শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৮

বিপ্রতীপ সমকোণ

বিপ্রতীপ সমকোণ 
শুভাশিস ঘোষাল

ইদানিং তাঁর মন ভালো নেই একেবারেই তাঁ দল লোকসভা নির্বাচনে প্রায় আশি শতাংশ আসনে জিতেছে, প্রায় ষাট শতাংশ ভোট পেয়ে, তবুও যে ব-দলকে পাঁচ বছরের উপর অবিসংবাদী নেতৃত্ব দিলেন, সে দলের কাছেই আজ তিনি কার্যতঃ অপাঙ্কক্তেয় আজ জম্বুদ্বীপের সবথেকে অসুখী মানুষ তিনি দু হাজার চোদ্দয় আচ্ছে দিনের স্লোগান দিয়ে হই হই করে জিতে আসা সবথেকে ক্ষমতাবান মানুষটি দশ বছর পরে দুহাজার চব্বিশে নিঃসঙ্গ, ক্ষমতাহীন আসত যদি প্রতিদ্বন্দী দল ক্ষমতায়, তেমন দুঃখ হত না সেই করেই তো কেটেছিল শেষ পাঁচ বছর রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছেই, কিন্তু শীর্ষে থাকার পর সঙ্গীহীন হওয়ার যে কি জ্বালা!

মুখে অবশ্য দলের সবাই প্রকাশ্যে বলবে যে তিনি দলের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ, দলের অভিভাবক, দলকে দিশা দেখিয়েছেন তার পথে হেঁটেই তো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, তিরিশ বছর পর জম্বুদ্বীপের রাজনীতিতে এমনটা প্রথম ঘটল কে ভাবতে পেরেছিল, মাত্র দুটো আসনের দল পনের বছরের মধ্যে সরকার গড়বে আর তিরিশবছরে হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য? যার সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে প্রধান প্রতিপক্ষ শতাব্দীপ্রাচীন ক-দলটি কে না জানে তিনি না থাকলে সেই অতিমানবিক নেতার অবয়ব গড়ে উঠত না একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো দূরের কথা, আদৌ সরকার গড়া যেত কি না সেই নিয়েও সন্দেহ ছিল

আজ মনে পড়ছে বছর কুড়ি আগেকার কথা দল যখন প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে, তিনি এক নবীন নিতান্তই অপরিচিত রাজ্যস্তরের রাজনীতিক রাজ্যের প্রধানস্তরের রাজনীতিকও নন ব-দলের নেতৃত্বে এক বিচিত্র সঙ্কট কাদাছোড়াছুড়ির মধ্যে হঠাৎ করেই একসময় সুযোগ খুলে গেছিল গ-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীপদের এক দন্ড সময় নষ্ট করেন নি তিনি দুর্জনে বলে তিনি বাঁকা পথ নিয়েছেন ছোঃ ওসব দুর্বলের ঈর্ষাবাক্য রাজনীতিতে বাঁকাপথ বলে কিছু হয় নাকি? সুযোগটা অবশ্য এনে দিয়েছিল ট্রেনের ঘটনাটা সঙ্কটকে কিভাবে সুযোগে পরিণত করতে হয় তিনি জানতেন দলেও অনেকে বলেছিল জম্বুদ্বীপ বহুত্ববাদের দেশ, কাজটা খুব ঝুঁকির হয়ে যাচ্ছে তবু তিনি জানতেন এটাই পথ তিনদিন পুলিশ-প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেই কেল্লা ফতে গ-রাজ্যে আরো কুড়ি বছরের জন্য ব-দলের শাসনের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন সেইসঙ্গে ব-দলের দার্শনিক দিকনির্দেশক ছাগপুরের নেকনজরে চলে এলেন রাতারাতি

কেন্দ্রে তখন ব-দলের সরকারের প্রধান শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা উদার মুখের তখন বড়ো প্রয়োজন দলের, কারণ শরিকদের নিয়ে সরকার চালাতে হয় তবে ব-দলে রাজনৈতিক ক্ষমতার চাবিকাঠি পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার হাতে কারণ তিনিই মন্দির আন্দোলনের প্রধান হোতা, দুই আসনের চোরাবালি থেকে দলকে টেনে তুলেছেন, রথে চেপে সারা দেশ ঘুরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করেছেন তাঁর পক্ব গোঁফজোড়াটি এমনই পরিপাটি যে দেখলে প্রথমেই মনে হয় এইমাত্র বুঝি ক্ষীরের বাটিতে চুমুক দিয়ে মুখটি তুলেছেন মসজিদ ভাঙ্গায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, যদিও পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা নিজমুখে সে কথা কিছুতেই বলেন না ছাগপুরের আশীর্বাদ তাঁর মাথায়, সবাই জানে শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতার তাঁকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা হেন শক্তিশালী নেতার আশীর্বাদ বিশেষ প্রয়োজন, না বোঝার মতো মূর্খ নবীন নেতা নন তা তিনি পেয়েওছিলেন --- লোকে তাঁকে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার ভাবশিষ্য বলে জানল কিন্তু রাজ্যব্যপী দাঙ্গার পর যখন শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা রাজ্য পরিদর্শণে আসার ঘোষণা করলেন, তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন তখন পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন নিতান্তই শরিকি রাজনীতির চাপ আর শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতার ভাবমূর্তি বজায় রাখার ব্যবস্থা, দলেরই প্রয়োজনে নবীন নেতা অবশ্য কাঁচা কাজ করেন না, সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে তাঁকে অভিযুক্ত করাটা একপ্রকার অসম্ভব, বিশেষ করে ব-দল গ-রাজ্যে ক্ষমতায় থাকতে যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের দু একজন ছাড়া বাকিদের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি এক ছিল রাজনৈতিক ক্ষতির চিন্তা, তবে এই ধরনের কোনও অভিযোগে তাঁর রাজনৈতিক লাভের সম্ভাবনাই বেশী প্রকৃতপক্ষে তাই হয়েও ছিল শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা রাজ্যে তাঁকে শুধু মৃদুভাবে রাজধর্ম পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন তিনিও তার উত্তরে বলেছিলেন, “ওঁ হি তো কর রাহা হুঁ ব্যাস, আর কথা এগোয় নি বিধিমত একটা অনুসন্ধান হয়েছিল, যেরকম হয়ে থাকে, তবে তাতে অসুবিধার কিছু ছিল না তিনিও গ-রাজ্যে আরও দুবার ড্যাং ড্যাং করে নির্বাচনে জিতে এসেছিলেন

তবে সামান্য এক অঙ্গরাজ্যের অধিপতি হবার জন্য তো তাঁর জন্ম হয় নি তাঁর লক্ষ্য সমগ্র জম্বুদ্বীপের অধিপতি হওয়া, তবে তার জন্য দরকার ধৈর্য আর পরিকল্পনা নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তোলা যা সারা দেশে খাওয়ানো যাবে প্রাথমিক প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর আর দাঙ্গার পথে মোটেও হাঁটেন নি তিনি শাদীর পয়লা রাতে বেড়াল মারাটা অনেক বেশী কাজে দেয় সেবারেই যা কড়কে দেওয়া হয়েছিল, ট্যাঁফোঁ করার সাহস পায় নি কেউ এমনকি শতাব্দীপ্রাচীন ক-দলের বিরোধিতাও কেমন ম্যাড়মেড়ে ছিল তাদেরও তো লাভক্ষতির অঙ্ক করে চলতে হয় নবীন নেতা মন দিলেন বিকাশপুরুষ ভাবমূর্তি গড়ে তোলায় তিনি জানেন গল্পকথা কেমন করে ছড়িয়ে দিতে হয় সাদা দাড়ি সত্বেও তিনি তো তরুণ, অন্ততঃ বৃদ্ধ রাজনীতিকদের ভিড়ে তিনি জানেন ফেসবুক-ট্যুইটার-ইন্সটাগ্রামের ব্যবহার, নিজস্ব আইটি সেল গড়ে খবর কি করে তৈরি করা যায়, ফটোশপ করে কি করে রামকে মুহুর্তে শ্যাম বানিয়ে দেওয়া যায় আর গ-রাজ্যের রাজধানী আ-নগরীকে অমরাবতী তাঁর রাজ্য লোকমুখে শ্রেষ্ঠ উন্নয়নের শিরোপা পেল, সে পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন।

কেন্দ্রের ব-দলের সরকারের নেতৃত্বে শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা তখন বোম টোম ফাটিয়ে বেশ হাওয়ায় ভাসছেন, জম্বুদ্বীপ শাইনিং এর ঢাকঢোল জোরদার পেটাচ্ছেন ফুরফুরে মেজাজের ফলে পেগের দৈনিক মাত্রাটাও একটু চড়েছে। জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন তিনি, কিন্তু কথা বলেন খুবই ধীরগতিতে। তারপর  ভাষণকে আরও নাটকীয় করতে এক শব্দ থেকে অপর শব্দের উচ্চারণের ব্যবধান তখন প্রায় এক মিনিটে ঠেকেছে। প্রতিপক্ষ ক-দলের নেত্রী বিদেশী, এতে আরো সুবিধা হয়েছে প্রচারের সবাই ধরে নিয়েছে আবার নির্বাচনে জিতে হইহই করে ক্ষমতায় ফিরবেন শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা কিন্তু হিসেবে কোথায় যেন গোলমাল হয়ে গেল যত গর্জন, তত বর্ষণ হল না --- ব-দলের জোট যথেষ্ট আসন পেল না শতাব্দীপ্রাচীন দলটি বেশ কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে বামদলগুলির সাহায্য নিয়ে গদিতে বসল নাটকীয়ভাবে ক-দলের দলের নেত্রী নিজে না হয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে বসালেন এক প্রায় মূক, প্রায় না-রাজনীতিক প্রবীণ নেতাকে ক্ষমতা হারিয়ে ব-দলের অনেকে মুষড়ে পড়ল, তবে  নবীন নেতা এই বিপর্যয়ে সুযোগ বুঝতে পারলেন এইসব প্রবীণ নেতাদের দলের মাথা থেকে না সরালে নতুন রাস্তা খুলবে কি করে? কেন্দ্রে সরকার হারানোয় ব-দলের কাছে তাঁর গ-রাজ্যের শক্তিশালী সরকারের গুরুত্ব অনেক বাড়ল তিনি ব-দলের দ্বিতীয় সারি থেকে প্রথম সারির নেতা হয়ে গেলেন

ওদিকে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতাও হিসেব কষছেন সরকার সরলে নিঃসন্দেহে  ব-দলের সরকার হবে এবার প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁর হকের পাওনা দলকে জেতাতে ব্যর্থ শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা ক্ষমতা আর প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ছাগপুরও তাঁর ওই ব্যর্থতায় বিশেষ অখুশী হয়ে ছিল, তাই নিজেকে না সরিয়ে নিয়ে তাঁর উপায়ও ছিল না বস্তুতঃ সেবারই পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার  প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট কিন্তু হাওলা লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে, আর তিনিও দুম করে ঘোষণা করে দেন যে নিজেকে নির্দোষ না প্রমাণ করে আর ভোটে দাঁড়াবেন না এতটার আদৌ কোনও দরকার ছিল না --- জম্বুদ্বীপের রাজনীতিতে দুর্নীতিটা জলভাত, আর পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতাকে এমনকি ঘোর বিরোধীরাও দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করত না মুস্কিল হল দুর্নীতি প্রমাণ বা অপ্রমাণে জম্বুদ্বীপে প্রচুর সময় লাগে শেষমেশ অভিযোগ প্রমাণ হয় নি, কিন্তু তাঁর ক্ষতি যা হবার হয়ে গেল, দলের প্রধান মুখ হওয়া সত্ত্বেও পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ প্রথমবার ফস্কে গেলনিজেকে ব্যতিক্রমী রাজনীতিক প্রমাণ করতে গিয়ে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা প্রকারান্তরে নিজের পায়ে কুড়ুল মারলেন। এর প্রায় দশবছর বাদে নির্বাচনে সে সুযোগ এল শেষে কিন্তু নন্দলালের মন্দ কপাল। সামাজিক প্রকল্পে জোর দেওয়ার সুফল হোক বা যে কারণেই হোক, ক-দলের জোট আর একবার ক্ষমতায় ফিরে এল। পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার শবরীর প্রতীক্ষা আরও বাড়ল।

যা হোক ক-দলের দ্বিতীয়বারের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এত অভিযোগ উঠতে লাগল যে কারুরই বিশেষ সন্দেহ রইল না যে সরকারের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাহলে আবার ব-দলের হাতে আসবে সরকারের ভার। কিন্তু মুস্কিল হল এত বড় দেশে একেবারে একার জোরে ক্ষমতায় আসা বেশ কঠিন --- শরিকদের নিয়ে চলতে হবে। এসব শরিকনেতাগুলো এক একজন সামন্তরাজার মতো। দেশের কোনও এক ক্ষুদ্র অংশে তাদের হয়তো প্রতিপত্তি, সাংসদ আছে হয়তো দুই কি তিন, কিন্তু হাজার বায়নাক্কা, আর তেমনি দুর্নীতির মদতদাতা এছাড়া এদের নিজেদের মধ্যে আছে নানা স্বার্থসঙ্ঘাত। এদের নিয়ে সরকার চালানো মানে দড়ির উপর হাঁটা। ব-দলের সংখ্যালঘু বিরোধী ভাবমূর্তি সরকার চালানোয় আরও অন্তরায়শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা এইদিকটা সামলাতেন ভালোকিন্তু পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার হার্ডলাইন ভাবমূর্তি এক্ষেত্রে অসুবিধা, কারণ সরকার গড়তে কার সাহায্য লাগবে জানা নেই।  শরিকদের কিছুও যদি ভেগে যায় তবে সরকার গড়ার জন্য দরকারি সাংসদ কম পড়তে পারে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা তাই এবার উদার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে যত্নবান হলেন প্রথম প্রয়োজন মসজিদ ভাঙ্গার দায় ঝেড়ে ফেলা ভেবেচিন্তে মন্তব্য করলেন যে মসজিদ ভাঙ্গার দিন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন তাতে দলের বাইরে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ল কি না জানা নেই, কিন্তু ব-দলের কট্টর সমর্থকরা দ্বিধাগ্রস্ত হল কেমন কথা? যদিমন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে”, তবে মসজিদটা না ভাঙ্গলে চলবে কি করে? আর যে কাজটা করে এতদিন গর্বের সাথে বলা হত জম্বুদ্বীপবাসীর আবেগ, আর অতীতের অন্যায়ের সংশোধন, সেটা কি করে দুম করে দুঃখের ব্যাপার হয়? তবে কি পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতাও আর একজন সিকুলার?

পর্যন্ত তাও একরকম ছিল, কিন্তু প-দেশ সফরে গিয়ে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা বেমক্কা সে দেশের প্রতিষ্ঠাতার প্রশংসা করে ছাগপুরের চক্ষুশূল হয়ে গেলেন প-দেশ আগে জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত  ছিল, সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত থেকে আলাদা হয়ে যায়, তার পর থেকে ক্রমাগত বৈরিতা চলছে দু দেশের। ঘাগু প্রবীণ রাজনীতিকের হেন শিশুসুলভ ভুলে নবীন নেতা বিশেষ আল্হাদিত হলেন। নবীন নেতার  বিশ্বস্ত সাঙ্গপাঙ্গরা আড়ালে ক্রমাগতঃ ছাগপুরের কান ভারী করে যাচ্ছিল যে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা যথেষ্ট দৃঢ় নন, নবীন নেতা  তাঁর থেকে আরো বেশী যোগ্য পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার শিক্ষাদীক্ষা আর সহজাত ভদ্রতাবোধ তাঁকে প্রতিপক্ষ শিবিরের নেতাদের সাথেও ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রাখতে শিখিয়েছিল। কারুকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু ব-দলের সমর্থকদের কাছে, সেটা দুর্বলতা বলে প্রতিপন্ন হল। এই দলের সমর্থকরা অবশ্য যুক্তির ধার ধারে এমন অভিযোগ কেউ করবে না, কিন্তু ছাগপুরের নেতৃত্বের চটাটা পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার কাল হল। ছাগপুর এতদিনে তাদের মনের মতো নেতা পেয়ে গেছে, তাই পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার কদর কমছিল। তারা এখন প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প হিসেবে নবীন নেতার কথা ভাবল।  গ-রাজ্যে কড়া হাতে সরকার চালিয়ে তিনি ছাগপুরের নয়নের মণিসেই সময়ে ক-দলের দ্বিতীয় সরকারের দুর্নীতির ফলে সামনে ফাঁকা গোল, শুধু বলটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া চাই। এই সময় এমন কাউকে চাই যাকে দ্বিধাহীন  অতিমানব বলে প্রতিপন্ন করা যাবে। যার উন্নয়নের স্টীমরোলার তুচ্ছ মানবিক হিসেবনিকেশের দুর্বলতা দেখাবে না। এ ব্যাপারে নবীন নেতার থেকে  উপযুক্ত আর কে?

 কিন্তু অসুবিধাও আছে কিছু। ব-দলের মধ্যে না হয় পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার অনুগামীদের একরকম পশ্চাদগামী বলে বাতিল করা গেল, কিন্তু দলের বাইরে নবীন নেতার গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম। জম্বুদ্বীপের আনাচে কানাচে যে সব আঞ্চলিক দলের আধিপত্য, সঙ্গী হিসেবে তাদের লাগবে। তাদেরও রাজনীতি করে খেতে হয়, নিজের নিজের ভোটারদের নবীন নেতার মতো এরকম কড়া ডোজের নেতা গেলাতে তাদের বিলক্ষণ অসুবিধা। তারা যদি বেঁকে বসে? বস্তুত সেইসব ভেবেই পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা উদার ভাবমূর্তি তৈরি করতে যাচ্ছিলেন যাতে শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতার জায়গাটা নেওয়া যায়। কিন্তু ছাগপুরের কাছে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা এতই অবাঞ্ছিত তখন যে এই বিরাট ঝুঁকিটা তারা নিয়েই ফেললেন। ব-দলের মহাসম্মেলনে পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নবীন নেতার নামটা প্রস্তাব হয়েই গেল। মঞ্চে মুখ চুন করে বসেছিলেন পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা। প্রবীণ নেতার অনুগামীরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে এরকম কোনও ঘোষণা সরাসরি না করতে। নির্বাচনের ফল বেরোলে সেইমত নেতা ঠিক করা যাবে। কিন্তু ছাগপুরের আর ত্বর সইছিল না। তারা বুঝতে পারছিলেন যে সরাসরি নাম ঘোষণা না করলে অবিচল বিকাশপুরুষ প্রচারটার সুবিধা পাওয়া যাবে না। নবীন নেতা মঞ্চে আনন্দাশ্রু  মিশ্রিত ভাষণ দিলেন পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এই প্রতিভাটা তাঁর সহজাত, প্রয়োজনে যখন তখন অশ্রু আমদানি করতে পারেন তিনি। ক্রন্দনরত রাজনীতিককে  জম্বুদ্বীপের মানুষ নিজের লোক ভাবে  তা তিনি জানেন।

নবীন নেতা জানেন কেন্দ্রে সরকার গড়তে গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের ভোটের কোনও প্রয়োজন নেই। দরকার ত্রিশ শতাংশের মতো। বেশীরভাগ মানুষ তাঁকে না চাইলেও কিছু এসে যায় না। ত্রিশ শতাংশ মানুষের মাথায় শুধু ঢুকিয়ে দিতে হবে তাদের কাণ্ডারিকে তারা পেয়ে গেছে। ব-দলের পুরনো প্রচার কৌশলে  তাঁর আস্থা নেই। এসব দলটল এক কাঁড়ি নেতা অতিমানবিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার অন্তরায়। তিনি নিজের মতো লোকজন বেছে ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রচারে গুরুত্ব দিলেন। ভোট হবে তাঁর নামে। প্রতিপক্ষ শতাব্দীপ্রাচীন ক-দল সেভাবেই চলে। তবে তাদের নেতার আছে বংশের আভিজাত্য, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার জম্বুদ্বীপে যা ভালো খায়। সে সুযোগ তাঁর  নেই, তাই তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত পথ ধরলেন। নিজেকে দরিদ্র অতি সাধারণ শ্রমজীবী শ্রেণী থেকে উঠে  আসা প্রতিপন্ন করলেন । লোকে বলল, দেখো, সামান্য চা বিক্রেতা থেকে যিনি এই জায়গায় উঠে আসতে পারেন তিনি ঈশ্বরতুল্য। ঈশ্বরের স্থান রাজারও উপরে। কবে কোথায় কদিন চা বিক্রি তিনি করেছিলেন কেউ জানে না, তবে সেসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। নিজের স্ত্রীকে বিনা নোটিশে ছেড়ে আসায়  কথা উঠেছিল বটে, তবে তাতে উল্টে তুলনা হল শ্রীরামচন্দ্রের সাথে। কজন পারবে দেশের কথা ভেবে এমন ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করতে? যারা আরও ভাবিয়ে সমর্থক, তারা বলল যে এতদ্বারা তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নীতিগত যুদ্ধ করেছেন। আর তাঁর  সঙ্গে আছে প্রযুক্তিহাজার হাজার সমর্থক ফেসবুক ইউটিউব ছেয়ে ফেলল তাঁর বন্দনায়। গুণমুগ্ধরা সেগুলো আবার সেগুলো তাদের পরিচিতমহলে আবেগের সঙ্গে পাঠাতে লাগল, আর সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম স্থুল সমস্তরকমের সাম্প্রদায়িক মন্তব্য ফেসবুক ট্যুইটারে তাঁর কয়েক কোটি অনুগামী। তাঁর  ট্যুইটগুলি সাথে সাথে হাজার হাজার বার রিট্যুইট হয়ে যায়। শিক্ষা, আর্থিক ক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে নতুন এক শ্রেণীর মানুষের উদ্ভব হল --- ভক্ত। মোড়ে মোড়ে তাঁর  নাম করে চা বিক্রি হল দলের নির্বাচনী তহবিলের জন্য।


প্রতিপক্ষ শতাব্দীপ্রাচীন ক-দলের নেতৃত্বে অভিষেক  হয়েছে দলনেত্রীর ছেলের, তাদের দলের পরিবারতন্ত্রের প্রথা মেনে। একে ছোকরা-বয়সে রাজনীতিতে কল্কে পাওয়া কঠিন, তার উপর ওর অদ্ভুত চালচলন আর কথা বলার ভঙ্গি ওকে একরকম হাসির খোরাকে পরিণত করে।  ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যপে চুটকি ছড়ায় তাকে নিয়ে। তাতে শালীনতারও কোনও বালাই থাকে না। হাসির খোরাক হলে রাজনীতিকের সবথেকে ক্ষতি হয়। সহজেই রটে গেল ছোকরা নেতা রাজনীতিতে অনুৎসাহী, নেহাৎ পরিবারের হাতে দলের রাশ রাখতে দলনেত্রী জোর করেই তাকে রাজনীতিতে পাঠিয়েছেন। এমন  অনিচ্ছুক নেতাকে কে আর প্রধানমন্ত্রী পদে চায়? নবীন নেতার এ একেবারে সোনায় সোহাগা হল।

দুর্নীতি তখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। নবীন নেতা নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কান্ডারি ঘোষণা করলেন। তিনি দেশের চৌকিদার হয়ে থাকবেন যাতে আর কেউ দেশের সম্পদ চুরি করতে না পারে। 
কালো টাকা যা বিদেশের ব্যাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছে ধনীরা, সেসব তিনি ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক জম্বুদ্বীপবাসীর একাউন্টে দশ পনেরো লাখ করে জমা দেবেন। পেট্রল ডিজেল জলের দর হয়ে যাবে, ডলারে টাকার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে, আর সবার উপরে প-দেশকে দেবেন কড়কে যা করা মৌন নেতার দুর্বল নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব হয় নি, আর আলুভাতেমার্কা ছোকরা নেতার দ্বারা তো সম্ভবই নয় তিনিই পারেন সেই বীরোচিত কাজ কারণ তিনি সিংহহৃদয় আপসহীন নেতা, তার ছাতির পরিমাপ ছাপ্পান্ন। একমাত্র তাঁর নেতৃত্বেই আসবে সেই আচ্ছে  দিন, জম্বুদ্বীপ আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।

বিপুল ঝুঁকিটা খেটেই গেল। হই হই করে ভোটে জিতে এসেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা ব-দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছে দিয়েছিল। চা বিক্রির গল্পটা লোকে খেয়েছিল খুব। খাবে না? আর কেউ পারত ওই জায়গা থেকে উঠে আসতে? পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার আশা ছিল ভোটের পরে যখন অন্য দলের সমর্থন লাগবে, তখন তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী পদে আবার ডাকতে হবে। কিন্তু ব-দলের  নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁর ক্ষীণ আশায় জল ঢেলে দিলবাকি ছোটখাটো সম্ভাব্য সমর্থক  দলগুলোও সুড়সুড় করে আগ বাড়িয়ে সমর্থন দিয়ে দিল, পাছে শাঁসালো দফতর কিছু ফস্কে যায়। পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা পুরোপরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে আর যে দু চারজন পুরনো মন্ত্রীসভার প্রবীণ মন্ত্রী ছিলেন, তাঁদেরও অপাংক্তেয় করে দেওয়া হল। ব-দলের সভাপতি হয়ে গেলেন নবীন নেতার এক খুব কাছের লোক। টাক মাথার মোটাসোটা চেহারার মানুষ সে, সারাক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর দফতরেই পড়ে থাকে, প্রতিটি কাজ নবীন নেতার কথা মতো হয় । ব-দলের উপর তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বিস্তৃত হল।

তিনি প্রথম সংসদে ঢুকে গণতন্ত্রের পীঠস্থানকে প্রণাম করে আবেগে চোখে জল এনেছিলেন। সংসদে প্রশ্নোত্তরে অবশ্য তিনি কখনই আগ্রহ দেখান নি। তিনি বলতে ভালোবাসেন, শুনতে নয়। তাই নিজেই ব্যবস্থা করে নিলেন নিয়মিত রেডিও শোর মাধ্যমে দেশের মানুষকে জানাবেন তার অন্তরের কথা। তিনি বলেন, দেশবাসী শোনে, মুগ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, সারা দেশকে তিনি যোগব্যায়ামেও সামিল করলেন তাঁর সঙ্গে, টিভির মাধ্যমে। তার কথাতে বহু লাখ লোক জ্বালানি গ্যাসের সাবসিডি ছেড়ে দিল দেশের স্বার্থে। এতেও অবশ্য নিন্দুকরা ছাড়ে নি, সংসদে কেন তিরিশ টাকায় মাংস-ভাত পাওয়া যায়, এসব কথা তুলেছিল। আরে ধুর, এ দুটো জিনিস কি একই হল? কোত্থেকে  জোটে এসব সমালোচকরা? 

ওঃ কি দিন ছিল। ব্যবসায়ীকুল খুশী, সেন্সেক্স উর্ধমুখী। মন্দা কাটিয়ে বিশ্ব বাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশ কম। বস্তুতঃ আন্তর্জাতিক মন্দা আর প্রবল দুর্নীতি সত্বেও জম্বুদ্বীপের অর্থনীতি আগেও ভালই চলছিল, তবে নবীন নেতা পুরো কৃতিত্বটাই নিয়ে নিলেন। তাঁর ভক্তের দল তৈরিই থাকে। এমন অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি কখনও হয় নি আগে প্রচার চলল, নেতা নিজে ঝাঁট দিচ্ছেন স্বচ্ছ জম্বুদ্বীপ গড়তে এসব ছবি বানানো হল, চীনের রেলস্টেশনকে দেশের বলে চালানো হল। বিরোধীরা মুখ চুন করে রইল, ঘরে শত্রু দমন করে তিনি আন্তর্জাতিক প্রচারের দিকে নজর দিলেন। ইউরোপ আমেরিকা আগে যে তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল, তারা দিব্যি পাল্টি খেল। সুসম্পর্ক চাই, জম্বুদ্বীপের এত বড় বাজার তো হারানো যায় না। তিনি অর্ধেক সময় বিদেশ সফরে চললেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তাঁর আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি ছাপা হল ফলাও করে। এমনকি কোন এক দেশ সফর শেষে হঠাৎ করে প-দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ঢুঁ মেরে তাকে বাগে এনে মধ্যাহ্নভোজন সেরে রাতে রাজধানী ফিরলেন। গেছোদাদার মতো কখনো মস্কো, কখনো বাগদাদ, কখনো বার্লিন --- তাঁকে ধরার কোনও উপায় রইল না। এক সাক্ষাৎকারে মায়ের প্রসঙ্গ উঠতে আবেগে কাঁদলেন, দেশবাসীরও চোখে জল এল। ওদিকে ব-দলের সভাপতি নানা রাজ্যে ভোটে জেতা হারা নির্বিশেষে সরকার গড়া যায় দেখিয়ে দিলেন।

শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতা তখন অবশ্য রাজনীতি থেকে প্রায় অবসর নিয়ে নিয়েছেন, তবে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অবশেষ রাখতে নেই। তিনি তাই শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতাকে  জম্বুরত্ন দেবার প্রস্তাব করলেন। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। ব-দলের মধ্যে ও বাইরে ওঁর গুণগ্রাহীদের মন জয় করা যায়, এবং তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ পুরোপুরি বন্ধ করা যায়। জম্বুরত্ন পাবার পর আবার সক্রিয় রাজনীতি করতে এলে খেলো হয়ে যাবেন তিনি। জম্বুরত্ন দেওয়ায় অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নেই, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের এ তো বাঁধা পাওনা। তবে টেকো মোটা বিশ্বস্ত সাকরেদের  বুদ্ধিতে তিনি সেই সাথে আর এক অতি প্রাচীন মৃত  অকিঞ্চিৎকর বিস্মৃতপ্রায় হিন্দুনেতার নামও এক সঙ্গে  জম্বুরত্নের জন্য অনুমোদন করলেন।  শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতাকে এইরকম তুতেনখামেন  বানিয়ে  ওঁর গুরুত্বকে  কমিয়ে দেওয়া গেল। তাতে সেই সঙ্গে দেশকে সঙ্কেত দেওয়া গেল যে নাচতে নেমে ঘোমটা টানার যে সেকেলে পদ্ধতি শ্মশ্রুগুম্ফহীন উদার নেতার সময় ব-দল অনুসরণ করত, নেতার অবসরের পর ওঁর নীতির আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হল। ওঃ টেকো মাথায় আসেও বটে এসব বুদ্ধি, তিনি ভেবে উৎফুল্ল হলেন। পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতার জন্য অবশ্য ঠিক হলো, এসবেরও কোনও দরকার নেই, পুরোপুরি উপেক্ষাতেই কাজ চলবে। 

বিপুল জয়ের পর বছর দুয়েক গড়িয়েছে, সেই সময় সবচেয়ে বড় রাজ্য সহ আরো বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভোট আসন্ন। এবার তিনি এক অভূতপূর্ব ঘোষণা করলেন। রাতারাতি দেশের পঁচাশি শতাংশ নোট বাতিল হল। কালোটাকার রাঘব বোয়ালদের ধরতে হবে, তাই। আবার কখনো সেটা হল প-দেশে  তৈরি জাল টাকা আটকানো, কখনও বা ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য। মতলবটা অবশ্য উকিলটার, অর্থ দপ্তর সামলায় যে। জম্বুদ্বীপে সবই চলে মূলত নগদ লেনদেনে। রাজনৈতিক দলের তহবিল  তো বটেই। তাঁর নিজের দল এই নোটবাতিলের জন্য তৈরি ছিল,  কিন্তু বিরোধী দলগুলো পড়ল আতান্তরে। ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে সদ্যবাতিল নোট জমা দেওয়ার লাইন দীর্ঘ হল। কখনো দৈবাৎ এটিএমে টাকা পাওয়া গেলে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। টাকার অভাবে তরকারিওয়ালা, ফেরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, অটোওয়ালা সবার রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ রইল। কিন্তু বহু  লোকে মনে করল দেশের ভালোর জন্য এই ত্যাগ স্বীকার জরুরি। কি ভালো সেটা তেমন বোঝা না গেলেও কালোটাকার কারবারিদের কল্পিত সাড়ে সর্বনাশের আশায় অনেকেই উৎফুল্ল হল, সে নিজের যে কষ্টই হোক না কেন। আর নেহাত কেউ বেসুর গাইলে মনে করিয়ে দেওয়া হল জওয়ানরা সীমান্তে অবর্ণ্নীয় কষ্ট সহ্য করছে, আর এরা স্বার্থপর দেশদ্রোহীরা সামান্য অসুবিধায় বাজে সমালোচনা করছে। তিনি যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন দেশকে।

তবে সুখ তো আর  চিরকাল থাকে না। অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল এদিক ওদিক। অর্থনীতিবিদরা প্রায় সবাই একবাক্যে নোটবাতিলের অসারতার কথা বলছিলেন। নোটবাতিলে কালোটাকা জালে উঠল না।  রাজনৈতিক লাভ যা হয়েছিল,  অর্থনীতি ঘা খেয়ে দুর্বল হওয়াতে তার অনেকটাই গেল। এর উপর শুরু হল গো রক্ষকদের দাপাদাপি। ব-দলের দার্শনিক দিশা ছাগপুরে থাকলেও ব-দলের সমর্থকরা ছাগল নয়, গরুর উপাসক, গরুকে মাতা মনে করে। গোমাংস খাওয়া হচ্ছে এরকম যে কোনও অভিযোগ তুলে যখন তখন যাকে তাকে পিটিয়ে মারা হতে থাকল। সিনেমাহলে জাতীয়সঙ্গীত বাজানো ও তখন উঠে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক, না হলেই প্যাদানি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখে বেশ কিছু  সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হলেন। কিছু নৃশংস ধর্ষণের ঘটনায় ব-দলের লোকেরা জড়িত থাকায় মানুষ ক্ষুব্ধ হল। কৃষকরা চাষের খরচ প্রচুর বাড়ায় আর ফসলের দাম না পেয়ে বিশাল বিক্ষোভে সামিল হচ্ছিল, বা  আত্মহত্যা করছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বিক্ষোভ জানাচ্ছিল।  কিছু বিশেষ শিল্পপতি যে অনেক বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে, সে ব্যাপারে অনেকে সোচ্চার হচ্ছিল। সে অবশ্য বিরোধিতা ওরকম থাকবেই, কিন্তু প্রযুক্তির যুগে তারাও বেশ প্রচার পেতে লাগল। ভক্তরা অবশ্য সব সমালোচনার উত্তরে অন্য কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করত, তবে তাদের ধার কমে আসছিল। বিরোধীরাও খানিকটা একজোট হবার চেষ্টা করতে লাগল।  তার মধ্যে কোত্থেকে একটা ভুঁইফোঁড় প্যাটেল নেতা এসে  ক-দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ব-দলকে গ-রাজ্যে প্রায় হারিয়ে  দিচ্ছিল নির্বাচনে।

ক-দলের ছোকরা নেতাও কেমন যেন পরিণত হচ্ছিল। গ্রামে রাত কাটিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে কেমন যেন উপলব্ধি এসেছিল ছোকরার। অক্সফোর্ড না কোথায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সংবেদনশীল উত্তর দিয়ে অনেকেরই প্রশংসা কুড়োলো। তখন লোকে তাকে খানিকটা সম্ভ্রমের সাথে নিতে থাকল। উল্টোদিকে নবীন নেতাই বরং সিঙ্গাপুরে সাজানো প্রশ্নোত্তরের আসরে অংশ নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে অপ্রস্তুত হলেন। ফেসবুক ট্যুইটার হোয়াটসঅ্যাপে চুটকি বরঞ্চ তাঁর উদ্যেশ্যেই বেশী বেশী হতে থাকল। দুই প্রতারক যখন ব্যাঙ্কের টাকা লুঠে সহজেই পালাল, তখন দেশের চৌকিদার বলে বড়াই করা তিনি খোরাক হয়ে গেলেন। হতচ্ছাড়া দুটোর একটার নাম আবার তাঁরই নামে। কি বিপদ! ইন্টারনেট যুদ্ধ কি তাহলে তিনি হারতে চললেন?

আরো বিপদ হল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হুহু করে বেড়ে যাওয়ায়। সেই সঙ্গে ডলারের সাপেক্ষে টাকার মান পড়ে যাওয়ায়। এমনটা অবশ্য হবার কথাই ছিল, চিরকাল তেলের দাম কম থাকতে পারে না। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি লোকে অপছন্দ করে ভীষণ, ওদিকে ভোটের সময় এগিয়ে আসছে। কর্মসংস্থানের অবস্থাটাই সবচেয়ে করুণ, সেটাই সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। আগেরবার ভোটের সময় তিনি বছরে দুকোটি চাকরির ব্যবস্থা করবেন বলেছিলেন বড়মুখ করে। সেসব তো হয়ই নি, বরঞ্চ চাকরির সংখ্যা আগের থেকে কমে গেছে কিছু। সেটাই সবচেয়ে ভাবাচ্ছে। পরিসংখ্যান চেপে টেপে তথ্য দিলেও লোকে বিশ্বাস করছে না আর আগের মতো। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে। আবার বিদেশ থেকে বিমান কিনতে বিপুল অনিয়ম হয়েছে, সেকথা এমনকি সেই দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত কবুল করে ফেললেন। সীমান্তে জওয়ান যুদ্ধ করছে ঠান্ডায় জমে, এই প্রচারেও কাজ কম হচ্ছিল। অসন্তোষ যে জমা হচ্ছিল, তা আস্তে আস্তে বিপুল অবয়ব ধারণ করছিল। যারা আগে চুপ করে ছিল, তারাও এখন অনেক মুখ খুলতে লাগল। বিরোধীরা তাদের চিরাচরিত বৈরিতাকে পাশে সরিয়ে অনেকেই নির্বাচনী সমঝোতা করছিল অন্য দলের সঙ্গে। ক-দল সেই জোটের মধ্যমণি। 

প্রচারে অবশ্য ব-দলই এগিয়ে। তাদের হাতে আছে অফুরন্ত নির্বাচনী তহবিল। বড় বড় শিল্পপতিরা প্রচুর টাকা দিয়েছে ব-দলকে কৃতজ্ঞতায়, আইন বেঁকিয়ে নানা ব্যবসায়িক সুযোগ দেবার জন্য। তবু তলায় মাটি সরতে থাকলে সবকিছু আগের মতো থাকে না। মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব-দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, সাধারণ চাকরিজীবি, শ্রমিক আর কৃষকেরা তো আগেই রুষ্ট ছিল। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি প্রতিকূল হল ভোটের মুখে। দু হাজার উনিশের ভোটে নবীন নেতা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেলেন। 

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি। এতদিন যে সাফল্যে ভর করে তিনি দলে ও দেশে সর্বশক্তিমান হয়েছিলেন, ব্যর্থতায় সে শক্তি যেন হঠাৎই উবে গেল। ছাগপুর মনে করল অতিরিক্ত অর্থনৈতিক উদারীকরণ করতে গিয়ে তিনি দেশের মানুষকে রুষ্ট করেছেন, আর হিন্দুত্বে যথেষ্ট জোর দেন নি। বস্তুতঃ ছাগপুরে স্বদেশী অর্থনীতির প্রবক্তা ছিল অনেক, যারা নীতিগতভাবে অর্থনীতির উদারীকরণের ঘোর বিরোধী, কিন্তু নবীন নেতার চোখ ধাঁধানো নির্বাচনী সাফল্যে আর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সহজাত ক্ষমতায় তারা বিশেষ সমালোচনা করতে পারে নি। এখন হাতি কাদায় পড়তে তারা হৈ হৈ করে তেড়ে এল। তাদের পছন্দ বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য  উ-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বৈদ্যনাথ। 

বৈদ্যনাথ কোন এক মঠের মহন্ত ছিল, গেরুয়াধারী সন্যাসী। তার মুখে কোনও কথাই আটকায় না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টাইট দেওয়ার জন্য তার বিধান ছিল প্রয়োজনে কবর থেকে উপড়ে এনেও ধর্ষণ করা যেতে পারে। এ হেন বৈদ্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হবার কথাই ছিল না, সে রাজ্যে ব-দলের প্রথমসারির রাজনীতিক নয়, আংশিক সময়ের রাজনীতিক। ব-দল তাকে প্রচারে ব্যবহার করে মাত্র। তাকে নেতৃত্বে  আনাটা সে রাজ্যের ভোটের আগে এক অপ্রত্যাশিত চাল ছিল তাঁর। বুদ্ধিটা অবশ্য টেকো-মোটাই জুগিয়েছিল।  রাজ্যে বিরোধী অনৈক্যের সুযোগ নিতে এমন একজন প্রধান মুখ দরকার ছিল যার সাম্প্রদায়িক প্রচার হবে কুন্ঠাহীন। নোটবাতিলের পরে পরে বিরোধী দলগুলির তখন হাড়ির হাল, সংখ্যালঘুদের বুথে হাজির করার মতো সামর্থ্য তখন তাদের নেই। তাদেরকে চোরা হুমকি আর বিপুল মেরুকরণের জোরে ব-দল বিপুল ভোটে সে রাজ্যে ক্ষমতায় এল। অর্থনৈতিক উদারীকরণ নিয়ে বৈদ্যনাথের বিশেষ উৎসাহ নেই, বরঞ্চ দেশকে বৈদিক যুগে নিয়ে যেতে চায় সে। এমন লোককে ছাগপুরের স্বদেশীদের বিশেষ পছন্দ হবে, বলাই বাহুল্য। ক-দলের জোটের সরকারের জোট হঠানোর জন্য দরকার নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। বৈদ্যনাথের দিকে পাল্লা ভারী হয়ে গেল, ক্রমশঃ সে বেশি বেশি করে গুরুত্ব পেতে লাগল। নবীন নেতা বুঝতে শুরু করলেন যে দলের কাছে তিনি ক্রমশঃই অবাঞ্ছিত হয়ে যাচ্ছেন। 

ভাবা যায়! এই বৈদ্যনাথ। যাকে তিনি প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনে সবচেয়ে বড়ো উ-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করে দিয়েছিলেন রাতারাতি, সে এখন তাঁকে টেক্কা দিচ্ছে! ছাগপুরের নেতৃত্ব এখন বৈদ্যনাথকেই তুরুপের তাস করতে চাইছে। সবকিছুতেই অতি উগ্র মতামত  বৈদ্যনাথের। ওর রাজ্যে একটা জগতবিখ্যাত সৌধ আছে, পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য, দেশবিদেশের দর্শনার্থীদের অতি প্রিয় গন্তব্য। কিন্তু আগেকার মুসলমান শাসকের তৈরি বলে রাজ্যের পর্যটন তালিকা থেকে দিল ঘ্যাচাং করে নাম কেটে! 
নাঃ, বৈদ্যনাথের পর্যায়ে নামা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ওর কোনও চোখের চামড়া নেই। ঐ তো, তখন তিনি ক্ষমতায়, আর রাজ্যে বৈদ্যনাথ সবে কিছুদিন হল মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা না থাকায় বাচ্চাগুলো মরছিল। তখন কাবিল না কাফিল কি সেই সংখ্যালঘু শ্রেণীর ডাক্তারটা যেন, নিজের নার্সিংহোম থেকে কটা সিলিন্ডার আনিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল, মিডিয়ায় খুব প্রচার হল। কিন্তু বৈদ্যনাথ এসে সটান বলে দিল, হিরো হবার শখ হয়েছে? দেখাচ্ছি মজা। বলে সত্যিই দিল সাসপেন্ড করে আর গারদে পুরে, কি একটা দুর্নীতির চার্জ দিয়ে। তিনি কিছুতেই অত নীচ হতে পারতেন না, শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, ভদ্রতার খাতিরে বলতে হতো, আপনে তো বহুত আচ্ছা কাম কিয়া। ভদ্র লোকেদের সত্যি কত অসুবিধা, তাই বৈদ্যনাথের মতো লোকেরা মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। 

আর লোকজনও সব বেইমান। টেকো-মোটাটা, যে কিনা সারাদিন কুত্তার মতো পায়ের কাছে বসে থাকত, সে পর্যন্ত এখন বৈদ্যনাথের দলে ভিড়েছে! এখন দেখলে এড়িয়ে যায়। যার ছেলের সম্পত্তি বাড়াতে অত সাহায্য করলেন তিনি, তার কি না এই মতি। সত্যি মানুষ চেনা মুস্কিল। আর ওই ভণ্ড বাবাজিটা, ফোঁস ফাঁস নিঃশ্বাস ছেড়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করল এত সরকারি সুবিধা পেয়ে, সেও এখন বৈদ্যনাথের পাতি চামচা হয়েছে, তাকে তেল মেরে পরশুরামের সাথে তুলনা করেছে। উকিলটা অবশ্য পাল্টি খাবে তিনি জানতেন, একটা ব্যক্তিত্বহীন ভেড়া, নিজে ভোটে জেতারও মুরোদ নেই, ক্ষমতার পদলেহন করা ছাড়া ওর আর কি গুণ আছে? নেহাত তিনি পাদপ্রদীপে এনেছিলেন তাই। নইলে ওই সামলা পরে কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করেই জীবন কাটত। আর বৈদ্যনাথের এক নম্বর সাকরেদটা যেদিন সেই অপমানটা করল, দাঁতে দাঁত চেপে হজম করতে হল। ব-দলের বিশাল জনসভা, বৈদ্যনাথের নামে, যা কি না কদিন আগেও তাঁর নামে হতো। তবে তাঁকে ডেকেছিল ওরা। তিনি গিয়েওছিলেন। ইদানিং তো বিশেষ কেউ ডাকে না। বৈদ্যনাথের কি যেন তাড়া ছিল, ভাষণ দিয়েই চলে যাবে হেলিকপ্টরে চেপে। ও চলে যেতেই পাবলিকের উৎসাহ চলে গেল, লোকজন উঠে পড়ল। ফলে তাঁর আর ভাষণ দেবার সুযোগ হল না। মুখ চুন করে মঞ্চ থেকে নামার সময় সাকরেদটা নামমাত্র কুশল জিজ্ঞাসার পর বলল, "বুরা মাত মানিয়ে মনো সাব, আজকাল তো আপ বিলকুল চুহা বন গ্যায়ে। কিধার গয়া আপকা ছাপ্পান ইঞ্চ ছাতি। কুছ বলতা হি নেহি। দেখিয়ে মহারাজজী কো। মর্দ হোতা হ্যায় এইস্যা।  ওঁ হি সাকেগা হামারে দলকো পাওয়ারমে ওয়াপাস লে আনা।" অপমানে জ্বলে উঠে তাঁর  ইচ্ছে হচ্ছিল সাকরেদটার উপর সি বি আই লেলিয়ে দিতে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, তাঁর হাতে এখন আর ক্ষমতা নেই। আর সাকরেদটা বৈদ্যনাথের মদত ছাড়া কিছুতেই এত সাহস পেত না।  কিন্তু বৈদ্যনাথকে কিছু করার ক্ষমতা তাঁর আর নেই। আর বৈদ্যনাথও মহা ধড়িবাজ, মুখে খুব মিষ্টি কথা বলে তাঁর সাথে। 

ক-দলের জোটের সরকার টিমটিম করে কাটাল পুরো মেয়াদই। খেয়োখেয়ি ছিল যথেষ্ট, শরিক দলগুলো বায়নাক্কা করে ছোকরা নেতার জান কয়লা করে দিচ্ছিল। আর তার নিজের দলের অপোগন্ডগুলো তো আছেই। তবু ছোকরার এলেম আছে বলতে হবে, টেনে দিল তো পাঁচ বছর। অবশ্য এখন শরিকগুলো বুঝে গেছে যে সরকার ফেললে নিজেদেরই ক্ষতি, মন্ত্রিত্ব খোয়া যাবে। তাই বোধ হয় ছোকরা চালিয়ে  যেতে পারল। কাজ অবশ্য সাঙ্ঘাতিক কিছু করে নি, তবে  তেমন কোনও বিপর্যয় হয় নি। ্ম্যাড়মেড়ে পাঁচটা বছর কাটাল। তবে ক-দলের ক্ষমতায় আর ফেরা সম্ভব ছিল না। বৈদ্যনাথ মেরুকরণকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে  ছোকরা নেতার সামাল দেওয়া সাধ্যের অতীত। কি সব দাবি তোলে বৈদ্যনাথ! এ দেশটাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের থাকতে গেলে, বাড়তি কর দিতে হবে --- প্রজাপালন কর। মুসলিম শাসনে একসময় যেমন জিজিয়া কর দিতে হতো, এ তারই মতো। কারন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশাত্মবোধ কম, তা ছাড়া এ হলো ইতিহাসের অন্যায়ের প্রতিকার। বামপন্থীরা তাদের ক্ষীণ হয়ে যাওয়া কন্ঠ নিয়ে আপত্তি জানাতে বৈদ্যনাথের শিবির সটান জানিয়ে দিল, বামেদের কাজই হল দালালি করা। কৈ, যখন জিজিয়া কর চালু হয়েছিল, বা গজনীর মামুদ যখন সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিল, তখন এইসব সিকুলাররা কোথায় ছিল? ভোটের পরে সব কটা দেশদ্রোহীকে প-দেশে চালান করে দেওয়া হবে। 

ভোট হল দু হাজার চব্বিশে। বৈদ্যনাথের নেতৃত্বে সারা দেশে ব-দলের জয় জয়াকার। সংখ্যালঘু মহল্লায় কোথাও দশ কোথাও পনের শতাংশ ভোট পড়েছে। তারা আর বাইরে বেরিয়ে ভোট টোট দেবার বিশেষ সাহস দেখায় নি। শরিক-টরিকের বালাই রাখে নি  বৈদ্যনাথ, ভোট পুরোপুরি তার নিজের নামে হয়েছে। সে নিজেই প্রার্থী বেছেছে, মন্ত্রী ঠিক করেছে সে। ছাগপুর এখন তাদের পুরো নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে ছাড়পত্র দিয়েছে তাকে, যেমন খুশি লোক বাছার। সে বেছে বেছে নিজের লোক রেখেছে, বলা বাহুল্য তিনি ব্রাত্য। তবু বৈদ্যনাথ নিজে বলেছিল বলে তিনি শপথ গ্রহণে এসেছিলেন। ভিতরটা জ্বলছিল, তবু তিনি হাসিমুখে বসেছিলেন, বৈদ্যনাথকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বৈদ্যনাথও কুশল জানতে চেয়েছিল, আর বলেছিল, "মনো সাব, আপ ফিকর মাত কিজিয়ে। আপকো জম্বুরত্ন মিল জায়েগা। ম্যায় আভি আভি সাইন করুঙ্গা।" শুনেই দপ করে জ্বলে উঠেছিল ভিতরটা। বৈদ্যনাথের মতলবটা তিনি বোঝেন না যেন? আর  কথা বলার কি ছিরি, তিনি যেন জম্বুরত্ন খেতাবের জন্য হেদিয়ে মরছেন। কিন্তু কি করবেন, না বলাটাও খুব দৃষ্টিকটু হবে। বাধ্য হয়েই একটু হেসে ধন্যবাদ দিতে হলো। 

আজ দেওয়া হলো সেই খেতাব, তাও আবার সেই লোকটার সাথে, যে কি না জাতির জনকের খুলি ফুটো করে দিয়েছিল। জাতির জনক যাকে বলা হয়, তিনি জম্বুদ্বীপের স্বাধীনতার সময় ক-দলের এক বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। ব-দলের নেতারা স্বাধীনতায় বিশেষ অংশ নেয় নি, সে দলের এক উগ্র সমর্থকের হাতে জাতির জনক নিহত হন। হত্যাকারীর প্রতি ব-দলের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন ছিল, কিন্তু এভাবে তাকে জম্বুরত্ন বানানো বৈদ্যনাথের পক্ষেই সম্ভব। লজ্জায়, অপমানে তাঁর চোখ ফেটে জল আসছিল। সত্যিকারের অশ্রু। তবু তিনি সামলে নিলেন। নিঃসঙ্গ বাড়ি ফিরে এলেন। চুপ হয়ে বসে ছিলেন, ঘরে আলো জ্বালান নি। ধীরে ধীরে উঠে চোখ মুছলেন।  পোশাকটা ঠিক করবেন বলে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলেন। বুকটা ধক করে উঠল। আয়নার মধ্যে  ও কার আবছা প্রতিচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে? পক্বগুম্ফ প্রবীণ নেতা না? তাঁর প্রতি একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি। তিনি দরদর করে ঘেমে উঠলেন। বুকের ভিতর উথাল পাথাল হচ্ছে। তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। দু চোখ চেপে ধরে পাশে রাখা চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়লেন। মাথা ঘুরে গেল। সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন তিনি। 

কতক্ষণ এভাবে কেটেছে কে জানে? সংজ্ঞা  ফিরে আসতে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। এ কি! এ তো তাঁর বাড়ি নয়, কিন্তু এ  তাঁর খুব পরিচিত জায়গা। এই তো তাঁর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার টেবিল। ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তে দেখলেন, অক্টোবর ২০১৮। মানে? দু হাজার উনিশের নির্বাচনের এখনও প্রায় আট মাস বাকি, দু হাজার চব্বিশ আসার তো প্রশ্নই নেই। ওই তো বাইরের ঘরে টেকো-মোটার গোদাগোদা পায়ে থপথপ করে পায়চারি করার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।  তার মানে তিনি এখনও ক্ষমতায়? কাজ করতে করতে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? ওটা স্রেফ দুঃস্বপ্ন?  উফ, কি সাংঘাতিক!  কিন্তু তিনি যে ওই ছ বছরের প্রতি মাস দিন কি ঘটেছে মনে করতে পারেন। স্বপ্ন এত দীর্ঘ হয়? 

যা হোক, কিছুতেই বৈদ্যনাথকে ওরকম জায়গা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন নেই। দরকারে তিনি আরও নির্মম হবেন। বৈদ্যনাথ যা যা দাবী তুলতে পারে, তিনি নিজেই তুলে ওর পালের বাতাস কেড়ে নেবেন। ওই প্রজাপালন করটার ব্যাপারে ভেবে দেখতে হবে, ওটা কি করে চালু করা যায়। সীমান্তে প-দেশের সঙ্গে যদি একটা টক্কর লাগানো যায় তো খুব সুবিধা হয়। প-দেশের প্রতি লোকের যা আক্রোশ, আর কিছুর দরকার পড়বে না। জাতীয়তাবাদ দিয়েই ভোটটা উৎরে যাওয়া যাবে। আর টেকো-মোটা, উকিল আর যে সব চামচাগুলো আছে, তারা যাতে বিশ্বাসঘাতকতা না করতে পারে কড়া নজর রাখতে হবে। হয়তো স্বয়ং রামচন্দ্রই তাঁকে স্বপ্নে সাবধান করে দিয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে ইষ্টদেবতার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতাসূচক প্রণাম করলেন। 




------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, অক্টোবর ২০১৮


কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন