বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০

রূপকথার রাজনীতিক হেনরি ওয়ালেস

 

রূপকথার রাজনীতিক হেনরি ওয়ালেস

-শুভাশিস ঘোষাল



হেনরি এগার্ড ওয়ালেস নামটা এখন আমেরিকাতেই প্রায় বিস্মৃত, বাকি পৃথিবীতে হয়তো খুব কম লোকেই তাঁর নাম শুনেছে। অথচ ইতিহাসের মোড় শেষ মুহুর্তে ঘুরে না গেলে হয়তো তিনিই হতেন বিংশ শতাব্দীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাহলে হয়তো পৃথিবীটা হতো অনেক অন্যরকম, অনেক মানবিক।

ইতিহাস বই থেকে জানা যাবে যে হেনরি ওয়ালেস আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি। কিন্তু সে তো অনেকেই আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি হয়েছেন, সারা পৃথিবীতে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন। শুধু সেজন্য তাঁকে স্মরণ করার কারণ নেই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্টাডস টার্কেল বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীতে তিনজন শ্রেষ্ঠ আমেরিকানের দুজন  --- ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট (এফ ডি আর) আর ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ঘরে ঘরে পরিচিত নাম। সেরকমই হওয়া উচিত ছিল তৃতীয় জনের --- হেনরি ওয়ালেসের নাম”। স্বয়ং এফ ডি আর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেনরি ওয়ালেসের থেকে বেশি আমেরিকার ভূমিপুত্র আর কেউ নন”। কেন? কারণ ইতিহাসের এক করাল অধ্যায়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও অন্তর্দৃষ্টি মানবসভ্যতাকে সামনের পথে এগোতে সাহায্য করেছিল। এক সৌভ্রাতৃত্বের পৃথিবী তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আমেরিকার রাষ্ট্রপতিপদে তিনি বসলে তাঁর চিন্তাধারা প্রয়োগ করা সম্ভব হতো। এবং সেই সুযোগ প্রায় হাতের মুঠোয় এসেও একটুর জন্য হারিয়ে যায়।

হেনরি ওয়ালেসের জন্ম ১৮৮৮ সালের ৭ই অক্টোবর আইওয়া রাজ্যে এক বিখ্যাত পরিবারে। আইওয়া কৃষিপ্রধান রাজ্য, ওয়ালেস পরিবারের এক বিশাল ফার্ম ছিল। তাঁর পিতামহ, যার নামও ছিল হেনরি ওয়ালেস, একটি ফার্ম পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর বাবা হেনরি ক্যান্টওয়েল ওয়ালেস আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন ও রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন হার্ডিং আর কেলভিন কুলিজের সরকারে আমেরিকার কৃষিসচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন। হেনরি ওয়ালেস পশুপালনবিদ্যায় স্নাতক হবার পর পরিবারের ব্যবসা দেখতেন ও ফার্ম পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। রিপাবলিকান পরিবারে বড়ো  হলেও এফ ডি আরের রাজনৈতিক বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে বিপর্যয়কর ধ্বসের পর তিরিশের দশকের গোড়ায় মহামন্দায় আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে অর্থনীতি ধুঁকছিল। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এফ ডি আর। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রস্তাব করেন তাঁর বিখ্যাত ‘নিউ ডিল’, যা প্রভূত সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান করবে। এ ব্যাপারে এফ ডি আর ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্সের অনেক পরামর্শ নেন। কৃষিসচিব হিসেবে এফ ডি আর বেছে নেন ওয়ালেসকে। নিউ ডিলের সার্থক রূপায়নে ওয়ালেস ছিলেন এফ ডি আরের প্রধান ভরসা। তাঁর প্রগতিশীল নীতিগুলোর রূপায়ন করতে  এফ ডি আর ক্যাবিনেটে হেনরি ওয়ালেস, ফ্রান্সিস পার্কিন্স, হেনরি হপকিন্স ও রেক্স টাগওয়েলের বিশেষ সমর্থন পেয়েছিলেন। তাঁরা কারখানার শ্রমিক, শহরের গরীব ও কৃষকদের স্বার্থের অনুকুল নীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করতেন। তবে রিপাবলিকানরা ও ব্যবসায়ীদের অনেকে চড়া কর ও প্রচুর সরকারি লগ্নির বিরোধী ছিল, আবার কৃষক সংগঠনগুলো মনে করত যে যথেষ্ট সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। এমনকি নীতি রূপায়নের প্রশ্নে  ক্যাবিনেটেও বাণিজ্যসচিব জেসি জোন্সের সাথে ওয়ালেসের বিরোধ বাঁধে। এফ ডি আরের নিউ ডিলের অন্তর্গত ওয়ালেসের করা কৃষি ও পশুপালন সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক, তার কারণ ওয়ালেস নিজেও ছিলেন একজন বিজ্ঞানী আর পরিসংখ্যানবিদ। তিনি সঠিক  তথ্য সংগ্রহ করে ও পরিসংখ্যানবিদ্যা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। যেমন, সেই সময় কৃষি ও পশুপালনে আয় কমে যাবার কারণ ছিল মন্দার জন্য চাহিদা কমে যাওয়া সত্ত্বেও অধিক উৎপাদনে দাম পড়ে যাওয়া। দাম স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজন ছিল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা করে উৎপাদনের মাত্রা ঠিক করা। ওয়ালেস হিসেব করে তুলোর উৎপাদনের পঁচিশ শতাংশ ও ষাট লক্ষ শূকরছানা ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। চাষিদের ক্ষতি কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে পুষিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বাজারে ভারসাম্য ফিরে আসে। কৃষিজমির মাটি সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় খরচে ঢাল বসানো, ও চাষিদের অনুর্বর বা অসুরক্ষিত জমি চাষ না করতে রাজি হবার বদলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নীতি তিনি চালু করেন। কৃষিপণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা আনার ও দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণের জন্য শস্যভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। ওয়ালেসের কৃষিনীতি সহ নিউ ডিলের পরিকল্পনাগুলি আমেরিকার অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছিল। এ ছাড়া ওয়ালেসের তত্ত্বাবধানে অনেকগুলো জনকল্যাণমূলক প্রকল্প নেওয়া হয়, যেমন চাষিদের নিখরচায় বিদ্যুতের যোগান দেওয়া, অভাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা করা ও গরিব পরিবারদের জন্য খাবার কেনার কুপন ফুডস্ট্যাম্প দেওয়া, ইত্যাদি। দেশের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ওয়ালেস ১৯৩৪ সালে প্রায় সব কটি রাজ্য মিলে সড়কপথে চল্লিশ হাজার মাইল পাড়ি দেন ও বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

হেনরি ওয়ালেস পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সেই সময় পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর একটাই বই ছিল, আডনি ইউলের লেখা। ওয়ালেস সেই বই থেকে নিজে নিজেই পরিসংখ্যানবিদ্যা শেখেন। ১৯২৫ সালে (পরে) প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ জর্জ স্নেডেসরের সঙ্গে একত্রে তিনি একটি গবেষণাপত্র লেখেন যন্ত্রগণক ব্যবহার করে মাল্টিপ্ল লিনিয়ার রিগ্রেসনের (একটি রাশিকে একাধিক সম্পর্কিত চলগ রাশির সম্ভাব্য সরলরৈখিক অপেক্ষক হিসেবে প্রকাশ করার পদ্ধতি) সমীকরণ সমাধান করার পদ্ধতির উপর। এর ফলে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ১৯২৭ সালে বিমূর্ত পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণা শুরু হয়। ওয়ালেসের চেষ্টায় ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানবিদ্যার বিভাগও চালু হয় সেখানে ও ওয়ালেস নিজে দশ সপ্তাহ একটা পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর কোর্স পড়ান। কৃষিসচিব থাকাকালীন তিনি আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিকে কৃষিক্ষেত্রে সরকারি নমুনা-সমীক্ষার ও তার বিশ্লেষণের অনেক দায়িত্ব দেন। সরকারের কৃষিবিভাগেও তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যার সেমিনার চালু করেন। শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব আনা স্ট্যাটিস্টিকাল কোয়ালিটি কন্ট্রোল খ্যাত ওয়াল্টার শুয়ার্টের সেমিনার থেকে পাওয়া ধারণা ওয়ালেস সেন্সাস ব্যুরোয় চালু করেন। প্রখ্যাত বৃটিশ পরিসংখ্যানবিদ স্যার রনাল্ড ফিশারকে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার দিতে আনার জন্য ওয়ালেসের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওয়ালেসের মত ছিল “অর্থনীতিবিদরা তাত্ত্বিক অর্থনীতিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন, তবে সত্য আসলে লুকিয়ে থাকে তথ্যে, যা একমাত্র পরিসংখ্যানবিদ্যা দিতে পারে”। এ ছাড়া তাঁর আর একটি (অসমর্থিত সূত্রে প্রাপ্ত) প্রখ্যাত উক্তি ছিল, “ভবিষ্যতে ভালভাবে অবহিত সচেতন নাগরিক হতে গেলে মাল্টিপ্ল লিনিয়ার রিগ্রেসন বোঝা বিশেষ প্রয়োজন”।  তবে ওয়ালেস মূলতঃ ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী, তাঁর পরিসংখ্যানবিদ্যায় আগ্রহ এসেছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এইচ এল মুরের একটি গবেষণাপত্র পড়ে, যেখানে খুব সহজে বোঝানো ছিল পরিসংখ্যানবিদ্যার কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি কি করে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতিতে ও কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ মূল্য পূর্বাভাস করতে সাহায্য করতে পারে। আইওয়া সহ আমেরিকার মাঝের অংশের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলির অর্থনীতির বুনিয়াদ ও  প্রধান কৃষিপণ্য হল ভুট্টা, যা রুটি তৈরি ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। ওয়ালেস একধরণের উচ্চফলনশীল সংকর ভুট্টা তৈরি করেছিলেন। এই সাফল্য হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার ফলে নয়, পরিকল্পনামতো খোঁজার ফল।  ১৯২৬ সালে তিনি পায়োনিয়ার হাই-ব্রেড কোম্পানির পত্তন করেন এই নতুনজাতের ভুট্টার বীজ উৎপাদন ও বিক্রির জন্য। আইওয়া রাজ্যের ভুট্টার ৯৮% শতাংশই ওয়ালেসের কোম্পানির বীজ থেকে হতো। এই বীজের বিপণনের জন্য ওয়ালেস এক অভিনব পদ্ধতি নিয়েছিলেন। চাষিদের বিনামূল্যে বীজ দিয়ে বলেছিলেন অর্ধেক প্রচলিত ভুট্টা আর অর্ধেক নতুন ভুট্টা চাষ করতে। পরে নতুন ভুট্টার বাড়তি উৎপাদনের ফলে লাভের একটা অনুপাত দিয়ে পায়োনিয়ার কোম্পানির দেওয়া বীজের দাম মেটাতে। আর পায়োনিয়ার একা এত বীজের চাহিদা মেটাতে পারবে না বলে অন্য কোম্পানিদেরও তিনি বীজের ফর্মুলা দিয়ে উৎপাদন করতে উৎসাহ দেন। তা ছাড়া এখন সারা পৃথিবীতে যত ডিম উৎপাদন হয়, তার প্রায় অর্ধেকই আসে পায়োনিয়ারের ব্রিড থেকে তৈরি করা মুরগি থেকে। উল্লেখ্য, পায়োনিয়ার ১৯৯৯ সালে ডুপন্ট কোম্পানি কিনেছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডলারে। ওয়ালেসের আর একটি বিশেষ অবদান হল কৃষিপণ্যের ও গবাদি পশুর ভবিষ্যৎ মূল্যের পূর্বাভাসের “রেশিও পদ্ধতি” উদ্ভাবন। এই পদ্ধতির মূলমন্ত্র হল দীর্ঘমেয়াদে পণ্যের মূল্য পরষ্পরের সঙ্গে নির্ভরশীল, যেমন ভুট্টা ও শূকরের মাংসের দাম। ফলে মাল্টিপ্ল রিগ্রেসন পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের মূল্যের পূর্বাভাস করা সম্ভব। ওয়ালেস ১৯২০ সালে একটি বই লেখেন খুব সহজ ভাষায়, যাতে রেশিও পদ্ধতি অনুসরণ করে সাধারণ চাষিরা তাদের পণ্যের মূল্য অনুমান করতে পারে। ১৯৪০ সালে উপরাষ্ট্রপতি হবার পর এফ ডি আরের পরামর্শে ওয়ালেস ছ সপ্তাহ মেক্সিকোতে থেকে মেক্সিকো সরকারকে কৃষিনীতি প্রণয়নে সহায়তা করেন। যুদ্ধোত্তরকালে সারা পৃথিবীতে সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ার পিছনেও ওয়ালেসের বিরাট অবদান রয়েছে। রকাফেলার ফাউন্ডেশনকে চিঠি লিখে তিনি অনুরোধ করেছিলেন আন্তর্জাতিক কৃষিগবেষণার একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। তার ফলশ্রুতি হিসেবে তারা নর্ম্যান বর্ল্যাগের নেতৃত্বে সেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। বর্ল্যাগ ১৯৭০ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান উচ্চফলনশীল রোগ-নিরোধক গমের বীজ তৈরি করে। অনুমান করা হয় এর ফলে সারা পৃথিবীতে খাবারের যোগান বাড়ার ফলে একশ কোটি মানুষের প্রাণ বেঁচেছিল। এফ ডি আরের ক্যাবিনেটে ওয়ালেসই ছিলেন একমাত্র বিজ্ঞানী। ওয়ালেসের মতো একজন সর্বোচ্চস্তরের রাজনীতিক নিজেও একজন প্রথমসারির বিজ্ঞানী, এরকম নজির পৃথিবীতে আর নেই।

হেনরি ওয়ালেস সব অর্থেই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিক। ওয়াশিংটনে বিরাট দায়িত্ব পালন করলেও তিনি ওয়াশিংটনের অন্দরমহলের রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন নি। সন্ধেবেলায় যেসব পার্টি দেওয়া হত, সেখানে না গিয়ে ওয়ালেস খেলাধুলো করতে ও বই পড়তে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিনি ধুমপান বা মদ্যপান করতেন না। নিজে খৃষ্টান হলেও বৌদ্ধধর্ম, জরথ্রুষ্টের মতবাদ ও আমেরিকার প্রাচীন উপজাতি নাভাহোদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তিনিই প্রথম শ্বেতাঙ্গ যিনি নেটিভ আমেরিকান সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন।

১৯৩৩-১৯৩৯ এ এফ ডি আরের প্রথম দুই মেয়াদের সরকারে ওয়ালেস কৃষিসচিব হিসেবে অসামান্য দক্ষতা দেখানোয় ১৯৪০ এর ভোটে এফ ডি আর তৃতীয়বারের মেয়াদের জন্য ওয়ালেসকে উপরাষ্ট্রপতি করতে চান। সাধারণতঃ আমেরিকায় দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না, তবে তখন মহামন্দার রেশ রয়ে গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে, এরকম একটা জটিল পরিস্থিতিতে এফ ডি আরের মতো বিরাট জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে রাষ্ট্রপতিপদে দরকার, দেশের লোকে মনে করছিল। কিন্তু সোজাসাপটা কথা বলা ‘রাজনীতিতে বেমানান’ ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার ওয়ালেসকে অপছন্দ করার লোকের অভাব ডেমোক্র্যাটিক দলেও ছিল না। তাদের অনেকেরই মতে ওয়ালেস সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট শাসকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এফ ডি আর ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জার্মানিতে ফ্যাসিস্টদের উত্থানে এফ ডি আর খুবই চিন্তান্বিত ছিলেন, কিন্তু আমেরিকার সাধারণ মানুষ ইউরোপে আর একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে রাজি ছিল না।  তা ছাড়া যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা ও যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন, এ ব্যাপারেও ওয়ালেসের মতকে এফ ডি আর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কারণ ওয়ালেস বিদেশনীতি সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্ব ওয়ালেসের মনোনয়নে আপত্তি জানালে এফ ডি আর তখন রাষ্ট্রপতিপদে মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করবেন বলেন। এবার পার্টির নেতৃত্ব ওয়ালেসকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

জিতে আসার পর এফ ডি আর ওয়ালেসকে যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক পরিষদের প্রধানপদ সহ  অনেক দায়িত্ব দেন।  নির্বাচনের সময় এফ ডি আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আমেরিকা নিজে আক্রান্ত না হলে যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু ফ্যাসিজমের বিপদ দেখে এফ ডি আরের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে ব্রিটেন-ফ্রান্সকে সামরিক সাহায্য দেবার ব্যবস্থা করেন। মার্কিন কংগ্রেসকে সে ব্যাপারে রাজি করাতে যথেষ্ট বাধা পেরোতে হয়েছিল। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের পতন হয় ও হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে যুদ্ধের পরিধি অনেক বেড়ে যায়। জার্মানিকে রুখতে যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করা দরকার, এফ ডি আর বুঝেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বকে পাশে পাচ্ছিলেন না। তাঁর ক্যাবিনেটে ওয়ালেসকে পাশে পেয়েছিলেন, কারণ ওয়ালেস সমস্যাটার গুরুত্ব বুঝতেন। ওদিকে জাপানের সঙ্গে আমেরিকার বিরোধ বাড়তে বাড়তে ১৯৪২ সালে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হিটলারও অবিমৃষ্যকারীর মতো আমেরিকার বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এফ ডি আরের জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আর বাধা থাকে না। জার্মানির সম্ভাব্য পরমাণু অস্ত্রের গবেষণার খবর শুনে আমেরিকাতে যখন পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেই বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট তদারক করার কমিটির প্রধানও ছিলেন ওয়ালেস। সামরিক ও বৈদেশিক নীতিতে ওয়ালেস অনেক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৩ সালে এফ ডি আরের নির্দেশে লাতিন আমেরিকা সফরে গিয়ে মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যে তিনি বারোটি রাষ্ট্রকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় রাজি করান। ওয়ালেস এত দায়িত্ব সামলাতেন যে রাজনৈতিক মহলে তিনি ‘সহকারী রাষ্ট্রপতি’ বলে পরিচিত হন।

১৯৪২ সালের ৮ই মে ওয়ালেস “সাধারণ মানুষের শতাব্দী” নামে একটি বিখ্যাত ভাষণে বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন “আমেরিকার যুদ্ধকালীন লক্ষ্য হল গোলামির বিরুদ্ধে মুক্ত পৃথিবীর জন্য লড়াই। আধুনিক বিজ্ঞান সবার জন্য যথেষ্ট খাদ্য তৈরির উপায় করেছে। কিন্তু তার সুষ্ঠু বন্টনের জন্য চাই পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের পরষ্পরের সঙ্গে সহযোগিতা। যাতে কি না সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মান উন্নত হতে পারে।'' তিনি যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ করার আহ্বান জানান এই বলে যে, কোনও জাতির অপর কোনও জাতির উপর শাসন করার ও তাদের সম্পদ শোষণ করার কোনও অধিকার থাকতে পারে না। ওয়ালেসের বক্তৃতা সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয় --- কুড়িটা ভাষায় অনুবাদ হয়ে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বিতরণ হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ব্যাপারে এফ ডি আরের সঙ্গে ওয়ালেসের দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ মিল ছিল। এফ ডি আর ইউরোপীয় জাতিগুলির এশিয়া ও আফ্রিকায় সাম্রাজ্য ও উপনিবেশের বিরোধী ছিলেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের অন্যতম কারণ হল উপনিবেশবাদ, এবং ব্রিটেন-ফ্রান্স-নেদারল্যান্ডসের এশীয় সাম্রাজ্যে শোষণ এবং ভুল পদক্ষেপের কারণেই যে জাপানী সাম্রাজ্যবাদের উত্থান এবং সেজন্য আমেরিকান সৈনিকদের মরতে হচ্ছে, সেকথা মনে করিয়ে এফ ডি আর ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে যুদ্ধের পর উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে বলেন। ফিলিপাইনে আমেরিকার যে উপনিবেশ ছিল, ১৯৪৬ সালেই আমেরিকা ফিলিপিনোদের হাতে তাদের দেশের ভার ছেড়ে দেবে বলে এফ ডি আর জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও জরুরী। যুদ্ধের পর আমেরিকা উদ্যোগ নেবে যাতে প্রাক্তন উপনিবেশের দরিদ্র দেশগুলি তাদের দেশ গড়ে তোলার জন্য ঋণ পায়। আমেরিকার সরকারের এই উপনিবেশ বিরোধী মনোভাবে তাদের প্রধান শরিক ব্রিটেনের ও ফ্রান্স সহ অন্যান্য ইউরোপীয় শরিকদের যথেষ্ট চিন্তা ছিল। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এ ব্যাপারে তাঁর অনীহার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এই বলে যে (ইংল্যান্ডের) রানির সাম্রাজ্য গুটিয়ে ফেলার জন্য তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন নি। চার্চিলের সঙ্গে ওয়ালেসের মতবিরোধ ছিল সুবিদিত। এমনকি ওয়ালেস সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি দুর্বল, এইরকম ধারণার বশবর্তী চার্চিল গোপনে ওয়ালেসের পিছনে গোয়েন্দাও লাগিয়েছিলেন।

ফ্যাসিবাদ যে শুধু জার্মানি বা ইউরোপে নয়, খোদ আমেরিকাতেও যথেষ্ট চিন্তার কারণ, তা ওয়ালেস তাঁর ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে “আমেরিকায় ফ্যাসিবাদের বিপদ” বলে এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সত্যকে বিকৃত করা, অনৈক্য ছড়ানো, অতি-দেশপ্রেমিক সাজা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে দাবানো, মুখে স্বাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা বললেও কার্যত একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা করা, সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, ইত্যাদি হল ফ্যাসিবাদের লক্ষণ ও আমেরিকায় তা যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত বলে সতর্ক করেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টের প্রধান পরিচালক লেসলি গ্রোভস সহ  আমেরিকায় উচ্চপদে থাকা অনেককেই তিনি উগ্র সোভিয়েতবিরোধী ফ্যাসিবাদী মনোভাবের মনে করতেন। যুদ্ধের অর্থনীতি আমেরিকার মালিকশ্রেণিকে অভূতপূর্ব মুনাফা এনে দিচ্ছিল, কিন্তু মজুরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ছিল না, শ্রমিকদের বিনা ছুটিতে ক্রমাগতঃ কাজ করে যেতে হচ্ছিল। প্রতিবাদে ১৯৪৪ সালে রেকর্ড সংখ্যায় ধর্মঘট হয়, দশ লক্ষ শ্রমিক তাতে যোগ দেয়। পুলিশের পীড়নও বাড়ে তার সঙ্গে। ডেট্রয়েট শহরে জাতিদাঙ্গায় পুলিশের গুলিচালানোয় অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মারা যায়। ওয়ালেস পরিস্থিতি দেখে এসে মন্তব্য করেন, নিজেদের দেশে মানুষকে আমরা এরকম পীড়ন করলে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়ার নৈতিক শক্তি আমাদের থাকবে না। তাঁর সেই কথা প্রতিধ্বনিত্ব হয় আবার কুড়ি বছর পরে, ষাটের দশকে আমেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলনে ডঃ মার্টিন লুথার কিং এর কথায়।  যুদ্ধের সময় জাপানি-আমেরিকানদের শত্রু চিহ্ণিত করে তাদের ঘেরাটোপে আটকে রাখা বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সরকারি নীতির বিরোধিতাও করেছিলেন ওয়ালেস। ওয়ালেসের বিরোধীরা তাঁকে অতিসরল, ভাবালু, কল্পনাপ্রবণ, কমিউনিস্ট বলে চিহ্ণিত করেন। প্রকৃতপক্ষে যা কিছু অপছন্দের, তাকেই কমিউনিজম বলে দেগে দেবার প্রবণতা আমেরিকায় ছিল, যা এখনও আছে। ডেমোক্র্যাটিক দলেও ক্রমশঃ তাঁর বিরোধীরা শক্তিশালী হতে থাকে।

তখন ১৯৪৪ সালের নির্বাচন প্রায় আসন্ন। যুদ্ধ ও রাষ্ট্র চালানোর ধকল এবং অতিরিক্ত ধুমপানের ফলে এফ ডি আরের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়ছে। ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতৃত্ব শংকিত হয়ে ওঠেন, যদি এফ ডি আরের মৃত্যু হয়, তাহলে উপরাষ্ট্রপতি ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন। তাঁরা এফ ডি আরকে চাপ দিতে থাকেন ওয়ালেসকে এবার উপরাষ্ট্রপতিপদে টিকিট না দেবার জন্য, কারণ তা হলে দলে ভাঙ্গন হতে পারে। এফ ডি আর ওয়ালেসের মতো দক্ষ এবং সহমর্মীকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে চান, কিন্তু ভগ্ন শরীরে তাঁর চিন্তাধারাকে রাজনৈতিক নেতাদের বোঝাতে বোঝাতে তিনি ক্লান্ত। দলের নেতৃত্বকে তিনি পরিষ্কার কিছু জানান না। ওয়ালেস তখন এফ ডি আরেরই নির্দেশে চীনে গিয়েছিলেন যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। চীনের শাসক চিয়াং-কাই-শেক ও তাঁর আমেরিকায় শিক্ষিত স্ত্রী আমেরিকার রাজনৈতিক মহলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু ওয়ালেস ফিরে এসে তাঁর রিপোর্টে জাপানিদের প্রতিরোধে মাও-জে-দংএর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা জানান। অত্যন্ত বিতর্কিত বলে তাঁর সেই রিপোর্টকে চেপে দেওয়া হয়। জুলাই মাসে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলন হয় শিকাগোতে। দলের নেতৃত্ব চাইছিলেন মিসৌরির সেনেটর হ্যারি ট্রুম্যানকে উপরাষ্ট্রপতিপদে। বলতে গেলে তাঁর একমাত্র যোগ্যতা ছিল কম শত্রুসংখ্যা। তবে ওয়ালেসের দিকে পাল্লা ভারী ছিল, কারণ তার পিছনে ছিল অধিকাংশ প্রতিনিধির সমর্থন। আর আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওয়ালেসকেই চাইছিলেন। এফ ডি আরের স্ত্রী এলিনর রুজভেল্টও ওয়ালেসকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। ভোট নেওয়া হলে প্রথম রাউন্ডে ওয়ালেস অনেক এগিয়ে থাকেন। সেই সময় দলের নেতৃত্বের চাপে সম্মেলন মুলতুবি রাখা হয়। সেই রাত্রে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদের টাকা ও পদের লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয়। পরের দিন দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে ওয়ালেস এগিয়ে শুরু করেও পরে পিছিয়ে পড়েন। তাঁর সমর্থকদের অনেকে, যারা প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে গেছিল, তাদের ভোট নেওয়া যাবে না বলে জানানো হয়। শেষমেষ ট্রুম্যানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নিজে ওয়ালেসকে চাইলেও দলের নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ এড়াতে এফ ডি আর সেটা মেনে নেন। এফ ডি আর তাঁর সমর্থনে না দাঁড়ানোয় ওয়ালেস মর্মাহত হন, তবে এফ ডি আরের নেতৃত্বের সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। এফ ডি আর আবারও ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতি হন, আর ট্রুম্যান উপরাষ্ট্রপতি। ওয়ালেসকে ক্যাবিনেটে আহ্বান করা হয়, তিনি বাধ্য সৈনিকের মতো এই পদাবনতিতেও রাজি হন। তাঁকে আবার তাঁর পছন্দমতো বাণিজ্যসচিবের পদ দেওয়া হয়, তবে আর অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্বে রাখা হয় না।

সেদিন শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলনে ওয়ালেসের বদলে ট্রুম্যানকে মনোনয়ন দেবার সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে। নির্বাচিত হবার কয়েকমাসের মধ্যেই এফ ডি আর মারা যান। হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এসে পড়ে ট্রুম্যানের উপর। এইরকম একটা গুরুদায়িত্ব পালন করতে যে অন্তর্দৃষ্টি লাগে, ট্রুম্যানের তা ছিল না। রক্ষণশীল মিসৌরিতে বড়ো হওয়া ট্রুম্যানের সঙ্গীরাও ছিলেন নিতান্ত স্থানীয় স্তরের রাজনীতিক। আর ছিল আমেরিকার গড়পড়তা সাধারণ রাজনীতিবিদদের মতো তীব্র সোভিয়েত বিদ্বেষ। বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি ছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে  যদি জার্মানি জিততে থাকে রাশিয়াকে সাহায্য করতে হবে, আর রাশিয়া জিততে থাকলে জার্মানিকে, যাতে তারা পরষ্পরকে যতসম্ভব মারতে পারে। এফ ডি আর রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এইসব মতকে উপেক্ষা করতেন। রাশিয়া যে জার্মানিকে সবথেকে বেশি রুখছে, সে কথা তিনি স্বীকার করতেন। রাশিয়াকে সাহায্য করার জন্য ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন ১৯৪৩ এর বসন্তকালের মধ্যেই খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু চার্চিলের অসহযোগিতায় তা প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে গেছিল শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনে আমেরিকা টাকা দেবে এবং তার অর্ধেক যাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে, এমন পরিকল্পনা ছিল এফ ডি আরের। তাঁরই উপরাষ্ট্রপতি হলেও ট্রুম্যানকে তিনি আদৌ গুরুত্ব দিতেন না --- মাত্র দুবার তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। ম্যানহাটন প্রজেক্ট সম্পর্কেও ট্রুম্যানকে কিছুই জানান নি এফ ডি আর। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি ট্রুম্যান অভিষিক্ত হবার সময় ততদিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে গিয়েছিল। নর্মান্ডিতে মিত্রসেনার অবতরন ঘটে আগেই --- জার্মানির পরাজয় তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯৪৫ সালে মে মাসে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। জুলাই মাসে আমেরিকা সফলভাবে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে। বোমার যে মূল অভিপ্রায় ছিল জার্মানির সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমার প্রতিরোধ করা, তার আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কিন্তু এই নতুন লব্ধ অপরিসীম শক্তি ট্রুম্যানের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। বিশ্বশক্তির নেতৃত্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্রমশঃ ব্রিটেনের কাছ থেকে আমেরিকার হাতে চলে আসছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তা সম্পূর্ণ হয়। বিদেশনীতিতে বিশেষ ধারণা না থাকায় ট্রুম্যান বিশেষকরে তীব্র সোভিয়েত বিদ্বেষী বর্ণবিভাজনবাদী দক্ষিণের রাজনীতিক জিমি বার্নসের উপর নির্ভর করতে থাকেন, যাকে তিনি বিদেশসচিব করেছিলেন। আমেরিকার বিদেশনীতি ক্রমশঃই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর কঠোর হতে থাকে। যুদ্ধের শেষে নতুন করে দেশ গড়ে তোলার জন্য এফ ডি আরের প্রতিশ্রুত আমেরিকান সাহায্য প্রায় সবই ব্রিটেন ও পশ্চিমী দেশগুলোয় পাঠানো হয়।  দুই দেশের ব্যবস্থায় বিরাট তফাৎ থাকলেও এফ ডি আর আর স্তালিনের মধ্যে একটা পারষ্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, ট্রুম্যানের সময় হঠাৎ আমেরিকার মনোভাব পরিবর্তনে স্তালিন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন। এফ ডি আরের বিরাট ব্যক্তিত্ব ট্রুম্যানের ছিল না, খর্বকায় হওয়ায় ও নারীসুলভ কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য ছোটবেলায় ট্রুম্যান সঙ্গীসাথীদের অনেক বিদ্রূপের শিকার হয়েছিলেন। তাই মনে করা হয় ট্রুম্যানের মানসিকতায় শক্তিপ্রদর্শনের একটা অদম্য ইচ্ছা ছিল। জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত তিনি নেন। অথচ ততদিনে জাপান প্রায় পরাজিত --- সম্মানজনক আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজছে, সম্রাটকে সরাতে না হলেই তারা যুদ্ধ শেষ করতে রাজি ছিল। ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীরা অনেকে ট্রুম্যানকে অনুরোধ করেছিলেন পরমাণু বোমা প্রয়োগ না করতে। আমেরিকার দুই প্রধান কম্যান্ডার আইসেনহাওয়ার এবং ম্যাকআর্থারও বলেছিলেন এই বোমা ফেলার কোনও সামরিক প্রয়োজন নেই। আসলে ট্রুম্যানের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিপ্রদর্শন। তাঁর ধারণা ছিল  একচেটিয়াভাবে পারমাণবিক বোমা হাতে থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাবিয়ে রাখা যাবে ও সারা পৃথিবীতে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো যাবে। তাঁর এই পদক্ষেপের ফলস্বরূপ যে বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দেবে, তা বোঝার মতো প্রজ্ঞা ট্রুম্যানের ছিল না।

ট্রুম্যান যে মারাত্মক খেলা শুরু করেন, ওয়ালেস তাঁর বিরোধিতা করে বলেছিলেন এই নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাঁর মতে পারমাণবিক বোমার গবেষণা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিনিময় করা উচিৎ, যাতে ভবিষ্যতে সঙ্ঘাত এড়ানো যায় ও দুই দেশই পরমাণু গবেষণা বন্ধ করতে রাজি হয়। বিজ্ঞানীদের এবং অভিজ্ঞ জেনারেল হেনরি স্টিম্পসনেরও তাই মত ছিল। কিন্তু ট্রুম্যান রাজি হন না। তাঁর নির্বোধের মতো ধারণা ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনই পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করতে পারবে না। এই ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি বিশেষ। যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবার আগেই দুই প্রধান শরিকের মধ্যে যে বৈরিতার সূচনা ট্রুম্যান করেন, তা আরও প্রায় পঞ্চাশ বছর ঠান্ডা যুদ্ধ হিসেবে সারা পৃথিবীর উপর অনিশ্চয়তার মেঘ এনে দেয়। ইউরোপের পুনর্গঠনে মার্শাল প্ল্যানের বিরোধিতা করে ওয়ালেস বলেছিলেন, এই ত্রাণ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রসংঘের নিয়ন্ত্রণে করা উচিৎ। মার্শাল প্ল্যানকে তিনি ঠান্ডা যুদ্ধের অনুঘটক বলে মনে করেছিলেন। আমেরিকা জুড়ে কমিউনিস্ট সন্দেহে ধড়পাকড় ও দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ করতে বাধ্য করার মতো অপমানজনক নীতির বিরুদ্ধেও তিনি বলেন। ১৯৪৬ সালে ট্রুম্যানের নির্দেশে ওয়ালেস তাঁর ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেন। এইভাবে ক্ষমতায় আসার দু বছরের মধ্যেই ট্রুম্যান এফ ডি আরের ঘনিষ্ঠ সবাইকে পদ থেকে সরিয়ে দেন।

ট্রুম্যানের সরকারের প্রচার ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাক-স্বাধীনতা বন্ধ করে ইউরোপকে কুক্ষিগত করে রাখার পরিকল্পনা করছে। বাস্তবে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের এরকম কোনও কিছু করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাদের কোনও সহযোগী রাষ্ট্র ছিল না তখন, যুদ্ধে তারা আড়াই কোটির উপর মানুষ হারিয়েছে, সারা দেশের প্রধান শিল্প ও কৃষি অঞ্চলগুলি বিধ্বস্ত, নতুন করে গড়ার চেষ্টা করছে। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক, যা এফ ডি আরের সময় গড়ে উঠেছিল, বজায় রাখার যথেষ্ট তাগিদ স্তালিনের ছিল। কমিউনিস্ট দেশের প্রধান হলেও স্তালিন ছিলেন মূলতঃ রুশ জাতীয়তাবাদী নেতা। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখাই তখন তাঁর অগ্রাধিকার ছিল। তার জন্য স্তালিনের মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েতের সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে, বিশেষকরে পোল্যান্ডে, যাতে সোভিয়েতের বৈরী কোনও সরকার না অধিষ্ঠিত হয় দেখা, যাতে ভবিষ্যতে সোভিয়েত ইউনিয়নে আর কোনও জার্মান আক্রমণ হতে না পারে। ইউরোপের কোন দেশ কার প্রভাবে থাকবে তা নিয়ে  চার্চিলের সঙ্গে একটা গোপন বৈঠকে স্তালিনের যে বোঝাপড়া হয়েছিল, এমনকি চার্চিলও স্বীকার করেন যে স্তালিন তা মেনে চলেছিলেন। গ্রীসে ব্রিটিশ প্রভাব মেনে নিয়ে তিনি সেখানে তাদের পছন্দমতো সরকারকে স্বীকার করে নেন, যার অনেক সদস্য এমনকি কিছুদিন আগে পর্যন্ত জার্মানদের সহযোগী ছিল। সেই সরকারের বিরুদ্ধে নাৎসিদের প্রতিরোধ করা  কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে স্তালিন তাতে কোনও সাহায্য করেন নি। এই নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর সঙ্গে স্তালিনের বিরোধ হয়েছিল। ইতালি, ফ্রান্স, এমনকি খোদ ব্রিটেনেও তখন কমিউনিস্টরা বেশ শক্তিশালী ছিল, কিন্তু স্তালিন তাদের কোনও সাহায্য দেন নি। ট্রটস্কির মতো বিপ্লব রফতানি করা ও নিরন্তর বিপ্লবের তত্ত্বে স্তালিনের আগ্রহ ছিল না, অন্ততঃ সেই পরিস্থিতিতে। সুতরাং সেই সময় ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসনের তত্ত্ব ধোপে টেঁকে না। আর ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলতে অনেক দেরি করার ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় সোভিয়েত প্রভাব মেনে না নেওয়ার বাস্তব কোনও উপায় ব্রিটেন-আমেরিকার কাছে ছিল না। কিন্তু ট্রুম্যান সোভিয়েত ইউনিয়নের পুনর্গঠনে যথেষ্ট টাকা না দিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে আলাদা করে ত্রাণের লোভ দেখিয়ে দলে টানার চেষ্টা করতে থাকলে স্তালিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে এইসব দেশগুলোকে স্তালিন আমেরিকান ত্রাণ প্রত্যাখ্যান করতে বলেন। সোভিয়েত প্রভাবাধীন দেশগুলোতে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির সরকার বসানো হয় ও তাদের একত্র করে সোভিয়েত নেতৃত্বে ‘ইস্টার্ন ব্লক’ গড়ে ওঠে। ইউরোপের মাঝে লৌহ-যবনিকা নেমে আসে। ন্যাটোর বিরুদ্ধে  (পরে) ওয়ারশ চুক্তি দ্বারা সামরিক জোট গঠন করা হয় ও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন হয়। সারা পৃথিবী জুড়েই ক্রমশঃ এক সাংঘাতিক সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা পরে কিউবা মিসাইল সংকটের সময় প্রায় পরমাণু যুদ্ধ শুরু হবার আশংকা ঘটায়।

ট্রুম্যানের ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেবার পর ওয়ালেস ঠিক করেন ট্রুম্যানের বিপজ্জনক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই করবেন। ওয়ালেস ট্রুম্যানের বিরুদ্ধে এফ ডি আরের নীতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ করেন, কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক দলকে তাঁর সমর্থনে পান না। ধনী ব্যবসাদারেরা, যারা দুই যুদ্ধ থেকে প্রচুর টাকা করেছিলেন ও যে কোনও সমাজতান্ত্রিক ধারণার চুড়ান্ত বিরোধী ছিলেন, তাঁরা সবাই ট্রুম্যানের সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে তিনি নতুন গঠিত প্রগতিশীল দলের টিকিটে রাষ্ট্রপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মনস্থ করেন। বিশ্বসংকটের মোকাবিলা করা ছাড়াও ওয়ালেসের অনেকগুলি প্রগতিশীল দাবী ছিল, যেমন দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বর্ণবাদী বিভেদ বন্ধ করা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একই কাজের জন্য সমপরিমান বেতন, সকলের জন্য স্বাস্থ্যবিমা, সারা দেশে কারখানা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিয়নের অধিকার আইনি করা, ইত্যাদি। এইসব দাবীগুলির সঙ্গে আধুনিককালে বামপন্থী রাষ্ট্রপতিপদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের তোলা সকলের জন্য স্বাস্থ্যপরিষেবা, উপযুক্ত মজুরি, ইউনিয়নের অধিকার ইত্যাদি দাবীর অনেক মিল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু তুলনা হয়েছে দুজনের মধ্যে। তবে বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্র্যাটিক দলেরই প্রার্থী হয়ে তাঁর দাবীগুলির পিছনে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা করেছেন --- নিজে প্রার্থীপদে মনোনয়ন না পেলেও দাবীগুলির অনেকগুলিকে দলের কর্মসূচীতে ঢোকাতে পেরেছেন। সেখানে ওয়ালেসকে দলের বাইরে থেকে লড়াই করতে হয়েছে। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ওয়ালেসের অবস্থান গড়ে উঠেছিল আইওয়াতে থাকার  সময়ই। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ স্নাতক পিতৃবন্ধু জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কার্ভারের প্রভাবে ওয়ালেস উদ্ভিদবিদ্যায় আগ্রহী হয়েছিলেন ও ভুট্টার সংকর বীজ তৈরিতে সাফল্য পাবার পিছনে কার্ভারের শিক্ষার অবদান স্বীকার করতেন। সুযোগ পেলে যে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের যোগ্যতা দেখাতে পারে, সেই উপলব্ধি ওয়ালেসকে বরাবরের জন্য সিভিল রাইটের দৃঢ় সমর্থক করেছিল। আইনস্টাইন, পল রবসন সহ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের অনেকে ওয়ালেসের প্রার্থীপদের সমর্থনে বিবৃতি দেন। আমেরিকায় প্রধান দুই দলের বাইরে প্রতিদ্বন্দিতা করে সাফল্য পাওয়া খুব দুরুহ ব্যাপার, তবু ওয়ালেসের দিকে শুরুতে কুড়ি শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল। বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে প্রচার করতে ওয়ালেস দক্ষিণের রাজ্যগুলি সফরে যান। এই রাজ্যগুলি ছিল ‘জিম ক্রো’ আইনের অন্তর্গত। জিম ক্রো আসলে কোনও ব্যাক্তির নাম নয় --- বর্ণের মিশ্রণে নিষেধাজ্ঞার ও অশ্বেতাঙ্গদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে যে সব আইন চালু ছিল, সেগুলোকে একত্রে জিম ক্রো আইন বলা হত। ওয়ালেসের উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গ ও উদারপন্থী শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন একত্র করে বিভেদমূলক আইনগুলোর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। কারণ বিভেদমূলক নীতি শুধু কৃষ্ণাঙ্গ নয়, শ্বেতাঙ্গদেরও স্বার্থের পরিপন্থী এবং ধনী প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করে। ওয়ালেস ভার্জিনিয়ার নরফোক থেকে তাঁর প্রচার শুরু করেন। তবে ভার্জিনিয়ায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের একত্রে বড়ো জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ওয়ালেসও আলাদা আলাদা জমায়েতে বক্তৃতা দিতে অস্বীকার করেন। তাই ছোট ঘরোয়া সভার আয়োজন করা হয়। তবে প্রগতিশীল যে শ্বেতাঙ্গদের সভায় যোগ দেবার আশা করা হচ্ছিল, তাদের দেখা পাওয়া যায় না। প্রগতিশীল দলকে অনেকে ‘নিগ্রোদের দল’ হিসেবে চিহ্ণিত করত বলে শ্বেতাঙ্গদের প্রগতিশীল দলের প্রতি অনীহা ছিল। এর পর ওয়ালেস নর্থ ক্যারোলাইনা যান। তখন দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনা সবথেকে প্রগতিশীল ছিল --- অন্ততঃ সেখানে মিশ্র বর্ণের জমায়েত ও সভা করায় কোনও বাধা ছিল না।  ১৩০ জন ছাত্র তাঁর সভায় সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল, তিরিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর ওয়ালেসের সমর্থনে জোগাড় হয়। আশা ছিল নর্থ ক্যারোলাইনা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রগতিশীল দলকে ভোটে জেতাতে পারে --- তাতে অন্ততঃ একটা বড়ো ধাক্কা দেওয়া যাবে। সভায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মিলে বহু হাজার লোক হয়। তবে ওয়ালেসের প্রচারের দলে নিউ ইয়র্ক থেকে অনেক কমিউনিস্টরা যোগ দিয়েছিলেন। প্রচারে ওয়ালেসের বিরোধীরা সেই প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে বেঁধে। ওয়ালেসের এ ব্যাপারে কোনও ধারণা ছিল না --- তাঁকে এসব আগে না জানানোয় তিনি অসন্তুষ্টও হন। শ্রমিক সংগঠন, মধ্যবিত্ত ও কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে মনে করে ওয়ালেসের ভোট কাটায় রিপাবলিকান দলের সুবিধা হয়ে গেলে শ্রমিক আন্দোলনের অনেক ক্ষতি হবে। ডুরহামের প্রভাবশালী কৃষ্ণাঙ্গ সংগঠন ট্রুম্যানকে সমর্থন জানায়। প্রগতিশীল দল ‘কমিউনিস্ট সহযোগী ও মস্কোর চর’ এই অভিযোগে ডুরহ্যাম, গ্রিন্সবোরো, বার্লিংটন এইসব শহরে ওয়ালেসের সভায় শারীরিক হামলাও হয়। টম্যাটো, ডিম এসব ছোড়া হয় --- পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে। মাত্র তিন বছর আগে যিনি  উপরাষ্ট্রপতি ও দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম মানুষ ছিলেন, তাঁর এই ধরণের হেনস্থা অভাবনীয় মনে হলেও আসলে সেই সময় বর্ণভেদকারী নিয়মনীতি দক্ষিণে এতই স্বাভাবিক ছিল যে এমনকি প্রগতিশীল দলের কোনও কোনও প্রার্থীও মনে করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য অন্তর্দেশীয় নীতিতে ঠিক হলেও  ওয়ালেসের বর্ণভেদবিরোধী চিন্তাধারা দক্ষিণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিপন্থী। ওয়ালেসের সভায় যোগ দেওয়া কেউ কেউ মন্তব্য করেন, ওয়ালেস তিরিশ বছর আগে এসে পড়েছেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওয়ালেস শেষমেশ মাত্র তিন শতাংশ ভোট পেয়ে পরাজিত হন ও রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে নিউ ইয়র্কে নিজের ফার্ম হাউসে বাকি জীবন কাটান। ১৯৬৫ সালের ১৮ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। মাঝে কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সমালোচনা করা ছাড়া আর রাজনীতিতে অংশ নেন নি। তবে ওয়ালেসের রাষ্ট্রপতিপদে লড়াই সাফল্য না পেলেও তাঁর দক্ষিণের রাজ্য সফর পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। এর কুড়ি বছর পরে ডঃ মার্টিন লুথার কিং এর নেতৃত্বে ষাটের দশকে যে সিভিল রাইটস আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার বীজ ছিল ওয়ালেসের সফরে।

১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রুম্যান জেতেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ট্রুম্যানের নীতির ব্যর্থতা প্রকট হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু বোমার পর হাইড্রোজেন বোমাও বানিয়ে ফেলায়। চীনেও কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে। কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় সরাসরি সঙ্ঘাত হয় ও আমেরিকা কোনও সামরিক বিজয় পেতে ব্যর্থ হয়। দেশে ট্রুম্যানের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচুর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সমীক্ষায় ভোটারদের কাছে সাঙ্ঘাতিক অপ্রিয় হয়ে ওঠা ট্রুম্যান ১৯৫২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষদিকে ট্রুম্যান উপলব্ধি করেছিলেন কি মারাত্মক পথে তিনি পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছেন, কিন্তু ততদিনে যে দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে গেছে, তাকে আর বোতলে পোরার ক্ষমতা ট্রুম্যানের বা আর কারোর ছিল না। অস্ত্রের জোরে পৃথিবীকে বশে রাখার ‘ট্রুম্যান ডক্ট্রিন’ যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আমেরিকার বিদেশনীতির মূলমন্ত্র হয়ে যায়। ট্রুম্যানের পরবর্তী মধ্যপন্থী রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারও সেই নীতিই মেনে চলেন, একসময় তিনি নিজেই যার বিরোধী ছিলেন। কমিউনিজমের প্রসার রোধের নামে কোরীয় ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের নিয়ন্ত্রনের জন্য একাধিক যুদ্ধ, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বামপন্থী প্রভাব রুখতে বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তাঁবেদার সামরিক শাসক বসানো --- গত সত্তর বছর ধরে চলে আসা এসব ঘটনা সেই ট্রুম্যান ডক্ট্রিনেরই ফলশ্রুতি।

ফিরে দেখলে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলনে ওয়ালেসের বদলে ট্রুম্যানকে উপরাষ্ট্রপতিপদে মনোনয়ন দেবার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড়ই ঘুরিয়ে দেয়। এফ ডি আরের মৃত্যুতে ট্রুম্যানের বদলে ওয়ালেস যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তবে এফ ডি আরের সেই মেয়াদ ছাড়াও আরও চার বা আট বছর ওয়ালেস নির্বাচিত হতে পারতেন। তবে হয়তো বা ঠান্ডাযুদ্ধ আর অস্ত্রপ্রতিযোগিতা এড়ানো যেত, উপনিবেশ শাসন হয়তো দশ থেকে পনের বছর আগেই পৃথিবীতে শেষ হয়ে যেত, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুফলগুলো হয়তো সারা পৃথিবীতে আরও অনেক ভালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেত, সবুজ বিপ্লব হয়তো পৃথিবীতে অনাহার মুছে দিত, পরিবেশ বাঁচানোয় হয়তো আরও অনেক বিনিয়োগ করা যেত। জাপানে যে পরমাণুবোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো না, তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা কার্যকারী সুসম্পর্ক থাকলে তাদের উপরও চাপ থাকত আরও খোলা ব্যবস্থা রাখতে --- সেখানে বা পূর্ব ইউরোপে যে ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, তার অনেকই হয়তো এড়ানো যেত। স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চভ পুনর্মূল্যায়ণ ও সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমেরিকার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে গুটিয়ে যান। ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি থাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে রাজি হতো। খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শুধু শত্রু হিসেবে দেখলে, ট্রুম্যান ডক্ট্রিনে হয়তো আমেরিকার কিছু লাভ হয়েছে। অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল সোভিয়েত অর্থনীতি সেই চাপ সামলাতে পারে নি। অর্থনীতিকে বাঁচানোর তাগিদে শেষমেশ গর্বাচভ আমেরিকাকে এতটাই কূটনৈতিক সুবিধা দিয়ে দেন যে সোভিয়েত কাঠামোটাই ভেঙ্গে যায়। পৃথিবী  একমেরু হয়ে পড়ে। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব পেতে আমেরিকার সাধারণ মানুষকেও অনেক প্রাণ এবং অর্থমূল্য দিতে হয় --- করের টাকার একটা বড়ো অংশ মানুষের কাজে না লেগে প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় হয়, ভিয়েতনাম সহ অনেক যুদ্ধে বহু আমেরিকান সৈন্য আহত বা নিহত হয়। ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি হলে এইধরণের প্রতিযোগিতা এড়াতে পারতেন। তা ছাড়া আমেরিকাতে হয়তো এক দেড় দশক আগেই বর্ণবিভেদ লোপ করা যেত, নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরিতে বৈষম্য হয়তো বন্ধ করা যেত, শ্রমিকদের অধিকার হয়তো আরও মানা হতো, সকলের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য হয়তো অনেক বেশি বিনিয়োগ হতো। এফ ডি আরের যথাযোগ্য উত্তরসূরী হয়ে হয়তো এফ ডি আরের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা ও তাকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি পারতেন। হয়তো এর সবকিছু হতো না, তবে এর কিছু কিছু যে হতো, অন্ততঃ ওয়ালেস যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন, তা আশা করা যায় অবশ্যই।

রাজনীতির কায়েমী স্বার্থ ওয়ালেসের চিন্তাকে অবাস্তব ও স্বপ্নদর্শী বলেছে, ওয়ালেসকে কমিউনিস্ট তকমা দিয়েছে। অথচ ওয়ালেস তাঁর যোগ্যতা বহুভাবে প্রমাণ করেছেন। ওয়ালেসের চিন্তাধারার বিশেষ গুরুত্ব না থাকলে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি এফ ডি আর তাঁর উপর এত ভরসা করতেন না। যিনি এক হাজার কোটি ডলারের এক সফল ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন, সেই হেনরি ওয়ালেস আমেরিকার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রেই আস্থাশীল ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের একটা কল্যাণকামী ভূমিকা, নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববোধ আর বিশ্বশান্তির প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক অস্ত্রের জোরে নয়, মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতে, সেইভাবেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুক। তাঁর মত ছিল, “যারা কমিউনিজমের ভয়ে ভীত, তাদের আসলে গণতন্ত্রের উপরই আস্থা নেই”। ওয়ালেস আমেরিকার এক অন্য মুখ দেখতে চেয়েছিলেন, যা অনেক বেশি মানবিক, নৈতিক বলে বলীয়ান। দুঃখের বিষয়, এফ ডি আর ছাড়া তাঁকে বোঝার মতো প্রভাবশালী রাজনীতিকদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। হেনরি ওয়ালেস যে সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন।

 

আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।

তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

(আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে --- হুমায়ুন আজাদ)


----------
প্রথম প্রকাশিত ঃ সৃষ্টির একুশ শতক, নভেম্বর ২০২০


কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন