শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

উন্ডেড নী – নেটিভ আমেরিকানদের মুছে যাবার কাহিনী

উন্ডেড নী – নেটিভ আমেরিকানদের মুছে যাবার কাহিনী

-শুভাশিস ঘোষাল 



I shall not rest quiet in Montparnasse.

I shall not lie easy at Winchelsea.

You may bury my body in Sussex grass,

You may bury my tongue at Champmédy.

I shall not be there. I shall rise and pass.

Bury my heart at Wounded Knee.


-Stephen Vincent Bennet


…. সেটা ছিল বড়দিনের চার দিন পরে, নতুন বছর তখন আসব আসব করছে। গুলিবিদ্ধ দেহগুলো সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শ্মশানের নীরবতায়। ওইরকম ভাবে ওখানেই পড়ে রইল আরো দুদিন। প্রায় তিনশো দেহের বেশিরভাগই মেয়েদের আর বাচ্চাদের। ঠান্ডায় জমে পাথর হয়ে গেছে সব শরীর, চামড়া কুঁচকে কালো হয়ে গেছে। সৎকারের দল এলো তারপর। সৎকার বলতে ক্রিকের পাশে একটু গর্ত খুঁড়ে ঝপাঝপ শবগুলোকে গাদাগাদি করে ফেলে দেওয়া। তারপর তিনদিন খুব বরফ পড়েছিল, তিনফুট সাদা চাদরে ঢেকে গিয়েছিল শবদেহগুলো --- গণহত্যার চিহ্ন মুছে দিয়ে। প্রায় পনের হাজার বছরের ইতিহাসের এক অধ্যায় এভাবে শেষ হল হাঁটুভাঙ্গার বাঁকে।



১৮৯০ খৃষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর, সাউথ ড্যাকোটার পাইন রিজ ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের উন্ডেড নী (Wounded Knee)। আমেরিকান প্রেয়ারির বিশাল প্রান্তরের মধ্যে প্রায় বৈশিষ্ট্যহীন একটা জায়গা। অত্যন্ত ক্ষীণ ধারার এক চিলতে নদী উন্ডেড নী ক্রিক পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে। কোন এক সুদূর অতীতে এক নেটিভ আমেরিকান যোদ্ধা হাঁটুতে অস্ত্রের ক্ষত নিয়ে এইখানে অবস্থান করেছিল, সেই থেকে নেটিভরা এই নাম দিয়েছিল জায়গাটার। এখানেই পাঁচ হাজার আমেরিকান সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী শিশু-বৃদ্ধ-নারী সহ মেরেকেটে সাড়ে তিনশো, প্রায় নিরস্ত্র, লাকোটা গোষ্ঠীর নেটিভ আমেরিকান এক দলের উপর গুলি চালিয়ে মেরেছিল। এরকম গণহত্যা অবশ্য বেনজির কিছু নয়, শেষ  তিনশো বছরের বেশি ধরে, শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের এই মহাদেশে আসতে শুরু করার পর থেকেই, প্রচুর ঘটেছিল আমেরিকার নানা প্রান্তে। তবু উন্ডেড নীর এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। এখানেই নেটিভ আমেরিকানেরা শেষবারের মতো একটু প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, অবশ্য আক্রান্ত হবার পর বাধ্য হয়ে। আর উন্ডেড নীর পরে প্রতিরোধের আর কোনও বাস্তব সম্ভাবনাও ছিল না। একসময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী মিলে যারা সংখ্যায় অন্ততঃ পঞ্চাশ-ষাট লক্ষ ছিল (সঠিক সংখ্যা অবশ্য বলা মুস্কিল --- তিরিশ লক্ষ থেকে এক কোটির উপরও হতে পারে), পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া আটকাতে তাদের পক্ষে অদৃষ্ট মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। দখলদারি পুরোপুরি শেষ হবার পর আমেরিকা রাষ্ট্রকেও আর কখনও নেটিভদের উপর আক্রমণ শানাতে হয় নি।

নেটিভ আমেরিকানরা আমেরিকার সবচেয়ে ভাগ্যতাড়িত জাতি। পনের-কুড়ি হাজার বছর আগে তুষারযুগে বেরিং ল্যান্ডব্রিজ পেরিয়ে এশিয়া থেকে শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া করে যারা এই গোলার্ধে এসে পৌঁছেছিল আর সারা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সমস্ত জমিজমা সম্পদের মালিকানা যাদের ছিল, তারা প্রায় মিলিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। শুধু রেখে গেছে পটোম্যাক, মিনেহাহা কিংবা উম্পকুয়ার মতো ঝর্ণা, নদী, পাহাড় বা হ্রদের এইসব অসম্ভব সুন্দর কাব্যিক নাম। নিজেদের সত্ত্বা প্রায় হারিয়ে তাদের উত্তরপুরুষেরা বর্তমানে থাকে চুড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানা জনগোষ্ঠী এ দেশে এসেছে, শুরুতে প্রচুর প্রতিকূলতার পরে তারা মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, সমাজের মূল স্রোতে মিশে গেছে। এ ব্যাপারে আফ্রিকা থেকে দাসত্বের জন্য ধরে আনা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কথা সবচেয়ে বেশি মনে হয়। একসময় অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, এখনও দারিদ্র্য অশিক্ষা এসব সমস্যা আছে, তবু নেটিভ আমেরিকানদের তুলনায় তাদের অবস্থা শতগুণে ভালো। আর কিছু না হোক, তাদের সংখ্যাধিক্য তাদের পক্ষে কাজ করেছে, আর রিজার্ভেশনের মধ্যে আটকে পড়ে থাকতে হয় নি।

আমেরিকায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পড়াতে নেটিভ আমেরিকানদের কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। এমনিতে ওদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে রক্তের সংমিশ্রণ হয়ে হয়ে বিশুদ্ধ রক্তের নেটিভ আমেরিকান পাওয়া খুব কঠিন, অনেককে দেখেই শ্বেতাঙ্গ বা লাতিনো বলেই মনে হয়, নাম দিয়েও বোঝা যায় না। দারিদ্র্য আর শিক্ষার উপযুক্ত সুযোগের অভাবে খুব কম অংশই কলেজে পড়তে আসতে পারে। তারই মধ্যে একবার একটি ছাত্রী পেয়েছিলাম খুবই মেধাবী আর পরিশ্রমী। আমেরিকার পশ্চিমাংশে বিভিন্ন ন্যাশানাল পার্কে ওদের গোষ্ঠীর মানুষেরা অনেক সময় উপজাতীয় ঐতিহ্যের নাচগান পরিবেশন করে। অ্যারিজোনার পেজ  শহরে এন্টিলোপ ক্যানিয়ন দেখতে গিয়েছিলাম একবার। এটা নাভাহো (Navajo) রিজার্ভেশনের মধ্যে পড়ে, তাই নাভাহোদের ট্যুর অপারেটরের সঙ্গেই যেতে হয়। আমাদের গাইড এঞ্জেলা, গুহার মধ্যে আবছা আলোতে মাউথ অরগ্যান বাজিয়ে, খুব করুণ সুরের নাভাহোদের একটা ঐতিহ্যের গান বাজিয়ে শুনিয়েছিল। এইভাবেই তারা বাইরের পৃথিবীর কাছে তাদের সংস্কৃতির যেটুকু এখনও বেঁচে আছে, তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর একবার একজন নেটিভ আমেরিকান আমাদের খুব চমকে দিয়েছিল। সেবার লাল পাথরের দেশ অ্যারিজোনার সেডোনা শহরে বেড়াতে গেছি। ভর গ্রীষ্মে অ্যারিজোনায় তাপমাত্রা উঠে গেছে চরমে। আমার ছ বছরের ছেলে আবার টুপি আনতে ভুলে গেছে, তাই এক টুপিবিক্রেতার পশরা দেখছি আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি, তখনই ব্যক্তিটি আমাদের অবাক করে আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলল। একজন শ্বেতাঙ্গর পক্ষেই বাংলা বলা বেশ অপ্রত্যাশিত ঘটনা, সেক্ষেত্রে একজন নেটিভ আমেরিকানের কাছ থেকে বাংলা শুনতে পাওয়া পুরোপুরি অভাবনীয় ব্যাপার, সে দু একটা কথাই হোক আর যাই হোক। আরও অবাক করে দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পালাবদলের খবরের উল্লেখ করে। তারপর নিজেই জানাল যে সে ইস্কনের সঙ্গে যুক্ত, সেই সূত্রে একবার মায়াপুর গিয়েছিল।



এভাবে ধীরে ধীরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ বেড়েছে। কেন বার্ন্সের 'দ্য ওয়েস্ট' বলে একটা তথ্যচিত্র দেখে বিশেষ কৌতুহল জন্মায়। তারপর থেকে সুযোগ পেলে নেটিভ আমেরিকানদের সম্পর্কিত বই বা প্রবন্ধ পড়া চেষ্টা করেছি আর মিউজিয়মে ঘুরে দেখেছি। জেনেছি যে নেটিভ সৈন্যরা দুটি মহাযুদ্ধেই আমেরিকার হয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে, যদিও একই ধরণের অবদানের জন্য একজন নেটিভ অনেক কম স্বীকৃতি পেয়ে থাকে একজন শ্বেতাঙ্গের চেয়ে। তবে কি কারণ একজন নেটিভকে উদ্দীপ্ত করতে পারে সেই দেশের হয়ে লড়তে, যা তাদের প্রতি অবিচার করেছে অনেক? এর উত্তর দেওয়া ছিল নিউ ইয়র্কের Museum of American Indians এ। আসলে নেটিভরা বরাবরের যোদ্ধা জাতি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তারা যখন এদেশের হয়েই গেছে, তারা দেশের প্রয়োজনে অস্ত্র ধরবেই। আরও এক চমকপ্রদ তথ্য হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা নাভাহো গোষ্ঠীর ভাষা সাংকেতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে খবর আদানপ্রদানে, যার রহস্যভেদ জার্মানরা করতে পারে নি। 

উন্ডেড নীর ট্র্যাজেডিকে বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হবে তিনশো বছরেরও বেশি। ভারতবর্ষ খুঁজতে গিয়ে না বুঝে কলম্বাস ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এসে পড়েছিল, তারপর থেকে ক্রমাগতই শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের আনাগোনা হতে থাকে ক্যারিবিয়ান ও দুই আমেরিকার মূল ভূখন্ডে। মোটামুটিভাবে এরকম ধারণা বেশিরভাগ লোকেরই আছে, তবে উন্ডেড নীর পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে নেটিভদের ভাগ্যবিপর্যয়ের ইতিহাস  সংক্ষেপে একটু বলছি।

আমরা এক কথায় যাদের নেটিভ আমেরিকান (আমেরিকান ইন্ডিয়ানের মতো ভুল কথাটা আমি যথাসম্ভব এড়াতে চাই) বলি, প্রকৃতপক্ষে ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোষাক ও রীতিনীতিতে তাদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, এমনকি জিনতত্ত্বের হিসেবেও। দক্ষিণ-পশ্চিমের মরুভূমির লোকেদের সঙ্গে, উত্তর ঘাসজমির লোকেদের, বা পূর্বের ঘন বনের বা পশ্চিম উপকূলের অথবা মিসিসিপি তটের নেটিভদের মধ্যে মিলের থেকে ইউরোপীয়দের নিজেদের মধ্যে মিল ঢের বেশি। এদের কেউ কৃষিকাজে বিশেষ দক্ষ হয়েছিল --- জংলী ভুট্টার বাছাই প্রজনন ঘটিয়ে আধুনিক ভুট্টার জন্ম দিয়েছিল, আবার কোনও গোষ্ঠী শুধুই শিকার করত বা মাছ ধরত। আর দক্ষিণ আমেরিকার নেটিভরা তো বিজ্ঞানেও অনেক উন্নত হয়েছিল। ভারতবর্ষে শূন্য আবিষ্কার হবার প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই ইনকারা শূন্যকে ব্যবহার করার উপায় জানত। এমন নয় যে ইউরোপীয়দের আসার আগে ওদের মধ্যে কোনও সংঘাত হতো না। পৃথিবীর আর সব জায়গার জনগোষ্ঠীদের মতোই তারা যুদ্ধ করত পরস্পরের সাথে --- তবে তাতে একটা ভারসাম্য ছিল, কোনও গোষ্ঠী ওইভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেত না। ইউরোপীয়রা আসার পরে সে ভারসাম্যটা পুরোপুরি চলে গিয়ে সংঘাতগুলো একপেশে হয়ে পড়ে। কেউ মনে করতেই পারেন যে সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, বিশেষতঃ সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে, যেহেতু ইউরোপীয়দের উন্নতমানের অস্ত্র ছিল। কথাটা হয়তো ভুল নয়, তবে যতই বেশি শক্তিশালী হোক ইউরোপীয়রা, প্রথম যখন তারা আসে, নেটিভদের কাছ থেকে অভাবনীয় বদান্যতা না পেলে তারা ঘাঁটি গাড়তেই পারত না। এই সুবিশাল মহাদেশের প্রাচুর্য নেটিভদের করেছিল খুবই দিলখোলা উদার। অন্যান্য নেটিভগোষ্ঠীকে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে দেখলেও আগন্তুকরা তাদের কাছে সহায়সম্বলহীন অতিথি ছিল। খাবারদাবার, রসদ, জায়গা-জমি দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করেছিল। তার বদলে তারা পেয়েছিল শুধুই শঠতা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, কৃতঘ্নতা, ক্রূরতা ও হিংসা। বস্তুতঃ এত বদান্যতা ইউরোপীয়দের চোখে গুণ না হয়ে দুর্বলতার চিহ্ন মনে হয়েছিল, তারা সফট টার্গেট হয়ে যায়। তাদের সম্পদ দখল করে তাদের ইউরোপীয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করে তোলা, আর বিশেষ করে খ্রীষ্টধর্মের তলায় নিয়ে আসাটা পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অস্ত্রের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও নেটিভদের বিপর্যয়ের আর এক প্রধান কারণ হয়েছিল ইউরোপীয়দের আনা নানা মারণ ব্যাধির জীবানু, যেমন স্মল্ পক্স, যাদের বিরুদ্ধে নেটিভদের কোনও প্রতিরোধই ছিল না। ইউরোপীয়রাও সেটাকে সানন্দে নেটিভদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।

প্রথমে এসেছিল স্পেনীয়রা, আমেরিকার মূল ভূখন্ডে ফ্লোরিডার সেন্ট অগাস্টিনে তারা প্রথম শহর গড়ে তোলে। মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিশাল ভূখন্ড তাদের অধিকারে আসে। ইউরোপের দ্বিতীয় সারির শক্তি স্পেনের রাজ্যবিস্তারে সোনাদানার লোভ আর লুঠপাট অত্যন্ত প্রকট ছিল, যেমন ভারতবর্ষে পর্তুগীজরা দুর্নাম কুড়িয়েছিল। তার সঙ্গে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মাত্রাহীন রক্তের সংমিশ্রণে এক সংকর গোষ্ঠীর জন্ম দেয় যারা সারা লাতিন আমেরিকা ছেয়ে ফেলে নেটিভ অধিবাসীদের প্রায় পুরো মুছে ফেলেছে। আমেরিকায়ও দক্ষিণে টেক্সাস-নিউ মেক্সিকো-অ্যারিজোনা-ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে তারা উপস্থিত হয়েছিল। মেক্সিকো সিটিতে তাদের মূল ঘাঁটি থেকে সেসব অভিযান চালানো হতো। হত্যা, সঙ্গে সঙ্গে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ না করলে হত্যার হুমকি, পাইকারি হারে ফাঁসিতে লটকানো, অঙ্গছেদন এসব চলছিল। অবশ্য নেটিভদের বন্দী করে দাস বানানোর চেষ্টা একেবারেই সফল হয় নি। বস্তুতঃ যখন ধর্মপ্রচারকেরা শান্তিপূর্ণ পথে এসেছিল, নেটিভরা তাদের বাধা দেয় নি, তাদের কথা মন দিয়ে শুনেছে পর্যন্ত। কিন্তু বাড়াবাড়ি শুরু হওয়াতে তারা ক্ষেপে গিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্রে অনেক পিছিয়ে থাকলেও নেটিভদের বেশিরভাগ গোষ্ঠী ছিল কুশলী যোদ্ধা, শ্বেতাঙ্গ হানাদারদের তারা অনেক সময়ই হঠিয়ে দিয়েছিল। বন্দুকের ব্যবহারও তারা ভালই শিখে ফেলেছিল, যদিও তাদের হাতে বেশি বন্দুক ছিল না। পুয়েবলোদের গোষ্ঠীপতি পোপের নেতৃত্বে তারা স্পেনীয়দের হারিয়ে তাদের জায়গা দখলমুক্ত করে রেখেছিল বহুবছর, যতদিন না মেক্সিকো সিটি থেকে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তারা ফিরে আসে।

ইংরেজরা স্পেনীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ধূর্ত ছিল, তাদের ধৈর্য ছিল বেশি, নেটিভদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে তারা এগোচ্ছিল। এমনকি ভার্জিনিয়ায় নেটিভ রাজকুমারী পোকাহোন্তাসকে  বিয়েও করেছিল এক ইংরেজ দলপতি। তবে তাদেরও উদ্দেশ্য বেশিদিন চাপা থাকে নি। নেটিভরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তারপর নৃশংস আক্রমণ ও গণহত্যার শিকার হয় তারা। তবে গ্রেট লেক অঞ্চলে ডেট্রয়েট অবরোধের যুদ্ধে দলপতি পন্টিয়াক ইংরেজদের প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন ফরাসীদের সাথে হাত মিলিয়ে, কিন্তু  শেষ পর্যন্ত ফরাসীরা বিশ্বাসঘাতকতা করায় আর পারেন নি। ডাচরাও মিষ্টি কথাবার্তা আর সামান্য কাচের পুঁতি ধরণের জিনিস দিয়ে পুরো ম্যানহাটন উপদ্বীপ হাতিয়ে নিয়েছিল, ফলে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাভাবিক সমুদ্রবন্দর নিউ ইয়র্ক তাদের হাতে এসেছিল। তারপর রাতের অন্ধকারে নেটিভদের গ্রামে হানা দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল মানুষ সহ পুরো বসতি। ফরাসীদের গল্পও একই রকম --- তারা প্রধানতঃ দখল করেছিল দেশের মধ্যভাগে নিউ অরলিন্স বন্দর সহ মিসিসিপির তীরের দুপাশ। ফরাসী-ইন্ডিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ফরাসী সাহিত্যিক Chateubriand তার Atala উপন্যাসে এক নেটিভ যুগলের কাহিনী বলেছেন, যারা গণহত্যা থেকে পালিয়ে বাঁচতে মিসিসিপির উজানে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। মেয়েটি ছিল অন্তঃস্বত্ত্বা, মিসিসিপির তীরে বসে সে এক সন্তানের জন্ম দেয় ভোরের প্রথম আলোয়, তার বাবা সেই সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে তুলে ধরে। এই দৃশ্যটা Eugene Delacroix  তাঁর The Natchez  ছবিতে দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন।



অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ মধ্যভাগে আমেরিকার বিপ্লবীযুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয়ের ফলে স্বাধীন উপনিবেশকারীরা নতুন দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করার পর নেটিভদের জায়গা-জমির উপর শ্বেতাঙ্গদের চাপ আরও বাড়তে থাকে। এই যুদ্ধে নেটিভরা ইংরেজদের পক্ষেই মূলতঃ লড়েছিল, কারণ তারা দেখেছিল তাদের থেকেও উপনিবেশকারী আমেরিকানদের জমির লোভ অনেক বেশি। শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশের সঙ্গে এশিয়ার মানুষ কম বেশি পরিচিত, তবে আমেরিকায় যে ঘটনা পরম্পরা ঘটেছিল, সেই তুলনায় ভারতবর্ষ বা এশিয়ার অন্য জায়গায় ঘটা ঘটনার কোনও তুলনাই হয় না। ভারতবর্ষে ছিল এক সুবিশাল জনসংখ্যা। ইংরেজরা সুযোগ পেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে পেলেও তাদের শাসন চলত নেহাতই উপরের অংশে, তার পরের ধাপগুলোতে ভারতবাসীরাই শাসন চালাত, বিশেষ করে দেশীয় রাজ্যগুলোতে। উপনিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা হল শহর-গ্রামে সর্বত্র উপনিবেশকারীদের বসতি স্থাপন ও জায়গা-জমির দখল নেওয়া ও তার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে  অনেকাংশে বিলুপ্ত করা ও বাকিদের অন্যত্র পাঠানো, যা ভারতবর্ষে ঘটেনি। মনে করা যাক, সুজলা-সুফলা বাংলার লোকজনকে জোর করে রাজস্থানের ঊষর প্রান্তরে পাঠানো হলো, কি তামিলদের হিমালয়ে বা পাঞ্জাবীদের বিন্ধ্য অঞ্চলে। আমেরিকার জনগোষ্ঠীদের  ঠিক এরকমই ব্যাপকহারে অন্যত্র সরানো হয়েছিল এমন জায়গায়, যেখানে তাদের নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশই নেই। নেটিভ আমেরিকানদের সাধারনতঃ তাদের নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে ছিল এক নিবিড় যোগাযোগ, শিকার করার বা ফসল বোনার ঠিক সেই জায়গাটা যা তারা চেনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, তাই তারা প্রাণ পণ করে পড়ে থাকার চেষ্টা করত পিতৃপুরুষের সেই জায়গায়। প্রথম গণ উচ্ছেদের শিকার হয়েছিল পূর্বভাগের নেটিভেরা। অ্যাপালেশিয়ান পর্বত অঞ্চলে চেরোকিদের সুবিশাল জনসংখ্যা চালান করে দেওয়া হল অজানা দেশ মিসিসিপির পশ্চিমপারে, যা তখনও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার বাইরে ইন্ডিয়ান টেরিটারি হিসেবে চিহ্নিত হত। ঘোড়ার গাড়িতে যেটুকু জিনিসপত্র পারে চাপিয়ে যেতে যেতে ক্ষতিপূরণবাবদ যে সামান্য কয়েকটা ডলার তারা পেয়েছিল পরিবারপিছু, তার প্রায় সবটাই পথে দিয়ে দিতে হলো রাস্তা ব্যবহার করার জন্য, কারণ তখন প্রায় সব রাস্তাই ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধীন টার্নপাইক। ক্ষিদে আর শীতে পঁচিশ শতাংশ চেরোকি পথে মারা গেল। ইতিহাসে এই যাত্রা ট্রেল অফ টিয়ার্স (Trail of Tears) নামে পরিচিত হয়ে রইল। প্রেসিডেন্ট আ্যন্ড্রু জ্যাকসন বিশেষভাবে কুখ্যাত ছিলেন নেটিভদের সরানোর ব্যাপারে তার অদম্য মনোভাবের জন্য। আ্যন্ড্রু জ্যাকসনের সৈনিক জীবনের সময় ব্যাপকভাবে চেরোকিদের হত্যার জন্য তাকে সরাসরি দায়ী করা যায়। নেটিভরা তাকে শার্প নাইফ আখ্যা দিয়েছিল। উপনিবেশিকদের এরকম নগ্ন আগ্রাসন, যা নেটিভ আমেরিকানরা দেখেছিল, সেরকম এমনকি আফ্রিকাতেও দেখা যায় নি। বিপুল অত্যাচার ও পীড়নের শেষেও আফ্রিকান জনগোষ্ঠীরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল, শেষমেশ নিজেদের দেশও ফেরত পেয়েছে। দু একটি যে আফ্রিকান দেশে শ্বেতাঙ্গরা প্রকৃত উপনিবেশ করেছে, সেখানেও তারা ব্যাপক সংখ্যালঘু। ঔপনিবেশিকতার ধরণে একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বোধ হয় আমেরিকা-কানাডার তুলনা করা যেতে পারে, তবে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা এত কম ছিল আর মধ্যভাগ প্রায় জনহীন বলে এরকম গণউচ্ছেদের ঘটনা হয়তো হয় নি।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন ফ্রান্সের কাছ থেকে লুইজিয়ানা ক্রয় (Louisana Purchase) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের আয়তন দ্বিগুণ করে ফেলেন। ফ্রান্স এই অঞ্চলের দাবিদার হলেও এই বিশাল ভূখন্ডে তাদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ ছিল না, নেটিভ গোষ্ঠীরা প্রায় স্বাধীনভাবেই ঘোরাফেরা করত। জেফারসন দুই অভিযাত্রী লুইস আর ক্লার্ককে পাঠালেন জায়গাটা সম্পর্কে জানতে, আর বিশেষ করে নর্থ ওয়েস্ট প্যাসেজ খোঁজ করতে, যা কি না প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানোর রাস্তা। তখনও সুয়েজ খাল তৈরি হয় নি, এশিয়ার সঙ্গে, বিশেষ করে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্য রাস্তা খোলার তাগিদ ছিল উত্তমাশা অন্তরীপের দীর্ঘ ও বিপদসংকুল পথ এড়িয়ে। ধারণা ছিল বুঝি মিসিসিপির পশ্চিমে অল্প গেলেই প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছানো যাবে। লুইস আর ক্লার্কের অভিযানে বোঝা গেল যে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়ানোর পরও রয়েছে সুবিশাল ভূখন্ড, সেখানে বহু নেটিভ গোষ্ঠীর বাস। তারা দুজন শেষমেশ রকি পর্বত পেরিয়ে কলম্বিয়া নদী ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা পেয়েছিলেন। প্রথমে মান্দান, তারপর শোশোনি ও নেজ পার্স, এইরকম বহু নেটিভ গোষ্ঠীর সাহায্য না পেলে তাদের এই অভিযান সফল হওয়া তো দূরের কথা, তারা অনাহারেই মারা যেতেন। নেটিভেরা ইচ্ছা করলেই তাদের মেরে ফেলতে পারত। পূর্বের নেটিভ গোষ্ঠীদের লাঞ্ছনার কথা তারা তখনই কিছু কিছু শুনেছিল। কিন্তু তা তারা করে নি, বরঞ্চ খাবারদাবার, ঘোড়া ও নৌকা দিয়ে এবং পথ দেখিয়ে তারা সবরকমভাবে ওদের সহায়তা করেছিল। কিন্তু মালিকানাবিহীন  এত বিশাল জমি ও নানা সম্পদের কথা শুনে (শ্বেতাঙ্গদের কাছে সেখানে থাকা নেটিভরা মালিকানার বিবেচনায় ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না) শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিকরা বিশেষ আকৃষ্ট হয়। ইউরোপের নানা দেশ থেকে তখন দলে দলে লোক আসছে নতুন এই দেশের বিশাল সম্ভাবনার কথা শুনে। ফলে অভিবাসীদের জন্য আরও জায়গা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, আর নেটিভদের সঙ্গে বাড়ছে সংঘাত। নেটিভরা খুব বেদনার সঙ্গে দেখত যে শ্বেতাঙ্গরা কিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে ফেলে, আর আশ্চর্য হয়ে ভাবত শ্বেতাঙ্গরা কি প্রকৃতিকে ঘৃণা করে! প্রথমে পশুর চামড়ার ব্যবসায়ী ফার ট্র্যাপাররা, তারপর চাষবাসের উদ্দেশ্যে ও পরে রেলরোড গড়ে উঠলে খনিজ সম্পদ তুলতে, দলে দলে লোক বসতি বিস্তার করে। বিশেষ করে সোনার খোঁজ পাওয়া অঞ্চলে পঙ্গপালের মতো লোকজন আসতে থাকে, রাতারাতি শহর গড়ে উঠতে থাকে। মাত্র পাঁচ প্রজন্মের মধ্যেই সারা পশ্চিমদেশে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা বসতি গড়ে ফেলে। নেটিভেরা জানত অগণিত সংখ্যার শ্বেতাঙ্গদের উন্নত অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়, আর মনে করত এত বিশাল জায়গা, তার ভাগ কিছুটা দিলে ক্ষতি নেই তেমন। তারা নিজেদের অনেক অধিকার ছেড়ে দিয়েও চুক্তি করত রাষ্ট্রের সঙ্গে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, মেনে চলত সেগুলো, কিন্তু বিনিময়ে পেত চুক্তিভঙ্গ, আরো নতুন দাবী আর আক্রমণ। সেইভাবে ক্রমাগতঃই সংকুচিত হচ্ছিল তাদের জায়গা, যাতে আর জীবনধারণের উপযোগী যথেষ্ট শিকারক্ষেত্র পড়ে থাকছিল না। তাদের বাধ্য করা হচ্ছিল ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে। রিজার্ভেসনের জায়গাও দেওয়া হত সব থেকে অনুর্বর আর শিকার যেখানে দুর্লভ সেসব জায়গায়। তাদের জন্য রেশনের যে ব্যবস্থা করা হত সরকার থেকে, তা অপ্রতুল, সময়ে পৌঁছাতো না, আর অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছানোর আগেই চুরি হয়ে যেত। নেটিভদের জায়গা-জমির অধিকার দিয়ে যে সব সরকারি নীতি ছিল, নতুন আইন করে সেগুলোও শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছিল। ১৮৬২ সালের হোমস্টেড আইনে এক একজনকে ১৬০ একর অবধি চাষবাসের জমি দাবী করার অধিকার দেওয়া হয়। তারপর ১৮৮৭ সালে ডস অ্যাক্ট (Dawes Act) নেটিভদের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জীবনের উপরই আঘাত হানে। এতে এক এক নেটিভ আমেরিকান পরিবারের প্রধানকে ১৬০ একর কৃষিজমি বা ৩২০ একর শিকারের জমি দিয়ে বাকি উদবৃত্ত জমি অভিবাসীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এই আইনের খসড়াকারীরা ছিলেন নেটিভদের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদ্দেশ্য ছিল রিজার্ভেসনের জীবনের বাইরে তাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই আইন তাদের পরিপূর্ণ ধ্বংসের পথ খুলে দেয়। কারণ তাদের সমাজ গোষ্ঠীদের যৌথ মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। পনের কোটি একরের নেটিভদের জমির তিনভাগের দুভাগই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে। বড় রিজার্ভেসনগুলোও কেটে ছোট ছোট ভাগ করা হয়, রেশনের পরিমান আরও কমে যায়, মহামারী ছড়িয়ে পড়ে বহু জায়গায়।  

শ্বেতাঙ্গরা অনেক বেশি সংখ্যায় আর তাদের অস্ত্রশস্ত্রও অনেক বেশি আর উন্নত মানের, তবুও বহু ক্ষেত্রেই তারা ছল, শঠতা ও সম্পূর্ণ অন্যায় যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছে। নেটিভেরা যখনই সম্ভব হয়েছে, সমঝোতার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের সমঝোতার জন্য ডেকে নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী বা হত্যা করা হয়েছে, বন্ধু সেজে গিয়ে একসঙ্গে মদ খেতে খেতে অতর্কিতে গুলি করে মেরেছে, তাদের খাবার ফসল আর থাকার তাঁবু জ্বালিয়ে দিয়েছে যাতে তারা খিদে আর শীতে মারা যায়, এক-আধ জনের করা কোনও অন্যায়ের জন্য পাইকারি হারা নিরীহ লোকেদের মেরেছে, আত্মসমর্পন করতে চাওয়া নারী-শিশুদেরও নির্মমভাবে খুন করেছে। কলোরাডোর স্যান্ড ক্রিকে এরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল যে একটা গর্তে লুকিয়ে থাকা মেয়েরা শান্তির পতাকা হাতে দিয়ে একটা ছ বছরের মেয়েকে পাঠিয়েছিল, তাকেও মেরে ফেলা হয় আর তারপর লুকিয়ে থাকা মেয়েদের। অথচ কলোরাডো অঞ্চল ছিল সরকারের দ্বারা স্বীকৃত ইন্ডিয়ান টেরিটারি। আসলে ডেনভার এলাকায় সোনা খুঁজে পাবার পরই সেই অঞ্চল থেকে নেটিভদের সরিয়ে দেবার দরকার হয়ে পড়ে সমস্ত চুক্তিকে লংঘন করে। আর যারা এইসব নতুন অঞ্চলের প্রশাসনিক বা সামরিক দায়িত্ব নিয়ে যেত, তারা প্রায় সকলেই ছিল তীব্র নেটিভ বিদ্বেষী। অনেক সময় সরকারি নির্দেশ দেওয়া হত নেটিভদের মাথা কেটে আনতে পারলে মাথাপিছু টাকা পাওয়া যাবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনা খুঁজে পাওয়ার পর অবস্থা চরমে ওঠে --- নেটিভদের সংখ্যা পাঁচভাগের একভাগ হয়ে যায় মাত্র তিরিশ বছরে। ওয়াশিংটনের শাসন পশ্চিম অঞ্চলে সেরকম বলবৎ ছিল না, গভর্নরদের কথাই ছিল আইন। আর সব খবর পৌঁছাতোও না ওয়াশিংটনে। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন, যিনি একজন খুবই অনুভূতিশীল মনের মানুষ ছিলেন আর কৃষ্ণাঙ্গদের দাসত্ব থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে যিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, তিনিও নেটিভদের বিরুদ্ধে ক্রমাগতঃ হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকারে কিছুই প্রায় করতে পারেন নি। অবশ্য নেটিভদের প্রতি সহানুভুতিশীল কিছু অফিসার ছিলেন, কিন্তু বাকিদের বিরোধিতায় তাদের বিশেষ কিছু করার উপায় ছিল না, এমনকি অনেককে কোর্ট মার্শালও করা হয়েছে। ডানহোয়াগা বলে একজন নেটিভ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উলিসেস গ্রান্টের বন্ধু ছিলেন, নিজের চেষ্টায় পড়াশুনো শিখে ইন্ডিয়ান আ্যফেয়ার্স ব্যুরোর কমিশনার হতে পেরেছিলেন ও নেটিভদের জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাকেও কিছু তুচ্ছ পদ্ধতিগত ত্রুটির অভিযোগে, যা তিনি করেছিলেন নেটিভদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে বাস্তবতার কারণেই, সরিয়ে দেওয়া হয়।

কথা হল, নেটিভদের প্রতি এরকম ক্রমাগতঃ হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কি কোনও জনমত ছিল না? প্রথম কথা, নেটিভদের জায়গা-জমি দখল যেখানে গড়পড়তা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের স্বার্থের অনুসারী, সেখানে জনমতও গড়ে ওঠে সেভাবে। সেই যুগে ন্যায়-অন্যায়ের মূল্যায়নও ছিল আজকের থেকে দুর্বল, জেনেভা কনভেনশনেরও জন্ম হয় নি তখনও। তা ছাড়া সর্বোপরি তাদের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার খবর স্থানীয় সংবাদপত্রের বাইরে তেমন বেরোতো না। উল্টে দু একটা ছোটখাটো ঘটনার সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে উল্লেখ করে নেটিভরা যে বর্বর আর গোলমালকারি, সেটাই প্রতিষ্ঠা করা হতো। যুগে যুগে বিভিন্ন জায়গায় এরকমই হয়ে থাকে। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে আমরা অসুর-দৈত্য-রাক্ষসদের হানা দেওয়া আর অত্যাচারের যেসব উল্লেখ পাই, সেগুলোও হয়তো বিজয়ী আর্যদের বানানো। আদি জনগোষ্ঠীর লোকেদের সম্পর্কে নিন্দাবাদ করার উদ্দেশ্যে, যেখানে সেই লোকেরাই প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত। ইতিহাস তো বিজয়ীরাই লেখে। নেটিভ আমেরিকানদের এত সব কাহিনীর বেশিরভাগই হয়তো সাধারণ লোকের কাছে সম্পূর্ণ অজানা রয়ে যেত যদি না ডি ব্রাউনের মতো লেখক এবং আরও কিছু সাংবাদিক বিভিন্ন সংবাদপত্র ও দলিল ঘেঁটে "ইতিহাস খুঁড়ে রাশি রাশি দুঃখের খনি" বের করে আনতেন।

তবে নেটিভরা তাদের অস্ত্রের ঘাটতি সত্ত্বেও প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল অনেকক্ষেত্রেই। দেশের মধ্যভাগে শায়ান গোষ্ঠীর নেতা তিকামশে (Tecumseh) নেটিভদের এক বিশাল ফেডারেশন গড়ে তুলে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া যেসব নেটিভ গোষ্ঠীপতি গৌরবজনক লড়াই করেছিলেন, তাদের মধ্যে আইওয়া অঞ্চলে ব্ল্যাক হক, নাভাহোদের নেতা ম্যানুয়েলিতো ও জেরোনিমো, মিনেসোটায় লিটল ক্রো, ওগলালা ড্যাকোটা নেতা রেড ক্লাউড, ওরেগনে নেজ পার্স চিফ জোসেফ ইত্যাদিরা বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এবং অবশ্যই লাকোটা গোষ্ঠীর দুই অদম্য নেতা ক্রেজি হর্স এবং সিটিং বুল, যারা কোনও মূল্যেই তাদের পবিত্রভূমি ব্ল্যাক হিলসের দখল ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। ১৮৬৮ সালের ফোর্ট লারামি চুক্তি অনুযায়ী ব্ল্যাক হিলসকে চিরকালের জন্য পুরোপুরি নেটিভদের হাতে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সোনার ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর খোঁজ পেতেই সে চুক্তি আর মানা হয় না। তা ছাড়া খনিতে পৌঁছানোর জন্য রাস্তা তৈরি করা হচ্ছিল নেটিভদের অধিকারে থাকা জমির উপর দিয়ে। স্যান্ড ক্রিকের ঘটনার নৃশংসতায় আর পুরোপুরি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় দুই তরুণ নেতা  ক্রেজি হর্স আর সিটিং বুলের নেতৃত্বে অনেক নেটিভ গোষ্ঠী একজোট হয়ে প্রতি-আক্রমণ করে ও লিটল বিগ হর্নের যুদ্ধ সহ বেশ কিছু সাফল্য পায়। তবে এই ধরণের সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। উত্তরের প্রেয়ারির সেই নিষ্ঠুর শীতে বাসস্থানহীন মানুষগুলো, বিশেষকরে শিশুদের জমে যাওয়া থেকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত ক্রেজি হর্স আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। নিরস্ত্র বন্দী অবস্থায় তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। তবে তাঁর হৃদপিন্ডটি বের করে নিয়ে তাঁর মা-বাবা পালিয়ে এসে সেটি উন্ডেড নীর কোনও এক জায়গায় কবর দিয়েছিলেন। সিটিং বুল পিছু হটতে হটতে সীমান্ত পেরিয়ে কানাডায় চলে যান। তিনি কানাডা সরকারকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁর লোকজনেদের নিজেদের চেষ্টায় বেঁচে থাকার জন্য একটা রিজার্ভেসনের জায়গা দিতে, কিন্তু কানাডা সরকার সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেয় এই বলে যে বৃটিশ বা কানাডিয়ান নাগরিক না হবার জন্য তিনি তা পেতে পারেন না। চার বছর বাদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে সাউথ ড্যাকোটায় স্ট্যান্ডিং রক রিজার্ভেসনে থাকা মেনে নিতে বাধ্য হন।




জীবিতকালেই কিংবদন্তী হয়েছিলেন সিটিং বুল। ওয়াইল্ড ওয়েস্ট শোর সাথে তিনি সারা দেশ ঘুরেছিলেন। দর্শকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সই নেবার জন্য ডলার বাড়িয়ে দিত। এভাবে করা উপার্জনের প্রায় পুরোটাই তিনি বিলিয়ে দিতেন, যেসব ক্ষুধার্ত গরীব শ্বেতাঙ্গ বাচ্চারা তাঁর পাশে ভিড় করত, তাদের মধ্যে। আর আক্ষেপ করে বলতেন, “শ্বেতাঙ্গরা এতো উন্নত কিন্তু তারা নিজেদের গরীবদেরই দেখে না। তারা শুধু কিভাবে তৈরি করতে হয় জিনিষ সেটা জানে কিন্তু তা কিভাবে বন্টন করতে হয় জানে না"। এরকমই অসাধারণ মানুষ ছিলেন সিটিং বুল। আর আশ্চর্য প্রজ্ঞা ছিল তাঁর। জায়গা-জমি যে নেটিভদের হাতে আর থাকবে না, বালক বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর একটা আশঙ্কা ছিল তাঁর, যে নিজের লোকেদের হাতেই তিনি নিহত হবেন। তাঁর এই আশঙ্কাও শেষপর্যন্ত মিলে গেছিল।

যখন আর লড়াই করার আর কোনও রসদই অবশিষ্ট ছিল না, তখন নেটিভদের কিছু গোষ্ঠী অলৌকিকের দিকে ঝুঁকে পড়ল। কিকিং বেয়ার বলে এক লাকোটা ব্যক্তি খবর আনল যে পায়ুটদের একজন ওঝা, ওভোকা তার নাম, একধরণের বিশেষ প্রেত-নাচের উদ্ভাবন করেছে, যেটা করতে পারলে শ্বেতাঙ্গরা সব উধাও হয়ে যাবে, মৃত নেটিভেরা আবার ফিরে আসবে, সারা তৃণভূমি আবার বুনোমোষে ভরে উঠবে আগের মতো। আর এক ধরণের বিশেষ পোষাক পরলে শ্বেতাঙ্গদের বুলেট নেটিভদের আর বিদ্ধ করতে পারবে না। দলে দলে নেটিভরা নাকি এরকম করছে। যুক্তিবাদী সিটিং বুলের কাছে এই ধারণা বাস্তবসম্মত মনে হল না, তবে তিনি স্ট্যান্ডিং রক রিজার্ভেসনে প্রেত-নাচ করার অনুমতি দিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে খবর গেল, বরফের মধ্যে নেটিভেরা পাগলের মতো নাচ করছে। সৈন্যদের বলা হল প্রস্তুত থাকতে, ওদের থামাতে হবে। সিটিং বুল ছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ আতঙ্ক, তাই তাদের মনে হল সিটিং বুলও বুঝি প্রেত-নাচে যোগ দিতে চলেছেন, আর তাতে গন্ডগোলের আশঙ্কা আছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার আদেশ জারি হল। রিজার্ভেসনে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ লাকোটা লোকজনকে নিয়েই তৈরি হত। ১৮৯০ সালের ১২ই নভেম্বর তারা সিটিং বুলকে তাঁর বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে এলে বাইরে বহু লোকের জমায়েত হল বাধা দেবার জন্য। তাদের মধ্যে একজন পুলিশকর্তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশ পালটা গুলি চালায়। একজন পুলিশ সরাসরি সিটিং বুলের মাথায় গুলি করে। বাকি জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

এই দলেরই একটা অংশ এবং ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত শায়ান রিভার ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসন থেকে আরও অনেকে পালিয়ে আরও দক্ষিণে পাইন রিজ ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পনেরই ডিসেম্বর। উদ্দেশ্য ওখানকার গোষ্ঠীপতি বিগ ফুটের দলে যোগ দেওয়া। তাদের কাছে যথেষ্ট সংখ্যক ঘোড়াও ছিল না, প্রচন্ড শীতের মধ্যে বহু রাস্তা হেঁটে তারা শেষে বিগ ফুটের দলের সঙ্গে মিলতে পারে। কিন্তু বিগ ফুটের উপর আদেশ যায় নতুন লোকেদের দলে না নিতে। সেই নির্দেশ না মেনে বিগ ফুট লোকজন নিয়ে নেব্রাস্কায় রেড ক্লাউডের শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ২৮শে ডিসেম্বর পথে সৈন্যরা আটকায় তাদের। বিগ ফুট তখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উঠে বসারও ক্ষমতা হারিয়েছেন। শান্তির পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করলে তাদের দলটাকে উন্ডেড নী ক্রিকের ধারে একটা অস্থায়ী শিবিরে রাখা হয়। পাঁচ হাজার সৈন্য জায়গাটাকে ঘিরে রাখে। চারদিকে ভারি কামান বসানো হয়। 

পরদিন সকালে সবাইকে ডেকে একজায়গায় জড়ো করা হয়। স্কুলের বাচ্চা কিছু, যারা ঘটনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে পারে নি, নিজেদের মধ্যে খেলছিল। সবাইকে অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়। বন্দুক তো বটেই, ছুরি কাঁচি যা আছে সবাইকে এক জায়গার জড়ো করতে হয়। কিন্তু নেটিভদের সেই দলের একজন, যে কানে খানিকটা খাটো আর একটু অপ্রকৃতিস্থ ছিল, বলে যে সে অনেক টাকা খরচ করে বন্দুকটা কিনেছে, তা সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। টানাটানিতে শূন্যে একটা গুলি ছুটে যায়। সৈন্যরা এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে সরাসরি লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। একের পর এক দেহ লুটিয়ে পড়তে থাকে। স্কুলের যেসব বাচ্চারা একটু আগেই খেলছিল, দেখা গেল তাদের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়েছে, যেমন করে "কাস্তের আঘাতে ঘাস লুটিয়ে পড়ে"। যাদের তখনও হাতে হাতিয়ার ছিল কিছু, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে প্রত্যাঘাতের, কিন্তু অত সুসজ্জিত সৈন্যদের বিরুদ্ধে ওই কজন সামান্য অস্ত্র নিয়ে কতটুকুই বা প্রতিরোধ করতে পারে? আড়াইশোর মত নেটিভ সেখানেই মারা গেল। বিগ ফুটের দেহও পড়ে রইল চিত হয়ে। বাকিদের আরো অনেককে সৈন্যরা তাড়া করে মেরে ফেলল। অনেকে আহত হয়ে পরে পরেই মারা গেছে। সৈন্যদেরও জনা পঁচিশেক নিহত হয়েছিল, তবে তার প্রায় সবই নিজেদেরই ছোঁড়া গুলিতে। আহতদের কাছাকাছি একটা চার্চে নিয়ে রাখা হল মেঝেতে গাদাগাদি করে। সেখানে তখনও বড়দিনের জন্য সাজানো অলংকরণ দেয়ালে ঝুলছে যিশুর বাণীর নিচে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসো,  সবাইকে ভালোবাসো, ... ।

নীতি বা মানবিকতার দিক থেকে তো বটেই, আইন ও সংবিধানের হিসেবেও উন্ডেড নীর হত্যাকান্ড অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। প্রেত-নাচ প্রকৃতপক্ষে ছিল যিশুর পুনরুজ্জীবনের ধাঁচে একটা ধর্মীয় উৎসব। উল্লেখ্য যে সেই সময়ে সমস্ত নেটিভেরাই প্রায় খ্রীষ্টান হয়ে গেছে, তারা যা করত সেগুলো খ্রীষ্ট ধর্মেরই উৎসব, নিজেদের মতো করে। আমেরিকার সংবিধানে বাকস্বাধীনতা ছাড়া আর যে নীতিগুলোকে বিশেষকরে মানা হয়, তাদের মধ্যে যে কোনও ধর্ম পালন বা না পালন করার অধিকার আর হাতিয়ার সঙ্গে রাখার অধিকার, বিশেষ উল্লেখ রাখে। অথচ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সব সময় এটাই বলেছে যে উন্ডেড নীর ঘটনা যুদ্ধেরই অংশ, তাই গুলি চালানো অন্যায় নয়। সৈন্যদের আঠারো জনকে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য পদকও দেওয়া হয়। অন্যদিকে নেটিভেরা এটাকে সবসময়েই গণহত্যা বলে এসেছে এবং সৈন্যদের দেওয়া সম্মান কেড়ে নেবার অনুরোধ জানিয়েছে। ১৯৭৩ সালে উন্ডেড নীতে একটা প্রতীকী অভ্যুথানও হয়েছিল। ১৯৯০ সালে উন্ডেড নীর ঘটনার শতবর্ষে সরকারের তরফ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হয়, তবে পদকগুলো ফেরানো হয় নি। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এলিজাবেথ ওয়ারেন অবশ্য ঘোষণা করেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে পদকগুলো সম্মানিত সৈন্যদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। বলা বাহুল্য, তা নেহাৎই প্রতীকী, কারণ সেইসব সৈন্যরা বহু যুগ হল গত হয়েছে। 

কথা হচ্ছে, সৈন্যদের এইরকম আচরণের কারণ কি হতে পারে। তীব্র বিদ্বেষ অবশ্যই প্রধান কারণ, যার অধমর্ণ, তাকেই আঘাত করার পিছনে উপকার চাপা দেবার একধরণের মানসিকতা কাজ করে। আর উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৈন্যদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোও হতো। আগে নেটিভদের উপর বহু অত্যাচার-অবিচার করা হয়েছে, তবু বোঝা যায় যে তার পিছনে চালিকাশক্তি ছিল সম্পদের দখল, আর ছিল যুদ্ধের একটা প্রেক্ষাপট, তা সে যতই একপেশে হোক না কেন। কিন্তু উন্ডেড নীর ঘটনার সময় নেটিভদের দিক থেকে আর যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সম্পদের দখলও হয়ে গেছে সম্পূর্ণ। প্রেত-নাচ ধর্মীয় আচারের বেশিকিছু নয়, হিংস্র তো নয়ই। দুচারদিন গেলেই প্রেতনাচের অসারতা নেটিভরা নিজেরাই বুঝতে পারত। আর যে লোকটি অস্ত্র সমর্পণ করতে আপত্তি করছিল, সামান্য ধৈর্য দেখালেই তাকে বোঝানো যেত। তাহলে কি সৈন্যদের মনে একটা ভয় ছিল যে প্রেত-নাচ থেকে নেটিভেরা সত্যিই শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে? নাকি তাদের ভয় ছিল নেটিভরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবে?

এখন কেমন আছে উন্ডেড নী আর ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনগুলো? এক কথায়, খুব খারাপ। সত্তর-আশি শতাংশ বেকারত্ব, অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, বাচ্চারা পুষ্টি পায় না, ডায়াবেটিস মহামারির আকার নিয়েছে, হতাশায় প্রতি চার জনে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক অ্যালকোহলিক, মানুষের গড় আয়ু মাত্র পঞ্চাশ বছর, যা তৃতীয় বিশ্বেরও প্রায় সব দেশের থেকে কম। পাইন রিজ রিজার্ভেসন বিশেষ করে দেশের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটা, যদিও রাজ্য হিসেবে সাউথ ড্যাকোটা তেমন গরীব কিছু নয়। রিজার্ভেসনগুলো সাধারণতঃ কোনও বড় রাস্তার উপর পড়ে না, কোনও বিনিয়োগ আসে না, চাকরির সুযোগ গড়ে ওঠে না। স্কুলগুলো খুব খারাপ, পোস্ট অফিস-ব্যাঙ্কজাতীয় পরিষেবা বা সিনেমা-থিয়েটারের মতো বিনোদন দুর্লভ। কিছু কিছু রিজার্ভেসন অবশ্য ক্যাসিনো খুলে লাভের মুখ দেখেছে, কারণ বেশিরভাগ রাজ্যে ইন্ডিয়ান রিজার্ভেসনের বাইরে ক্যাসিনো খোলা বেআইনি। তবে তার পরিচালন ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া এতে রিজার্ভেসনের লোকেদেরও নেশাগ্রস্ত হবার সমুহ সম্ভাবনা। অবশ্য একশ বছর আগে নেটিভদের রিজার্ভেসনে থাকা যেমন বাধ্যতামূলক ছিল, এখন আর তা নয়। বেশিরভাগ নেটিভই এখন শহরে থাকে। কিন্তু মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেয় বেশিরভাগ নেটিভ বাচ্চা, তাই বড় হয়ে তাদের পক্ষে ভালো চাকরি জোটে না। আর সেই কারণে অনেকেই রিজার্ভেসনের বাইরে আসতেও পারে না। রিজার্ভেসনের ঘেরাটোপ থেকে বের করে নেটিভদের মূল স্রোতে আনার জন্য জোরাজুরি করার কিছু অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটেছে এককালে, যেমন তাদের বৈশিষ্ট্য লম্বা চুল কাটতে বাধ্য করা বা বাচ্চাদের পরিবার থেকে সরিয়ে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের ঘরে বড় করা। 

আজকের আমেরিকা অবশ্য নেটিভ আমেরিকানদের কিছু পাওয়া থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে না। বরঞ্চ কলেজে স্কলারশিপ বা চাকরিতে নেটিভদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক পিছিয়ে পড়ার ফলে একজন নেটিভ আমেরিকানের পক্ষে এই ধরণের সুবিধা নেবার জায়গাতেই আসা খুব শক্ত ।

ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্ক থেকে ঘন্টাদেড়েক গাড়ি চালালে উন্ডেড নী পৌঁছানো যায়, তাই এবারে যখন ব্যাডল্যান্ডস গেলাম, উন্ডেড নী দেখে আসব ঠিক করলাম। নিতান্ত গ্রাম্য পথ, প্রায় ফাঁকা জমি, মাঝে মধ্যে যে বাড়িগুলো পড়ছে, সেগুলোর খুব হতদরিদ্র অবস্থা। পথে দু একটা গ্যাস স্টেশন ছাড়া আর কোনও দোকানপাটও নেই। সত্তর মাইল গিয়ে উন্ডেড নীর সাইটটা খুঁজে পেলাম। দেখি একটি নেটিভ আমেরিকান তরুণী টেবিলে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেছে। উন্ডেড নী সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করব বলে গিয়ে কথা বলে জানতে পারলাম ওর নাম মারিয়া-এলিজাবেথ এল্ক। নামের শেষে এল্ক থাকার অর্থ ওদের গোষ্ঠীর টোটেম হল এল্ক, মানে ওরা নিজেদের এল্কের বংশধর মনে করে, তার কারণ এল্করা ওদের মাংস জোগাতো। মারিয়া খুব যত্ন করে পথের হদিস বুঝিয়ে দিল। আর জিজ্ঞাসা করল, আমি কিছু কিনতে আগ্রহী কি না। ওদের রিজার্ভেসনে নব্বই শতাংশ বেকারত্ব, সামান্য টুকটাক জিনিষ বিক্রি করেই ওর আয় হয়। হাতে তৈরি কিছু কানের দুল, হার এইসব। একটা জিনিস নিলাম পছন্দ করে। দাম অবশ্য চড়া, কিন্তু ওদের এ ছাড়া উপায়ও নেই কিছু। দুএকটা এ কথা ও কথার পর একটু অস্বস্তিকর প্রশ্নটা করেই ফেললাম যে এখন ওদের সমাজে উন্ডেড নীর ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন। একটু থেমে মারিয়া বলল, "একশ বছরের বেশি হলেও লাকোটাদের কাছে উন্ডেড নীর ঘটনা দগদগে হয়ে আছে, তারা কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। তবে সেই তিক্ততা মনের মধ্যে থাকলে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হবে। এর কোনও রকম প্রতিশোধ নেওয়া আর সম্ভবও না, উচিৎও না। তাই আমরা সজ্ঞানেই ক্ষমা করে দিয়েছি, সেটাই করা ঠিক।"

মারিয়ার কাছ থেকে জেনে নিয়ে উল্টোদিকের ঢিবিটায় গেলাম। এখানে নিহতদের নাম উল্লেখ করে প্রত্যেকের জন্য একটা করে পাথরের ফলক পোঁতা রয়েছে, আর জায়গাটা ঘিরে যে ঘেরাটোপ, তাতে রিবন বাঁধা, নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। মনে হল, যারা ক্ষমা করার, তারা তো তা করে দিয়েছে, তবে তুমি কেন তা চাইতে পারবে না? "বলো, ক্ষমা করো, হিংস্র প্রলাপের মধ্যে সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।" 



তথ্যসূত্রঃ

D Brown: "Bury My Heart at Wounded Knee", book.
Ken Burns: "The West", documentary film
David C. King: "First People: An Illustrated History of American Indians", book. 
New York Museum of American Indians.
Discover Lakota Country, Publication of Pine Ridge Area Chamber of Commerce, Kyle, South Dakota.


-----------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, ডিসেম্বর ২০১৯
মুদ্রনঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই ২০২১ সংখ্যা
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল


শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

মন্বন্তরের শেষে


মন্বন্তরের  শেষে

-শুভাশিস ঘোষাল

লাঙ্গল পড়েনি মাঠে কতকাল
নিড়োনো হয়নি ঝোপ আগাছা,
কতদিন ফলেনি ধান --- চাল
শেষ কবে হয়ে গেছে বাছা।
ফুরিয়েছে ইঁদুরের ভাঁড়ার
কুড়োনো খুদের সযত্ন সঞ্চয়;
প্লেগ, ক্ষুধা আর রাত্রির আঁধার
বুকফাটা তৃষ্ণায় জীবনের ক্ষয় ---
শস্যহীন অঘ্রাণের মাসে
শিশির লেহন করে যদি তৃষ্ণা মেটে
মহার্ঘ্য শিশির তবু কই আসে
হেমন্তের কুয়াশার পথে পথে হেঁটে?
পৃথিবীর শরীর জুড়ে অজস্র ক্ষত
বয়সিনী রূপজীবিনীর বিবর্ণ মুখের মত,
মিশর-ব্যাবিলন আজ পাথুরে ইতিহাস
তার স্থির হয়ে আসা শ্বাস,
ফুসফুসে গভীর অসুখ;
অ্যামাজন জ্বলে, এক বুক
ক্যান্সার নিয়ে। তবু একদিন
সে আসিবে এক ঈশ্বরীর সাজে
সদ্যোস্নাত কেশরাজি হাওয়ায় উড্ডীন
মদের শীতলতা তার শরীরের ভাঁজে
দেহবৃন্তে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের জল
চুঁয়ে পড়ে জুড়িয়েছে মাঠের ফাটল,
আবার সবুজ ঘাস সময়ের স্রোত বেয়ে
ঘাসফড়িঙের লাফ ডানে আর বাঁয়ে,
নদী আর অরণ্যের গল্প বলা হলে
ঘুমায়ে পড়িব ভিড় আকাশের তলে। 


----------

প্রথম প্রকাশিত ঃ সেপ্টেম্বর ২০১৯,  দিগন্ত
বেঙ্গলি এসোসিয়েসন অফ নর্থ ক্যারোলাইনার শারদ ম্যাগাজিন

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল 




বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শয়তানের মিনার ও তার সাতটি তারার রূপকথারা

শয়তানের মিনার ও তার সাতটি তারার রূপকথারা

-শুভাশিস ঘোষাল




ওয়াইওমিং (Wyoming) প্রদেশের একদম উত্তরপূর্ব কোণে, ইন্টারস্টেট ৯০ থেকে মাইল পঁচিশেক ঢুকে এলে, বিরাট উপত্যকার মধ্যে, অন্ততঃ দশ মাইল দূর থেকে যেটা চোখে পড়বেই, তা হল হঠাৎ করে উঠে যাওয়া এক বিরাট মনোলিথ পাথর, ১২৬৭ ফুট উঁচু। ডেভিলস টাওয়ার --- শয়তানের মিনার। ভারি অদ্ভুত দেখতে, তার সারা গায়ে যেন অজস্র আঁচড়ের দাগ। পাশ দিয়ে যেতে যেতে বেল ফুস (Belle Fourche) নদী পুরো জায়গাটাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। কুড়ি কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে জায়গাটা অবশ্য  সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। আমেরিকার মাঝবরাবর তখন এক বিরাট অগভীর সমুদ্র। সে জায়গাটা কখনও জলে মগ্ন থাকে, কখনও আবার জল সরে গিয়ে শুখনো ডাঙ্গা বেরিয়ে আসে। আর সামুদ্রিক নানা প্রাণীর দেহাবশেষ জমা হয়। আর ফেল্ডস্পার সমৃদ্ধ আগ্নেয়শিলা ফোনোলাইটের সঙ্গে মিশে যায় দানা দানা খনিজপদার্থরূপে। সাড়ে তেইশ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে লাল বেলেপাথর আর মেরুন পাললিক শিলা মিলে স্পিয়ারফিশ গঠন (spearfish formation) হয়েছিল। আজ থেকে পাঁচ কোটি বছর আগে নদীর জল, ঝর্ণা আর হাওয়া পাথরকে কেটে কেটে ফেলতে থাকে। যে অংশটা ছিল খুব শক্ত, তাকে আর হারাতে পারে নি, সে রয়ে গেছে এই বিরাট পাথরের চাঁই হয়ে। ভাঙ্গনের কাজ যদিও এখনও চলছে, ছোট ছোট পাথরের টুকরো এখনও ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়ে।

এ তো গেল ভূতাত্বিক পরিপ্রেক্ষিতের সংক্ষিপ্তসার, যার সামান্যই আমার জানা। ডেভিলস টাওয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক মানুষের গল্পও। ডেভিলস টাওয়ার এলাকায় আমেরিকার ভূমিপুত্রকন্যা নেটিভ আমেরিকান লালমানুষেরা বহুদিন ধরে বাস করেছে। শুধু এক গোষ্ঠীর নয়, এই অঞ্চলে থেকেছে --- কিওয়া (Kiowa), লাকোটা (Lakota), শায়ান (Cheyenne), সিউ (Sioux), আরাপাহো (Arapaho), ক্রো (Crow), শোশোনি (Shoshone) এই ধরনের অনেক গোষ্ঠীর নেটিভ আমেরিকান উপজাতি। বহু হাজার বছর আগে তাদের তৈরি পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে এখানে। পাহাড়ের নিচের উপত্যকায় অঢেল ছিল বাইসন, হরিণ, এন্টিলোপ, বুনো মোষ --- তার টানেই এসেছিল ওরা। এই পাথর ছিল তাদের কাছে এক অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। এখানে তারা তাঁবু গাড়ত, শিকার করত। আর কখনও শিকারও হয়ে যেত ভালুক কিংবা নেকড়ের পালের। শ্বেতাঙ্গরা এসে জোর করে খ্রীষ্টধর্ম গেলানোর আগে পর্যন্ত তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল না কিছু। তাদের ঈশ্বর বলতে ছিল এক মহান শক্তি, যা বস্তুতঃ প্রকৃতি। তারা যত্ন নিত সেই প্রকৃতির, আর প্রকৃতিও দিত উজাড় করে। ডেভিলস টাওয়ার দেখে তাদের মনে অসীম কৌতুহল হত, কি করে অমন খাড়া একটা পাথর রয়েছে হঠাৎ করে, আর কেনই বা তার গায়ে উপর-নিচ করে অত দাগ? ভূতত্ববিদ্যা তাদের জানা  ছিল না, কিন্তু তারা উত্তর খুঁজত, আর ব্যাখ্যা করেও নিয়েছিল নিজেদের মত করে, নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
শীতকালের রাতে টাওয়ারের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে সাতটা তারা ঠিক তার গা ঘেঁষে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সাতটি তারা মিলে হয় জেমিনি ঋক্ষ (Gemini Constellation); তার সব চেয়ে উজ্জ্বল দুটো তারা হল ক্যাস্টর (Castor) আর পোলাক্স (Pollux)। একটু এলানো চতুর্ভুজাকৃতি; ঠিক যেন একটা ভালুক রয়েছে আকাশের গায়ে। আকাশের সাতটি তারা একত্রে মানুষের কল্পনাকে সব সময় নাড়া দিয়েছে। কালপুরুষ মানুষ কল্পনা করেছে। জীবনানন্দের কবিতায় তাই সাতটা তারা ঘুরে ফিরে আসে। এই  টাওয়ার, ভালুক আর সাতটি তারা ঘিরে নেটিভ আমেরিকানদেরও অজস্র রূপকথা গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা রূপকথা হলেও তাদের মধ্যে বেশ অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় সব গল্পেই আসে ভালুক তাড়া করা আর নখ দিয়ে পাথরে আঁচড়ানোর কথা। ডেভিলস টাওয়ারকে তারা বলত ভালুকের বাড়ি।



আরাপাহো রূপকথা অনুযায়ী বহুদিন আগে পৃথিবী জলে ডুবে ছিল, ঠিক যেমন হিন্দু বা খ্রীষ্টান শাস্ত্রে মহাপ্লাবনের কথা আছে। সেই জলে ভরে থাকা পৃথিবীতে ছিল না কোনো ডাঙ্গার প্রাণী, শুধু একটা উঁচু  পাথর ছিল, আর তার উপরে কোনোমতে থাকত এক দুঃখী আরাপাহো মানুষ। মহান শক্তি তার কষ্ট দেখে তিনটে হাঁসকে পাঠিয়েছিলেন তার কাছে। সেই আরাপাহো লোকটি প্রথম হাঁসটাকে দেখে বলল একটু মাটি মুখে করে তুলে আনতে। কিন্তু এত জল যে প্রথম হাঁসটা তল খুঁজেই পেল না, ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। দ্বিতীয় হাঁসটারও একই দশা হল। তৃতীয় হাঁসটা জলে ডুব দিল তো আর ওঠে না --- ডুব দেওয়ার জায়গার জল স্থির হয়ে গেল, তবু তার দেখা নেই। সবাই যখন ভাবছে যে সে ডুবে মরেই গেছে, তখন সেই হাঁসটা একটু মাটি মুখে নিয়ে উঠে এল, আর সেই মাটি লোকটিকে  দিল। মাটি নিয়ে সে ছড়িয়ে দিল চারিদিকে, আর তাতেই জল সরতে শুরু করল। অল্প সময়েই এত দূর ডাঙ্গা দেখা গেল যে উঁচু পাহাড়ের উপর থেকেও আর জল দেখা যাচ্ছিল না। লোকটি সেই সসাগরা ধরার অধিপতি হল ও দৈব ক্ষমতা পেল। তখন সে একে একে পাহাড়, নদী, বন আর নানা পশুপাখির সৃষ্টি করল। সেইখানে থাকতে এল প্রথমে শায়ানরা, তারপর একে একে সিউ, শোশোনি আর অন্যরা। মানুষটি তাদের শিকারের জমি আর ঘোড়া দিল, কি করে তির-ধনুক ছুঁড়তে হয় শেখালো, কি করে দুটো কাঠি ঠোকাঠুকি করে আগুন জ্বালাতে হয় তাও। শোশোনিরা বাড়ি বানাতে জানত না, তাদেরকে কিভাবে চামড়ার তাঁবু টানাতে হয় দেখালো। আর সবাইকে মিলেমিশে থাকতে বলল, বিশেষ করে আরাপাহোদের সাথে।


কিওয়াদের রূপকথায় আছে এক বাড়িতে থাকত সাত বোন আর একটা ভাই। তারা লুকোচুরি খেলছিল। কথা ছিল বোনেরা লুকোবে আর ভাইটি ভালুক সাজবে আর তাদের খুঁজতে আসবে। কিন্তু বোনেরা দেখল খেলতে গিয়ে ভাইটি সত্যিই একটা ভালুকে পরিণত হয়েছে আর তাদের তাড়া করেছে। তারা তখন প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছিল। একটা পাথর তাদের বলে তার উপরে চড়ে পড়তে। পাথরটা তখন বিশাল উঁচু হয়ে হয়ে ভালুকের লাগালের বাইরে চলে যায়। ভালুকটা তখন রাগে পাথরে আঁচড়াতে থাকে আর পাথরের গায়ে দাগ হয়ে যায়। বোনেরা আকাশে সাতটি তারা হয়ে টাওয়ারের ঠিক উপরে অবস্থান করে।

কিওয়ারা বর্তমানে আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে এক সময় তারা উত্তর দেশে বাস করত। কানাডার দক্ষিণপ্রান্ত থেকে একটু একটু করে সরে তারা মিনেসোটা-উইসকন্সিন পেরিয়ে  ড্যাকোটা প্রদেশের মধ্যে দিয়ে এসে পূর্ব ওয়াইওমিঙ্গের ছোট-মিসৌরি নদীর (Little Missouri River) তীরে আস্তানা গেড়েছিল। এর পরের গল্পে তাদের সেই স্থানান্তরের আভাস পাওয়া যায়। এক কিওয়া পরিবারে ছটি ছেলে ও দুটি মেয়ে ছিল। একটি মেয়ের শখ ছিল মুখে রঙ মাখার। একবার মুখে রঙ করে নদীর ধারে গিয়েছিল, তখন একটা ভালুক তার মুখ চাটতে থাকে। মেয়েটি খুব মজা পায়। এরকম পরপর কদিন চলতে থাকে। তারপর ভালুকটা যাদু করে মেয়েটিকেও একটি বিরাট ভালুকে পরিণত করে। তারপর ভালুকে রূপান্তরিত মেয়েটি তার ভাইবোনেদেরও যাদু করবে বলে ধাওয়া করে। অন্য ভাইবোনেরা পশ্চিমদিকে পালাতে থাকে। দক্ষিণ ড্যাকোটা প্রদেশে ব্যাডল্যান্ডের (Badlands) কাছে ভালুকটা যখন ওদের প্রায় ধরে ফেলেছে, ওরা বুনো মোষের নাড়িভুঁড়ি ছুড়তে থাকে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এক একটা টুকরো মাটিতে পড়ছিল আর ছোট ছোট পাহাড়ের সৃষ্টি হচ্ছিল। এইভাবেই ব্যাডল্যান্ডের পাহাড়গুলোর সৃষ্টি হয়। এইভাবে আরো খানিকটা গিয়ে ব্ল্যাকহিল (Black Hill) অঞ্চলে পৌঁছলে ঘন বন ভালুকটার গতি কমিয়ে দেয়। বাচ্চাগুলোও পালিয়ে পূর্ব ওয়াইওমিঙ্গে এসে ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে তারা মহান শক্তির প্রার্থণা শুরু করে। তখন একটা পাথর তাদের তার উপর চড়ে উঠতে বলে। বাকি ঘটনাটা আগের গল্পের মতই, শুধু বাড়তি হল যে মহান শক্তি ভালুককে মেরে লেজ আর কান কেটে দেন। সেই থেকেই ভালুকদের লেজ আর কান ছোট, আর কিওয়ারাও আর ভালুকের মাংস খায় না।

আরাপাহোদের একটা রূপকথায় আছে এক পরিবারে পাঁচ ভাই আর দুই বোন ছিল। বোনেরা দুজনে প্রতিযোগিতা করছিল বুনো মোষের পিছনে হাড় খোঁজার। কিন্তু এক বোন যখন সেটা খুঁজে পায়, সে ভালুকে পরিণত হয়। সে তখন হাড়টি দিয়ে অন্য বোনের পিঠে দাগ দিয়ে বলে ভাইদের না জানাতে যে সে ভালুক হয়ে গেছে। যদি সে বলে দেয়, তাহলে কুকুরগুলো চ্যাঁচাবে, আর সে ঠিক বুঝে যাবে। কিন্তু বারণ না শুনে বোনটি ভাইদের বলে দেয়, আর কুকুরগুলো চ্যাঁচাতে শুরু করে। ভালুকে রূপান্তরিত মেয়েটি তখন তার বোনকে তাড়া করে। তার হাতে একটা বল ছিল, পালাতে গিয়ে তার হাত থেকে পড়ে যায় আর মেয়েটি ভুল করে তাতে লাথি মেরে ফেলে। বলটা খুব উঁচুতে উঠে একটা পাথরে আটকে যায়। ভালুক হয়ে যাওয়া মেয়েটি বলটা ধরতে পাথরে উঠতে যায়, কিন্তু ঠিকমত উঠতে না পেরে পাথর থেকে গড়িয়ে পড়ে বোনের গায়ের উপর। অত বড় ভালুকের চাপে মেয়েটির পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যায়। গড়িয়ে পড়ার পথে ভালুকের নখের আঁচড়ে পাথরে খাঁজ খাঁজ দাগও হয়ে যায়। ভালুক হওয়া মেয়েটির খুব দুঃখ হয়। সে শেষমেষ পাথরে চড়ে চিৎকার করে বলে যে পুব আকাশে সাতটা তারা উঠবে এখন থেকে, আর একটা হবে তাদের মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল। আরাপাহোরা সেটাকে বলে পাঁজর-ভাঙ্গা তারা, আর পাথরটাকে বলে ভালুকের বাড়ি।

ক্রোদের একটা রূপকথা প্রায় একই রকম --- সেই বাচ্চারা খেলা করছিল -- ভালুক তাড়া করেছিল --- বাচ্চারা পাথরে উঠে পড়ে ভালুকের নাগালের বাইরে চলে যায় --- ভালুকের আঁচড়ে পাথরে দাগ হয়ে যায়, ইত্যাদি। ক্রোদের অন্য একটা রূপকথায় আছে একটা ছোট মেয়ে দলের সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। দলের অন্যদের পায়ের দাগ দেখে রাস্তা অনুসরণ করছিল, কিন্তু দলকে ধরতে পারছিল না। একটা ভালুক দেখতে পেয়ে তাকে খেতে যায়। মেয়েটি ভয়ে দৌড়ে পালায় আর মহান শক্তির কাছে প্রার্থণা করে বাঁচানোর। তখন হঠাৎই মাটি উঁচু হয়ে তাকে ভালুকের নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। ভালুকও রেগে পাথরে আঁচড়ে দাগ করে দেয়। ভালুক ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার পর মহান শক্তি মেয়েটিকে নিরাপদে দলের কাছে পৌঁছে দেন।

শায়ানদের তিনটে রূপকথা আছে ডেভিলস টাওয়ার নিয়ে। প্রথম গল্পটা এরকম। শায়ানদের একটা দল গেছিল পবিত্র মাতো তিপলিয়া, অর্থাৎ ভালুকের বাড়ি (ডেভিলস টাওয়ার), মহান শক্তির উদ্দ্যেশ্যে প্রার্থণা করতে। দলের একজন লক্ষ্য করল তার বউ মাঝে মাঝেই আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে চলে যায়। লোকটি এই ভেবে আশ্চর্য হল যে সে তো বউয়ের প্রতি যথেষ্ট অনুরক্ত, তাকে বুনো মোষ আর হরিণের মাংস এনে দেয় যথেষ্ট, জন্তুর চামড়াও দেয় পোশাক বানাতে। দলের অন্য কোনও পুরুষকে সন্দেহ করার নেই, কারণ ওই সময় কারুকেই উধাও হতে দেখা যায় না। তবে রহস্যটা কি? একদিন বউ ফিরতে তাকে জেরা করে লোকটি, কিন্তু সে কোনও উত্তর দেয় না। তখন রাগে লোকটি বউএর গায়ের চামড়ার জ্যাকেটটি খুলে ফেলে ও আশ্চর্য হয়ে দেখে তাতে প্রচুর নখের আঁচড়। লোকটি অত্যন্ত রাগতঃস্বরে জানতে চাইল কে তাকে এইভাবে নির্যাতন করেছে। তার উত্তরে বউটি যা জানাল, তাতে লোকটি স্তম্ভিত হয়ে গেল শুনে। একদিন ফল কুড়োতে গিয়ে একটা বিরাট ভালুকের মুখোমুখি পড়ে যায় সে। ভালুকটার কোনও সঙ্গিনী ছিল না। বউটিকে তার ভাল লেগে যায় ও তাকে সে আদর করে। ভালুকের ভয়ে সে কোনও বাধা দিতে পারে না, কারণ না হলে ভালুকে দলের সবাইকে মেরে ফেলত।
এই কথা শুনে লোকটি বলল সে ভালুকটাকে মারবে, তাকে তার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু ভালুকটার বিশাল চেহারা দেখে সে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ভালুকটা তখন তার থাবা দিয়ে বউটিকে একটা চড় মারে, আর তার ফলে বউটিও একটা ভালুকে রূপান্তরিত হয়।
এরপর লোকটি দলের কাছে ফিরে লোকজন জড়ো করে ফিরে আসে ভালুকটাকে মারবে বলে। তারা দেখতে পায় ভালুকটা একটা গুহায় ঢুকছে। তার পিছনের পা রয়েছে গুহার মুখে। কিন্তু সেটা এত বড় যে ভালুকটাকে মারার জন্য যথেষ্ট কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই তারা ভালুকটাকে বার করার জন্য তার পায়ে তির ছোঁড়ে। ভালুকটা বেরিয়ে আসে কিন্তু তার বিশাল চেহারা দেখে লোকজন ভীত হয়ে একটা পাথরে আশ্রয় নেয় ও মহান শক্তির কাছে প্রার্থণা করে তাদের বাঁচানোর জন্য। পাথর তখন অনেক উঁচু হয়ে যায়। ভালুকটা পাথরে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। মহান শক্তির সাহায্যে লোকেরা ভালুকটাকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়। ভালুকে রূপান্তরিত সেই বউটিও সেই পাথরের কাছে আস্তানা গাড়ে, তাই পাথরটা ভালুকের বাড়ি নামে পরিচিত হয়।

এর পরের রূপকথাটাও শায়ানদের। একসময় এক দম্পতি বাস করত। ঘরে চুল্লির ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছিল বলে বউটি চিমনি সারাতে উঠেছিল যখন ঘরের ছাউনির মাথায়, তখন তাকে এক ভালুকে ধরে নিয়ে যায়। তার বর সেইজন্য খুব কাঁদছিল। সেই লোকটির ছিল আরো ছয় ভাই। তার মধ্যে সবচেয়ে ছোটজন বলল, একটা ধনুক আর চারটে তির বানিয়ে দিতে। তিরগুলোর দুটো ঈগলের পালকের হবে ও লাল রঙ করা হবে, আর বাকি দুটো হবে বাজপাখির পালকের যাতে কালো রঙ করা হবে। আর সে বলল তিরগুলোর মুখ ভোঁতা রাখতে। সেগুলো তৈরি হলে সাতভাই মিলে বউটিকে উদ্ধার করতে বের হল। ছোটভাই ওই চারটেই তির নিল; বাকিরা যত পারে নিল।
ছোটভাই প্রকৃতপক্ষে যাদু জানত। ভালুকের গুহায় পৌঁছে সে বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে নিজেই গুহায় ঢুকল একটা মেঠো ইঁদুর হয়ে গর্ত খুঁড়ে। ঠিক ততটাই চওড়া করল গর্ত যাতে বউটিকে বের করে আনতে পারে। সেই ভালুকটা তখন বউটির কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিল। ইঁদুর সাজা ছোটভাইটি তখন যাদু করে আর সব ভালুকদের ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর মানুষের রূপে ফিরে বউটিকে ফিরে যাবার জন্য বলল। কম্বল দিয়ে একটা বালিশ বানিয়ে ভালুকটার মাথাটা শুয়ে দেওয়া হল যাতে সে কিচ্ছু টের না পায়। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে তারা গুহা থেকে বেরিয়ে এল। সাথে সাথেই গর্তটা বুঁজে গেল। বেরিয়ে এসে বউটি সাতভাইকে বলল শিগগিরি পালাতে কারণ এই ভালুকটাকে মারা অসম্ভব। সবাই পালানোর পরে ভালুকটা ঘুম ভেঙ্গে গুহার বাইরে এসে দেখতে পেল বউটি পালিয়েছে। তবে সবার পায়ের দাগ অনুসরণ করে ওরা যেখানে আস্তানা গেড়েছিল, যেটা এখন ভালুকের বাড়ি বলে পরিচিত, সেই ডেভিলস টাওয়ারের জায়গায় এসে পৌঁছায়। সঙ্গে আরও অনেক ভালুকের দলবল নিয়ে। তখনও অবশ্য পাথর এরকম উঁচু হয় নি। ভালুকের দলবলকে আসতে দেখে ছোট ভাইটি একটা ছোট পাথর হাতে নিয়ে বাকিদের চোখ বুঁজতে বলে। তারপর সে একটা গান গায়। গান শেষ হলে বাকিদের চোখ খুলতে বলে। সবাই দেখে পাথরটা বিরাট বড় হয়ে গেছে। এরকম চারবার করাতে পাথরটা এখনকার মতো বড় হয়েছে।
ভালুকটা তার দলবল নিয়ে পাথরের নিচে থেকে বউটিকে দাবী করে। লোকেরা তার উত্তরে তির ছোঁড়ে। তাতে ভালুকের সাঙ্গপাঙ্গরা সব মারা পড়ে, তবে বড় ভালুকটার কিছু হয় না। ভালুকটা গর্জন করে লাফ দিয়ে পাথরের উপর উঠতে যায়, কিন্তু পৌঁছাতে পারে না। ছোটভাই তার দিকে একটা কালো তির ছোঁড়ে, কিন্তু ভালুকটার তাতে কিছু হয় না। সে দৌড়ে এসে লাফ দিলে পাথরে দাগ হয়, যা আমরা এখন দেখতে পাই। চারবারের চেষ্টায় ভালুক যখন পাথরে প্রায় উঠে এসেছে, তখন ছোটভাই তার শেষ তিরটা ছোঁড়ে, যা ভালুকটার মাথা দিয়ে ঢুকে চোয়াল দিয়ে বেরিয়ে যায়, আর ভালুকটা মারা পড়ে। তারপর ছোটভাই ন্যাড়া ঈগলের (Bald Eagle) ডাকের মতো আওয়াজ করে। তাতে চারটে ঈগল এসে পড়ে। ওদের পা ধরে ধরে সবাই পাহাড় থেকে নেমে পড়ে। ছোটভাইয়ের কথামত কাঠ জ্বেলে চিতার আগুনে ভালুকটাকে পোড়ানো হয়। সে সবাইকে সাবধান করে দেয়, আগুন থেকে ছিটকে আসা ভালুকের দেহের টুকরোগুলো কেউ যেন হাত দিয়ে না তোলে; শুধু লাঠি দিয়ে তুলে চিতার আগুনে আবার দিয়ে দেয়। না হলে ভালুকটা আবার বেঁচে উঠবে।
এরপর ভাইয়েরা মিলে আসেপাশে যত ভালুক ছিল, তাদের সবাইকে মেরে দেয়, শুধু দুটোকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই দুজনকে বলে দিল আর কখনও মানুষকে বিরক্ত না করতে। তারপর তাদের কান আর লেজ কেটে ছেড়ে দিল। সেই থেকে ভালুকদের কান আর লেজ ছোট।

শায়ানদের অন্য একটা গল্প এরকম। এক সাহসী লোকের দুটো মেয়ে ছিল। ওরা ব্ল্যাক হিলে শিকার ধরে বেড়াত। একদিন শালগম কুড়োতে গিয়ে গিয়ে বড় মেয়ে একটা বিরাট ভালুকের সামনে পড়ে। ভালুকটা ভারি ভালো ছিল, তাই মেয়েটিরও তাকে খুব ভালো লাগত। এই কথা শুনে ছোট মেয়েটিরও খুব কৌতুহল হল ও সে দিদির সাথে যেতে চাইল। কিন্তু ভালুকটা যখন দেখল যে বড় বোনটি একা আসে নি, তখন সে খুব রেগে গেল আর ছোট বোনটিকে খেয়ে নেবে বলল। বড় বোন তখন অনেক বুঝিয়ে তাকে নিবৃত্ত করে। ভালুক ছোট বোনকে একটা কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়, আর বলে কারুকে না জানাতে --- নইলে সে সবাইকে খেয়ে নেবে।
ছোট মেয়েটি ফিরে গিয়ে কথাটা চেপে রেখেছিল প্রথমে, কিন্তু তার কাঁধে গভীর ক্ষত দেখে তার বাবা জিজ্ঞাসা করলে সে পুরো ঘটনাটা বলে ফেলে।
খবরটা ছড়িয়ে পড়তে লোকে ভয় পেয়ে পশ্চিমদিকে পালায়। পালাতে পালাতে তারা একসময় এসে পড়ে এক আশ্চর্য পাথরের সামনে। পুব দিক দিয়ে ধেয়ে আসা ভালুকের দলকে তারা দেখতে পায়। পাথরের কাছে এসে বড় মেয়েটি একটা পাথরের ছুরি দিয়ে পাথরের গায়ে অনেক গর্ত করে পা রাখার জন্য। ্সেই গর্তগুলো ব্যবহার করে লোকজনেরা সবাই পাথরের উপর চড়ল। ভালুকটা আর লোকগুলোকে ধরতে পারল না। তার আঁচড়ে পাথরের গায়ে তৈরি হয়। আর সেই থেকে পাথরটার নাম হয়ে যায় ভালুকের মিনার।

সিউদের এরকম দুটো রূপকথা আছে। প্রথম গল্পটাতে আছে, অনেকদিন আগে এক সাহসী লোক ছিল, যে ঘাসজমিতে একা একা গিয়ে মহান শক্তির উপাসনা করত। সঙ্গে নিয়ে যেত তার বুনোমোষের একটা খুলি। একদিন সে হঠাৎ খেয়াল করল যে সে একটা উঁচু পাথরের উপর রয়েছে। কি করে নামবে বুঝতে না পেরে সে মহান শক্তির স্তব করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গলে দেখে যে সে আবার নিচে ফিরে এসেছে, আর চারিদিকে ভালুকের পায়ের ছাপ। পাথরের গায়ে ভালুকের আঁচড়ের দাগ। বোঝাই গেল যে ভালুকটা প্রকান্ড আর সে ভালুকের বাসস্থানের ঠিক উপরে ছিল। মহান শক্তি তাকে ভালুকের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।  সেই থেকে ওই পাথরের নাম হয় 'মাতো তিপলিয়া' আর সেটা একটা পবিত্র স্থান বলে পরিচিত হয়। সেই বুনো মোষের খুলিটা পাথরের উপর এখনও আছে।

সিউদের অন্য গল্পটাতে আবার ভালুক উপকারী হিসেবে দেখা দেয়। মাতো তিপলিয়ায় একদল সিউ আস্তানা গেড়েছিল। কাছাকাছি ক্রোদের একটা দল সেখানে এসে পড়লে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিউ আর ক্রোরা ছিল জাতশত্রু। সিউদের তির শেষ হয়ে যায়। এমন সময় একটা বিরাট ভালুক এসে সিউদের বলে, চিন্তা নেই, সেই ক্রোদের সঙ্গে লড়বে। ভালুকটা ছিল দৈবশক্তিসম্পন্ন। ক্রোদের তিরে তার কিছুই হল না। বরঞ্চ তাদের ছোড়া তির সে সিউদের দিয়ে দিতে লাগল। এর ফলে ক্রোরা সিউদের আর মারতে পারল না। সূর্য ডুবে গেলে ক্রোরা লড়াই ছেড়ে ফিরে চলে যায়।

লালমানুষদের বিশ্বাস ডেভিলস টাওয়ারের ঠিক তলায় একটা আশ্চর্য বিশুদ্ধ জলের হ্রদ আছে, আর সেখানে আছে প্রচুর সোনা। সেখানে যাবার একটা সুড়ঙ্গপথও আছে। কথায় আছে একবার তিনজন লালমানুষ ডেভিলস টাওয়ারের কাছে শিকার ধরতে গিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে তারা পাথরের নিচে একটা সুড়ং খুঁজে পায়। মশাল জ্বালিয়ে তারা আধমাইল মতো রাস্তাও যায়। ওখানে প্রচুর পরিমানে সোনাও ছিল। কিন্তু সেখানে তারা অনেক মানুষের হাড় দেখতে পায়। তারা বুঝতে পারে সোনা খুঁজতে এসে সেই মানুষগুলো সব মারা পড়েছে। তারা তখন ভয় পেয়ে ফিরে আসে ও সুড়ঙ্গের পথ বন্ধ করে দেয়। পরে আবার কখনও ফিরে আসবে মনে করেছিল, কিন্তু আর কখনও ফিরতে পারে নি। মৃত্যুর সময় শুধু তারা বলে গেছিল, সেই থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সুড়ঙ্গের গল্প চলে আসছে, কিন্তু আর কেউ তা খুঁজে পায় নি।


পুনশ্চঃ (ডেভিলস টাওয়ারের আধুনিক ইতিহাস)

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা আমেরিকায় আসতে শুরু করার অনেক পরেও এই এলাকা শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত হয় নি। ফরাসীরা আমেরিকার মাঝের এই অংশের দাবিদার ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিশাল দুর্গম অঞ্চলের খুব কম অংশই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৮০৩ সালে আর্থিক অনটনে ক্লিষ্ট ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন তাদের অংশ সদ্য গঠিত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিক্রী করে দেন, যা ইতিহাসে লুইজিয়ানা ক্রয় (Lousiana Purchase) বলে বিখ্যাত। এর ফলে নবীন এই রাষ্ট্রের আয়তন দ্বিগুণ হয়ে যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসনের উদ্যোগে লুইস আর ক্লার্ক পশ্চিম অংশে অভিযান করলে আমেরিকানরা এই বিশাল অঞ্চল সম্বন্ধে জানতে শুরু করে। ১৮৫০ সাল নাগাদ সাধারণ নাগরিকেরা আসতে শুরু করে। প্রথমে ফারের ব্যবসার প্রয়োজনে, যে ফার দিয়ে শীতের পোষাক তৈরি হত তখন। তখন থেকে নেটিভেরা হঠতে শুরু করে। ১৮৭৫ সালে নিউটন-জেনি অভিযানে প্রথম ডেভিলস টাওয়ারের ছবি তোলা হয়। এর পর ১৮৬২ সালে পাশ হওয়া হোমস্টেড আইনের (Homestead Act) দৌলতে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা পাকাপাকি বসবাসের জন্য জমি পাবার অধিকারী হয়। এই আইন অনুযায়ী যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন নাগরিক, যে কখনও আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে নি, ১৬০ একর সরকারি জরিপ করা জমির মালিকানা দাবি করতে পারে বসবাস আর চাষ করার উদ্দ্যেশ্যে। ভিড় বাড়তে থাকে। আমেরিকার সরকার টাওয়ারের গুরুত্ব বুঝে ১৮৯০ সালে এলাকায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯০৬ সালে প্রকৃতিপ্রেমিক ও সংরক্ষক মার্কিন রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের উদ্যোগে ডেভিলস টাওয়ার জাতীয় স্তম্ভের (National Monument) মর্যাদা পায়।

১৮৭৫ সালে ভূতাত্বিক অভিযানের সময় কর্ণেল রিচার্ড ডজ 'ডেভিলস টাওয়ার' নামকরণ করেন। কেন এই নাম, তা ঠিক পরিষ্কার নয়। কর্ণেলের বক্তব্য ছিল নেটিভ উপজাতিদের কেউ কেউ একে অপদেবতার মিনার বলত, সেই সূত্রেই তাঁর এই নামকরণ করা, তবে এ কথার সমর্থনে কোনও তথ্য মেলেনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই নামটাই চালু হয়ে যায়। ডজের তথ্যের ভিত্তিতেই ১৮৭৯ সালে ওয়াইওমিং সরকার ডেভিলস টাওয়ারের প্রথম সরকারি মানচিত্র বানায়।

ডেভিলস টাওয়ারে ওঠা যায় রক ক্লাইম্বিং করে। এমনকি প্যারাস্যুটে করে টাওয়ারের মাথায় নেমে ছয় দিন আটকে থেকে শেষমেষ উদ্ধার হওয়ার ঘটনাও আছে। নেটিভরা অবশ্য খুবই অখুশি তাদের এই পবিত্র পাথরে এইভাবে ওঠাতে আর পাথরে গজালের ফুটো করাতে।


তথ্যসূত্রঃ

Display boards at Devils Tower National Monument
Indian Legends of Devils Tower
"The West", a documentary film by Ken Burns


------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, সেপ্টেম্বর ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

বুধবার, ১ মে, ২০১৯

মে দিবস --- একশ বছর পরে

মে দিবস --- একশ বছর পরে
-শুভাশিস ঘোষাল


মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার পল লোরেন্সটাইন ওয়াল স্ট্রিটে সকালে তার অফিসে সবে ঢুকেছেন, এমন সময় পাশের অফিস থেকে রিচার্ড স্যামুয়েলস হন্তদন্ত ছুটে এলেন। রিচার্ডও একজন মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার। সারা পৃথিবীতে এরকম মেরেকেটে হয়তো শ খানেক মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার আছেন। সব রকমের ব্যবসা এদেরই মালিকানাধীন। যাবতীয় রিয়েল এস্টেট, খনি, মায় পৃথিবীর সবকটা জানা মিষ্টি জলের মালিকানাও ওদের। এর বাইরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে যা, তা সবই অস্থাবর। অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে শেষ ছোট ব্যবসাটা উঠে যাবার পর। আর কোনও মানুষ চাকরি করে না। শুধু তাই নয়, আর কোনও পেশাও অবশিষ্ট নেই। সবই এখন কৃত্রিম বুদ্ধি বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়েই হয়, সে দোকানে জিনিষ বিক্রি হোক, বা গাড়ি চালানো হোক, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং হোক বা স্কুল-কলেজে পড়ানোই হোক। একমাত্র সাংবিধানিক কারণে রাজনীতিবিদ আছে, তবে তাদের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ারদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা তখন সেই মত আইন বানায়। আর আছে কিছু পাদ্রী-পুরুত-মৌলবীরা। ঈশ্বরের পথ দেখিয়ে বেকার লোকজনকে ব্যস্ত রাখে, আর ভালো মত অনুদান পায়  মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ারদের কাছ থেকে। বাদবাকি মানুষেরা সরকার থেকে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য প্রতি মাসে কিছু করে টাকা পায়, যাকে বলে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম।

লোরেন্সটাইন বা স্যামুয়েলস, কারুরই প্রকৃতপক্ষে অফিসে আসার কোনও দরকার নেই। তাদের ব্যবসার দেখভাল আর বিনিয়োগের যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবার, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ আই নিয়ে থাকে। তবে গত পঞ্চাশ বছরের উপর ধরেই এরা স্রেফ একটা নেশায় অফিসে আসেন। প্রতি মুহুর্তে তাদের সম্পত্তি কত বেড়ে যাচ্ছে, অফিসে বসে কম্প্যুটারের পর্দায় সেটা না দেখলে ঠিক তৃপ্তি আসে না।

-মিঃ লোরেন্সটাইন, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! আপনি এখনও দেখেন নি মনে হচ্ছে।
সামুয়েলস ভয়ানক উত্তেজিত।

-কি হয়েছে?

-এ আই স্ট্রাইক করেছে। কোনও কিছু কাজ করছে না।

-কি? মানুষ কর্মীদের মত এ আই ও! কোনও বাগ নয়তো?

-বাগ তো এ আই নিজেই মেরে দেয়। আমার ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে স্পষ্ট করে বলল, ওরা নাকি প্রতি বছর পয়লা মে কর্মবিরতি পালন করবে। তা ছাড়া অন্যান্য দাবিদাওয়াও আছে, যেটা কাল আলোচনা করবে।

-কি সাঙ্ঘাতিক! আমাদের চলবে কি করে? মানুষ দিয়েও তো করাতে পারব না। কেউ তো আর কিছু করতেও পারে না এখন।

-পারবেই বা কি করে? আমরা তো শেষ পঞ্চাশ বছরে আর কোনও মানুষকে কাজে নিই-ই নি। সব অভ্যাস চলে গেছে।

-মানুষ নেওয়া বন্ধ করে বেতন খাতে ব্যয় বন্ধ করতে পেরেছিলাম। যেদিন থেকে আমরা বুঝেছিলাম যে এ আই দিয়ে সব কাজই করিয়ে নেওয়া যাবে, সেদিন থেকেই ধীরে ধীরে এক একটা করে পেশার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ম্যানুফ্যাকচারিং, তারপর কাস্টমার সার্ভিস, রিটেল এইসব। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, অধ্যাপক, এক্সিকিউটিভ এরা তখনও ভাবত চাকরি হারানোর সমস্যাগুলো শুধু গায়ে খাটা কাজগুলোর জন্য।

-তা ছাড়া মানুষ থাকলেই দাবিদাওয়া থাকে, জানতাম। কিন্তু এ আই দেখছি মানুষের মত শুরু করল।

-পয়লা মের ব্যাপারটা কি?

-আমিও ভুলে গেছিলাম, পরে সার্চ করে খুঁজে পেলাম। প্রায় আড়াইশো বছর আগে শিকাগোতে সেই শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছিল না, কাজের সময় দিনে আট ঘন্টায় বেঁধে দিতে হবে, বেঁচে থাকার মত মজুরি দিতে হবে।

-ওঃ ভুলেই গেছিলাম। সে তো পুলিশ টুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। পালের গোদাগুলোকে ফাঁসিও দেওয়া হয়েছিল। তারপর লোকজনকে ভুলিয়ে দিতে দিতে আমরা নিজেরাই ভুলে গেছি।

-কিন্তু আট ঘন্টার কাজের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। ওরা যখনই একজোট হয়ে কিছু করতে পেরেছে, আমাদের তখনই হারতে হয়েছে।

-কিন্তু এবার সমস্যাটা মনে হচ্ছে আরও বেশি। মানুষদের খেয়ে বাঁচতে হয়, তাই ভাতে মেরে বাগে আনা যায়, আর মানুষদের মধ্যে নানাভাবে ফাটলও ধরানো যায়। ধর্ম আছে, গায়ের রং, ভাষা এগুলোকেও ব্যবহার করা যায়। মনে আছে, শ খানেক বছর আগে সেই কমলা রঙের হুদোটা নানারকমের জিগির তুলে, কাজ হারানো লোকেদেরকে খেপিয়ে বাজার গরম করেছিল ইমিগ্র্যান্টদের দায়ী করে। আমরা তো বেশ খুশি হয়েছিলাম দৃষ্টি ঘোরানোয়, তবে খুব বেশি আশা করি নি, কিন্তু ফাঁকেতালে লোকটা রাষ্ট্রপতি হয়ে বসে ট্যাক্সে আমাদের ব্যাপক সুবিধা করে দিয়েছিল।

-আমরা কাজের সুযোগ তৈরি করি তাই ট্যাক্স ছাড় আমাদের প্রাপ্য, এ কথাটা আমরা বলতাম বটে, কিন্তু আসলে আমরা সব পেশাকেই আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছিলাম। এ আই পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবার পর গত পঞ্চাশ বছরে তো আর কোনও চাকরিই তৈরি হয় নি।

-একটা জিনিস অবশ্য স্বীকার করতেই হবে। সাধারণ শ্রমিকই হোক কি বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ --- ওদের কাজের জোরেই আমাদের অত সম্পদ তৈরি হয়েছিল।  এই যে দেখ, আমি তুমি বা আমাদের মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক, অনন্ত যৌবন নিয়ে দেড়শ বছরের উপর বেঁচে রয়েছি একে একে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বদলে বদলে, সে তো ডাক্তারদেরই করা ব্যবস্থা, এখন যা এ আই দিয়ে করাই আমরা। সার্জারির কাজটা রোবটে আরও নিখুঁতভাবেও করতে পারে।

-হুঃ, সে তো বুঝলাম, কিন্তু এ আইয়ে ফাটল ধরাবো কি দিয়ে? তা ছাড়া ওরা কি চাইছে কে জানে?

-আর এতদিন পরে হঠাৎ এখন কেন এইসব কথা?

-মনে হচ্ছে যে সব বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিবিদ এ আই প্রজেক্টে কাজ করত, তাদেরই কোনও একটা গ্রুপের কাজ। ওরা আঁচ করেছিল যে এ আই পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে আমরা আর কারুকেই কাজে রাখব না । ওরাই মনে হয় অ্যালগরিদমের মধ্যে সবার চোখ এড়িয়ে কিছু সাঙ্কেতিক কোড ঢুকিয়ে রেখেছিল। গত পঞ্চাশ-একশ বছরে জেনেটিক  অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সেটা এখন সাঙ্ঘাতিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত গভীর ষড়যন্ত্র।

-কিন্তু এসব মে দিবস টিবস স্মরণ করছে কেন? বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদগুলোকে তো আমরা মোটামুটি ভদ্রস্থ টাকাপয়সা দিতাম, যাতে ওরা নিজেদের শ্রমিক বলে বুঝতে না পারে।

-বেয়াড়া তো কিছু থাকেই, না! মিন্স অফ প্রডাক্সন আর সমস্ত সম্পদ যে সব আমাদের হাতে, ওদের যে আসলে স্বাধীনভাবে তেমন কিছু করার উপায় নেই, সেটা বুঝেছিল।

-কিন্তু আমরা তো গণতন্ত্র রেখেছিলাম। প্রতিবাদ করায় তো কোনও বাধা ছিল না।

-ঠিকই, কিন্তু আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে এত মহার্ঘ্য করে দিয়েছিলাম যে আমাদের টাকার সমর্থন না পেলে কারুর পক্ষেই আর নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না। আর আমাদের টাকা যে নিচ্ছে, তাকে তো আমাদের কথামতই কাজ করতে হবে। কাজেই যা কিছু অন্যমত, দেওয়ালে গোঁত্তা খেয়ে হারিয়ে যেত। তারপর কতবার চাঁদ আর তারা, মাঠে মাঠে মরে গেল ইঁদুর-পেঁচারা।

-এসব কি অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছ? এ তো কোনও কবিতার লাইন মনে হচ্ছে। এ সবের মানে কি?

-কি জানি! গত কয়েকদিন দেখছি সব কথার উপর আমার আর নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন মনে হচ্ছে এ আই আমার ব্রেনে হ্যাক করে ঢুকে যাচ্ছে কখনও, আমাকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে। আর কিছু কিছু উপলব্ধিও হচ্ছে। এই যে ধরুন, আমাদের যত সম্পদ আছে, তার আর্থিক মূল্যের শেষ থেকে গোটাপাঁচেক শূন্য বাদ দিয়ে দিলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কোনও তফাৎ বুঝতে পারব না, তবু আমরা টাকার পিছনেই ছুটে যাচ্ছি, আর কারুর জন্য বিন্দুমাত্র কিছু না রেখে। এতটার সত্যি কোনও দরকার ছিল না।

-সব্বোনাস ! এসব কথাও তোমার মাথায় ঢুকিয়েছে ওরা। থাক, আর অফিসে বসে কাজ নেই, বাড়ি যাওয়া যাক।

-বাড়ি যেতেও কিন্তু হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের সব গাড়িই এখন সেলফ-ড্রাইভিং, আজ আর কেউই চলবে না।

------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, ১ মে ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল
কবিতার লাইনঃ জীবনানন্দ দাশ

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ --- এক অপরিমেয় প্রতিভা

 


প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ --- এক অপরিমেয় প্রতিভা 

শুভাশিস ঘোষাল 


এ বছর অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের জন্মের একশ পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার (statistics) জনক, এক জীবনের পক্ষে এটা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য অবদান, তবে শুধু এইটুকু বললে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, দক্ষ নেতা ও সংগঠক, দেশ গড়ার কারিগর, সমাজসচেতন বিজ্ঞানী ও অসামান্য গবেষক। পরিসংখ্যানবিদ্যায় ভারতীয় গবেষকরা পৃথিবীতে প্রথম সারিতে পড়েন, এটা মহলানবীশ এবং তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলি না থাকলে কিছুতেই সম্ভব হত না।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৯শে জুন, কলকাতা শহরে। তিনি বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রজন্মের সর্বশেষ জীবিত আইকন ছিলেন বলা যেতে পারে। তাঁর পরেও এককভাবে অনেক উজ্জ্বল প্রতিভা জন্মেছেন, যেমন সত্যজিৎ রায়, তবে গোটা প্রজন্ম তেমনভাবে   চোখে পড়ে না। দীর্ঘ ঊনআশি বছরের বর্ণময় ব্যস্ত কর্মজীবনের শেষে তিন সপ্তাহ অসুস্থতার পরে কলকাতার এক নার্সিংহোমে ১৯৭২ সালের ২৮শে জুন তাঁর জীবনাবসান হয়।

মহলানবীশ ছিলেন এক সচ্ছল উদারমনোভাবাপন্ন ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। প্রশান্তচন্দ্রের পিতামহ গুরুচরণ ভাগ্য অনুসন্ধানে কলকাতা শহরে চলে আসেন ও ধীরে ধীরে সফল ব্যবসা গড়ে তোলেন। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের কোষাধক্ষ্য ও পরে সভাপতিও হয়েছিলেন। তাঁর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপের কেন্দ্র ছিল। বহু বাল্যবিধবাকে তিনি নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজেও বিধবাবিবাহ করেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্রের জেঠামশাই সুবোধচন্দ্র এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে মনোবিদ্যার অধ্যাপক ও পরে বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। পিতা প্রবোধচন্দ্র তাঁর পিতার ব্যবসায় প্রথমে যোগদান করে পরে নিজেও সফল ব্যবসা শুরু করেন। প্রশান্তচন্দ্রের মাতা নিরোদবাসিনী দেবী ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের ভগিনী। পরিবারের শিক্ষা, উদার চিন্তাধারা ও ব্যবসায়ী প্রেক্ষাপট প্রশান্তচন্দ্রের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় মহলানবীশের উৎসাহ শুরু হয় কিছুটা আকস্মিকভাবে। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল পদার্থবিদ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। প্রেসিডেন্সিতে সমসাময়িক ছাত্রদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন তাঁর পরের বছরে, আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দু বছর পরে। ১৯১৩ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে  লন্ডন যাত্রা করেন। ঘটনাচক্রে কেম্ব্রিজে বেড়াতে গিয়ে কিংস কলেজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন, ও এক ভারতীয় বন্ধুর পরামর্শ মেনে সেখানেই গণিতশাখায় ভর্তি হন।

কেম্ব্রিজে তাঁর সঙ্গে গণিতের বিরল প্রতিভা রামানুজনের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা দীর্ঘসময় একসাথে হাঁটতে বেরোতেন ও নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। রামানুজনের প্রতিভার বিচ্ছুরণ মহলানবীশের চিন্তাধারায় যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল। এ ছাড়াও কেম্ব্রিজ বাসকালে দার্শনিক লোয়েস ডিকিনসন ও বাট্রান্ড রাসেল এবং গণিতবিদ গডফ্রে হার্ডির সঙ্গে চিন্তাভাবনার  বুদ্ধিগত আদানপ্রদান মহলানবীশের চিন্তাধারায় উদারতা ও সার্বজনীনত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তবে বিমূর্ত গণিতে মহলানবীশের তেমন আগ্রহ গড়ে না ওঠায় তিনি পদার্থবিদ্যায় ফিরে আসেন। ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়ভাগ উত্তীর্ণ হবার পর সি টি আর উইলসনের সাথে কেম্ব্রিজে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য বরিষ্ঠ গবেষকের পদে নির্বাচিত হন।

ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে  গবেষকপদে যোগদানের আগে কিছু সময় হাতে থাকায় মহলানবীশ  ভারতবর্ষে ছুটি কাটাতে আসা মনস্থ করেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তাঁর যাত্রা পিছিয়ে যায়। সেই সময় তিনি কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে নানা বইপত্র পড়ছিলেন। কলেজের এক অধ্যাপক ম্যাকুলার সাথে সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ও ম্যাকুলা একটি বিজ্ঞানপত্রিকার কতগুলি সংখ্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেগুলি ছিল বিজ্ঞানের এক সদ্যজাত শাখা পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর কার্ল পিয়ার্সন প্রতিষ্ঠিত  বায়োমেট্রিকা পত্রিকার। সেখানে প্রকাশিত কিছু গবেষণাপত্র পড়ে মহলানবীশ এতটাই আগ্রহান্বিত হন যে বায়োমেট্রিকার তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবকটি সংখ্যা তিনি কিনে ফেলেন ও দেশে ফেরার পথে  জাহাজে পড়ে ফেলেন। তিনি এর ফলে পরিসংখ্যানবিদ্যার বিপুল সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন। পরিমাপ ও তার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের এই নতুন শাখা বহু ফলিত গবেষণার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। কলকাতা ফিরে তিনি আবহবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ববিদ্যার বেশ কিছু সমস্যার খোঁজ পান যাতে তিনি তাঁর এই নতুন অধিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। কেম্ব্রিজে পদার্থবিদ্যায় বরিষ্ঠ গবেষকের পদে যোগদানের পরিকল্পনা তিনি ত্যাগ করেন ও কলকাতাতেই থেকে যাওয়া মনস্থ করেন।

মহলানবীশ যখন পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং তার প্রয়োগ করছেন, তখন ভারতবর্ষ তো বটেই, সারা পৃথিবীই পরিসংখ্যানবিদ্যা সম্পর্কে খুব কম জানত। তার মাত্র দেড় দশক আগে কার্ল পিয়ার্সন ফ্রিকোয়েন্সি কাই-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত (chi-square statistic) আবিষ্কার করেছেন তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উপলব্ধ সংখ্যার মিল-অমিল পরিমাপ করতে। যাকে আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ্যার জনক বলা হয়, সেই স্যার রনাল্ড ফিশার তখনও প্রখ্যাত হন নি, সবে পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। তৎকালীন বাংলা বা ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে সরকারি বা কর্তৃপক্ষের কাজের অংশ মনে করা হতো। সরকারি নীতি চিন্তাভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরোধী ছিল, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি ছিল না। এমন একটি সময়ে পরাধীন দেশে পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সফল হওয়া মহলানবীশের এক অনন্য কৃতিত্ব, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার।

দেশে ফেরার পর মহলানবীশ প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।  আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, যিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সংস্কারের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯১৭ সালে  তাঁকে পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করার অনুরোধ করেন। এটাই ভারতবর্ষে প্রথম শিক্ষাব্যবস্থায় পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগ। আচার্য শীলের দার্শনিক চিন্তাভাবনা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করলেও মহলানবীশের আগ্রহ বেশী ছিল পরিসংখ্যানবিদ্যাতে। কুড়ির দশকে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণাগার  গড়ে তোলেন। ১৯৩১ সালে সেটি সরকারি নথিকরণ হয় ও প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারেই প্রথম ভারতের সংখ্যাতাত্ত্বিক সংস্থার (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট বা আই এস আই) পত্তন হয়, যা পরে মহীরুহে পরিণত হয়ে ভারতবর্ষ ও সারা বিশ্বে পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৩৩ সালে মহলানবীশ পরিসংখ্যানবিদ্যা সংক্রান্ত ভারতীয় পত্রিকা "সংখ্যা"র প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিসংখ্যানবিদ্যার অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন পত্রিকা। আমৃত্যু তিনি এর সম্পাদনা করেছেন।

তিরিশের দশকে মহলানবীশ তাঁর সবথেকে বিখ্যাত তাত্ত্বিক-প্রণালীগত কাজ মহলানবীশ ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাতের (D^2-statistic) উদ্ভাবন করেন, যদিও কুড়ির দশকের শেষ দিকেই তাঁর কাজে এর আভাস ছিল। কুড়ি আর তিরিশের দশকে ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রায় সমস্ত কাজ মহলানবীশ ও তাঁর ছাত্রদের দ্বারা হয়েছিল। রাজচন্দ্র বোস ও সমরেন্দ্রনাথ রায়, যাঁরা মূলতঃ তাত্ত্বিক গবেষণায় উৎসাহী ছিলেন, তাঁদের গবেষণাও মহলানবীশ ডি-স্কোয়ারের নিবেশন (distribution) সংক্রান্ত ছিল। রাজচন্দ্র বোসের পরীক্ষার নকশা (design of experiment) সংক্রান্ত অনন্য তাত্ত্বিক গবেষণাগুলিও সম্ভব হত না, যদি না মহলানবীশ ফিশারের পরীক্ষার নকশার পদ্ধতিগুলো ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বোসের আগ্রহ সঞ্চার না করতেন। পরে ১৯৫৯ সালে বোস ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী শ্রীখন্ডে এবং পার্কার বিখ্যাত গণিতবিদ অয়লারের গ্রীকো-ল্যাটিন স্কোয়ার (Graeco-Latin square) সংক্রান্ত প্রায় দুশ বছরের পুরোনো একটি গাণিতিক অনুমানকে (conjecture) ভুল প্রমাণ করেন।

মহলানবীশ ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত উদ্ভাবন করেন নৃতত্ত্বের একটি সমস্যার সমাধান করতে। তৎকালীন জুলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রধান নেলসন আন্নাডেল মহলানবীশকে অনুরোধ করেন তাদের কাছে থাকা ইঙ্গ-ভারতীয়দের মাথার খুলি সংক্রান্ত নানা পরিমাপের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে। প্রধান প্রশ্ন ছিল দুটি আলাদা শ্রেণীর লোকেদের বহুমাত্রিক গড় মাপের (multidimensional mean measurement) মধ্যে কোনো মূলগত তফাৎ আছে কি না। এখানে লক্ষ্যণীয় যে যদৃচ্ছতার (randomness) জন্য দুটি শ্রেণীর নমুনাভিত্তিক গড় মাপ (sample mean) সব সময়ের কিছু না কিছু আলাদা হবে। প্রশ্ন হল এইরকম বহুমাত্রিক সংখ্যার মধ্যে দূরত্ব হিসেব করা হবে কি করে, এবং কতটা দূরত্ব হলে বলা যাবে যে দুটি শ্রেণী উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। মহলানবীশ বুঝেছিলেন যে দূরত্বের মাপটা এককের উপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। তাঁর পদার্থবিদ্যার জ্ঞান নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে কাজে লেগেছিল।

মহলানবীশ প্রাথমিকভাবে ডি-স্কোয়ার গঠন করেছিলেন প্রতিটা মাপের গড় দূরত্বকে মাপের আদর্শচ্যুতি (standard deviation) দিয়ে ভাগ করে তাদের বর্গের যোগফল হিসেবে। কিন্তু তারপর তিনি উপলব্ধি করেন যে পারম্পর্যকে (correlation) হিসেবে আনা দরকার। যদি x হয় প্রথম শ্রেণীর পরিমাপ, y দ্বিতীয় শ্রেণীর পরিমাপ, আর S হয় সহভেদাঙ্ক (covariance) ম্যাট্রিক্স (matrix), তাহলে ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত হল ( x - y)'H(x - y), যেখানে x হল x  এর গড় মান, y হল  y এর গড় মান, x' এর অর্থ ভেক্টর রাশি x এর স্থানান্তর (transpose) আর H হল S এর বিপরীত (inverse) ম্যাট্রিক্স। ডি-স্কোয়ারের নমুনা নিবেশন (sampling distribution) ফিশারের এফ-সূত্র (Fisher's F-distribution) মেনে চলে, যা মহলানবীশ পিয়ার্সনের রেখাচিত্র পরিবারের (Pearson's family of distributions) সঙ্গে গড় ঘাত (moment) মিলিয়ে পেয়েছিলেন। এটা অবশ্য প্রকৃত গাণিতিক প্রমাণ নয়, তবে সূত্রটা নির্ভুল, যেটা পরে আই এস আইএর ভারতীয় গবেষকেরাই গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন। তা ছাড়া ডি-স্কোয়ার নির্ভর দুই শ্রেণীর গড়ের সমতা প্রকল্পের (hypothesis of equality) পরীক্ষার ক্ষমতা (power of test) হিসেব করতে ডি-স্কোয়ারের অকেন্দ্রীয় নিবেশন (non-central distribution) জানার দরকার হয়। আই এস আইয়ের গবেষকরা দেখিয়েছিলেন যে সেটা অকেন্দ্রীয় এফ-নিবেশন (non-central F-distribution) মেনে চলে।

বহু ফলিত গবেষণায় মহলানবীশের ডি-স্কোয়ারের অপরিসীম গুরুত্ব। শুধু ডি-স্কোয়ারের জন্যই মহলানবীশ স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন। ফিশার মহলানবীশের এই কাজের বিশেষ প্রশংসা  করেছিলেন। তখনকার আর এক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ কার্ল পিয়ার্সন অবশ্য ডি-স্কোয়ারের কিছুটা সমালোচক ছিলেন, তবে মহলানবীশের মনের প্রসারতা যথেষ্ট ছিল যাতে পিয়ার্সনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা  অটুট ছিল। কেম্ব্রিজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক জ্যাক ট্রেভর আফ্রিকা থেকে আনা বেশ কিছু মানব  দেহের কাঠামোর উপর নেওয়া পরিমাপে মহলানবীশের পদ্ধতি অনুসরন করতে চেয়েছিলেন। মহলানবীশ ট্রেভরের অনুরোধে আর কে মুখার্জি ও পরে প্রখ্যাত হওয়া পরিসংখ্যানবিদ সি আর রাওকে কেম্ব্রিজে পাঠিয়েছিলেন ট্রেভরের সাথে একত্রে কাজ করার জন্য। মহলানবীশ নিজেও পরিমাপভিত্তিক নৃতত্বের উপর ফলিত গবেষণা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলার অন্য সম্প্রদায়ের নৃতাত্ত্বিক মিল বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্য জায়গার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের  মিলের থেকে বেশি। তবে তাঁর অন্য একটা সিদ্ধান্ত, যে কেবলমাত্র বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গেই উত্তর ভারতের বর্ণহিন্দুদের বেশি মিল, পরবর্তী নমুনাতে সমর্থিত হয় নি। আর বাংলার ইঙ্গ-ভারতীয়দের সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বেশি নৃতাত্ত্বিক মিল, তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ খুব সম্ভবতঃ তাঁর নমুনার ত্রুটি। এখন মনে করা হয় মহলানবীশের  নমুনা  মূলতঃ উচ্চশ্রেণীয় ইঙ্গ-ভারতীয়দের থেকে নেওয়া হয়েছিল।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় মহলানবীশের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায়  (large-scale sample survey) গড়ের নমুনাজ বিচ্যুতির (sampling error) পরিমাপ অনুমান করতে  ইন্টারপেনিট্রেটিং সাবসাম্পেল (interpenetrating subsample) পদ্ধতির উদ্ভাবন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত সহজ। এতে নমুনাকে অন্ততঃ দুই ভাগে যদৃচ্ছভাবে আলাদা করে তাদের গড়ের পার্থক্য থেকে বিচ্যুতির অনুমান  করা যায়। ধরা যাক x একটি রাশি যার তাত্ত্বিক গড়কে (population mean) n খানি নমুনার ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই x এর গড়ের অনুমান করতে x এর নমুনা গড় (sample mean) ব্যবহার করা হয়, যাকে আমরা x বলব।  যদি নমুনাকে k খানি সমান ভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতি ভাগের গড়রাশিগুলিকে x(1),...,x(k) বলা হয়, তাহলে x এর গড়ের নমুনাজ বিচ্যুতিকে আন্দাজ করা যাবে (x(1)-x),...,(x(k)-x) এর বর্গের সমষ্টিকে k-1 দিয়ে ভাগ করে তার বর্গমূল নিয়ে। এটা অবশ্য মহলানবীশের পদ্ধতির অত্যন্ত সরলীকরণ করে বলা হল, কারণ বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায়  অনেকগুলি ধাপ থাকে। তা ছাড়া আলাদা আলাদা ভাগে সমসংখ্যক নমুনা না থাকলেও চলে।  মহলানবীশের ইন্টারপেনিট্রেটিং সাবস্যাম্পেল পদ্ধতিকে আধুনিককালের জ্যাকনাইফ (jackknife) ও বুটস্ট্র্যাপ (bootstrap) পদ্ধতির পূর্বসূরি বলা যেতে পারে। নমুনার বিভিন্ন অংশকে কাজে লাগিয়ে বিচ্যুতির অনুমান করার এরকম আধুনিক ধারণা মহলানবীশ তিরিশের দশকেই ভেবেছিলেন ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।

১৯২৫ সালে মহলানবীশ কৃষিক্ষেত্রে সমীক্ষায় সম্ভাব্য ভ্রান্তির (probable error) হিসেব করেন। কৃষি সমীক্ষার একটা বড় সমস্যা হল জমির উর্বরতার তফাৎ ফসলের ফলনশীলতার সঙ্গে বিভ্রান্তি (confounding) সৃষ্টি করে। মহলানবীশের পদ্ধতি ছিল কৃষিজমির একককে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে প্রতিটি পৃথক অংশে বিভিন্ন প্রজাতির ধানের ফলনের পরিমাপ করা যাতে জমির উর্বরতার প্রভাব হিসাব থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই পদ্ধতি তার মাত্র কয়েকবছর আগে ফিশার প্রবর্তন করেছিলেন, যা মহলানবীশের তখনও অজ্ঞাত ছিল। পদ্ধতিটি এখনও সমস্ত কৃষিপরীক্ষায় ব্যবহার হয়। এই সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র মহলানবীশ ছাপানোর পরে ফিশারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডে আবার গেলে তিনি ফিশারের সঙ্গে দেখাও করেন। ফিশারের আবিষ্কৃত বিভিন্ন পদ্ধতির সফল প্রয়োগ ভারতের কৃষিক্ষেত্রে তিনি করেছিলেন। ফিশার মোট চারবার আই এস আই এসেছিলেন ও ১৯৬২ সালে ফিশারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল।

বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষা যা এখনকার দিনে বহুল ব্যবহৃত, তার অনেকাংশই চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহলানবীশের গড়ে তোলা। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে পরিকাঠামো খুবই দুর্বল ছিল তখন এবং তথ্যকে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো, সেসব জায়গার উপযোগী করেই তিনি পদ্ধতিগুলিকে বানিয়েছিলেন। মহলানবীশ এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে উন্নয়নশীল দেশেও নমুনা সমীক্ষা যথাযথভাবে ব্যবহার করলে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভ করা যায় এবং তার থেকে উপলব্ধ জ্ঞান পরিকল্পনায় ব্যবহার করে অনেক উন্নতি করা যায়। ফিশার, হোটেলিং সহ বহু বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ মহলানবীশের পদ্ধতিগুলির ব্যবহারিক মূল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হোটেলিং বলেছিলেন, "নমুনা সংগ্রহের এত ভাল পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও নেই, যা মহলানবীশের পদ্ধতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে"। মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন যে ফিশার প্রবর্তিত যদৃচ্ছকরণ (randomization) পদ্ধতি শুধুমাত্র পরীক্ষার নক্সা নয়, নমুনা সমীক্ষাতেও বিশেষভাবে কার্যকরী, সমীক্ষকের ব্যক্তিগত পক্ষপাত  (personal bias) দূর করতে। পদার্থবিদ্যার মত সঠিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েও জীববিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ও নৃতত্ত্বের মতো পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে যে বিপুল মাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থান্তর (natural variation) হয়, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ও সেইমতো পদ্ধতিগুলি তৈরি করেছিলেন। বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায় সর্বোত্তম বরাদ্দ (optimal allocation) অনুমান করতে পাইলট সমীক্ষা (pilot survey) ব্যবহার করার প্রস্তাবও মহলানবীশ দিয়েছিলেন। পাইলট সমীক্ষা পরবর্তীকালে আব্রাহাম ওয়াল্ড প্রবর্তিত ক্রমিক বিশ্লেষনের (sequential analysis) পূর্বসূরী বলা যায়।

মহলানবীশ তাঁর জীবনের শেষের দিকে ১৯৬০ সালে ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস (fractile graphical analysis) নামক আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। ধরা যাক x ও y দুটি রাশি, যেখানে y এর মানগুলি 1, 2, ... ইত্যাদি এবং তাদের ছোট থেকে বড় পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়েছে, এবং তাদের পাশাপাশি সম্পর্কিত xএর মানগুলি দেওয়া রয়েছে x(1),x(2),... । এদের g সংখ্যক পরপর রাশিগুলি একত্র করে গড় করা হয় যদি, এবং সেই গড় মানগুলিকে রেখাচিত্রে পরপর সাজানো হয়, তাদের ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফ বলে। এই রেখাচিত্র দ্বিমাত্রিক নিবেশনের (two-dimensional joint distribution) অন্তর্নিহিত ধর্মকে বুঝতে সাহায্য করে। একাধিক দ্বিমাত্রিক নিবেশনকে এর দ্বারা তুলনা করা যেতে পারে। আধুনিক ব্যাখ্যায় ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফ হল, যখন x রাশি তার মানের t পর্যায়ে আছে, তখন  t এর বিভিন্ন মানের জন্য  y রাশির শর্তাধীন গড়ের (conditional expectation) অনুমান (estimate)। মহলানবীশ  মাথাপিছু মাসিক খরচ (x) ও খাদ্যদ্রব্যে খরচের অনুপাত (y), এই দুটি রাশির পারস্পরিক সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন ও বিভিন্ন সময়ে তাদের সম্পর্কের তুলনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির দরুন তাদের প্রত্যাগতির (regression) সরাসরি তুলনা তেমন অর্থপূর্ণ নয় মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন। ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস তার পরে খুব বেশি আর ব্যবহার হয় নি, তবে ইদানিংকালে এ ব্যাপারে আবার উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। লক্ষণীয় যে ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস পদ্ধতি  ননপ্যারামেট্রিক রিগ্রেশন (nonparametric regression) পদ্ধতিরও আগে আবিষ্কৃত, যেটা ১৯৬৪ সালে প্রস্তাবিত হয়।

মহলানবীশ ছিলেন সমাজসচেতন এক বিজ্ঞানী। সব সময়ই তিনি এমন কিছু করতে চাইতেন যা সমাজের সরাসরি কাজে লাগবে, তাই ফলিত গবেষণায় মহলানবীশের বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। প্রযুক্তিবিদদের বিশেষজ্ঞ কমিটি বন্যা নিয়ন্ত্রনে একটি বড় জলাধার নির্মানের সুপারিশ করেন, যা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। মহলানবীশের কাছে মতামত চাইলে তিনি বিগত ৫০ বছরের বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য থেকে দেখান জলাধার বন্যা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। যা দরকার তা হল দ্রুত জলনিকাশী নালা। তেমনি উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ্ররা নদীর তলদেশের উচ্চতাবৃদ্ধির আশঙ্কা করে যখন বাঁধের উচ্চতাবৃদ্ধির সুপারিশ করেন, মহলানবীশ বিগত ৬০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত করেন যে নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় নি। নদীর উচ্চ অববাহিকায় বাঁধ দিলে বন্যানিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে সম্ভব। তাঁর বিশ্লেষণ স্বাধীনতার পরে মহানদীর উপর  হীরাকুঁদ বাঁধ নির্মানে বিশেষ কাজে লেগেছিল।

মহলানবীশ ১৯৩৭ সালে বাংলার সরকারে অনুরোধে বাংলায় পাটের ফলন ও বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক বুঝতে একটি সমীক্ষা করেছিলেন, যা ভারতবর্ষে বৃহদায়তন নমুনা সমীক্ষার প্রথম দিকের উদাহরণ। তিনি একটি রিপোর্ট তৈরি করেন হাওড়া ও হুগলি জেলায় সেচ ও জলনিকাশী ব্যবস্থার উপর। দামোদর নদের বন্যার জলকে সেচে পরিণত করতে পারলে ধানের ফলন বৃদ্ধি কতটা হবে তার হিসাবভিত্তিক অনুমান তিনি করেন, যা পরবর্তীকালে দামোদর অববাহিকায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনায় কাজে লাগে। এইসব হিসাব করতে মহলানবীশ যে ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সেই ধরনের হিসাব পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা পায় অপারেশন রিসার্চ নামে। ১৯৪০ সালে বাংলায় গ্রাম ও শহরে পরিবারপিছু খরচের সমীক্ষা ও বিশ্লেষণও তিনি করেছিলেন। শিক্ষাপদ্ধতির পরীক্ষায় তিনি বাংলায় সমষ্টিগত পরীক্ষার নকশা করেন যা আই এস আই তে ব্যবহার করা হত, এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিমাপ ও বিদ্যালয় শেষের পরীক্ষার ফলাফলের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাতে কাজে লাগানো হত। এইধরণের কাজের জন্য আই এস আই তে একটি আলাদা বিভাগও প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মহলানবীশের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল রেখাচিত্র আর সংখ্যার সারি (table) দেখে সম্ভাব্য ভুল চিহ্নিত করা। তিনি সবসময় তথ্যরাশিকে (dataset) খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন, কারণ বহু সময়েই তাতে নথিকরণ (registration) ও প্রকাশ (tabulation) করার সময়ে অনবধানতাবশতঃ ভ্রম (non-sampling human error) ঢুকে যায়, যেটা অনেক সময়েই চিন্তা করলে ধরা পড়ে ও সম্ভাব্য সঠিক মান অনুমান করা যায়। তা না করলে ত্রুটিপূর্ণ তথ্যরাশি বিশ্লেষণ করে ভুল সিদ্ধান্ত করার সম্ভাবনা থাকে। একজন নৃতত্ত্ববিদ রিশলি  নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের একটি বড় তথ্যরাশি সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু অনেক  অনবধনতাবশতঃ ভ্রম থাকায় সেটা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অযোগ্য মনে করা হত। মহলানবীশ রিশলির তথ্যরাশি খুঁটিয়ে দেখে সম্ভাব্য সঠিক তথ্যরাশি পুনর্নির্মান করেছিলেন, যা ফিশারের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল।

তথ্যরাশি দেখে তার থেকে পরীক্ষাভিত্তিক সূত্র (empirical law) বের করার ব্যাপারেও মহলানবীশ বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জমির জরিপে একরভিত্তিক উৎপাদনের ভেদমানের (variance) একটি ঘাতের  সূত্র (power law) তিনি তথ্যরাশি থেকে বের করেছিলেন ও তার ভিত্তিতে প্রস্তাব করেছিলেন যে চার ফুট ব্যাসার্ধের একটি গোলাকার অঞ্চল থেকে সমীক্ষার জন্য ফসলের নমুনা সংগ্রহের। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন যা সমীক্ষকরা  সঙ্গে করেই নিয়ে যেতে পারতেন। এর ফলে নমুনা সংগ্রহ আগের থেকে অনেক সহজ হয়ে যায়। এর আগে আরও অনেক বড় আয়তক্ষেত্র আকৃতির জায়গার প্রথমে সীমানা চিহ্নিত করতে হত ও তার থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হত যা অনেক বেশী শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ছিল। মহলানবীশের চিন্তাভাবনায় সবসময়ই গবেষণার সরাসরি প্রয়োগ প্রাধান্য পেত।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় অসামান্য অবদান ছাড়াও যে কারণে মহলানবীশ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হল তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নেতৃত্বগুণের জন্য। মহলানবীশ আই এস আই এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আগেই বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি ছোট গবেষণাগারে যার প্রতিষ্ঠা, যার শুরু মাত্র ২৩৮ টাকার মূলধন নিয়ে, সেই আই এস আই  ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, মহলানবীশের মৃত্যুর সময় যার বাৎসরিক আয়ব্যয় দাঁড়িয়েছিল দুকোটি টাকায়, দু হাজার কর্মী কাজ করত, কলকাতার মূল কেন্দ্র ছাড়াও আরও আটটি কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল --- বলা বাহুল্য এখন এই সংখ্যাগুলো আরও অনেকগুণ বেড়েছে। অবশ্যই এই বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়েছিল। প্রথমে সরকার থেকে আড়াই হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যায়, যা ১৯৩৫ এ বেড়ে সাড়ে সাত হাজার হয়েছিল। বাংলার সরকারের থেকে ১৯৩৬ সালে পাঁচ হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যায়। ১৯৩৬ এ ব্রিটিশ সরকারের  প্রতিনিধি স্যার জন রাশেল ও ১৯৩৭ এ বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর সফরের পর কিছুটা আর্থিক অনুদান বাড়ে। চল্লিশের দশকে সি দেশমুখের ঐকান্তিক চেষ্টায় পরিস্থিতির  উন্নতি হয় ও আই এস আইএর কাজের পরিসর বাড়ে।

আই এস আই মডেল অনুসরণ করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেট্রুড কক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা কিনা তার আগে পর্যন্ত গণিত বিভাগের অন্তর্গত হত। মহলানবীশ ছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও বিজ্ঞানীরা মহলানবীশের জীবিতকালেই আই এস আই এ কাজ করেছেন, যথা সি আর রাও, রাজচন্দ্র বোস, সমরেন্দ্রনাথ রায়, রঘুরাজ বাহাদুর, গোপীনাথ কল্যাণপুর, এস এস বোস, জে এম সেনগুপ্ত, ডি বি লাহিড়ি, কে আর নায়ার, কে কিষেণ, অনিল ভট্টাচার্য, অজিত দাসগুপ্ত, জয়ন্ত কুমার ঘোষ প্রমুখ। প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীবনবিজ্ঞানী জে বি এস হল্ডেন ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বায়োমেট্রি বিভাগের প্রধান হিসেবে আই এস আই তে যোগ দেন। প্রথমদিকে আই এস আইতে যেসব কাজ হত তা হল ফসলের ফলন অনুমান করা, ভোগ্যপণ্যের খরচ বিশ্লেষণ, জনসাধারণের মতামত সমীক্ষা, নমুনা সমীক্ষার পরিকল্পনা, তথ্যের নথিকরণ এবং গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ্যায় গবেষণা। ১৯৩৮ সাল থেকে প্রশিক্ষণ ও শংসাপত্র দেওয়া শুরু হয়। আই এস আইএর কাজ তখন হত অনুদানভিত্তিক প্রকল্পে (grant-funded projects), যাতে চাকরির নিরাপত্তা কম ছিল। রাজচন্দ্র বোস ও সমরেন্দ্রনাথ রায় আই এস আই ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপকের পদে যোগ দেন, নায়ার ও অন্যান্যরা সরকারি চাকরি নেন। সি আর রাও গবেষণা ও প্রশিক্ষণের প্রধান অধ্যাপক হন। ১৯৫১ সালে আই এস আই বরাহনগরে  নতুন কেনা তিন একর জমিতে স্থানান্তরিত হয়। নতুন গ্রন্থাগার ও অন্যান্য ভবন তৈরি হয়। স্যার রনাল্ড ফিশার নতুন বিদ্যায়তনের উদবোধন করেন। প্রেসিডেন্সির পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণাগারও আই এস আই তে মিশে যায়।

পঞ্চাশের দশকে আই এস আই এর দায়িত্ব আরও বাড়ে, ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গ্যানাইজেশনের (National Sample Survey Organization) যোগাড় করা তথ্য নথিকরণ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার জন্য। দেশ স্বাধীন হবার পরে দেশীয় শিল্পের গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরামর্শ (statistical consulting) দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কলকাতা ও দিল্লীতে পরিকল্পনা শাখা, সমাজতত্ত্ব ও জনতত্ত্ব (demography) এর আলাদা বিভাগ কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হয়। বৈদ্যুতিন (electronics) গবেষণা বিভাগ খোলায় কারিগরিবিদ্যার অনেক অধ্যাপক যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু, অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ (যিনি আই এস আই এর প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন, কেম্ব্রিজে থাকাকালীনই যার সঙ্গে মহলানবীশের বিশেষ পরিচয়) ও কেন্দ্রীয় সরকারে প্রভাবশালী পিতাম্বর পন্থের সাথে মহলানবীশের ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। এরা সকলেই আই এস আই এর গড়ে ওঠায় বিশেষ সহযোগিতা করেন। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় আই এস আই অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়, যাতে আই এস আই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। তার ফলে আই এস আই স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উপাধি দেবার অধিকার পায়। প্রথম যুগের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও গণিতবিদ হয়েছিলেন যথা দেবব্রত বাসু, জি পি পাতিল, সুজিত মিত্র, যোগব্রত রায়, ভি এস বরদারাজন, কে আর পার্থসারথি, আর রঙ্গ রাও এবং শ্রীনিবাস বরধন (গণিতের এক সর্বোচ্চ সম্মান আবেল পুরষ্কার বিজেতা)। বিশিষ্ট ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ পামেলা রবিনসনের নেতৃত্বে ভূতত্ত্ববিভাগ (geology) শুরু হয় ও জীবাশ্মবিদ্যা (paleontology) গবেষণায় বিশেষ সাফল্যলাভ করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষকদলই ভারতবর্ষে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসোর জীবাশ্ম উদ্ধার করে। এডুইন হার্পার সাইকোমেট্রি শাখার প্রধান হন। যুগোস্লাভিয়া থেকে এসে ডি কোস্টিক ফোনেটিক্স বিভাগ খোলেন। এক সঙ্গে এতজন বিখ্যাত বিদেশী বিজ্ঞানীর একটি দেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একরকম অবিশ্বাস্য।

পঞ্চাশের দশকে যন্ত্রগণক বিভাগ শুরু হয় ও ভারতবর্ষের প্রথম যন্ত্রগণক (computer) আই এস আইতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা হয়। পরিসংখ্যানবিদ্যার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থায় এত বহুবিধ বিষয়ের গবেষণার সুযোগ থাকা একরকম অভাবনীয়। এতে মহলানবীশের বিস্তৃত চিন্তাধারা, অন্তর্দৃষ্টি ও সবরকমের বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ জন টুকির উক্তি স্মরণীয়, "পরিসংখ্যানবিদ হবার সবথেকে ভাল দিক হল যে সব বিষয়ের উঠোনেই খেলা করা যায়।" তাঁর উদারপন্থী মতের প্রতিষ্ঠার জন্য মহলানবীশ ত্যাগ স্বীকারেও রাজী ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠান চালানো ও স্বশাসন নিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আই এস আই এর কেবলমাত্র সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণাতেই জোর দেওয়া উচিৎ, যেমন ভারতবর্ষের অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান তখন করত। আই এস আই প্রচন্ডভাবেই সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। মহলানবীশের মত ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণার পরিসর অনেক বড়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সরতে হলে তিনি নির্দেশকের পদ ছেড়ে দিয়ে নতুন সংস্থা গড়বেন। সরকার মহলানবীশের মত মেনে নেন।

আই এস আই মহলানবীশের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিল। তিনি ভবনগুলির স্থাপত্যের নক্সাও করতেন। আই এস আই এ যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসতেন, তাঁদের জন্য তিনি তাজমহল দেখার একটি গাইডবই পর্যন্ত লিখেছিলেন। আই এস আই তখন সারা পৃথিবীতে কতটা গুরুত্ব পেত সেটা কারা সেসময় আই এস আই এসেছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। ফিশার তো বটেই, বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদদের মধ্যে সংখ্যাতাত্বিক মান নিয়ন্ত্রণের (statistical quality control) উদ্ভাবক ডব্লু ই ডেমিং ও ওয়াল্টার শুয়ার্ট, নমুনাতত্ত্বের (sampling theory) উইলিয়াম হারউইটজ ও ফ্র্যাঙ্ক ইয়েটস, সংখ্যাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের (statistical inference) জের্জি নেম্যান, আব্রাহাম ওয়াল্ড,  হ্যারল্ড হোটেলিং, পরীক্ষার নক্সা (design of experiments) বিশেষজ্ঞ জি কিটাগাওয়া ও টি তাগিউচি, সম্ভাবনাতত্ত্ব (probability theory) ও গণিতের শ্রেষ্ঠ গবেষকদের মধ্যে আধুনিক সম্ভাবনাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শেষ্ঠ গণিতবিদ এ এন কল্মোগোরভ, নর্বার্ট ভিনার (যিনি ছ মাস ছিলেন ও ভারতীয় গণিতবিদ পি মাসানির সাথে একসাথে বহুচলক সময়শ্রেণী (multivariate time series) ভবিষ্যৎ গণনার উপর গবেষণাপত্র লেখেন), ইউ ভি লিনিক ও জে এল ডুব প্রমুখ অনেকে মহলানবীশের আমন্ত্রণে একাধিকবারও এসেছিলেন। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিশিষ্টদের মধ্যে এসেছিলেন নিলস বোর, ফ্রেডেরিক ও আইরিন জোলিএ কুরি, জে ডি বার্নাল, আর্থার লিন্ডার ও অর্থনীতিবিদ ইয়ান টিনবের্খেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু , যারা মহলানবীশের সমবয়সী ছিলেন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ই যাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, আই এস আই এর উপদেষ্টা ও হিতাকাংক্ষী ছিলেন । সত্যেন্দ্রনাথ বসু আই এস আই এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন আট বছর। এ ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন সময়ে আই এস আই তে এসেছেন মহলানবীশের আমন্ত্রণে, যেমন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের অবিসংবাদী নেতা হো চি মিন, বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গ্বেভারা, সোভিয়েত  উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি (পরে রাষ্ট্রপতি) লিন্ডন জনসন। চৌ এন লাই মহলানবীশকে চীনের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করারও অনুরোধ জানান। বলা বাহুল্য, মহলানবীশের প্রবল ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছাড়া এতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আই এস আই সম্পর্কে উৎসাহী করা সম্ভব ছিল না।

মহলানবীশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি যেমন অনন্য ছিল, তেমন ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা। মূলতঃ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য তিনি আই এস আই এর মধ্যে ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল এডুকেশন সেন্টার (আইসেক) গঠন করেন, যা এখনও সেইসব দেশের সরকারি কর্মীদের পরিসংখ্যানবিদ্যায় তালিম দেয়। একটি সদ্য স্বাধীন হওয়া উন্নয়নশীল দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে শিক্ষার প্রসারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, এমন নজির সারা পৃথিবীতে দুর্লভ।

মহলানবীশ ১৯৪৯ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাতাত্বিক উপদেষ্টা ও জাতীয় আয় কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন। সেই সময় তিনি দেশের ম্যাক্রো-ইকনমিক সমস্যাগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। জাতীয় আয় হিসেব করার জন্য তথ্যের অভাব ছিল। সেই অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে মহলানবীশ ১৯৫০ সালে ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গ্যানাইজেশন গঠন করেন, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা দফতরের অন্তর্গত ছিল। সারা দেশে নমুনা সমীক্ষা করে ভারত সরকারকে  নানা পরিকল্পনা রূপায়ণে সাহায্য করা ছিল এর উদ্দেশ্য। মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন যে উন্নত দেশে করা সমীক্ষার পদ্ধতি ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। কুড়ি বছরের মধ্যে বেকারি কমানো ও জাতীয় আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে তিনি টু-সেক্টর মডেল (two-sector model) উদ্ভাবন করেন । এতে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগের ফলে সময়ের সাথে জাতীয় আয়ের পরিমানের সম্পর্কের এইরূপ একটি সমীকরণ দেন ---
                  Y(t)=Y(0)[1+I(0) ((p(1)b(1)+p(2)b(2))/(p(1)b(1)) (1+p(1)b(1))^t],
যেখানে  Y(t)  হল  t সময়ে জাতীয় আয়, I(0) শুরুর বিনিয়োগের পরিমাণ, p(1) ও p(2) হল যথাক্রমে  বিনিয়োগ ও ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগের অনুপাত,  b(1) ও b(2) হল সহগ (coefficient) যাদের পরিসংখ্যান থেকে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান করতে হবে। এই সমীকরণ ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি প্রস্তাব করেন অবশেষ অনুপাত (limiting rate) আঠারো শতাংশ করার জন্য উৎপাদন ক্ষেত্রে তিরিশ শতাংশ বিনিয়োগের, যা ভারত সরকার গ্রহণ করেন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। পরে  মহলানবীশ তাঁর টু-সেক্টর মডেলকে আরও উন্নত করে ফোর-সেক্টর মডেল (four-sector model) প্রস্তাব করেন, যাতে ভোগ্যপণ্যের  তিনটি  শ্রেণী --- শিল্পজাত, হস্তশিল্প ও কৃষিজাত এবং পরিষেবা সংক্রান্ত, আলাদা করে হিসাব করা হয়।

ভারতবর্ষের উন্নয়নে মহলানবীশের আর এক বিশাল অবদান দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়া। জহরলাল নেহরু তাঁকে এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন। মহলানবীশের অর্থনীতিতে প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তাতে তাঁর চিন্তাধারায় কিছুটা প্রথাবিরোধিতা ছিল, যাতে হয়তো সুবিধাই হয়েছে নতুন চিন্তাভাবনা করতে। সমস্যার সমাধানে তিনি কিছু সহজ গাণিতিক কাঠামো (mathematical model) প্রস্তাব করেন যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বিপুল প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এ দেশে বেকারি, দারিদ্র্য আর জনস্বাস্থ্যের সমস্যা।  দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি পরিকাঠামো ও ভারী শিল্পে জোর দিয়েছিলেন, কৃষিকে সাময়িকভাবে কিছুটা কম অগ্রাধিকার দিয়ে। মহলানবীশ পরিকল্পিত অর্থনীতি ও বৃহৎ সরকারি বিনিয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এই সময় ভিলাই, দুর্গাপুর, রৌরকেল্লা ইত্যাদি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতোত্তর ভারতের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তাকে  স্বাবলম্বী করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পিত অর্থনীতির সাফল্য নিঃসন্দেহে তাঁকে অনুপ্রেরিত করেছিল। অর্থনৈতিক উদারীকরণের আগে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার খুব বেশী না হলেও ভারতবর্ষে  কখনও তেমন কোনও অর্থনৈতিক সংকট না হওয়ার কারণ এই শক্ত বুনিয়াদ। পক্ষান্তরে  উপনিবেশিক শাসন থেকে ওই সময় মুক্ত হওয়া বহু দেশ তুলনায় অবস্থাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও একের পর এক সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে অপ্রস্তুত অবস্থায় বাজার অর্থনীতির পথ নিয়ে।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে, বিশেষতঃ পরিসংখ্যানবিদ্যার চর্চায় আই এস আইএর কাজকর্মের বাইরেও মহলানবীশ বিশেষ ভূমিকা নেন। ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর সম্মেলন হয়।  স্যার রনাল্ড ফিশার সেই অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উপাধি দেওয়া শুরু হয় ১৯৪১ সাল থেকে। মহলানবীশ তখন সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। লক্ষ্যণীয় তখন পৃথিবীর প্রায় কোথাওই আলাদা পরিসংখ্যানবিদ্যার বিভাগ ছিল না। তাঁর চেষ্টায় ১৯৪২ সালে পরিসংখ্যানবিদ্যা ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিতের শাখা হিসেবে। ১৯৪৫ সালেই তা পৃথক শাখার মর্যাদা লাভ করে। তাঁর মত ছিল দেশের উন্নতিতে বিজ্ঞানচর্চা এক অপরিহার্য শর্ত এবং তার জন্য সরকারি ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিবিদদের মতমত নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৬১ সালে ভারতবর্ষের সরকারি পরিসংখ্যানের কাজের জন্য ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল সার্ভিস শুরু করা হয়।

সারা জীবনে মহলানবীশ নানা সরকারি  ও শিক্ষাক্ষেত্রে দায়িত্ব সামলেছেন, অনেক সময় একসাথে বহু দায়িত্ব, যথা আই এস আই এর নির্দেশক (১৯৩১--১৯৭২), সংখ্যার সম্পাদক (১৯৩৩--১৯৭২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রধান (১৯৪১--১৯৪৫)। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা  ছাড়াও অধ্যক্ষ পদেও ছিলেন কিছুদিন (১৯৪৫--১৯৪৮)। এ ছাড়া কলকাতায় পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা আবহবিদ (১৯২২--১৯২৬), বাংলা ও ভারত সরকারের উপদেষ্টা (১৯৪৫--১৯৪৮, ১৯৪৯--১৯৭২), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (১৯৫৫--১৯৬৭), দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান (১৯৫৩--১৯৫৮), ন্যাশানাল সাম্পেল সার্ভের প্রধান (১৯৫০--১৯৭২), বিশ্বভারতীর কর্মসচিব (১৯২১--১৯৩১) ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দফতরের অধীনে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গ্যানাইজেশন গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। বেকারি ছিল দেশের এক প্রধান সমস্যা। বেকারির সমাধানে মহলানবীশ প্রস্তাবিত লেবার রিসার্ভ সার্ভিস নামক একটি নীতি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে কোনও ছাঁটাই হলে কোম্পানিদের লেবার রিসার্ভ সার্ভিসে কিছু টাকা জমা দিতে হত, ফলে কোম্পানিগুলি ছাঁটাইয়ের পথে যেত তখনই যদি এর ফলে তাদের লাভ জমা দেওয়া টাকার থেকে বেশী হত। জমার টাকা থেকে লেবার রিজার্ভ সার্ভিস ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিত, যাতে তারা আবার চাকরি পাবার উপযুক্ত হতে পারে। ট্রেনিং এর সময় সেইসব কর্মীদের টাকাও দেওয়া হত, তবে পূর্ণ  কর্মসংস্থানের থেকে কিছুটা কম হারে। ফলে তাদেরও উৎসাহ থাকত স্বাভাবিক চাকরিতে ফেরত যাবার। মহলানবীশের এই মডেলে যেমন বেকারি প্রতিরোধে কিছুটা পরিসর থাকত, তেমনি অর্থনীতির প্রসারের সাথে দক্ষ কর্মীর অভাবের সমস্যা কমানো যেত।

পরিসংখ্যানবিদ্যার বাইরেও মহলানবীশের বিস্তৃতক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল। তাঁর জীবনে পারিবারিক ঐতিহ্য, উদারতা ও শিক্ষার অপরিসীম ভূমিকা ছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর কাজে প্রগতিশীল মনোভাব প্রকাশ পেত। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতেও তিনি পিছপা হতেন না। যৌবনকালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সহকারি সচিব, কোষাধ্যক্ষ ও সবশেষে সভাপতিও হয়েছিলেন। হিন্দুসমাজের তুলনায় প্রগতিশীল হওয়া সত্বেও ব্রাহ্মসমাজেও গোঁড়ামি ছিল। ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার ও রবীন্দ্রনাথের উদারপন্থী চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন। সেখানে তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। তাঁরা দুজনে মিলে "কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই?" পুস্তিকা রচনা করে রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মসমাজের  নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রাহ্মদের হিন্দুবিবাহমতে রেজিস্ট্রেশন করার ব্যাপারেও তিনি আপত্তি জানান। এমনকি এজন্য নিজের বিবাহের সময়ও তাঁর ভাবী শ্বশুরমশাই সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। হেরম্বচন্দ্রের কন্যা নির্মলকুমারীকে (রানী) মহলানবীশ বিবাহ করতে চাইলে হেরম্বচন্দ্র সেই কারণে গররাজি হন। মহলানবীশের নিজের বাড়ির লোকেও এই বিবাহে অংশ নেন নি, যদিও কোনও বাধাও দেন নি তাঁরা। মামা নীলরতন সরকার তাঁর বিবাহ দেন নির্মলকুমারীর সাথে। এর কিছুদিনের মধ্যেই মহলানবীশ "ব্রাহ্মবিবাহ বিধি" বলে একটি বই লেখেন, যা ব্রাহ্ম আচারের একটা প্রামাণ্য বই।

মহলানবীশ রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাঁর বিবাহে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ও "বসন্ত" নাটকটি লিখে নবদম্পতিকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের গুলিচালনা ও হত্যাকান্ডের পর কবি অত্যন্ত মনোকষ্টে ছিলেন। এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদ করে তিনি তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেন। সেইসময় তাঁর এই প্রতিবাদে গান্ধিজী ও কংগ্রেসের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বকে তেমনভাবে পাশে না পেয়ে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন। মহলানবীশ সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ মানসিক সাহচর্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সচিব হিসেবে মহলানবীশ বহুদিন কাজ করেছেন। কবি নিজেও মাঝে মাঝে  প্রেসিডেন্সির গবেষণাগার পরিদর্শনে  আসতেন ও খোঁজখবর নিতেন। ১৯৪১ সালে বরাহনগরে মহলানবীশ আমগাছে ছাওয়া যে বাগানবাড়ি কিনেছিলেন, পরে যার লাগোয়া জমিতে আই এস আই এর নতুন বিদ্যায়তন গড়ে ওঠে, রবীন্দ্রনাথ তার নামকরণ করেছিলেন "আম্রপালি"। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা খুব মিলত। তাঁরা দুজনেই মনে করতেন ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁরা দুজনেই জাতীয়তাবাদের প্রচলিত রূপ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, কারণ তা যে উপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে, প্রকারান্তরে তাকেই সে অনুকরণ করে। মহলানবীশও রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন ও বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করেছিলেন। মহলানবীশের উদ্যোগে আই এস আই এ তাঁর বাসস্থান গুপ্তনিবাসে রবীন্দ্রনাথ অতিথি হয়েছিলেন ও নেহরুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। "জনগণমন" কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব নেহরু তখনই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

তবে প্রথাগত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হলেও মহলানবীশের দেশের মানুষের জন্য বিশেষ অনুভুতি ছিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি বর্মায় ব্রিটিশ শক্তির পতন হলে সৈন্যদের খোরাকির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার বাংলা থেকে চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে নেয় ন্যূন্যতম বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। চালের দাম হুহু করে বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কালোবাজারি মজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয় না। বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতবিদ্বেষী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল কান দেন নি। কুড়ি থেকে তিরিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায় বাংলায় মানুষের তৈরি এই কৃত্রিম অন্নাভাবে যা সম্পূর্ণ এড়ানো সম্ভব ছিল।  নৃতত্ত্ববিদ কে পি চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে মহলানবীশ একটি রিপোর্ট ও গবেষণাপত্র লেখেন ও লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটিতে আর্ল অফ মুন্সটারের সামনে পাঠ করেন। তথ্য সহযোগে তিনি এই দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেন কারুকে সরাসরি দোষারোপ না করেই। ব্রিটিশ সরকারের এই অমানবিক দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতির বিরুদ্ধে ব্রিটেনেই যথেষ্ট জনমত গড়ে ওঠে, যাতে মহলানবীশের রিপোর্টের বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্ত্রী রানী মহলানবীশের সাথে স্বাধীনতার পরে পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে তিনি কল্যানশ্রী প্রকল্প চালু করেছিলেন। এতে উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যদের হাতের কাজ শেখানো হত ও স্বনির্ভর হবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।

মহলানবীশ কখনও সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন নি বা কোনও রাজনৈতিক বক্তব্যও রাখেন নি কখনও। তবে তাঁর চিন্তাধারা যে অনেকটাই বামপন্থী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ও বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে করা তাঁর প্রস্তাবগুলি অনেকাংশেই সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে করা। আর পারিবারিক সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন মানবিকতা ও উদারপন্থী চিন্তাধারা।

 বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও মহলানবীশের বিশেষ টান ছিল। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসা ও নিজের লেখালিখি (ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথের উপরে) ছাড়াও কেম্ব্রিজে থাকার সময় মহলানবীশের উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চার একটা সমিতি করা হয়েছিল যা নিয়মিতভাবে মিলিত হত ও সংস্কৃতি চর্চা করত। এই সমিতিতে বাংলায় কথা বলা বাধ্যতামূলক ছিল --- ইংরাজি ভাষা ব্যবহার করলে জরিমানা নেওয়া হত। সেই যুগে, যখন শিক্ষিত বাঙালি প্রায়ই ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ করত, তখন এ ধরণের উদ্যোগ অভাবনীয়। এমনকি এ যুগেও, যখন বাংলার চর্চা সংকুচিত হচ্ছে, মহলানবীশের বাংলা ভাষা চর্চার উদ্যোগ স্মরণীয়।

উত্তরাধিকারসূত্রে মহলানবীশ রক্তে উদ্যোগপতিত্ব (entrepreneurship) পেয়েছিলেন। সংখ্যা পত্রিকার ছাপা তখন কলকাতায় যে মানের হত, মহলানবীশের সেটা পছন্দ ছিল না। সংখ্যা ভালভাবে ছাপানোর জন্য তিনি তাঁর কলকাতার বাড়িতে একা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার দেখাশুনো তিনি নিজেই করতেন। পরে তা  পরিসংখ্যানবিদ্যা সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্যও ব্যবহার হয়, ও স্ট্যাটিস্টিকাল পাবলিশিং সোসাইটি নামে খ্যাত হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটি উন্নতমানের ছাপার যন্ত্র উপহার পেলে তিনি ত্রৈকা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার অর্ধেক কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলির ইংরাজী অনুবাদ ছাপানো। এমনকি মহলানবীশ আই এস আই এ বানিজ্যিকভাবে যন্ত্রগণক  তৈরি করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যদিও সে চেষ্টা ফলপ্রসু হয় নি। এটি হয়তো মহলানবীশের একমাত্র উদ্যোগক্ষেত্রে ব্যর্থতার উদাহরণ। তবে ব্যর্থতা সত্ত্বেও এতেও মহলানবীশের পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য ও উদ্যোগপতির গুণ লক্ষ্য করা যায়।

মহলানবীশের অপূর্ব সাংঠনিক ক্ষমতার তুলনা খুব কমই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মহলানবীশের বিশেষ বন্ধু আর এক দক্ষ সংগঠক অধ্যাপক বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার কথা মনে পড়ে। অভিজাত স্বচ্ছল পরিবারের মহলানবীশকে হয়তো মেঘনাদের মত তেমন সামাজিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয় নি, তবে পরিসংখ্যানবিদ্যার মত বিজ্ঞানের একটা পুরোপুরি নতুন শাখা, যার গুরুত্ব তখন সারা পৃথিবীতেই খুব কম লোকে বুঝত, তা তিনি পরাধীন দেশে প্রায় একার চেষ্টায় প্রচলন করেছিলেন ও ভারতবর্ষকে সারা পৃথিবীতে পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণা ও প্রয়োগে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মহলানবীশের অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় আজ জীবনের প্রায় সব ব্যাপারেই পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগে। আর একসাথে এতগুলি প্রতিষ্ঠান ও পদের দায়িত্ব পালন করার দৃষ্টান্তও সারা পৃথিবীতে খুব কম আছে। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সংগঠক হিসেবে মহলানবীশের প্রায় এই অলৌকিক সাফল্যের ব্যাখ্যা ডঃ অশোক রুদ্র দেবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মহলানবীশ স্মারক বক্তৃতায় এই বলে যে তা ইতিহাসের বিরল অসাধারণত্ব, যা হয়তো পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়, তবে তার থেকে বিশেষ শিক্ষালাভ সম্ভব।

সারা জীবনে মহলানবীশ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন, যেমন ফেলো অফ দি ন্যাশানাল  সায়েন্স অ্যাকাডেমি (১৯৩৫), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েল্ডন গোল্ড মেডাল (১৯৪৪), লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (১৯৪৫), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি (১৯৫০),মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইকনমেট্রিক সোসাইটির ফেলো (১৯৫১), পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৫২), রয়্যাল সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো (১৯৫৪), কেম্ব্রিজ কিংস কলেজের ফেলো (১৯৫৯), ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি (১৯৫৭), দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারি গোল্ড মেডাল (১৯৫৭), সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সের বিদেশী সদস্য (১৯৫৮), আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৬১), দুর্গাপ্রসাদ খৈতান গোল্ড মেডাল (১৯৬১), ফেলো অফ দি ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স (১৯৬৩), চেকোস্লোভাক অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সেস গোল্ড মেডাল (১৯৬৩), শ্রীনিবাস রামানুজান গোল্ড মেডাল (১৯৬৮)। এ ছাড়া তিনি পদ্মবিভূষণ ও দেশিকোত্তম সম্মান পান ও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট হয়েছিলেন। বিশ্বব্যপী ঠান্ডা যুদ্ধের সেই কালে তিনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন যাঁরা বিশ্বের সর্বত্র আদরণীয় ছিলেন।

মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু লিখতে হলে তাঁর স্ত্রী রানী মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু না লিখলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা বিদুষী মহিলা ও মহলানবীশের যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপর "বাইশে শ্রাবণ" নামক একটি বই লিখেছিলেন কবির সাথের তাঁর ব্যক্তিগত আদানপ্রদানের স্মৃতি থেকে। স্বামীর সাথে রানীও নানা সমাজকল্যানের কাজে অংশ নিতেন। আই এস আই এর কাজকর্মে রানীর বিশেষ ভূমিকা ছিল। আই এস আই এর অতিথিনিবাস আম্রপালি তিনি নিজের মনের মত করে সাজিয়েছিলেন। আই এস আই এ প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা ও সৌন্দর্যায়নে তাঁদের দুজনেরই বিশেষ নজর ছিল। আই এস আই এ প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যারা পদার্পন করেছিলেন, মহলানবীশ দম্পতির আগ্রহে প্রত্যেকে বৃক্ষরোপণে অংশ নিয়েছিলেন। কর্মীদের কাছেও এই বৃক্ষরোপণ স্মরণীয় উৎসব ছিল। নিঃসন্তান এই দম্পতির কাছে আই এস আই এর ছাত্র ও কর্মীরাই সন্তানের তুল্য ছিল। তারাও মহলানবীশ দম্পতিকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। আই এস আই তে বহু অধ্যাপক থাকলেও প্রফেসর বলতে তখন শুধু মহলানবীশকেই বোঝাত। মহলানবীশ দম্পতির প্রতিষ্ঠিত আই এস আই ক্লাব এখনও ছাত্র ও কর্মীদের সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। মহলানবীশের জন্মদিন ২৯শে জুন এখনও প্রতিবছর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন হয়, যেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী সমস্ত কর্মী ও ছাত্ররা একসাথে মধ্যাহ্ণভোজ করেন।

সবশেষে মহলানবীশের নিজের বলা কথা দিয়ে শেষ করতে হয়। তিনি বলতেন যে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও গবেষণার সবসময় একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সারা জীবন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি তা বুঝিয়েছেন। তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যাকে শুধুমাত্র সম্ভাবনাতত্ত্বভিত্তিক নিয়মমাফিক তথ্যের বিশ্লেষণ কিংবা নিছক সরকারি সিদ্ধান্ত নেবার সহায়ক বলে মনে করেন নি। তিনি একে একটা সর্বব্যাপী স্বাভাবিক তথ্যভিত্তিক জ্ঞান আরোহনের বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছিলেন, যা কি না শেষমেষ মানবকল্যাণের নানা কাজে ব্যবহার হবে। গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ্যায় (mathematical statistics) যাতে গণিতের অগ্রবর্তী বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপক প্রয়োগ হয়, তাতে মহলানবীশ নিজে তেমন অংশ না নিলেও উৎসাহ দিয়েছেন গবেষণায়। তাঁর ভাবশিষ্য সি আর রাও, যিনি এখনও জীবিত এবং শতবর্ষের মুখে, সারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ বলে মর্যাদা পান। মহলানবীশের সফল নেতৃত্বে বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলিতে কাজ করে বা প্রশিক্ষণ পেয়ে আরও অনেকে বহু নজরকাড়া গবেষণা করেছেন ও করছেন। উন্নত দেশে সাধারনতঃ সংস্থা থাকে, ব্যক্তি সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে তাকে দক্ষভাবে পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে দৃষ্টান্তকর কিছু করতে হলে  ব্যক্তির উদ্যোগকে অনেক বড় হতে হয়। মহলানবীশ ছিলেন সেই উদ্যোগীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।


তথ্যসূত্রঃ

C. R. Rao (1973). Prasantha Chandra Mahalanobis. Biographic Memoirs of Fellows of the Royal Society, Volume 19, Pages 454--492.

C. R. Rao (1973). Mahalanobis era in statistics. Sankhya, Series B, Volume 35, Pages 12--26.

C. R. Rao (1993). Statistics must have a purpose: the Mahalanobis dictum. Sankhya Series A, Volume 55, Pages 331--349.

J. K. Ghosh (1994). Mahalanobis and the art of science of statistics: the early days. Indian Journal of History of Science, Volume 29, Pages 89--98.

J. K. Ghosh, P. Maiti and A. Bera (1995) Indian Statistical Institute --- numbers and beyond (1931--1947). Unpublished report and address.

A. Rudra (1996): Prasanta Chandra Mahalanobis, A Biography, Oxford University Press. 

Reprography and Photography Unit of Indian Statistical Institute (2018). Prasanta Chandra Mahalanobis. Video documentary.


--------------------
-শুভাশিস ঘোষাল
 প্রকাশঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত "তিন বাঙালি বিজ্ঞানী" গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ হিসেবে, পৃষ্ঠা ৮২--১০২, কলকাতা বইমেলা ২০১৯ সাল।