বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১

আমেরিকার কোভিড মোকাবিলা

আমেরিকার কোভিড মোকাবিলা

-শুভাশিস ঘোষাল

 

গত দেড় বছর ধরে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন আলোচনার সবচেয়ে বড়ো বিষয় হল কোভিড অতিমারি ও তার ফলে হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মানবিক সংকট। পৃথিবীতে সাম্প্রতিককালে অনেক মারাত্মক শ্বাসবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে, যেমন সার্স, মার্স, ইবোলা আর এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান, কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারির পর গত একশ বছরে কোভিডের মতো এরকম সাংঘাতিকভাবে আর কোনও রোগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েনি। কোভিডে সব দেশই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, ভারতবর্ষে প্রথম লকডাউনের সময় আমরা সমাজের নিচুতলার মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখেছি, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও প্রায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা গিয়েছিল, তবে আমেরিকার কোভিড পরিস্থিতির বিবর্তন বিশেষভাবে কৌতুহল জাগায়। অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামো বেশ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও কোভিডে সবথেকে বেশি বিপর্যয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা অন্যতম ---  সরকারি হিসেবে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যায় সবার থেকে বেশি। এক্ষেত্রে অবশ্য উল্লেখ্য যে বিভিন্ন দেশের সরকারিভাবে দেওয়া কোভিডে আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যায় অনেক গণনার ত্রুটি রয়েছে। অনুমান করা যায় অনেক দেশে পরিকাঠামোয় ঘাটতি বা অন্যান্য কারণে এই সংখ্যাগুলো কম দেখাচ্ছে ---   আসলে সংখ্যাগুলো অনেক বেশি হবে। আর শিল্পোন্নত দেশে বয়স্ক মানুষের আধিক্যের জন্য উন্নত পরিকাঠামো সত্ত্বেও তারা বেশি সমস্যায় পড়েছে, কারণ কোভিড বয়স্কদের অনেক বেশি ক্ষতি করে। তবে যাই হোক, আমেরিকা যে সাঙ্ঘাতিক কোভিড সংকটে পড়েছিল, সেটা পরিষ্কার। গত বছরের শেষ দিকে একরকম মৃত্যুর মিছিল চলছিল দিনে তিন-চার হাজারের উপর, আক্রান্তও হচ্ছিল প্রতিদিন দুই থেকে তিন লক্ষ লোক। এখন সেই সংখ্যাগুলো নব্বই-পচানব্বই শতাংশ কমে গেছে। সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল না হলেও একথা অবশ্যই বলা যায় যে সেই সাংঘাতিক পরিস্থিতির থেকে আমেরিকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিতে রীতিমতো জোয়ার চলছে। এর অন্যতম কারণগুলো হল টিকাকরণের সাফল্য, অর্থনীতিতে টাকার যোগান বাড়ানো --- বিশেষ করে সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি স্টিমুলাস চেক দেওয়া ও কাজ-হারানোদের বেকারভাতা যোগানো। এবং অবশ্যই দেশের শীর্ষনেতৃত্বে রদবদল, ও নতুন প্রশাসনের নেওয়া কিছু নীতির সুফল। আমেরিকার অর্থনীতির সঙ্গে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি বিশেষভাবে সম্পর্কিত ---  ১৯২৯ এবং ২০০৮ এর মহামন্দা সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকেই পঙ্গু করে দিয়েছিল। সেরকম মহামন্দা হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল এবারেও, যা এড়াতে পারাটা একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই নিবন্ধে আমেরিকার সরকারের পক্ষ থেকে কোভিড মোকাবিলায় কি কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আর তার ফলে কি কি সাফল্য এসেছে, সেগুলো কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে।

আমেরিকায় কোভিড রুগী প্রথম (বিদেশ থেকে আসা লোকেদের বাদ দিয়ে) পাওয়া গিয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে, যদিও পরোক্ষ প্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় যে ২০১৯ সালের শেষের দিকেই হয়তো সংক্রমণ শুরু হয়েছে চীন এবং ইউরোপ থেকে আসা পর্যটকদের মাধ্যমে। ততদিনে ভাইরাসের উৎস ইউহানে লকডাউন হয় গেছে, চীন থেকে অন্যান্য দেশে যাতায়াতও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমেরিকাও ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে চীন থেকে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে ও তার পরদিন দেশে জনস্বাস্থ্যসংকট ঘোষণা করে। এর তিনদিন আগে অবশ্য বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা হু পৃথিবীব্যপী জনস্বাস্থ্যসংকট ঘোষণা করেছে। মানুষ থেকে মানুষে কোভিড ছড়ায় তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। মার্চের মাঝামাঝি হু কোভিডকে অতিমারি বলে অভিহিত করে আর ট্রাম্পের প্রশাসন জাতীয় সংকট ঘোষণা করে। এর ফলে প্রশাসন কোভিড মোকাবিলায় জরুরি তহবিল থেকে খরচ করার অধিকার পায়। ইউরোপ থেকে যাতায়াতেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেই অবস্থায় মাত্র পনেরটি জানা কোভিড সংক্রমণ ছিল সারা দেশে। ট্রাম্প ঘোষণা করেন শিগগিরি সংক্রমণের সংখ্যা শূণ্যে নেমে আসবে। বলা বাহুল্য, তা হয় নি। কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। মার্চের মাঝামাঝি মৃতের সংখ্যা একশ পৌঁছে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে থাকতে বলা হয় সাধারণ মানুষকে। অন্যান্য রাজ্যেও বেশ কিছু ব্যবসা বন্ধ করতে হয়, স্কুল-কলেজ অনলাইনে পড়ানো শুরু করে, জরুরি পরিষেবা ছাড়া বেশিরভাগ চাকরিতে বাড়ি থেকে কাজ করতে বলা হয়। বহু মানুষ, বিশেষ করে যারা ঘন্টাপ্রতি কাজের হিসেবে পারিশ্রমিক পান, তাদের অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। বিমান ও হোটেল পরিষেবা নেবার লোক ভীষণভাবে কমে যায়, পর্যটন কার্যতঃ থমকে যায়, অর্থনীতিতে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসে। বেকারত্বের হার চার শতাংশের কম থেকে প্রায় পনের শতাংশে পৌঁছায়, যা কি না গত দশকের মহামন্দার সময়ের থেকেও অনেক বেশি। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির বদলে অর্থনীতিতে সংকোচন হয় --- ২০২০ এর প্রথম ত্রৈমাসিক পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্যায়ে তিরিশ শতাংশেরও বেশি। শেয়ার বাজারে ডাউ-জোন্স সূচক মাঝ-ফেব্রুয়ারি থেকে মাঝ-মার্চের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মূল্য হারিয়ে ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের তিন বছরের বৃদ্ধির  পুরোটাই খোয়ায়। এমনকি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজারে এতটাই হতাশা দেখা দেয় যে আমেরিকান ক্রুড অয়েল শর্ট-টার্ম ফিউচার ব্যারেলপিছু শূণ্য ডলারের নিচে নেমে গিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে (এর মানে অবশ্য এই নয় যে পেট্রল-পাম্পে গিয়ে গাড়িতে তেল ভরলে পয়সা পাওয়া যেত)। 

এদিকে মৃতের সংখ্যা হুহু করতে বাড়তে থাকে। নিউ ইয়র্ক শহরে হাসপাতালগুলোর উপর এমন চাপ সৃষ্টি হয় যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। সেই সময় সম্পূর্ণ নতুন রোগ কোভিডের চিকিৎসা সম্পর্কে ডাক্তারদেরও বিশেষ কিছু জানা ছিল না। ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা কিছু ককটেল ড্রাগ আন্দাজের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হচ্ছিল হৃদরোগের ঝুঁকি থাকা এবং বিশেষ সাফল্য না পাওয়া সত্ত্বেও। মে মাসে রেমডেসিভির কোভিড চিকিৎসায় প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আংশিক লকডাউন, কিছুটা সচেতনতা বৃদ্ধি, ডাক্তারদের কোভিড চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা বাড়া এবং রেমেডেসিভিরে অনেকটা কাজ দেওয়ায় দিনপ্রতি মৃতের সংখ্যা অনেকটা নেমে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্যও অনেকটাই খুলে দেওয়া হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে। তবে দিনপ্রতি আক্রান্তের সংখ্যা কমে না। জুন মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা কুড়ি লক্ষ অতিক্রম করে। তবে কোভিড টেস্টের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আগে যেসব কোভিড আক্রান্ত অসনাক্ত থেকে যাচ্ছিল, তাদের বেশিরভাগই নথিভুক্ত হতে থাকে। প্রতিষেধক টিকা তৈরির উদ্দেশ্যে ফাইজার, মোডের্না, অ্যাস্ট্রোজেনিকা ইত্যাদি ওষুধ কোম্পানি তাদের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করে। অনুমান করা হয় অক্টোবরেই প্রথম ডোজ পাওয়া যেতে পারে।

মার্চের শেষাশেষি ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান জনপ্রতিনিধিরা একযোগে মার্কিন আইনসভায় করোনাভাইরাস এইড রিলিফ অ্যান্ড ইকনমিক সিকিউরিটি (কেয়ার্স) অ্যাক্ট অনুমোদন করেন, যা রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সইয়ের পর আইনে পরিণত হয়। দুলক্ষ কোটি ডলারের এই সরকারি উদ্যোগ ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা। এতে রাজ্য ও স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পরিষেবা চালু রাখার জন্য অনুদান পাঠানো হয় ও ছোট-বড় ব্যক্তিগত ব্যবসাকে ঋণ ও অনুদান দেওয়া হয়। এয়ারলাইনগুলি বা ওই ধরণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয় এবং হাসপাতালগুলিকে কোভিড মোকাবিলার জন্য অর্থ জোগানো হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাড়তি মূলধন জুগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসাকে ঋণ দিতে উৎসাহ দেওয়া হয় --- রাষ্ট্র সেইসব ঋণের গ্যারান্টার থাকে, ফলে ব্যাংকের টাকা মার যাবার ভয় থাকে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডেরাল রিজার্ভও সুদের হার এক ধাক্কায় দেড় শতাংশ কমিয়ে প্রায় শূণ্যের কাছে নিয়ে আসে। কর্মহীনদের ভাতা দেওয়ার পরিসর বাড়ানো হয়। তা ছাড়া নাগরিকদের সরাসরি আর্থিক সাহায্য পাঠানো হয় যাতে তারা সেই টাকা বাড়িভাড়া ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খরচ সামাল দিতে পারে বা কোনও অনাবশ্যকীয় কারণে ব্যয় করে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পারে। অর্থনীতির ভাষায় একে আর্থিক উত্তেজক বা স্টিমুলাস বলে। মন্দার সময় যাদের কাজ টিকে আছে আর আয়ও মোটামুটি ঠিক আছে, তারাও ভবিষ্যতের আশংকায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বা পরিষেবা ছাড়া অন্য কিছু চট করে কিনতে চায় না, অপেক্ষা করে। ফলে দেশের অর্থনীতির মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে সময়ও বেশি লাগে। সরকার এভাবে মানুষের হাতে সরাসরি টাকা দিয়ে বাজারে টাকার যোগান বাড়ালে তা অর্থনীতিতে সক্রিয়তা বাড়ায়। বিশেষ করে সুদের হার কম থাকলে মানুষের টাকা জমিয়ে রাখার প্রবণতা কম থাকে। এই ধরণের সরকারি উদ্যোগ নেওয়ায়, জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আর প্রতিষেধক টিকা সফল হবে এই আশার ফলে বাজার শিগগিরি ঘুরে দাঁড়ায়। ডাউ-জোন্স সূচক দ্রুত হৃত অবস্থা পুনরুদ্ধার করে বর্তমানে সর্বনিম্ন মানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। রেকর্ড হারে কর্মহীনতার পর মাত্র এক মাসের মধ্যেই বেকারত্বের হার ছয় শতাংশের নিচে নেমে আসে। ২০২০ এর তৃতীয় ত্রৈমাসিক পর্যায়ে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার পৌঁছায় তিরিশ শতাংশে। যেরকম মহামন্দা হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা এড়িয়ে অর্থনীতি এত তাড়াতাড়ি চাঙ্গা হওয়াটা একটা বিরাট সাফল্য। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে এশিয়া বা ইউরোপের বহু দেশ যে অর্থে সামগ্রিক লকডাউন করেছে, আমেরিকা সেই অর্থে তেমন কিছু করেনি। শুরুতে কিছু নিয়ন্ত্রণ চালু থাকলেও তার পরে দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরা, পরিবহন প্রায় স্বাভাবিকভাবে চলেছে। সাধারণ মানুষের রাস্তায় বেরোনোর নিষেধাজ্ঞা কখনই ছিল না। তবে রাজনৈতিক অঙ্ক সবক্ষেত্রেই নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা নেয়। রিপাবলিকান দল প্রায় কোনওরকম নিয়ন্ত্রণই চাপাতে অস্বীকার করে --- শুরুতে বিশেষ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ সহ সমস্ত প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে খোলা রাখতে চাপ দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। কারণ ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের অন্যতম ভোটিং ব্লক। অর্থনীতির প্রশ্নে রিপাবলিকানরা নিজেদের ‘ফিসকালি কনসারভেটিভ’ বলে --- তারা অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ও করের হার যৎসামান্য রাখার পক্ষ্যে। ওবামার রাষ্ট্রপতিত্বে মহামন্দার সময় তারা সরকারি উদ্যোগে প্রবলভাবে বাধা দিয়েছিল এই বলে যে এতে দেশের ঋণের বোঝা অতিরিক্ত হয়ে গিয়ে ভবিষ্যতে বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে। লক্ষ্য করার বিষয় রিপাবলিকানরা গতবছর সরকারি স্টিমুলাসকে সমর্থন করে, কারণ তখন রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি আর সেই বছরেই ভোট। তবে কেয়ার্স অ্যাক্ট থেকে পাওয়া সাহায্য সব সময় সঠিক জায়গায় পৌঁছায় নি --- ছোট ব্যবসার টাকা বড়ো কর্পোরেট হাউস হাতিয়ে নিয়েছে লবি করে।  এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে দুলক্ষ কোটি ডলারের মতো সুবিশাল আর্থিক প্যাকেজ, যা আমেরিকার মতো বৃহৎ অর্থনীতির পক্ষেও অনেক, প্রকৃতপক্ষে অর্থায়িত হয় রাষ্ট্রীয় ঋণের মাধ্যমে। এই ঋণ মূলতঃ আসে ট্রেজারি বন্ড বিক্রি থেকে --- বিনিয়োগকারীরা সেই বন্ড কিনে তার বদলে আমেরিকান ট্রেজারির কাছ থেকে সুদ পায়। দেশের উৎপাদনশীলতার সাপেক্ষে ঋণের পরিমান বাড়লে অর্থনীতির নিয়মে ঝুঁকি বেড়ে সুদের হার (যাকে ট্রেজারি ইল্ড বলে) বেড়ে যাবার কথা --- না হলে বিনিয়োগকারীরা সেই বন্ড কিনতে উৎসাহী হবে কেন? সেরকম হলে ঋণ শোধ করার চাপ অনেক বেড়ে যায়। সাম্প্রতিককালে গ্রীস বা আরও বেশ কিছু দেশে রাষ্ট্রীয় ঋণ অত্যধিক হয়ে যাবার ফলে এরকম সংকট দেখা দিয়েছিল। তবে আমেরিকার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা এতটাই নিশ্চিত যে ট্রেজারি ইল্ড বাড়ে না, টাকার জোগানের ফলে বাড়তি উৎপাদনশীলতা এই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারবে বাজার এমন বিশ্বাস করে। বরং শেয়ারে লগ্নি করা সেই অবস্থায় ঝুঁকির বলে তুলনায় অনেক কম ঝুঁকির আমেরিকার ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ বাড়ে। ফলে ইল্ড কমে যায়, মার্কিন অর্থনীতিতে কোনও বড় সংকট হয় না।

তবে অর্থনীতি রক্ষা পেলেও দেশের স্বাস্থ্যসংকটের সুরাহা হয় না। অক্টোবর থেকে হুহু করে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যথাক্রমে সর্বোচ্চ তিন লক্ষ ও চার হাজারের উপর পৌঁছায়।  ট্রাম্পের প্রশাসন কোভিড মোকাবিলায় চুড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয় দেয় শুধু নয়, ট্রাম্প ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাবও প্রকট হয়ে যায়। যেহেতু ২০২০ সাল নির্বাচনের বছর, ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের মূল লক্ষ্য দাঁড়ায় কোভিড সমস্যাকে লঘু করে দেখিয়ে ভোটে উৎরানো। বিশেষজ্ঞদের মতামত না মেনে ঝুঁকি সত্ত্বেও যেনতেনপ্রকারেণ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ স্বাভাবিকভাবে চালু রাখার জন্য জোরাজুরি করা হয় ও নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্প সমর্থকদের উস্কানি দেওয়া হয় বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করতে, মাস্ক পরার মতো সাধারণ সুরক্ষাবিধি পালনেও অনাগ্রহ দেখাতে। দেশের প্রধান ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর ফাউচিকে প্রাণে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেওয়া, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড প্রতিকারে ব্যর্থ জানার পরও সেটা প্রতিষেধক হিসেবে দাবি করা ছাড়াও ট্রাম্প হাসির খোরাক হন জীবানুনাশককে শরীরে ইনজেকশন দেবার কথা বলে। পরে দেখা গেছে কোভিড বায়ুবাহিত রোগ এবং তার অতিমারির হবার ক্ষমতা আছে, বিশেষজ্ঞদের কাছে জানুয়ারিতেই এরকম জেনেও ট্রাম্প প্রায় দুমাস ব্যবস্থা নিতে দেরি করে দেশকে সাংঘাতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেন। এমনকি প্রকাশ্য সভায় ট্রাম্প একথা কবুল করেন যে তিনি কোভিড টেস্ট বন্ধ করতে বলছিলেন, কারণ এতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশ পাচ্ছে, আর তাতে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পরে ট্রাম্পের আরও অমানবিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। দেশে যখন আক্রান্তের সংখ্যা পনের, তখন মার্কিন নাগরিকভর্তি সমুদ্রে ক্রুজে যাওয়া একটা জাহাজ ট্রাম্প বন্দরে ভেড়ার অনুমোদন দেন না তাতে কয়েকজন কোভিড রুগী আছে বলে। সেটা দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্য নয়, তাতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখাবে বলে। এমনকি আমেরিকায় যারা কোভিড আক্রান্ত হবে তাদের কিউবার মাটিতে আমেরিকার মালিকানায় থাকা গুয়ান্টানামো বে আটক কেন্দ্রে (যা কিনা সন্ত্রাসবাদীদের আটক করতে ব্যবহার হয়) পাঠানো যায় কিনা ট্রাম্প খোঁজ করেন, যাতে দেশের মাটিতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা খাতায়-কলমে কম করে দেখানো যায়। ভোটের প্রচারের সময় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না মেনে বড় জনসভা করেন, যা থেকে কোভিড ছড়ায় অনেক। ট্রাম্পের বিশেষ ইচ্ছে ছিল শার্লট শহরে রিপাবলিকান দলের অধিবেশনে রাষ্ট্রপতিপদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নেবার সময় বড় করে জমায়েত করতে, কিন্তু নর্থ ক্যারোলাইনার গভর্নর তাতে অনুমতি না দেওয়ায় ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে অবশ্য পরিস্থিতি মেনে অধিবেশন ভার্চুয়ালই করতে হয়। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে সুরক্ষা না মেনে বিরাট জমায়েত করেন এবং নিজেও কোভিড আক্রান্ত হন। হাসপাতালে গিয়ে প্লেটলেট চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হন ঠিকই, তবে ট্রাম্পের রোগ বেশ জটিল পর্যায়ে ছিল। ফিরে এসেই তিনি বলেন তিনি কোভিড যুদ্ধ জয় করে এসেছেন। সাধারণ আমেরিকানদের কোভিডে ভয় না পেয়ে জমায়েত করতে উৎসাহ দেন এই বলে যে কোভিডে চিকিৎসায় সহজেই নিরাময় হয়। প্লেটলেট চিকিৎসার মতো পরীক্ষামূলক, জটিল, ব্যয়বহুল পদ্ধতি, যা রাষ্ট্রপতি বলে ট্রাম্পের কাছে সহজলভ্য, বলা বাহুল্য তা সাধারণ আমেরিকানদের আয়ত্তাধীন নয়। নির্বাচনের আগে টিকা দেবার কৃতিত্ব অর্জন করে ভোট পেতে সুবিধা হবে বলে পদ্ধতি সম্পূর্ণ হবার আগেই টিকা অনুমোদন করার জন্য ট্রাম্প জোরাজুরি করেছেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেন নি, নিয়ম অনুযায়ীই চলেছেন। ভোটগ্রহণ ডাকযোগে করার ব্যবস্থাতেও ট্রাম্প নানাভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করেন। পরে ফলাফল বেরোবার পর হেরে গেছেন দেখে ফলাফল মানতে অস্বীকার করেন। এর পরিণতি ৬ই জানুয়ারী আইনসভার উপর ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, যা আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কিত ঘটনা হয়ে থাকবে। ভোট মেটার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে  যে আড়াই মাস ট্রাম্প ক্ষমতায় ছিলেন, সেই সময়েও পরবর্তী বাইডেন-প্রশাসনের জন্য যতটা সম্ভব অসুবিধা সৃষ্টি করে গেছেন। কোভিড টিকা জোগাড় ও প্রদান করার ব্যাপারেও গড়িমসি করেছেন, ডেমোক্র্যাটশাসিত বা যেসব রাজ্য ট্রাম্পকে ভোট দেয় নি, তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করেছেন। বেশ কিছু টিকার হদিস পাওয়া যায় নি। ডিসেম্বরে ফাইজার ও মোডের্নার কোভিড টিকা ব্যবহারে ছাড়পত্র এসে গেলেও ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের বিদায়ের দিন পর্যন্ত জনসংখ্যার এক শতাংশও পুরোপুরি টিকা পায় নি, যেখানে ব্রিটেনের মতো কিছু দেশ অনেক বেশি টিকাকরণ করে। বস্তুতঃ ট্রাম্পের প্রশাসনের যাবতীয় অপদার্থতা ও অসহযোগিতা সত্ত্বেও আমেরিকার আরও বড় সংকট এড়াতে পারার পিছনে দেশের পরিকাঠামো ও বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিতে হয়। বিশেষকরে এত তাড়াতাড়ি প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়ে যাওয়া এবং তাদের কার্যকারিতা এত বেশি হওয়া সমস্ত মানবজাতির জন্যই খুব সৌভাগ্যজনক ব্যাপার।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন রাজনীতিতে বহুদিনের অভিজ্ঞ জো বাইডেন। তিনি প্রচারে বলেছিলেন যে কোভিড মোকাবিলাকে প্রথমে তিনি সবথেকে গুরুত্ব দেবেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে নীতি নির্ধারণ করবেন ও টিকাকরণে গতি আনবেন। এ ছাড়া তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বে যে কাজগুলো গুরুত্ব পাবে, তা হল কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকার কর্মজীবী মানুষের আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধার, দেশে উৎপাদনশিল্প ফিরিয়ে এনে কাজ হারানো শ্রমজীবী পরিবারের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা, ওবামার চালু করা স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থাকে আরও আকর্ষণীয় করা ও তার পরিসর বাড়ানো, স্কুলগুলিকে নিরাপদে যত শীঘ্র সম্ভব চালু করা, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষকশিক্ষিকাদের পারিশ্রমিক বাড়ানো, জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করা, বিকল্প শক্তির ব্যবহারে প্রসার ঘটানো, জাতি ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যে বন্ধ করা, কাজ-হারানোদের বেকারভাতার পরিসর বাড়ানো, দেশের পরিকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়ানো, ঘন্টাপ্রতি নুন্যতম মজুরি বাড়িয়ে পনেরো ডলার করা, ইত্যাদি। এইসব প্রকল্প রূপায়ণে যে খরচ হবে, তা ধনীশ্রেণির উপর বাড়তি কর বসিয়ে জোগাড় হবে। বাইডেন মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট হওয়া সত্ত্বেও এই ধরণের কর্মসূচী প্রকৃতপক্ষে প্রগতিশীল নীতি। ফলে ডেমোক্র্যাট দলে  প্রগতিশীল অংশের নেতা ভার্মন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনীতিকরা বাইডেনের এইসব কর্মসূচীর প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠেন। বার্নি স্যান্ডার্স দলের প্রাইমারি পর্যায়ের ভোটে বাইডেনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বর্তমানে তিনি সেনেট বাজেট কমিটির প্রধান হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বাইডেনের নীতি বর্তমানে অনেক বেশি প্রগতিশীল হয়ে ওঠার পিছনে বার্নি স্যান্ডার্সের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আইনসভার নিম্নকক্ষ হাউসে ডেমোক্র্যাট দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। উচ্চকক্ষ সেনেটে বর্তমানে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, এই দু দলের শক্তি পঞ্চাশটি করে সেনেটর নিয়ে সমান-সমান, তবে উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের কাস্টিং ভোটে ডেমোক্র্যাটরা এগিয়ে। সেনেটে অবশ্য বড় কোনও নীতি-নির্ধারণের জন্য ষাট সদস্যের সমর্থন লাগে। রিপাবলিকান সদস্যরা যে কোনও ধরণের করবৃদ্ধি ও ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণের বিরোধী তো বটেই, বলা ভালো, নানা ছুতোয় ডেমোক্র্যাটদের আনা প্রায় যে কোনও উদ্যোগ বানচাল করতে তাঁরা আগ্রহী। ওবামার রাষ্ট্রপতিত্বের সময়ও রিপাবলিকানদের বাধাদান চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের দুটি রাস্তা খোলা আছে। রাষ্ট্রপতি তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে বেশ কিছু প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করতে পারেন। তবে সেটা সাময়িক ব্যাপার, আর সবকিছু নীতি সেভাবে প্রণয়ন করা যায় না। পরিকাঠামো উন্নয়নে যেরকম বিনিয়োগ দরকার, সেনেটের অনুমোদন ছাড়া তত টাকা পাওয়া সম্ভব নয়, নতুন কোনও কর বসানোও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বাইরে। অন্য উপায়টি হল ‘বাজেট রিকন্সিলিয়েশন’ পদ্ধতিতে বেশ কিছু অর্থনৈতিক উদ্যোগ সেনেটে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে পাশ করানো। তবে তার জন্য সব ডেমোক্র্যাটিক সেনেটারের পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। দলের দুজন সেনেটার, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার জো ম্যানসন এবং অ্যারিজোনার কির্স্টেন সিনেমা, বেশ রক্ষণশীল। তাদের সমর্থন রাখতে খুব প্রগতিশীল নীতি প্রণয়ন করা অসুবিধা --- অনেকক্ষেত্রেই সমঝোতা করতে হচ্ছে। তবে এসবের মধ্যেও বাইডেনের শাসনকালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। 

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল টিকাকরণ। কারণ কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হবে না। মানুষও মারা যেতে থাকবে আর ভাইরাসও নিজেকে বিবর্তন করে আরও মারাত্মক হতে থাকবে। বর্তমানে অর্থনীতির শক্তি অনেকটাই কোভিড শিগগিরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, বাণিজ্য আর পর্যটন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে --- এইরকম আশার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। বাইডেন প্রশাসন কাজ শুরু করার পরে টিকাকরণের ব্যাপারে বিশেষ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। বাইডেন বলেছিলেন তাঁর লক্ষ্য প্রথম একশ দিনে দশ কোটি টিকা দেবার ব্যবস্থা করবেন। এর জন্য প্রয়োজন হয় যুদ্ধকালীন উৎপাদন আইনের সাহায্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজার, মোডের্না, মার্ক এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের মধ্যে সহযোগিতা করানো, যাতে এক সংস্থার টিকা অপর সংস্থাগুলিও তৈরি করার অধিকার ও দায়িত্ব পায়। সেই দশ কোটির লক্ষ্যমাত্রা অনেকদূর ছাড়িয়ে চব্বিশ কোটি টিকা দেওয়া হয় ওই সময়ের মধ্যে। প্রতিদিনের টিকার সংখ্যা বাইডেনের অভিষেকের দিন ২০ জানুয়ারি ন লক্ষ ছিল, সেখান থেকে বেড়ে তেত্রিশ লক্ষে পৌছায় এপ্রিলের মাঝামাঝি। ইতিমধ্যে বারো থেকে ষোল বছর বয়সীদের জন্যও ফাইজারের টিকা ছাড়পত্র পায়। টিকার অপ্রতুলতার বা স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব হবার কোনও সমস্যা আর থাকে না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে টিকা নিতে কারুর কোনও আর্থিক দায় নিতে হয় নি, যদিও আমেরিকা একটা পুরোপুরি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। যাদের স্বাস্থ্যবিমা আছে, তাদের টিকার পুরো খরচ বিমা সংস্থা দিয়েছে। বাকিদের টিকার খরচ রাষ্ট্র যুগিয়েছে। তার জন্য নাগরিক বা আইনি অভিবাসী হতে হয় নি, কোনও কাগজপত্রও দেখাতে হয় নি। আমেরিকায় বহু বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আছে, তাদেরও রাষ্ট্র বিনামূল্যে টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছে। এর কারণ বোঝা শক্ত নয়। কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইনি-বেআইনি সবারই প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে, কারণ সংক্রমণ কোনও বাছবিচার করে না। রাষ্ট্রের কাছে এই খরচটা আরও অনেক বেশি ক্ষতিকে আটকানোর উপায়। বিমা সংস্থারাও জানে টিকার জন্য সামান্য খরচ করলে ভবিষ্যতে অনেক বড়ো খরচ তারা এড়াতে পারবে।

 

কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রাথমিক পর্যায়ে গতি আসার পর থেকে দৈনিক টিকা দেবার সংখ্যা কমতে কমতে মাত্র পাঁচ লক্ষে এসে পৌছায়, কারণ আমেরিকার বহু মানুষের টিকার উপর ভরসা নেই। এই সমস্যা বিশেষ করে রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি মাঝের এবং দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্যগুলিতে অত্যন্ত প্রকট। এর ফলে শতাংশের হিসেবে টিকাকরণ জনসংখ্যার  পঞ্চাশ শতাংশের সামান্য বেশিতে পৌঁছে থমকে গেছে। অথচ গোষ্ঠিগত রোগ প্রতিহত করার ক্ষমতা (herd immunity) পেতে কোভিডের মতো ছোঁয়াচে রোগের জন্য জনসংখ্যার অন্ততঃ সত্তর শতাংশকে টিকা দিতে হবে। বিভিন্ন রাজ্য এখন টিকা নেবার উৎসাহ বাড়ানোর জন্য পুরস্কার দিচ্ছে লটারির ভিত্তিতে, যার পরিমাণ দশ লক্ষ ডলার। অনেক রাজ্যে প্রতি মাসেই একাধিকবার এরকম পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তার জন্য রাজ্যগুলির জন্য বাড়তি টাকা বরাদ্দ করাও হয়েছে। নীতিতিগতভাবে, টিকা নিলে পুরস্কার দেওয়া হাস্যকর ব্যাপার মনে হলেও, আসল উদ্দেশ্য যেখানে যতসম্ভব লোককে টিকা দিয়ে অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেখানে এই খরচটা আমেরিকার মতো বড়ো দেশের পক্ষে কিছুই নয়। তবে তাতে যে পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, তা নয়। শুরুতে কিছু বাড়তি অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও তা ঝিমিয়ে পড়েছে। একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ গোঁ ধরে রয়েছে তারা কিছুতেই টিকা নেবে না। বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে কিছু গোষ্ঠীও এ ব্যাপারে ইন্ধন যোগাচ্ছে, টিকার প্রতিক্রিয়াকে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করছে। অবস্থা এমন যে টিকা রয়েছে প্রচুর, তা নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, কিন্তু নেবার লোকের অভাব। যেখানে বাকি পৃথিবীতে বহু জায়গায় মানুষ টিকার নেবার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, চেয়েও পাচ্ছে না, সেখানে এই ধরণের অপচয় শুধু দুঃখজনকই নয়, ভবিষ্যৎপরিস্থিতির জন্য উদ্বেগজনক। টিকা না নেওয়া লোকেদের মধ্যে কোভিডের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আবার। শেষ কয়েকদিনে আবার আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যায় উর্দ্ধগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমেরিকা একরকম দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে --- একদল মানুষ টিকা নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারছে তো আর একদল মানুষ টিকা না নিয়ে মারাত্মক বিপদের মুখে গিয়ে পড়ছে।

বাইডেনের অন্যান্য বিষয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের একশ দিনের মধ্যে আরও এক লক্ষ নব্বই হাজার কোটি ডলারের ‘আমেরিকা রেস্কিউ প্ল্যান’ পাশ করিয়ে পরিকাঠামো ও অর্থনৈতিক সংস্কার, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে মোকাবিলা করা। উল্লেখ্য, ট্রাম্পের সময়ে আমেরিকা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, বাইডেন আবার সেখানে আমেরিকাকে ফেরত নিয়ে গেছেন। মার্চ মাসে আইনসভা বাইডেনের পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যদিও কিছু কিছু জায়গায় কাটছাঁট করতে হয়। যেমন ঘন্টাপ্রতি পনের ডলারের ন্যূন্যতম মজুরি এখনও চালু করা যায় নি। তবে অনেককিছু হয়েছে, যেমন আরও চোদ্দশ ডলারের চেক দেওয়া হয়েছে সাধারণ আমেরিকান পরিবারগুলিকে স্টিমুলাস হিসেবে, বেকারভাতা দেওয়ার মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, রাজ্যগুলিকে পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি ডলারের বাড়তি সাহায্য দেওয়া হয়েছে। ফুড স্ট্যাম্প কর্মসূচী, যার মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলিকে খাবার কেনার খরচ যোগানো হয়, তা পনের শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বাকি পৃথিবীর জন্যও বাইডেন টিকা তৈরিতে চারশ কোটি ডলার আমেরিকান অনুদান বরাদ্দ করেছেন, কারণ কোভিড সমস্যা একটি পৃথিবীব্যাপী সমস্যা --- পুরো পৃথিবী থেকে নির্মূল না হলে আমেরিকাও নিরাপদ হবে না। এগুলো অবশ্য আপদকালীন ব্যবস্থা। দীর্ঘমেয়াদে উন্নতির জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ওবামার চালু করা স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য সড়ক ও সেতু নির্মান, উন্নতি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হবে। আমেরিকার রেলপথ, যা মোট দৈর্ঘ্যে পৃথিবীর দীর্ঘতম কিন্তু আধুনিকিকরণ না হবার ফলে ইউরোপ বা এশিয়ার বেশ কিছু দেশগুলির থেকে মানে অনেক পিছিয়ে পড়েছে, তাকে আবার পুরোদমে চালু করার জন্য সাড়ে বাইডেন আট হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ করার প্রস্তাব রেখেছেন। এছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো এবং পেট্রল-ডিজেলের গাড়ির ব্যবহার ও উৎপাদন ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেবার মতো নীতি চালু করার চেষ্টা চলছে। বিকল্প শক্তির উৎপাদনে বাড়তি বিনিয়োগ করে তাকে প্রধান শক্তির উৎস করার মতো পরিকল্পনা রয়েছে। পুরো আমেরিকাকে নতুন অর্থনীতিতে পুরোপুরি উপযুক্ত করার জন্য প্রয়োজন সর্বত্র ব্রডব্যান্ড পরিষেবা, বিশাল দেশের গ্রামীণ এলাকায় যা অমিল বা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। বাইডেনের এই সমস্যার সমাধানে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছেন। স্কুলের শিক্ষায় বাড়তি বিনিয়োগ, কমিউনিটি কলেজগুলিতে প্রথম দুবছরে বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, শিশুদের ডে কেয়ারের সুলভ ব্যবস্থা করা, শিশুপিছু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারদের করছাড় দুহাজার থেকে বাড়িয়ে ছত্রিশশো ডলার করা, আর যে কোনও জীবিকাতেই পিতৃত্ব-মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটির ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। উল্লেখ্য, আমেরিকাই একমাত্র উন্নত দেশ যেখানে পিতৃত্ব-মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটির কোনও দেশব্যপী আইন নেই --- নিয়োগকর্তার নীতির উপর নির্ভরশীল। তবে এইসব পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য যে দুই থেকে চার লক্ষ কোটি ডলারের অর্থের প্রয়োজন, তা প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে হবে না। তার জন্য আইন পাশ করাতে হবে ও বাড়তি কর চাপিয়ে সেই টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইডেনের পরিকল্পন্‌ উচ্চতম করের হার ট্রাম্পের আগে যে ৩৯.৬% ছিল, সেখানে নিয়ে যাওয়া, আর দশ লক্ষ ডলারের উপর যেসব পরিবারের বার্ষিক আয়, তাদের মূলধনী লাভের (capital gain) উপর সাধারণ আয়ের হারে কর বসানো। আর চার লক্ষের কম বার্ষিক আয়ের পরিবারদের উপর কোনও  কর না বাড়ানো। প্রচুর আয়ের পরিবারদের আয় হয় মূলতঃ মূলধনী লাভ থেকে যার হার অনেক কম, ফলে ধনীরা বেশিরভাগক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের কম হারে কর দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। তাছাড়া বড় ব্যবসাগুলি প্রচুর আইনি উপায়ে কর এড়াতে পারে। আমাজনের মতো বিশাল কোম্পানি বেশ কয়েকবছরে কোনও কর দেয় নি, কারণ তারা বিনিয়োগের খরচ দেখিয়ে কর ছাড় পেয়েছে। ধনীদের ও কর্পোরেশনের উপর কর বসানোয় রিপাবলিকানদের সহায়তা পাবার সম্ভাবনা শূণ্য, ফলে ডেমোক্র্যাটরা আলোচনা করছেন কিভাবে এই পরিকল্পনাগুলো রূপায়ণ করা যায়। মোটামুটিভাবে তাঁরা বাজেট রিকন্সিলিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ ব্যাপারে এগোতে চাইছেন। তারা নিজেদের মধ্যে সাড়ে তিন লক্ষ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে মোটামুটি একমত হয়েছেন।

সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা একটা পরীক্ষিত পদ্ধতি, তবে তার বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। জাতীয় ঋণ বেড়ে এখন আঠাশ লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা জাতীয় মোট বার্ষিক উৎপাদনের বেশি। শতাংশের হিসেবে সেটা অবশ্য সেরকম মারাত্মক পরিমান নয়, অনেক দেশেরই সেই অনুপাত অনেক বেশি, জাপানের অনুপাত তো আমেরিকার প্রায় আড়াইগুণ। আমেরিকার ঋণ শোধ দেবার ক্ষমতা নিয়ে এখনও বাজারের কোনও সংশয় দেখা দেয় নি। তবে কোভিডের আগের থেকে জাতীয় ঋণ প্রায় চার লক্ষ কোটি ডলার বেড়ে গেছে। বাজেট ঘাটতিও এখন বেড়ে প্রায় তিন লক্ষ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এগুলো কতটা আশংকাজনক, তাই নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন ঘাটতি করেও বিনিয়োগ বাড়িয়ে জাতীয় উৎপাদন বাড়াতে পারলে লাভ বেশি হয়, বিশেষতঃ যখন সুদের হার কম আছে। তবে যেটা সত্যিকারের মারাত্মক হয়ে দেখে দিতে পারে, তা হল মুদ্রাস্ফীতি। বাজারে টাকার যোগান বাড়ালে প্রায় অবধারিতভাবেই মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। শেষ তিন মাসে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশের মতো হয়েছে। একটা উন্নত অর্থনীতির পক্ষে এই পরিমান বেশ বেশি, কারণ তাদের বৃদ্ধির সুযোগ কম। কোভিডের চরম অবস্থার সময় অনেক জিনিষ উৎপাদন করতে পারা যায় নি। চাহিদা বাড়ার ফলে এখন সেইসব জিনিষের দাম অনেক বেড়ে গেছে। জ্বালানী তেলের দামও এখন বেশ চড়া। আর মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে বাড়ির দাম, কারণ চাহিদার থেকে নতুন বাড়ি কম বাড়ি তৈরি হয়েছে আর লোকে কোভিডের কারণে বাড়ি বিক্রি করতে অনীহা করেছে। বাড়ি তৈরির কাঁচামাল অমিল বলে নতুন বাড়ি তৈরির খরচ বেড়ে গেছে। আপাতভাবে মনে হতে পারে যে বাড়ির দাম বাড়লে বাড়ির মালিকের পক্ষে তা ভাল, আর বেশিরভাগ পরিবার যেহেতু বাড়ির মালিক, তাতে সামগ্রিকভাবে দেশের ভালোই। মুস্কিল হল অনেক জায়গায় এই মূল্যবৃদ্ধি মানুষের রোজগার বৃদ্ধির তুলনায় এতই বেশি যে স্থানীয় মানুষের বাসস্থান সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষকরে যারা প্রথম বাড়ি কিনছে। অর্থনীতির বাস্তুতন্ত্র তাতে নষ্ট হয়ে যায়। সবার হঠাৎ করে রোজগার বাড়ার তেমন সুযোগও থাকে না। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অনেক পরিবার আবার দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাবে। আর একটা সমস্যা হয়েছে উপযুক্ত কর্মীর অভাবের। এর ফলে অনেক ব্যবসা পুরোদমে চালু থাকছে না। রিপাবলিকানরা অভিযোগ করেছে লোকের হাতে সহজেই টাকা তুলে দেবার ফলে আর বেকারভাতা খুব উদারভাবে দেবার ফলে কর্মীদের কাজে যোগ দিতে অনীহা রয়েছে, কারণ তারা রোজগারের থেকে ভাতা বেশি পাচ্ছে। ডেমোক্র্যাটদের বক্তব্য ব্যবসাগুলি যথেষ্ট মজুরি দিতে রাজি থাকলে এই সমস্যা হয় না। সুতরাং তাদের উচিৎ ঘন্টা হিসেবে কাজ করা কর্মীদের পারিশ্রমিক বাড়ানো। বস্তুতঃ মুদ্রাস্ফীতির হিসেব মাথায় রাখলে সেই সত্তর দশক থেকে আমেরিকার সাধারণ কর্মীদের ঘন্টাপ্রতি প্রকৃত মজুরি বাড়ে নি, অনেকে পুরোসময়ের জন্য কাজ করেও সরকারি ফুড-স্ট্যাম্পের উপর নির্ভরশীল। কম মজুরি দিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের মতো অনেক বড়ো কর্পোরেশনও পরোক্ষভাবে সরকারি ভর্তুকি নিচ্ছে আর নিজেদের মুনাফা বাড়াচ্ছে। কোভিডের সূত্রে হলেও এইধরণের সংশোধন বিশেষ কাম্য। 

বাইডেন প্রশাসনের সংস্কার ও বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলি খুবই আশাবাদী, বাস্তবে কতটা রূপায়িত হবে তা সময়ই বলবে। তবে এরকম ব্যাপক সংস্কার আমেরিকায় বহুদিনের অপেক্ষিত। কোনও সংকটের সময়ই সব থেকে বড়ো প্রগতি হয়। মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট তাঁর বিখ্যাত ‘নিউ ডিল’ পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার করেছিলেন। তার দুই দশক পরে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের (civil rights movement) প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন খুব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করেছিলেন। বাইডেনের পরিকল্পনাগুলির সঙ্গে সেইসব সংস্কারের তুলনা হয়েছে। যদি বাইডেন মোটের উপর সফল হন তাঁর পরিকল্পনাগুলিকে রূপায়ন করতে, তাহলে তিনি আমেরিকার ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নেবেন। 


--------------------

লেখার তারিখঃ ২১ জুলাই, ২০২১

প্রথম প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, নভেম্বর ২০২১ সংখ্যা

শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আফগান সংকট --- আমেরিকার কুড়ি বছরের ব্যর্থ অভিযান

 আফগান সংকট --- আমেরিকার কুড়ি বছরের ব্যর্থ অভিযান

 -শুভাশিস ঘোষাল 

এই মুহুর্তে পৃথিবীর সর্বত্র আলোচ্য বিষয় হল আফগানিস্তান আবার তালিবানদের দখলে চলে যাওয়া ও তার ফলে উদ্ভূত মানবিক সংকট। তালিবানের শাসন থেকে নিষ্কৃতি পেতে কাতারে কাতারে মানুষ কাবুল এয়ারপোর্টে জড়ো হয়ে বিমানের অপেক্ষা করছেন বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বিমানে ঝুলে পড়ছেন, এরকম দৃশ্য দেখে মানুষ আঁতকে উঠেছে। কত সাংঘাতিক পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ এতো বড়ো ঝুঁকিও নিতে পারে, সেটা আন্দাজ করা যায়, কারণ মানুষ এর আগে তালিবানি শাসনের মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি আর নৃশংসতার পরিচয় পেয়েছে। আমেরিকার কুড়ি বছরের আফগানিস্তান অভিযানের শেষে তাহলে কি পাওয়া গেল? কেনই বা আমেরিকার আফগান নীতি এরকম শোচনীয় ব্যর্থ হল? কেন আফগান সরকারি বাহিনী আমেরিকার কাছ থেকে এত সাহায্য, প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র পেয়েও তালিবানদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ দিতে ব্যর্থ হল? আর সব ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠছে, আমেরিকার প্রশাসনের তরফে এতটা বিশৃংখলা কি এড়ানো যেত না? আমেরিকা সরে যাবার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন, রাশিয়া আর পাকিস্তান সেই শূণ্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসবে, ফলে এই অঞ্চলে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আইসিস ও অন্যান্য আরও চরমপন্থী জঙ্গি সংগঠন নতুন জমি পেয়ে যেতে পারে। আফগান সংকট ভারতবর্ষের জন্যও বিশেষ চিন্তার বিষয়, কারণ তালিবানের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা, বিশেষ করে কাশ্মীরে। ভারতীয় কোম্পানি আর কর্মীরা যারা আফগানিস্তানে নির্মান বা পরিষেবা শিল্পে নিযুক্ত ছিল, তারাও কাজ হারাবে। সব মিলে, পরিস্থিতি খুবই বিমর্ষকর।

আফগানিস্তানকে বলা হয় সাম্রাজ্যের কবরখানা। তার কারণ জারের রাশিয়ার রাজ্যবিস্তার আফগান সীমান্তে এসে থেমে গিয়েছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আফগানিস্তান দখল করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়, আর গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সর্বশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তি আফগানিস্তানের মতো ছোট অনুন্নত দেশে অভিযান করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। কথাটা অবশ্য কিছুটা সরলীকরণ --- ব্রিটিশরা সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্য নিয়ে আফগানিস্তান অভিযান করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল অন্য। তবে পাহাড়ে ঘেরা দুর্গম জায়গা আর বিভিন্ন সশস্ত্র উপজাতীয় গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান জয় করা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার সাধ অপূর্ণ রেখেই মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে আফগানিস্তান সন্ত্রাসের ঘাঁটি হয়ে উঠল, কেন এত শক্তিশালী আমেরিকা অন্য দেশের কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়েও তালিবানদের রুখতে পারল না, আর কিভাবে আমেরিকার আফগানিস্তানে অভিযান পূর্বতন সোভিয়েত অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা বুঝতে গেলে আফগানিস্তানের ইতিহাসটা কিছুটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আফগানিস্তানের ইতিহাস চার হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। কাবুল উপত্যকাতেই সাড়ে তিন হাজার বছরের উপর মানুষ টানা বাস করছে, ভারতবর্ষেরও কোনও বর্তমান জনপদ এতটা প্রাচীন নয়। সিল্ক রুট ধরে চলা  বাণিজ্যপথে আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। আফগানিস্তানের ইতিহাসও অস্থিরতায় ভরা। অতি প্রাচীন যুগে পারস্য ও সিন্ধু-সভ্যতার মধ্যে অবস্থিত আফগানিস্তানের দুই দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল। আলেকজান্দার এই অঞ্চল দখল করেছিলেন। তারপর গ্রীকরা উত্তর আফগানিস্তানে ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্য গড়ে তোলে। মৌর্য ও কুষাণদের অধিকারে ছিল একসময় আফগানিস্তান, বৌদ্ধধর্ম প্রসারলাভ করেছিল। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে আরব বিজয়ের ফলে ইসলাম ধর্ম আফগানিস্তানে সর্বব্যাপী হয়। এরপর চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, বাবর এবং দিল্লীর থেকে ঘুরি আর  খিলজি সুলতানদের আক্রমণে পড়েছিল আফগানিস্তান। তবে বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর অধীনে থাকা এই অঞ্চলকে একটা দেশ হিসেবে একীকৃত করেছিলেন আহমেদ শাহ দুরানি, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝে। পাশতুন গোষ্ঠীর দুরানি পারস্য সম্রাট নাদির শাহের সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। নাদির শাহের মৃত্যুর তিনি দেশে ফিরে একে একে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দলে টানেন বা জয় করেন। তিনি ভারতবর্ষ অভিযানও করেন ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে যেতেন। তবে শিখদের সঙ্গে লড়াইয়ে পিছু হঠে আবার আফগানিস্তানের সীমানার মধ্যেই ফিরে আসেন। এই সময় জারের রাশিয়ার মধ্য এশিয়ায় প্রসারণ, ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও চীনের উপর ইংরেজ নিয়ন্ত্রণের ফলে আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়ে দেশটা বাকি পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধর্মীয় সূত্রে প্রায় সবাই সুন্নি মুসলমান হওয়ায় আর পাহাড়ে ঘেরা একটা অঞ্চলে আবদ্ধ হবার ফলে দেশ হিসেবে আফগানিস্তান ঐক্যবদ্ধ হয়। আর দেশে লড়াইমুখী রক্ষণশীল সংস্কৃতি গড়ে ওঠারও এটাই বড় কারণ।

জারের রাশিয়ার অগ্রগতিতে চিন্তিত হয়ে ব্রিটিশরা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আফগানিস্তান অভিযান করে, কারণ তাদের ভয় ছিল আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে রাশিয়া ভারতবর্ষ দখল করে ফেলতে পারে। এই অভিযানে ব্রিটিশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের বসানো তাঁবেদার শাসক ব্যর্থ হলে আবার পুরোনো শাসক দোস্ত মহম্মদকে গদি ফিরিয়ে দিতে হয়। বিদেশনীতি ছাড়া আর সব ব্যাপারে আফগানিস্তানের স্বশাসন মেনে নেওয়া হয়, ব্রিটিশ-ভারতবর্ষের সঙ্গে চিরস্থায়ী সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইন টানা হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে বাকি সময় তারা সদ্ভাব মেনে চলে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাইজার এবং অটোমানদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও তারা অক্ষশক্তিতে যোগ দেয় নি। আফগানিস্তান পুরোপুরি স্বাধীনতা পায় ১৯১৯ সালে। ১৯২৬ সালে সংবিধান চালু হয়। আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানের স্বাধীন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন, ও দেশের আধুনিকীকরণ ধীরে ধীরে শুরু করেন। তবে ১৯২৯ সালে গৃহযুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইতালিতে পালিয়ে যান। ১৯৩৩ সালে আফগানিস্তানের রাজা হিসেবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা পান মহম্মদ জাহির শাহ। তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর সময়ে আফগানিস্তান স্থিতিশীলতা পায়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই তিনি সুসম্পর্ক রেখে উভয় দেশের সাহায্যেই দেশের আধুনিকীকরণ করছিলেন। কাবুলে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তিনি বোরখা নিষিদ্ধ করেছিলেন ও স্কুল-কলেজে কো-এডুকেশন নীতির প্রচলন করেছিলেন। মেয়েরা বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পারত। রক্ষণশীল আফগানিস্তানে ইসলামী মৌলবাদীরা অবশ্য এতে অসন্তুষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু জাহির শাহ খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার মোটামুটি নির্বিঘ্নেই শাসন চালান। তবে অঘটন ঘটে ১৯৭৩ সালে, যখন ইতালিতে ছুটি কাটানোর সময় তার জ্ঞাতিভাই দাউদ খান তাঁকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, ও রাজতন্ত্র বাতিল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। তবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নয়, তাঁর মন্ত্রীরা সবাই মনোনীত হতেন। দায়ুদের স্বৈরাচারী শাসন অবশ্য জনপ্রিয় হচ্ছিল না। দেশে বামপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ও অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি মুজাহিদীনরা শক্তিশালী হতে থাকে। ব্যাঙ্ক জাতীকরণের মতো সমাজতান্ত্রিক সংস্কার করলেও দায়ুদের সোভিয়েত-বিরোধী মুসলিম দেশদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ও দেশের উত্তর অংশে সোভিয়েত সীমানার কাছাকাছি সামরিক  ঘাঁটিতে নেটোর বিশেষজ্ঞদের সফর সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুষ্ট করে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত অস্ত্রের সাহায্যে পিডিপিএ ‘সর (এপ্রিল) বিপ্লবের’ মাধ্যমে দায়ুদ খানকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে ও আফগান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কমিউনিস্ট নেতা নুর-মহম্মদ তারাকি রাষ্ট্রপতিপদে বসেন, ও ভূমি-সংস্কার সহ সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেন। তারাকির আশা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান এতে উপকৃত হবে ও কমিউনিস্টদের সমর্থন বাড়বে। স্থানীয় স্তরে উপজাতীয় শাসনে অভ্যস্ত রক্ষণশীল আফগান সমাজে এই ধরণের সংস্কার তেমন বোধগম্য হয় না, প্রভাবশালীরা রুষ্ট হয় তো বটেই।  দেশের উৎপাদনেরও কোনও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয় না। পিডিপিএ দলের ও সরকারের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর লড়াই,আর বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিনের ‘বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি সন্ত্রাসের নীতি’ তারাকির সরকারের জন্য বিশেষ বিড়ম্বনার কারণ হয়। ওদিকে সেই সুযোগে বিরোধী মুজাহিদীনদের শক্তি বাড়াতে থাকে। তারাকি সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে সাহায্য সামরিক প্রার্থণা করেন, কিন্তু সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ তাঁকে নিরস্ত করেন ও সোভিয়েত বাহিনীর আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে সামরিক হস্তক্ষেপ কাম্য নয় বলে জানান। ব্রেজনেভ তারাকিকে বলেন লোকের মন বুঝে সংস্কারের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে আর আমিনকে সামলাতে। কিন্তু তারাকি তা করতে ব্যর্থ হন, বরঞ্চ আমিন তাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন আর তারাকির প্রাণদন্ড দেন। আফগানিস্তানে তখন চুড়ান্ত বিশৃংখলা চলছিল, আর মুজাহিদীনরা শক্তিশালী হচ্ছিল। পিডিপিএর দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পরিস্থিতি দেখা দেয়।

আফগানিস্তানে যখন এইসব ঘটনা ঘটছিল, তখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডেমোক্র্যাটিক দলের জিমি কার্টার। তিনি নরমপন্থী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন। ঠান্ডা যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে এর চারবছর আগে ভিয়েতনামে কুড়ি বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার পর আমেরিকা সেখান থেকে খালি হাতে ফেরে। সেই যুদ্ধের ঘা তখনও দগদগে। আফগান সংকটে সোভিয়েতপন্থী সরকারের পতন হলে আমেরিকার বড় লাভ হয়। ইতিমধ্যে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসে। ইরানে আমেরিকান দূতাবাসে আমেরিকান কূটনীতিকদের বন্দী রাখা হয়েছিল। জ্বালানীর দামও অত্যধিক বেড়ে গেছিল, সামগ্রিকভাবে আমেরিকা তথা সারা পৃথিবীতে একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছিল। কার্টারের উপর পেন্টাগনের চাপ আসছিল আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করার জন্য। কার্টারের প্রশাসন তখন মুজাহিদীনদের অর্থসাহায্য দেওয়া শুরু করে। আমেরিকার ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে কিছুতেই নিজেদের সেনা পাঠাবে না। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হবে।

আফগানিস্তানে অরাজকতা ও মুজাহিদীনদের প্রভাব বাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিচলিত করে। সোভিয়েত নেতৃত্বের আশংকা হয়, কাবুলে সরকারের পতন হলে ইসলামী মৌলবাদ সীমান্ত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে ছড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের ইসলামিক বিপ্লব, পাকিস্তানের ঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা আর সৌদি আরবের মুজাহিদীনদের অর্থ যোগানো সেই চিন্তাকে বাড়িয়ে তোলে। তা ছাড়া আমিন শিবির বদলে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন, এমন আশংকাও সোভিয়েত নেতৃত্বের ছিল। এই ধারণা অবশ্য অমূলক ছিল, কারণ আমিনই সোভিয়েত সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠাচ্ছিলেন বারবার। ব্রেজনেভ আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর ব্যাপারে বেশ যত্নবান ছিলেন। বিভিন্ন দেশে বামপন্থী গেরিলাদের সাহায্য যোগালেও ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত এলাকার বাইরে তিনি সরাসরি সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন করেন নি কখনও। আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর দ্বিধা ছিল। কেজিবি প্রধান (পরে রাষ্ট্রপ্রধান) ইউরি আন্দ্রোপভ তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে দু-তিন মাসের মধ্যেই সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে এনে দেশে ফিরে আসতে পারবে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে ও দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আমিনকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়। প্রথমে বারবাক কারমালের ও পরে মহম্মদ নাজিবুল্লার নেতৃত্বে সোভিয়েত সেনা সহায়তায় পিডিপিএ সরকার চালায়। ব্যাপক মৃত্যুদন্ড দেওয়া বন্ধ হয়, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়, মুক্ত-ভাষণের অধিকার মেনে নেওয়া হয়, অধিগৃহীত জমিও বেশ কিছু ফেরত দেওয়া হয়। এই সময় আফগান সমাজ বেশ কিছুটা প্রগতিশীল ছিল, মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়তে পারত, চাকরি করতে পারত, ডাক্তারদেরও চল্লিশ শতাংশই ছিল মহিলা।

তবে সোভিয়েত নেতাদের যে হিসেব ছিল কয়েকমাসের মধ্যেই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের বাহিনী ফেরত চলে আসবে, তা শোচনীয়ভাবে ভুল প্রমাণ হয়। আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্রের সাহায্যে মুজাহিদীনরা সোভিয়েত বাহিনীকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে দুর্গম পাহাড়ে পালিয়ে যেত। সোভিয়েত সেনা তাদের নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৮০ সালে কার্টারকে হারিয়ে কট্টরপন্থী রনাল্ড রেগন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর আফগান মুজাহিদীনদের দেওয়া মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। মোট দুহাজার কোটি ডলারের অস্ত্রসাহায্য দেয় আমেরিকা। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জিয়া-উল-হকের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদীনদের হাতে সেইসব অস্ত্র পৌঁছে দিত। যুদ্ধ প্রলম্বিত হতেই থাকে। অনিচ্ছার যুদ্ধে আমেরিকা যেমন ভিয়েতনামে পাঁকে পড়ে গিয়ে বহুবছর  আটকে পড়েছিল, সোভিয়েত বাহিনীরও সেই দশা হয়। পরবর্তী দশ বছর তারা ব্যাপক নাজেহাল হয়। তাদের মোট পনের হাজারের মতো সৈন্য মারা যায়। সাধারণ আফগান নাগরিকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। অনুমান করা হয় মুজাহিদীন সহ পাঁচ থেকে কুড়ি লক্ষ আফগান প্রাণ হারিয়েছিল এই যুদ্ধে, আর শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত নাগরিকের সংখ্যা সব মিলে হতে পারে সত্তর লক্ষের মতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ফলে সারা পৃথিবীতেই নিন্দিত হয়। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের চেষ্টা করতে থাকেন। বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে সোভিয়েত আর মুজাহিদীন, এই দুই পক্ষই নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে অপরপক্ষকে জানিয়ে সামরিক হানা করত। অবশেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।

তবে আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নাজিবুল্লার নেতৃত্বাধীন পিডিপিএ সরকারকে সাহায্য পাঠায়। নাজিবুল্লাহ আরও তিন বছর ইসলামী মুজাহিদীনদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তবে ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙ্গে গেছে, অনুগত বাহিনীর অনেকে শিবির বদল করে মুজাহিদীনদের দলে যোগ দিয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল হলে ১৯৯২ সালে নাজিবুল্লা ক্ষমতাভার ছেড়ে দেন ও কাবুলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অফিসে আশ্রয় নেন। রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্ততায় বুরহাউদ্দিন রাব্বানির নেতৃত্বে বিভিন্ন মুজাহিদীন গোষ্ঠী মিলিয়ে সরকার গঠন করা হয়। দেশের নাম দেওয়া হয় আফগান ইসলামিক রাষ্ট্র। তবে পাকিস্তানের মদতে চরমপন্থী নেতা গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার পুরো ক্ষমতাটাই নিজের হাতে চান, তাই গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও  নর্দার্ন অ্যাল্যায়েন্স নামক তাজিক, উজবেক ও অন্যান্য উত্তরাঞ্চলের উপজাতিদের মিলিত সামরিক সংগঠনের নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ, যিনি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, মধ্যস্ততা করে হেকমেতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান ও কিছুটা শান্তি ফেরে। কিন্তু আফগানিস্তানে তাদের প্রভাব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের চর সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আই এস আই) মুজাহিদীনদের একটা অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তালিবান নামে একটা চরমপন্থী মৌলবাদী ধর্মীয়-সামরিক বাহিনী তৈরি করে। তালিবান কথাটা পশতু ভাষায় ছাত্র বোঝায়, কারণ তারা পাকিস্তানের মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমেরিকা পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে জেনেও না জানার ভান করে থাকে, পাকিস্তানকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য দেওয়া চলতেই থাকে। তালিবানরা এর পর সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে দেশের সিংহভাগ দখল করে ফেলে। কঠোর শরিয়তি আইন চালু হয়, স্কুল-কলেজ,  গান-বাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়, মেয়েদের প্রায় সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ব্যাপক লুঠ, নরহত্যা, প্রায় বিনা অপরাধে মধ্যযুগীয় বর্বর শাস্তিপ্রদান, অস্ত্র, মাদক ও আফিংএর চোরাচালান এসব চলতে থাকে। সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে দেখে বামিয়ানের বিখ্যাত প্রাচীন  বুদ্ধমূর্তি তালিবানরা ধ্বংস করে ফেলে। তালিবানি বাহিনীর বিরুদ্ধে নর্দার্ন অ্যাল্যায়েন্স প্রতিরোধ জারি করে দেশের উত্তরাংশকে তালিবানমুক্ত রাখতে সমর্থ হয়। ওদিকে তালিবানরা কাবুলের দিকে এগিয়ে আসছিল। কাবুলের পতন হবার উপক্রম হলে নাজিবুল্লাকে শহর ছেড়ে পালাতে বলা হয়, কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করার পর চুড়ান্ত অত্যাচারের পর তালিবানরা নাজিবুল্লাকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। তারা নিজেদের আফগানিস্তানের শাসক বলে দাবী করে ও দেশের নামকরণ করে আফগান ইসলামী আমিরশাহী। শুধু পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী তালিবানের সরকারকে স্বীকার করে। রাব্বানি নির্বাসিত সরকার চালাতে থাকেন  পৃথিবীর বাকি দেশগুলো রাব্বানির সরকারকেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়।

এদিকে পৃথিবীর অন্যত্র অনেক মুসলিম দেশে আমেরিকার প্রতি বন্ধুভাব কমে আসে। ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমেরিকার প্রতি একধরণের অনুযোগ সবসময়ই ছিল মুসলিম সমাজে, কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে যৌথবাহিনী সাদ্দাম হুসেনের ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করে ও সেই উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের মাটিতে সৈন্য মোতায়েন করে। রক্ষণশীল মুসলিমদের কাছে সৌদি এক পবিত্রভূমি, ইসলাম ধর্মের জন্মস্থান, হজরত মুহম্মদের স্মৃতিবিজড়িত। ওসামা বিন লাদেন নামে এক ধনী সৌদি অভিজাত রক্ষণশীল মুসলিম নেতা, যিনি সোভিয়েত বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে আফগানিস্তানের মুজাহিদীনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন, বিদেশী সৈন্যের সৌদিভূমিতে অবস্থান নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন, কিন্তু সৌদি আরবের রাজা তার কথায় আমল দেন না। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সিনিয়র বলেছিলেন সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতা থেকে না হঠানো পর্যন্ত সৌদি মাটিতে আমেরিকার সৈন্য থাকাটা জরুরি। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের পরে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাদ্দামকে বুশ ক্ষমতা থেকে সরান না, আর সৌদি থেকেও সৈন্য সরান না। লাদেন এবার ক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমকে আমেরিকার বিরিদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে বলেন। সৌদি আরব লাদেনকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। লাদেন সুদানে আশ্রয় নেন। তবে সুদানও তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর হলে আর সুদানে তার ব্যবসা মার খাবার পর নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে লাদেন তালিবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আফগানিস্তানে আশ্রয় নেন ও ইসলামি জিহাদি সংগঠন আল-কায়েদা গড়ে তোলেন। এর পর একের পর এক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করতে থাকে তারা। ১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে বোমাবিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য তারা পায় ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, যখন আল-কায়েদা জঙ্গিরা চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে। তিন হাজার আমেরিকাবাসী সাধারণ মানুষ মারা যায় এই আক্রমণে। ভৌগলিকভাবে সুরক্ষিত আমেরিকায় এত বড় জঙ্গিহানা আগে কখনও ঘটেনি। সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে টেলিভিশনে দেখে সেই দৃশ্য। আমেরিকার নাগরিকেরা আগে কখনও এরকম বিপন্ন মনে করে নি নিজেদের। সর্বত্র দাবী ওঠে জঙ্গিদের ধ্বংস করে দিতে হবে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন তালিবানদের কাছে দাবী করে লাদেন ও তাদের সংগঠনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা ওমর সে দাবী অগ্রাহ্য করেন। প্রায় নজিরবিহীন ঐক্যমত্যে মার্কিন আইনসভার উভয় কক্ষই বুশকে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আফগানিস্তানে অভিযানের অনুমতি দেয়। সারা পৃথিবীর জনমতই বলতে গেলে আমেরিকার অভিযানের পক্ষে ছিল। ২৬ এ সেপ্টেম্বর আমেরিকা আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আমেরিকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তালিবানদের দৃশ্যমান ঘাঁটিগুলো সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তালিবান আর আল-কায়েদাবাহিনী পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে টিঁকে থাকে। তালিবান বিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়েন্স কাবুলসহ দেশের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নেয়, তবে প্রত্যন্ত গ্রামে তালিবানরা ঘাঁটি গেড়ে থাকে। ২০০১ এর ডিসেম্বরে তোরা বোরা পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে মার্কিন বাহিনী লাদেনকে প্রায় ধরে ফেলেছিল, কিন্তু লাদেন তাদের হাত ফস্কে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়েন। পাকিস্তান কিছুই না জানার ভান করে, যদিও পরে এটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আই এস আই এর ব্যবস্থাপনায়ই লাদেন আর মোল্লা ওমর পাকিস্তানে ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তানের সন্দেহজনক ভূমিকা দেখেও আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে সেরকম কিছু ব্যবস্থা নেয় না, তাদের সাহায্য পাঠানোও বন্ধ করে না। বরঞ্চ মার্কিন বিদেশসচিব ডনাল্ড রামসফেল্ড বলেন যে আফগানিস্তানে বড় কোনও সংঘাতের আর সম্ভাবনা নেই, তালিবান প্রায় শেষ হয়ে গেছে, মার্কিন সৈন্য শুধু আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখবে। বলা বাহুল্য, বাস্তবে তা ঘটেনি। খুব সম্ভবতঃ রামসফেন্ড নিজেও একথা বিশ্বাস করতেন না। আসলে বুশ-চিনি-রামসফেল্ডরা তখন তাদের পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন ইরাকে, তাই আফগানিস্তানে কাজ প্রায় শেষ, এরকম একটা বার্তা দেশে দেওয়া দরকার ছিল ইরাক যুদ্ধে সমর্থন আদায় করার জন্য। রাষ্ট্রপতি বুশও বলেছিলেন আফগানিস্তানে জঙ্গিদের হঠানোর পর আমেরিকা সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে আর দেশ গড়ার কাজে হাত লাগাবে।

তালিবান পরবর্তী আফগানিস্তানে প্রথমে হামিদ কার্জাইয়ের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানে প্রথম দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়। কার্জাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ও ২০০৯ সালে পুনর্নির্বাচিত হন। তবে কার্জাই সংস্কারের ব্যাপারে খুব সাবধানে চলতে থাকেন। তিনি তালিবানদের ভাই এবং দেশপ্রেমিক বলে সম্বোধন করেন, আফগানিস্তানের গঠনে তাদের ভূমিকা নিতে অনুরোধ করেন, জঙ্গিদের সাথে শান্তি-আলোচনা করেন, পাকিস্তান-আফগানিস্তান যমজ ভাই বলেন, মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, ক্রিমিয়ার উপর রাশিয়ার দাবী সমর্থন করেন। মার্কিন বাহিনীর হাতে আফগান নাগরিক হতাহত হবার জন্য তিনি অনেকবার উষ্মা  জানান। এসবের ফলে আমেরিকার ভ্রূকুঞ্চন হয়, তবে মোটের উপর আমেরিকার সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালোই ছিল। তবে কার্জাই সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল মানুষের। মার্কিন সাহায্যের ছিঁটেফোঁটাও সাধারণ আফগানদের কাছে পৌঁছচ্ছিল না, রাজনীতিক ও পদস্থ সরকারি কর্মচারিরা আত্মসাৎ করে ফেলছিল। আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সক্ষম মানুষদের প্রতি চারজনের একজনই কর্মহীন, দেশটা মূলতঃ আন্তর্জাতিক সাহায্যে চলে। আফগানিস্তানের মাটির নিচে মূল্যবান খনিজের বিরাট ভান্ডার (অনুমান করা হয় এক থেকে তিন লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের লিথিয়াম, তামা, সোনা, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি) আছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের অভাব আর জঙ্গি উপদ্রবের জন্য সেগুলো তোলার তেমন ব্যবস্থা হয় নি আর ফলে কর্মসংস্থান বা সরকারি আয়ও হয় নি। ফলে এখনও আফগানিস্তান পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। বহু মানুষ বেআইনি আফিংএর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। টহলদার বাহিনী মাঝে মাঝে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। ড্রাগের চোরাচালান বন্ধ করতে আমেরিকার প্রস্তাব ছিল বিমান থেকে ওষুধ ছড়িয়ে ব্যাপকহারে আফিংএর ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়া, কিন্তু কার্জাই সম্মতি দেন নি। ২০১০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতায় খানিকটা উন্নতি হবার পর তা আবার কমতে থাকে। তবে সামাজিক ক্ষেত্রে তালিবানের সময়ের তুলনায় বেশ কিছু উন্নতি হয়। শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেক হয়ে যায়, মেয়েদের স্বাক্ষরতার হার বেড়ে ৩৭% হয়। জন্মহার সাড়ে সাত থেকে কমে চার হয়, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের গর্ভধারণের প্রবণতা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। তবে বুশের রাষ্ট্রপতিত্বে লাদেন সহ অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীদের ধরা সম্ভব হয় না, তালিবানদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ ও গ্রামাঞ্চলে নতুন ঘাঁটি বাড়তে থাকে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয় না, সামগ্রিকভাবে দেশগঠনের প্রতিশ্রুতি শুধু কথার কথাই রয়ে যায়।

২০১১ সালে বারাক ওবামা আমেরিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার পর আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসের ঘাঁটি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সাময়িকভাবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি বাড়িয়ে তিরিশ হাজার থেকে এক লক্ষের উপর নিয়ে যান। তাঁর বক্তব্য ছিল এরপর আফগান সরকারি সেনাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলার উপযুক্ত করে দিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেবে। ওবামার সময়ে আফগানিস্তানে আমেরিকার বিনিয়োগের প্রায় সবটাই মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা এবং আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে ব্যয় হয়। ফলে দেশের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে। আমেরিকা যে আর আফগানিস্তানের দেশ গঠনে তেমন উৎসাহী নয়, তা পুরো পরিষ্কার হয়ে যায়। ওবামার সময় সব থেকে বড় সাফল্য পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ সামরিক ঘাঁটিতে লুকিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন কম্যান্ডো বাহিনীর হত্যা করে আসা। মোল্লা ওমরকেও খতম করা সম্ভব হয়। এর ফলে ২০১২ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি র্নিবাচনের সময় ওবামা বেশ কিছুটা সুবিধা পান। বিতর্কের সময় তিনি একথা জোর দিয়ে বলেন যে শিগগিরিই আফগান বাহিনীকে স্বনির্ভর করে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করতে পারবে। ওবামা সেনার সংখ্যা অনেক কমিয়ে দশ হাজারের নিচে নিয়ে আসেন। তবে ইতিমধ্যে ইরাক থেকে আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নেবার পর সেখানে আইসিস জঙ্গি গোষ্ঠীর রমরমা দেখে তিনি আফগানিস্তান থেকে আর বাকি সৈন্য সরাতে সাহস করেন নি। একরকম স্থিতাবস্থা বজায় রেখে আমেরিকার নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি যথাসাধ্য কমিয়ে ওবামা তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের বাকি সময়টা কাটিয়ে দেন।

২০১৬ সালের আমেরিকার নির্বাচনে প্রথাবিরুদ্ধ রাজনীতিক ডনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ঘটে। তাঁর ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির কথা হল মূলতঃ বাকি পৃথিবীর সমস্যাকে কোনও আমল না দেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্প দাবি করেন তিনি রাষ্ট্রপতি হলে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে আনবেন, কারণ এতে অনর্থক ব্যয় হচ্ছে করদাতাদের টাকার। আফগানিস্তানের কি অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতির পনের বছর গড়িয়ে গেছে। সাধারণ আমেরিকানদের আফগানিস্তান নিয়ে আর কোনও উৎসাহ না থাকাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে লাদেন নিহত হবার পর।  প্রতিটি সেনার মৃত্যু সেই অনীহা আরও বাড়ায়। জনমত তাই সেনা প্রত্যাহারের পক্ষেই ছিল। খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রাম্প নির্বাচিতও হয়ে যান। কিন্তু প্রত্যাহার নয়, ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথমে সেনা মোতায়েন আসলে বেড়ে দশ হাজারের উপর হয়ে যায়। তবে তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ট্রাম্প তালিবানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় এসে সেনার সংখ্যা কমিয়ে আড়াই হাজারের মতো করেন। ২০২১ সালের মে মাসের শেষে বাকি বাহিনীকেও ফিরিয়ে আনা হবে এই মর্মেও কথা হয়। অবশ্য তালিবান সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় খাতায় চিহ্ণিত বলে কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় না।

২০১৪ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আশরাফ গনি। পশ্চিমে শিক্ষিত ও বিশ্বব্যাঙ্কে কাজ করা উদারপন্থী গনি প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তানে শিকড়হীন। বহুদিন তিনি আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। তবু প্রথম পর্যায়ের ভোটে  পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটে তিনি গরিষ্ঠতা পান। তাঁর নির্বাচনও বিতর্কিত এবং আমেরিকার মধ্যস্ততায় জেতা, ফলে গনির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সাধারণ আফগানদের প্রশ্ন আছে। আমেরিকার ক্রীড়নক হিসেবেই অনেকের কাছে তিনি পরিচিত। ২০১৯ সালে আর এক বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। গনির আমলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি স্লথগতিতে চলে, দুর্নীতি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, সাধারণ আফগানদের দুর্দশা কমে না। গনি, তাঁর পরিবার এবং সাঙ্গপাঙ্গরা প্রচুর সম্পত্তি করেছেন, এরকম অভিযোগ সর্বত্র শোনা যায়। তালিবানদের প্রতি গনি নরম মনোভাব নিয়ে চলেন। তালিবানদের শক্তি বৃদ্ধি পায়, বিশেষকরে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে তালিবানরা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। সম্ভাব্য মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানি সরকারি বাহিনীকে স্বনির্ভর করার জন্য গনির কোনও তৎপরতা চোখে পড়ে নি।

২০২০ সালের নির্বাচনে দুই প্রধান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন দুজনেই ২০২১ সালের মধ্যেই পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দেন। কুড়িবছরব্যাপী আফগান যুদ্ধের খরচ ইতিমধ্যে মোট দু লক্ষ কোটি ডলারে ঠেকেছে। আমেরিকা সৈন্য হারিয়েছে আড়াই হাজারের মতো, আর হাজার চারেকের কাছাকাছি ঠিকাদার কোম্পানিদের হয়ে কাজ করতে যাওয়া আমেরিকান নাগরিক। নেটোভুক্ত সহযোগী দেশের সেনা হাজারের উপর, শ পাঁচেক ত্রাণকর্মী আর বাহাত্তরজন সাংবাদিক। সেনা, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ মিলে এক লক্ষের উপর আফগান মানুষ মারা গেছে। আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান যুদ্ধের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হলেও উপেক্ষা করার মতো নয় কিছুতেই। তবে এই যুদ্ধ আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের তেমন ব্যতিব্যস্ত করেনি, কারণ এর ফলে তাদের বেশি কর দিতে হয় নি, যেমন কোরীয় আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যাপকহারে বাড়ানো হয়েছিল উচ্চ আয়ের লোকেদের জন্য। বুশ বরঞ্চ করছাড় দিয়েছিলেন, বিশেষকরে ধনীদের জন্য। এর কারণ যুদ্ধের খরচ যুগিয়েছে ঋণ। তবে ঋণ এক সময় শোধ করতে হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে এইজন্য আমেরিকাকে সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। যুদ্ধ ফেরত সেনাদের পুনর্বাসনে আরও দুলক্ষ কোটি ডলারের বোঝা চাপবে। অবশ্য শিগগিরি টাকা দিতে হচ্ছে না, তাই সাধারণ মানুষের এই আর্থিক বোঝা নিয়ে ভাবিত হবার কারণ ঘটেনি। তবে ইতিমধ্যে কোভিড সংক্রমণ ও অর্থনীতির উপর কোভিডের প্রভাব প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন জেতেন। তবে আগের দুই রাষ্ট্রপতির সময় যা হয় নি, এবারে সত্যি সত্যিই আমেরিকা সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়। মের মধ্যে না হলেও অগস্টের ৩১ তারিখের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হবে বলে বাইডেন জানান। তিনি এও বলেন “যে চিন্তার কারণ কিছু নেই, আফগান বাহিনীকে অনেক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসাহায্য দেওয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে যথেষ্ট সমর্থ। আমেরিকার পক্ষে চিরকাল অন্য দেশে সেনা রেখে দেওয়া সম্ভব নয়।'' তাঁর মতে "আফগানিস্তানের থেকে আরও অনেক বড়ো নিরাপত্তার সমস্যাগুলোকে আমেরিকার গুরুত্ব দিতে হবে। আফগানিস্তানকে গড়ে তোলাও আর আমেরিকার কাজ নয়। ছেড়ে চলে আসার কোনও আদর্শ সময়ও কখনই পাওয়া যাবে না। দ্রুতগতিতে সেনা প্রত্যাহারই এই পরিস্থিতিতে সেরা সমাধান।" জুলাই মাসের শুরু থেকে উল্লেখযোগ্যরকম সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়।

কিন্তু এর পরে যা হয় তা একরকম দুঃস্বপ্ন। তালিবানেরা বিদ্যুৎগতিতে বিনা বাধায় একের পর এক এলাকা দখল করতে থাকে, আফগান প্রশাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ উপন্যাসে বর্ণনা পাওয়া যায় সেই সময়ের আফগান রাজা আমানুল্লাহ খানের প্রশাসন দুর্বৃত্ত বাচায়ে সকাওয়ের বাহিনীর আক্রমণের সামনে কিভাবে পালিয়ে বেঁচেছিল। তবে আমানুল্লাহ পরে রাজ্য উদ্ধার করেছিলেন, এক্ষেত্রে সেরকম সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ৬ থেকে ১৬ অগস্টের মধ্যে তালিবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১০০% করে ফেলে, রাজধানী কাবুলেরও পতন হয়। তবে এর ঠিক আগেই রাষ্ট্রপতি গনি প্রচুর টাকাপয়সা বোঝাই করে হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন বাকি দেশবাসীকে ফেলে রেখে। গনি অবশ্য টাকাপয়সা সঙ্গে নেবার কথা অস্বীকার করেছেন আর বলেছেন নাজিবুল্লার মতো পরিণতি এড়াতেই তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লাহ সালেহ এদিকে বলেছেন, গনি চলে যাবার পর তিনি দায়িত্বভার নিয়েছেন, লড়াই জারি থাকবে। তবে সেই কথায় ভরসা করছে, এমন লোক পাওয়া দুর্লভ। মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান যারা বিমানে জায়গা পেয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে, তাদের বাদ দিয়ে বাকি মানুষ চুড়ান্ত আশংকায় দিন কাটাচ্ছে। প্রতিবেশী এবং ইউরোপের দেশগুলো আবার একটা বড়ো শরণার্থী সমস্যার আশংকা করছে।

কথা হচ্ছে, আমেরিকা কি সেনা প্রত্যাহার আরও সুশৃংখলভাবে করতে পারত আর সাধারণ মানুষকে দেশ ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে পারত? বিশেষকরে দূতাবাসকর্মী, দোভাষী সহ যারা আমেরিকানদের এতদিন সহায়তা দিল, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কি আমেরিকার কর্তব্য ছিল না? যখন সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনে কাবুল বিমানবন্দরে চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা চোখের সামনে দেখতে পারছে, তাতে বিদেশে আমেরিকার ভাবমূর্তির কেমন ক্ষতি হল? এত তাড়াতাড়ি তালিবানরা সব এলাকা দখল করে ফেলল কিভাবে? মার্কিন গোয়েন্দাদের হিসেব এত ভুল হল কি করে? আফগান বাহিনীকে এতদিন দেওয়া প্রশিক্ষণ এরকম নিরর্থক হয়ে গেল কেন? আসন্ন আফগান শরণার্থীর ঢেউএর অনেকটা কি আমেরিকার নিজের দেশে নেওয়া উচিৎ নয়? আফগান বাহিনীকে আমেরিকার যোগানো অস্ত্রভান্ডারের কতটা তালিবানদের হাতে পড়ল? পুরোপুরি সেনা না ফিরিয়ে এনে কিছু অল্পসংখ্যক সেনা কি রেখেই দেওয়া যেত না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ব্যাপারে ঐক্যমত্য হওয়া অসম্ভব। তবে মনে হয় এইধরণের পশ্চাদপশরণের সময় সুশৃংখলা আশা করাটা অলীক ব্যাপার, যখন খুব অল্প সময় হাতে আর এত মানুষকে সরাতে হবে। সাহায্যকারী আফগানদের তালিবানদের নাগালের মধ্যে ফেলে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক, বিশেষকরে তাদের জীবনের ঝুঁকি আছে যেহেতু। তবে এরকম পরিস্থিতিতে সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেয়। এখনও বহু আমেরিকান নাগরিক আফগানিস্তানে আটকা পড়ে রয়েছে। বাইডেন অবশ্য আরও দশদিন প্রত্যাহারের সময়সীমা বাড়িয়েছেন, যাতে আরও অনেক লোককে সরিয়ে ফেলা যায়। সাহায্যকারী আফগানদেরও নিরাপদে সরিয়ে আনা হবে বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। সরকারি আফগান বাহিনী ছিল তিন লক্ষের মতো, আর আমেরিকার হিসেব ছিল তালিবানরা ষাট হাজারের মতো হবে। তবে দুর্নীতির আফগানিস্তানে সরকারি হিসেব শুধু খাতায়-কলমে, অনেক সৈন্যই অস্তিত্বহীন, বা বসে বসে বেতন ভোগ করে। অন্যদিকে কর্মহীন যুবকদের মধ্যে টাকা ছড়িয়ে দলে টানা তালিবানদের তেমন অসুবিধার নয়, যে টাকা তারা তোলা আদায় বা বেআইনি মাদক ব্যবসা করে জোগাড় করেছে, বা কট্টর মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেয়েছে। আমেরিকার সৈন্য সরে যাবার পরে যে শূণ্যতা তৈরি হবে তা আন্দাজ করে তালিবানরা আগে থেকেই প্রস্তুতি চালিয়েছিল স্থানীয় শাসকদের দলে টেনে। গনির শিকড়হীন শাসন তাদের সাফল্য পেতে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে রক্ষণশীল এলাকায়। আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গেছে ৭৩% মানুষ সাহায্যকারী আফগানদের উদ্ধার করা উচিৎ মনে করেন, আর ৬৫% মানুষ আফগান শরণার্থীদের আমেরিকায় আশ্রয় দেবায় সম্মতি জানিয়েছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকরাও দাবী তুলেছেন শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার। অস্ত্র বেহাত হওয়াটা অবশ্যই চিন্তার, আর এ ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য জানানো হবে না তা নিশ্চিত। তবে অত্যাধুনিক অস্ত্রতে সাধারণতঃ অনেক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, হাতে পেলেই তা ব্যবহার করা যায় না। আর সেনা ফেরানোর ব্যাপারে বাইডেন যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তিনি মেনে চলেছেন। তাঁর পূর্বসূরীদের মতো তিনি টালবাহানা করে কাটাতে পারতেন, তাতে এতটা বিতর্কের মধ্যে তাঁকে পড়তে হত না। কারণ যে রাষ্ট্রপতি শেষে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন, তার উপর যাবতীয় দুর্ভোগের বড় দায়টা এসে পড়ে, যেমন ভিয়েতনামের যুদ্ধের শেষে জেরাল্ড ফোর্ডের হয়েছিল। তা জেনেও বাইডেনের এই দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। তবে কথা হচ্ছে এত মানুষের ভাগ্য যেখানে বিপন্ন, সেখানে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে চলাটা কি বেশি কাম্য? অল্প সৈন্য রেখে দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা কি ভাল হত না, কোরিয়া-জাপানে যেমন সত্তর বছর ধরে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে যখন সৈন্যদের প্রাণহানি ঘটে নি? মনে হয় অল্প সৈন্যের ঘাঁটি রাখলে তাদের জীবন বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। মনে রাখতে হবে কোরিয়ার মতো স্থিতাবস্থা নয়, আফগানিস্তানে পুরোপুরি যুদ্ধ চলছে। আর অল্প সৈন্য দিয়ে দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব হত না, শুধু সামরিক ঘাঁটিগুলোরই হয়তো নিরাপত্তা দেওয়া যেত। তালিবানরা ওদিকে সেনা সরে যাবে এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমেরিকান সৈন্য ছেড়ে আফগান বাহিনীর উপর বেশি আক্রমণ চালিয়েছে। আমেরিকার সৈন্য থেকে গেলে তালিবানরা আবার আক্রমণ শানাতো, সেনা মারা যেত, তা প্রায় নিশ্চিত। যখন আফগান সমস্যার কোনও প্রকৃত সমাধান দেখা যাচ্ছে না, যখনই সেনা সরুক একই পরিস্থিতি হবার কথা, বাইডেন ব্যাপারটার এখানেই ইতি ঘটাতে চেয়েছেন। ট্রাম্প অবশ্য দাবী করেছেন, তাঁর পরিকল্পনা আরও অনেক সুষ্ঠু ছিল, বাইডেন ব্যাপারটা ঠিক সামলাতে পারেন নি। রিপাবলিকানরাও বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা অবশ্য সেরকম বলবেন প্রত্যাশিত, কারণ তাতে তাদের রাজনৈতিক লাভ বই ক্ষতি নেই। তবে ট্রাম্পের দাবী বিশ্বাসযোগ্য নয় মোটেই। বাইডেন মোটামুটিভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের করে যাওয়া ব্যবস্থাই অনুসরণ করছেন, বরং আর একটু সময়সীমা বাড়িয়েছেন। বিদেশনীতির ব্যাপারে ট্রাম্প কখনই তেমন সড়গড় নন, এমনকি বিশেষজ্ঞদের ব্রিফিং শুনতেও আগ্রহী ছিলেন না রাষ্ট্রপতি থাকার সময়। কোভিড ও জাতিগত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করায় ট্রাম্পের প্রশাসনের অপদার্থতার পরিচয় ও মানুষ পেয়েছে। ট্রাম্প চার বছর সময় পেয়েও সেনা প্রত্যাহারে তাঁর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন নি, কাজেই ট্রাম্পের আরও ভালভাবে সেনা প্রত্যাহারের দাবীকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়েই দিতে হয়।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা যে পরিকল্পনা মতো হয় নি তাতে সন্দেহ নেই। এতে  বাইডেনের রাজনৈতিক সমর্থনেও কিছুটা ভাঁটা লক্ষ্য করা গেছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর অনুমোদন এই প্রথম ৫০% এর নিচে নেমে এসেছে। ৫১% তাঁর আফগানিস্তান পরিচালনা অনুমোদন করছেন না যেখানে মাত্র ৩১% অনুমোদন করছেন। তবে এই মুহুর্তে সেটা নিয়ে বাইডেনের ভাবিত হবার তেমন প্রয়োজন নেই, কারণ এক্ষুনি কোনও নির্বাচন হচ্ছে না। ২০২২ মধ্যবর্তী নির্বাচনে আইনসভার নিম্নকক্ষের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটরা হয়তো এমনিতেই হারাবে। ২০২৪ সালে তাঁর পুনর্নির্বাচনের সময় বিদেশের মাটিতে হওয়া একটা সংকটকে ভোটাররা একটা বড় বিষয় করবে, আমেরিকার রাজনীতিতে তেমনটা বিশেষ হয় না। বরং ততদিনে স্মৃতি ফিকে হয়ে গেলে, আর সন্ত্রাসবাদের সমস্যা যদি আমেরিকার মাটিতে তেমন মাথাচাড়া দিয়ে না বসে, তাহলে বাইডেন যুদ্ধ শেষ করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের কৃতিত্ব দাবী করতে পারবেন।

যেহেতু তালিবানরাই কাবুলে ক্ষমতায় থাকছে অদূর ভবিষ্যতে, এই মুহুর্তে শুধু এটুকুই আশা করা যেতে পারে যে শাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ও  দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে তারা কিছুটা পরিণত শাসকের ভূমিকা নেবে, দেশের অর্থনীতিকে গড়ে তোলার স্বার্থে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলবে, আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মোটামুটি মেনে চলবে, সেরকম কঠোর শরিয়তি অনুশাসনী চালাবে না। শুধু বন্দুকের উপর ভিত্তি করে শাসন যে টানা চালানো যাবে না, সেটা হয়তো তারা বুঝবে। চীন বা রাশিয়া হয়তো তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, কারণ আফগানিস্তানে তাদের ব্যবসায়ী লক্ষ্য রয়েছে। তালিবানরা আগের তুলনায় কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে। শরিয়ত মেনে মেয়েদের স্কুলে শিক্ষা তারা অনুমোদন করবে, বোরখা না পরে শুধু হিজাব পরলেই চলবে। তবে বলা বাহুল্য, তালিবানদের উপর খুব ভরসা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আইসিসের মতো আরও চরম সংগঠনের বৃদ্ধি হবার আশংকাও রয়েছে।

তাহলে আমেরিকার আফগানিস্তান অভিযানের শেষে কুড়ি বছর পরে একরকম শূণ্যই পাওয়া গেল। এক সময় কমিউনিস্টদের হঠানোর জন্য যে মুজাহিদীনদের সাহায্য করা তারা শুরু করে, তার ফলে আজ ইসলামী জঙ্গিবাদ এত শক্তিশালী আফগানিস্তানের মাটিতে। সেই সিদ্ধান্তের কুফল এখন আমেরিকার নিজেরই বড় সমস্যা। ফলে বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়ে যে ভুল করেছিল, আমেরিকার এই ভুলও সেই মাপেরই। 


==========

লেখার তারিখঃ অগস্ট ২৭, ২০২১

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

লেখাটি "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।


মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া

 

আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া

-শুভাশিস ঘোষাল



একথা সবারই জানা যে আমেরিকায় কিছুদিন আগে নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাস্ত হয়েছেন। এই নির্বাচনের ফলাফল কি যে রকম ভাবা হয়েছিল, সেরকম হয়েছে? আগেরবারের নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনের ফল কেমন হয়েছে? কারা কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন, কি কারণে? এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য কি? করোনা ভাইরাসের প্রভাব নির্বাচনে কতটা পড়ল? নির্বাচনের ফলের প্রতিক্রিয়া কি? বর্তমান নিবন্ধে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।

প্রথমে সবাই যেটা জানতে আগ্রহী হন, তা হল, নির্বাচনের পূর্বাভাস মিলেছে কি না। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে প্রথমে ঠিক করতে হবে পূর্বাভাস মেলা বলতে কি বোঝানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য, দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন জয়ী হবেন (আরও কিছু ছোট দলের বা নির্দল প্রার্থী থাকলেও তাদের জেতার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না), তাই এই দুজনের কে জয়ী হবেন সেই পূর্বাভাস মেলাটা খুব একটা অসাধারণ ব্যাপার নয়। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুই প্রধান প্রার্থীর কে জয়ী হবেন, তা পূর্বাভাসের সঙ্গে প্রায় সব সময়ই মিলে যায়, শুধু ২০১৬ সালের নির্বাচনে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন, তাও প্রায় ২৯ লক্ষ ভোট কম পেয়ে। সেটা ঘটেছিল কারণ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ঠিক সরাসরি সাধারণ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন না, হন রাজ্যগুলির ভোটের ভিত্তিতে, যাকে বলে ইলেক্টোরাল কলেজ। প্রতিটা রাজ্যের থেকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার ভোট আছে (সেই রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট সংখ্যা), যা তারা রাজ্যের বিজয়ী প্রার্থীকে সবটা দিয়ে দেয়। এই পদ্ধতি এবং বর্তমান নির্বাচনের দল এবং প্রার্থীদের সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এই পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটি নিবন্ধে করা হয়েছিল। এবারে পূর্বাভাসে জো বাইডেন এগিয়ে ছিলেন, ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবেন বলা হয়েছিল, ফলাফলেও তাই হয়েছে। এমন কি যেসব রাজ্য বাইডেন জিতবেন ভাবা হয়েছিল, তার মধ্যে ফ্লোরিডা ও নর্থ ক্যারোলাইনা ছাড়া বাকি সব রাজ্য তিনি জিতেছেন। সেই হিসেবে ফলাফল অবশ্যই মিলে গেছে, কিন্তু আরও খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অনেক কিছুই মেলে নি। এমন কি, এবারের পূর্বাভাসে এক হিসেবে ২০১৬ সালের থেকেও অনেক বেশি ভুল হয়েছে।

এ কথা বলা বাহুল্য যে এবার অতিমারির জন্য একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভোট হয়েছে। তাতে যা হতে পারত, ভোট পড়ার হার কমে যাওয়া। কিন্তু এবার প্রায় সবাইকেই ডাকযোগে ভোট দেবার সুবিধা দেওয়ায় ভোট দেওয়া ব্যাপকহারে বেড়েছে। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি, তার মধ্যে ভোট দেওয়ার অধিকারী (অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান নাগরিক) প্রায় ২৪ কোটি। তবে ভোট দেবার জন্য সবাই নাম নথিকরণ করান না, বা করালেও ভোট দিতে আসেন না। আগের বছরগুলিতে সাধারণতঃ ৫২-৫৭%  ভোট পড়ত, এবারে তা বেড়ে ৬৭ শতাংশের মতো হয়েছে। তার ফলে দুই প্রধান প্রার্থীরই ভোট ব্যাপকহারে বেড়েছে, বিশেষ করে তৃতীয় কোনও দলের শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায়। বিজয়ী প্রার্থী জো বাইডেন ৮.১ কোটিরও বেশি ভোট পেয়ে সর্বকালীন রেকর্ড করেছেন, যেখানে আগের কোনও ভোটে কোনও প্রার্থী ৭ কোটিই অতিক্রম করতে পারেন নি। এমনকি পরাজিত প্রার্থী ট্রাম্পও প্রায় ৭.৪ কোটি ভোট পেয়েছেন, আগের যে কোনও প্রার্থীর থেকে বেশি। ট্রাম্প ২০১৬ সালে নিজের ভোটের থেকে এক কোটিরও বেশি ভোট বাড়িয়েছেন। এমনকি শতাংশের হিসেবেও ট্রাম্প নিজের ভোট প্রায় ১% বাড়িয়েছেন, ৪৬.১% থেকে ৪৬.৯%। প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা অনুযায়ী সেটা খুবই অপ্রত্যাশিত। যদিও বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষার ভিত্তিতে পাওয়া হিসেবের মধ্যে কিছুটা তফাৎ ছিল, তবে প্রায় সবাই ট্রাম্পের পাওয়া ভোটকে কম আন্দাজ করেছে, ভাবা হচ্ছিল  ৪১-৪৪% হতে পারে (সমীক্ষার গড়ের ভিত্তিতে, সমীক্ষক সংস্থার গুণগত মান হিসেবে রেখে)। বাইডেনের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা ভাগ অবশ্য সংস্থাগুলো প্রায় ঠিকই আন্দাজ করেছিল, ৫১-৫২% ভাবা হচ্ছিল, বাইডেন ৫১.৩% পেয়েছেন। তবে সারা দেশের ভোটের শতাংশ দিয়ে ফলাফল নির্ধারণ হয় না, হয় রাজ্যে রাজ্যে পাওয়া ভোটের হিসেবে। সেখানে প্রায় কোনও রাজ্যেই দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান সমীক্ষার সঙ্গে মেলে নি। একমাত্র কলোরাডো ছাড়া বাকি সব রাজ্যেই শতকরা হিসেবে পূর্বাভাসের তুলনায় ট্রাম্প হারা রাজ্যে ব্যবধান কমিয়েছেন নয়তো জেতা রাজ্যে ব্যবধান বাড়িয়েছেন। মিশিগান-উইসকন্সিন-পেনসিলভ্যানিয়ায় যেখানে বাইডেনের খুবই ভালো ব্যবধানে জেতার কথা ছিল, সেখানে বেশ লড়াই করে জিততে হয়েছে, অ্যারিজোনা-নেভাদা জিতলেও ব্যবধান প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম হয়েছে। ফ্লোরিডায় যেখানে বাইডেন সমীক্ষায় এগিয়ে ছিলেন, সেখানে তিনি সহজেই হেরেছেন। টেক্সাস, ওহায়ো, আইওয়া তে বাইডেন যেরকম লড়াই দিতে পারবেন মনে হয়েছিল, তা হয় নি। সব মিলে শুধু ১৬টি ব্যাটল্গ্রাউন্ড স্টেটের (অর্থাৎ যেসব রাজ্যগুলিতে দুই প্রার্থীরই জেতার ভদ্রস্থ সম্ভাবনা আছে) মধ্যেই নটি রাজ্যে ট্রাম্পের পাওয়া ভোটকে যে রকম কম অনুমান করা হয়েছিল, তা সমীক্ষার ভ্রান্তির ব্যাপ্তির বাইরে, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভুল। বাইডেনের বা  ট্রাম্পের নিশ্চিত রাজ্যগুলিকে ধরলে ভুল হিসেবের সংখ্যা আরো বেশি। সেই তুলনায় ২০১৬ সালে মাত্র একটা রাজ্যেই ফল পূর্বাভাসের ব্যাপ্তির বাইরে হয়েছিল। তবে আন্দাজে অনেক বেশি ভুল হলেও এবারে বিজয়ী আন্দাজ করতে ভুল হয় নি, কারণ বাইডেনের এগিয়ে থাকার ব্যবধান হিলারির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। আর কেউ ৫০ শতাংশের উপরে ভোট পেলে তাকে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে হারানো অনেক বেশি শক্ত হয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ্য যে ইলেক্টোরাল কলেজের পদ্ধতি থাকায় রিপাবলিকান প্রার্থীর কিছুটা সুবিধা রয়েছে। অল্প জনসংখ্যার রাজ্যগুলি, যাদের জনসংখ্যার তুলনায় ইলেক্টরাল কলেজে প্রতিনিধিত্ব বেশি, সেইসব রাজ্যে রিপাবলিকানরা বেশি শক্তিশালী কারণ এইসব গ্রামীণ রাজ্যগুলি অনেক বেশি রক্ষণশীল। দুই দলের প্রার্থী সারা দেশে মোটামুটি সমান সংখ্যক ভোট পেলে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয় প্রায় অবধারিত, এমনকি দুই শতাংশের মতো ভোট কম পেলেও তাঁর জয়ের ভালই সম্ভাবনা। ব্যবধান তিন শতাংশের উপর নিয়ে যেতে পারলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী তাঁর জয়কে মোটামুটি সুরক্ষিত করতে পারেন, চার বা তার উপরে নিয়ে যেতে পারলে তা অবধারিত হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন হচ্ছে ট্রাম্পের ভোট সমীক্ষা সংস্থাগুলি ঠিক করে আন্দাজ করতে পারছে না কেন? এখানে উল্লেখ্য, গুটিকয়েক সংস্থা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমীক্ষা করতে পারে, তবে বেশিরভাগই নামী পেশাদারী সংস্থা, বছরের পর বছর তারা সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিতে পেরেছে, ২০১৬ সালে ট্রাম্প ভোটারদের হিসেব করতে ভুল হবার পর হিসেবে সংশোধনী পর্যন্ত ঢুকিয়েছে, তা সত্ত্বেও এই ধরণের ব্যাপক তফাৎ খুবই অপ্রত্যাশিত। এবং এইরকম হিসেব না মেলাটা ট্রাম্প থাকলেই হচ্ছে শুধু। ২০১৮ সালের অন্তর্বর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জয় পূর্বাভাস ছাপিয়ে গিয়েছিল। তবে কি ট্রাম্পের অনেক নীরব সমর্থক আছে, যারা সেকথা প্রকাশ করতে লজ্জা পেয়ে ভুল তথ্য দেয়? অনেকের তাই মত, তবে যেহেতু সমীক্ষা গোপনে হয়, কোনও ভোটারের এরকম কিছু করার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ নেই। অবশ্য মানুষ অনেককিছুই অযৌক্তিক কাজ করে, তাই সেই হিসেবে এটা অসম্ভব নয়, তবে যে পরিমাণে তফাৎ হয়েছে সমীক্ষার তুলনায়, তাতে অন্য দুটো কারণের কথা বেশি মনে হয়। এক, সমীক্ষায় যেরকম নমুনা বাছা হচ্ছে, তাতে কোনোভাবে ট্রাম্পের ভোটারদের একটা বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব বাদ পড়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য সমীক্ষায় অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক ব্যাপার, সমীক্ষায় অংশগ্রহণে ট্রাম্প ভোটারদের অনীহা থাকার বেশি সম্ভাবনা হতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, এরা হয়তো সমীক্ষার সময় মনস্থির না করা ভোটার এবং বাইডেন বা ডেমোক্র্যাটদের বিরোধী, ট্রাম্পের কাজেও অখুশি (ট্রাম্পের অনুমোদনের অনুপাত বরাবর ঐতিহাসিকভাবে কম) রিপাবলিকান সমর্থক, যারা শেষমেশ ট্রাম্পকে ভোট দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, হয়তো কম করের হার বা সামাজিক রক্ষণশীল নীতি বজায় রাখার জন্য। এরকম ভাবার কারণ বিশেষ করে এই যে, যারা বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন, তাদের অনুপাত প্রায় সঠিকভাবেই পূর্বাভাস করা গেছে সমীক্ষা থেকে।

প্রত্যাশার থেকে কম হলেও বাইডেনের জয়কে কম ভাবার কোনও কারণ নেই। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিকে হারানো কঠিন কাজ, বিশেষ করে ট্রাম্পের প্রথম তিন বছরে অর্থনীতির উন্নতি ঘটেছিল। অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য সাফল্য বাইডেন পেয়েছেন --- ২০১৬ তে হিলারির পাওয়া ভোট দেড় কোটি বাড়িয়ে মোট আট কোটির উপর রেকর্ড সংখ্যক ভোট পাওয়া, পঞ্চাশ শতাংশের উপর মানুষের সমর্থন, বহু বছর পর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে অ্যারিজোনা ও জর্জিয়া জেতা, এবং হোয়াইট হাউস পুনরুদ্ধার করার জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ডেমোক্র্যাটদের বহুদিনের ঘাঁটি মিড ওয়েস্টের রাস্টবেল্ট রাজ্য (যেখান থেকে উৎপাদন শিল্প সরে গেছে) মিশিগান-উইসকন্সিন-পেনসিল্ভ্যানিয়া জিতে ‘নীল দেওয়াল’ গড়া (ডেমোক্র্যাটিক দলকে নীল রঙ দিয়ে চিহ্ণিত করা হয়)। ফ্লোরিডা আর দু একটি (ফলাফলের জন্য গুরুত্বহীন) ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব রাজ্যেই বাইডেন প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়িয়েছেন। ইলেক্টোরাল কলেজে বাইডেনের জয়ের ব্যবধান ৩০৬-২৩২, যেটা মোটেই সামান্য নয়। কাকতালীয়ভাবে গত নির্বাচনে হিলারির বিপক্ষে ট্রাম্প ঠিক এই ব্যবধানেই জিতেছিলেন, তবে ট্রাম্প যেখানে ২৯ লক্ষ কম ভোট পেয়ে জিতেছিলেন, সেখানে বাইডেন ৭০ লক্ষ বেশি ভোট পেয়ে ঠিক একই জয় পাচ্ছেন। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থীরা প্রাপ্ত ভোটের তুলনায়  ইলেক্টোরাল কলেজে কেমন সুবিধা পান, বিশেষ করে ব্যবধান যখন অল্প হয়।

২০১৬ সালে হিলারির তুলনায় বাইডেন কোথায় উন্নতি করলেন যাতে তিনি জয় ছিনিয়ে আনতে পারলেন? আগেই উল্লেখ করেছি, তেমন কোনও শক্তিশালী তৃতীয় দলের প্রার্থী না থাকায় দুই প্রধান প্রার্থীরই ভোটের অনুপাত মোটের উপর বেড়েছে, তবে জনগোষ্ঠীভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে জয়-পরাজয়ের মূল কারণ বুঝতে সুবিধা হবে। জনগোষ্ঠী অনুযায়ী ভোট দেবার প্রবণতা অবশ্য প্রাপ্ত ভোট থেকে হিসেব করা সম্ভব নয় পুরোপুরি, তাই বুথফেরৎ সমীক্ষার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে এবারে কোভিডের কারণে বহু ভোটার ডাকযোগে ভোট দেওয়ার কারণে বুথফেরৎ সমীক্ষার পদ্ধতিতেও বদল করতে হয়েছে --- টেলিফোনে সেই সব ভোটারদের যোগাযোগ করতে হয়েছে। সেই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে বাইডেন আর ট্রাম্প দুজনেই, পুরুষ আর মহিলা, উভয় ভোটারের মধ্যেই ভোটের হার বাড়িয়েছেন, তবে বাইডেন বেশি করে বাড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে মোটের উপর পুরুষদের রিপাবলিকানদের ভোট দেবার আর মহিলাদের ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবার প্রবণতা বেশি, তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আলাদা করে হিসেব করলে এই হিসেব বদলাবে। বয়স হিসেবে ভাগ করলে ১৮-২৯ বছরের সর্বকনিষ্ঠ শ্রেণীর ভোট বাইডেন অনেক বেশি বাড়িয়েছেন, কিন্তু ৩০-৪৪ বছরের ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প ভোট বাড়িয়েছেন বেশি। ৪৫-৬৪ বছরের ভোটারদের মধ্যে বাইডেন অনেকটা ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প খুইয়েছেন। ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে বাইডেন কিছুটা ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প একই জায়গায় রয়েছেন। সাধারণতঃ তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে রিপাবলিকানদের ভোট বাড়ে। এবারের ভোটে কোভিডের প্রভাব বিভিন্ন বয়সের মধ্যে বিভিন্নরকম দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের প্রশাসন কোভিড নিয়ন্ত্রণ একেবারেই করতে পারে নি। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানরা মাস্ক পরার মতো সাধারণ সুরক্ষাবিধি চাপাতেও অনীহা দেখিয়েছেন, যেন কিছুই নয় এরকম একটা তত্ত্ব দিয়ে স্কুল-কলেজ-ব্যবসা সব স্বাভাবিকভাবে খোলা রাখার জন্য জোরাজুরি করেছেন। বেশি বয়স্কদের মধ্যে কোভিডে মৃত্যুর প্রবণতা বেশি বলে রিপাবলিকানদের জন্য নির্ভরযোগ্য এই ভোটিং ব্লক, অর্থাৎ বয়স্ক ভোটাররা, শঙ্কিত হয়ে ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে মাঝবয়সীরা, যাদের ঝুঁকি কম, রুটি-রুজির কারণে ব্যবসা খোলা রাখার সপক্ষে --- তারা আগের তুলনায় ট্রাম্পকে বেশি হারে ভোট দিয়েছেন, অর্থনীতির অবনতিকে তারা কোভিডের কারণে ক্ষণস্থায়ী বলে মনে করেছেন। এর থেকে মনে হয় কোভিডের প্রভাব কাটাকুটি হয়ে গিয়ে ভোটের ফলাফলকে মোটের উপর তেমন প্রভাবিত করতে পারে নি।  একবারে অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে অবশ্য হিসেবটা একটু অন্যরকম, গতবার এদের অনেকেই হিলারিকে অপছন্দের কারণে ব্যাপকহারে ভোটদানে বিরত ছিলেন, তৃতীয় দলের প্রার্থী বা এমনকি ট্রাম্পকেই ভোট দিয়েছিলেন --- বাইডেন তাদের ভোট বেশ কিছু ফিরে পেয়েছেন।

অন্যভাবে, জাতি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে ডেমোক্র্যাটদের জন্য কিছুটা দুঃসংবাদ আছে। সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গরা এবং তুলনায় কম মাত্রায় লাতিনো (ফ্লোরিডার কিউবানদের বাদ দিয়ে) আর এশিয়ানরা, সাধারণতঃ ডেমোক্র্যাটিক দলের বিশ্বস্ত ভোটার। কিন্তু এবারে দেখা যাচ্ছে এদের মধ্যে বাইডেনের ভোটের হার কমেছে, ট্রাম্পের বেড়েছে, বিশেষ করে এশিয়ানদের মধ্যে এই তফাৎটা বেশ চোখে পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় রেকর্ড হারে কৃষ্ণাঙ্গ ভোট পেয়েছেন (যদিও সেটাও অনপেক্ষভাবে খুব উঁচু নয়)।  এটা বেশ আশ্চর্যের বিষয়, কারণ ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব অনেকভাবেই প্রকাশ পেয়েছে, কয়েকমাস আগে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পুলিশের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিক্ষোভ হয়েছে যাতে ডেমোক্র্যাটরা বিশেষ করে সামিল হয়েছে আর ট্রাম্পের প্রশাসন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মেক্সিকো, মধ্য আর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত শরণার্থীদের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের অমানবিক আচরণও প্রচুর নিন্দিত হয়েছে। এমনকি ইসলামি দেশ থেকে ভিসা দেওয়া আটকানোর ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা বহুচর্চিত হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প অনেক মুসলিম ভোট পেয়েছেন।  সংখ্যালঘুদের এইরকম ভোট দেবার প্রবণতার নানা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সংখ্যালঘুরা সবাই এক ধাঁচের নয়, সবার সমস্যাও একই রকমের নয়। অনেকে নিজেদের সংখ্যালঘু না ভেবে মূলধারার ভাবতে চান। ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যালঘু নীতির অনেকটাই কৃষ্ণাঙ্গকেন্দ্রিক, ‘ট্রাম্প বর্ণবিদ্বেষী’ এই প্রচার মনে হয় বহু সংখ্যালঘুর কাছে তেমনভাবে কাজ করেনি। অনেক ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের শ্লোগান ‘ডিফান্ড দা পোলিস’ ডেমোক্র্যাটিক দলের কথা না হয়েও তাদের সঙ্গে জুড়ে গেছে রিপাবলিকানদের সফল প্রচারে। তবে আসল কারণ খুব সম্ভবতঃ অর্থনৈতিক। এশিয়ানদের উচ্চশিক্ষিত অংশ বাদ দিলে বাকি সংখ্যালঘুরা বেশিরভাগই মূলতঃ ঘন্টা হিসেবে কাজে বেতন পাওয়া অল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, অথবা ছোট ব্যবসা করেন। কোভিডে অর্থনীতি অচল হওয়াতে এরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ট্রাম্পের প্রথম তিন বছরে অর্থনীতি সবল থাকায় এদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছিল। কোভিডে দুর্দশার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার থেকে অর্থনীতি বন্ধ হলে সরাসরি ক্ষতি তাদের কাছে বেশি ভয়ের মনে হয়েছে। ফ্লোরিডার লাতিনো অধ্যুষিত ডেমোক্র্যাটদের ঘাঁটি মায়ামি অঞ্চলে বাইডেন অল্প লিড পেয়েছেন, ওবামা বা হিলারির মতো ভোট পেলেই ফ্লোরিডার বাকি অঞ্চলে ভালো ফলের জোরে বাইডেন ফ্লোরিডা জিততে পারতেন। টেক্সাসে মেক্সিকো সীমান্তবর্তী যেসব লাতিনো অধ্যুষিত অঞ্চল ওবামা বা হিলারি জিতেছিলেন, বাইডেন জিততে পারেন নি। ফলে মোট হিসেবে টেক্সাসে বাইডেন ব্যবধান কমালেও যেরকম কাছাকাছি আসার কথা পূর্বাভাসে ছিল, তা আদৌ হয় নি। অ্যারিজোনা-নেভাদাতেও লাতিনো ভোট কম পাওয়ার ফলে বাইডেনের জয় অনেক কষ্টসাধ্য হয়েছে। নর্থ ক্যারোলাইনাতে কৃষ্ণাঙ্গ ভোট যথেষ্ট পরিমানে না পাওয়ার ফলে, ব্যবধান কমালেও জয় বাইডেনের হাতছাড়া হয়ে যায়। জর্জিয়াতে একই রকম পরিস্থিতি হলেও কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট নেত্রী স্টেসি আব্রামসের নিরলস চেষ্টার ফলে অবশ্য বাইডেনের অল্প ব্যবধানে জয় এসেছে। অর্থাৎ কমলা হ্যারিস রানিং মেট হওয়া সত্ত্বেও বাইডেনের কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান বা এমনকি মহিলা ভোট পেতেও বাড়তি কোনও সুবিধা হয় নি। কিন্তু অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের, যারা ভোটারদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ও রিপাবলিকানদের ভরসার জায়গা, তাদের মধ্যে বাইডেন উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছেন। ফলে তাদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে শেষমেশ বাইডেনই জয়ী হয়েছেন। ট্রাম্পের সবথেকে বিশ্বস্ত ভোটিং ব্লক অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ভোটারদের মধ্যেও বাইডেন  ভোটের হার বাড়িয়েছেন। তবে বাইডেন আর ট্রাম্পের ভোটের যে বিশাল ব্যবধান সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছিল, আর তার ফলে যে  ‘নীল সুনামি’ হবে ভাবা হচ্ছিল, তা হয় নি সংখ্যালঘু ভোট এতটা কমে যাবার জন্য। সংখ্যালঘু ভোট কমে যাওয়াটা যদি স্থায়ী ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় ডেমোক্র্যাটদের জন্য সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে রইল।

আমেরিকা অনেকদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে খুব বিভাজিত দেশ। সমীক্ষাতে এও দেখা যাচ্ছে যে অতিমারি, অর্থনীতির অবনতি বা জাতিগত বিক্ষোভের মতো এতকিছু একসঙ্গে ঘটে যাবার পরও দুই দলের নথিভুক্ত ভোটাররা দৃঢ়ভাবেই নিজেদের দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করেছেন। তবে যারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দলের ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করেন নি, সেইধরণের স্বাধীন ভোটারদের মধ্যে বাইডেন বিরাট সমর্থন বাড়িয়েছেন, আর ট্রাম্প সমর্থন খুইয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাইডেনকে জিততে সাহায্য করেছে। একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে যারা নিজেদের মধ্যপন্থী বলে ভাবেন, তাদের মধ্যে। আয় হিসেবে দেখলে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বাইডেন আর ট্রাম্প দুজনেই কিছুটা ভোট বাড়িয়েছেন, মধ্য আয়ের মধ্যে বাইডেন ভোট বাড়িয়েছেন আর ট্রাম্প খুইয়েছেন, আর উচ্চ আয়ের লোকেদের মধ্যে ট্রাম্পের ভোট উল্লেখযোগ্য বেড়েছে আর বাইডেনের কমেছে। ট্রাম্পের কর কমানোর নীতি আর শেয়ার বাজারের ভালো অবস্থা ট্রাম্পকে উচ্চ আয়ের লোকেদের সমর্থন পেতে সাহায্য করেছে। তবে বাইডেনের জেতার পিছনে বিরাট অবদান রয়েছে আমেরিকার শহরতলী অঞ্চলের আর মাঝারি জনসংখ্যার শহরের ভোটারদের। শ্রেণীগতভাবে এরা বেশিরভাগই মধ্য আয়ের সংসারী মানুষ --- রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের মোটামুটি সমানহারে ভোট দিয়ে থাকেন। আমেরিকায় বড় শহরের ভিতরে সাধারণতঃ অফিস হোটেল এইসব বেশি থাকে, খুব অল্প কিছু দামী এলাকায় কিছু উচ্চ আয়ের মানুষ থাকেন, শহরের কেন্দ্রে অ্যাপার্টমেন্টে কিছু অল্পবয়সী চাকরিজীবি থাকেন, আর বেশ কিছু দরিদ্র অঞ্চলে অল্প আয়ের মানুষেরা থাকেন। মধ্যবিত্ত সংসারী মানুষেরা সাধারণতঃ শহরের ভিতরে না থেকে শহরতলি থেকে যাতায়াত করেন, সেখানে আয়ত্তের দামের মধ্যে খানিকটা জায়গা নিয়ে বাড়ি পাওয়া যায়, স্কুলগুলোও অনেক ভালো হয়, আইন-শৃংখলাও অনেক ভালো হয়। নিচের রেখচিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে বড় শহর, শহরতলী, মাঝারি শহর, ছোট শহর, খুব ছোট শহর আর গ্রামীন এলাকায় ডেমোক্র্যাটদের আর রিপাবলিকানদের ভোটের হারের কিরকম বিবর্তন হয়েছে গত চারটে নির্বাচনে। খুব ছোট শহর আর গ্রামীণ এলাকা ক্রমশঃই রিপাবলিকানদের প্রায় একচেটিয়া হয়ে গেছে, তবে এইসব এলাকার জনসংখ্যা খুব কম। শহরতলীর ভোটারদের  সংখ্যা অনেক বেশি। এবারের ভোটে তাদের কিছুটা বাড়তি সমর্থন, বিশেষকরে শহরতলীর মহিলাদের যারা ট্রাম্পের আচরণে অনেকেই ক্ষুব্ধ, বাইডেনের জয় সহজসাধ্য করেছে।  এই প্রবণতা ২০১৮ সালের আইনসভার নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটদের বিপুল জয় এনে দিয়েছিল। 


তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাথে আইনসভার দুই কক্ষ, হাউস আর সেনেটের নির্বাচন নিয়েও কিছু বলা প্রয়োজন। হাউসে প্রতি দু বছরে সব আসনে নির্বাচন হয়। ডেমোক্র্যাটরা ২০১৮ সালে বিপুল গরিষ্ঠতা পায়, এবারে আশা করা হচ্ছিল তারা একই রকম গরিষ্ঠতা বজায় রাখবে। ফলাফলে দেখা গেল তারা বেশ কিছু আসন হারিয়ে অল্পের জন্য গরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে, রিপাবলিকানরা অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্যভাবে ভোট বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রিপাবলিকান প্রার্থীরা ট্রাম্পের তুলনায় ভাল ফল করেছেন তাদের নির্বাচনী কেন্দ্রে। আসন হারানোর জন্য মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটরা অনেকে প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের দায়ী করে বলেছেন, মধ্যপন্থী ভোটাররা তাদের ভয়ে রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছেন, তাদের কর্মসূচী ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ আর ‘গ্রিন নিউ ডিল’ ধরণের ‘সমাজতান্ত্রিক নীতি’ ভোটারদের অপছন্দ। তবে যে একশ প্রগতিশীল প্রার্থী ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ সমর্থক, তারা সকলেই জিতেছেন। ফলে প্রগতিশীলরা দাবী করেছেন মধ্যপন্থীদের দৃঢ়তার অভাবেই তাঁরা ভোটারদের কাছে পৌঁছতে পারেন নি।  সেনেটের নির্বাচন অবশ্য সব আসনে হয় না একসাথে, আর জনসংখ্যা নির্বিশেষে সব রাজ্যের দুই সেনেটরের নিয়ম রিপাবলিকানদের সুবিধা করে অনেক। তবে সমীক্ষার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছিল ডেমোক্র্যাটরা সামান্য গরিষ্ঠতায় বা ৫০-৫০ করে উপরাষ্ট্রপতির ভোটে সেনেটের দখল রাখবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তারা দুটি আসন ছিনিয়ে এনেছে, একটি খুইয়েছে আর দুটি আসনে বিশেষ নিয়মের কারণে আবার নির্বাচন হতে হবে। ফলে এই দুটিই জিতলে তবেই তারা ৫০-৫০ করতে পারবে, যা অসম্ভব না হলেও মোটেই সহজ নয়। অন্ততঃ দুটি আসনে তাদের প্রত্যাশিত জয় না আসার ফলে ডেমোক্র্যাটরা পিছিয়ে পড়েছে। অনেকের মতে বাইডেনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে চাইলেও ওয়াল স্ট্রিট আর ভোটারদের একটা বড় অংশ সেনেটের দখল ডেমোক্র্যাটদের হাতে দিতে চান নি। কারণ তা হলে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের করছাড় রদ করে করের হার বাড়াতে সফল হতে পারেন, বা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের নতুন বিধি চালু করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সেনেটের সাহায্য ছাড়া বাইডেনের প্রতিশ্রুত নীতিগুলির বাস্তবায়ন করা বেশ শক্ত হবে। তবে বাকি দুই আসন জিতে সেনেটের দখল নিতে পারলে হোয়াইট হাউস-সেনেট-হাউসের দখল নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের ‘ট্রাইফেক্টা’ হবে, যা রিপাবিলকানরা ২০১৬ সালে পেয়েছিল।   

নির্বাচনের ব্যাপারে তিনটি কাল্পনিক কিন্তু কৌতুহলদ্দীপক প্রশ্ন মনে আসে, যার প্রকৃত উত্তর জানা সম্ভব না, শুধু আলোচনা হতে পারে। প্রথম হল, কোভিড অতিমারি না হলে কি ট্রাম্প জিততেন? এর তিনরকম উত্তর পাওয়া গেছে। প্রথম উত্তর হল, না। ট্রাম্পের অনুমোদন ভোটারদের কাছে বরাবর খুব কম। ট্রাম্প খুব বিভাজনকারী রাজনীতিক --- সমর্থক বা সমালোচক দুই দলই তাদের অবস্থানে খুব দৃঢ়, এত কিছু ঘটনায় ট্রাম্পের এতরকম সমালোচনাও তাঁর সমর্থকদের বিচলিত করে নি, এমনকি কোভিডকেও অনেকে ‘ফেক নিউজ’ বা ‘চীনের ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অতিমারির আগে গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই সমীক্ষায় তিনি বাইডেন সহ বেশ কিছু সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীর থেকে কাল্পনিক লড়াইয়ে পিছিয়ে ছিলেন। অবশ্য সমীক্ষার ফল না মিলতে দেখা যাচ্ছে, বিশেষতঃ অতদিন আগের হলে সেটা তত নির্ভরযোগ্য নয়, তাই শুধু তার ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে গতবার ট্রাম্পের জয়ের কারণ রাস্টবেল্টের তিনটি রাজ্যে কাজ-হারাদের মধ্যে হিলারির জনপ্রিয়তার অভাব। ফলে ট্রাম্প যা পেতে পারতেন, তিনি তাইই পেয়েছেন। দ্বিতীয় অংশের মত হল অল্প হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে কোভিডের কারণে এবং তার ফলে অর্থনীতির অবনতিতে কিছু ভোট ট্রাম্পের বিপক্ষে যাওয়াতেই ফলাফল ট্রাম্পের প্রতিকূল হয়েছে। নইলে শক্তিশালী অর্থনীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্প জিততেন, তা তাঁর প্রশাসন যতই বিতর্কিত কাজ করুক বা মানুষ হিসেবে তিনি যতই অপছন্দের হোন না কেন। তৃতীয় মত হচ্ছে, কোভিডের ফলে ট্রাম্পের কিছুটা হলেও সুবিধাই হয়েছে। এতে ট্রাম্পের আর তাঁর প্রশাসনের অন্যান্য দুর্নীতি ও অপদার্থতা চাপা পড়ে গেছ। কোভিডের ফলে যে লকডাউন আর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে মূলতঃ ডেমোক্র্যাট শাসিত রাজ্য বা শহরে, তার ফলে যারা কাজ হারিয়েছেন তারা ডেমোক্র্যাটদেরই দায়ী করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন যে তাদের সাহায্যের জন্য প্রায় কিছুই করেনি, সেটা তাদের কাছে তেমন পরিষ্কার হয় নি, রিপাবলিকানদের অর্থনীতি চালু রাখার চেষ্টাটাই বড়ো প্রতিপন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্প কোভিডের বিধিনিষেধ না মেনে একের পর এক জনসভা করে গেছেন, রিপাবলিকান স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছেন, নিয়ম মেনে ডেমোক্র্যাটরা সেগুলো থেকে বিরত থাকায় তাদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি হয়েছে। তবে একটা ব্যাপারে একমত হওয়া যায় যে, কোভিডের সংকটে ট্রাম্প যদি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাহলে সমর্থন বাড়িয়ে জয়ী হবার সুযোগ তাঁর সামনে ছিল, যেমন যুদ্ধের সময় ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানরা  জনসাধারনের সমর্থন পান। তবে ট্রাম্প সেই রাস্তায় হাঁটেন নি, বা বলা ভালো, তার জন্য যে মানসিকতা আর যোগ্যতা লাগে, তা ট্রাম্পের নেই। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল বাইডেনের বদলে যদি প্রগতিশীল ও বামপন্থী সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারি জিতে দলের প্রার্থী হতেন (যা প্রাইমারির শুরুর দিকে বেশি সম্ভাব্য মনে হচ্ছিল), তাহলে কি ট্রাম্প জিততে পারতেন? একথা ঠিক মধ্যপন্থী বাইডেন অনেক কম ঝুঁকির প্রার্থী, তবে স্যান্ডার্সের রাজনৈতিক বক্তব্যগুলি অনেক বেশি সরাসরি গরীব মানুষের রুটিরুজি, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কিত --- যেমন সবার জন্য সরকারি স্বাস্থ্যবিমা ‘মেডিকেয়ার ফর অল’, যার খরচ করের টাকা থেকে সরাসরি মেটানো হবে, ছাত্রঋণ মকুব করা হবে, ইত্যাদি। সমীক্ষায় দেখা গেছে মানুষ প্রগতিশীল নীতিগুলি সমর্থন করেন, যদি তাতে রাজনৈতিক তকমা না দেওয়া হয়। দেশের ৭২% মানুষই ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ নীতিতে উৎসাহী বা আপত্তি নেই জানিয়েছেন। এছাড়া ফ্লোরিডায় ১৫ ডলার সর্বনিম্ন ঘন্টাপ্রতি মজুরি ভোটাররা অনুমোদন করেছে ৬০% ভোটে, অথচ সেখানে ট্রাম্প এই নীতির বিরোধী হয়েও ফ্লোরিডা  জিতেছেন, বাইডেন এই নীতির সমর্থক হয়েও তা নিয়ে প্রচার করেননি। স্যান্ডার্স প্রার্থী হলে এইসব বিষয় প্রচারে গুরুত্ব পেত। রাস্টবেল্টেও স্যান্ডার্সের আবেদন বেশি, তাতে ওই রাজ্যগুলি জিততে বেগ পেতে হতো না, বরঞ্চ ওহায়ো বা আইওয়া জেতারও সুযোগ থাকত । লাতিনোদের মধ্যেও স্যান্ডার্সের জনপ্রিয়তা খুব ভালো। তবে শ্বেতাঙ্গ মধ্যপন্থী ভোটাররা যারা বাইডেনকে অনেক সমর্থন করেছেন, তাতে হয়তো কিছু ভাঁটা পড়ত। তবে দলের তরফ থেকে সহযোগিতা পেলে অন্ততঃ রাস্টবেল্টের তিনটি রাজ্য জিতে স্যান্ডার্স নির্বাচিত হতে পারতেন। তৃতীয় প্রশ্ন হল, লিবারেটারিয়ান প্রার্থী যদি না থাকতেন, তাহলে কি ট্রাম্প জিততেন? যদিও গতবারের মতো এবারে শক্তিশালী লিবারেটেরিয়ান প্রার্থী ছিল না, কিন্তু তাও চার-পাঁচটি রাজ্যে ভোটের যে ব্যবধান, তা উলটে যেত সমস্ত লিবারেটেরিয়ান ভোট ট্রাম্পের ঝুলিতে এলে, আর তা হলেই ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হতেন। লিবারেটেরিয়ান দল অর্থনীতির প্রশ্নে আরও প্রবলভাবে দক্ষিণপন্থী, তাই ভাবা হয় তারা রিপাবলিকানদের ভোটই কাটছে। বাস্তবে অবশ্য তা হয় না, যারা লিবারেটেরিয়ানদের ভোট দিচ্ছেন, তারা নীতিগত কারণেই দেন, না হলে ভোটই দিতেন না, কারণ লিবারেটেরিয়ানরা সামাজিকভাবে উদারপন্থী, প্রায় কোনোরকম নিয়ন্ত্রণেই বিশ্বাসী নন, আর রিপাবলিকানদের যুদ্ধনীতির ঘোর বিরোধী। তাই এরকম কোনও সহজ সমীকরণ সম্ভব নয়। 

নির্বাচনের পরে ট্রাম্পের করা কুনাট্যের কথা না বললেই নয়। এবারে ভোট যেহেতু অতিমারির মধ্যে হয়েছে, প্রচুর মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। সেগুলো পৌঁছানোর সময়সীমা বা গণনা করার সময় বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা আলাদা। ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থকদের কোভিড সচেতনতা বেশি, তাই তারা অনেক বেশি ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। যেহেতু বেশিরভাগ রাজ্যে ডাকযোগে আসা ভোট পরে গোনা হয়, তাই নির্বাচনের ফল বেরোনোর শুরুর দিকে এক ধরণের ‘লাল মরীচিকা’ (লাল রঙ দিয়ে রিপাবলিকান দলকে চিহ্ণিত করা হয়) হতে পারে জানাই ছিল, যাতে ট্রাম্প শুরুতে বিভিন্ন রাজ্যে এগিয়ে থাকলেও ডাকযোগে আসা ব্যালট গোনা হলে বাইডেন এগিয়ে যাবেন। বাস্তবে ঠিক তাই ঘটল, মিশিগান, উইসকন্সিন, পেনসিলভ্যানিয়া আর জর্জিয়ায় ট্রাম্প শুরুতে এগিয়ে যেতেই তিনি তড়িঘড়ি দাবী করে বসেন যে তিনি আবার জিতেছেন। ক্রমশঃ ফলাফল বদলে যেতে থাকলে আবার দাবী জানান যে এই সমস্ত রাজ্যে ভোট গণনা বন্ধ করে দিয়ে ডাকযোগে আসা ব্যালট গ্রাহ্য না করতে, কারণ তাঁর দাবী এতে প্রচুর জাল ভোট গোনা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় সেই স্তরে গণনা বন্ধ করা হল, তাহলে বাইডেনই জিতে জেতেন। ট্রাম্প অবশ্য চাইছিলেন, যেসব রাজ্যে তিনি পিছিয়ে, সেখানেই শুধু গণনা চলুক। আদালতেও সেইমর্মে তাঁর আইনজীবীরা পিটিশন করেন। বলা বাহুল্য, আদালত এরকম উদ্ভট যুক্তি শুনতে চায় নি। ট্রাম্পের আইনজীবীরা ভোটে বেনিয়ম হবার কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি। বস্তুতঃ ট্রাম্পের পুরো আইনি সেল এক বিশৃঙ্খল ও হাস্যকর কার্যকলাপের উৎস হয়ে উঠেছে। কোনও নামী ল ফার্ম এই দায়িত্ব নিতে চায় নি, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি এই দল পরিচালনা করছেন। জুলিয়ানি এক সময় নিউ ইয়র্কের মেয়র হিসেবে ভালো কাজ করেছিলেন, কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর আইনচর্চা না করা জুলিয়ানির কোনও আইনি দক্ষতা দেখা যায় নি, প্রায়ই আদালতে ভর্তসৃত হয়েছেন। এমনই অপদার্থতা যে সাংবাদিক সম্মেলন করার জন্য ফিলাডেলফিয়া শহরে ‘ফোর সিজন’ অভিজাত হোটেল ভাড়া করতে গিয়ে ভুল করে ওই নামে একটা ল্যান্ডস্কেপিং কোম্পানির পার্কিং এর জায়গা ভাড়া করে ট্রাম্পের আইনি সেল। সেখানে সাংবাদিক সম্মেলন করাটা একটা চুড়ান্ত অস্বস্তিকর ব্যাপার। ট্রাম্পের এক প্রধান আইনজীবী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তা কিছু ছদ্ম সংবাদমাধ্যম থেকে উদ্ধৃতি দিতে থাকলে সেলের পক্ষেও সেটা থেকে দূরত্ব তৈরি করে বলতে হয় ওই আইনজীবী দলের অংশ নন। জুলিয়ানি কাহিল অবস্থায় রোদে ঘেমে প্রায় ভাঁড় প্রতিপন্ন হন। সঙ্গত কারণেই কথা উঠেছে, জাল ভোট পড়ার কারণে ভোটকে যদি অগ্রাহ্য করতে হয়, তবে একই ব্যালটে  অন্যান্য পদে রিপাবলিকান প্রার্থীদেরও নির্বাচন অবৈধ হয়ে যায়। ট্রাম্পের প্রায় সমস্ত পিটিশনই বিভিন্ন রাজ্যে আদালতে পরিত্যক্ত হয়েছে, যদিও আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদেরই ব্যাপক সংখ্যাধিক্য। জর্জিয়াতে ব্যবধান কম বলে নিয়মমাফিক পুনর্গণনা হয়, তবে পুনর্গণনাতে কখনই ব্যবধানে কয়েকশর বেশি তফাৎ হয় না। উইসকন্সিনে ট্রাম্প কয়েকটি অঞ্চলে টাকা জমা দিয়ে পুনর্গণনার অনুরোধ করেন, কিন্তু তাতে বাইডেনেরই ভোট কিছু বাড়ে। এত কিছু সত্ত্বেও ট্রাম্প বাইডেনের জয় স্বীকার করে ‘কনসেসন স্পিচ’ দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর প্রশাসনের অন্যান্য ব্যক্তিরাও বাইডেনের আসন্ন অভিষেক মসৃণভাবে হবে কি না সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে হাস্যকরভাবে দাবী করেন ট্রাম্পই রাষ্ট্রপতি থাকছেন। অবশ্য ‘কনসেসন স্পিচ’ দেওয়া একটা সৌজন্যরীতি মাত্র, ট্রাম্প স্বীকার না করলেও বাইডেনের অভিষেক আটকায় না, যদি সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি বাইডেনকে তাদের রাজ্যের জয়ী বলে সরকারি ঘোষণা করে আর ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধিরা সেই নির্দেশ অনুযায়ী ভোট দিয়ে বাইডেনকে সরকারিভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। রাজ্যগুলির জয়ীকে শংসাপত্র দেবার সময়সীমা ৮ই ডিসেম্বর,  ইলেক্টরাল কলেজে ভোট নেওয়া হবে ১৪ই ডিসেম্বর, ৬ই জানুয়ারী কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ভোট গোনা হবে আর নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ হবে ২০ জানুয়ারী দুপুর বারোটায়। কাজেই যাই ঘটুক, সেই পর্যন্ত ট্রাম্পই রাষ্ট্রপতি থাকছেন, যদি না আগেই পদত্যাগ করেন।

আমেরিকার সংবিধানে এই আড়াই মাসেরও বেশি লম্বা ‘লেম ডাক পিরিয়ড’ রাখা হয়েছিল যাতে এক প্রশাসন থেকে পরবর্তী প্রশাসনে যাওয়া সহজসাধ্য হয়। নীতিগতভাবে এই সময়ে আগের রাষ্ট্রপতির, বিশেষকরে যিনি নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তাঁর কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়, সবকিছু সিদ্ধান্ত পরবর্তী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সমন্বয় করে করা উচিৎ। কিন্তু যেহেতু সংবিধানে পরিষ্কার কোনও নির্দেশ নেই, তাই ট্রাম্প এই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেন্টাগনের ও সাইবার নিরাপত্তার বরিষ্ঠ অফিসারদের সরিয়ে নিজের অনুগতদের পদে বসিয়েছেন এই আশায় যে তাঁরা কিছু ট্রাম্পকে সুবিধা দেবেন। তা ছাড়া অভিবাসন নীতিতে উল্লেখযোগ্য কড়াকড়ি চালু করা, আলাস্কায় সংরক্ষিত জায়গা তেল ড্রিলিং করতে খুলে দেওয়া, কোভিড ত্রাণের বরাদ্দ টাকা পেতে বাইডেনের প্রশাসনের জন্য ইচ্ছাকৃত অসুবিধা সৃষ্টি করা, ইরানের সাথে বিরোধ ইচ্ছা করে বাড়িয়ে নেওয়া  ইত্যাদি সিদ্ধান্তও ক্ষতিকারক হতে পারে। নির্বাচন চলাকালীন ট্রাম্পের দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের এক নতুন বিচারপতি নিয়োগ করাও এই সৌজন্যের বিরোধী। তবে এ ব্যাপারে সব রিপাবলিকান সেনেটরকেই দায়ী করতে হয়, কারণ তাঁদের ভোটেই এই নিয়োগ আইনসিদ্ধ হয়েছে। এমনকি ট্রাম্পের মনোভাবে দেশের গোপন তথ্যের ব্যাপারে তাঁর উপর নির্ভর করা যায় কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে, বিশেষ করে ট্রাম্পের ব্যবসার সঙ্গে যেহেতু বেশ কিছু দেশের সম্পর্ক রয়েছে।  

এরকম কি হতে পারে যে এর পরও ইলেক্টোরাল কলেজ ট্রাম্পকেই নির্বাচন করল? তত্ত্বগতভাবে সেটা সম্ভব, দুরকমভাবে, কারণ আমেরিকার জটিল এবং সেকেলে নির্বাচন পদ্ধতি। এক হতে পারে, ইলেক্টোরাল কলেজের কিছু নির্বাচক ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করে বাইডেনের প্রাপ্য ভোট ট্রাম্পকে দিলেন। কিন্তু বাইডেনের যে ব্যবধান, তাতে ট্রাম্পের জিততে এরকম আটত্রিশজন ‘বিশ্বাসহীন নির্বাচক’ দরকার, যেটা সম্পূর্ণ অলীক ব্যাপার। আর হতে পারে যদি বেশ কয়েকটি রাজ্য, নির্বাচনের ফল নির্ভরযোগ্য নয় বলে তাদের নিজেদের রাজ্যের ভোটের ফল অগ্রাহ্য করে পছন্দমতো ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধি বেছে তাদেরকে নির্দেশ দেন ট্রাম্পকে ভোট দিতে। সেটা হওয়া সম্ভব যদি রাজ্যের নিয়ন্ত্রক আইনসভা আর রাজ্যপাল দুইই রিপাবলিকান দলের হন, তারা দুই পক্ষই এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অনৈতিক কাজ করতে রাজি থাকেন আর আদালতে বাধা না পান। এরকম একাধিক রাজ্য দরকার ট্রাম্পের জিততে। এরকম কিছু করলে দেশে-বিদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে যা আগুন নিয়ে খেলার থেকেও অনেক সাঙ্ঘাতিক। সেইসব রাজনীতিকরাও নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এভাবে জলাঞ্জলি দিতে চাইবেন না। আদালতে ঘা খেয়ে ট্রাম্প এই রাস্তা নিতে চাইছিলেন, মিশিগানের প্রতিনিধিদের হোয়াইট হাউসে ডেকে তাদের অনুরোধ করেছেন ভোটের ফল অগ্রাহ্য করে তাঁকে ভোট দিতে। কিন্তু একের পর এক রাজ্যের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিয়েছেন যে তাদের রাজ্যে নির্বাচনে কোনও বেনিয়ম হয় নি, তাঁরা আইন অনুযায়ীই চলবেন। ফলে ট্রাম্পের আবার গদিতে বসার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ট্রাম্প সেকথা মুখে স্বীকার না করলেও সম্প্রতি বাইডেনের প্রশাসনের প্রস্তুতিপর্বে সহযোগিতা করতে নিজের প্রশাসনকে অনুমতি দিয়েছেন, আর বলেছেন ইলেক্টোরাল কলেজে বাইডেন নির্বাচিত হলে তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে দেবেন। যদিও এ ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা হয় না, তবু এইটুকু সহায়তাও অচলাবস্থা দূর করতে সাহায্য করছে, বিশেষতঃ যেখানে কোভিডের মোকাবিলা করতে পরবর্তী প্রশাসনের পুরোপুরি প্রস্তুত থাকা ভীষণ জরুরি। 

হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের বিদায়টাও ব্যতিক্রমী হতে পারে। সাধারণ সৌজন্য মেনে বাইডেনের অভিষেকে উপস্থিত থেকে সবার নজর বাইডেনের উপরে পড়ছে দেখে সেটা ট্রাম্পের পক্ষে সহ্য করা মুশকিল। হয়তো তার আগেই অলিখিতভাবে হোয়াইট হাউস ছেড়ে ফ্লোরিডায় নিজের গলফ কোর্স ‘মার-আ-লাগো’ তে ছুটি কাটাতে গিয়ে ট্রাম্প আর ফিরে আসবেন না। 

মানুষের পছন্দ অস্বীকার করার ট্রাম্পের এই চেষ্টা অত্যন্ত নিন্দনীয় আর আমেরিকার গণতন্ত্রের পক্ষে সাংঘাতিক ক্ষতিকর হলেও মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এরকম হতে পারে এই পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত আমার নিবন্ধটিতেও উল্লেখ করেছিলাম। প্রথম কারণ ট্রাম্প একজন আত্মমোহিত, দাম্ভিক ও স্বার্থপর মানুষ, যিনি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া দেশ বা অন্য কোনও কিছু নিয়ে ভাবেন না। সঙ্গত পরাজয় স্বীকার করতে যে মানসিকতা লাগে, তা তাঁর বিন্দুমাত্র নেই। সমর্থকদের কাছে বুক ফুলিয়ে ‘আমি জিতেছি' দাবী করতে পারাটাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তবে তা ছাড়াও আরও গভীর কারণ রয়েছে। তার প্রথমটা আর্থিক। ট্রাম্পের ব্যবসায় প্রচুর দেনা, শিগগিরিই অন্ততঃ চল্লিশ কোটি ডলারের একটা বড় কিস্তি তাঁকে মেটাতে হবে পাওনাদারদের কাছে। রাষ্ট্রপতিপদে থাকতে পারলে আরও চার বছর সেটা এড়াতে পারতেন, বা পাওনাদারদের কোনোভাবে সুবিধা দিয়ে তার বিনিময়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করতেন। সেটা যখন হচ্ছে না, তখন একটা রাস্তা হচ্ছে সমর্থকদের কাছ থেকে টাকা তোলা। ভোটের প্রচারের সময় সেটা করা যায়, তবে ভোট মিটে যাবার পর অন্য রাস্তা লাগে। ভোটের ফলের বিরুদ্ধে  আদালতে লড়াই করতে হচ্ছে এই অজুহাতে টাকা তোলা হচ্ছে, কিন্তু এখানেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের দল একটা অনৈতিক পদ্ধতি নিচ্ছে। ‘একমাত্র আট হাজার ডলারের উপর দানের চল্লিশ শতাংশ আইনি লড়াইয়ে ব্যয় হবে, বাকি ষাট শতাংশ বা ছোট দানের পুরোটাই যাবে ট্রাম্পের নির্বাচনের ধার মেটাতে বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সাধারণ তহবিলে’ এই শর্তটা শুধু ফাইন প্রিন্টে লেখা, বহু সমর্থক না বুঝেই টাকা দিচ্ছেন। তোলা টাকার কিছুটা অংশ রিপাবলিকান দলের সাধারণ তহবিলে যাবে বলে ওই দলের বেশিরভাগ নেতাই ট্রাম্পের এতসব কুনাট্যে চুপ হয়ে বসে আছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রপতিপদ থেকে সরে গেলেই, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি যেমন আইনি মামলা থেকে রেহাই পান, তা আর পাবেন না। ট্রাম্পের ব্যবসায় নানারকম বেনিয়ম আর কর ফাঁকির অভিযোগে তদন্ত চলছে, এ ছাড়া প্রশাসনিক দুর্নীতিও প্রকাশ পাবার সম্ভাবনা আছে। সেসব ব্যাপারে ফেঁসে গেলে ট্রাম্পের ভালোরকম কারাদন্ডও হতে পারে। ট্রাম্পের সহযোগী অপরাধে অভিযুক্ত একজনকে তিনি ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে মার্জনা করেছেন, শোনা যাচ্ছে ক্ষমতা ছেড়ে দেবার আগে নিজেকেও মার্জনা করে যেতে পারেন। সেটার আইনি ভিত্তি নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে, তবে তিনি যদি আগেরভাগে পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি মাইক পেন্সকে রাষ্ট্রপতিত্ব ছেড়ে দেন, তবে পেন্স তাঁকে আইনসঙ্গতভাবেই মার্জনা করতে পারেন। অবশ্য তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া রিপাবলিকান দলের পক্ষে খারাপ হতে পারে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ থেকে ছাড়া পেলেও রাজ্যের জন্য এই মার্জনা প্রযোজ্য নয়, নিউ ইয়র্কে আনা অভিযোগ এভাবে তিনি এড়াতে পারবেন না। তবে এই কুনাট্য করে ট্রাম্পের একটা বড় সাফল্য হয়েছে --- রিপাবলিকান দলের ভোটারদের একটা বিরাট অংশ মনে করে নির্বাচনের ফলে কারচুপির ফলেই বাইডেন জিতেছেন। এর জন্য কয়েকটি অত্যন্ত দক্ষিণপন্থী ছদ্ম সংবাদমাধ্যমকে বিশেষভাবে দায়ী করা যায়। ট্রাম্প বা রিপাবলিকান সমর্থক মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ’ কারচুপির তত্ত্বে ততটা সমর্থন না দেখানোয় তারা সম্প্রতি ট্রাম্পের চক্ষুশূল হয়েছে, আর তার পর থেকে ট্রাম্পের গোঁড়া সমর্থকদের মধ্যে ওইধরণের ছদ্ম সংবাদমাধ্যমের প্রভাব বেড়ে গেছে। এমনকি তারা এও দেখিয়েছে যে ট্রাম্প চারশোর বেশি ইলেক্টোরাল ভোট জিতে আবার ক্ষমতায় আসছেন। এইসব ভুয়ো সংবাদ অনেক ট্রাম্প সমর্থকই বিশ্বাস করে। এই বিশালসংখ্যক সমর্থকরা বাইডেনের প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করতে পারে, ট্রাম্পের ২০২৪ সালে আবার ভোটে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও খুলে দিতে পারে। সত্যি সত্যি ট্রাম্প অবশ্য ২০২৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না সন্দেহ আছে। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে লড়ে জয় পাওয়া বেশ কঠিন, যদি দেশের অর্থনীতি মোটের উপর ভালো চলে। ভালোরকম জয়ের সম্ভাবনা না বুঝলে ট্রাম্প দাঁড়াবেন না, কারণ আবার পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে সহ্য করা কষ্ট। রিপাবলিকান প্রাইমারিও তাঁকে আবার জিততে হবে। তা ছাড়া চার বছর বাদে ট্রাম্পের বয়স হবে আটাত্তর --- স্থুল চেহারা আর খারাপ খাদ্যাভাসের জন্য তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর সর্বোপরি কারাদন্ড হলে আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও থাকবে না। তবে তিনি আবার লড়বেন কথাটা ভাসিয়ে রাখতে পারলে সমর্থকদের ধরে রাখা, রিপাবলিকান দলে প্রভাব বজায় রাখা ও নির্বাচনী তহবিল থেকে ক্রমাগতঃ টাকা তোলার সুযোগ থাকছে, যেটা ট্রাম্প ছাড়তে চাইবেন না। শেষমেশ হয়তো বড়ছেলে ডনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র বা বড়মেয়ে ইভাংকা ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিতে পারেন। মোট কথা, আগামী চার বছরে ট্রাম্পের কি হয়, সেটা একটা বিরাট কৌতুহলের ব্যাপার হয়ে রইল।


==========

লেখার তারিখঃ নভেম্বর ৩০, ২০২০

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

লেখাটি "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকার জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।