সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

সোনার তরী


















সোনার তরী
-
শুভাশিস ঘোষাল 

পর্ব ১।। কৈশোর 

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে আজ কদিন থেকেই। সেই সঙ্গে মেঘের গর্জন আর তুমুল বাজ পড়ার শব্দ। এবার বর্ষা বেশ জমাটি। ফসল ভালো হবারই কথা। আমন ধান বোনা হয়ে গেছে সময়েই। শীতের শুরুতেই তাদের গ্রামে ঘরে ঘরে গোলা ভরে উঠবে ধান। এক যদি না অতিবৃষ্টিতে ভেসে যায়। ছোট ছোট চাষি এরা। কারুরই দু-চার বিঘের বেশী জমি নেই। সারাবছর উদয়াস্ত খাটতে থাকা মানুষগুলোর অন্ততঃ কটা দিনের জন্য মুখে একটু হাসি ফুটবে। এর বেশী এরা কিছু চাইতেও শেখে নি। গ্রামে পরিশ্রুত পানীয় জল নেইবিদ্যুৎ কেনার ক্ষমতা নেইস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেইস্কুলও বলতে গেলে না থাকার মতই। তবু ওঠেনা কোনো দাবীদাওয়াযেন শুধু বেঁচে থাকার চেয়ে বেশী নেই কিছু চাওয়ার। ওদের কথা ভেবে কষ্ট লাগে রবির। কবে যে ওদের ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ জেগে উঠবে?

রবি নিজেও চাষ করত একসময়। তবে ধানজমি ছিল না ওর। দরিদ্র ক্ষেতমজুর পরিবারের ছেলে সেতার উপর বাবাকে হারিয়েছে একেবারে ছোটবেলায়। রবির বাবা দেবেনের সামান্য কয়েক বিঘে জমি ছিল। তবে দেবেন তার  বাবার করা দেনা শোধ করতে অনেকটা জমিই বেচে দিতে বাধ্য হয়। কষ্টেসৃষ্টে চলত যা হোক তাদের, তার মধ্যেও দেবেনের শখ ছিল লেখাপড়ার। আর ছিল কিছুটা ভবঘুরে বাতিক। একটা পুরোনো ভাঙ্গাচোরা সাইকেল কিনেছিল সে। তাই নিয়ে দূর কে দূর গ্রামে চলে যেত। সেবার খালপারে বাস রাস্তার ধার দিয়ে যাচ্ছিল, একটা বাস একটা ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দেবেনকে ধাক্কা মারে। ছিটকে পড়েছিল সে, পাঁজরের হাড় ভেঙ্গেছিল, সারা গায়ে ক্ষত হয়েছিল অনেক, শুধু কোনোমতে প্রাণটা রক্ষা পেয়েছিল। লোকজন ধরাধরি করে টেম্পো চাপিয়ে নিয়ে গেল কাছাকাছি গঞ্জ শহরে। দেড়বছরের রবিকে কোলে নিয়ে মা ছুটল হাসপাতালে। দেবেন বেঁচে ফিরল বটে, তবে চলৎশক্তিহীন। মা অনেক চেষ্টা করেছিল সারিয়ে তোলার। সামান্য জমির প্রায় সবটাই বেচে দিতে হল, শুধু বসতবাড়িটা বাদে। তবু শেষ রক্ষা হল না। আগে বোঝা যায় নি, মাথায় ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। বাড়ি ফেরার কয়েকমাস বাদে সব শেষ হয়ে গেল। রবি তখন এত ছোট যে বাবাকে তার মনে পড়ে না। তার মা অন্যের জমিতে খেটে কোনোমতে তাকে মানুষ করেছে। 

মা ও চলে গেল কয়েকবছর আগে। একটা বিশ্রীধরনের জ্বরে ভুগে দুদিনের মধ্যেই। সেও ছিল এক আষাঢ় শেষের বেলা। চিকিৎসার সুযোগ হল না কোনো। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামেই। জরাজীর্ণ একটা বাড়ি মাত্রডাক্তার ওষুধ কিছুই মেলে না। পাঁচুডাক্তার লেবেল মেরে দাগ দেওয়া শিশিতে ওই একটা মিক্সচার দিয়ে দেয় সব রোগেই। পাঁচুডাক্তার আসলে ডাক্তার নয়মুদিখানা চালায়শখের ডাক্তারি করে। এককালে গঞ্জশহরে কোনো এক কম্পাউন্ডারের সাকরেদি করেছিল কিছুদিন। তবে সাধ্যমত চেষ্টা করে সেঅন্ততঃ পথ্যের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা কিছুটা কাজে লাগে বই কিআর লোকেও একেবারে বিনা চিকিৎসার বদলে কিছু চিকিৎসা হচ্ছে ভেবে সান্ত্বনা পায়। তাতে হয়ত সামান্য মনস্তাত্বিক সুবিধা হয়।
পাঁচু বলেছিল, “রবিআমি আর কি করতে পারি বলএকটা জলপট্টি দিয়ে দেখ কষ্টটা একটু কমাতে পারিস কি না। আর ভগবানকে ডাক।“
গঞ্জশহর অন্ততঃ পাঁচ মাইল দূরে। কাঁচামাটির রাস্তা সেই ভরা বর্ষায় পাঁক হয়ে আছে। গরুর গাড়ি যাবারও অবস্থা নেই। একটা ষোল বছরের ছেলে আর কতই বা করতে পারেমা ও আর কোথাও যেতে চায় নি। বলেছিল, “শুধু আমার কাছে বোসএকটু শান্তি পাব।“ দুদিন মায়ের বিছানার পাশে ঠায় বসেছিল রবি। পরপর জলপট্টি বদলে দিয়েছে। মা রবির হাতটা চেপে ধরে ছিল অনেকক্ষণকি যেন বলতে চেয়েছিল --- মুখে কথা ফোটেনি। তারপর তপ্ত হাতটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা অসাড় হয়ে এল --- মার বুকের শীত যেন অনুভব করল শরীর জুড়ে। রবি বুঝতে পারল সে একা হয়ে গেল পৃথিবীতে। মুখে প্রশান্তি নিয়ে মা চলে গেল এটুকু সান্ত্বনা পেয়েছিল রবি।
মার মৃত্যুর পর প্রায় আট বছর হল। তার সবকিছু ছিল মা। ছোট থাকতে প্রথম যখন স্কুলে যায় রবিঅনেক আশা নিয়ে গেছিল শেখার। মা সব সময় বলতলেখাপড়া করিস মন দিয়েমন থেকে। ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে লেখাপড়া শিখতেই হবে। কিন্তু স্কুলে গিয়ে পেল একরাশ হতাশা। মাস্টার মশাই শুধু পড়া মুখস্থ ধরেন। কি হচ্ছেকেন হচ্ছে সেসব কিছুই বলেন না। প্রশ্ন করলে তিরিক্ষি হয়ে ওঠেনআর বেত চলে সপাসপ। তাও দাঁতে দাঁত চেপে দুমাস পড়েছিল রবি। কিন্তু এভাবে সে কি শিখবেআর না পেরে মা কে কথাটা বলেই ফেলে।
মা বলেছিল, “বেশতোর ভালো লাগছে না যখন নাই বা গেলি ইস্কুলে। আমিই তোকে পড়াইযেটুকু জানি।"
রবি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল মায়ের প্রতিক্রিয়ায়। ব্যাপারটা এত সহজে মা মেনে নেবে আশাই করে নি। ছোট হলেও একথা বুঝতে তার অসুবিধা হয় নি যে মা অনেক আশা করেছিল তার উপর --- সে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে।
মা সামান্য লেখাপড়া জানত। রোজ মাঠের কাজ শেষ হলে রবিকে পড়াতে বসত। তার স্বল্পশিক্ষিত মা কি যত্নে তাকে অক্ষরপরিচয় করিয়েছিলবর্ণপরিচয়ের গল্পঈশপের গল্পযোগ-বিয়োগএই সব শেখার প্রতিটা মুহুর্ত রবির মনে আছে। এমন করে যদি স্কুলের মাস্টারমশাই শেখাতেনসে কক্ষনো স্কুল ছেড়ে আসত না। সে তো শিখতেই গিয়েছিল।
অল্পদিনেই মার যা যা জানা ছিলরবির শেখা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রবির শেখার স্পৃহা ছিল অদম্যতাই নিজে নিজেই বই জোগাড় করে পড়তে শুরু করল। তেমন বাঁধাধরা রাস্তায় নয়যেমন সুযোগ হল তেমনই পড়া। কোনো কোনো জিনিষ বুঝতে পারে নাবিশেষ করে বিজ্ঞান আর অঙ্কের ব্যাপারে। তবে সে দমে নাআবার পড়ে। আর মাকে কাজে সাহায্য করে। আর একটু বড় হলে সে পুরো রোজগেরে হতে পারবে।
দিনমাসবছর যায়। রবি একটু একটু করে বড় হয়। চাষের কাজ এখন সেও করতে পারে। মাটি কোপানোবীজ বোনাআগাছা ওপড়ানোধান কাটা। শ্রমের পুরষ্কার তার শরীরে ফুটে ওঠে বলিষ্ঠ পেশী হয়ে।
তবে অন্যের জমিতে সারাবছর কাজ জোটে না। রবি সেসব দিন পুকুরের পাড়ে বসে অপার বিস্ময়ে হাঁসগুলোকে লক্ষ্য করে কেমন ওরা সারাদিন জলে ভেসে ভেসে গেঁড়ি গুগলি খোঁজে। পুকুরের পানা শ্যাওলাকলমীফুলের গন্ধঘাসে বসে থাকা দুএকটা শালিখ --- রবির মনে একাত্ম হয়ে যায়। আবার শরতে যখন কাশফুল ফোটেঅনেক দূরের রেললাইনটাকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়রেলইঞ্জিনের কু ঝিক ঝিক শব্দটাকে পুরোপুরি মায়াবী মনে হয়। তারপর হেমন্ত আসে একরাশ কুয়াশা নিয়ে। রবি গভীর আগ্রহভরে ঋতুর পরিবর্তন লক্ষ্য করে। শীতবসন্তগ্রীষ্মবর্ষা --- কেমন আসে নিজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে --- তারপর চলে যায় সময় ফুরোলে।
মা মারা যাবার পর রবির মনে হল গ্রামে থেকে আর কি হবেএখানে কাজকর্ম জোটানো কঠিন। কাছাকাছি গঞ্জ শহরে বা আরো দূরে অনেক বড় শহরে গিয়ে দেখা যেতে পারে। রবি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায় যৎসামান্য জিনিষ একটা পোটলায় বেঁধে। আপাততঃ লক্ষ্য মাইল পাঁচেক দূরে গঞ্জ শহরে।

পর্ব ২।। গঠন

ঢোলপুর নিতান্তই একটা ছোট জায়গা। কাজের সুযোগ কম। তবে বাজার আছে । আর সব থেকে বড় কথা বাসস্ট্যান্ড আছে বাজারের ঠিক গায়েই। কলকাতা থেকে মালদা যাবার বাসটা এখানে একটা বড় স্টপ দেয়। যাত্রীরা খাওয়া দাওয়া করে। তাই সার বেঁধে পর পর কয়েকটা ভাতের হোটেল। বিক্রিবাটা মন্দ হয় না। এর মধ্যে একটাতে ভাগ্যক্রমে একটা কাজ জুটে গেল রবির। বাসটা যখন এসে দাঁড়ায় তখন ব্যস্ততার ধুম পড়ে যায়। টেবিলে অর্ডার নেওয়াঝটপট রান্নাঘর থেকে প্লেটে সাজিয়ে ভাতডালমাছ এসব এনে দেওয়াহয়ে গেলে টেবিল মুছে পরের জনের ব্যবস্থা করাএইসব। হোটেলে কাজ করার একটা মস্ত সুবিধা খাওয়ার চিন্তা নেই। ভাতডালতরকারি তো বটেইমাছমাংসডিম সবই জুটে যায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। মালিক হরেনবাবু লোক ভালোকর্মচারীদের খাওয়ার ব্যাপারে অন্ততঃ কোনো কার্পণ্য করেন না। আর রান্নার ঠাকুরটির রাঁধার হাতও বেশ ভালো।
ঢোলপুরে এসে একটা মস্ত লাভ হয়েছে রবির। স্থানীয় এক ক্লাবের উদ্যোগে একটা লাইব্রেরি রয়েছে এখানে। সেখানে রবি এক নতুন জগৎকে খুঁজে পায়। এতো বই --- গল্পউপন্যাসনাটককবিতাভূগোলবিজ্ঞান সবকিছু। যেটুকু অবসর বের করতে পারে রবিপুরো সময়টাই পড়ে --- সবকিছু। তবে সবচাইতে বেশী টানে কবিতা। কবিতার মধ্যে যেন হারিয়ে যায় রবি। যেন নতুন করে খুঁজে পায় নিজেকে --- এই পৃথিবীকে। তার মনের মধ্যেও কবিতা আসতে থাকে --- শুধু বেরোনোর ভাষা পায় না। কবিতা লিখতে হবে তাকে --- নইলে কিছুতেই সে প্রাণের শান্তি পাবে না।
পড়তে হবে আরো। প্রধান সমস্যা সময়। হোটেলে কাজ করে অবসর মেলে না। সারাক্ষণই খদ্দের থাকে প্রায়আর খদ্দের মানেই কাজ। রবি ঠিক করল বাজারে ফল বিক্রি করবে। পুঁজি সামান্য কিছু জমেছে খদ্দেরদের দেওয়া বখশিশ থেকে। বাকিটা জোগাড় হয়ে যাবেজ্যোতিদাদা বলেছেন। জ্যোতিদাদা ক্লাবের লাইব্রেরির প্রধান উদ্যোক্তা --- বইপাগল মানুষ। স্থানীয় ব্যাঙ্কে কাজ করেন। উপার্জনের অনেকটাই বইয়ের পিছনে খরচ করেনআর সেই বই লাইব্রেরিকে দান করেন। রবির পড়ায় আগ্রহ দেখে জ্যোতিদাদাই রবিকে বলেন দোকান করার কথা। তাহলে সকালে বিক্রিবাটা শেষ করে আবার বিকেলে দোকান খোলার ফাঁকে বেশ কিছুটা সময় পাবে রবি।

জ্যোতিদাদার প্রভাব এ শহরে যথেষ্টই। একে অনেকদিনের বাসিন্দাতায় ব্যাঙ্কে কাজ আর সমাজসেবা করেনযা সকলের চোখে পড়ে। ব্যবসায়ী সমিতির অনুমোদন হয়ে গেল সহজেই। দোকান চালু হল। চলে মন্দ নয়। ফল ছাড়াও টুকটাক মনিহারি জিনিষ, পেন-পেন্সিল খাতাপত্র এসবও রাখে রবি। জ্যোতিদাদার বাড়িতেই থাকে রবি। একটু কুন্ঠিত ছিল রবিকিন্তু জ্যোতিদাদা কোনো ওজর আপত্তি শোনেন নি। বলেছিলেন, "দেখ এত উদ্যোগ নিয়ে লাইব্রেরি বানালামকিন্তু পড়ার লোক পাই কইএটা আমি নিজের  স্বার্থে করছি রে।" এত আন্তরিকতা রবি ফেরাবে কেমন করেতবে জ্যোতিদাদার টাকাটা তাড়াতাড়ি শোধ করে দেবে সে। 

জ্যোতিদাদার বাড়ি যত্নের কোনও অভাব নেই। জ্যোতিদাদা তো বটেই, ওর স্ত্রীও রবিকে খুবই স্নেহ করেন। ওনার খুব স্নিগ্ধ  ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। ভদ্রমহিলার নাম কাদম্বরী, বয়সে রবির থেকে অল্পই বড় হবেন, অনেক অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে চলে এসেছেন। রবি এরকম রাসভারী অথচ সুন্দর নাম কখনও শোনেনি আগে। রবি অভিধান খুলে দেখেছে কাদম্বরী শব্দের অর্থ মদিরা। নামেই যেন মাদকতা আছে --- মনে হয় যেন সূর্য ডোবার পর পুব আকাশে গোল থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। রবি শুনেছে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্টের কাদম্বরী নামে একটা কাব্য আছে। সত্যি কাব্যের উপযুক্ত নামই বটে। রবি যখন প্রথম বাড়িতে এসেছিল, তখন বৌঠান বলে সম্বোধন করেছিল। কাদম্বরী স্মিত হেসে বলেছিলেন, "রবি, তোমাদের গ্রামে কি এরকম সম্বোধন এখনো চলে?" তা অবশ্য নয়, বৌঠান কথাটা বলা বোধ হয় খুব সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্তু নামের সাথে বৌদি বলাটাও কেমন যেন জোলো শোনায়। রবি খুব লজ্জা পেয়ে গেছিল। কিন্তু কাদম্বরী নিজেই বললেন, "তুমি আমাকে বৌঠান বলেই ডেকো, ভারী মিষ্টি শোনায়।" 
হোটেলে একবছর কাজ করার পর তিনবছর দোকান দেওয়া হয়ে গেছে রবির। এখন সে কুড়ি বছরের এক পরিপূর্ণ যুবক। হালকা চাপ দাড়ি আর কোঁকড়ানো চুলে দীর্ঘকায় রবিকে ভারি সুন্দর সুপুরুষ দেখায়। আর এই চার বছরে রবি প্রচুর বই পড়ে ফেলেছে। বেশ খানিকটা ইংরাজিও শিখেছে। প্রথম প্রথম জ্যোতিদাদা খুব সাহায্য করেছিলেন। এখন রবি নিজে নিজেই বেশ বুঝতে পারে। আর বাংলা গল্প কবিতা যে কত পড়েছে তার শেষ নেই। লিটল ম্যাগাজিনের অনামা অজানা লেখক কবিদের অনেকের লেখা দারুন উপভোগ করেছে। দু একটা লিটল ম্যাগাজিনে জ্যোতিদাদার লেখাও কয়েকবার বেরিয়েছে। তবে ভদ্রলোক নিজে লেখার থেকে লেখায় উৎসাহ বেশি দেন।

আর জ্যোতিদাদা খুব সুন্দর পিয়ানো বাজান। এই যন্ত্রটা রবি এখানে এসেই প্রথম দেখেছে। কেমন সুন্দর টুংটাং সুর বাজে। জ্যোতিদাদা যখন বাজান, রবি এককোণে বসে চুপ করে শোনে মন দিয়ে। সুরগুলো খুব ভালো লাগে --- রবির মনে গেঁথে যায়। এগুলো নাকি পশ্চিমী কিছু গানের সুর, জ্যোতিদাদাকে জিজ্ঞাসা করে রবি জানতে পারে। আহা, এইরকম সুরে যদি সে বাংলায় গান লিখতে পারত, কি ভালই না হত, রবি ভাবে। 

রাত্রি নিস্তব্ধ হলে তারাদের দিকে চেয়ে রবি ভাবতে থাকে গ্রামের কথাতার মায়ের কথা --- আর তখন তার মনের মধ্যে ভেসে আসতে থাকে কবিতার কিছু পদ। এখন সেগুলো ভাষা পেতে থাকে। রবি তখন তার নতুন বানানো কবিতার খাতায় লিখতে থাকে সুন্দর হস্তাক্ষরে। আবার কখনো কখনো পছন্দ হয় না তেমন। সেগুলোকে কাটেও খুব সুন্দর করে --- নানারকম নকশা বানায় সেগুলো দিয়ে। কিন্তু লেখা কারুকে দেখাতে লজ্জা পায় --- কে জানে কেমন হয়েছেতবু স্বপ্ন দেখে তার লেখাও ছেপে বেরোবে লিটল ম্যাগাজিনে --- হয়ত বা বই হয়ে বাঁধাই মলাটের মধ্যে। তারপর নিজের মনেই হেসে ফেলে --- ধুরতাই হয় না কি কখনো?

তবে বৌঠান জানতে পেরে যান যে রবি লেখে। জ্যোতিদাদা না হয় নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু বৌঠান তো বাড়িতেই থাকেন, রবিকে লিখতে দেখে ফেলাটা স্বাভাবিক। আর রবিরও বোধ হয় অবচেতনে বৌঠানকে লেখা দেখানোর একটা ইচ্ছা কাজ করছিল। লিখে একজন কাউকে না দেখাতে পারলে কেমন যেন অপূর্ণতা থেকে যায়। আর কেমন হয়েছে একটু জানতে পারলেও কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। জ্যোতিদাদা এত ভালবাসেন তাকে, তবু তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব যেন একটু সংকোচের দেওয়াল তুলে দেয়। কিন্তু বৌঠানকে যেন কত কাছের মনে করা যায় সহজে। মনে হয় যেন লেখাগুলো ওঁকেই উৎসর্গ করা যায়।  প্রাথমিক জড়তা ভেঙ্গে রবি বৌঠানকে তার লেখাগুলো দেখায়। তবে আর্তি করে, জ্যোতিদাদাকে এখন কিছু না জানাতে। স্মিত হেসে বৌঠান বলেন, "বেশ, তবে শর্ত হল সব লেখা আমাকে দেখাতে হবে।" রবি না করে না, বৌঠান কি তার মনের কথা পড়তে পারেন?

রবি একটা কবিতা লিখেছেযাতে একটা ঝর্ণা নিজের শক্তিকে খুঁজে পাচ্ছে ঘুম ভেঙ্গে উঠে। বৌঠানকে সে পড়ে শোনাতে শোনাতে বৌঠানের চোখেমুখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা দেখতে পায়। "কি অপূর্ব লিখেছ রবি!", তিনি বলেন। এই কথাটা শোনার জন্য বোধ হয় পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য ছেড়ে দেওয়া যায়। রবি বলবে কি, সে যে নিজেই সেই ঝর্ণা, যে নিজের শক্তিকে চিনতে পেরেছে। 

ঢোলপুরে জীবনযাত্রা বেশ নির্ঝঞ্ঝাট, এত যত্নআর পড়ার এত সুযোগ রয়েছেরবি তবু অনুভব করে তার গ্রাম তাকে টানছে। সেই পুকুরশ্যাওলা কলমীর গন্ধহাঁসেদের সারাদিন ভেসে চলাকাশফুলবিশেষ করে তার প্রিয় জায়গা তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট নদীটির পাড় --- এগুলো তার জীবনে জড়িয়ে আছে। কিছু লিখতে গেলে ওগুলোর কথাই মনে পড়ে। এই আধাশহরের ঘিঞ্জি পরিবেশে তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে। তবে তার থেকেও বড় কারণ রয়েছে একটা। তার গ্রামের বাচ্চাদের নিয়ে একটা স্কুল গড়বে সে। সেটা হবে একদম অন্যরকম। সেখানে পড়া হবে গাছের ছায়ায় বসে। বেত থাকবে নাধমক নাযার যা ভালো লাগে তাই দিয়েই শেখা হবে --- গল্পের মধ্যে দিয়ে। সেখানে পড়াশুনোর বাঁধাধরা সময় থাকবে না। রবি যে স্কুলে গেছিল ছোটবেলায় --- সে স্কুল যা যা নয়তাই হবে এই নতুন স্কুল। এটা করতেই হবে রবিকে। কারণ সে দেখেছে কিভাবে বাচ্চাগুলো পড়া ছেড়ে দেয়।
জ্যোতিদাদার টাকা শোধ হয়ে গেছে এখন। দোকানটা বেচে দিলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু চলে যাবার কথাটা জ্যোতিদাদাকে বলতে খুব খারাপ লাগবে রবির। ভদ্রলোক তার মতো একটা অপরিচিত সহায়-সম্বলহীন ছেলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে অনেক করেছেন। আর তার উপরে রয়েছেন বৌঠান। ভীষণ সংবেদনশীল মানুষ তিনি, শুনলে খুব অভিমান করবেন।  দ্বিধায় পড়ে রবি --- কিছুতেই বলে উঠতে পারে না।
ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে গেল। সেদিন নিজের ছোট্ট একচিলতে ঘরে তার তক্তপোষের উপর আধশোয়া হয়ে রবি মন দিয়ে লিখছিল। জ্যোতিদাদা কখন ঘরে ঢুকে পড়েছেন বুঝতেও পারে নি।
কি লিখছিস রে রবি?”
প্রশ্নটা শুনে হঠাৎ করে চমকে ওঠে রবি। তারপর ধরা পড়ে যাবার ভঙ্গিতে একটু লাজুক হাসি হেসে বলে, “ও কিছু না।“
জ্যোতিদাদা আগে কয়েকবার রবিকে লেখায় উৎসাহ দেবার চেষ্টা করে বলেছিলেন, “লেখাটা হল তোর বলতে না পারা কথা। কোথায় বেরোবেকে পড়বেনা ভেবেই লিখে দেখবি কত কষ্ট হালকা হয়ে যায়।“ এখন স্পষ্টতঃই রবি লিখছেতাই আর জ্যোতিদাদার কাছ থেকে আড়াল করা অনুচিত। দ্বিধাগ্রস্তভাবে রবি খাতাটা জ্যোতিদাদার হাতে তুলে দেয়।
সহজ পাঠ?” শিরোনাম দেখে জ্যোতিদাদা জিজ্ঞাসা করেন।
ওই আর কি। ছোটদের পড়াশুনো শেখার জন্য একটা বই বানাচ্ছিলাম।“
আমি কি একটু পড়ে দেখতে পারি?”
আপত্তি করার প্রশ্ন ওঠে না। জ্যোতিদাদা নিজের ঘরে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেন রবির লেখাটা। কি সুন্দর গল্প আর ছড়ায় ছোটদের লেখাপড়া শেখার সম্পূর্ণ নতুন ধরণের বই। কি সহজঅথচ কি সুন্দরযেন নতুন যুগের বর্ণপরিচয়। তিনি বৌঠানকে গিয়ে দেখিয়ে বলেন, "দেখো, আমাদের রবি কি সুন্দর লিখেছে।"
খুব ভাল লিখেছিস রে। এটা শেষ করতারপর ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলা ভাষা এভাবেই শেখানো উচিৎ”রবির ঘরে ফিরে এসে খাতাটা রবিকে ফেরত দিতে দিতে জ্যোতিদাদা বললেন।
জ্যোতিদাদাআমার খুব ইচ্ছে করছে গ্রামে ফিরে গিয়ে বাচ্চাদের পড়াই” --- ধাঁ করে কথাটা বলে ফেলে রবি।
কথাটা বুঝতে একটু সময় নেন জ্যোতিদাদা। তারপর বলেন, “গ্রামে ফিরে গিয়ে বাচ্চাদের পড়াবিসে তো খুব ভালো কাজ হবে। তুই সত্যি অনন্য রে রবি। কিন্তু রোজগার কি হবে?”
সেটা নিয়ে রবির নিজেরই কিছুটা সংশয় আছে। তার বসতবাড়ির লাগোয়া জমিটুকু ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই নেই। কয়েকবছর আগে হলে দিব্যি অন্যের জমিতে কাজ পেয়ে যেতযা সে আগে করত। জমিতে কাজের একটা সুবিধা যে টাকার সাথে চাল পাওয়া যায়বাজার থেকে কিনতে হয় নাতাতে খোরাকিটা দিব্যি চলে যায়। একা মানুষ সেপ্রয়োজন খুবই সামান্য। কিন্তু গত চার বছরে গ্রামের অর্থনীতিতে আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। যা যুগ যুগ ধরে একান্ত কৃষকেরই কাজ ছিল --- চাষসরকারি সিদ্ধান্তে তা এখন খুলে দেওয়া হয়েছে মোটা বিনিয়োগকারী এগ্রিকালচারাল কোম্পানিদের কাছে। কোম্পানি উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষ করায়। আগে যে জমিতে গ্রামে দেড়শ দুশো লোকের অনায়াশে কাজ জুটে যেতসেখানে এখন পাঁচ দশ জন কোম্পানির লোক কাজ করে। তারা ইউনিফর্ম পরে ট্রাকে চেপে আসেএকরের পর একর জমিতে ট্রাক্টর চালায়কীটনাশক ছড়ায়অথবা ফসল কাটার যন্ত্র চালিয়ে ফসল কেটে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে যায় কোম্পানির প্রসেসিং সেন্টারে। রপ্তানিতে বিদেশী মুদ্রা আয় হয়তাই কোম্পানিরা পায় কর ছাড়শস্তায় বিদ্যুৎসেচের জল এই সব সুবিধা। পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় দেশের শ্রীবৃদ্ধি --- মান্ধাতা আমলের কৃষিপদ্ধতির সংস্কারের ফলে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে অনেক। দেশের কয়েক কোটি ভূমিহীন কৃষিজীবি সেই শ্রীবৃদ্ধির দাম চোকায়। গ্রামে মাঠের কাজ হারিয়ে তারা কাছাকাছি শহরে ভিড় করে --- বা কলকাতামুম্বইদিল্লী ইত্যাদি মহানগরে। রিক্সা টানাহকারিফেরিজোগাড়ে মজুর --- যে যা পারে। নগর বাড়তে থাকে আয়তনে --- আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভিখারিগণিকা আর দরিদ্র মানুষ। ঝুপড়িরেলস্টেশনবস্তি ছেয়ে যায় নতুন ধরনের উদ্বাস্তুতে। ঝুপড়ি বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রাক্তন কৃষিজীবীদের সন্তানেরা বড় হতে থাকে। 
কিন্তু রবিকে যে ফিরতেই হবে। সে একটা উপায় বার করে। গ্রামে তার বসতবাড়ির কাছেই নদীর বুকে চড়া পরে একটা ছোট দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে কিছুদিনশিয়ালমারির চর বলে সেটাকে। ঝোপঝাড়ে ঢাকাযাওয়ার অসুবিধা বলে কেউ যায় না। রবি ঠিক করল সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে সে চাষ করবে সেখানে। খুবই মেহনতের কাজতবে এ ছাড়া আর কিছু উপায় নেই। গ্রামে আর একটা দোকান দিয়ে লাভ নেই। পাঁচুডাক্তারের দোকানই ভাল করে চলে না। লোকের হাতে নগদ থাকে না বলতে গেলে। চড়ার জায়গাটা রবির বাড়ির কাছে হলেও অবশ্য ঠিক রবির নিজের নয়সরকারি সম্পত্তি হয় নিয়মানুযায়ী। তবে আর কোনো দাবিদারও নেই যখন আর সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই ও জায়গা নিয়েতবে দেখাই যাক না।
জ্যোতিদাদাকে সংক্ষেপে বোঝায় রবি। ভদ্রলোক বোঝেন কি না বোঝা যায় নাতবে আপত্তি করেন না। শুধু বললেন যে মাঝে মাঝে আসতেবইপত্র যা লাগবে বলতে। সে তো রবিকে আসতেই হবে। 
জ্যোতিদাদাকে তাও না হয় বলা গেল, তিনি আদর্শবাদী কর্মবীর মানুষ, কাজকে ব্যক্তিগত ব্যাপারের উপরে স্থান দেবেন। কিন্তু বৌঠান খুব স্পর্শকাতর মানুষ, জানলে ভীষণ দুঃখ পাবেন, বিশেষ করে এই জন্য যে রবি তাকে না জানিয়েই চলে যাবার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু জ্যোতিদাদার সঙ্গে আগে কথা না বলে এ ব্যাপারে কিছু করা যায় না। 
শেষ কদিন বৌঠান আর আগের মত লেখা দেখতে চান নি। মানুষটা খুব গুটিয়ে গেলেন। একবার শুধু বলেছিলেন, "তুমি চলে যাবে কাজে, কিন্তু সেটা আগে আমাকে জানাতে পারতে। আমি কি বাধা দিতাম?" কি আর বলবে রবি, মুখ নিচু করে অপরাধ স্বীকার করে নেয়।  
ঢোলপুরে থাকতে থাকতে বাকি কদিনে রবি সহজ পাঠ লেখাটা শেষ করে ফেলে। জ্যোতিদাদার জেদাজেদিতে সেটা ছাপাতেও রাজি হয় সেযদিও আশা করে নি কেউ সেটা ছাপবে। কিন্তু কি আশ্চর্যজ্যোতিদাদার এক চেনা ছোট প্রকাশক সেটা পড়ে এত আপ্লূত হলেন যে সেটা ছাপতে ছাইলেন। জ্যোতিদাদা অবশ্য রবির পরিচয় আগে দেন নিসে যে একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের নিজে নিজে লেখাপড়া শেখা মাত্র কুড়ি বছরের ছেলেসেটা আগে জানলে ভদ্রলোক আদৌ লেখাটা পড়ে দেখবেন কি না সন্দেহ ছিল। রবির প্রকৃত পরিচয় শোনার পর ভদ্রলোক প্রায় অবিশ্বাস করছিলেন।
জ্যোতিদাদা রবির আরো কিছু কবিতা চেয়ে নিলেন লিটল ম্যাগাজিনে পাঠানোর জন্য। বেছে বেছে ঠিক করলেন কোনটা কোথায় পাঠাবেন। সেই ঝর্ণার কবিতাটাতে জ্যোতিদাদাও একেবারে আত্মহারা হয়ে  গেলেন।

তুই জানিস তুই কত ভালো লিখেছিস?”
রবি মাথা নিচু করে থাকে। এত করে তার প্রশংসা কেউ করলে সে খুব লজ্জা পায়।

পর্ব ৩।। উত্তরণ

গ্রামে ফিরে এসে রবি প্রথমে ভাঙ্গা বসতবাড়িটার একটা ব্যবস্থা করে। আগেই জীর্ণ ছিলএখন কয়েক বছরের অব্যবহারে প্রায় পুরো ভেঙ্গে পড়েছে। খুঁটি দিয়ে মাটি লেপে ওটাকে খাড়া করে কোনোক্রমে। মাথায় খড়ের ছাউনি দেয়। যা হোকমোটামুটি বাসযোগ্য হয়েছে। এবার চাষের জমিটার জন্য কিছু করার দরকার। ওখানে যাবার জন্য নদীর ওইটুকু ব্যবধান রবি সহজেই সাঁতরে পার হতে পারেতবে কাস্তে কোদাল এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে হবে বলে একটা ছোট ডিঙ্গিনৌকো বানিয়ে নেয়। রবি কোদাল চালায় যখনতার সুঠাম শরীরের প্রতিটি পেশী যেন কথা বলে। দু সপ্তাহের চেষ্টায় জায়গাটা তৈরি করে। ভেবেচিন্তে ঠিক করে সে পানের চাষ করবে। তাতে কোম্পানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা এড়ানো যাবে। পানের চাষ আজকাল খুব কম হয়কিন্তু চাহিদা আছে সে দেখেছে।
জীবিকার একটা মোটের উপর বন্দোবস্ত হতে এবার আসল কাজে নামার দরকার। গ্রামে যে কটি পরিবার রয়েছে এখনোতাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা স্কুল খোলা। তাদের বাবা মা দের বোঝাতে হবে। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। এখন বাবা মা রা ছেলেপিলেদের স্কুলে পাঠায় বটেতবে তার মূল কারণ স্কুলে গেলে  অন্ততঃ মিড ডে মিলের একবেলা খাবার জুটে যায়। স্কুলে পড়াশুনো হয় খুব কমছাত্রছাত্রীরা শেখে আরো কম।

বছর ঘুরে যায়। এর মধ্যে যে দুএকজন ছাত্রছাত্রী জুটেছিলঅভাবের কারণে তারা লেগে থাকতে পারে না। তবে রবি ধৈর্য্য ধরে থাকে। স্রোত যেমন ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে পাথরকে কাটেসেইভাবে সরাতে হবে অশিক্ষার অচলায়তন। অবশেষে পায় কিছু ছাত্রছাত্রী যারা লেগে থাকেপড়া ছাড়ে না। তাদের প্রিয় রবিদা যেমনটি করে পড়ায়নানা দেশের গল্প করেসেটা তাদের খুব পছন্দ হয়।
পানের চাষে ফলন হয় প্রত্যাশিত। নদীর জলে পুষ্ট চরে প্রকৃতি যথেষ্ট সদয়। হাওয়া যখন পানের বনের উপর চঞ্চল হয়ে ওঠেমনে হয় শঙ্খচিল যেন ডানা মেলে উড়ে যায়।
ইতিমধ্যে সহজ পাঠ ছেপে বেরিয়েছে। বইটা ছোট ছোট বাচ্চাদের খুব পছন্দেরতাই প্রত্যাশার থেকে বহু বেশী বিক্রি হয়। তার থেকে কিছু টাকা পেয়ে রবির খুব উপকার হয়। কারণ ওই সামান্য জমি থেকে কতটুকুই বা ফসল হয়। এবার সে বাচ্চাগুলোর জন্য স্লেট পেন্সিল কিনে দিতে পারবে।
সেদিন আমবাগানের রাস্তা ধরে রবি যাচ্ছিলহঠাৎ “রবিদা” ডাক শুনে ঘুরে তাকালো।
কি রে মিনি?” রবি জিজ্ঞাসা করে।
আমি পড়াশুনো করতে চাই”মৃণালিনী বলে।
সে তো আমিও তাই বলিকিন্তু তোর বাবা মত না দিলে কি করা যাবে?”
তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো।“
মৃণালিনী এখন পনেরো বছরের। তার বাবা বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করছে। তাই রবির কাছে আর পড়তে পাঠায় নাস্কুলে পাঠানোরও ইচ্ছে নেই। অথচ মেয়েটির পড়াশুনোয় খুবই আগ্রহনিজের মন থেকে গল্প লিখতে পারে। রবির কাছে পড়েছে কিছুটা সময়।
সে তো বলেইছি। বেশী বলতে গেলে হয়তো উলটো ফল হতে পারে। জানিস তো তোর বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে?”
আমি এখন বিয়ে করব না। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো দাম নেই বুঝিবাবা না বললেও আমি পড়তে চলে আসব তোমার কাছে।“
আচ্ছা আবার চেষ্টা করে দেখব।“
সহজ পাঠ জনপ্রিয় হবার কারণেই হোক বা জ্যোতিদাদার লাগাতার চেষ্টায়এখন রবির লেখা প্রায়ই নানা পত্রিকায় ছেপে বেরোয়আর বই হয়ে কখনো বা। চাষের কাজ রবিকে আর করতে হয় না মোটে। তাতে খুব সুবিধা হয়েছেলেখার জন্য আরো অনেক সময় পায়। রবির বই ছাপা হয়ে বেরিয়েছেরবি নিশ্চয়ই একটা কেউকেটাতাই আর ছাত্রছাত্রীদের বাবা মায়েরা পড়তে পাঠাতে ইতস্ততঃ করে না। বয়স্করাও কেউ কেউ তার কাছে শিখতে আসে। পারিপার্শিকের প্রভাবেই হোক আর আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া বেআইনি শুনেই হোকমৃণালিনীর বাবা মেনে নিলেন শেষমেষ।
রবি একটা ছোট্ট রেডিও কিনেছে। সময় পেলেই তাতে গান শোনে নানা রকমের --- বিশেষ করে বাংলার লোকসঙ্গীতলালন ফকিরের গানবাউলভাটিয়ালি তাকে বিস্মিত করে দেয়। এত সহজ করে এত গভীর কথা বলা যায়! বাউলের দল তো মাঝে মাঝেই গ্রামের আশেপাশে গাইতে আসে। রবি শুনতে চলে যায়। সুরগুলোকে বুঝে মনের মধ্যে তুলে নিতে চেষ্টা করে। রবি বুঝতে পারে তার না বলা অনেক কথা গান হয়ে যেতে চাইছে। সুরগুলোকে আরও ভালো করে বুঝতে হবে। তাহলে সেও গান বাঁধতে পারবে। আর শুধু বাংলা গান নয়অন্যদেশের গান সম্বন্ধেও জানতে হবে। সে মাঝে মাঝে ইংরাজি গান শোনেবোঝার চেষ্টা করে। ওদের গ্রামেই দিনু থাকেসবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পড়েছেতার গানের গলাটি ভারি মিষ্টি। মাঝে মাঝে রবি ওর সঙ্গে গান নিয়ে কথা বলে। দুএক পদ সুর দিয়ে দিনুকে বলে একটু গেয়ে শোনাতে। কেমন হচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করে। দিনুও সাহায্য করার চেষ্টা করে। সেও বেশ উৎসাহ পেয়ে গেছে এখন। রবি কিছু লিখলে সুর দেবার চেষ্টা করে।
অনেক ভোরে ওঠার অভ্যাস রবির সেই ছোটবেলা থেকে। ক্ষেতের কাজ সেই সকালবেলা শুরু হত। এখনও রবি সকালে উঠে ছোট্ট নদীটার পাড়ে বসে থাকেসূর্যোদয় দেখে। আর দেখে মানুষজন। মাঝি দাঁড় টেনে নৌকো বেয়ে যাচ্ছে অথবা পালতোলা নৌকোয় হাল ধরে আছে। ক্ষেতে চাষি লাঙ্গল দিচ্ছেবীজ বুনছেআবার ফসল ফললে কেটে ঘরে তুলছে। এমন করেই চিরকাল ওরা কাজ করে যায়। এটাই ভারতবর্ষের শাশ্বত ছবি। রবি কখনও বিদেশ দেখে নিতবে তার মনে হয় বিদেশও আসলে একই রকম। এইসব শ্রমজীবী মানুষের কথাই আসল ইতিহাস। রাজারাজড়ার কথা যা ইতিহাস বই ভরে থাকেসেগুলো কতগুলো অর্থহীন চর্বিতচর্বণ মাত্র। সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়েজয়ী-বিজেতা বদলে যায়ওরা তবু ভ্রূক্ষেপহীনএকইরকমভাবে কাজ করে যায়।
রবি এখন বেশ কিছু গান লিখে ফেলেছে। গগন হরকরার একটা গান, “কোথায় পাবো তারে” তার এত ভালো লেগেছে যে সেই ওই সুর ভিত্তি করে একটা ভারী সুন্দর গান তৈরি করেছে। দিনুর গলায় সেটা দারুণ শোনায়। আর একটা জিনিস সে করেছে একদম নতুনআগে কেউ করেনি --- নাচ আর গানকে জুড়ে জুড়ে নাটকের মতো। তার পাঠশালার ছেলেমেয়েদের দিয়ে অভিনয় করায়। নিজেও এক একটা ভূমিকায় অভিনয় করে। মৃণালিনীর খুব উৎসাহভীষণ নিষ্ঠার সঙ্গে সে অভিনয় করে। এই একটা কাজে সে বাইরের জগতকে যেটুকু পায়আঁকড়ে ধরতে চায়। রবিকেও খোঁচায় নতুন লেখা লিখলেই তাকে দেখাতে হবে। না হলে অভিমান হয়। আর মৃণালিনীকে নতুন লেখা দেখাতে রবিরও যেন বিশেষ ইচ্ছা হয়। সময়টা যেন কি তাড়াতাড়ি কেটে যায় তখন।

