বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩

আফ্রোদাইতির দেশে

 আফ্রোদাইতির দেশে

-শুভাশিস ঘোষাল






প্রথম পর্বঃ

প্রস্তাবটা উঠেছিল বছর চারেক আগে। কুড়ি সালের জুনে পরের কনফারেন্সটা হবে সাইপ্রাসের পাফোস শহরে। যে পেশায় আছি, তাতে কিছুটা সুযোগ আছে গবেষণাপত্র পড়ার সূত্রে বিভিন্ন দেশে যাবার। আর সাইপ্রাস! ভূমধ্যসাগরের নীল জলের মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপ। ঝকঝকে দিন, ফুরফুরে হাওয়া, কিংবদন্তি খাদ্য-পানীয় "নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী, রেশম, মদের সার্থবাহ, দুধের মতন শাদা নারী" নিয়ে সে নিশ্চয়ই গ্রিক রূপকথার দেশের মতো। কিছুতেই ছাড়া যায় না। তাই সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি দিয়েছিলাম। প্রস্তুতিও নেওয়া শুরু হয়েছিল, তবে বাধ সাধল কোভিড অতিমারি। প্রথমে একবছর পিছিয়ে একুশের জুনে, সেখান থেকে আবারও পিছিয়ে বাইশের জুনে হবে ঠিক হল। কনফারেন্স জুমে ভার্চুয়াল হবে না, জায়গাতেই হবে। ভাগ্যিস!

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভ্রান্ত যাবে ওই কনফারেন্সে, স্ত্রী আর বছরের মেয়েকে নিয়ে। তাই আমার স্ত্রী আর ষোল বছরের ছেলেকেও জিজ্ঞাসা করলাম ওরাও যেতে চায় কিনা। ছেলের স্কুলও শেষ হয়ে যাবে তার মধ্যে। স্ত্রী তো আগ্রহী বটেই, এমনকি আমার ছেলে, যে কিনা বাড়িতে থাকতে পারলে সবথেকে খুশি হয়, সেও যেতে চায়। তার একটা কারণ অবশ্যই কাকুও যাচ্ছে ঝিনুককে নিয়ে, তবে জায়গাটা নিয়ে আগ্রহও কিছু থেকে থাকবে। অতএব টিকিট খোঁজ করো। জুন হল ইউরোপ যাবার জন্য চড়া মরশুম --- স্কুল-কলেজ ছুটি থাকে, আবহাওয়া উষ্ণ থাকে, দিন বড় থাকে, এইসব কারণে। আমেরিকায় আমরা যে শহরে থাকি, সেটা মাঝারি মাপের। এখান থেকে ইউরোপের সরাসরি বিমান কম চলে, টিকিটের দামও তুলনায় বেশি। জানুয়ারি মাসে যখন আমরা টিকিটের খোঁজ করছি, চোদ্দ' ডলারের মতো দাম দেখাচ্ছিল। সেটা খারাপ নয়, ইদানিং ওর কমে গ্রীষ্মে ইউরোপের বড় কোনও জায়গায় যাবার টিকিট পাওয়াই কঠিন, আর সাইপ্রাস তো আরও অনেক দূর --- একেবারে ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে ভূমধ্যসাগরের মধ্যে প্রায় সিরিয়া-লেবাননের কাছে। তাই আর দেরি না করে তিনজনের টিকিটই কিনে ফেলা হল। একটু দ্বিধা অবশ্য ছিলই --- কোভিড তো পুরোদমে চলছে! যদি যাবার মতো পরিস্থিতি না থাকে? এতগুলো টাকা দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে টিকিট হয়তো ওরা বদলে দেবে, কিন্তু পরে যদি যাবার উপযুক্ত সময় না পাওয়া যায়? সে যাক গে, দেখা যাবে। অত ভাবতে গেলে আর কোথাওই যাওয়া হবে না। দু' বছর হল আমেরিকার বাইরে যাওয়া হয় নি, একবার কলকাতা যাওয়া ছাড়া। তবে একটা কাঁটা আছে --- আমেরিকায় ঢুকতে কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট লাগবে। কাজেই খুব সাবধানে থাকতে হবে যাতে বিদেশে আটকা পড়ে না থাকতে হয়!

সাইপ্রাসে দুটো চালু বিমানবন্দর  আছে --- লারনাকা আর পাফোস শহরে। লারনাকা হল সাইপ্রাসের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে আর পাফোস হল একেবারে পশ্চিম প্রান্তে --- দুটো শহরই সমুদ্রের উপর। আমাদের গন্তব্য পাফোস লারনাকার থেকে বড় শহর হলেও লারনাকার বিমানবন্দর বেশি বড় --- অনেক বেশি জায়গা থেকে লারনাকায় বিমান পরিষেবা আছে, ভাড়াও সরাসরি পাফোস যাবার চেয়ে কম পড়ে। অবশ্য আমেরিকার কোনও শহর থেকে লারনাকা বা পাফোসে সরাসরি বিমান চলে না --- ইউরোপের কোনও প্রধান শহর অথবা দুবাই কি কাতার হয়ে যেতে হয়। যা হোক, এক্সপিডিয়ার থেকে ইন্টারনেটে আমাদের টিকিট কেনা হল ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স- লুফৎহান্সা-অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্সের। এগুলো সবই একে অপরের সহযোগী বিমানসংস্থা। যাবার সময় ইউনাইটেড-লুফৎহান্সায় শিকাগো-ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে লারনাকা, ফেরার সময় অস্ট্রিয়ান-ইউনাইটেডে লারনাকা থেকে ভিয়েনা-ওয়াশিংটন হয়ে বাড়ি। অর্থাৎ লারনাকা থেকে পাফোসে সড়কে যাতায়াত করতে হবে --- পৌঁছানোর দিন ফেরার আগের দিন লারনাকায় হোটেলও বুক করতে হবে। তা ভালই, আমরা তো শুধু কাজে যাচ্ছি না, কিছুটা বেড়াতে না পারলে অতদূরে সাইপ্রাসে গিয়ে লাভ কী? লারনাকা আর পাফোসের মধ্যে রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যেতে দেশটার মধ্যেকার অংশও কিছুটা দেখা হয়ে যাবে। তাই টিকিট কাটা হতেই লারনাকা আর পাফোসে হোটেলও বুক করে ফেলা হল। হোটেলের ভাড়া খুব বেশি নয় --- এক' ডলারের মধ্যে সমুদ্রের পাশে চমৎকার হোটেল পাওয়া গেল দু'জায়গাতেই। কোভিডের কারণে যাত্রা বাতিল করতে হলে অন্ততঃ হোটেল নিয়ে চিন্তা নেই, কারণ বুকিং বাতিলযোগ্য। জুন মাসও এসে গেল দেখতে দেখতে। বেরোনোর কয়েক সপ্তাহ আগে একটা বিরাট সুখবর পাওয়া গেল --- আমেরিকায় ঢুকতে গেলে আর কোভিড টেস্ট করাতে হবে না। ইউরোপ তো আরো দুয়েকমাস আগেই সেই নিয়ম তুলে দিয়েছে। ফলে নিশ্চিন্তমনেই বাড়ি থেকে বেরোলাম। 

সাইপ্রাসের আয়তন 'হাজার বর্গকিলোমিটারের সামান্য বেশি, লোকসংখ্যা সাড়ে বারো লক্ষের মতো। আনাতোলিয়ান প্লেট আর আফ্রিকান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সাইপ্রাসের উৎপত্তি। মধ্যে রয়েছে ট্রুডোস পর্বত, প্রায় দু'হাজার মিটার উঁচু। প্রায় দশ-বারো হাজার বছর আগে থেকে সাইপ্রাসে লোকবসতি শুরু হয়। ব্রোঞ্জ যুগের শেষ দিকে সাইপ্রাসে গ্রিকরা বসবাস শুরু করে। তখন অবশ্য গ্রিস একটা দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল না, কতগুলো ছোট ছোট রাজ্য আর নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি ছিল। সেই হিসেবে প্রাচীন সাইপ্রাসকে গ্রিক সভ্যতার অংশ ভাবা যেতে পারে, যেমন ছিল এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম অংশ) গ্রিক পুরাণের অনেক গল্প সাইপ্রাসের পটভূমিতে রয়েছে। সৌন্দর্য উর্বরতার গ্রিক দেবী আফ্রোদাইতির জন্মস্থান সাইপ্রাস। আলেক্সান্দার একসময় সাইপ্রাস অধিকার করেছিলেন। তারপর মিশরের টলেমি-গ্রিকরা সাইপ্রাসে আধিপত্য করে। এইভাবে দীর্ঘ সময় ধরে সাইপ্রাসে গ্রিক রীতিনীতি-সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়, যা আজও পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে রোমানরা সাইপ্রাস দখল করে। এর 'চারেক বছর পরে রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব-পশ্চিম দুভাগে ভেঙ্গে গেলে সাইপ্রাস পূর্বের বাইজান্টিন সাম্রাজ্যের ভাগে পড়ে। আট' বছর এভাবে চলার পর ক্রুশেড যুদ্ধ শুরু হলে সাইপ্রাসের মালিকানায় ব্যাপক হাতবদল হতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে তুরস্কের অটোমানরা বিশাল বাহিনী নিয়ে সাইপ্রাস দখল করলে তুর্কি বসতি শুরু হয় সাইপ্রাসে। তবে খ্রিষ্টান গ্রিক-রোমানদের আর মুসলিম তুর্কিদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপে চলা বিভিন্ন যুদ্ধ আর সামরিক চুক্তির ফলস্বরূপ সাইপ্রাস ব্রিটিশদের হাতে এসে পড়ে, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরোপুরি ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি তারপর ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়। ১৯৬০ সালে সাইপ্রাস ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পায়। সাইপ্রাসের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রিক জনগোষ্ঠী  চেয়েছিল গ্রিসের সঙ্গে মিলতে, যেমন ক্রীট দ্বীপ গ্রিসে যোগ দিয়েছিল। আশংকিত সংখ্যালঘু তুর্কি জনগোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেশভাগ দাবী করে। এমনকি একদল দাবী জানায় সাইপ্রাস বৃহত্তর আনাতোলিয়ার (তুরস্কের) অংশ। জাতিদাঙ্গা গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক সাইপ্রাসে সৈন্য পাঠানোর হুমকি দেয়। ওদিকে তখন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী রাজা (বর্তমানে গ্রিসে রাজতন্ত্র অবলুপ্ত) সাইপ্রাসকেও "মাতৃভূমি গ্রিসে" যোগ দিতে আহ্বান জানান। সম্ভাব্য তুর্কি আক্রমণের প্রতিরোধ হিসেবে গ্রিস দশ হাজার সৈন্য সাইপ্রাসে পাঠায়। ইতিমধ্যে ১৯৭৪ সালে গ্রিসে সামরিক অভ্যুত্থান হলে সাইপ্রাসেও গ্রিক সৈন্যরা অভ্যুত্থান শুরু করে গ্রিসের সঙ্গে সংযুক্তির উদ্দেশ্যে। পালটা হিসেবে তুরস্ক সৈন্য পাঠায় নেটোভুক্ত দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তুরস্ক সাইপ্রাসের উত্তরের এক তৃতীয়াংশ অধিকার করে। আন্তর্জাতিক চাপে তিনদিন পরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়। দেশের মাঝবরাবর রাজধানী নিকোসিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা টানা হয়। নিকোসিয়ার বিমানবন্দর এখন রাষ্ট্রসংঘের নিয়ন্ত্রণে --- কোনও বাণিজ্যিক বিমান চলে না। দক্ষিণের তুর্কি জনগোষ্ঠী উত্তরাংশে উত্তরের গ্রিক জনগোষ্ঠী দক্ষিণাংশে সরে আসে। ঠিক ভারতের স্বাধীনতার সময় হওয়া জনসংখ্যা বিনিময়ের মতো। তবে উত্তরের অংশকে আলাদা দেশ হিসেবে তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনও দেশ স্বীকৃতি দেয় নি। 

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লারনাকার বিমানযাত্রা পৌনে চার ঘন্টার মতো। আর সাইপ্রাস মধ্য ইউরোপের থেকে সময়ে এক ঘন্টা এগিয়ে। আমরা সকালে ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমেছিলাম। সাড়ে এগারোটা নাগাদ আবার লারনাকার বিমান। সাইপ্রাস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে, কয়েকবছর হল ইউরো মুদ্রাও চালু করেছে, তবে এখনো সেঙ্গেন মুক্ত সীমানা চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় নি। তাই ফ্রাঙ্কফুর্টে নয়, অভিবাসন লারনাকা গিয়েই হবে। অবশ্য ভিসার প্রয়োজন নেই, আমেরিকানরা ভিসা ছাড়াই নব্বই দিন অবধি সাইপ্রাসে থাকতে পারে। লারনাকায় নেমে অভিবাসন পেরোতে কোনও বেগ পেতে হল না। ব্যাগও ঠিকমতো এসে পৌঁছালো। বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরলাম। বাসও নেওয়া যেত, তবে জায়গাটা ঠিক চিনি না, তাই খোঁজাখুজি করার চেষ্টা করলাম না। লারনাকা ছোট শহর, হোটেল মাত্র সাত কিলোমিটার দূরেই। সাইপ্রাসে দেখলাম ট্যাক্সি ভাড়া নির্দিষ্ট গন্তব্যের জন্য নির্দিষ্ট --- মিটার না হলেও চলে। পনের ইউরো ভাড়া আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় কম। 

বিমানবন্দর থেকে শহরে আসতে একটা হ্রদ পড়ে। নভেম্বর মাসে এখানে ফ্লেমিংগোর দল জমায়েত হয়, পুরো জায়গাটা কমলা রঙে ভরে যায়। জুন মাসে অবশ্য তাদের দেখা পাবার প্রশ্ন নেই --- ফ্লেমিংগো পরিযায়ী পাখি। মিনিট দশেকের মধ্যে হোটেলে পৌঁছালাম। অবশ্য হোটেলের ঠিক আগে রাস্তা একটু বন্ধ থাকায় সামান্য হাঁটতে হল। সমুদ্রের ধার ধরে একটা রাস্তা টানা চলে গেছে, হোটেলটা তারই উপর। কাউন্টারের মেয়েটি চটপট চেক-ইন করে দিল। পর দিন আমাদের পাফোস যেতে হবে, তাই দূরপাল্লার বাসের খোঁজ করলাম ওর কাছে। বাস আছে, ঘন্টা তিনেক লাগে, ভাড়াও মাত্র সাত ইউরো করে। তবে সেদিন রবিবার বলে একটাই মাত্র বাস ছাড়বে। তেমন দূর না হলেও একটু হেঁটে বাসস্ট্যান্ডটায় যেতে হবে। তাই একবার ট্যাক্সির খোঁজও করলাম। এক' দশ বা পনের ইউরোতে যাওয়া যাবে, অর্থাৎ খুবই ন্যায্য ভাড়া প্রায় দেড়' কিলোমিটার রাস্তার জন্য। ভেবে দেখলাম ট্যাক্সিতে যাবার অনেকগুলো সুবিধা। আমাদের সুবিধামতো সময়ে, অর্থাৎ দুপুর বারোটায় শুরু করতে পারি, ট্যাক্সিতে সওয়া ঘন্টায় চলে যাব। পাফোসে একেবারে হোটেলে পৌঁছে দেবে, মালপত্র নিয়ে সেটা একটা বিরাট সুবিধা। আর আমরা তো তিনজন আছি, পড়তায় পোষাবে বেশি একজনের তুলনায়। তাই রিসেপসানিস্টকে বলে দিলাম পরদিন দুপুর বারোটায় একটা ট্যাক্সি বলে দেবার জন্য। অবশ্য আমার সুবিধা ছিল বলে, আর আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম বলে। না হলে কারুর টানাটানির বাজেট থাকলে বা একা মানুষ হলে দিব্যি বাসে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াত করা সম্ভব। বাসের পরিষেবার মান যথেষ্ট ভাল। 

লিফট দিয়ে এসে তিনতলায় ঘরে ঢুকলাম। এরা এখনও সাবেকি কায়দায় চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার ব্যবস্থা রেখেছে, কার্ড ঢুকিয়ে বা স্ক্যান করে নয়। ঘরটা চমৎকার --- সোফা-কাম-বেড সহ একটা বাইরের বসার ঘরও আছে, ফ্রিজ-মাইক্রোওয়েভ-ইলেকট্রিক কেটলি আছে, আর আছে চমৎকার একটা ব্যালকনি। আমাদের হোটেলটা মেরিনার প্রায় পাশেই --- অসংখ্য মোটরবোট জড়ো হয়ে রয়েছে। ঘরে একটু চা বানিয়ে খেয়ে বেরোলাম স্ট্র্যান্ডে। সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসছে। ওটা অবশ্য পুবদিক বলে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখা যাবে না --- পরদিক সকালে সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারলে সূর্যোদয় দেখা যাবে। এখানে সমুদ্র বেশ শান্ত, পাড়ও বাঁধানো। সমুদ্রের ধারে বোর্ডওয়াক ধরে অনেকটা হাঁটা বেশ উপভোগ করা গেল। স্ট্র্যান্ড ধরে রাস্তার উপর দুপাশে দোকান --- একদিকে গিফট-সহ নানা টুকিটাকি জিনিষের, অন্যদিকে প্রচুর রেস্তোরাঁ। শুকনো ফল, টুকিটাকি গিফটের জিনিস কেনার পর রাতের খাবার জন্য একটা লেবানীয় রেস্তোরাঁতে ঢুকে পড়লাম। মধ্যপ্রাচ্যের রেস্তোরাঁগুলো কাবাব খুব ভাল বানায়।  ভিতরে না বসে বাইরের টেবিলে বসলাম। মনোরম আবহাওয়া, শুধু পথচারীদের জন্য নির্দিষ্ট রাস্তায় প্রচুর লোক হাঁটছে, নাচানাচি করছে। সব মিলিয়ে খুব জমজমাট পরিবেশ। লোকজনকে দেখে বেশ আনন্দে আছে বলে মনে হয়। এইধরণের 'ওয়াক ফ্রেন্ডলি' জায়গায় দোকানপাট-রেস্তোরাঁ আমেরিকায় খুব বড় শহরে গুটিকয়েক জায়গা ছাড়া পাওয়াই যায় না, সর্বত্রই প্রায় গাড়ি করে যেতে হয়। অথচ এইধরণের পরিবেশ মানুষকে খুশি রাখতে কত সাহায্য করে, দোকানপাটের বিক্রিবাটাও অনেক বেশি ভাল হয়। খাবার এল সময়মতোই। এখানকার খাবারদাবারেও আমেরিকায় তুলনায় অনেক ভাল স্বাদ, দামেও ন্যায্য। এই রেস্তোরাঁটা তুলনায় একটু দামী, তবে জনপ্রতি কুড়ি-বাইশ ইউরোতে স্টার্টার-ডেসার্ট সহ তিন কোর্সের মেনু সম্ভব। অ্যালকোহলীয় পানীয় খেতে হলে অবশ্য আর একটু বেশি পড়বে। আর সাইপ্রাসে দেখেছি ক্রেডিট কার্ড প্রায় সব জায়গাতেই চলে, এমনকি এক ইউরোর মতো সামান্য দাম মেটানোর জন্যও দোকানগুলোকে হাসিমুখে ক্রেডিট কার্ড নিতে দেখেছি। আমেরিকাতেও ক্রেডিট কার্ড এতটা চলে না, অল্প দামের জিনিষে মানুষ ক্যাশ দেয় --- ছোট দোকানগুলোয় দশ-বিশ ডলারের কম হলে অনেক সময় ক্রেডিট কার্ড নিতে অস্বীকার করে। বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে দাম মেটানো কাস্টমারের পক্ষে অনেক বেশি সুবিধাজনক কারণ এতে মুদ্রা বিনিময় হার অনেক ভাল পাওয়া যায় এটিএম থেকে টাকা তোলার বা ডিলারের কাছ থেকে টাকা ভাঙ্গানোর তুলনায়। 

                                     ছবিঃ লারনাকার স্ট্র্যান্ড দুপাশের দোকানপাট-রেস্তোরাঁ। 

খেতে খেতে বেলি-ড্যান্সারের নাচও শুরু হল। বেশ উপভোগ্য একটা সন্ধ্যা কাটল। হোটেলে ঘরে ফিরে ঘুমানোর তোড়জোড় হল। একে এত লম্বা একটা বিমানযাত্রা ধকল, তায় জেটল্যাগ রয়েছে। আশা ছিল পরদিন ভোরবেলায় উঠে সূর্যোদয় দেখব ব্যালকনি থেকেই। তবে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করি নি, একটা জানলা ছিল খোলা। তাতে এসি ঘর ঠান্ডা করতে সময় নিচ্ছিল অনেক, আর বাইরে নাচ-গানের প্রচন্ড আওয়াজ আসছিল। ফলে যে ঘুমের ব্যাঘাত হল, তাতে আর পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগে ওঠা হল না। একটু দেরিতে উঠে তৈরি হয়ে কাছেই একটা রেস্তোরাঁতে ব্রেকফাস্ট সারলাম সাইপ্রাসের স্থানীয় কফি সহযোগে। কিছুটা সময় হাতে আছে, তাই ইচ্ছা হল লারনাকার একপাশে প্রাচীন শহর কিটিয়নের ধ্বংসাবশেষ দেখব। জায়গাটা হাঁটাপথে হোটেল থেকে মিনিট কুড়ি লাগবে। তবে বাইরে চড়া রোদ, তাই স্ত্রী-পুত্র যেতে রাজি হল না। রবিবার বলে কিটিয়নের আর্কিয়লজিকাল পার্ক বন্ধ রয়েছে, অন্ততঃ গুগল তাই বলছে। তবে ভাবলাম, অন্ততঃ জায়গাটা তো দেখতে পাব, ভিতরে ঢুকতে না পাই। গুগল ম্যাপ চালিয়ে খুঁজে খুঁজে জায়গাটা বের করলাম, তবে দেখলাম আমি উল্টোদিকের অংশে এসেছি যেখান থেকে গেট সবসময় বন্ধই থাকে। অবশ্য জায়গাটা খোলা, তাই বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। সোজাদিকের গেট যদিও রবিবারে বন্ধ থাকার কথা, তবে দেখলাম একদল পর্যটক পার্কের মধ্যে ঢুকেছে। বোধ হয় কন্ডাক্টেড ট্যুরের গাইড বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। ভাবলাম গেটকিপারকে বিশেষ অনুরোধ করলে হয়তো ঢুকতে দিতেও পারে, তাই পার্কের বাইরের রাস্তা ধরে ধরে পুরোটা ঘুরে মূল গেটে গেলাম। গেটকিপার ভদ্রলোক খুবই ভাল, একবার অনুরোধ করতেই বিনা বাক্যবয়ে দরজা খুলে দিলেন। আর সরকারিভাবে যেহেতু বন্ধ, তাই টিকিটের প্রশ্নও নেই!

                                         ছবিঃ কিটিয়নের প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ।

কিটিয়নের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয় প্রায় এক' বছর আগে। এর দুটো ভাগ আছে, কাঠারি আর পাম্পুলা। পুরো জায়গাটা তেমন বড় নয়। এখানে লোকবসতি শুরু হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শেষ ব্রোঞ্জ যুগে। প্রথমে মাইসেনীয় গ্রিকরা শহর গড়ে লাইমস্টোনের দেওয়াল তুলে শহর সুরক্ষিত করে। তারপর ফিনিশিয়রা (বর্তমান লেবানন অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসী) বসতি করে। কিটিয়ন শহর বাণিজ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এখান থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্যশস্য রপ্তানি হত। ফিনিশিয়রা কয়েকটি মন্দির তামা নিষ্কাশনের কারখানা গড়ে তোলে। তামা সাইপ্রাসের এক বিশেষ অর্থকরী খনিজ --- সাইপ্রাস নামের উৎপত্তিও তামার গ্রিক নাম কিপ্রস থেকে। মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল উর্বরতার  ফিনিশিয় দেবীর মন্দির, যাঁর গ্রিক প্রতিরূপ হল প্রেম উর্বরতার দেবী আফ্রোদাইতি। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরের টলেমি-গ্রিকরা কিটিয়ন দখল করে ফিনিশিয় রাজাকে মেরে মন্দিরগুলো ধ্বংস করে। এরপর ধীরে ধীরে কিটিয়নের বসতি লোপ পেয়ে যায়। তবে কিটিয়নের সমস্তটা এখনও খুঁড়ে বার করা হয় নি।  

হোটেলে ফেরার পথে রাস্তায় লারনাকা আর্কিওলজিকাল মিউজিয়ম দেখতে পেয়ে ঢুকে গেলাম। এতে আবার কোনও প্রবেশমূল্যও নেই। এখানে লারনাকা অঞ্চলের বসতির ইতিহাস, মাটির জিনিষপত্র অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিষের প্রদর্শনী রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব সাড়ে আট হাজার সাল থেকেই এই অঞ্চলে লোক থাকা শুরু করেছিল। প্রথম দিককার সময়ের জিনিসপত্রের নিদর্শন তেমন না পাওয়া গেলেও নব্য-প্রস্তর যুগের খ্রীষ্টপূর্ব সাড়ে সাত হাজার সাল থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার সালের মধ্যেকার অনেককিছুই আবিষ্কৃত হয়েছে। 

লারনাকায় আর একটা আকর্ষণ আছে --- একটা মধ্যযুগীয় দুর্গ। সেটা স্ট্র্যান্ডের উপরই, আমাদের হোটেলের খুব কাছে। বন্দর হিসেবে লারনাকার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জন্য এই দুর্গের প্রচুর গুরুত্ব। এটা অবশ্য কিটিয়নের তুলনায় অনেক পরের, চোদ্দ' শতাব্দীতে বাইজেন্টিয়ান রোমানদের তৈরি, যা অটোমানদের সময় কিছুটা পরিবর্তিত হয়। এখন অবশ্য এটা শুধুই মিউজিয়ম, প্রবেশমূল্য আড়াই ইউরো মাত্র।

                                       ছবিঃ লারনাকার মধ্যযুগীয় দুর্গ।

বেরোনোর সময় প্রায় চলে আসছিল, তাই হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। অবশেষে হোটেলে ফিরে চটপট বেরোনোর জন্য তৈরী হলাম। ট্যাক্সি ঠিক বারোটার সময় এসে গেছে। 

 

দ্বিতীয় পর্বঃ

লারনাকা থেকে চলা শুরু হবার পর মিনিট দশেক বাদে হাইওয়েতে পড়ল। ড্রাইভার বলল যে এখান থেকে শুরু করে পাফোস পৌঁছানো পর্যন্ত আর কোনও সিগনাল পড়বে না, রাস্তায় কিছু অসুবিধা না থাকলে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিটে পৌঁছে যাব। হাইওয়েটা প্রায় সমুদের ধার ধরে চলেছে সাইপ্রাসের একেবারে পুব থেকে পশ্চিমে।  যেতে যেতে হাইওয়ের ধারে দেখলাম পাহাড়ে বিরাট করে ধোঁয়া উঠেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম অ্যাকসিডেন্ট বুঝি, কোনও তেলের ট্যাংকার ধরণের কিছুতে আগুন লেগে গেছে। তারপর দেখলাম ওয়াইল্ড ফায়ার। শুখা মরশুম চলছে, তাই জঙ্গলে গাছ শুকিয়ে আগুন  ধরে যাচ্ছে। ড্রাইভার বলল চিন্তার কিছু নেই, আগুন নিয়ন্ত্রণেই আছে।

পাফোসের রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক মাঝামাঝি পড়ে লিমাসোল শহর, গ্রিক নাম Lemesos, সাইপ্রাসের বাণিজ্যিক রাজধানী, প্রধানতম বাণিজ্যিক বন্দর আর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। খানিকটা দূর থেকেই উঁচু উঁচু বহুতল বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছিল। আমরা অবশ্য লিমাসোলে ঢুকছি না, পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। আর লিমাসোলে সেই অর্থে সমুদ্রের বিচ ছাড়া খুব কিছু দেখারও নেই। লিমাসোলের কাছে দুটো দ্রষ্টব্য আছে, যা আমরা পরে দেখেছিলাম। সাইপ্রাসে, বিশেষ করে লিমাসোলে, ব্যাপকহারে রিয়েল এস্টেট কিনে নিচ্ছিল বিদেশীরা, প্রধানতঃ  রাশিয়ান 'অলিগার্ক'রা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার সময় এরা ক্ষমতার কাছাকাছি এসেছিল। সেই সুযোগে সত্তর বছর ধরে বহু মানুষের পরিশ্রমে গড়া অতবড় দেশের অধিকাংশ সম্পদ হাতিয়ে এরা অপরিসীম বিত্তশালী হয়ে ওঠে, দেশের বাকি মানুষদের অনিশ্চিত অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে। সেই অর্থে্র জোরে এরা বিভিন্ন দেশে সম্পত্তি কিনতে থাকে, বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সম্পদ ছড়িয়ে রাখলে ঝুঁকি কমানো যায়, বিশেষ করে রাশিয়ার অর্থনীতি যেখানে অস্থিতিশীল। সাইপ্রাস এই অলিগার্কদের বিশেষ পছন্দের জায়গা, কারণ এখানে কর কম, রিয়েল-এস্টেট পশ্চিম ইউরোপের মতো অত দামী নয়, সাইপ্রাস বাকি ইউরোপের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত, মনোরম আবহাওয়া, জীবনযাত্রা স্থিতিশীল --- প্রয়োজনে নাগরিকত্ব নিয়ে সাইপ্রাসে চলে এসে ইউরোপের অন্যত্র চলে যাবারও ছাড়পত্র মিলে যাবে। এই অলিগার্কদের এত সম্পত্তি কেনার ফলে তুলনায় অনেক অসচ্ছল স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে রিয়েল এস্টেট দামে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিল। কয়েকবছর আগে সাইপ্রাসের সরকার বিদেশীদের রিয়েল এস্টেট কেনার উপরে অনেক নিয়ন্ত্রণ চাপানোতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। 

পাফোসে ঢোকার পর গাড়ি হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে স্থানীয় রাস্তা ধরে আরও মিনিট দশেক যাবার পর আমাদের হোটেলটা পড়ল। পাফোস বেশ ছড়ানো শহর, আমাদের জায়গাটা শহরের উত্তরে। কনফারেন্স যে পাঁচতারা হোটেলে হবার কথা ছিল, আমাদের হোটেলটা ঠিক তার পাশে। অবশ্য আমাদেরটা পাঁচতারা নয়, তিনতারা। তবে সমুদ্রের উপরে --- সুইমিং পুলও আছে। আর একটা ছোট কিচেন সহ ঘরগুলো দু-কামরার সুইট। এর থেকে বেশি কিছুর দরকার কী? পরে অবশ্য অনিবার্য কারণে কনফারেন্সের জায়গাটা আরও সাত কিলোমিটার উত্তরে পাফোসের অনেকটা বাইরে আর একটা পাঁচতারা হোটেলে সরে যায়। ফলে হেঁটে যাওয়া যাবে না। আয়োজকরা অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাসের ব্যবস্থা করে দেবেন। ফলে আমরা আর খুবই ন্যায্যমূল্যে পাওয়া এই চমৎকার হোটেলটা বদলাই নি। কনফারেন্সের বাসের ব্যবস্থা যদি না হয়, স্থানীয় বাসের ব্যবস্থা এখানে ভালই আছে, আর ট্যাক্সি-বা উবের তো আছেই। তিনটেতে চেক-ইন, আমরা একটু আগেই এসে পড়েছি। রিসেপসনিস্ট বলল ঘর তৈরি করতে বলা হচ্ছে, অল্প সময় বাদেই পাওয়া যাবে। হোটেলেই পুলের ধারের রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ সারলাম। ফিরে এসে লাউঞ্জে বসে অল্প একটু অপেক্ষা করতেই চাবি পেয়ে গেলাম। একতলায় ঘর, সামনের উপর সুইমিং পুলে অনেক লোকজন আছে বলে একটু অস্বস্তিকর, কিন্তু উপরতলায় সি-ফেসিং ঘর খালি নেই, কী আর করা যাবে। 

অল্প সময় বাদে অভ্রান্তরা এসে পৌঁছালো। ওরা ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়েছিল, লন্ডন থেকে সরাসরি পাফোসে নেমেছে। তবে পাফোসের এয়ারপোর্ট থেকেও আধঘন্টার উপর লাগে ট্যাক্সিতে আসতে। ঝিনুকের একটু খাবারের থেকে অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাই ওরা যতটা সম্ভব বাড়িতে রান্না করে খায়। কিচেন তো আছেই হোটেলে, তাই কাছাকাছি কোনও মুদিখানা থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেওয়া হবে। আমরাও সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য ডিম, দুধ, পাউরুটি, মাখন, কফি ধরণের টুকিটাকি জিনিস কিনব বলে ওদের সাথে গেলাম। কাছেই দোকান, পুরোমাত্রার গ্রসারি নয় --- কনভিনিয়েন্স স্টোর, তবে যা দরকার মোটামুটি পাওয়া গেল। হোটেলে ফিরে এসে সমুদ্রের ধারে বসলাম খানিকক্ষণ। জায়গাটা বেশিরভাগটাই পাথুরে ক্লিফ --- বিচের অংশ কমই। পাফোস পশ্চিম উপকূলে বলে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায়। 


                                   ছবিঃ সূর্য ডুবে যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরে --- পাফোস থেকে। 

পরদিন, সোমবার, আমাদের কনফারেন্সে যাওয়ার আছে। মোট পাঁচদিনের কনফারেন্সে প্রথম দুদিন আমাদের, অর্থাৎ অভ্রান্ত আর আমার, ভূমিকা রয়েছে। শেষের তিনদিন তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার নেই আমাদের --- না গেলেও চলবে। অভ্রান্তরা ফিরে যাবে বৃহষ্পতিবার রাতে, আমরা শুক্রবার পাফোস থেকে লারনাকা গিয়ে তার পরদিন ফেরার ফ্লাইট ধরব। অর্থাৎ বুধ আর বৃহস্পতি --- এই দুদিন আমরা দুটো পরিবার একসঙ্গে ঘুরতে পারি। আর আমরা তিনজন শুক্রবারটাও পাচ্ছি। তাই ঘোরার পরিকল্পনাটা করতে বসলাম। আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে সব তথ্যই কম্প্যুটারে পাওয়া যায়। প্রথমেই দেখা হল ট্যুর কী পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় ট্যুর কোম্পানিরা যেসব ট্যুর চালায়, সেগুলো ট্রিপঅ্যাডাভাইসার বা ভায়াটর ওয়েব পোর্টালে পোস্ট করে, ওখান থেকেই ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ঘরে বসেই ট্যুর বুক করা যায়। ট্যুরের বিশদ বর্ণনা, রেটিং আর রিভিউ দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই দুটো পোর্টালে ভাল রেটিংএর ট্যুরগুলো ভালই হয়। বিভিন্ন কোম্পানি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বলে দামেও বেশ যুক্তিসঙ্গত হয়। এরা সাধারণতঃ হোটেল থেকেই সকালে তুলে নিয়ে যায় আর বিকেলে হোটেলে ফেরত দিয়ে যায়। পছন্দসই ট্যুরগুলোর মধ্যে রয়েছে  পাফোসের সংলগ্ন দ্রষ্টব্যগুলো নিয়ে একটা গোটা দিনের ট্যুর, সাইপ্রাসের কিছুটা ভিতরে ঢুকে ট্রুডোস পর্বতে কয়েকটা দ্রষ্টব্য আর লিমাসোলের কাছে দু-তিনটে জায়গা নিয়ে একটা সারাদিনের, রাজধানী নিকোসিয়া ঘোরার একটা ট্যুর আর পাফোস থেকে উত্তরে ব্লু লেগুন অঞ্চলে লঞ্চ রাইড সহ একদিনের ট্যুর। তবে দেখা গেল ট্যুরগুলো রোজ হয় না --- আমরা যে দুদিন যেতে চাইছি, তাতে পাওয়া যাবে না। ব্লু লেগুনটা শুধু আমরা শুক্রবার যাব --- অন্যগুলোর জন্য তাহলে কিছু বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ছজন আছিই --- সেক্ষেত্রে একটা বড় গাড়ি ভাড়া করা যেতে পারে। তাই রিসেপসনে খোঁজ নিতে গেলাম। দেখা গেল সাইপ্রাসের গাড়ি ভাড়ার নিয়মটা খুবই সহজ আর খুবই ন্যায্যমূল্যের --- ঘন্টাপ্রতি পঁয়ত্রিশ ইউরোতে ড্রাইভারসহ গাড়ি পাওয়া যাবে --- সাইপ্রাসের যে কোনও জায়গাতেই নিয়ে যাবে।  সবার মিলে ট্যুরবাসে যেতে যা টাকা লাগত, তার থেকে খুব বিরাট বেশি নয়। আর নিজেদের সুবিধামতো দ্রষ্টব্যস্থান বাছার আর সময় কাটানোর সুবিধা থাকছে। কাজেই সঙ্গে সঙ্গে বুধ-বৃহস্পতি দুদিনের  জন্য বুক করে নিলাম। শুক্রবার শুধু আমাদের জন্য ব্লু লেগুন ট্যুরের টিকিটও কেটে নিলাম। তবে দুঃখের বিষয়, সাইপ্রাসে ক্রেডিট কার্ড বহুল প্রচলিত হওয়া সত্ত্বেও ট্যাক্সিকে ভাড়া ক্যাশেই মেটাতে হয়, কারণ ড্রাইভারদের কাছে ক্রেডিট কার্ড মেশিন থাকে না। তাই দুদিনের ট্যাক্সি ভাড়া যা লাগবে আন্দাজ করে টি এম থেকে তুলে রাখলাম। ইদানিং ইউরোপের বেশিরভাগ ব্যাংকগুলো নিজেরা টি এম আর রাখে না। এখন ওগুলো কিছু টি এম কোম্পানি চালায় ব্যাংকগুলোর সাথে চুক্তিতে, আর তারা অনেক বেশি বিনিময় হার আর সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে। এতে ইউরো অঞ্চলের গ্রাহকদের বাড়তি কোনও খরচ না লাগলেও আমাদের মতো বাইরের খরিদ্দারদের খরচ অনেক বেশি পড়ছে। 

আমরা রাতের খাওয়া সারলাম হোটেল থেকে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই একটা সামুদ্রিক খাবারের স্থানীয় রেস্তোরাঁতে। রিসেপশন থেকে এটার বেশ প্রশংসা করেছিল। গ্রিল করা সামুদ্রিক মাছ অন্যান্য খাবার খুব ভাল পাওয়া যায়। এমনকি আমার মত নিরামিষাশীদের জন্যও স্যালাড সহ অনেক কিছুই আছে --- কোনও অসুবিধা নেই। 

পরের দুদিন কেটে গেল কনফারেন্সে ব্যস্ততায়। প্রতিশ্রুতিমতো বাস দেওয়া হয়েছিল আমাদের হোটেল থেকে যাওয়া আসার জন্য। কনফারেন্সটা হচ্ছিল কোরাল বে অঞ্চলে একটা পাঁচতারা হোটেলে। এখানে সমুদ্রের ধারটা দারুণ সুন্দর। যে হোটেলে হচ্ছিল, সেখানে কনফারেন্সের তরফ থেকে দুপুরের খাওয়াও দেওয়া হচ্ছিল, যা সাধারণতঃ এই ধরণের কনফারেন্সে দেওয়া হয় না। অসংখ্য পদ আর খুবই সুস্বাদু খাবার। 


                                       ছবিঃ কোরাল বে হোটেল থেকে সমুদ্র

কনফারেন্সে শ্রীতমের সঙ্গে দেখা হল। আমারই সহকর্মী, তবে বয়সে অনেক ছোট। ওর ফ্লাইট বাতিল হয়ে গিয়েছিল, তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অন্য পথে এসে পৌঁছেছে। জিনিসপত্রও এসে পৌঁছায় নি সঙ্গে সঙ্গে, আসার পরদিন পেল। ওকে আমাদের ঘোরার পরিকল্পনার কথা বলতে আগ্রহী হল। তবে শুধু বুধবারই যেতে পারবে, কারণ বৃহস্পতিবার ওর একটা সেমিনার দেবার আছে। ওকে জানালাম আমরা গাড়ি নিয়ে ওর হোটেল থেকে তুলে নেব। 

রাতে ফিরে হোটেলের উল্টোদিকে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁতে খেলাম দুদিন। খাবারের মান যথেষ্ট ভাল। আজকাল দেখেছি সব জায়গাতেই ভারতীয় রেস্তোরাঁ অনেক পাওয়া যায়। তাই ভারতবর্ষ থেকে যেসব পর্যটকেরা বিদেশে গিয়ে ভারতীয় খাবার পাওয়া যাবে কিনা তাই নিয়ে চিন্তায় থাকেন, তাদের বলি নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়ুন।  

 

তৃতীয় পর্বঃ 

সকালে উঠে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের মুখে ট্যাক্সি দাঁড়াবার জায়গাটায় যাবার প্রায় সাথে সাথেই ট্যাক্সি এসে হাজির। একটা বড় ভ্যান --- ড্রাইভারসহ দশজন ভালভাবেই বসতে পারে। ড্রাইভার আর শ্রীতমকে নিয়ে আমরা আটজন --- সুতরাং জায়গার কোনও অভাব নেই। আমি ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম ওর সাথে একটু গল্প করব বলে। আমাদের ড্রাইভারের নাম থিও। স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেকদিন, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর প্রৌঢ় মানুষটা একাই থাকে। থিও ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের জর্জিয়া প্রদেশের লোক, তবে জাতিতে গ্রিক। জর্জিয়ায় থিও ছিল ট্রেনলাইন পাতানোর ইঞ্জিনিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বিশাল দেশে রেললাইন পাতার কাজে বহু জায়গা ঘুরেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার সময় থিওর মতো বহু মানুষের নিশ্চিত চাকরি রাতারাতি উবে যায়। পশ্চিমা অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ ছিল করো শক থেরাপি, ভেঙ্গে দাও যাবতীয় চালু ব্যবস্থা, যত তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রীয় মালিকানা ধ্বংস করে ব্যক্তিপুঁজিভিত্তিক অর্থনীতি চালু হবে, তত তাড়াতাড়ি হুহু করে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ফল হয়েছিল প্রথম সাত বছরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির প্রায় বিয়াল্লিশ শতাংশ সংকোচন, দেশের সম্পদ লুটে মুষ্টিমেয় কিছু অলিগার্কের উৎপত্তি আর থিওর মতো অসংখ্য মানুষের অপরিসীম দুঃখ দুর্দশা। দেশে কোনও চাকরি পাবার সম্ভাবনা আর নেই, মাঝবয়েস পেরিয়ে যাওয়া থিও আর কী করে? জাতিতে গ্রিক বলে সাইপ্রাসে আশ্রয় জুটে গেল, আর গ্রিক তো ওর মাতৃভাষা। তা ছাড়া বলল ইংরাজি সহ আরও গোটা সাতেক ভাষা বলতে পারে। ইংরাজিতে একটু আড়ষ্ঠতা আছে অবশ্য, যদিও তাতে কথা চালাতে তেমন অসুবিধা হয় না। তবে কিনা ছোট্ট সাইপ্রাসে কোনও রেললাইনই নেই, থিওর অধিত বিদ্যার এখানে কোনও উপযোগিতা নেই। প্রথমে কিছু বছর কনস্ট্রাকসনের কাজ করার পর ট্যাক্সি কোম্পানির হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। নাঃ, কোনও অভিযোগ নেই। রোজগার বেশি না হলেও একা মানুষের দিব্যি চলে যায়। অবসর সময়ে গান শোনে বা ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের ডকুমেন্টারি দেখে। হোটেলে রিসেপসানিস্টের কাছেও শুনেছিলাম, সাইপ্রাসে মাথাপিছু রোজগার তেমন বেশি নয় আর গত দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় সাধারণ মানুষের ব্যাংক-আমানত থেকেও  সাড়ে ছ শতাংশ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছিল, যা থেকে থিওর মতো গরিব মানুষেরাও রেহাই পায় নি। ব্যাংকগুলো গ্রিসের সরকারি বন্ডে লগ্নি করে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছিল। দেশের সরকারের এমন সামর্থ্য ছিল না যে তাদের উদ্ধার করে। দেশ চালু রাখার জন্য বিদেশি ঋণ পেতে অগত্যা যে ব্যয় সংকোচনের পরিকল্পনা নিতে হয়, তাতে ছোট আমানতকারীদের টাকাতেও হাত দিতে হয়।

শ্রীতমের হোটেল কোরাল বের কাছে, আমাদের হোটেল থেকে উত্তরদিকে। ওকে তুলে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দক্ষিণদিকে চললাম। প্রথমে আমরা পাফোসের মধ্যে নিকটবর্তী দেখার জায়গাগুলো ঘুরে ট্রুদোস পর্বতের দিকে যাব। প্রথমে পড়ল পাফোসেরই 'টুম্বস অফ দ্য কিংস আর্কিওলজিক্যাল সাইট' এটা একটা ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট। সাইপ্রাসের দ্রষ্টব্যস্থানগুলো, বিশেষকরে এরকম প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গাগুলো, প্রায় সবই সরকারি মালিকানায় দক্ষভাবে পরিচালিত। প্রতি জায়গাতেই ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা আছে, যা দিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক  নিদর্শনগুলোর বিষয়ে বারকোড স্ক্যান করে সব তথ্য জানা যায়। টিকিটের দাম এখানে আড়াই ইউরো --- কোনও কোনও জায়গায় সাড়ে চার ইউরোও হতে পারে। তবে সারাদিনের টিকিট করে যতগুলো খুশি সাইট দেখা যেতে পারে সাড়ে আট ইউরোতে। আমাদের দুদিন ধরে সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার, তাই দৈনিক টিকিট কেনাই ভাল। তবে আবার পরপর তিনদিনের টিকিট সতের, অর্থাৎ দুদিনের দামে, তাই সেটাই কিনলাম, যদিও শেষদিনে এরকম কোথাও যাবার সুযোগ হবে না খুব সম্ভবতঃ।  

 নাম টুম্ব অফ দ্য কিংস হলেও এটা কিন্তু কোনো রাজা-রাজড়াদের সমাধিক্ষেত্র নয়, বরং পাফোসের  অভিজাতদের সমাধিস্ত করতে ব্যবহার হত তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত। তবে সমুদ্রের ধার থেকে উঠে আসা আর দেখতে এত জমকালো যে এইরকম নাম চালু হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা ভাগে নির্মাণ হয়েছে মৃতদের থাকার ঘরবাড়ি। পাথর কুঁদে মাটির নিচে খিলান দেওয়া ঘর বানানো আছে। একটা বাচ্চারও সমাধি দেখা গেল, দু হাজার বছর ধরে ওর স্বল্পায়ু জীবনের স্মৃতি বহন করছে পৃথিবীতে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে থাকা বাড়িগুলো অপূর্ব দেখতে। তবে জিনিসপত্র কিছুই প্রায় পাওয়া যায় নি এই সমাধিস্থল থেকে। বহু বছর ধরে কবর-চোরেরা লোপাট করে ফেলেছে। সব মিলে আধ ঘন্টার মতো লাগল দেখতে। চাইলে আরও সময় কাটানো যায়। 

এর পরে আমাদের গন্তব্য হল কাটো পাফোস আর্কিওলজিকাল পার্ক। এটা পাফোস বন্দরের গায়ে লাগানো, আর একটা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে এখনও খননকার্য চলছে। মোটামুটি যা জানা গেছে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মত সময় কাটো পাফোস প্রথম গড়ে ওঠে। পাফোসের নতুন এলাকার মধ্যে পড়ে বলে নিয়া পাফোস নামেও পরিচিত। এখানে বেশ কয়েকটা 'হাউস' রয়েছে, যেমন হাউস অফ ডাইওনিসাস, হাউস অফ অর্ফিওস, ভিলা অফ থিসিয়াস, হাউস অফ আওন ইত্যাদি। এরা গ্রিক রূপকথার খুবই পরিচিত নাম। হাউস অফ ডাইওনিসাসকে প্রাচীনকালের মিউজিয়াম বলা যেতে পারে। এখানে মোজাইক পাথর জুড়ে জুড়ে ছবি বানিয়ে গ্রিক রূপকথার নানা ঘটনা ধরা হয়েছে। কিছু কিছু মোজাইক উঠে গেলেও অনেকগুলো ছবিই প্রায় অক্ষত রয়েছে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থেও  ছবিগুলো বিশাল, বেশিরভাগক্ষেত্রেই মানুষের থেকে বড় আকৃতির।



    ছবিঃ বাঁদিকে টুম্ব অফ দ্য কিংস। ডানদিকে হাউস অফ ডাইওনিসাসে মোজাইকে গ্রিক রূপকথা। 

হাউস অফ অর্ফিয়স অনেকটা একই ধরণের। ভিলা অফ থিসিয়স ছড়ানো জায়গা জুড়ে তৈরি। থাম দিয়ে বানানো বাড়িও আছে, আবার মোজাইকের কাজে গ্রিক রূপকথাও আছে। থিসিয়স কেমন করে গোলকধাঁধা জয় করল সেই গল্প ছবিতে দেখানো হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, গোলকধাঁধাকে একটা মানুষের রূপে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ বিমূর্ততা। এছাড়া রয়েছে অ্যাগোরার কোর্টচত্ত্বর, একটা প্রাচীন থিয়েটারমঞ্চ, একটা চার্চ ব্যাসিলিকা অফ ক্রিসোপলিটিসা, যা বিভিন্ন যুগে নতুন করে গড়া হয়েছে। 

আর সামান্য দূরে আছে পাফোস দুর্গ। সমুদ্রে গা লাগোয়া এই দুর্গের উপর থেকে চারপাশটা চমৎকার দেখা যায়। বলা বাহুল্য, শহরকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই এই দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। দুর্গের একতলায় পাফোস এলাকার মেরিন লাইফের উপর একটা আধুনিক মিউজিয়াম রয়েছে। 

দুর্গ থেকে বেরিয়ে বন্দরের ধার ধরে 'প্রমেনাদে'তে সার সার দোকান আর রেস্তোরাঁ। তার একটাতে ঢুকে আইসক্রিম খাওয়া হবে ঠিক হল। দুপুরের খাওয়া করা হবে ট্রুডোস পর্বতে একটা গ্রামে, তবে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে যেহেতু, হাল্কা কিছু খেয়ে নেওয়া ভাল, বিশেষ করে বাচ্চার জন্য। এখানে আবার একটা রেস্তোরাঁ খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য একটা পেলিক্যান পাখি পোষে। সেটা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তার দিকে মাছ ছুঁড়ে দিতে পেলিক্যানটা ওর বিরাট ঠোঁটটা খুলে কপ করে মাছটা গিলে ফেলল। 

খাওয়া শেষ করে আমরা পার্কিংয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। থিও ওখানেই অপেক্ষা করছিল। পাহাড়ের  রাস্তা সমুদ্রের ধার ছেড়ে দ্বীপের মাঝের দিকে চলল। প্রথম দিকে চওড়া ডিভাইডেড হাইওয়ে। পরের দিকে অনেকটা উপরে ওঠার পর রাস্তা আঁকাবাঁকা আর সরু হয়েছে।  এটা সাইপ্রাসের অন্যতম প্রধান ওয়াইন উৎপাদক অঞ্চল। তাই আঙুরগাছে দুদিক ভরে আছে। পাহাড়ে বৃষ্টিও হয় যথেষ্ট। আঙুর ছাড়াও আখরোট, এপ্রিকট এসবেরও চাষ হয়। প্রায় ঘন্টাদেড়েক যাবার পর পৌঁছালাম আমাদের প্রথম গন্তব্য ওমোদোস গ্রামে। তবে গ্রাম বলতে অজ-পাড়াগাঁ নয়, এটা রীতিমত ট্যুরিস্ট স্পট। মাঝের চত্ত্বরে সার সার গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। ছোট বসতি হলেও ধাঁচটা পুরোনো ছোট ইউরোপিয়ান শহরের মতো --- গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ি, পাথরে বাঁধানো পায়ে হাঁটার রাস্তা, আর মাঝখানে চমৎকার একটা বাইজান্টিয়ান চার্চ, হোলি ক্রস মনাস্টেরি।  এটা প্রথম কখন তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে গল্পকথা চালু আছে, তবে বর্তমানের চার্চটা প্রথম চার্চটা ভেঙ্গে যাবার পর তৈরি হয়েছে। বলা হয় সম্রাট কন্সটান্টিনের মা রানি এলেনা নাকি জেরুজালেম থেকে একটা ক্রস নিয়ে এসে এখানে পত্তন করেছিলেন, যাতে যিশুখ্রিস্টকে বিদ্ধ করা ক্রুশটার একটা অংশ ছিল। আর নাকি এখানে আছে তাঁকে বেঁধে রাখার জন্য যে দড়ি ব্যবহার হয়েছিল, তার একটা অংশ। এখানে প্রতিবছর একবার একটা বিশাল জমায়েত হয়, সারা সাইপ্রাস থেকে লোকে এসে জড়ো হয়। তখন নাকি পার্কিং পেতে এতই অসুবিধা হয় যে লোককে কুড়ি কিলোমিটার দূরে পার্ক করে আসতে হয়। মনাস্টেরির ভিতরে অনেক বাইজান্টিয়ান আর্টের সংগ্রহ আছে। তবে দুঃখের বিষয়, ভিতরে ছবি তোলা বারণ। 

মনাস্টেরি থেকে বেরিয়ে আমরা যাব দুপুরের খাবার খেতে। প্রচুর রেস্তোরাঁ রয়েছে সাইপ্রাসের স্থানীয় খাবারের। একটা পছন্দ করে বসা হল। বিভিন্ন ধরণের স্যালাড, পাস্তা, গ্রিল করা মাছ, ভেড়ার ঠ্যাং ঝলসিয়ে বানানো ল্যাম্ব শ্যাঙ্ক --- অজস্র পছন্দের সুযোগ আর দামও বেশ যুক্তিসঙ্গত। আর সবথেকে বড় কথা, টাটকা সবজি বা মাছমাংসের চমৎকার স্বাদ। এখানে আলু দিয়ে তৈরি একধরণের পাস্তা খেয়ে বেশ লাগল। আমার সঙ্গীরা বলল ল্যাম্ব শ্যাঙ্কটা খুবই ভাল রান্না হয়েছে। গাড়িতে ফেরার পথে একটা দোকানে নানা ধরণের শুকনো ফল বিক্রি হচ্ছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা সবাই। সবই স্থানীয় উৎপাদন। কিছু কিনে নেওয়া হল বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। 

এরপর থিও আমাদের নিয়ে গেল ট্রুডোস পর্বতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায়। এখানে একটা আবহাওয়া পর্যালোচনা করার অবজার্ভেটরি আছে, তবে ভিতরে সাধারণ লোকের যাবার সুযোগ নেই। সেখান থেকে অল্প দূরে একটা উপযুক্ত ভিস্তা পয়েন্ট দেখে গাড়ি দাঁড় করালো। একটা সুন্দর পিয়ের বানানো রয়েছে, যেখান থেকে নিচে বহুদূর দেখা যায়। প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে উপকূল অঞ্চল মনে হচ্ছে একেবারে হাতের নাগালে। আর অন্যপাশে তুর্কি অধিকৃত-সাইপ্রাসও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এখানকার উচ্চতা প্রায় দু হাজার মিটার। তাই শীতকালে প্রচুর বরফ পড়ে। সেই বরফ গলে যে পুষ্ট জলের ধারা নামে সেগুলো বাঁধ দিয়ে আটকে বেশ কিছু জলাধার তৈরি করা হয়েছে, যা সাইপ্রাসের জলের চাহিদা ভালভাবেই মেটাতে পারে। এই জলাধারগুলো তৈরির আগে সাইপ্রাসকে জলের কষ্টে ভুগতে হয়েছিল কখনও কখনও, তবে সেসব অসুবিধা এখন আর নেই। প্রচুর বরফের চাপ সামলানোর জন্য এখানে পাইন গাছগুলোর ডালপালায় বিশেষ  অভিযোজন ঘটেছে। 


                                        

                                         
                                           ছবিঃ ট্রুডোস পর্বতের উপর থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ।

ট্রুডোস পর্বতে আমাদের শেষ গন্তব্য ফিনি (Foini) গ্রামে হান্তারা (Chantara) জলপ্রপাত। খুব উঁচু বা চওড়া না হলেও গহন বনের মধ্যে প্রাণবন্ত উপস্থিতি। পাথরের উপর বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে জলের শব্দ শুনতে শুনতে। আমাদের অবশ্য হাতে অত সময় নেই। পাফোসে ফিরতে হবে। ফেরার পথে লিমাসোলের কাছে আর দুটো জায়গা দেখার ইচ্ছে। এর প্রথমটা হল কলোসি দুর্গ। লিমাসোলের থেকে মাত্র পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে কলোসি গ্রামে অবস্থির এই দুর্গ বানানো হয়েছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লিমাসোলের সুরক্ষার জন্য, তারপর বার কয়েক নতুন অংশ জোড়া হয়েছে। এই অঞ্চলে আখের চাষ হত, তাই একটা চিনিকল বানানো হয়েছিল দুর্গের পাশে। দুর্গের উপর থেকে চারিদিকের একটা চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। 

কলোসি ছেড়ে পাফোসের দিকে আর কিছুটা এগোলে পড়ে প্রাচীন শহর কুরিয়ন। বনের দেবতা অ্যাপোলো হেলাইটিসের সম্মানে গড়ে তোলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে অষ্টম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা এই শহরের ধ্বংসস্তুপ এখন সাইপ্রাসের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে একটা বিরাট ওপেন এয়ার অ্যাম্ফিথিয়েটার আছে, সমুদ্রের ধারে। অর্ধচন্দ্রাকার স্টেডিয়ামের আকৃতির অনেকগুলো সারি ধরে পাথরের উপর বসার জায়গা পর পর উপরে উঠে গেছে। একদম নিচে কেন্দ্রে রয়েছে স্টেজ। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এটা এখনও চালু রয়েছে। আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন শেক্সপীয়ারের লেখা কোনও একটা নাটকের মহড়া চলছে। 


                                            ছবিঃ কুরিয়নের অ্যাম্ফিথিয়েটার। 

পাফোসের উপকন্ঠে সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ এসে উপস্থিত হলাম এদিনের শেষ দ্রষ্টব্য আফ্রোদাইতির জন্মস্থানে। এটা আসলে সমুদ্রের মধ্যে কতগুলো পাথরের সমষ্টি। গ্রিক পুরাণের গল্প অনুযায়ী সৌন্দর্য আর উর্বরতার দেবী আফ্রোদাইতি জন্মের পর সমুদ্র থেকে এইখানেই উঠে আসেন। তবে তাঁর জন্মের গোড়ার কাহিনীটা বেশ বীভৎস। আফ্রোদাইতি অযোনিসম্ভূতা। দেবরাজ জিউস সহ অন্যান্য দেবতাদের বাবা ক্রোনাস ছিল আসলে এক প্রচন্ড হিংস্র দানব। সে নিজের বাবা ইউরেনাসের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে ইউরেনাসের যৌনাঙ্গ কেটে বস্তায় পুরে এইখানে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তখন উত্তাল সমুদ্রে এক বিশাল ফেনার সৃষ্টি হয়। সেই ফেনা থেকে এক অপরূপ সুন্দরী নারীর জন্ম হয়। ঝিনুকের খোলা ফাঁক করে নগ্ন দেহে উঠে আসা সেই নারীই দেবী আফ্রোদাইতি। রোমানরা তাকে বলে ভিনাস। ভিনাসের জন্মের দৃশ্য কল্পনা করে ইতালীয় রেনেশাঁ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লির আঁকা 'বার্থ অফ ভিনাস' পৃথিবীর সর্বকালের সুন্দরতম ছবিগুলির একটি, যা ফ্লোরেন্সের ইউফফিজি গ্যালারিতে রাখা আছে। সাইপ্রাসের লোককথায় বলে, পূর্ণিমার রাতে আফ্রোদাইতির জন্মস্থানে যে নগ্নদেহে সাঁতার কাটে, দেবী তাকে অনন্তযৌবন দান করেন। তবে সাঁতার কাটতে হবে সেই পাথরগুলোকে ঘিরে গোল করে, ঘড়ির কাটার উল্টোদিকে। তবেই না সময় উল্টোদিকে ঘুরবে!


ছবিঃ বাঁদিকে আফ্রোদাইতির জন্মস্থানের পাথর। ডানদিকে বত্তিচেল্লির 'বার্থ অফ ভিনাস'

কনফারেন্সের ব্যাংকুয়েটটা সেদিনই ছিল, এর পরে পরেই, আফ্রোদাইতি রকের খুব কাছেই একটা পাঁচতারা হোটেলে। কনফারেন্সের লোকজনকে কনফারেন্স থেকেই একবেলার ট্যুরে পাফোসের আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলো ঘোরানোর জন্য বাসে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমরা ব্যক্তিগতভাবে সারাদিনের ট্যুরে এসেছিলাম বলে সেই ট্যুরে যাই নি। আফ্রোদাইতি রকে এসে ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। থিওকে বললাম অভ্রান্ত, শ্রীতম আর আমাকে ব্যাংকুয়েটে পৌঁছে দিয়ে আমাদের পরিবারের লোকেদের হোটেলে ছেড়ে আসতে। সব মিলে বারো ঘন্টার একটু বেশি হয়েছিল সেদিন। তের ঘন্টার টাকা আর কিছুটা বখশিস দিতে থিও খুব খুশি হল। সাইপ্রাসে ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বখশিস করার খুব বেশি চল নেই। বাড়তি টাকা পেয়ে থিও বলল, আজ একটু পাবে গিয়ে মদ খাবে। তা সে খেতেই পারে, সারাদিন তো কম খাটনি যায় নি ওর। তবে বলে দিলাম, পরদিন আবার যাব আমরা, যেন সকাল সাড়ে আটটায় আবার এসে হাজির হয় আমাদের হোটেলে। 

ব্যাংকুয়েটটাও ছিল বেশ। সুস্বাদু টাটকা খাবার অনেক রকমের, সেই সঙ্গে ওয়াইন অন্যান্য পানীয় অঢেল। আর দেখলাম একরকম স্থানীয় নাচ, একজন মাথায় একের পর এক গ্লাস চাপিয়ে প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু করে, তার উপর একটা ওয়াইনের বোতল দিয়ে নাচতে থাকল, কিন্তু একটা কিছুও মাথা থেকে পড়ে গেল না, ভেঙ্গে গেল না! মানুষ সব পারে। 

 

চতুর্থ পর্বঃ

পরদিন সাড়ে আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্টের পর লবিতে যেতেই থিওর দেখা পেলাম। আজ গন্তব্য রাজধানী নিকোসিয়া। সাইপ্রাসের ঠিক মাঝে অবস্থিত দ্বিখন্ডিত শহর, ঠিক যেন ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার বার্লিন। গ্রিক নাম Leskosia, তুর্কি নাম Leskosa, ইংরাজিতে লেখা হয় Nicosia. আজ শুধু আমরা জন যাচ্ছি। লিমাসোলের দিকে যেতে যেতে হাইওয়ে নিকোসিয়ার দিকে বেঁকে গেল। ঘন্টাদুয়েক বাদে একটা পার্কিং চত্ত্বরে গাড়ি দাঁড় করাল থিও। সেখান থেকে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে শহরের রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। নিকোসিয়া আড়াই হাজার বছরের পুরোনো শহর, অজস্র ক্যাথেড্রালমনুমেন্ট আর মিউজিয়াম রয়েছে, আয়তনেও কম বড় নয়। তাই ঘন্টাকয়েকে সবকিছু দেখে ফেলার উপায় নেই। আমরা ঠিক করেছিলাম পথে পড়ে এমন কয়েকটা দ্রষ্টব্য দেখে শহরের মূল বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ দ্বিখন্ডিত অবস্থাটা উপলব্ধি করব। প্রথমে সেন্ট জন্স ক্যাথেড্রাল বলে একটা বাইজান্টিন চার্চ দেখলাম। এর পাশেই আর্চবিশপের মহল, তবে সেখানে সাধারণের যাবার অনু্মতি নেই। নিকোসিয়া পুরোনো শহরকে ঘিরে রয়েছে ভেনিসিয়ান ওয়াল, যা সাইপ্রাসের ভেনিসিয় শাসকেরা বানিয়েছিল অটোমানদের রোখার উদ্দেশ্যে। তবে তাতে কাজ হয় নি, অটোমানরা নিকোসিয়ায় ঢুকে পড়েছিল ঠিকই। নিকোসিয়ার প্রধান দুটো মিউজিয়াম --- সাইপ্রাস মিউজিয়াম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহের জন্য এবং নিকোসিয়া মিউনিপ্যাল আর্ট সেন্টার আধুনিক আর্টের জন্য বেশ পরিচিত। শহরের এক প্রান্তে আছে ফার্মাগুস্তা গেট। এটা আগেকার দিনে বাইরে থেকে রাজধানী নিকো্সিয়ায় ঢোকার জন্য ব্যবহার হত। এখন এটা একটা নিছক ট্যুরিস্ট স্পট, ছবি তোলার জন্য খুবই জনপ্রিয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শহীদদের স্মৃতিতে রয়েছে মিউজিয়ম অফ দ্য ন্যাশানাল স্ট্রাগল আর লিবার্টি মনুমেন্ট।  

   


                    ছবিঃ বাঁদিকে সেন্ট জন্স ক্যাথিড্রালের ভিতর। ডানদিকে লিবার্টি মনুমেন্ট।

 

চড়া রোদ থাকায় নিকোসিয়া দ্বীপের মাঝখানে হওয়ায় পাফোসের তুলনায় বেশ গরম। সঙ্গে বাচ্চাও আছে, তাই আর বেশি হাঁটাহাঁটি না করে ঠিক হল থিওকে ডেকে গাড়িটা নিয়ে শহরের মাঝে গিয়ে একটা উপযুক্ত জায়গা দেখে দুপুরের খাওয়া সারা হবে। পার্কিং লটে গিয়ে ফোন করতেই থিওর দেখা মিলে গেল। থিও আমাদের নামিয়ে দিল লেড্রা স্ট্রিটের এক জায়গায়, যেখানে অনেক খাবার দোকানপাট আছে। এই লেড্রা স্ট্রিট আবার চলে গেছে তুর্কি নিয়ন্ত্রিত অংশে। সীমানা পেরিয়ে ওদিকে একবার যাওয়াটা আমাদের একটা বিশেষ লক্ষ্য। 

 

দুপাশে সার সার দোকান, তার মধ্যে উপযুক্ত খাবারের দোকান খুঁজছি। এমন সময় এক বাংলাদেশী ছাত্রের সঙ্গে দেখা। আমাদের নিজেদের মধ্যে বাংলা কথা বলতে শুনে নিজে থেকেই এগিয়ে সে কথা বলল। ও নিকোসিয়ার সাইপ্রাস ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। একটা আরবি রেস্তোরাঁ দেখিয়ে বলল এখানে ভাল কাবাব পাওয়া যায়। ও ওখানে মাঝে মধ্যেই খায়। রেস্তোরাঁটা আমাদের আগে চোখে পড়েছিল, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আর কাবাব ছাড়াও ফলাফেল, যা কিনা ছোলা বেটে বল বানিয়ে তেলে ভাজা হয় --- ভূমধ্যাসাগর অঞ্চলের একটা সুপরিচিত খাবার, তাই দিয়ে বানানো র‍্যাপ পাওয়া যায়। সঙ্গে গোটা গোটা আলুভাজা আর স্যালাড। দুপুরের খাবার জন্য আর কী চাই! এটা তেমন বড় কোনও রেস্তোরাঁ নয়, তবে খদ্দেরদের জন্য ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আমার ছেলে তো বিশেষ খুশি তাতে। বেশি দেখার জন্য ঘোরাঘুরি করব না, তাই সময় নিয়ে বেশ আয়েশ করে খেলাম। তারপর একটু আধটু স্যুভেনির কিনে লেড্রা রোড ধরে হাঁটতে থাকনাম চেক পোস্টের দিকে। রাস্তায় একটা বাড়িতে দেখলাম একতলা থেকে দোতলা দেওয়াল জুড়ে একটা বুগেনভেলিয়া গাছ, আর তা ভরে আছে উজ্জ্বল গোলাপী রঙের ফুলে।

 


যেতে যেতে হঠাৎ ই দেওয়াল শহরকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে। রাস্তার উপরেই ছাউনির মধ্যে মঞ্চ বেঁধে ইমিগ্রেশন অফিসার বসে। পাসপোর্ট আমরা সঙ্গে নিয়েই এসেছিলাম, কারণ জানতাম চেকপোস্ট পেরোতে দেখাতে হবে। প্রথমে গ্রিক অংশের অফিসার, পাসপোর্ট দেখে বেরোনোর জন্য অনুমতি দিচ্ছে। তারপর একটু নো-ম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়েই তুর্কি অংশের অফিসার বসে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে স্বীকৃতিহীন দেশ Turkish Republic of Northern Cypus (TRNC) এ ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে। এর জন্য ভিসা লাগে না। সাইপ্রাসের নাগরিকেরা তো বটেই, যারাই সাইপ্রাসে বৈধভাবে ঢুকেছে, তারাই চেকপোস্ট পেরিয়ে ওপারে যেতে পারে। অনেকের তো জীবিকার খাতিরে রোজই যেতে হয়।

 

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ‘বর্ডার’ পেরোনো হয়ে গেল --- একেবারে পায়ে হেঁটে। নিকোসিয়ার গ্রিক আর তুর্কি অংশের মধ্যে তফাৎটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। গ্রিক অংশটা যেমন সাজানো-সুশৃঙ্খল, তুর্কি অংশটা বেশ ঘিঞ্জি, জৌলুসহীন --- তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সেটা বোঝাই যায়। অনেকটা নতুন দিল্লি আর পুরোনো দিল্লির তফাতের মতো। ঢুকে একটু এগোলেই প্রথমে চোখে পড়ে একটা মসজিদ --- উপরে পতাকা উড়ছে। সেলিমিয়ে মসজিদ --- প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো। তবে শুরুতে এটা চার্চ ছিল --- সপ্তদশ শতাব্দীতে অটোমানরা নিকোসিয়ার দখল নেবার পর একে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। পথে প্রচুর স্যুভেনির শপ। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর ট্যুরিস্টই আমাদের মতো নিছক বর্ডার পেরোনোর অভিজ্ঞতাটা পেতে চায়। টার্কিশ লিরা এখানকার সরকারি বিনিময় মুদ্রা, তবে ইউরো চলে দিব্যি। দুয়েকটা টুকিটাকি স্যুভেনির কিনে একটু এগিয়ে আতাতুর্ক স্কোয়ার বলে একটা ঘেরা চত্ত্বরে এসে পড়লাম। দু তলা বর্গাকৃতি কোর্টহাউস, এখানে বেশ কিছু ছোট ছোট দোকানপাট আর অফিস আছে। একটা ছোট রেস্তোরাঁতে বসে একটু কফি-আইসক্রিম খাওয়া হবে ঠিক হল। রেস্তোরাঁর ভিতরে বসার জায়গা নেই, বাইরে টেবিল পেতে বসা, অনেকটা কলকাতার চায়ের দোকানের মতো। তবে মাথার উপর ছাদ আছে। গরম আছে, তাই ফ্যানও চালিয়ে দিল। দু বোতল জল, কফি আর আইসক্রিম মিলে ছজনের পঁচাশি টার্কিশ লিরা, যা কিনা বর্তমান বিনিময় হারে মাত্র পাঁচ ইউরো! সমসাময়িককালে টার্কিশ লিরার মূল্যে বিরাট পতনের পর এইরকমই দাম দাঁড়িয়েছে।

 

তবে যা ট্যুরিস্টদের পৌষমাস, তাইই স্থানীয় মানুষের দুর্গতির কারণ। মনে আছে, বছর পনের আগে তুরস্কে গিয়েছিলাম যখন, টার্কিশ লিরার মান তখন প্রায় আমেরিকান ডলারের কাছাকাছি ছিল (যদিও সেটা ডলারের দুর্বল সময় চলছিল), আর এখন ডলারে পনের লিরা। কোনও মুদ্রার এত বড় পতন হলে সেই দেশের মানুষের কিছু দুর্গতি হয়ই, দেশের মধ্যে থাকলেও, কারণ অনেককিছুই বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। TRNC এর বাড়তি সমস্যা হল স্বীকৃতির অভাব। সেইজন্য বাণিজ্যিক আদানপ্রদান করতে অসুবিধা হয়, সব ব্যাপারেই তুরস্কের উপর নির্ভরশীল। আর তুরস্কের নিজের অর্থনীতিই ধুঁকছে। চরম দক্ষিণপন্থী এর্দোয়ান তুরস্কের রাষ্ট্রপতি হবার পর থেকে সেই দেশে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ আর তীব্র জাতীয়তাবাদকে চাগানোর ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে, যা তাদের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করেছে। TRNC এর অর্থনীতি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করে। যারা পেরেছে দক্ষিণে গিয়ে সেখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলে যাবার চেষ্টা করছে। 

 



 ছবিঃ বাঁদিকে সীমানা পেরিয়ে তুর্কি অংশে। ডানদিকে নিকোসিয়ার তুর্কি অংশে আতাতুর্ক স্কোয়ার।

 

আবার সীমান্ত পেরিয়ে গ্রিক অংশের নিকোসিয়ায় ফিরে থিওকে ফোন করে ডাকতে ও এসে আমাদের তুলে নিল, লেড্রা স্ট্রিটে যেখানে আগে নামিয়ে দিয়েছিল, সেখান থেকে। ওদিনই রাতে অভ্রান্তদের ফেরার ফ্লাইট পাফোস থেকে, তাই বেরিয়ে পড়লাম নিকোসিয়া ছেড়ে। পথে আরও দুটো জায়গা দেখে নেব ঠিক হল।

প্রথমটা হল পাফোসের ষোল কিলোমিটার আগে কুকলিয়া গ্রামে পালিওপাফোস --- দ্য স্যাংকচুয়ারি অফ আফ্রোদাইতি। আড়াই হাজার বছর আগে তৈরি এই মন্দির কমপ্লেক্স অবশ্য প্রায় পুরোই ভেঙ্গে গেছে। ছ হাজার বছর ধরেই সাইপ্রাসের অধিবাসীরা উর্বরতার দেবীর উপাসনা করত। গ্রিকরা আসার পর আফ্রোদাইতির জন্মের  পৌরাণিক আখ্যান পাফোসের সঙ্গে জড়িয়ে যাবার পর থেকে আফ্রোদাইতি হলেন সাইপ্রাসে সবথেকে বেশি পূজিতা দেবী। তাই তাঁর সম্মানে এরকম বড় একটা মন্দির থাকা কিছু আশ্চর্য নয়। তবে মন্দির চত্ত্বর ভেঙ্গে গেলেও একদিকে মিউজিয়ম বানানো হয়েছে। সেখানে প্রাচীন শিল্পকলা, ব্যবহার্য জিনিস, মোজাইকে গ্রিক রূপকথার গল্প এইসবের একটা চমৎকার সংগ্রহ রয়েছে।

এরপর আমরা গেলাম পাফোসে প্রায় ঢুকে পড়ার মুখে নিওফিটস মনাস্টেরিতে। পাহাড়ের উপর গুহা কেটে সেখানে সন্ন্যাসীরা থাকত, আর দেওয়ালে ফ্রেস্কো আঁকত। অনেকটা অজন্তার মতো, তবে অবশ্য অত বিস্তৃত নয়। আর সেই সঙ্গে আছে উপাসনাগৃহ আর মিউজিয়ম। তবে এটা একটা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সরকারি নয়। তাই সাইপ্রাসের আর্কিওলজি বিভাগের থেকে দৈনিক টিকিট এখানে গ্রাহ্য নয়, আলাদা করে টিকিট কিনতে হয়। মূল্য দু ইউরো করে।

এ ছাড়া পাফোসে ও আর আশেপাশের মধ্যে যাওয়ার জায়গা বলতে ছিল পুরোনো পাফোস শহর। আর একটু সময় হাতে থাকলে একবার ঢুঁ মারতাম সেখানে। তবে ফ্লাইট ধরার প্রশ্ন যেহেতু, নিওফিটস দেখেই সেদিনের মতো হোটেলে ফিরলাম। 



 

ছবিঃ বাঁদিকে কুকলিয়ায় স্যাংকচুয়ারি অফ আফ্রোদাইতি। ডানদিকে নিওফিটস মনাস্টেরি।


পঞ্চম পর্বঃ

পরদিন শুধু আমরা তিনজন ব্লু লেগুন ট্রিপে যাচ্ছি। ট্রিপঅ্যডভাইসার পোর্টাল থেকে টিকিট কিনেছিলাম। এটা আটঘন্টার ট্যুর, ইওএস ট্যুরস বলে একটা কোম্পানি নিয়ে যাচ্ছে। ব্লু লেগুনে তিনঘণ্টার লঞ্চ চড়ানো ছাড়াও আরও কয়েকটা জায়গা নিয়ে যাবে। হোটেল থেকেই বাসে তুলে নেবে, আবার হোটেলেই ফিরিয়ে আনবে। মাত্র পঁচিশ ইউরো টিকিটে এটা একটা দুর্দান্ত ডিল। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে হোটেল থেকে চেকআউট করে নিলাম, কারণ পাফোসে ফিরেই আমরা ট্যাক্সি নিয়ে লারনাকায় চলে যাব পরেরদিন সকালে লারনাকা থেকে ফেরার ফ্লাইট ধরব বলে। ট্যাক্সিও রিসেপসন বুক করে দিল। কখন ফিরব ঠিক নিশ্চিত নই, মোটামুটি হিসেব করে পাঁচটায় ট্যাক্সি আসতে বলে দিলাম। কিছুটা দেরি হলেও ক্ষতি নেই, কারণ ফ্লাইট পরদিন। বাক্স-প্যাঁটরা লেফট লাগেজে রেখে দিলাম। ট্যুর কোম্পানি থেকে ফোন করে বলল হোটেলের সামনে যে বাস স্টপ আছে, সেখানে অপেক্ষা করতে, পৌনে নটা নাগাদ বাস আসবে। বাস এলে ড্রাইভার আমাদের নামধাম জিজ্ঞাসা করে লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে আমাদের বাসে উঠতে বলল। মোটামুটি পুরো বাসই ভর্তি দেখা গেল। তবে আমরা এক জায়গাতেই বসতে পারলাম। এটা যাচ্ছে পাফোস থেকে উত্তরদিকে, সাইপ্রাসের উত্তরপশ্চিম অংশে। কোরাল বে পেরিয়ে সমুদ্রের ধার ধরে। সবুজাভ-নীল সমুদ্র বাঁপাশে রেখে চলেছি আমরা। আধঘন্টাটেক যাবার পর বাস একটা স্পটে দাঁড় করালো। এই জায়গাটায় সমুদ্রের উপর ক্লিফ রয়েছে। নীল জলের সঙ্গে হলদেটে পাথরের রঙের তারতম্যটা ভীষণভাবে নজর কাড়ে। সমুদ্রের জল পাথরে ধাক্কা দিতে দিতে গর্ত করে ফেলেছে, যাকে বলে সী কেভ। অবশ্য ওইরকম গুহায় যেখানে সারাক্ষণ সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে, সেখানে মানুষের বাস করার চেষ্টা হলে সেটা খুব একটা সুখকর হবে না। তবে এখানে আর একটা দর্শনীয়  জিনিষ রয়েছে, সেটা হল একটা হেলে পড়ে জাহাজ। তাই জায়গাটার নাম হয়েছে শিপ রেক। ২০১১ সালে একটা মালবাহী জাহাজ লিমাসোল থেকে ছেড়ে ইউরোপের দিকে যাচ্ছিল। খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এই অগভীর খাঁড়িতে এসে ভূত্বকের পাথরে ধাক্কা খেয়ে হেলে পড়ে। জাহাজটাতে অনেক ডিজেল ছিল, সেটা সমুদ্রে ছড়িয়ে গেলে বিরাট পরিবেশ দূষণ হত। ভাগ্যক্রমে সমস্ত জ্বালানিই জাহাজ থেকে উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়, নাবিকেরাও অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারেন। তবে জাহাজটাকে সচল করে সরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেরকম কোনও ঝুঁকি না থাকায় জাহাজটা ওখানেই রেখে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। সেটাই এখন দর্শনীয় বস্তু। ট্যুরিস্ট স্পট হলেও তেমন অর্থকরী নয়, কারণ দেখার জন্য কোনও টিকিট লাগছে না। পড়ে পাওয়া স্পট ব্লু লেগুনের ভ্রমণসূচীতে জুড়ে দিয়েছে ট্যুর কোম্পানিগুলো।



ছবিঃ শিপ রেক ও সী কেভ। 


এর পরে বাস আমাদের নিয়ে গেল একটা ওয়াইন টেস্টিং সেন্টারে। ওয়াইন, অর্থাৎ  দ্রাক্ষারস --- আঙুর থেকে তৈরি মদ। বহু হাজার বছর ধরে দ্রাক্ষারস উৎসবে-ভোজে এক অপরিহার্য অঙ্গ। ইউরোপের দক্ষিণাংশে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ওয়াইনের উপযোগী আঙুর চাষ হয়। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ দ্রাক্ষারস তৈরি করছে। গ্রিক রূপকথায় বলে মর্ত্যমানবী সিমেলের গর্ভজাত দেবরাজ জিউসের পুত্র ডাইওনিসাসকে তাঁর শৈশবে জিউসের স্ত্রী স্বর্গের রানি হেরার ভয়ে নাইসা পর্বতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখানেই ডাইওনিসাস আঙুর থেকে মদ বানানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ডাইওনিসাস তাঁর নতুন আবিষ্কারকে পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করাতে বিশ্বভ্রমণে বেরোলেন। সাইপ্রাস তো বটেই, ডাইওনিসাস ভারতবর্ষেও নাকি এসেছিলেন। তবে ডাইওনিসাসের আবিষ্কারে সবাই যে খুশি হয়েছিলা তা নয়। প্রজারা মদ খেয়ে ফুর্তি করছে দেখে কোনও কোনও রাজা তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন। পথে জলদস্যুদলের কবলেও পড়েছিলেন ডাইওনিসাস। তাকে বন্দী করার চেষ্টা করতে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। দস্যুদলের জাহাজের হাল-মাস্তুল-গলুই ছেয়ে ভরে উঠল আঙুরলতা আর আঙুর ফল, আর তার থেকে নিঃসারিত হতে থাকল  সুগন্ধী মদ। দস্যুরা ভয় পেয়ে গেল। ডাইওনিসাস ঘোষণা করলেন, আমি গ্রিসদেশে যাচ্ছি, মানবজাতির জন্য মদ উপহার নিয়ে। এথেন্সে এসে বন্ধু ইকারিয়াসকে মদ উপহার দিলেন। ইকারিয়াস তাঁর অতিথিদের নেমন্তন্ন করে মদ দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। মানবজাতি তখনও মদ সম্বন্ধে অজ্ঞ --- অতিথিরা ভাবল ইকারিয়াস বিষ পরিবেশন করেছে। তারা ইকারিয়াসকে হত্যা করল। জন্মস্থান থিবসের অত্যাচারী রাজা ডাইওনিসাসকে বন্দী করে পাথরের নিশ্ছিদ্র কারাগারে নিক্ষেপ করল। তখন সেই পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জন্ম নিল আঙুরলতা, কারাগারের দেওয়াল পড়ল ভেঙে, ডাইওনিসাস বেরিয়ে এলেন কারাগার থেকে। মানুষ মেনে নিল ডাইওনিসাসের দৈব ক্ষমতা, আর উৎসবে-আয়োজনে মদের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে। 

ওয়াইন সেন্টারে নিখরচায় ওদের তৈরি ওয়াইন আস্বাদন করা যায়। অবশ্যই তাদের লক্ষ্য বিক্রি করা, তবে আস্বাদন করলেই কিনতে হবে, সেরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কিনে তখন না নিয়ে গিয়ে ডাকযোগে বাড়িতে পাঠানোরও ব্যবস্থা আছে। তবে সেটা যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে হয়, সেক্ষেত্রে সেই দেশ আমদানি শুল্ক বসাতে পারে। সেন্টারে ওরা ওয়াইন সম্বন্ধে অনেক তথ্যও জানায়, বিশেষ করে সাইপ্রাসের ওয়াইন সম্পর্কে। সাইপ্রাসে পঞ্চাশের উপর বড় ওয়াইনারি আছে। বছরে এক কোটির বেশি ইউরো মূল্যের ওয়াইন তৈরি হয় সাইপ্রাসে। আড়াইশ লোকের জীবিকা চলে। সব অঞ্চলের মতই সাইপ্রিট ওয়াইনেরও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আমি একটা মিষ্টি ওয়াইন বাছলাম আস্বাদন করার জন্য। বেশ লাগল। তবে সুটকেস ভারি হয়ে যাবে বলে আর কিনলাম না, কারণ এক বোতল অলিভ তেল এই ওয়াইনারি থেকেই কেনা হয়ে গেছে। ওরা ওয়াইন ছাড়াও অলিভ তেল ধরণের জিনিসও বিক্রি করে।

এখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম বাথস অফ আফ্রোদাইতি বোটানিক্যাল গার্ডেন। এটা একটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। গেট পেরিয়ে অল্প চড়াই ভেঙ্গে একটু উপরে উঠে পাওয়া গেল একটা ছোট ঝর্ণা আর জলাশয়। এখানেই নাকি দেবী আফ্রোদাইতি স্নান করে তাঁর প্রেমিক অ্যাডোনিসের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। জলাশয়টা দেখে অবশ্য সেরকম দারুণ কিছু মনে হল না। গাছের ঝুরি নেমে এসেছে, পাথরে শ্যাওলা ধরে গেছে, জায়গাটাও ছায়ার আড়ালে কেমন অন্ধকার। অবশ্য গোপন স্নানের জায়গা ওরকমই হবার কথা। আফ্রোদাইতি প্রেমের দেবী, প্রেমের ব্যাপারে বেপরোয়াও বটেন। অসামান্য রূপবান  অ্যাডোনিসকে তিনি তাঁর স্ত্রী পার্সিফোনির কাছ থেকে একরকম কেড়েই নেন, যদিও তিনি নিজেও বিবাহিতা ছিলেন আগুনের দেবতা হেফেস্তাসের সঙ্গে এক অস্বচ্ছন্দ সম্পর্কে, আবার যুদ্ধের দেবতা অ্যারেস সহ বেশ কয়েকজন প্রেমিকও ছিল তাঁর। এখান থেকে পথ নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে। একটা বিরাট ওক গাছের তলায় আফ্রোদাইতির সঙ্গে দেখা হত অ্যাডোনিসের। দুই যুগল মিলনের পর ফিরে যেতেন দুটো পথ ধরে --- আফ্রোদাইতি ট্রেল আর অ্যাডোনিস ট্রেল বলে বলা হয় এখন যাদের। অ্যাডোনিস মারাও গেছিলেন   আফ্রোদাইতির কোলে মাথা রেখে, একটা বুনো শুয়োর শিকার করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়ে, যেই শুয়োরটা আসলে অ্যাপোলো পাঠিয়েছিলেন অ্যাডোনিসকে মারার উদ্দেশ্যেই। আফ্রোদাইতি তারপর অ্যাডোনিসের স্মরণে অ্যাডোনিয়া উৎসব প্রচলন করেন, যা এখনও গ্রীষ্মকালে গ্রিস, সাইপ্রাস, আনাতোলিয়া আর লেবাননে মহিলারা পালন করেন। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি স্যাফোর কাব্যেও অ্যাডোনিয়া উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাই পৌরাণিক কাহিনিকে সরিয়ে রেখেও বলা যায় অন্ততঃ আড়াই হাজার বছর ধরে এই উৎসব চলছে।



ছবিঃ  বাথস অফ আফ্রোদাইতি। 


ছবিঃ তিশিয়ানের আঁকা ভিনাস (আফ্রোদাইতি) ও অ্যাডোনিস।


একটু দূরে সমুদ্রের মধ্যে একটা পাথরের ছোট দ্বীপ, বা বলা ভাল নিমজ্জিত একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার লম্বা  এই দুই পথের উপর অনেক প্রজাতির ছোট ছোট গাছ আর ঝোপ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে এই পুরো এলাকাটা আকামাস ন্যাচারাল রিজার্ভ পার্কের মধ্যে পড়ে। সমুদ্রের ধার থেকে উঠে এসে রাস্তার উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটা গাছ, যা কৃষ্ণচুড়ার মতো লাল ফুলে ভরে আছে। অবশ্য কৃষ্ণচুড়া নয়, গাছটার নাম রয়্যাল পয়ন্সিয়ানা। ছবি তুলে ফিরে আসছি, দেখি বেঞ্চের উপর এক বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি আমার টি শার্টে ভার্জিনিয়া বিচ লেখা দেখে বলে উঠলেন, ও তুমি ভার্জিনিয়া বিচ গেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমরা তো ওখান থেকে মাত্র তিন ঘন্টার দূরত্বে থাকি, প্রতি বছরই একবার যাই ছুটি কাটাতে। ওরা জানালেন, ওরা এসেছেন টেক্সাস থেকে, ভার্জিনিয়া বিচ ওদেরও খুব ভাল লাগে। আমি কদিন আছি, আর কে এসেছে এসব কথার পর আমিও জিজ্ঞাসা করলাম ওরা কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন। উত্তরে ওরা বললেন যে ওরা ঠিক বেড়াতে আসেন নি, ওরা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন --- আমেরিকা ছেড়ে সাইপ্রাসে পাকাপাকি থেকে যেতে চান, তাই খোঁজখবর নিতে আর ব্যবস্থাপত্র করতে এসেছেন। টেক্সাসে বাড়িও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন সাইপ্রাসে পাকাপাকি থাকার ভিসা পাবার অপেক্ষায় রয়েছেন। ধারণাটা অবশ্য ভাল। অনেকেই অবসরের পর আমেরিকা ছেড়ে এরকম কোনও সুন্দর আবহাওয়ার কম খরচের দেশে চলে আসতে চান। তবে ওরা বললেন এখন সাইপ্রাসে পাকাপাকি থাকার ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ওদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার বাসে এসে উঠলাম। এখান থেকে অল্প দূরেই লাচি বলে সমুদ্রের ধারে একটা গ্রামে একটা রিসর্টে আমাদের দুপুরের খাবার বিরতি। খাবার অবশ্য নিজেদের খরচে। মেনু আগেই দেখিয়ে রেখেছিল আমাদের, এবং বলেছিল কী অর্ডার করব জানিয়ে দিতে। তাহলে পৌঁছানোর পরে পরেই আমাদের খাবার পেয়ে যাব, বেশি অপেক্ষা করতে হবে না, কারণ সময় সীমিত --- আমাদের এর পর লঞ্চ ট্রিপে যেতে হবে।

লাচির রিসর্টে রেস্তোরাঁটা ভালই, অবশ্য যদি মাছ খাওয়ার ইচ্ছে থাকে। যা হোক আমার একটা মার্গারিটা পিজ্জা পেতে অসুবিধা হল না। খাবার পরও হাতে খানিকটা সময় ছিল --- আমরা তাই জলের ধারে ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে বসে খানিকটা অবসর উপভোগ করলাম। ঠিক দেড়টার সময় বাস নিয়ে গেল অদূরেই লাচি হারবারে, যেখান থেকে ব্লু লেগুন যাবার লঞ্চ ছাড়বে। ব্লু লেগুন অবশ্য ঠিক লেগুন নয়, ভূমধ্যসাগরের উপসাগর, আকামস উপদ্বীপের গায়ে। সামনের দিকে একটা বেঞ্চে তিনজন বসলাম ছাউনির মধ্যে। চড়া রোদ বলে ছাদে বা ছাউনির বাইরে যেতে চাই নি। ঠিক দেড়টায় লঞ্চ ছাড়ল। নীল জল কেটে যাচ্ছে। মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর লঞ্চটা এসে দাঁড় করাল অগভীর খাঁড়িতে। এখানে এক ঘন্টা দাঁড়াবে, লোকে জলে নেমে স্নরকেলিং করতে পারে। এখানেও সী কেভ হয়ে রয়েছে। অনেকেই জলে নেমে ওইদিকে গেল সাঁতার কেটে। লঞ্চটা গ্লাস-বটম। জলে না নেমেও জলের তলায় কী মাছ আছে, সেসব দেখার উপায় আছে। আমরা হোটেল থেকে চেক আউট করে নিয়েছি তাই জলে নামার আর প্রশ্ন নেই, এমনিতেও তেমন আগ্রহী ছিলাম না। লঞ্চের ডেক থেকেই দেখলাম আর ছবি তুললাম। লঞ্চে কিছু ফল আর জ্যুস ফ্রি দিচ্ছিল। আইসক্রিম, বিয়ার বা ওয়াইন খেতে হলে পয়সা দিতে হবে, তবে খুব বেশি কিছু নয়। দুঃখের বিষয়, প্রবল হাওয়ার চোটে জ্যুস খাবার পর খালি প্লাস্টিকের কাপটা হাত থেকে উড়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে পড়ল। অনিচ্ছাকৃত হলেও এমন সুন্দর একটা জায়গায় প্লাস্টিক দূষণ করায় দায়ী হবার দুঃখ রয়ে গেল।



ছবিঃ ব্লু লেগুন ও স্নরকেলিং। 


লঞ্চ আবার লাচি হারবারে ফিরল সওয়া চারটে নাগাদ। সঙ্গে সঙ্গে বাস ছাড়ল পাফোসের দিকে। বাসে বসেই হোটেল থেকে ফোন পেলাম ট্যাক্সি ড্রাইভার চলে এসেছে। সে কী? এ তো পাংকচুয়ালের এককাঠি উপরে --- পাঁচটায় আসার কথা ছিল, সাড়ে চারটের মধ্যেই চলে এসেছে। যা হোক, বললাম আর একটু সময় লাগবে। আমাদের হোটেলটাতে শুরুতেই নামাবে, সেটাই রক্ষে। পাঁচটা বাজার পাঁচ-সাত মিনিট আগে হোটেলে পোঁছালাম। মালপত্র তুলে চললাম লারনাকার দিকে। ট্যুর শেষ হল বলে। এখন শুধু ফেরার পালা।  বাকি গল্প একেবারেই সাদামাটা। লারনাকায় পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে পরদিন খুব ভোরে ফ্লাইট বলে ট্যাক্সি বলে রেখেছিলাম।  সময়মতো এয়ারপোর্টে পৌঁছে লম্বা যাত্রা শেষে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরত এলাম। তবে সাইপ্রাস মনের মধ্যে গেঁথে রইল। সবকিছু দেখা হল না, তার দরকারও নেই কোনও। যতই ছোট দেশ হোক, সাতদিনে আর কত হয়? পুবদিকে ফার্মাগুস্তা গোস্ট টাউন একটা দর্শনীয় জায়গা। পরে আবার এলে যাওয়া যেতে পারে। তুর্কি অংশটা আরও ভাল করে ঘোরা যেতে পারে। নভেম্বরে এলে লারনাকা খাঁড়িতে ফ্লেমিংগো দেখা যেতে পারে। আবার যেতে হবে সাইপ্রাস, আফ্রোদাইতির নিজের দেশ। বারবার দেখলেও আশ মিটবে না। 

---------------------------------------------- 


১। গোপনীয়তার খাতিরে সঙ্গীসাথীদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে লেখায়।

২। গ্রিক পুরাণের গল্পে অনেকসময়ই একাধিক ভার্সন থাকে, পাত্রপাত্রীও অনেকসময় বদলে যায়। বর্তমান লেখায় একটি ভার্সনই উপস্থাপনা করা হয়েছে। 

 

সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত।