শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

উন্ডেড নী – নেটিভ আমেরিকানদের মুছে যাবার কাহিনী

উন্ডেড নী – নেটিভ আমেরিকানদের মুছে যাবার কাহিনী

-শুভাশিস ঘোষাল 



I shall not rest quiet in Montparnasse.

I shall not lie easy at Winchelsea.

You may bury my body in Sussex grass,

You may bury my tongue at Champmédy.

I shall not be there. I shall rise and pass.

Bury my heart at Wounded Knee.


-Stephen Vincent Bennet


…. সেটা ছিল বড়দিনের চার দিন পরে, নতুন বছর তখন আসব আসব করছে। গুলিবিদ্ধ দেহগুলো সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শ্মশানের নীরবতায়। ওইরকম ভাবে ওখানেই পড়ে রইল আরো দুদিন। প্রায় তিনশো দেহের বেশিরভাগই মেয়েদের আর বাচ্চাদের। ঠান্ডায় জমে পাথর হয়ে গেছে সব শরীর, চামড়া কুঁচকে কালো হয়ে গেছে। সৎকারের দল এলো তারপর। সৎকার বলতে ক্রিকের পাশে একটু গর্ত খুঁড়ে ঝপাঝপ শবগুলোকে গাদাগাদি করে ফেলে দেওয়া। তারপর তিনদিন খুব বরফ পড়েছিল, তিনফুট সাদা চাদরে ঢেকে গিয়েছিল শবদেহগুলো --- গণহত্যার চিহ্ন মুছে দিয়ে। প্রায় পনের হাজার বছরের ইতিহাসের এক অধ্যায় এভাবে শেষ হল হাঁটুভাঙ্গার বাঁকে।



১৮৯০ খৃষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর, সাউথ ড্যাকোটার পাইন রিজ ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের উন্ডেড নী (Wounded Knee)। আমেরিকান প্রেয়ারির বিশাল প্রান্তরের মধ্যে প্রায় বৈশিষ্ট্যহীন একটা জায়গা। অত্যন্ত ক্ষীণ ধারার এক চিলতে নদী উন্ডেড নী ক্রিক পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে। কোন এক সুদূর অতীতে এক নেটিভ আমেরিকান যোদ্ধা হাঁটুতে অস্ত্রের ক্ষত নিয়ে এইখানে অবস্থান করেছিল, সেই থেকে নেটিভরা এই নাম দিয়েছিল জায়গাটার। এখানেই পাঁচ হাজার আমেরিকান সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী শিশু-বৃদ্ধ-নারী সহ মেরেকেটে সাড়ে তিনশো, প্রায় নিরস্ত্র, লাকোটা গোষ্ঠীর নেটিভ আমেরিকান এক দলের উপর গুলি চালিয়ে মেরেছিল। এরকম গণহত্যা অবশ্য বেনজির কিছু নয়, শেষ  তিনশো বছরের বেশি ধরে, শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের এই মহাদেশে আসতে শুরু করার পর থেকেই, প্রচুর ঘটেছিল আমেরিকার নানা প্রান্তে। তবু উন্ডেড নীর এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। এখানেই নেটিভ আমেরিকানেরা শেষবারের মতো একটু প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, অবশ্য আক্রান্ত হবার পর বাধ্য হয়ে। আর উন্ডেড নীর পরে প্রতিরোধের আর কোনও বাস্তব সম্ভাবনাও ছিল না। একসময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী মিলে যারা সংখ্যায় অন্ততঃ পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ ছিল (সঠিক সংখ্যা অবশ্য বলা মুস্কিল --- তিরিশ লক্ষ থেকে এক কোটির উপরও হতে পারে), পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া আটকাতে তাদের পক্ষে অদৃষ্ট মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। দখলদারি পুরোপুরি শেষ হবার পর আমেরিকা রাষ্ট্রকেও আর কখনও নেটিভদের উপর আক্রমণ শানাতে হয় নি।

নেটিভ আমেরিকানরা আমেরিকার সবচেয়ে ভাগ্যতাড়িত জাতি। পনের-কুড়ি হাজার বছর আগে তুষারযুগে বেরিং ল্যান্ডব্রিজ পেরিয়ে এশিয়া থেকে শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া করে যারা এই গোলার্ধে এসে পৌঁছেছিল আর সারা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সমস্ত জমিজমা সম্পদের মালিকানা যাদের ছিল, তারা প্রায় মিলিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। শুধু রেখে গেছে পটোম্যাক, মিনেহাহা কিংবা উম্পকুয়ার মতো ঝর্ণা, নদী, পাহাড় বা হ্রদের এইসব অসম্ভব সুন্দর কাব্যিক নাম। নিজেদের সত্ত্বা প্রায় হারিয়ে তাদের উত্তরপুরুষেরা বর্তমানে থাকে চুড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানা জনগোষ্ঠী এ দেশে এসেছে, শুরুতে প্রচুর প্রতিকূলতার পরে তারা মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, সমাজের মূল স্রোতে মিশে গেছে। এ ব্যাপারে আফ্রিকা থেকে দাসত্বের জন্য ধরে আনা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কথা সবচেয়ে বেশি মনে হয়। একসময় অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, এখনও দারিদ্র্য অশিক্ষা এসব সমস্যা আছে, তবু নেটিভ আমেরিকানদের তুলনায় তাদের অবস্থা শতগুণে ভালো। আর কিছু না হোক, তাদের সংখ্যাধিক্য তাদের পক্ষে কাজ করেছে, আর রিজার্ভেশনের মধ্যে আটকে পড়ে থাকতে হয় নি।

আমেরিকায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পড়াতে নেটিভ আমেরিকানদের কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। এমনিতে ওদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে রক্তের সংমিশ্রণ হয়ে হয়ে বিশুদ্ধ রক্তের নেটিভ আমেরিকান পাওয়া খুব কঠিন, অনেককে দেখেই শ্বেতাঙ্গ বা লাতিনো বলেই মনে হয়, নাম দিয়েও বোঝা যায় না। দারিদ্র্য আর শিক্ষার উপযুক্ত সুযোগের অভাবে খুব কম অংশই কলেজে পড়তে আসতে পারে। তারই মধ্যে একবার একটি ছাত্রী পেয়েছিলাম খুবই মেধাবী আর পরিশ্রমী। আমেরিকার পশ্চিমাংশে বিভিন্ন ন্যাশানাল পার্কে ওদের গোষ্ঠীর মানুষেরা অনেক সময় উপজাতীয় ঐতিহ্যের নাচগান পরিবেশন করে। অ্যারিজোনার পেজ  শহরে এন্টিলোপ ক্যানিয়ন দেখতে গিয়েছিলাম একবার। এটা নাভাহো (Navajo) রিজার্ভেশনের মধ্যে পড়ে, তাই নাভাহোদের ট্যুর অপারেটরের সঙ্গেই যেতে হয়। আমাদের গাইড এঞ্জেলা, গুহার মধ্যে আবছা আলোতে মাউথ অরগ্যান বাজিয়ে, খুব করুণ সুরের নাভাহোদের একটা ঐতিহ্যের গান বাজিয়ে শুনিয়েছিল। এইভাবেই তারা বাইরের পৃথিবীর কাছে তাদের সংস্কৃতির যেটুকু এখনও বেঁচে আছে, তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর একবার একজন নেটিভ আমেরিকান আমাদের খুব চমকে দিয়েছিল। সেবার লাল পাথরের দেশ অ্যারিজোনার সেডোনা শহরে বেড়াতে গেছি। ভর গ্রীষ্মে অ্যারিজোনায় তাপমাত্রা উঠে গেছে চরমে। আমার ছ বছরের ছেলে আবার টুপি আনতে ভুলে গেছে, তাই এক টুপিবিক্রেতার পশরা দেখছি আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি, তখনই ব্যক্তিটি আমাদের অবাক করে আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলল। একজন শ্বেতাঙ্গর পক্ষেই বাংলা বলা বেশ অপ্রত্যাশিত ঘটনা, সেক্ষেত্রে একজন নেটিভ আমেরিকানের কাছ থেকে বাংলা শুনতে পাওয়া পুরোপুরি অভাবনীয় ব্যাপার, সে দু একটা কথাই হোক আর যাই হোক। আরও অবাক করে দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পালাবদলের খবরের উল্লেখ করে। তারপর নিজেই জানাল যে সে ইস্কনের সঙ্গে যুক্ত, সেই সূত্রে একবার মায়াপুর গিয়েছিল।



এভাবে ধীরে ধীরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ বেড়েছে। কেন বার্ন্সের 'দ্য ওয়েস্ট' বলে একটা তথ্যচিত্র দেখে বিশেষ কৌতুহল জন্মায়। তারপর থেকে সুযোগ পেলে নেটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কিত বই বা প্রবন্ধ পড়া চেষ্টা করেছি আর মিউজিয়মে ঘুরে দেখেছি। জেনেছি যে নেটিভ সৈন্যরা দুটি মহাযুদ্ধেই আমেরিকার হয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে, যদিও একই ধরণের অবদানের জন্য একজন নেটিভ অনেক কম স্বীকৃতি পেয়ে থাকে একজন শ্বেতাঙ্গের চেয়ে। তবে কি কারণ একজন নেটিভকে উদ্দীপ্ত করতে পারে সেই দেশের হয়ে লড়তে, যা তাদের প্রতি অবিচার করেছে অনেক? এর উত্তর দেওয়া ছিল নিউ ইয়র্কের Museum of American Indians এ। আসলে নেটিভরা বরাবরের যোদ্ধা জাতি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তারা যখন এদেশের হয়েই গেছে, তারা দেশের প্রয়োজনে অস্ত্র ধরবেই। আরও এক চমকপ্রদ তথ্য হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা নাভাহো গোষ্ঠীর ভাষা সাংকেতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে খবর আদানপ্রদানে, যার রহস্যভেদ জার্মানরা করতে পারে নি। 

উন্ডেড নীর ট্র্যাজেডিকে বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হবে তিনশো বছরেরও বেশি। ভারতবর্ষ খুঁজতে গিয়ে না বুঝে কলম্বাস ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এসে পড়েছিল, তারপর থেকে ক্রমাগতই শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের আনাগোনা হতে থাকে ক্যারিবিয়ান ও দুই আমেরিকার মূল ভূখন্ডে। মোটামুটিভাবে এরকম ধারণা বেশিরভাগ লোকেরই আছে, তবে উন্ডেড নীর পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে নেটিভদের ভাগ্যবিপর্যয়ের ইতিহাস  সংক্ষেপে একটু বলছি।

আমরা এক কথায় যাদের নেটিভ আমেরিকান (আমেরিকান ইন্ডিয়ানের মতো ভুল কথাটা আমি যথাসম্ভব এড়াতে চাই) বলি, প্রকৃতপক্ষে ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোষাক ও রীতিনীতিতে তাদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, এমনকি জিনতত্ত্বের হিসেবেও। দক্ষিণ-পশ্চিমের মরুভূমির লোকেদের সঙ্গে, উত্তর ঘাসজমির লোকেদের, বা পূর্বের ঘন বনের বা পশ্চিম উপকূলের অথবা মিসিসিপি তটের নেটিভদের মধ্যে মিলের থেকে ইউরোপীয়দের নিজেদের মধ্যে মিল ঢের বেশি। এদের কেউ কৃষিকাজে বিশেষ দক্ষ হয়েছিল --- জংলী ভুট্টার বাছাই প্রজনন ঘটিয়ে আধুনিক ভুট্টার জন্ম দিয়েছিল, আবার কোনও গোষ্ঠী শুধুই শিকার করত বা মাছ ধরত। আর দক্ষিণ আমেরিকার নেটিভরা তো বিজ্ঞানেও অনেক উন্নত হয়েছিল। ভারতবর্ষে শূন্য আবিষ্কার হবার প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই ইনকারা শূন্যকে ব্যবহার করার উপায় জানত। এমন নয় যে ইউরোপীয়দের আসার আগে ওদের মধ্যে কোনও সংঘাত হতো না। পৃথিবীর আর সব জায়গার জনগোষ্ঠীদের মতোই তারা যুদ্ধ করত পরস্পরের সাথে --- তবে তাতে একটা ভারসাম্য ছিল, কোনও গোষ্ঠী ওইভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেত না। ইউরোপীয়রা আসার পরে সে ভারসাম্যটা পুরোপুরি চলে গিয়ে সংঘাতগুলো একপেশে হয়ে পড়ে। কেউ মনে করতেই পারেন যে সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, বিশেষতঃ সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে, যেহেতু ইউরোপীয়দের উন্নতমানের অস্ত্র ছিল। কথাটা হয়তো ভুল নয়, তবে যতই বেশি শক্তিশালী হোক ইউরোপীয়রা, প্রথম যখন তারা আসে, নেটিভদের কাছ থেকে অভাবনীয় বদান্যতা না পেলে তারা ঘাঁটি গাড়তেই পারত না। এই সুবিশাল মহাদেশের প্রাচুর্য নেটিভদের করেছিল খুবই দিলখোলা উদার। অন্যান্য নেটিভগোষ্ঠীকে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে দেখলেও আগন্তুকরা তাদের কাছে সহায়সম্বলহীন অতিথি ছিল। খাবারদাবার, রসদ, জায়গা-জমি দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করেছিল। তার বদলে তারা পেয়েছিল শুধুই শঠতা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, কৃতঘ্নতা, ক্রূরতা ও হিংসা। বস্তুতঃ এত বদান্যতা ইউরোপীয়দের চোখে গুণ না হয়ে দুর্বলতার চিহ্ন মনে হয়েছিল, তারা সফট টার্গেট হয়ে যায়। তাদের সম্পদ দখল করে তাদের ইউরোপীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে তোলা, আর বিশেষ করে খ্রীষ্টধর্মের তলায় নিয়ে আসাটা পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অস্ত্রের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও নেটিভদের বিপর্যয়ের আর এক প্রধান কারণ হয়েছিল ইউরোপীয়দের আনা নানা মারণ ব্যাধির জীবানু, যেমন স্মল্ পক্স, যাদের বিরুদ্ধে নেটিভদের কোনও প্রতিরোধই ছিল না। ইউরোপীয়রাও সেটাকে সানন্দে নেটিভদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।

প্রথমে এসেছিল স্পেনীয়রা, আমেরিকার মূল ভূখন্ডে ফ্লোরিডার সেন্ট অগাস্টিনে তারা প্রথম শহর গড়ে তোলে। মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিশাল ভূখন্ড তাদের অধিকারে আসে। ইউরোপের দ্বিতীয় সারির শক্তি স্পেনের রাজ্যবিস্তারে সোনাদানার লোভ আর লুঠপাট অত্যন্ত প্রকট ছিল, যেমন ভারতবর্ষে পর্তুগীজরা দুর্নাম কুড়িয়েছিল। তার সঙ্গে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মাত্রাহীন রক্তের সংমিশ্রণে এক সংকর গোষ্ঠীর জন্ম দেয় যারা সারা লাতিন আমেরিকা ছেয়ে ফেলে নেটিভ অধিবাসীদের প্রায় পুরো মুছে ফেলেছে। আমেরিকায়ও দক্ষিণে টেক্সাস-নিউ মেক্সিকো-অ্যারিজোনা-ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে তারা উপস্থিত হয়েছিল। মেক্সিকো সিটিতে তাদের মূল ঘাঁটি থেকে সেসব অভিযান চালানো হতো। হত্যা, সঙ্গে সঙ্গে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ না করলে হত্যার হুমকি, পাইকারি হারে ফাঁসিতে লটকানো, অঙ্গছেদন এসব চলছিল। অবশ্য নেটিভদের বন্দী করে দাস বানানোর চেষ্টা একেবারেই সফল হয় নি। বস্তুতঃ যখন ধর্মপ্রচারকেরা শান্তিপূর্ণ পথে এসেছিল, নেটিভরা তাদের বাধা দেয় নি, তাদের কথা মন দিয়ে শুনেছে পর্যন্ত। কিন্তু বাড়াবাড়ি শুরু হওয়াতে তারা ক্ষেপে গিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্রে অনেক পিছিয়ে থাকলেও নেটিভদের বেশিরভাগ গোষ্ঠী ছিল কুশলী যোদ্ধা, শ্বেতাঙ্গ হানাদারদের তারা অনেক সময়ই হঠিয়ে দিয়েছিল। বন্দুকের ব্যবহারও তারা ভালই শিখে ফেলেছিল, যদিও তাদের হাতে বেশি বন্দুক ছিল না। পুয়েবলোদের গোষ্ঠীপতি পোপের নেতৃত্বে তারা স্পেনীয়দের হারিয়ে তাদের জায়গা দখলমুক্ত করে রেখেছিল বহুবছর, যতদিন না মেক্সিকো সিটি থেকে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তারা ফিরে আসে।

ইংরেজরা স্পেনীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ধূর্ত ছিল, তাদের ধৈর্য ছিল বেশি, নেটিভদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে তারা এগোচ্ছিল। এমনকি ভার্জিনিয়ায় নেটিভ রাজকুমারী পোকাহোন্তাসকে  বিয়েও করেছিল এক ইংরেজ দলপতি। তবে তাদেরও উদ্দেশ্য বেশিদিন চাপা থাকে নি। নেটিভরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারপর নৃশংস আক্রমণ ও গণহত্যার শিকার হয় তারা। তবে গ্রেট লেক অঞ্চলে ডেট্রয়েট অবরোধের যুদ্ধে দলপতি পন্টিয়াক ইংরেজদের প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন ফরাসীদের সাথে হাত মিলিয়ে, কিন্তু  শেষ পর্যন্ত ফরাসীরা বিশ্বাসঘাতকতা করায় আর পারেন নি। ডাচরাও মিষ্টি কথাবার্তা আর সামান্য কাচের পুঁতি ধরণের জিনিস দিয়ে পুরো ম্যানহাটন উপদ্বীপ হাতিয়ে নিয়েছিল, ফলে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাভাবিক সমুদ্রবন্দর নিউ ইয়র্ক তাদের হাতে এসেছিল। তারপর রাতের অন্ধকারে নেটিভদের গ্রামে হানা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল মানুষ সহ পুরো বসতি। ফরাসীদের গল্পও একই রকম --- তারা প্রধানতঃ দখল করেছিল দেশের মধ্যভাগে নিউ অরলিন্স বন্দর সহ মিসিসিপির তীরের দুপাশ। ফরাসী-ইন্ডিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ফরাসী সাহিত্যিক Chateubriand তার Atala উপন্যাসে এক নেটিভ যুগলের কাহিনী বলেছেন, যারা গণহত্যা থেকে পালিয়ে বাঁচতে মিসিসিপির উজানে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। মেয়েটি ছিল অন্তঃস্বত্ত্বা, মিসিসিপির তীরে বসে সে এক সন্তানের জন্ম দেয় ভোরের প্রথম আলোয়, তার বাবা সেই সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে তুলে ধরে। এই দৃশ্যটা Eugene Delacroix  তাঁর The Natchez  ছবিতে দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন।



অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ মধ্যভাগে আমেরিকার বিপ্লবীযুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয়ের ফলে স্বাধীন উপনিবেশকারীরা নতুন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করার পর নেটিভদের জায়গা-জমির উপর শ্বেতাঙ্গদের চাপ আরও বাড়তে থাকে। এই যুদ্ধে নেটিভরা ইংরেজদের পক্ষেই মূলতঃ লড়েছিল, কারণ তারা দেখেছিল তাদের থেকেও উপনিবেশকারী আমেরিকানদের জমির লোভ অনেক বেশি। শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশের সঙ্গে এশিয়ার মানুষ কম বেশি পরিচিত, তবে আমেরিকায় যে ঘটনা পরম্পরা ঘটেছিল, সেই তুলনায় ভারতবর্ষ বা এশিয়ার অন্য জায়গায় ঘটা ঘটনার কোনও তুলনাই হয় না। ভারতবর্ষে ছিল এক সুবিশাল জনসংখ্যা। ইংরেজরা সুযোগ পেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে পেলেও তাদের শাসন চলত নেহাতই উপরের অংশে, তার পরের ধাপগুলোতে ভারতবাসীরাই শাসন চালাত, বিশেষ করে দেশীয় রাজ্যগুলোতে। উপনিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা হল শহর-গ্রামে সর্বত্র উপনিবেশকারীদের বসতি স্থাপন ও জায়গা-জমির দখল নেওয়া ও তার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে  অনেকাংশে বিলুপ্ত করা ও বাকিদের অন্যত্র পাঠানো, যা ভারতবর্ষে ঘটেনি। মনে করা যাক, সুজলা-সুফলা বাংলার লোকজনকে জোর করে রাজস্থানের ঊষর প্রান্তরে পাঠানো হলো, কি তামিলদের হিমালয়ে বা পাঞ্জাবীদের বিন্ধ্য অঞ্চলে। আমেরিকার জনগোষ্ঠীদের  ঠিক এরকমই ব্যাপকহারে অন্যত্র সরানো হয়েছিল এমন জায়গায়, যেখানে তাদের নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশই নেই। নেটিভ আমেরিকানদের সাধারনতঃ তাদের নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে ছিল এক নিবিড় যোগাযোগ, শিকার করার বা ফসল বোনার ঠিক সেই জায়গাটা যা তারা চেনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, তাই তারা প্রাণ পণ করে পড়ে থাকার চেষ্টা করত পিতৃপুরুষের সেই জায়গায়। প্রথম গণ উচ্ছেদের শিকার হয়েছিল পূর্বভাগের নেটিভেরা। অ্যাপালেশিয়ান পর্বত অঞ্চলে চেরোকিদের সুবিশাল জনসংখ্যা চালান করে দেওয়া হল অজানা দেশ মিসিসিপির পশ্চিমপারে, যা তখনও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার বাইরে ইন্ডিয়ান টেরিটারি হিসেবে চিহ্নিত হত। ঘোড়ার গাড়িতে যেটুকু জিনিসপত্র পারে চাপিয়ে যেতে যেতে ক্ষতিপূরণবাবদ যে সামান্য কয়েকটা ডলার তারা পেয়েছিল পরিবারপিছু, তার প্রায় সবটাই পথে দিয়ে দিতে হলো রাস্তা ব্যবহার করার জন্য, কারণ তখন প্রায় সব রাস্তাই ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধীন টার্নপাইক। ক্ষিদে আর শীতে পঁচিশ শতাংশ চেরোকি পথে মারা গেল। ইতিহাসে এই যাত্রা ট্রেল অফ টিয়ার্স (Trail of Tears) নামে পরিচিত হয়ে রইল। প্রেসিডেন্ট আ্যন্ড্রু জ্যাকসন বিশেষভাবে কুখ্যাত ছিলেন নেটিভদের সরানোর ব্যাপারে তার অদম্য মনোভাবের জন্য। আ্যন্ড্রু জ্যাকসনের সৈনিক জীবনের সময় ব্যাপকভাবে চেরোকিদের হত্যার জন্য তাকে সরাসরি দায়ী করা যায়। নেটিভরা তাকে শার্প নাইফ আখ্যা দিয়েছিল। উপনিবেশিকদের এরকম নগ্ন আগ্রাসন, যা নেটিভ আমেরিকানরা দেখেছিল, সেরকম এমনকি আফ্রিকাতেও দেখা যায় নি। বিপুল অত্যাচার ও পীড়নের শেষেও আফ্রিকান জনগোষ্ঠীরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল, শেষমেশ নিজেদের দেশও ফেরত পেয়েছে। দু একটি যে আফ্রিকান দেশে শ্বেতাঙ্গরা প্রকৃত উপনিবেশ করেছে, সেখানেও তারা ব্যাপক সংখ্যালঘু। ঔপনিবেশিকতার ধরণে একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বোধ হয় আমেরিকা-কানাডার তুলনা করা যেতে পারে, তবে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা এত কম ছিল আর মধ্যভাগ প্রায় জনহীন বলে এরকম গণউচ্ছেদের ঘটনা হয়তো হয় নি।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন ফ্রান্সের কাছ থেকে লুইজিয়ানা ক্রয় (Louisana Purchase) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের আয়তন দ্বিগুণ করে ফেলেন। ফ্রান্স এই অঞ্চলের দাবিদার হলেও এই বিশাল ভূখন্ডে তাদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ ছিল না, নেটিভ গোষ্ঠীরা প্রায় স্বাধীনভাবেই ঘোরাফেরা করত। জেফারসন দুই অভিযাত্রী লুইস আর ক্লার্ককে পাঠালেন জায়গাটা সম্পর্কে জানতে, আর বিশেষ করে নর্থ ওয়েস্ট প্যাসেজ খোঁজ করতে, যা কি না প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানোর রাস্তা। তখনও সুয়েজ খাল তৈরি হয় নি, এশিয়ার সঙ্গে, বিশেষ করে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্য রাস্তা খোলার তাগিদ ছিল উত্তমাশা অন্তরীপের দীর্ঘ ও বিপদসংকুল পথ এড়িয়ে। ধারণা ছিল বুঝি মিসিসিপির পশ্চিমে অল্প গেলেই প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানো যাবে। লুইস আর ক্লার্কের অভিযানে বোঝা গেল যে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়ানোর পরও রয়েছে সুবিশাল ভূখন্ড, সেখানে বহু নেটিভ গোষ্ঠীর বাস। তারা দুজন শেষমেশ রকি পর্বত পেরিয়ে কলম্বিয়া নদী ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা পেয়েছিলেন। প্রথমে মান্দান, তারপর শোশোনি ও নেজ পার্স, এইরকম বহু নেটিভ গোষ্ঠীর সাহায্য না পেলে তাদের এই অভিযান সফল হওয়া তো দূরের কথা, তারা অনাহারেই মারা যেতেন। নেটিভেরা ইচ্ছা করলেই তাদের মেরে ফেলতে পারত। পূর্বের নেটিভ গোষ্ঠীদের লাঞ্ছনার কথা তারা তখনই কিছু কিছু শুনেছিল। কিন্তু তা তারা করে নি, বরঞ্চ খাবারদাবার, ঘোড়া ও নৌকা দিয়ে এবং পথ দেখিয়ে তারা সবরকমভাবে ওদের সহায়তা করেছিল। কিন্তু মালিকানাবিহীন  এত বিশাল জমি ও নানা সম্পদের কথা শুনে (শ্বেতাঙ্গদের কাছে সেখানে থাকা নেটিভরা মালিকানার বিবেচনায় ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না) শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিকরা বিশেষ আকৃষ্ট হয়। ইউরোপের নানা দেশ থেকে তখন দলে দলে লোক আসছে নতুন এই দেশের বিশাল সম্ভাবনার কথা শুনে। ফলে অভিবাসীদের জন্য আরও জায়গা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, আর নেটিভদের সঙ্গে বাড়ছে সংঘাত। নেটিভরা খুব বেদনার সঙ্গে দেখত যে শ্বেতাঙ্গরা কিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে ফেলে, আর আশ্চর্য হয়ে ভাবত শ্বেতাঙ্গরা কি প্রকৃতিকে ঘৃণা করে! প্রথমে পশুর চামড়ার ব্যবসায়ী ফার ট্র্যাপাররা, তারপর চাষবাসের উদ্দেশ্যে ও পরে রেলরোড গড়ে উঠলে খনিজ সম্পদ তুলতে, দলে দলে লোক বসতি বিস্তার করে। বিশেষ করে সোনার খোঁজ পাওয়া অঞ্চলে পঙ্গপালের মতো লোকজন আসতে থাকে, রাতারাতি শহর গড়ে উঠতে থাকে। মাত্র পাঁচ প্রজন্মের মধ্যেই সারা পশ্চিমদেশে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা বসতি গড়ে ফেলে। নেটিভেরা জানত অগণিত সংখ্যার শ্বেতাঙ্গদের উন্নত অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়, আর মনে করত এত বিশাল জায়গা, তার ভাগ কিছুটা দিলে ক্ষতি নেই তেমন। তারা নিজেদের অনেক অধিকার ছেড়ে দিয়েও চুক্তি করত রাষ্ট্রের সঙ্গে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, মেনে চলত সেগুলো, কিন্তু বিনিময়ে পেত চুক্তিভঙ্গ, আরো নতুন দাবী আর আক্রমণ। সেইভাবে ক্রমাগতঃই সংকুচিত হচ্ছিল তাদের জায়গা, যাতে আর জীবনধারণের উপযোগী যথেষ্ট শিকারক্ষেত্র পড়ে থাকছিল না। তাদের বাধ্য করা হচ্ছিল ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে। রিজার্ভেসনের জায়গাও দেওয়া হত সব থেকে অনুর্বর আর শিকার যেখানে দুর্লভ সেসব জায়গায়। তাদের জন্য রেশনের যে ব্যবস্থা করা হত সরকার থেকে, তা অপ্রতুল, সময়ে পৌঁছাতো না, আর অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছানোর আগেই চুরি হয়ে যেত। নেটিভদের জায়গা-জমির অধিকার দিয়ে যে সব সরকারি নীতি ছিল, নতুন আইন করে সেগুলোও শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছিল। ১৮৬২ সালের হোমস্টেড আইনে এক একজনকে ১৬০ একর অবধি চাষবাসের জমি দাবী করার অধিকার দেওয়া হয়। তারপর ১৮৮৭ সালে ডস অ্যাক্ট (Dawes Act) নেটিভদের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জীবনের উপরই আঘাত হানে। এতে এক এক নেটিভ আমেরিকান পরিবারের প্রধানকে ১৬০ একর কৃষিজমি বা ৩২০ একর শিকারের জমি দিয়ে বাকি উদবৃত্ত জমি অভিবাসীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এই আইনের খসড়াকারীরা ছিলেন নেটিভদের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদ্দেশ্য ছিল রিজার্ভেসনের জীবনের বাইরে তাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই আইন তাদের পরিপূর্ণ ধ্বংসের পথ খুলে দেয়। কারণ তাদের সমাজ গোষ্ঠীদের যৌথ মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। পনের কোটি একরের নেটিভদের জমির তিনভাগের দুভাগই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে। বড় রিজার্ভেসনগুলোও কেটে ছোট ছোট ভাগ করা হয়, রেশনের পরিমান আরও কমে যায়, মহামারী ছড়িয়ে পড়ে বহু জায়গায়।  

শ্বেতাঙ্গরা অনেক বেশি সংখ্যায় আর তাদের অস্ত্রশস্ত্রও অনেক বেশি আর উন্নত মানের, তবুও বহু ক্ষেত্রেই তারা ছল, শঠতা ও সম্পূর্ণ অন্যায় যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছে। নেটিভেরা যখনই সম্ভব হয়েছে, সমঝোতার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের সমঝোতার জন্য ডেকে নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী বা হত্যা করা হয়েছে, বন্ধু সেজে গিয়ে একসঙ্গে মদ খেতে খেতে অতর্কিতে গুলি করে মেরেছে, তাদের খাবার ফসল আর থাকার তাঁবু জ্বালিয়ে দিয়েছে যাতে তারা খিদে আর শীতে মারা যায়, এক-আধ জনের করা কোনও অন্যায়ের জন্য পাইকারি হারা নিরীহ লোকেদের মেরেছে, আত্মসমর্পন করতে চাওয়া নারী-শিশুদেরও নির্মমভাবে খুন করেছে। কলোরাডোর স্যান্ড ক্রিকে এরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল যে একটা গর্তে লুকিয়ে থাকা মেয়েরা শান্তির পতাকা হাতে দিয়ে একটা ছ বছরের মেয়েকে পাঠিয়েছিল, তাকেও মেরে ফেলা হয় আর তারপর লুকিয়ে থাকা মেয়েদের। অথচ কলোরাডো অঞ্চল ছিল সরকারের দ্বারা স্বীকৃত ইন্ডিয়ান টেরিটারি। আসলে ডেনভার এলাকায় সোনা খুঁজে পাবার পরই সেই অঞ্চল থেকে নেটিভদের সরিয়ে দেবার দরকার হয়ে পড়ে সমস্ত চুক্তিকে লংঘন করে। আর যারা এইসব নতুন অঞ্চলের প্রশাসনিক বা সামরিক দায়িত্ব নিয়ে যেত, তারা প্রায় সকলেই ছিল তীব্র নেটিভ বিদ্বেষী। অনেক সময় সরকারি নির্দেশ দেওয়া হত নেটিভদের মাথা কেটে আনতে পারলে মাথাপিছু টাকা পাওয়া যাবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনা খুঁজে পাওয়ার পর অবস্থা চরমে ওঠে --- নেটিভদের সংখ্যা পাঁচভাগের একভাগ হয়ে যায় মাত্র তিরিশ বছরে। ওয়াশিংটনের শাসন পশ্চিম অঞ্চলে সেরকম বলবৎ ছিল না, গভর্নরদের কথাই ছিল আইন। আর সব খবর পৌঁছাতোও না ওয়াশিংটনে। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন, যিনি একজন খুবই অনুভূতিশীল মনের মানুষ ছিলেন আর কৃষ্ণাঙ্গদের দাসত্ব থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে যিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, তিনিও নেটিভদের বিরুদ্ধে ক্রমাগতঃ হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকারে কিছুই প্রায় করতে পারেন নি। অবশ্য নেটিভদের প্রতি সহানুভুতিশীল কিছু অফিসার ছিলেন, কিন্তু বাকিদের বিরোধিতায় তাদের বিশেষ কিছু করার উপায় ছিল না, এমনকি অনেককে কোর্ট মার্শালও করা হয়েছে। ডানহোয়াগা বলে একজন নেটিভ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উলিসেস গ্রান্টের বন্ধু ছিলেন, নিজের চেষ্টায় পড়াশুনো শিখে ইন্ডিয়ান আ্যফেয়ার্স ব্যুরোর কমিশনার হতে পেরেছিলেন ও নেটিভদের জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাকেও কিছু তুচ্ছ পদ্ধতিগত ত্রুটির অভিযোগে, যা তিনি করেছিলেন নেটিভদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে বাস্তবতার কারণেই, সরিয়ে দেওয়া হয়।

কথা হল, নেটিভদের প্রতি এরকম ক্রমাগতঃ হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কি কোনও জনমত ছিল না? প্রথম কথা, নেটিভদের জায়গা-জমি দখল যেখানে গড়পড়তা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের স্বার্থের অনুসারী, সেখানে জনমতও গড়ে ওঠে সেভাবে। সেই যুগে ন্যায়-অন্যায়ের মূল্যায়নও ছিল আজকের থেকে দুর্বল, জেনেভা কনভেনশনেরও জন্ম হয় নি তখনও। তা ছাড়া সর্বোপরি তাদের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার খবর স্থানীয় সংবাদপত্রের বাইরে তেমন বেরোতো না। উল্টে দু একটা ছোটখাটো ঘটনার সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে উল্লেখ করে নেটিভরা যে বর্বর আর গোলমালকারি, সেটাই প্রতিষ্ঠা করা হতো। যুগে যুগে বিভিন্ন জায়গায় এরকমই হয়ে থাকে। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে আমরা অসুর-দৈত্য-রাক্ষসদের হানা দেওয়া আর অত্যাচারের যেসব উল্লেখ পাই, সেগুলোও হয়তো বিজয়ী আর্যদের বানানো। আদি জনগোষ্ঠীর লোকেদের সম্পর্কে নিন্দাবাদ করার উদ্দেশ্যে, যেখানে সেই লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত। ইতিহাস তো বিজয়ীরাই লেখে। নেটিভ আমেরিকানদের এত সব কাহিনীর বেশিরভাগই হয়তো সাধারণ লোকের কাছে সম্পূর্ণ অজানা রয়ে যেত যদি না ডি ব্রাউনের মতো লেখক এবং আরও কিছু সাংবাদিক বিভিন্ন সংবাদপত্র ও দলিল ঘেঁটে "ইতিহাস খুঁড়ে রাশি রাশি দুঃখের খনি" বের করে আনতেন।

তবে নেটিভরা তাদের অস্ত্রের ঘাটতি সত্ত্বেও প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল অনেকক্ষেত্রেই। দেশের মধ্যভাগে শায়ান গোষ্ঠীর নেতা তিকামশে (Tecumseh) নেটিভদের এক বিশাল ফেডারেশন গড়ে তুলে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া যেসব নেটিভ গোষ্ঠীপতি গৌরবজনক লড়াই করেছিলেন, তাদের মধ্যে আইওয়া অঞ্চলে ব্ল্যাক হক, নাভাহোদের নেতা ম্যানুয়েলিতো ও জেরোনিমো, মিনেসোটায় লিটল ক্রো, ওগলালা ড্যাকোটা নেতা রেড ক্লাউড, ওরেগনে নেজ পার্স চিফ জোসেফ ইত্যাদিরা বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এবং অবশ্যই লাকোটা গোষ্ঠীর দুই অদম্য নেতা ক্রেজি হর্স এবং সিটিং বুল, যারা কোনও মূল্যেই তাদের পবিত্রভূমি ব্ল্যাক হিলসের দখল ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। ১৮৬৮ সালের ফোর্ট লারামি চুক্তি অনুযায়ী ব্ল্যাক হিলসকে চিরকালের জন্য পুরোপুরি নেটিভদের হাতে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সোনার ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর খোঁজ পেতেই সে চুক্তি আর মানা হয় না। তা ছাড়া খনিতে পৌঁছানোর জন্য রাস্তা তৈরি করা হচ্ছিল নেটিভদের অধিকারে থাকা জমির উপর দিয়ে। স্যান্ড ক্রিকের ঘটনার নৃশংসতায় আর পুরোপুরি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় দুই তরুণ নেতা  ক্রেজি হর্স আর সিটিং বুলের নেতৃত্বে অনেক নেটিভ গোষ্ঠী একজোট হয়ে প্রতি-আক্রমণ করে ও লিটল বিগ হর্নের যুদ্ধ সহ বেশ কিছু সাফল্য পায়। তবে এই ধরণের সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। উত্তরের প্রেয়ারির সেই নিষ্ঠুর শীতে বাসস্থানহীন মানুষগুলো, বিশেষকরে শিশুদের জমে যাওয়া থেকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত ক্রেজি হর্স আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। নিরস্ত্র বন্দী অবস্থায় তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। তবে তাঁর হৃদপিন্ডটি বের করে নিয়ে তাঁর মা-বাবা পালিয়ে এসে সেটি উন্ডেড নীর কোনও এক জায়গায় কবর দিয়েছিলেন। সিটিং বুল পিছু হটতে হটতে সীমান্ত পেরিয়ে কানাডায় চলে যান। তিনি কানাডা সরকারকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁর লোকজনেদের নিজেদের চেষ্টায় বেঁচে থাকার জন্য একটা রিজার্ভেসনের জায়গা দিতে, কিন্তু কানাডা সরকার সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেয় এই বলে যে বৃটিশ বা কানাডিয়ান নাগরিক না হবার জন্য তিনি তা পেতে পারেন না। চার বছর বাদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে সাউথ ড্যাকোটায় স্ট্যান্ডিং রক রিজার্ভেসনে থাকা মেনে নিতে বাধ্য হন।




জীবিতকালেই কিংবদন্তী হয়েছিলেন সিটিং বুল। ওয়াইল্ড ওয়েস্ট শোর সাথে তিনি সারা দেশ ঘুরেছিলেন। দর্শকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সই নেবার জন্য ডলার বাড়িয়ে দিত। এভাবে করা উপার্জনের প্রায় পুরোটাই তিনি বিলিয়ে দিতেন, যেসব ক্ষুধার্ত গরীব শ্বেতাঙ্গ বাচ্চারা তাঁর পাশে ভিড় করত, তাদের মধ্যে। আর আক্ষেপ করে বলতেন, “শ্বেতাঙ্গরা এতো উন্নত কিন্তু তারা নিজেদের গরীবদেরই দেখে না। তারা শুধু কিভাবে তৈরি করতে হয় জিনিষ সেটা জানে কিন্তু তা কিভাবে বন্টন করতে হয় জানে না"। এরকমই অসাধারণ মানুষ ছিলেন সিটিং বুল। আর আশ্চর্য প্রজ্ঞা ছিল তাঁর। জায়গা-জমি যে নেটিভদের হাতে আর থাকবে না, বালক বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর একটা আশঙ্কা ছিল তাঁর, যে নিজের লোকেদের হাতেই তিনি নিহত হবেন। তাঁর এই আশঙ্কাও শেষপর্যন্ত মিলে গেছিল।

যখন আর লড়াই করার আর কোনও রসদই অবশিষ্ট ছিল না, তখন নেটিভদের কিছু গোষ্ঠী অলৌকিকের দিকে ঝুঁকে পড়ল। কিকিং বেয়ার বলে এক লাকোটা ব্যক্তি খবর আনল যে পায়ুটদের একজন ওঝা, ওভোকা তার নাম, একধরণের বিশেষ প্রেত-নাচের উদ্ভাবন করেছে, যেটা করতে পারলে শ্বেতাঙ্গরা সব উধাও হয়ে যাবে, মৃত নেটিভেরা আবার ফিরে আসবে, সারা তৃণভূমি আবার বুনোমোষে ভরে উঠবে আগের মতো। আর এক ধরণের বিশেষ পোষাক পরলে শ্বেতাঙ্গদের বুলেট নেটিভদের আর বিদ্ধ করতে পারবে না। দলে দলে নেটিভরা নাকি এরকম করছে। যুক্তিবাদী সিটিং বুলের কাছে এই ধারণা বাস্তবসম্মত মনে হল না, তবে তিনি স্ট্যান্ডিং রক রিজার্ভেসনে প্রেত-নাচ করার অনুমতি দিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে খবর গেল, বরফের মধ্যে নেটিভেরা পাগলের মতো নাচ করছে। সৈন্যদের বলা হল প্রস্তুত থাকতে, ওদের থামাতে হবে। সিটিং বুল ছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ আতঙ্ক, তাই তাদের মনে হল সিটিং বুলও বুঝি প্রেত-নাচে যোগ দিতে চলেছেন, আর তাতে গন্ডগোলের আশঙ্কা আছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার আদেশ জারি হল। রিজার্ভেসনে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ লাকোটা লোকজনকে নিয়েই তৈরি হত। ১৮৯০ সালের ১২ই নভেম্বর তারা সিটিং বুলকে তাঁর বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে এলে বাইরে বহু লোকের জমায়েত হল বাধা দেবার জন্য। তাদের মধ্যে একজন পুলিশকর্তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশ পালটা গুলি চালায়। একজন পুলিশ সরাসরি সিটিং বুলের মাথায় গুলি করে। বাকি জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

এই দলেরই একটা অংশ এবং ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত শায়ান রিভার ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসন থেকে আরও অনেকে পালিয়ে আরও দক্ষিণে পাইন রিজ ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পনেরই ডিসেম্বর। উদ্দেশ্য ওখানকার গোষ্ঠীপতি বিগ ফুটের দলে যোগ দেওয়া। তাদের কাছে যথেষ্ট সংখ্যক ঘোড়াও ছিল না, প্রচন্ড শীতের মধ্যে বহু রাস্তা হেঁটে তারা শেষে বিগ ফুটের দলের সঙ্গে মিলতে পারে। কিন্তু বিগ ফুটের উপর আদেশ যায় নতুন লোকেদের দলে না নিতে। সেই নির্দেশ না মেনে বিগ ফুট লোকজন নিয়ে নেব্রাস্কায় রেড ক্লাউডের শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ২৮শে ডিসেম্বর পথে সৈন্যরা আটকায় তাদের। বিগ ফুট তখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উঠে বসারও ক্ষমতা হারিয়েছেন। শান্তির পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করলে তাদের দলটাকে উন্ডেড নী ক্রিকের ধারে একটা অস্থায়ী শিবিরে রাখা হয়। পাঁচ হাজার সৈন্য জায়গাটাকে ঘিরে রাখে। চারদিকে ভারি কামান বসানো হয়। 

পরদিন সকালে সবাইকে ডেকে একজায়গায় জড়ো করা হয়। স্কুলের বাচ্চা কিছু, যারা ঘটনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে পারে নি, নিজেদের মধ্যে খেলছিল। সবাইকে অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়। বন্দুক তো বটেই, ছুরি কাঁচি যা আছে সবাইকে এক জায়গার জড়ো করতে হয়। কিন্তু নেটিভদের সেই দলের একজন, যে কানে খানিকটা খাটো আর একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিল, বলে যে সে অনেক টাকা খরচ করে বন্দুকটা কিনেছে, তা সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। টানাটানিতে শূন্যে একটা গুলি ছুটে যায়। সৈন্যরা এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে সরাসরি লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। একের পর এক দেহ লুটিয়ে পড়তে থাকে। স্কুলের যেসব বাচ্চারা একটু আগেই খেলছিল, দেখা গেল তাদের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়েছে, যেমন করে "কাস্তের আঘাতে ঘাস লুটিয়ে পড়ে"। যাদের তখনও হাতে হাতিয়ার ছিল কিছু, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে প্রত্যাঘাতের, কিন্তু অত সুসজ্জিত সৈন্যদের বিরুদ্ধে ওই কজন সামান্য অস্ত্র নিয়ে কতটুকুই বা প্রতিরোধ করতে পারে? আড়াইশোর মত নেটিভ সেখানেই মারা গেল। বিগ ফুটের দেহও পড়ে রইল চিত হয়ে। বাকিদের আরো অনেককে সৈন্যরা তাড়া করে মেরে ফেলল। অনেকে আহত হয়ে পরে পরেই মারা গেছে। সৈন্যদেরও জনা পঁচিশেক নিহত হয়েছিল, তবে তার প্রায় সবই নিজেদেরই ছোঁড়া গুলিতে। আহতদের কাছাকাছি একটা চার্চে নিয়ে রাখা হল মেঝেতে গাদাগাদি করে। সেখানে তখনও বড়দিনের জন্য সাজানো অলংকরণ দেয়ালে ঝুলছে যিশুর বাণীর নিচে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসো,  সবাইকে ভালোবাসো, ... ।

নীতি বা মানবিকতার দিক থেকে তো বটেই, আইন ও সংবিধানের হিসেবেও উন্ডেড নীর হত্যাকান্ড অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। প্রেত-নাচ প্রকৃতপক্ষে ছিল যিশুর পুনরুজ্জীবনের ধাঁচে একটা ধর্মীয় উৎসব। উল্লেখ্য যে সেই সময়ে সমস্ত নেটিভেরাই প্রায় খ্রীষ্টান হয়ে গেছে, তারা যা করত সেগুলো খ্রীষ্ট ধর্মেরই উৎসব, নিজেদের মতো করে। আমেরিকার সংবিধানে বাকস্বাধীনতা ছাড়া আর যে নীতিগুলোকে বিশেষকরে মানা হয়, তাদের মধ্যে যে কোনও ধর্ম পালন বা না পালন করার অধিকার আর হাতিয়ার সঙ্গে রাখার অধিকার, বিশেষ উল্লেখ রাখে। অথচ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সব সময় এটাই বলেছে যে উন্ডেড নীর ঘটনা যুদ্ধেরই অংশ, তাই গুলি চালানো অন্যায় নয়। সৈন্যদের আঠারো জনকে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য পদকও দেওয়া হয়। অন্যদিকে নেটিভেরা এটাকে সবসময়েই গণহত্যা বলে এসেছে এবং সৈন্যদের দেওয়া সম্মান কেড়ে নেবার অনুরোধ জানিয়েছে। ১৯৭৩ সালে উন্ডেড নীতে একটা প্রতীকী অভ্যুথানও হয়েছিল। ১৯৯০ সালে উন্ডেড নীর ঘটনার শতবর্ষে সরকারের তরফ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হয়, তবে পদকগুলো ফেরানো হয় নি। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এলিজাবেথ ওয়ারেন অবশ্য ঘোষণা করেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে পদকগুলো সম্মানিত সৈন্যদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। বলা বাহুল্য, তা নেহাৎই প্রতীকী, কারণ সেইসব সৈন্যরা বহু যুগ হল গত হয়েছে। 

কথা হচ্ছে, সৈন্যদের এইরকম আচরণের কারণ কি হতে পারে। তীব্র বিদ্বেষ অবশ্যই প্রধান কারণ, যার অধমর্ণ, তাকেই আঘাত করার পিছনে উপকার চাপা দেবার একধরণের মানসিকতা কাজ করে। আর উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৈন্যদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোও হতো। আগে নেটিভদের উপর বহু অত্যাচার-অবিচার করা হয়েছে, তবু বোঝা যায় যে তার পিছনে চালিকাশক্তি ছিল সম্পদের দখল, আর ছিল যুদ্ধের একটা প্রেক্ষাপট, তা সে যতই একপেশে হোক না কেন। কিন্তু উন্ডেড নীর ঘটনার সময় নেটিভদের দিক থেকে আর যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সম্পদের দখলও হয়ে গেছে সম্পূর্ণ। প্রেত-নাচ ধর্মীয় আচারের বেশিকিছু নয়, হিংস্র তো নয়ই। দুচারদিন গেলেই প্রেতনাচের অসারতা নেটিভরা নিজেরাই বুঝতে পারত। আর যে লোকটি অস্ত্র সমর্পণ করতে আপত্তি করছিল, সামান্য ধৈর্য দেখালেই তাকে বোঝানো যেত। তাহলে কি সৈন্যদের মনে একটা ভয় ছিল যে প্রেত-নাচ থেকে নেটিভেরা সত্যিই শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে? নাকি তাদের ভয় ছিল নেটিভরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবে?

এখন কেমন আছে উন্ডেড নী আর ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনগুলো? এক কথায়, খুব খারাপ। সত্তর-আশি শতাংশ বেকারত্ব, অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, বাচ্চারা পুষ্টি পায় না, ডায়াবেটিস মহামারির আকার নিয়েছে, হতাশায় প্রতি চার জনে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক অ্যালকোহলিক, মানুষের গড় আয়ু মাত্র পঞ্চাশ বছর, যা তৃতীয় বিশ্বেরও প্রায় সব দেশের থেকে কম। পাইন রিজ রিজার্ভেসন বিশেষ করে দেশের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটা, যদিও রাজ্য হিসেবে সাউথ ড্যাকোটা তেমন গরীব কিছু নয়। রিজার্ভেসনগুলো সাধারণতঃ কোনও বড় রাস্তার উপর পড়ে না, কোনও বিনিয়োগ আসে না, চাকরির সুযোগ গড়ে ওঠে না। স্কুলগুলো খুব খারাপ, পোস্ট অফিস-ব্যাঙ্কজাতীয় পরিষেবা বা সিনেমা-থিয়েটারের মতো বিনোদন দুর্লভ। কিছু কিছু রিজার্ভেসন অবশ্য ক্যাসিনো খুলে লাভের মুখ দেখেছে, কারণ বেশিরভাগ রাজ্যে ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের বাইরে ক্যাসিনো খোলা বেআইনি। তবে তার পরিচালন ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া এতে রিজার্ভেসনের লোকেদেরও নেশাগ্রস্ত হবার সমুহ সম্ভাবনা। অবশ্য একশ বছর আগে নেটিভদের রিজার্ভেসনে থাকা যেমন বাধ্যতামূলক ছিল, এখন আর তা নয়। বেশিরভাগ নেটিভই এখন শহরে থাকে। কিন্তু মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেয় বেশিরভাগ নেটিভ বাচ্চা, তাই বড় হয়ে তাদের পক্ষে ভালো চাকরি জোটে না। আর সেই কারণে অনেকেই রিজার্ভেসনের বাইরে আসতেও পারে না। রিজার্ভেসনের ঘেরাটোপ থেকে বের করে নেটিভদের মূল স্রোতে আনার জন্য জোরাজুরি করার কিছু অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটেছে এককালে, যেমন তাদের বৈশিষ্ট্য লম্বা চুল কাটতে বাধ্য করা বা বাচ্চাদের পরিবার থেকে সরিয়ে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের ঘরে বড় করা। 

আজকের আমেরিকা অবশ্য নেটিভ আমেরিকানদের কিছু পাওয়া থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে না। বরঞ্চ কলেজে স্কলারশিপ বা চাকরিতে নেটিভদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক পিছিয়ে পড়ার ফলে একজন নেটিভ আমেরিকানের পক্ষে এই ধরণের সুবিধা নেবার জায়গাতেই আসা খুব শক্ত ।

ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্ক থেকে ঘন্টাদেড়েক গাড়ি চালালে উন্ডেড নী পৌঁছানো যায়, তাই এবারে যখন ব্যাডল্যান্ডস গেলাম, উন্ডেড নী দেখে আসব ঠিক করলাম। নিতান্ত গ্রাম্য পথ, প্রায় ফাঁকা জমি, মাঝে মধ্যে যে বাড়িগুলো পড়ছে, সেগুলোর খুব হতদরিদ্র অবস্থা। পথে দু একটা গ্যাস স্টেশন ছাড়া আর কোনও দোকানপাটও নেই। সত্তর মাইল গিয়ে উন্ডেড নীর সাইটটা খুঁজে পেলাম। দেখি একটি নেটিভ আমেরিকান তরুণী টেবিলে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেছে। উন্ডেড নী সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করব বলে গিয়ে কথা বলে জানতে পারলাম ওর নাম মারিয়া-এলিজাবেথ এল্ক। নামের শেষে এল্ক থাকার অর্থ ওদের গোষ্ঠীর টোটেম হল এল্ক, মানে ওরা নিজেদের এল্কের বংশধর মনে করে, তার কারণ এল্করা ওদের মাংস জোগাতো। মারিয়া খুব যত্ন করে পথের হদিস বুঝিয়ে দিল। আর জিজ্ঞাসা করল, আমি কিছু কিনতে আগ্রহী কি না। ওদের রিজার্ভেসনে নব্বই শতাংশ বেকারত্ব, সামান্য টুকটাক জিনিষ বিক্রি করেই ওর আয় হয়। হাতে তৈরি কিছু কানের দুল, হার এইসব। একটা জিনিস নিলাম পছন্দ করে। দাম অবশ্য চড়া, কিন্তু ওদের এ ছাড়া উপায়ও নেই কিছু। দুএকটা এ কথা ও কথার পর একটু অস্বস্তিকর প্রশ্নটা করেই ফেললাম যে এখন ওদের সমাজে উন্ডেড নীর ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন। একটু থেমে মারিয়া বলল, "একশ বছরের বেশি হলেও লাকোটাদের কাছে উন্ডেড নীর ঘটনা দগদগে হয়ে আছে, তারা কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। তবে সেই তিক্ততা মনের মধ্যে থাকলে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হবে। এর কোনও রকম প্রতিশোধ নেওয়া আর সম্ভবও না, উচিৎও না। তাই আমরা সজ্ঞানেই ক্ষমা করে দিয়েছি, সেটাই করা ঠিক।"

মারিয়ার কাছ থেকে জেনে নিয়ে উল্টোদিকের ঢিবিটায় গেলাম। এখানে নিহতদের নাম উল্লেখ করে প্রত্যেকের জন্য একটা করে পাথরের ফলক পোঁতা রয়েছে, আর জায়গাটা ঘিরে যে ঘেরাটোপ, তাতে রিবন বাঁধা, নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। মনে হল, যারা ক্ষমা করার, তারা তো তা করে দিয়েছে, তবে তুমি কেন তা চাইতে পারবে না? "বলো, ক্ষমা করো, হিংস্র প্রলাপের মধ্যে সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।" 



তথ্যসূত্রঃ

D Brown: "Bury My Heart at Wounded Knee", book.
Ken Burns: "The West", documentary film
David C. King: "First People: An Illustrated History of American Indians", book. 
New York Museum of American Indians.
Discover Lakota Country, Publication of Pine Ridge Area Chamber of Commerce, Kyle, South Dakota.


-----------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, ডিসেম্বর ২০১৯
মুদ্রনঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই ২০২১ সংখ্যা
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল


২টি মন্তব্য:

  1. নেটিভদের উপর অত্যাচার করে... সব জমি দখল করে... তবেই আজকের আমেরিকা. এ কথা তো সবাই জানে... বস্তুত সভ্যতার ইতিহাস সবজাগাতেই এইরকমই.
    কিন্তু আজও আদিবাসীদের প্রান্তিক অবস্থান তোর লেখায় আমাকে চমকে দিলো. সভ্যতার গর্ব করা আমেরিকায় এখনো এতো জাতিগত ভাবে বঞ্চিত মানুষ আছে... এটা খুব কম লোকেই জানে বোধহয়. বাস্তব হচ্ছে আমার তো মনে হচ্ছে, ভারতে এতটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী আজও আছে কি
    . .. যায় হোক... লেখাটা ভালো লাগলো. বড়ো কিন্তু এছাড়া নেটিভ দের পুরো ইতিহাস বা বর্তমান দুরবস্থা তো জানতে পারতাম না.
    লেখাটা ভালো হয়েছে. ধন্যবাদ বন্ধু.

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ, সুব্রত। এটা খুবই লজ্জার যে এরকম দুরবস্থায় রয়েছে মানুষ। ভারতে আদিবাসীদের অবস্থা বেশি ভালো নয় হয়তো, তবে গড় জীবনযাত্রার এত তফাত নেই বোধ হয়।

    উত্তরমুছুন