"এটা কি লিখেছ রবিদা?" মৃণালিনী জিজ্ঞাসা করে, "এ তো বাংলা ভাষা নয়! অথচ বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না! শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা --- শাঙন মানে তো শ্রাবণ, তাই না? কি সুন্দর ভাষা। আমি শিখব।"
রবি হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, "এটা আসলে একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলাম। ঠিকই বলেছিস। এটা বাংলা ভাষা না, তবে বাংলার খুব কাছাকাছি। এটা আসলে একটা কৃত্রিম ভাষা, ব্রজবুলি বলে। অনেকদিন আগে মিথিলাদেশে বিদ্যাপতি নামে একজন খুব বড় কবি ছিলেন। তিনি মৈথিলি আর বাংলার মিশ্রণে এই ভাষা তৈরি করেছিলেন পদাবলী লেখার জন্য। তার লেখা অনেক বিখ্যাত পদ আছে, যেমন ধর, "এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর ।" বাংলা না হলেও দিব্যি বোঝা যায়। এটা রাধার আর্তি, কৃষ্ণ চলে যাবার পর। খুব কম কবিই এইভাবে ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। চৈতন্যদেবেরও খুব প্রিয় ছিল বিদ্যাপতির পদ।"
"ভাষা এত মিষ্টি হয়!"
"হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। খুব মিষ্টি ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষাটাও কিন্তু খুব মিষ্টি, আমরাই ঠিক করে বলতে লিখতে  পারি না। আমাদের ভাষা, আমাদেরই যত্ন করতে হবে, চর্চা করতে হবে, তবেই না ভালো ভালো লেখা বেরবে। বাংলাতেও কত ভালো ভালো লেখা হবে, দেখবি।"
"তুমি লিখবে সেই লেখা, আমি জানি"।
"ধুর, আমার কথা আসছে কি করে এর মধ্যে?"
মৃণালিনী হাসে, "আর তুমি ভানু নামে লিখেছ? এটা কি ছদ্মনাম?"
রবি মৃদু হাসে, কিছু বলে না। 
"আমি জানি, ভানু মানে তো রবি, তাই না?"
"ঠিক ধরেছিস, একদম ঠিক", রবি বলে। 

ইদানিং সাম্প্রদায়িক বিভাজন চারিদিকে বিশেষ করে বেড়ে গেছে। এই গ্রামে কয়েকশো বছর ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করছেদুর্গাপুজো ইদ বড়দিনে একে অপরের উৎসবে হাসিমুখে যোগ দিয়েছেছোঁয়াছুঁয়ির মতো কিছু খারাপ প্রথা থাকলেও সেটা অনেকটাই অভ্যাসের দাসত্বকিন্তু শুধুমাত্র অপর সম্প্রদায়ের হবার জন্য ঘৃণাএমন জিনিষটা রবি আগে এমন দেখে নি কখনো। এমনকি কোথাও কোথাও সেটা হিংসার আকারে প্রকাশ পায়। রবির মনে হয় এত রক্ত কেনরবি ভাবে এদের এক করাটা খুব দরকার। একটা অভিনব পরিকল্পনা করে সেলোকে একে অপরের হাতে একটা রঙ্গীন সুতো বেঁধে দিয়ে সৌভ্রাতৃত্ব বোঝাবেএটা হবে এক ধর্মহীন মিলন উৎসব। এটার একটা সুন্দর নামও দিয়েছে সে --- রাখীবন্ধন। বাচ্চাদের দলবল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েগ্রামের রাস্তায় যাকে পায়তাকেই বোঝায় এই নতুন উৎসবের তাৎপর্য।
এরকমই সে দলবল নিয়ে রাখীবন্ধনের প্রচার করছিল গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে ডোমপাড়ায়। অনেকক্ষণ ধরে সে ঘুরছেতেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। মোক্ষদাবুড়িকে দেখতে পেয়ে একটু জল চায় খেতে।
মোক্ষদা ইতস্ততঃ করে। রবি গরিব আর গ্রামের ছেলে ঠিকইতবে জন্মসূত্রে সে বর্ণহিন্দু। ওকে তার ছোঁয়া জল খেতে দেওয়া কি ঠিক হবে?
রবি মোক্ষদার দ্বিধার ব্যপারটা আন্দাজ করে। সত্যি এই ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যপারটা একটা চরম লজ্জাজনক ব্যাপারমনুষ্যত্বের অপমান। সে বোঝায় মোক্ষদাকে, “দেখো খুড়িএই আমি যেমন মানুষতুমিও ঠিক তাই। আর তেষ্টার জলের থেকে বড় দান আর কিছু নেই।“
তুই খাবি রবিসত্যি?” মোক্ষদার চোখে জল আসে। রবি পরম তৃপ্তিভরে গ্লাসে চুমুক দেয়। আঃশান্তি।

পর্ব ৪।। উপসংহার

সন্ধেবেলায় সে বাড়িতে কুপী জ্বালিয়ে একটা উপন্যাস পড়ছেএমন সময় একটা মোটরবাইক এসে থামল আর একটা চাপা গলায় ডাক শুনতে পেল, “রবি”।
তাকিয়ে দেখে ভোম্বলদা। ভোম্বলদা গ্রামেরই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিলএখন কাছাকাছি শহরে থাকে। ইট সিমেন্টের ব্যবসা আছেআর রাজনীতি করে। ভোম্বলদার দলই এখন রাজ্যে ক্ষমতায় আছে। শোনা যায় নাকি রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে ভোম্বলদার ব্যবসার দারুণ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। শহরে থাকলেও ভোম্বলদা অবশ্য গ্রামের সাথে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখেছে। বিপদে আপদে লোকেদের সাহায্যও করে।
আরে রবিকেমন আছিস। গ্রামের সব খবর কি?”
ভালো। তোমার কি খবর?” সৌজন্যবশতঃ জিজ্ঞাসা করে রবি।
এই চলছে একরকম। তোর তো এখন দারুণ নাম হয়েছে শুনি। গ্রামে স্কুল করেছিসখুব ভালো। স্কুল ভালো চলছে তো?”
হচ্ছে মোটামুটি। অনেকে পড়তে আসছে। আরো বড় করার ইচ্ছে আছে।“
সে তো বটেই। এটা তো আমাদের গ্রামের একটা গর্ব। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তোকে সাহায্য করা। আমি সরকারি সাহায্যের সুপারিশ করছি তোর স্কুলের জন্য। এখন তো আমরাই ক্ষমতায়। ঠিক ব্যবস্থা করে দেব।“
এই ভর সন্ধেবেলা ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে ভোম্বলদা কি এই কথাটাই বলতে এসেছে?
শুধু আমাদের দিকটাও একটু দেখিস।“
রবির অবাক চাউনির দিকে চেয়ে ভোম্বলদা নিজেই খুলে বলে, “নন্দদা তো এবার ইলেকশনে আমাদের ক্যান্ডিডেট হচ্ছেজিতলেই মন্ত্রী হবে। এই এলাকাটা তো আমার। তা আমার দায়িত্ব পড়েছে এখান থেকে অন্ততঃ পাঁচহাজারের লিড দেওয়ার। না দিতে পারলে আমার সম্মানটা কোথায় থাকে বল তোতোর তো এখন এ গ্রাম ও গ্রাম মিলে এই এলাকায় সুপার পপুলারিটি। তুই শুধু একটু লোকজনকে বলবি যেন আমাদের ভোট দেয়।“
ভোম্বলদাতুমি তো জানো আমি রাজনীতি করি না। ভোট দিইদেওয়া দরকার সেই জন্য। আমি কি হিসেবে প্রচার করতে পারিআর তা ছাড়া ওরা আমার কথা মতো ভোট দিতে যাবেই বা কেন?”
আরে তুই একজন নামকরা বুদ্ধিমান লোকভেবেচিন্তে ভোট দিস যখন নিশ্চয়ই আমাদেরই দিস। সেই কথাটাই লোকেদের বলবি। তুই আমাদের সঙ্গে আছিস দেখলেই সবাই বুঝবে আমাদেরই ভোট দেওয়া উচিৎ।“
সঙ্গে আছি মানে?” রবি বিস্মিত হয়।
কেন তুই কি ওদের দিকে ভিড়বি না কি?”
ভোম্বলদাআমি তো বলেইছি আমি রাজনীতিতে নেইওদের দিকে বা তোমাদের দিকে বা কারুর দিকেই নেই।“
না না তোকে রাজনীতি করতে বলছি না। শুধু লোকজনকে বুঝিয়ে বলবি আমাদের ভোট দিলে কত লাভ হবে গ্রামের। এই দেখ না আমরা গ্রামে পাকা রাস্তা করে দিয়েছিবিদ্যুৎ এনে দিয়েছিএর পর তোর স্কুল বড় করা হবেহাসপাতাল হবেএরকম করেই উন্নয়ণ করে যাব।“
কথাটা ভুল নয়তবে ব্যাপারটা অতটা সোজাও নয়। ভোম্বলদার দল তো ক্ষমতায় আছে বেশ কয়েকবছর। বহুদিন বলে বলেও রাস্তার ব্যাপারে কিছুই করা হয় নি। কিন্তু যেই কোম্পানিগুলো জমি কিনে নিলতাদের ট্রাক্টর যন্ত্রপাতি আনার জন্য রাস্তার দরকার পড়লঅমনি ভোজবাজির মতো রাস্তার অনুমোদন হয়ে গেল। আর বিদ্যুতের লাইন এলেও তার যা দামতাতে গ্রামে খুব কম লোকই তা কিনতে পারে। অথচ কোম্পানি শস্তাদরে বিদ্যুৎ পায় রপ্তানি করার জন্য। তবে এসব কথা বলে ভোম্বলদার সঙ্গে তর্ক করার কোনো প্রবৃত্তি নেই তার।
রবি চুপ করে আছে দেখে ভোম্বলদা মধুমাখা গলায় বলে, “দেখস্কুলের জন্য কিছু করতে গেলেও তো ক্ষমতায় থাকতে হবে আমাদের। তোদের সমর্থন না পেলে সেটা কি করে হবে বল?”
হাসি পায় রবির। যেন স্কুলের চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না ভোম্বলদার।
ভেবে দেখে রবি। ভোম্বলদার দল এখন বেশ শক্তিশালীএ এলাকায় জেতারই কথা। আর এ এলাকার ভোট না পেলেও এই কেন্দ্রে ঠিক জিতে যাবে। দরকারে জবরদস্তি ভোট করে। আর ভোম্বলদা অন্ততঃ গ্রামের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে। বিপদে আপদে সহায়ও হয়। স্কুলটা সত্যিই আরো বড় করে করতে হবেএটুকুতে আটকে থাকলে চলবে না। এটা একদিন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবেদেশ বিদেশ থেকে জ্ঞানীগুনীরা আসবেনআলোচনা হবে শিল্পসাহিত্যকলাবিজ্ঞান নিয়ে। ছাত্রছাত্রীরা এদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ পাবে। সেটা রবির পক্ষে একার চেষ্টায় করা অসম্ভব। ভোম্বলদা নিজে থেকেই যখন সাহায্য করতে চাইছেসেক্ষেত্রে কেন নেবে নাভোম্বলদার অবশ্য স্বার্থ আছে। সে থাক। নিঃস্বার্থ সাহায্যের আশা তো করা যায় না।
দেখো ভোম্বলদাআমি তোমার হয়ে ভোট চাইতে পারব না। তবে আমি গ্রামের মানুষ জড়ো করে তাদের বলতে পারিভোম্বলদার দল স্কুল আর হাসপাতাল করে দিতে চায়তোমাদের সমর্থন চাইছেতোমরা ভেবে দেখো তোমরা ওদের ভোট দিতে পারো কি না।“
অগত্যা তাই হবে। ওরা ঠিক বুঝে নেবে তুই আমাদেরই সমর্থন করছিস। আর করবে নাই বা কেনআমাদের মতো ভালো ভালো কাজ কেউ করেছেওরাও তো পাওয়ারে ছিলকরেছে কিছুআর তুই কিছু ভাবিস নানন্দদার সাথে আমার পাকা কথা হয়ে গেছে। নন্দদা চেয়ারে বসবে আর তোর স্কুলের ফাইল অ্যাপ্রুভ করবে।”
যা হোক রবি কথা রেখেছিল। পাঁচহাজারের উপর লিড ভোম্বলদার দল পেয়েছিল। জিতে নন্দবাবু মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু রবির স্কুলের জন্য কিছু বরাদ্দ আসে নি।
ভোম্বলদা গ্রামে এসেছিল কোনো কাজে। হঠাৎ রবির মুখোমুখি হয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে পড়ে, “মাইরি বলছি রবিআমি নন্দদাকে ইলেকশনের পরেই মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। মালটা এত হারামি বুঝতে পারি নি মাইরি। বলে গ্রামে সরকারি স্কুল তো আছে। ওটাই সারিয়ে ঠিক করা হোক আগে। আরে ও স্কুল আর তোর স্কুল কি এক হলওদিকে নিজের শালী কোথায় নাচের স্কুল করাবে তার জন্য টাকা স্যাংসন করে বসে আছে।“
রবি দুঃখ পায় না। ভোম্বলদা সত্যিই চেষ্টা করেছিল সে বোঝে। আর নন্দবাবুর সাথে তো তার সরাসরি কথা হয়ই নি। তার করা স্কুল একদিন ঠিক বড় হবেবিশ্ববিদ্যালয় হবে। দেশবিদেশের জ্ঞানপিপাসুরা আসবেআলোচনা হবেনতুন সৃষ্টি হবে। সরকারি সাহায্য না এলেও সে দমবে না। সে মানুষের কাছে যাবে। জায়গাটা কেমন হবে সে মনে মনে ভেবে রেখেছে। আর একটা নামও ভেবে রেখেছেশান্তিনিকেতন।
আজ শ্রাবণদিনে দূরে ঈশানকোনে মেঘ কালো করে এসেছেবিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রবির মনে একটা কবিতা আসছে। রবি লিখতে শুরু করে, “গগনে গরজে মেঘ,...”

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল।
কবি যদি আজকের দিনে দরিদ্র গ্রামীন পরিবারে জন্মাতেন, তাহলে কেমন হত ভেবে অনেক দুঃসাহসে ভর করে এই লেখাটা লিখেছিলাম। ২০১৮ সালের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ফেসবুকে প্রথম এই লেখাটা দিয়েছিলাম। কয়েকজন বন্ধুর গঠনমূলক মন্তব্য খুব উপকারে লেগেছে। তার ভিত্তিতে কিছু কিছু অংশ পরিমার্জন করলাম।