রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

শেফালীর সেলফি

শেফালীর সেলফি

-শুভাশিস ঘোষাল

 

শেফালী একজন ফেলিব্রিটি। ফেসবুকে তার হাজার দশেক ফ্রেন্ড-ফলোয়ার। প্রতিদিন সে দশ-বারোটা সেলফি অন্ততঃ পোস্ট করে ফেসবুকে। তাতে তিন-চার হাজার করে লাইক পড়ে। শ’পাঁচেকের উপর কমেন্ট। প্রতিটি কমেন্টের উত্তরে সে নিজে কিছু লেখে, বা অন্ততঃ রিয়্যাক্ট করে ইমোজি দেয়।

আমি শেফালীর একনম্বর ফেসবুক ফ্যান ছিলাম। কেন, কি করে আর এখন কেন আর নেই, সে কথা বলার জন্যই তো এই লেখা।

শেফালী আমাদের শহরেই থাকে। বাঙালিদের উইকএন্ডে পার্টি লেগেই থাকে। কারুর একটা বাড়িতে অনেকগুলো ফ্যামিলি জড়ো হয়ে আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া। এরকম একটা পার্টিতেই শেফালীর সঙ্গে আলাপ।

শেফালী সবে তিরিশের কোঠায় পড়েছে। ছিপছিপে চেহারা, লম্বা খোলা চুল, টিকালো নাক। শিক্ষিত, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। আর খুব মিশুকে। প্রথম আলাপেই এমনভাবে কথা বলে যেন কতদিনের চেনা। মোটকথা খুবই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।

জানি, শেফালী নাম শুনে সেরকম সুন্দর কোনও ছবি ফুটে উঠছে না, তাই তো? শেফালী নামটা আমাদের মা-মাসীদের প্রজন্মে রাখা হত, এখন চলে গরীবদের মধ্যে। তবে শেফালী প্রবাসে বড় হয়েছে, ওখানে বোধ হয় আধুনিক নামের ঢেউটা দেরিতে পৌঁছায়। আর দাদু-দিদিমা বা বয়স্ক কেউ কেউ অনেকসময় ওরকম নাম দিয়ে দেয়, তখন তাদের সম্মানে সেই নামটাই শেষে রাখতে হয়। কিন্তু নাম শুনে কি সব সময় বোঝা যায়? আমার এক কাজিনের নাম তো ব্রজগোপাল, অথচ সে বেশ আধুনিক ছোকরা। আর আমার এক তালেবর ক্লাশমেট ছিল তারিণী নামে। একটা হিন্দী সিনেমাতেও দেখেছিলাম, পুলিস ইন্সপেক্টর অক্ষয়কুমার তদন্তে গেছে একটা ফোন পেয়ে। ফোনটা করেছে মহালক্ষ্মী নামে কেউ। অক্ষয়কুমার তো ভেবেছে কোনও বৃদ্ধা হবে, ঢোকার গেটের মুখে সেরকমই একজন দাঁড়িয়ে। কিন্তু দেখা গেল সে নয়, মহালক্ষ্মী হল ঐশ্বর্য রাই। গেটের সেই বৃদ্ধার বরঞ্চ অনেক আধুনিক নাম। 

যা হোক, সেসব অবান্তর কথায় কাজ নেই। শেফালী যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, ওর সাথে আলাপ হলে খুশি হবার যথেষ্ট কারণ আছে। শেফালী অবশ্য বেশি পরিচিত শেলী নামে। লেখার সময় শেফালী বলে লিখছি বটে, তবে আমরা সম্বোধন করার সময় শেলী বলেই ডাকি। এখানে এরকম অনেকেই নিজের নামটা ওয়েস্টার্নাইজ করে নেয়। তাতে রণজয় হয়ে যায় রন, তিমির হয়ে যায় টিম, অনিন্দিতা হয় অ্যানি। ষাটের দশকে এ দেশে এসেছিলেন মোক্ষদাচরণ, আমাদের বাঙালি কম্যুনিটির একজন প্রবীণতম সদস্য, তিনি পরিচয় দেন ম্যাক্স নামে।

এখানে বাঙালিদের পার্টিগুলোয় আড্ডা মারার সময় ছেলেরা আর মেয়েরা বেশিরভাগ সময় আলাদা জায়গায় জমায়েত হয়। নিজেদের মধ্যে আড্ডা মারে। তবে কম লোকের পার্টি হলে তা হয় না, একসাথেই আড্ডা চলে। সেদিনের পার্টিটা সেরকমই ছিল। তার ফলে আর শেফালীর খুব মিশুকে ব্যক্তিত্বের গুণে সেদিনের আড্ডাটা খুবই জমেছিল। প্রথম আলাপ বলেই মনেই হল না। ওর বর অত্রিও বেশ চমৎকার ছেলে, কথা বলে আনন্দ আছে। একটা চমৎকার আমেজ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম সে রাতে।

বাড়ি পৌঁছে ফেসবুকে খুলেই দেখি শেফালীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। কি আনন্দ! ‘হৃদি ভেসে গেল অলোকানন্দা জলে’। সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকসেপ্ট করে নিই। সে দিনই গোটা কুড়িক ছবি পোস্ট করেছে। কয়েকটা সেদিনের পার্টিরও। কয়েকটা ছবিতে লাইকও মেরে দিলাম। প্রচুর লাইক আর কমেন্ট ছবিগুলোয়। তখন থেকেই শেফালীর ফেলিব্রিটি স্ট্যাটাসের কথা জানতে পারলাম।

কিন্তু ফেসবুকে ওর অত পপুলারিটি কি জন্য? শেফালী ফিল্মের নায়িকা বা ওরকম কোনও সেলিব্রিটি নয়। সুন্দরী বটে, তবে সুন্দরীর তো অভাব নেই, আমাদের কম্যুনিটিতেই অনেকে আছে, কয়েকজন আবার ওর থেকে বেশিই সুন্দরী হবে। বাঙালি অ্যাসোসিয়েসনের নাটকে অভিনয় ভালই করে ও, তবে সে তো অ্যামেচার ব্যাপার। অল্প-স্বল্প নাচ-গান হয়তো পারে, তা সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু তো নয়। লেখা টেখারও ব্যাপারে নেই ও। ব্যক্তিত্ব অবশ্যই একটা ব্যাপার, তবে মনে হয় কিছু মানুষ স্রেফ বিখ্যাত বলেই বিখ্যাত হয়। শেফালীও সেরকম হবে।

এর কিছুদিন পর আর একটা পার্টিতে আবিরের সঙ্গে দেখা। আবির আমার থেকে বছর দশেকের ছোট হবে। প্রায়ই পার্টিতে দেখা হয়। ওর সাথে গুলতানিটা ভালো জমে। ঘরে সিগারেট খাওয়া যায় না বলে বাইরে গিয়ে খেতে হয়। স্মোকাররা এরকম তিন-চার জনের দলে বেরোয় মাঝে মাঝে। তখন আরও কিছু এক্সক্লুসিভ আড্ডা চলে যেটা সর্বসমক্ষে একটু অসুবিধার। সেই সূত্রেই আবিরের সঙ্গে দোস্তি। কয়েকবছর আগে আমি  সিগারেট ছেড়ে দিলেও বাড়তি আড্ডার আকর্ষণটার জন্য ওদের দলের সঙ্গে বাইরে যাই মাঝে মাঝে। সেদিন অবশ্য স্মোকার আবির একাই। বলল, “সুমিতদা, চলো একটু বাইরে ঘুরে আসি।“

“চল”, বলে বেরোলাম ওর সাথে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে আবির বলল, “তোমার ফ্রেন্ড লিস্টে শেফালী আছে দেখলাম।“

আমি বললাম, “হ্যাঁ, এই কদিন আগে ও রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, তখন থেকেই।“

-“বা, তা ভালো, কিন্তু কমেন্ট কিছু করছ না কেন?”

আবির প্রচুর কমেন্ট করে শেফালীর ছবি পোস্টে, লক্ষ্য করেছি। প্রায় ফ্লার্ট করে বলা যায়।

-“কমেন্ট আর কি করব? আর পোস্টও তো করে অনেক। যতগুলো পারি লাইক তো দিই, কয়েকটা হয়তো বাদ পড়ে যায়।“

-“একটা দায়সারা লাইক মারলেই হল? ভালো কিছু কমেন্ট না করলে ওর খারাপ লাগবে না, বিশেষ করে তোমাকে নিজে রিকোয়েস্ট দিয়েছে? ভাববে ওর অ্যাপিল বুঝি কম হয়ে গেল। একজন সুন্দরী মেয়ের সম্মান রাখতে হবে না? জানো, কত লোকে ফ্রেন্ড হতে চেয়েও পায় নি?”

-“এত ফলোয়ারের ভিড়ে আমার কমেন্টের আর আলাদা করে কি মূল্য আছে? ‘বাগান কি তার প্রতিটি গাছ চেনে?’ আর আমার এখন পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই, এই বয়সে তোর মতো ওরকম ফ্লার্ট করব বুঝি? আমার থেকে প্রায় বছর কুড়ির ছোট হবে।“

-“এটা কি বলছো? একজন ফলোয়ারই বা কমেন্ট দিতে কার্পণ্য করবে কেন? কত ভালো ভালো কথা লেখা যায়। অরুণ মেসোকে দেখোনি? আরে, অর্ণার বাবা, গত সামারে এসেছিলেন এখানে। কত কমেন্ট দেন শেফালীর প্রতিটা পোস্টে। ওনার তো অন্ততঃ পঁয়ষট্টি বছর বয়েস হবে। তাহলে তুমি কে যে পারবে না?”

হ্যাঁ, দেখেছি বটে অর্ণার বাবা বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে কমেন্ট করে থাকেন। রিটায়ার্ড মানুষ, এইসব করেই সময় কাটান বোধ হয়।

বললাম, “আচ্ছা, তুই যে এরকম ফ্লার্ট করিস, তোর বউ রাগ করে না?”

-“ফ্লার্ট কোথায়, অ্যাডমায়ার করি। যার যা সম্মান, তাকে তো তা দিতেই হবে। আর শ্রেয়শী রাগ করবেই বা কেন? ওর পোস্টেও তো কত কমেন্ট দেয় লোকে? আমি কি তাই নিয়ে কখনও বলতে গেছি?”

আবিরের বউ শ্রেয়শী অবশ্য রান্নার স্পেশালিস্ট। নানারকম খাবার বানায় আর নিজের সঙ্গে তার ছবি ফেসবুকে পোস্টায়। ইউটিউবে রান্নাবান্নার একটা চ্যানেলও খুলেছে। 

-“আচ্ছা, সে না হয় হল, কিন্তু তুই যেরকম লিখিস, তাতে অত্রিও চটে যেতে পারে তুই ওর বউএর সাথে ফ্লার্ট করছিস বলে।“

-“আরে ধুর, আমি ওর বউএর অ্যাডমায়ার করছি, তাতে তো ও আরও খুশি হবে এই ভেবে যে ওর বউ রিয়েলি একটা জুয়েল। তোমাদের জেনারেশনটা এতো সেকেলে চিন্তাভাবনায় চলে যে কি বলব! শেফালীকে তোমার আমার সকলেরই ভালো লাগে। তা লাগে যখন, সেটা বললেই দোষ? তুমিও কমেন্ট করে দেখ না, অত্রি তো নয়ই, বউদিও কিছু মনে করবে না। আর তুমি আমি তো প্রেমিক নই, অ্যাডমায়ার। ফেমাসদের ওসব প্রেমিক-টেমিকের ব্যাপার থাকে না। জানো তো, ‘যতো বুঁচি ক্ষেদি নয়, মন্দিরা বেদি আর মাধুরী দীক্ষিতের প্রেমিক থাকেনা’। এসব ব্যাপারে শেফালী খুব স্ত্রিক্ট, নো লাইন ক্রশিং।”

আবির চন্দ্রবিন্দু থেকে কোটেশন ঝাড়ে।

ভাবলাম, ব্যাটা, তুই আমার থেকে মাত্র দশবছরের ছোট, তাতে একেবারে আলাদা জেনারেশন হয়ে গেলি? তুইও তো চল্লিশে পড়লি।

জিজ্ঞাসা করি, “আচ্ছা, শেফালীর পোস্টে এত লাইক আর কমেন্ট পড়ে কেন বল তো? সুন্দরী ঠিকই, তবে ও তো আর মডেল বা ফিল্ম আর্টিস্ট নয়। সিঙ্গার বা রাইটারও নয়। একরকম আমাদের মতো সাধারণই বটে।“

আবির বলে, “দেখো সুমিতদা, শেফালী যে এত লাইক আর কমেন্ট পায়, তার জন্য ওর সাধনাটা কেউ খেয়াল করে না। প্রত্যেক ফ্রেন্ডের কমেন্টে ও ইমোজি তো দেয়ই, উত্তরও দেয়। তারা কিছু পোস্ট করলে নিজেদের ওয়ালে, শেফালী কমেন্ট করে। প্রত্যেককে জন্মদিনে উইশ করে। পারফেক্ট ফেসবুক এটিকেট জানে আর প্রয়োগ করে। কত সময় দেয় জানো? এগুলো সাধনা নয়?”

-“কিন্তু এত সময় কি করে দেয়? এখনও বাচ্চা হয় নি বুঝলাম, কিন্তু চাকরি তো করে।”

-“এফিসিয়েন্সি, মাল্টিটাস্কিং। সন্ধেবেলায় অফিসের পরে ছবিগুলো পোস্ট করে। আর ও মেনলি বাড়ি থেকে কাজ করে। অফিসের মিটিং যখন চলে, সেই সময়ই অন্য একটা ল্যাপটপ থেকে আগের দিনের পোস্টের কমেন্টগুলোর উপর, যেগুলোর তখনও উত্তর দেওয়া হয় নি, উত্তর দেয়।“

আবিরের সঙ্গে কথা সেদিন এখানেই শেষ হল। মোটিভেটেড হলাম। সত্যিই তো, ভালো ভালো কমেন্ট করাই উচিৎ। কিন্তু কি লিখব? আর পাঁচজনে যেমন সুপার্ব, অসাম-বিউটি, হট লেখে --- এগুলোই ঘুরে ফিরে দেব? অন্যদের থেকে আলাদা, চোখে পড়ার মতো কিছু দিলে হয় না? ছোটবেলায় স্কুলে টিচাররা, বাড়িতে বাবা-মা বলতেন, যা করবে, মন দিয়ে ভালো করে করবে, পড়াশুনোই হোক, কি খেলাধুলো, আঁকা, গান-বাজনা, লেখাজোখা, অভিনয় যা হোক। ওদের কথা শুনিনি কখনও, পড়াশুনো, লেখাজোখা, খেলাধুলো সবেতেই ফাঁকিবাজি করেছি, তাই কোথাও তেমন ভালো ফল পাই নি। ফেসবুকে কমেন্ট করার ব্যাপারে ওরা অবশ্য বলেন নি কিছু, তবে তখন তো ফেসবুকই ছিল না। থাকলে নিশ্চয় একই কথা বলতেন। তা অন্ততঃ একটা ব্যাপারে নিষ্ঠার সঙ্গে সেই চেষ্টা করি না কেন?

কিন্তু কি করে আমার ভাষার দারিদ্র্য ঢাকা যায়? ভাবতে ভাবতে মনে হলো, সিচুয়েশন বুঝে কিছু বিখ্যাত কবিদের কবিতার কিছু লাইন তুলে দিলে কেমন হয়? রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, সুনীল, জয়? শেফালী অবশ্য কনভেন্টে পড়েছে, ইংরাজি কবিদের লাইন, কীটস-শেলীর মত চিরন্তন কবিদের, বা রবার্ট ফ্রস্ট, টি এস ইলিয়টের মতো আধুনিকদের লেখা থেকে তুলে দিলে হয়তো বা আরও ইম্প্যাক্ট হতো, তবে আমার বরাবর বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনো --- ইংরাজি সাহিত্যে একেবারেই জ্ঞান নেই। যা জানা নেই, সে চেষ্টা করে লাভ নেই। বাংলাই লিখব, শেফালীর বাংলা কবিতা কেমন লাগে জানি না, তবে বাংলা পড়তে লিখতে পারে ঠিকঠাক, জানি।   

ওইদিন শেফালীর একটা সেলফি পোস্টে সুধীন দত্তের কবিতা থেকে একটা উদ্ধৃতি দিলাম,

“কখনও কখনও মনে হয় যেন চিনি

বিদ্যুতে লেখা হেন রূপরেখা

চীনে পটে বন্দিনী।“

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শেফালী একটা লাভ ইমোজি দিল। আর উত্তরে কমেন্টও লিখল, “দারুণ হয়েছে দাদা। লাভ ইট।“

উৎসাহ পেয়ে গেলাম। সেলফির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেন্টে আমার কোটেশন চলতে থাকল সুযোগ মতো। সেদিন একটা সুন্দর কাজ করা হলুদ রঙের শাড়ি পরে একটা সেলফি পোস্ট করল। তাতে স্বাভাবিকভাবেই মনে এল রূপসী বাংলার একটা লাইন,

“সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ‘পর—শঙ্খমালা নাম তার”

লাইনের মধ্যেই রূপের প্রশংসা করা হয়েছে, তাই আলাদা করে আর সেটা বলতেও হলো না।

তারপর একদিন শেফালীদের বাড়িতে পার্টি, ওর বাড়ির ডেকে দাঁড়িয়ে ওর কয়েকজন বান্ধবীদের সাথে একটা গ্রুপ সেলফি পোস্ট করল। শেফালী, রিনিকা, শ্রেয়শী, সুচেতনা – এরা সব আছে সেই ছবিতে, ট্যাগও করা আছে ওদের। ওরা তো শুধু সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতীও বটে, তাই জীবনানন্দ থেকে নিয়ে কমেন্ট করলাম

“সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী,
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে মেধাবিনী।“

দেখলাম ওদের সকলেরই কথাটা খুব ভালো লেগেছে। লাভ ইমোজি দেওয়া ছাড়াও সকলেই কমেন্ট লিখেছে উত্তরে। তাই মনে হল আরও দুলাইন লিখি, বিশেষ করে ওদের বরেরাও যখন সব সফল, প্রতিষ্ঠিত, সেটাও ওদের এক শ্লাঘার বিষয়, সেকথাও বলতে হবে বই কি? তাই আরও লিখলাম

 “কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো

পুরুষ তাদের ঃ কৃতকর্ম নবীন”

ওরা সবাই দারুণ খুশি। ফ্যান হিসেবে আমার ভিসিবিলিটি চড়চড় করে বেড়ে গেল।

দেখতে দেখতে চলে এল সেই বিশেষ দিন, শেফালীর জন্মদিন। ওকে সবাই প্রচুর উইশ করছে। তবে শুধু হ্যাপি বার্থ ডে বলার কোনও মানে হয় না। একটু বিশেষ করে কিছু তো লিখতে হবে। তাই রবি ঠাকুরের শরণাপন্ন হতে হল।

“জন্মের দিনে দিয়েছিল আজি তোমারে পরম মূল্য

রূপসত্তায় এলে যবে সাজি সূর্যতারার তুল্য।“

না, এর থেকে সুন্দর উইশ কেউ লেখে নি। আবির, অরুণমেসো ওদের অনেকদূরে ছাড়িয়ে আমি তখন এক নম্বর ফ্যান হয়ে উঠতে পেরেছি।

তারপর বর্ষা এসেছে। শেফালী খুব রোমান্টিক, ভিজতে ভালোবাসে। বৃষ্টিভেজা একটা অপার্থিব সেলফি পোস্ট করেছে দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন থেকে কমেন্টে লিখে দিলাম

“রূপালি মানবী, সন্ধ্যায় আজ শ্রাবণ ধারায়

ভিজিও না মুখ, রূপালি চক্ষু, বরং বারান্দায়

উঠে এসো।”

তার উত্তরে শেফালী হা হা ইমোজি দিয়ে প্রশ্রয়ের সুরে লিখেছে, “ইউ আর নটি”। আমিও একটা হাহা ইমোজি দিলাম।

দারুণ জমে উঠেছে খেলাটা। এবার ঝড়ের হাওয়ায় এলোচুল মেলে একটা সেলফি পোস্ট করল। দেখেই আমার মনে পড়ল কয়েকটা পংক্তি ---

“এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;

কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!

তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে

কবেকার সমুদ্রের নুন!”

কিছুটা সন্দেহ ছিল চুলের মধ্যে নুন আছে বলাতে কেমনভাবে রিয়্যাক্ট করবে। কিন্তু দেখা গেল সেসব আশংকা অমূলক। লাইন কটা ওর খুবই পছন্দ হয়েছে। বল, “দাদা, দারুণ মিলিয়েছ।“ আমি লিখলাম, জীবনানন্দ মিলিয়েছেন। তবে মনে মনে ভাবলাম, জীবনানন্দ লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু সার্থক প্রয়োগ করেছি আমি, সেটাও কম কৃতিত্বের নয়।

এরকম করে চলতে থাকে অনেক অনেক দিন। মাঝে মাঝে শেফালীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখাও হয় পার্টিতে। অনেক গল্প করে। ওর খুশি দেখে ভালো লাগে।

তখন শরৎ এসেছে। ঊজ্জ্বল আলোয় ভরে গেছে চারিদিক। বর্ষার শেষে সবুজের সমারোহ। লনে নিখুঁত গালিচার মতো কচি সবুজ ঘাস। বাড়ির ডেকে দাঁড়িয়ে একটা সেলফি তুলে পোস্ট করেছে শেফালী। ঠিক যেন, ‘সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর, তেমনই দেখেছি তারে’। আমি কত চেষ্টা করি আমার লনের ঘাসটা সুন্দর সবুজ রাখার, কিছুতেই পেরে উঠি না, অথচ শেফালীর লনটা কি সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে আমি কমেন্ট করলাম, “কি অপূর্ব ঘাস তোমার লনের। কি সুন্দর মেন্টেন করো! তোমার ল্যান্ডস্কেপারের কন্ট্যাক্টটা একটু দিও।“

 শেফালীর কোনও উত্তর পেলাম না। মনমরা লাগল। আরও দুদিন গেল, শেফালীর কোনও পোস্টও আর চোখে পড়ে না ফেসবুকে। এরকম তো হয় না, শরীর খারাপ নয় তো। কিন্তু ওরকম দুম করে জিজ্ঞাসা করা যায় নাকি, “তোমার কি শরীর খারাপ? সেলফি পোস্ট করছ না কেন?”

দুদিন বাদে আর একটা পার্টিতে আবার আবিরের সঙ্গে দেখা। সিগারেট খাবার জন্য ও বেরোলে ওর সঙ্গে আবার বেরোলাম। ওকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাঁ রে, শেফালীর কি হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি? ফেসবুকে আর কিছু পোস্ট করে না তো।“

আবির অবাক হয়ে বলল, “তা তো না, পোস্ট তো করছেই। কেন, তুমি পাচ্ছ না?”  

একটা আশংকা ধক করে ওঠে। মোবাইলটাতেই তখন ফেসবুক খুলি। ফ্রেন্ডলিস্ট খুঁজতে থাকি। কোথাও শেফালী নেই! কি ব্যাপার? আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে। সে কি!

আবিরও আশ্চর্য হল, বলল, “তুমি তো খারাপ কথা কিছু লিখবে না। তাহলে? শেষ কমেন্ট কি লিখেছিলে মনে আছে?”

বললাম ঘটনাটা। আবির বলল, “তুমি দেখালে বটে! আক্কেল বলে কি কিছু নেই? ঘাস নিয়ে তুমি যে আদেখেলেপনা করলে না, গরুও ওরকম করে না। তা তুমি ফুল, পাখি, চাঁদ, পাহাড়, নদী, আকাশ, বাতাস, মেঘ, ঘাস, গাছ --- যার খুশি প্রশংসা করো না কেন, তা বলে শেফালীকে ইগনোর করে শুধু সেই কথাটা বলা ওর পক্ষে কত অপমানজনক ভাবো তো? বেশ তো কোটেশন ঝাড়ছিলে, নিজে লিখতে গিয়েই গন্ডগোল পাকালে।“

সত্যি খুব ভুল হয়ে গেছে, তবে শেফালী কি সেটা একটু বুঝতে পারত না? বেশ, ‘না হয় যত্ন করে ভুলেই যেও’। বুঝলাম, যে কোনও ব্যাপারেই এক নম্বর জায়গাটা ধরে রাখা কত কঠিন।


----------- 
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, জুলাই ২০২০ 
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন