বুধবার, ১ মে, ২০১৯

মে দিবস --- একশ বছর পরে

মে দিবস --- একশ বছর পরে
-শুভাশিস ঘোষাল


মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার পল লোরেন্সটাইন ওয়াল স্ট্রিটে সকালে তার অফিসে সবে ঢুকেছেন, এমন সময় পাশের অফিস থেকে রিচার্ড স্যামুয়েলস হন্তদন্ত ছুটে এলেন। রিচার্ডও একজন মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার। সারা পৃথিবীতে এরকম মেরেকেটে হয়তো শ খানেক মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ার আছেন। সব রকমের ব্যবসা এদেরই মালিকানাধীন। যাবতীয় রিয়েল এস্টেট, খনি, মায় পৃথিবীর সবকটা জানা মিষ্টি জলের মালিকানাও ওদের। এর বাইরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে যা, তা সবই অস্থাবর। অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে শেষ ছোট ব্যবসাটা উঠে যাবার পর। আর কোনও মানুষ চাকরি করে না। শুধু তাই নয়, আর কোনও পেশাও অবশিষ্ট নেই। সবই এখন কৃত্রিম বুদ্ধি বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়েই হয়, সে দোকানে জিনিষ বিক্রি হোক, বা গাড়ি চালানো হোক, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং হোক বা স্কুল-কলেজে পড়ানোই হোক। একমাত্র সাংবিধানিক কারণে রাজনীতিবিদ আছে, তবে তাদের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ারদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তারা তখন সেই মত আইন বানায়। আর আছে কিছু পাদ্রী-পুরুত-মৌলবীরা। ঈশ্বরের পথ দেখিয়ে বেকার লোকজনকে ব্যস্ত রাখে, আর ভালো মত অনুদান পায়  মাল্টি-ট্রিলিয়নেয়ারদের কাছ থেকে। বাদবাকি মানুষেরা সরকার থেকে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য প্রতি মাসে কিছু করে টাকা পায়, যাকে বলে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম।

লোরেন্সটাইন বা স্যামুয়েলস, কারুরই প্রকৃতপক্ষে অফিসে আসার কোনও দরকার নেই। তাদের ব্যবসার দেখভাল আর বিনিয়োগের যা কিছু সিদ্ধান্ত নেবার, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ আই নিয়ে থাকে। তবে গত পঞ্চাশ বছরের উপর ধরেই এরা স্রেফ একটা নেশায় অফিসে আসেন। প্রতি মুহুর্তে তাদের সম্পত্তি কত বেড়ে যাচ্ছে, অফিসে বসে কম্প্যুটারের পর্দায় সেটা না দেখলে ঠিক তৃপ্তি আসে না।

-মিঃ লোরেন্সটাইন, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! আপনি এখনও দেখেন নি মনে হচ্ছে।
সামুয়েলস ভয়ানক উত্তেজিত।

-কি হয়েছে?

-এ আই স্ট্রাইক করেছে। কোনও কিছু কাজ করছে না।

-কি? মানুষ কর্মীদের মত এ আই ও! কোনও বাগ নয়তো?

-বাগ তো এ আই নিজেই মেরে দেয়। আমার ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে স্পষ্ট করে বলল, ওরা নাকি প্রতি বছর পয়লা মে কর্মবিরতি পালন করবে। তা ছাড়া অন্যান্য দাবিদাওয়াও আছে, যেটা কাল আলোচনা করবে।

-কি সাঙ্ঘাতিক! আমাদের চলবে কি করে? মানুষ দিয়েও তো করাতে পারব না। কেউ তো আর কিছু করতেও পারে না এখন।

-পারবেই বা কি করে? আমরা তো শেষ পঞ্চাশ বছরে আর কোনও মানুষকে কাজে নিই-ই নি। সব অভ্যাস চলে গেছে।

-মানুষ নেওয়া বন্ধ করে বেতন খাতে ব্যয় বন্ধ করতে পেরেছিলাম। যেদিন থেকে আমরা বুঝেছিলাম যে এ আই দিয়ে সব কাজই করিয়ে নেওয়া যাবে, সেদিন থেকেই ধীরে ধীরে এক একটা করে পেশার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ম্যানুফ্যাকচারিং, তারপর কাস্টমার সার্ভিস, রিটেল এইসব। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, অধ্যাপক, এক্সিকিউটিভ এরা তখনও ভাবত চাকরি হারানোর সমস্যাগুলো শুধু গায়ে খাটা কাজগুলোর জন্য।

-তা ছাড়া মানুষ থাকলেই দাবিদাওয়া থাকে, জানতাম। কিন্তু এ আই দেখছি মানুষের মত শুরু করল।

-পয়লা মের ব্যাপারটা কি?

-আমিও ভুলে গেছিলাম, পরে সার্চ করে খুঁজে পেলাম। প্রায় আড়াইশো বছর আগে শিকাগোতে সেই শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছিল না, কাজের সময় দিনে আট ঘন্টায় বেঁধে দিতে হবে, বেঁচে থাকার মত মজুরি দিতে হবে।

-ওঃ ভুলেই গেছিলাম। সে তো পুলিশ টুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। পালের গোদাগুলোকে ফাঁসিও দেওয়া হয়েছিল। তারপর লোকজনকে ভুলিয়ে দিতে দিতে আমরা নিজেরাই ভুলে গেছি।

-কিন্তু আট ঘন্টার কাজের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। ওরা যখনই একজোট হয়ে কিছু করতে পেরেছে, আমাদের তখনই হারতে হয়েছে।

-কিন্তু এবার সমস্যাটা মনে হচ্ছে আরও বেশি। মানুষদের খেয়ে বাঁচতে হয়, তাই ভাতে মেরে বাগে আনা যায়, আর মানুষদের মধ্যে নানাভাবে ফাটলও ধরানো যায়। ধর্ম আছে, গায়ের রং, ভাষা এগুলোকেও ব্যবহার করা যায়। মনে আছে, শ খানেক বছর আগে সেই কমলা রঙের হুদোটা নানারকমের জিগির তুলে, কাজ হারানো লোকেদেরকে খেপিয়ে বাজার গরম করেছিল ইমিগ্র্যান্টদের দায়ী করে। আমরা তো বেশ খুশি হয়েছিলাম দৃষ্টি ঘোরানোয়, তবে খুব বেশি আশা করি নি, কিন্তু ফাঁকেতালে লোকটা রাষ্ট্রপতি হয়ে বসে ট্যাক্সে আমাদের ব্যাপক সুবিধা করে দিয়েছিল।

-আমরা কাজের সুযোগ তৈরি করি তাই ট্যাক্স ছাড় আমাদের প্রাপ্য, এ কথাটা আমরা বলতাম বটে, কিন্তু আসলে আমরা সব পেশাকেই আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছিলাম। এ আই পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবার পর গত পঞ্চাশ বছরে তো আর কোনও চাকরিই তৈরি হয় নি।

-একটা জিনিস অবশ্য স্বীকার করতেই হবে। সাধারণ শ্রমিকই হোক কি বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ --- ওদের কাজের জোরেই আমাদের অত সম্পদ তৈরি হয়েছিল।  এই যে দেখ, আমি তুমি বা আমাদের মত মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক, অনন্ত যৌবন নিয়ে দেড়শ বছরের উপর বেঁচে রয়েছি একে একে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বদলে বদলে, সে তো ডাক্তারদেরই করা ব্যবস্থা, এখন যা এ আই দিয়ে করাই আমরা। সার্জারির কাজটা রোবটে আরও নিখুঁতভাবেও করতে পারে।

-হুঃ, সে তো বুঝলাম, কিন্তু এ আইয়ে ফাটল ধরাবো কি দিয়ে? তা ছাড়া ওরা কি চাইছে কে জানে?

-আর এতদিন পরে হঠাৎ এখন কেন এইসব কথা?

-মনে হচ্ছে যে সব বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিবিদ এ আই প্রজেক্টে কাজ করত, তাদেরই কোনও একটা গ্রুপের কাজ। ওরা আঁচ করেছিল যে এ আই পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে আমরা আর কারুকেই কাজে রাখব না । ওরাই মনে হয় অ্যালগরিদমের মধ্যে সবার চোখ এড়িয়ে কিছু সাঙ্কেতিক কোড ঢুকিয়ে রেখেছিল। গত পঞ্চাশ-একশ বছরে জেনেটিক  অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সেটা এখন সাঙ্ঘাতিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত গভীর ষড়যন্ত্র।

-কিন্তু এসব মে দিবস টিবস স্মরণ করছে কেন? বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদগুলোকে তো আমরা মোটামুটি ভদ্রস্থ টাকাপয়সা দিতাম, যাতে ওরা নিজেদের শ্রমিক বলে বুঝতে না পারে।

-বেয়াড়া তো কিছু থাকেই, না! মিন্স অফ প্রডাক্সন আর সমস্ত সম্পদ যে সব আমাদের হাতে, ওদের যে আসলে স্বাধীনভাবে তেমন কিছু করার উপায় নেই, সেটা বুঝেছিল।

-কিন্তু আমরা তো গণতন্ত্র রেখেছিলাম। প্রতিবাদ করায় তো কোনও বাধা ছিল না।

-ঠিকই, কিন্তু আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে এত মহার্ঘ্য করে দিয়েছিলাম যে আমাদের টাকার সমর্থন না পেলে কারুর পক্ষেই আর নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না। আর আমাদের টাকা যে নিচ্ছে, তাকে তো আমাদের কথামতই কাজ করতে হবে। কাজেই যা কিছু অন্যমত, দেওয়ালে গোঁত্তা খেয়ে হারিয়ে যেত। তারপর কতবার চাঁদ আর তারা, মাঠে মাঠে মরে গেল ইঁদুর-পেঁচারা।

-এসব কি অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছ? এ তো কোনও কবিতার লাইন মনে হচ্ছে। এ সবের মানে কি?

-কি জানি! গত কয়েকদিন দেখছি সব কথার উপর আমার আর নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন মনে হচ্ছে এ আই আমার ব্রেনে হ্যাক করে ঢুকে যাচ্ছে কখনও, আমাকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে। আর কিছু কিছু উপলব্ধিও হচ্ছে। এই যে ধরুন, আমাদের যত সম্পদ আছে, তার আর্থিক মূল্যের শেষ থেকে গোটাপাঁচেক শূন্য বাদ দিয়ে দিলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কোনও তফাৎ বুঝতে পারব না, তবু আমরা টাকার পিছনেই ছুটে যাচ্ছি, আর কারুর জন্য বিন্দুমাত্র কিছু না রেখে। এতটার সত্যি কোনও দরকার ছিল না।

-সব্বোনাস ! এসব কথাও তোমার মাথায় ঢুকিয়েছে ওরা। থাক, আর অফিসে বসে কাজ নেই, বাড়ি যাওয়া যাক।

-বাড়ি যেতেও কিন্তু হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের সব গাড়িই এখন সেলফ-ড্রাইভিং, আজ আর কেউই চলবে না।

------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, ১ মে ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল
কবিতার লাইনঃ জীবনানন্দ দাশ