কিছু নেই। আর আইনতঃ সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কিন্তু তাকে উত্তেজিত হলে চলবে না। বাড়িতে রাধুনি-চাকর-মালি-ড্রাইভার-দরোয়ান নিয়ে অনেক লোক। তারা যেন কিছু আঁচ না করতে পারে। কাকা তো নয়ই।
দিন দুয়েক যাবার পর মনোহর পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। উত্তেজনায় বুক ধড়াস ধড়াসটা আর করছে না তার। এখন কাকার শরীর বেশি খারাপ বলে বেরোনোর সময় কাকা গাড়ি করেই যায়, সঙ্গে চাকর ড্রাইভার থাকে। প্রকাশ্য দিনে এত লোকের মাঝে লোটনরা কাকাকে মারতে পারবে না মনে হয়। সঞ্জয় ধর ওদের অতটা বেপরোয়া হতে দেবে না। তাহলে নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে মারতে আসবে। কাকা তো রাতে আর বাড়ির বাইরে বেরোয় না। তাহলে কি শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ওরা চেষ্টা করবে। কিন্তু কাকার ঘরে জানলা তো বন্ধই থাকে, এসি চালিয়ে শোয়। তাহলে কি জানলার ছিটকিনিটা একটু খুলে দেবে? আর ভাবতে পারে না মনোহর। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
একটু পরে ধাতস্থ হয় সে। তাকে পারতেই হবে। এ ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।
এখন মনোহর রোজই সবার অলক্ষ্যে জানলার ছিটকিনিটা খুলে দেয়। প্রথম দিন এত উত্তেজিত হয়েছিল যে নিজের ঘরে এসে একটু হুইস্কি খেয়েছিল। ঘুম আসে নি, মটকা মেরে পড়েছিল। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। এখন সে সম্পূর্ণ নির্বিকার। দিব্যি ঘরে এসে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। সে জানে লোটনরা সুযোগ খুঁজবেই, আজ হোক কাল হোক, ঠিক কাজ সারতে আসবে। ছিটকিনিটা যে সে খুলেছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই, কেউ সেই প্রসঙ্গ তুলবে বলে মনে হয় না। আর তুললেও, যে চাকরটা ঝাড়পোঁচ করে, সে একটা ভুলোমন, সবাই ওকেই দোষ দেবে। মনোহর পুরোপুরি সেফ।
পাঁচ ।।
লোটন গুলিটা করেছিল জানলা আলগা করেই। সে তুখোড় বন্দুকবাজ, পাঁচ-দশ হাত দূর থেকে গুলি ফস্কানোর প্রশ্নই নেই। নাইটল্যাম্পের হাল্কা আলোই তার নিশানা করার পক্ষে যথেষ্ট। গুলিটা সুধীরবাবু মাথাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। ইন্সট্যান্ট ডেথ। মুখটা বীভৎস হয়ে গেছে, তাকানো যাচ্ছে না।
তবে লোটনদের কাজটা নির্বিঘ্নে হয় না। দারোয়ানটা পুরোপুরি ঘুমোয় নি, ঝিমোচ্ছিল। গুলির শব্দে সে উঠে দৌড়ে গিয়ে টর্চ মারে। লোটনরা তখন পাঁচিল টপকে পালাচ্ছিল। সে দেখে ফেলে। রাস্তার কুকুরগুলোও চিৎকার করতে থাকে। প্রতিবেশীরা কয়েকজন ওদের পালাতে দেখে।
সবচেয়ে কেঁদেছিল মনোহর। লোটন-সঞ্জয়দের সে দেখে নেবে বলে। থানায় অভিযোগ-পিটিশন জমা পড়ে। লোটন-কাঁচা-চশমারা এলাকা ছেড়ে পালায়। লোকজন সঞ্জয়ের বাড়ি চড়াও হয়। ভয়ে সে গা ঢাকা দেয়।
তিনদিন পর বর্ধমান জেলায় একটা চুল্লুর ঠেক থেকে লোটন ধরা পড়ে। কাঁচা আর চশমাও যথাক্রমে মেটিয়াবুরুজ আর কালিঘাটের বেশ্যাখানা থেকে ধরা পড়ে। সঞ্জয় কোর্টে আত্মসমর্পণ করে। জামিন পায়, তবে এলাকায় ঢুকতে সাহস করে না। কলকাতার নিউ টাউনে তার একটা ফ্ল্যাট আছে, সেখানেই থাকে।
মনোহরকে কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না। সে মনে মনে হাসে। খুন করে লোটন-সঞ্জয়রা শুধু আক্রোশ মিটিয়েছে, কিন্তু নিজেরা পুরোপুরি ফেঁসে গেছে। লোটনরা তো বটেই, সঞ্জয়েরও বড় রকমের জেলমেয়াদ হওয়ার কথা। আর ছাড়া যদি পায়ও সঞ্জয়, এলাকায় আর বাছাধনকে ব্যবসা করতে হচ্ছে না।
কলোনির লোকেরা মিটিং করে। সুধীরবাবুর স্মৃতিতে বিরাট শোকসভা হয়। মনোহর মঞ্চেই কেঁদে ফেলে। বয়স্ক লোকেরা এসে তাকে সান্ত্বনা দেয়। সুধীরবাবুর স্বপ্ন তারা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। সুধীরবাবুর লেগাসি এখন মনোহরের। কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা করতেই হবে, যত বাধাই আসুক। জমি হস্তান্তরের কাগজপত্র তারা শিগগিরি মনোহরের হাতে তুলে দেবে।
কেজরিওয়ালেরও কলোনির জমিটার উপর আগ্রহ আছে, অমিত বলছিল মনোহরকে। কেজরিওয়ালের সাথে কথা বলতে হবে, মনোহর ভাবে। জমিটা পেয়ে কেজরিওয়ালের হাতে তুলে দিলে কত কমিশন পাওয়া যাবে সে সব ব্যাপারে। অল্পে স্বল্পে ছাড়বে না সে, ভালরকম দাঁও মারতে হবে। কলোনির লোকেদের সময়মতো কিছু ভুজুং-ভাজাং দিতে হবে। প্রমোটারি ব্যবসাটায় খাটুনি অনেক, ঝুঁকি বেশি। তার থেকে অনেক সহজে অনেক বেশি রোজগার জমির দালালিতে। সঞ্জয় এখন ফুটে গেছে, ওর জায়গাটা মনোহর দখল করবে। কাকার লাইন তার জন্য নয়।
আজ আনন্দে খুব মদ খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই শোকের আবহাওয়ায় আজ বারে যাওয়া যাবে না, লোকে দেখে ফেললে পরিণতি ভাল হবে না। সে বাড়িতে ফেরে, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। দামি হুইস্কির বোতলটা খোলে। বরফ নেয় গ্লাসে, হুইস্কি ঢেলে একটা পরিতৃপ্তির চুমুক দেয়।
------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, এপ্রিল ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল
নামকরণে জীবনানন্দের পংক্তি ধার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
এটা কিন্তু নিতান্তই সাদামাটা একটা ক্রাইম আর মোটিভের গল্প। এর মধ্যে মাসদুয়েক আগের সীমান্ত হামলার ঘটনার কোনও রূপক খুঁজলে নিজ দায়িত্বে খুঁজবেন, লেখক দায়ী নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন