বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০

রূপকথার রাজনীতিক হেনরি ওয়ালেস

 

রূপকথার রাজনীতিক হেনরি ওয়ালেস

-শুভাশিস ঘোষাল



হেনরি এগার্ড ওয়ালেস নামটা এখন আমেরিকাতেই প্রায় বিস্মৃত, বাকি পৃথিবীতে হয়তো খুব কম লোকেই তাঁর নাম শুনেছে। অথচ ইতিহাসের মোড় শেষ মুহুর্তে ঘুরে না গেলে হয়তো তিনিই হতেন বিংশ শতাব্দীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাহলে হয়তো পৃথিবীটা হতো অনেক অন্যরকম, অনেক মানবিক।

ইতিহাস বই থেকে জানা যাবে যে হেনরি ওয়ালেস আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি। কিন্তু সে তো অনেকেই আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি হয়েছেন, সারা পৃথিবীতে আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন। শুধু সেজন্য তাঁকে স্মরণ করার কারণ নেই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্টাডস টার্কেল বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীতে তিনজন শ্রেষ্ঠ আমেরিকানের দুজন  --- ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট (এফ ডি আর) আর ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ঘরে ঘরে পরিচিত নাম। সেরকমই হওয়া উচিত ছিল তৃতীয় জনের --- হেনরি ওয়ালেসের নাম”। স্বয়ং এফ ডি আর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেনরি ওয়ালেসের থেকে বেশি আমেরিকার ভূমিপুত্র আর কেউ নন”। কেন? কারণ ইতিহাসের এক করাল অধ্যায়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও অন্তর্দৃষ্টি মানবসভ্যতাকে সামনের পথে এগোতে সাহায্য করেছিল। এক সৌভ্রাতৃত্বের পৃথিবী তিনি গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আমেরিকার রাষ্ট্রপতিপদে তিনি বসলে তাঁর চিন্তাধারা প্রয়োগ করা সম্ভব হতো। এবং সেই সুযোগ প্রায় হাতের মুঠোয় এসেও একটুর জন্য হারিয়ে যায়।

হেনরি ওয়ালেসের জন্ম ১৮৮৮ সালের ৭ই অক্টোবর আইওয়া রাজ্যে এক বিখ্যাত পরিবারে। আইওয়া কৃষিপ্রধান রাজ্য, ওয়ালেস পরিবারের এক বিশাল ফার্ম ছিল। তাঁর পিতামহ, যার নামও ছিল হেনরি ওয়ালেস, একটি ফার্ম পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। তাঁর বাবা হেনরি ক্যান্টওয়েল ওয়ালেস আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন ও রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি ওয়ারেন হার্ডিং আর কেলভিন কুলিজের সরকারে আমেরিকার কৃষিসচিব হিসেবে কাজ করেছিলেন। হেনরি ওয়ালেস পশুপালনবিদ্যায় স্নাতক হবার পর পরিবারের ব্যবসা দেখতেন ও ফার্ম পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। রিপাবলিকান পরিবারে বড়ো  হলেও এফ ডি আরের রাজনৈতিক বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলে যোগ দেন। ১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে বিপর্যয়কর ধ্বসের পর তিরিশের দশকের গোড়ায় মহামন্দায় আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে অর্থনীতি ধুঁকছিল। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এফ ডি আর। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রস্তাব করেন তাঁর বিখ্যাত ‘নিউ ডিল’, যা প্রভূত সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান করবে। এ ব্যাপারে এফ ডি আর ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্সের অনেক পরামর্শ নেন। কৃষিসচিব হিসেবে এফ ডি আর বেছে নেন ওয়ালেসকে। নিউ ডিলের সার্থক রূপায়নে ওয়ালেস ছিলেন এফ ডি আরের প্রধান ভরসা। তাঁর প্রগতিশীল নীতিগুলোর রূপায়ন করতে  এফ ডি আর ক্যাবিনেটে হেনরি ওয়ালেস, ফ্রান্সিস পার্কিন্স, হেনরি হপকিন্স ও রেক্স টাগওয়েলের বিশেষ সমর্থন পেয়েছিলেন। তাঁরা কারখানার শ্রমিক, শহরের গরীব ও কৃষকদের স্বার্থের অনুকুল নীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করতেন। তবে রিপাবলিকানরা ও ব্যবসায়ীদের অনেকে চড়া কর ও প্রচুর সরকারি লগ্নির বিরোধী ছিল, আবার কৃষক সংগঠনগুলো মনে করত যে যথেষ্ট সরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। এমনকি নীতি রূপায়নের প্রশ্নে  ক্যাবিনেটেও বাণিজ্যসচিব জেসি জোন্সের সাথে ওয়ালেসের বিরোধ বাঁধে। এফ ডি আরের নিউ ডিলের অন্তর্গত ওয়ালেসের করা কৃষি ও পশুপালন সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক, তার কারণ ওয়ালেস নিজেও ছিলেন একজন বিজ্ঞানী আর পরিসংখ্যানবিদ। তিনি সঠিক  তথ্য সংগ্রহ করে ও পরিসংখ্যানবিদ্যা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। যেমন, সেই সময় কৃষি ও পশুপালনে আয় কমে যাবার কারণ ছিল মন্দার জন্য চাহিদা কমে যাওয়া সত্ত্বেও অধিক উৎপাদনে দাম পড়ে যাওয়া। দাম স্বাভাবিক করার জন্য প্রয়োজন ছিল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা করে উৎপাদনের মাত্রা ঠিক করা। ওয়ালেস হিসেব করে তুলোর উৎপাদনের পঁচিশ শতাংশ ও ষাট লক্ষ শূকরছানা ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। চাষিদের ক্ষতি কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে পুষিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে বাজারে ভারসাম্য ফিরে আসে। কৃষিজমির মাটি সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় খরচে ঢাল বসানো, ও চাষিদের অনুর্বর বা অসুরক্ষিত জমি চাষ না করতে রাজি হবার বদলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নীতি তিনি চালু করেন। কৃষিপণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা আনার ও দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণের জন্য শস্যভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। ওয়ালেসের কৃষিনীতি সহ নিউ ডিলের পরিকল্পনাগুলি আমেরিকার অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করিয়েছিল। এ ছাড়া ওয়ালেসের তত্ত্বাবধানে অনেকগুলো জনকল্যাণমূলক প্রকল্প নেওয়া হয়, যেমন চাষিদের নিখরচায় বিদ্যুতের যোগান দেওয়া, অভাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা করা ও গরিব পরিবারদের জন্য খাবার কেনার কুপন ফুডস্ট্যাম্প দেওয়া, ইত্যাদি। দেশের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ওয়ালেস ১৯৩৪ সালে প্রায় সব কটি রাজ্য মিলে সড়কপথে চল্লিশ হাজার মাইল পাড়ি দেন ও বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

হেনরি ওয়ালেস পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সেই সময় পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর একটাই বই ছিল, আডনি ইউলের লেখা। ওয়ালেস সেই বই থেকে নিজে নিজেই পরিসংখ্যানবিদ্যা শেখেন। ১৯২৫ সালে (পরে) প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ জর্জ স্নেডেসরের সঙ্গে একত্রে তিনি একটি গবেষণাপত্র লেখেন যন্ত্রগণক ব্যবহার করে মাল্টিপ্ল লিনিয়ার রিগ্রেসনের (একটি রাশিকে একাধিক সম্পর্কিত চলগ রাশির সম্ভাব্য সরলরৈখিক অপেক্ষক হিসেবে প্রকাশ করার পদ্ধতি) সমীকরণ সমাধান করার পদ্ধতির উপর। এর ফলে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ১৯২৭ সালে বিমূর্ত পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণা শুরু হয়। ওয়ালেসের চেষ্টায় ১৯৩৩ সালে আমেরিকায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানবিদ্যার বিভাগও চালু হয় সেখানে ও ওয়ালেস নিজে দশ সপ্তাহ একটা পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর কোর্স পড়ান। কৃষিসচিব থাকাকালীন তিনি আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিকে কৃষিক্ষেত্রে সরকারি নমুনা-সমীক্ষার ও তার বিশ্লেষণের অনেক দায়িত্ব দেন। সরকারের কৃষিবিভাগেও তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যার সেমিনার চালু করেন। শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব আনা স্ট্যাটিস্টিকাল কোয়ালিটি কন্ট্রোল খ্যাত ওয়াল্টার শুয়ার্টের সেমিনার থেকে পাওয়া ধারণা ওয়ালেস সেন্সাস ব্যুরোয় চালু করেন। প্রখ্যাত বৃটিশ পরিসংখ্যানবিদ স্যার রনাল্ড ফিশারকে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার দিতে আনার জন্য ওয়ালেসের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওয়ালেসের মত ছিল “অর্থনীতিবিদরা তাত্ত্বিক অর্থনীতিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন, তবে সত্য আসলে লুকিয়ে থাকে তথ্যে, যা একমাত্র পরিসংখ্যানবিদ্যা দিতে পারে”। এ ছাড়া তাঁর আর একটি (অসমর্থিত সূত্রে প্রাপ্ত) প্রখ্যাত উক্তি ছিল, “ভবিষ্যতে ভালভাবে অবহিত সচেতন নাগরিক হতে গেলে মাল্টিপ্ল লিনিয়ার রিগ্রেসন বোঝা বিশেষ প্রয়োজন”।  তবে ওয়ালেস মূলতঃ ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী, তাঁর পরিসংখ্যানবিদ্যায় আগ্রহ এসেছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এইচ এল মুরের একটি গবেষণাপত্র পড়ে, যেখানে খুব সহজে বোঝানো ছিল পরিসংখ্যানবিদ্যার কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি কি করে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতিতে ও কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ মূল্য পূর্বাভাস করতে সাহায্য করতে পারে। আইওয়া সহ আমেরিকার মাঝের অংশের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলির অর্থনীতির বুনিয়াদ ও  প্রধান কৃষিপণ্য হল ভুট্টা, যা রুটি তৈরি ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। ওয়ালেস একধরণের উচ্চফলনশীল সংকর ভুট্টা তৈরি করেছিলেন। এই সাফল্য হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার ফলে নয়, পরিকল্পনামতো খোঁজার ফল।  ১৯২৬ সালে তিনি পায়োনিয়ার হাই-ব্রেড কোম্পানির পত্তন করেন এই নতুনজাতের ভুট্টার বীজ উৎপাদন ও বিক্রির জন্য। আইওয়া রাজ্যের ভুট্টার ৯৮% শতাংশই ওয়ালেসের কোম্পানির বীজ থেকে হতো। এই বীজের বিপণনের জন্য ওয়ালেস এক অভিনব পদ্ধতি নিয়েছিলেন। চাষিদের বিনামূল্যে বীজ দিয়ে বলেছিলেন অর্ধেক প্রচলিত ভুট্টা আর অর্ধেক নতুন ভুট্টা চাষ করতে। পরে নতুন ভুট্টার বাড়তি উৎপাদনের ফলে লাভের একটা অনুপাত দিয়ে পায়োনিয়ার কোম্পানির দেওয়া বীজের দাম মেটাতে। আর পায়োনিয়ার একা এত বীজের চাহিদা মেটাতে পারবে না বলে অন্য কোম্পানিদেরও তিনি বীজের ফর্মুলা দিয়ে উৎপাদন করতে উৎসাহ দেন। তা ছাড়া এখন সারা পৃথিবীতে যত ডিম উৎপাদন হয়, তার প্রায় অর্ধেকই আসে পায়োনিয়ারের ব্রিড থেকে তৈরি করা মুরগি থেকে। উল্লেখ্য, পায়োনিয়ার ১৯৯৯ সালে ডুপন্ট কোম্পানি কিনেছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডলারে। ওয়ালেসের আর একটি বিশেষ অবদান হল কৃষিপণ্যের ও গবাদি পশুর ভবিষ্যৎ মূল্যের পূর্বাভাসের “রেশিও পদ্ধতি” উদ্ভাবন। এই পদ্ধতির মূলমন্ত্র হল দীর্ঘমেয়াদে পণ্যের মূল্য পরষ্পরের সঙ্গে নির্ভরশীল, যেমন ভুট্টা ও শূকরের মাংসের দাম। ফলে মাল্টিপ্ল রিগ্রেসন পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের মূল্যের পূর্বাভাস করা সম্ভব। ওয়ালেস ১৯২০ সালে একটি বই লেখেন খুব সহজ ভাষায়, যাতে রেশিও পদ্ধতি অনুসরণ করে সাধারণ চাষিরা তাদের পণ্যের মূল্য অনুমান করতে পারে। ১৯৪০ সালে উপরাষ্ট্রপতি হবার পর এফ ডি আরের পরামর্শে ওয়ালেস ছ সপ্তাহ মেক্সিকোতে থেকে মেক্সিকো সরকারকে কৃষিনীতি প্রণয়নে সহায়তা করেন। যুদ্ধোত্তরকালে সারা পৃথিবীতে সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ার পিছনেও ওয়ালেসের বিরাট অবদান রয়েছে। রকাফেলার ফাউন্ডেশনকে চিঠি লিখে তিনি অনুরোধ করেছিলেন আন্তর্জাতিক কৃষিগবেষণার একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। তার ফলশ্রুতি হিসেবে তারা নর্ম্যান বর্ল্যাগের নেতৃত্বে সেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। বর্ল্যাগ ১৯৭০ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান উচ্চফলনশীল রোগ-নিরোধক গমের বীজ তৈরি করে। অনুমান করা হয় এর ফলে সারা পৃথিবীতে খাবারের যোগান বাড়ার ফলে একশ কোটি মানুষের প্রাণ বেঁচেছিল। এফ ডি আরের ক্যাবিনেটে ওয়ালেসই ছিলেন একমাত্র বিজ্ঞানী। ওয়ালেসের মতো একজন সর্বোচ্চস্তরের রাজনীতিক নিজেও একজন প্রথমসারির বিজ্ঞানী, এরকম নজির পৃথিবীতে আর নেই।

হেনরি ওয়ালেস সব অর্থেই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিক। ওয়াশিংটনে বিরাট দায়িত্ব পালন করলেও তিনি ওয়াশিংটনের অন্দরমহলের রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন নি। সন্ধেবেলায় যেসব পার্টি দেওয়া হত, সেখানে না গিয়ে ওয়ালেস খেলাধুলো করতে ও বই পড়তে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিনি ধুমপান বা মদ্যপান করতেন না। নিজে খৃষ্টান হলেও বৌদ্ধধর্ম, জরথ্রুষ্টের মতবাদ ও আমেরিকার প্রাচীন উপজাতি নাভাহোদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তিনিই প্রথম শ্বেতাঙ্গ যিনি নেটিভ আমেরিকান সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন।

১৯৩৩-১৯৩৯ এ এফ ডি আরের প্রথম দুই মেয়াদের সরকারে ওয়ালেস কৃষিসচিব হিসেবে অসামান্য দক্ষতা দেখানোয় ১৯৪০ এর ভোটে এফ ডি আর তৃতীয়বারের মেয়াদের জন্য ওয়ালেসকে উপরাষ্ট্রপতি করতে চান। সাধারণতঃ আমেরিকায় দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না, তবে তখন মহামন্দার রেশ রয়ে গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে, এরকম একটা জটিল পরিস্থিতিতে এফ ডি আরের মতো বিরাট জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে রাষ্ট্রপতিপদে দরকার, দেশের লোকে মনে করছিল। কিন্তু সোজাসাপটা কথা বলা ‘রাজনীতিতে বেমানান’ ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার ওয়ালেসকে অপছন্দ করার লোকের অভাব ডেমোক্র্যাটিক দলেও ছিল না। তাদের অনেকেরই মতে ওয়ালেস সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট শাসকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এফ ডি আর ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জার্মানিতে ফ্যাসিস্টদের উত্থানে এফ ডি আর খুবই চিন্তান্বিত ছিলেন, কিন্তু আমেরিকার সাধারণ মানুষ ইউরোপে আর একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে রাজি ছিল না।  তা ছাড়া যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা ও যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন, এ ব্যাপারেও ওয়ালেসের মতকে এফ ডি আর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কারণ ওয়ালেস বিদেশনীতি সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্ব ওয়ালেসের মনোনয়নে আপত্তি জানালে এফ ডি আর তখন রাষ্ট্রপতিপদে মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করবেন বলেন। এবার পার্টির নেতৃত্ব ওয়ালেসকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

জিতে আসার পর এফ ডি আর ওয়ালেসকে যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক পরিষদের প্রধানপদ সহ  অনেক দায়িত্ব দেন।  নির্বাচনের সময় এফ ডি আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আমেরিকা নিজে আক্রান্ত না হলে যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু ফ্যাসিজমের বিপদ দেখে এফ ডি আরের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে ব্রিটেন-ফ্রান্সকে সামরিক সাহায্য দেবার ব্যবস্থা করেন। মার্কিন কংগ্রেসকে সে ব্যাপারে রাজি করাতে যথেষ্ট বাধা পেরোতে হয়েছিল। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের পতন হয় ও হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে যুদ্ধের পরিধি অনেক বেড়ে যায়। জার্মানিকে রুখতে যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করা দরকার, এফ ডি আর বুঝেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বকে পাশে পাচ্ছিলেন না। তাঁর ক্যাবিনেটে ওয়ালেসকে পাশে পেয়েছিলেন, কারণ ওয়ালেস সমস্যাটার গুরুত্ব বুঝতেন। ওদিকে জাপানের সঙ্গে আমেরিকার বিরোধ বাড়তে বাড়তে ১৯৪২ সালে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হিটলারও অবিমৃষ্যকারীর মতো আমেরিকার বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এফ ডি আরের জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আর বাধা থাকে না। জার্মানির সম্ভাব্য পরমাণু অস্ত্রের গবেষণার খবর শুনে আমেরিকাতে যখন পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেই বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট তদারক করার কমিটির প্রধানও ছিলেন ওয়ালেস। সামরিক ও বৈদেশিক নীতিতে ওয়ালেস অনেক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৩ সালে এফ ডি আরের নির্দেশে লাতিন আমেরিকা সফরে গিয়ে মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যে তিনি বারোটি রাষ্ট্রকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় রাজি করান। ওয়ালেস এত দায়িত্ব সামলাতেন যে রাজনৈতিক মহলে তিনি ‘সহকারী রাষ্ট্রপতি’ বলে পরিচিত হন।

১৯৪২ সালের ৮ই মে ওয়ালেস “সাধারণ মানুষের শতাব্দী” নামে একটি বিখ্যাত ভাষণে বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন “আমেরিকার যুদ্ধকালীন লক্ষ্য হল গোলামির বিরুদ্ধে মুক্ত পৃথিবীর জন্য লড়াই। আধুনিক বিজ্ঞান সবার জন্য যথেষ্ট খাদ্য তৈরির উপায় করেছে। কিন্তু তার সুষ্ঠু বন্টনের জন্য চাই পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের পরষ্পরের সঙ্গে সহযোগিতা। যাতে কি না সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মান উন্নত হতে পারে।'' তিনি যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ করার আহ্বান জানান এই বলে যে, কোনও জাতির অপর কোনও জাতির উপর শাসন করার ও তাদের সম্পদ শোষণ করার কোনও অধিকার থাকতে পারে না। ওয়ালেসের বক্তৃতা সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয় --- কুড়িটা ভাষায় অনুবাদ হয়ে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বিতরণ হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ব্যাপারে এফ ডি আরের সঙ্গে ওয়ালেসের দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ মিল ছিল। এফ ডি আর ইউরোপীয় জাতিগুলির এশিয়া ও আফ্রিকায় সাম্রাজ্য ও উপনিবেশের বিরোধী ছিলেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের অন্যতম কারণ হল উপনিবেশবাদ, এবং ব্রিটেন-ফ্রান্স-নেদারল্যান্ডসের এশীয় সাম্রাজ্যে শোষণ এবং ভুল পদক্ষেপের কারণেই যে জাপানী সাম্রাজ্যবাদের উত্থান এবং সেজন্য আমেরিকান সৈনিকদের মরতে হচ্ছে, সেকথা মনে করিয়ে এফ ডি আর ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে যুদ্ধের পর উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে বলেন। ফিলিপাইনে আমেরিকার যে উপনিবেশ ছিল, ১৯৪৬ সালেই আমেরিকা ফিলিপিনোদের হাতে তাদের দেশের ভার ছেড়ে দেবে বলে এফ ডি আর জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও জরুরী। যুদ্ধের পর আমেরিকা উদ্যোগ নেবে যাতে প্রাক্তন উপনিবেশের দরিদ্র দেশগুলি তাদের দেশ গড়ে তোলার জন্য ঋণ পায়। আমেরিকার সরকারের এই উপনিবেশ বিরোধী মনোভাবে তাদের প্রধান শরিক ব্রিটেনের ও ফ্রান্স সহ অন্যান্য ইউরোপীয় শরিকদের যথেষ্ট চিন্তা ছিল। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এ ব্যাপারে তাঁর অনীহার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এই বলে যে (ইংল্যান্ডের) রানির সাম্রাজ্য গুটিয়ে ফেলার জন্য তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন নি। চার্চিলের সঙ্গে ওয়ালেসের মতবিরোধ ছিল সুবিদিত। এমনকি ওয়ালেস সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি দুর্বল, এইরকম ধারণার বশবর্তী চার্চিল গোপনে ওয়ালেসের পিছনে গোয়েন্দাও লাগিয়েছিলেন।

ফ্যাসিবাদ যে শুধু জার্মানি বা ইউরোপে নয়, খোদ আমেরিকাতেও যথেষ্ট চিন্তার কারণ, তা ওয়ালেস তাঁর ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে “আমেরিকায় ফ্যাসিবাদের বিপদ” বলে এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “সত্যকে বিকৃত করা, অনৈক্য ছড়ানো, অতি-দেশপ্রেমিক সাজা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে দাবানো, মুখে স্বাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা বললেও কার্যত একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা করা, সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, ইত্যাদি হল ফ্যাসিবাদের লক্ষণ ও আমেরিকায় তা যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত বলে সতর্ক করেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টের প্রধান পরিচালক লেসলি গ্রোভস সহ  আমেরিকায় উচ্চপদে থাকা অনেককেই তিনি উগ্র সোভিয়েতবিরোধী ফ্যাসিবাদী মনোভাবের মনে করতেন। যুদ্ধের অর্থনীতি আমেরিকার মালিকশ্রেণিকে অভূতপূর্ব মুনাফা এনে দিচ্ছিল, কিন্তু মজুরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ছিল না, শ্রমিকদের বিনা ছুটিতে ক্রমাগতঃ কাজ করে যেতে হচ্ছিল। প্রতিবাদে ১৯৪৪ সালে রেকর্ড সংখ্যায় ধর্মঘট হয়, দশ লক্ষ শ্রমিক তাতে যোগ দেয়। পুলিশের পীড়নও বাড়ে তার সঙ্গে। ডেট্রয়েট শহরে জাতিদাঙ্গায় পুলিশের গুলিচালানোয় অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মারা যায়। ওয়ালেস পরিস্থিতি দেখে এসে মন্তব্য করেন, নিজেদের দেশে মানুষকে আমরা এরকম পীড়ন করলে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়ার নৈতিক শক্তি আমাদের থাকবে না। তাঁর সেই কথা প্রতিধ্বনিত্ব হয় আবার কুড়ি বছর পরে, ষাটের দশকে আমেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলনে ডঃ মার্টিন লুথার কিং এর কথায়।  যুদ্ধের সময় জাপানি-আমেরিকানদের শত্রু চিহ্ণিত করে তাদের ঘেরাটোপে আটকে রাখা বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সরকারি নীতির বিরোধিতাও করেছিলেন ওয়ালেস। ওয়ালেসের বিরোধীরা তাঁকে অতিসরল, ভাবালু, কল্পনাপ্রবণ, কমিউনিস্ট বলে চিহ্ণিত করেন। প্রকৃতপক্ষে যা কিছু অপছন্দের, তাকেই কমিউনিজম বলে দেগে দেবার প্রবণতা আমেরিকায় ছিল, যা এখনও আছে। ডেমোক্র্যাটিক দলেও ক্রমশঃ তাঁর বিরোধীরা শক্তিশালী হতে থাকে।

তখন ১৯৪৪ সালের নির্বাচন প্রায় আসন্ন। যুদ্ধ ও রাষ্ট্র চালানোর ধকল এবং অতিরিক্ত ধুমপানের ফলে এফ ডি আরের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়ছে। ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতৃত্ব শংকিত হয়ে ওঠেন, যদি এফ ডি আরের মৃত্যু হয়, তাহলে উপরাষ্ট্রপতি ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবেন। তাঁরা এফ ডি আরকে চাপ দিতে থাকেন ওয়ালেসকে এবার উপরাষ্ট্রপতিপদে টিকিট না দেবার জন্য, কারণ তা হলে দলে ভাঙ্গন হতে পারে। এফ ডি আর ওয়ালেসের মতো দক্ষ এবং সহমর্মীকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে চান, কিন্তু ভগ্ন শরীরে তাঁর চিন্তাধারাকে রাজনৈতিক নেতাদের বোঝাতে বোঝাতে তিনি ক্লান্ত। দলের নেতৃত্বকে তিনি পরিষ্কার কিছু জানান না। ওয়ালেস তখন এফ ডি আরেরই নির্দেশে চীনে গিয়েছিলেন যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে। চীনের শাসক চিয়াং-কাই-শেক ও তাঁর আমেরিকায় শিক্ষিত স্ত্রী আমেরিকার রাজনৈতিক মহলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু ওয়ালেস ফিরে এসে তাঁর রিপোর্টে জাপানিদের প্রতিরোধে মাও-জে-দংএর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কথা জানান। অত্যন্ত বিতর্কিত বলে তাঁর সেই রিপোর্টকে চেপে দেওয়া হয়। জুলাই মাসে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলন হয় শিকাগোতে। দলের নেতৃত্ব চাইছিলেন মিসৌরির সেনেটর হ্যারি ট্রুম্যানকে উপরাষ্ট্রপতিপদে। বলতে গেলে তাঁর একমাত্র যোগ্যতা ছিল কম শত্রুসংখ্যা। তবে ওয়ালেসের দিকে পাল্লা ভারী ছিল, কারণ তার পিছনে ছিল অধিকাংশ প্রতিনিধির সমর্থন। আর আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওয়ালেসকেই চাইছিলেন। এফ ডি আরের স্ত্রী এলিনর রুজভেল্টও ওয়ালেসকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। ভোট নেওয়া হলে প্রথম রাউন্ডে ওয়ালেস অনেক এগিয়ে থাকেন। সেই সময় দলের নেতৃত্বের চাপে সম্মেলন মুলতুবি রাখা হয়। সেই রাত্রে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদের টাকা ও পদের লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয়। পরের দিন দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে ওয়ালেস এগিয়ে শুরু করেও পরে পিছিয়ে পড়েন। তাঁর সমর্থকদের অনেকে, যারা প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে গেছিল, তাদের ভোট নেওয়া যাবে না বলে জানানো হয়। শেষমেষ ট্রুম্যানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নিজে ওয়ালেসকে চাইলেও দলের নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ এড়াতে এফ ডি আর সেটা মেনে নেন। এফ ডি আর তাঁর সমর্থনে না দাঁড়ানোয় ওয়ালেস মর্মাহত হন, তবে এফ ডি আরের নেতৃত্বের সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। এফ ডি আর আবারও ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতি হন, আর ট্রুম্যান উপরাষ্ট্রপতি। ওয়ালেসকে ক্যাবিনেটে আহ্বান করা হয়, তিনি বাধ্য সৈনিকের মতো এই পদাবনতিতেও রাজি হন। তাঁকে আবার তাঁর পছন্দমতো বাণিজ্যসচিবের পদ দেওয়া হয়, তবে আর অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্বে রাখা হয় না।

সেদিন শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলনে ওয়ালেসের বদলে ট্রুম্যানকে মনোনয়ন দেবার সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে। নির্বাচিত হবার কয়েকমাসের মধ্যেই এফ ডি আর মারা যান। হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এসে পড়ে ট্রুম্যানের উপর। এইরকম একটা গুরুদায়িত্ব পালন করতে যে অন্তর্দৃষ্টি লাগে, ট্রুম্যানের তা ছিল না। রক্ষণশীল মিসৌরিতে বড়ো হওয়া ট্রুম্যানের সঙ্গীরাও ছিলেন নিতান্ত স্থানীয় স্তরের রাজনীতিক। আর ছিল আমেরিকার গড়পড়তা সাধারণ রাজনীতিবিদদের মতো তীব্র সোভিয়েত বিদ্বেষ। বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি ছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে  যদি জার্মানি জিততে থাকে রাশিয়াকে সাহায্য করতে হবে, আর রাশিয়া জিততে থাকলে জার্মানিকে, যাতে তারা পরষ্পরকে যতসম্ভব মারতে পারে। এফ ডি আর রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এইসব মতকে উপেক্ষা করতেন। রাশিয়া যে জার্মানিকে সবথেকে বেশি রুখছে, সে কথা তিনি স্বীকার করতেন। রাশিয়াকে সাহায্য করার জন্য ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন ১৯৪৩ এর বসন্তকালের মধ্যেই খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু চার্চিলের অসহযোগিতায় তা প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে গেছিল শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনে আমেরিকা টাকা দেবে এবং তার অর্ধেক যাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে, এমন পরিকল্পনা ছিল এফ ডি আরের। তাঁরই উপরাষ্ট্রপতি হলেও ট্রুম্যানকে তিনি আদৌ গুরুত্ব দিতেন না --- মাত্র দুবার তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। ম্যানহাটন প্রজেক্ট সম্পর্কেও ট্রুম্যানকে কিছুই জানান নি এফ ডি আর। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি ট্রুম্যান অভিষিক্ত হবার সময় ততদিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে গিয়েছিল। নর্মান্ডিতে মিত্রসেনার অবতরন ঘটে আগেই --- জার্মানির পরাজয় তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ১৯৪৫ সালে মে মাসে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। জুলাই মাসে আমেরিকা সফলভাবে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে। বোমার যে মূল অভিপ্রায় ছিল জার্মানির সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমার প্রতিরোধ করা, তার আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কিন্তু এই নতুন লব্ধ অপরিসীম শক্তি ট্রুম্যানের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। বিশ্বশক্তির নেতৃত্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্রমশঃ ব্রিটেনের কাছ থেকে আমেরিকার হাতে চলে আসছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তা সম্পূর্ণ হয়। বিদেশনীতিতে বিশেষ ধারণা না থাকায় ট্রুম্যান বিশেষকরে তীব্র সোভিয়েত বিদ্বেষী বর্ণবিভাজনবাদী দক্ষিণের রাজনীতিক জিমি বার্নসের উপর নির্ভর করতে থাকেন, যাকে তিনি বিদেশসচিব করেছিলেন। আমেরিকার বিদেশনীতি ক্রমশঃই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর কঠোর হতে থাকে। যুদ্ধের শেষে নতুন করে দেশ গড়ে তোলার জন্য এফ ডি আরের প্রতিশ্রুত আমেরিকান সাহায্য প্রায় সবই ব্রিটেন ও পশ্চিমী দেশগুলোয় পাঠানো হয়।  দুই দেশের ব্যবস্থায় বিরাট তফাৎ থাকলেও এফ ডি আর আর স্তালিনের মধ্যে একটা পারষ্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, ট্রুম্যানের সময় হঠাৎ আমেরিকার মনোভাব পরিবর্তনে স্তালিন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন। এফ ডি আরের বিরাট ব্যক্তিত্ব ট্রুম্যানের ছিল না, খর্বকায় হওয়ায় ও নারীসুলভ কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য ছোটবেলায় ট্রুম্যান সঙ্গীসাথীদের অনেক বিদ্রূপের শিকার হয়েছিলেন। তাই মনে করা হয় ট্রুম্যানের মানসিকতায় শক্তিপ্রদর্শনের একটা অদম্য ইচ্ছা ছিল। জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত তিনি নেন। অথচ ততদিনে জাপান প্রায় পরাজিত --- সম্মানজনক আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজছে, সম্রাটকে সরাতে না হলেই তারা যুদ্ধ শেষ করতে রাজি ছিল। ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীরা অনেকে ট্রুম্যানকে অনুরোধ করেছিলেন পরমাণু বোমা প্রয়োগ না করতে। আমেরিকার দুই প্রধান কম্যান্ডার আইসেনহাওয়ার এবং ম্যাকআর্থারও বলেছিলেন এই বোমা ফেলার কোনও সামরিক প্রয়োজন নেই। আসলে ট্রুম্যানের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিপ্রদর্শন। তাঁর ধারণা ছিল  একচেটিয়াভাবে পারমাণবিক বোমা হাতে থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাবিয়ে রাখা যাবে ও সারা পৃথিবীতে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো যাবে। তাঁর এই পদক্ষেপের ফলস্বরূপ যে বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দেবে, তা বোঝার মতো প্রজ্ঞা ট্রুম্যানের ছিল না।

ট্রুম্যান যে মারাত্মক খেলা শুরু করেন, ওয়ালেস তাঁর বিরোধিতা করে বলেছিলেন এই নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করবে। তাঁর মতে পারমাণবিক বোমার গবেষণা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিনিময় করা উচিৎ, যাতে ভবিষ্যতে সঙ্ঘাত এড়ানো যায় ও দুই দেশই পরমাণু গবেষণা বন্ধ করতে রাজি হয়। বিজ্ঞানীদের এবং অভিজ্ঞ জেনারেল হেনরি স্টিম্পসনেরও তাই মত ছিল। কিন্তু ট্রুম্যান রাজি হন না। তাঁর নির্বোধের মতো ধারণা ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনই পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করতে পারবে না। এই ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি বিশেষ। যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবার আগেই দুই প্রধান শরিকের মধ্যে যে বৈরিতার সূচনা ট্রুম্যান করেন, তা আরও প্রায় পঞ্চাশ বছর ঠান্ডা যুদ্ধ হিসেবে সারা পৃথিবীর উপর অনিশ্চয়তার মেঘ এনে দেয়। ইউরোপের পুনর্গঠনে মার্শাল প্ল্যানের বিরোধিতা করে ওয়ালেস বলেছিলেন, এই ত্রাণ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রসংঘের নিয়ন্ত্রণে করা উচিৎ। মার্শাল প্ল্যানকে তিনি ঠান্ডা যুদ্ধের অনুঘটক বলে মনে করেছিলেন। আমেরিকা জুড়ে কমিউনিস্ট সন্দেহে ধড়পাকড় ও দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ করতে বাধ্য করার মতো অপমানজনক নীতির বিরুদ্ধেও তিনি বলেন। ১৯৪৬ সালে ট্রুম্যানের নির্দেশে ওয়ালেস তাঁর ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেন। এইভাবে ক্ষমতায় আসার দু বছরের মধ্যেই ট্রুম্যান এফ ডি আরের ঘনিষ্ঠ সবাইকে পদ থেকে সরিয়ে দেন।

ট্রুম্যানের সরকারের প্রচার ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাক-স্বাধীনতা বন্ধ করে ইউরোপকে কুক্ষিগত করে রাখার পরিকল্পনা করছে। বাস্তবে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের এরকম কোনও কিছু করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাদের কোনও সহযোগী রাষ্ট্র ছিল না তখন, যুদ্ধে তারা আড়াই কোটির উপর মানুষ হারিয়েছে, সারা দেশের প্রধান শিল্প ও কৃষি অঞ্চলগুলি বিধ্বস্ত, নতুন করে গড়ার চেষ্টা করছে। আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক, যা এফ ডি আরের সময় গড়ে উঠেছিল, বজায় রাখার যথেষ্ট তাগিদ স্তালিনের ছিল। কমিউনিস্ট দেশের প্রধান হলেও স্তালিন ছিলেন মূলতঃ রুশ জাতীয়তাবাদী নেতা। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখাই তখন তাঁর অগ্রাধিকার ছিল। তার জন্য স্তালিনের মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েতের সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে, বিশেষকরে পোল্যান্ডে, যাতে সোভিয়েতের বৈরী কোনও সরকার না অধিষ্ঠিত হয় দেখা, যাতে ভবিষ্যতে সোভিয়েত ইউনিয়নে আর কোনও জার্মান আক্রমণ হতে না পারে। ইউরোপের কোন দেশ কার প্রভাবে থাকবে তা নিয়ে  চার্চিলের সঙ্গে একটা গোপন বৈঠকে স্তালিনের যে বোঝাপড়া হয়েছিল, এমনকি চার্চিলও স্বীকার করেন যে স্তালিন তা মেনে চলেছিলেন। গ্রীসে ব্রিটিশ প্রভাব মেনে নিয়ে তিনি সেখানে তাদের পছন্দমতো সরকারকে স্বীকার করে নেন, যার অনেক সদস্য এমনকি কিছুদিন আগে পর্যন্ত জার্মানদের সহযোগী ছিল। সেই সরকারের বিরুদ্ধে নাৎসিদের প্রতিরোধ করা  কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে স্তালিন তাতে কোনও সাহায্য করেন নি। এই নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর সঙ্গে স্তালিনের বিরোধ হয়েছিল। ইতালি, ফ্রান্স, এমনকি খোদ ব্রিটেনেও তখন কমিউনিস্টরা বেশ শক্তিশালী ছিল, কিন্তু স্তালিন তাদের কোনও সাহায্য দেন নি। ট্রটস্কির মতো বিপ্লব রফতানি করা ও নিরন্তর বিপ্লবের তত্ত্বে স্তালিনের আগ্রহ ছিল না, অন্ততঃ সেই পরিস্থিতিতে। সুতরাং সেই সময় ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসনের তত্ত্ব ধোপে টেঁকে না। আর ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলতে অনেক দেরি করার ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় সোভিয়েত প্রভাব মেনে না নেওয়ার বাস্তব কোনও উপায় ব্রিটেন-আমেরিকার কাছে ছিল না। কিন্তু ট্রুম্যান সোভিয়েত ইউনিয়নের পুনর্গঠনে যথেষ্ট টাকা না দিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে আলাদা করে ত্রাণের লোভ দেখিয়ে দলে টানার চেষ্টা করতে থাকলে স্তালিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে এইসব দেশগুলোকে স্তালিন আমেরিকান ত্রাণ প্রত্যাখ্যান করতে বলেন। সোভিয়েত প্রভাবাধীন দেশগুলোতে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির সরকার বসানো হয় ও তাদের একত্র করে সোভিয়েত নেতৃত্বে ‘ইস্টার্ন ব্লক’ গড়ে ওঠে। ইউরোপের মাঝে লৌহ-যবনিকা নেমে আসে। ন্যাটোর বিরুদ্ধে  (পরে) ওয়ারশ চুক্তি দ্বারা সামরিক জোট গঠন করা হয় ও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন হয়। সারা পৃথিবী জুড়েই ক্রমশঃ এক সাংঘাতিক সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা পরে কিউবা মিসাইল সংকটের সময় প্রায় পরমাণু যুদ্ধ শুরু হবার আশংকা ঘটায়।

ট্রুম্যানের ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেবার পর ওয়ালেস ঠিক করেন ট্রুম্যানের বিপজ্জনক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই করবেন। ওয়ালেস ট্রুম্যানের বিরুদ্ধে এফ ডি আরের নীতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ করেন, কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক দলকে তাঁর সমর্থনে পান না। ধনী ব্যবসাদারেরা, যারা দুই যুদ্ধ থেকে প্রচুর টাকা করেছিলেন ও যে কোনও সমাজতান্ত্রিক ধারণার চুড়ান্ত বিরোধী ছিলেন, তাঁরা সবাই ট্রুম্যানের সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে তিনি নতুন গঠিত প্রগতিশীল দলের টিকিটে রাষ্ট্রপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মনস্থ করেন। বিশ্বসংকটের মোকাবিলা করা ছাড়াও ওয়ালেসের অনেকগুলি প্রগতিশীল দাবী ছিল, যেমন দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বর্ণবাদী বিভেদ বন্ধ করা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একই কাজের জন্য সমপরিমান বেতন, সকলের জন্য স্বাস্থ্যবিমা, সারা দেশে কারখানা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিয়নের অধিকার আইনি করা, ইত্যাদি। এইসব দাবীগুলির সঙ্গে আধুনিককালে বামপন্থী রাষ্ট্রপতিপদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্সের তোলা সকলের জন্য স্বাস্থ্যপরিষেবা, উপযুক্ত মজুরি, ইউনিয়নের অধিকার ইত্যাদি দাবীর অনেক মিল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু তুলনা হয়েছে দুজনের মধ্যে। তবে বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্র্যাটিক দলেরই প্রার্থী হয়ে তাঁর দাবীগুলির পিছনে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা করেছেন --- নিজে প্রার্থীপদে মনোনয়ন না পেলেও দাবীগুলির অনেকগুলিকে দলের কর্মসূচীতে ঢোকাতে পেরেছেন। সেখানে ওয়ালেসকে দলের বাইরে থেকে লড়াই করতে হয়েছে। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ওয়ালেসের অবস্থান গড়ে উঠেছিল আইওয়াতে থাকার  সময়ই। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ স্নাতক পিতৃবন্ধু জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কার্ভারের প্রভাবে ওয়ালেস উদ্ভিদবিদ্যায় আগ্রহী হয়েছিলেন ও ভুট্টার সংকর বীজ তৈরিতে সাফল্য পাবার পিছনে কার্ভারের শিক্ষার অবদান স্বীকার করতেন। সুযোগ পেলে যে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের যোগ্যতা দেখাতে পারে, সেই উপলব্ধি ওয়ালেসকে বরাবরের জন্য সিভিল রাইটের দৃঢ় সমর্থক করেছিল। আইনস্টাইন, পল রবসন সহ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের অনেকে ওয়ালেসের প্রার্থীপদের সমর্থনে বিবৃতি দেন। আমেরিকায় প্রধান দুই দলের বাইরে প্রতিদ্বন্দিতা করে সাফল্য পাওয়া খুব দুরুহ ব্যাপার, তবু ওয়ালেসের দিকে শুরুতে কুড়ি শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল। বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে প্রচার করতে ওয়ালেস দক্ষিণের রাজ্যগুলি সফরে যান। এই রাজ্যগুলি ছিল ‘জিম ক্রো’ আইনের অন্তর্গত। জিম ক্রো আসলে কোনও ব্যাক্তির নাম নয় --- বর্ণের মিশ্রণে নিষেধাজ্ঞার ও অশ্বেতাঙ্গদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে যে সব আইন চালু ছিল, সেগুলোকে একত্রে জিম ক্রো আইন বলা হত। ওয়ালেসের উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গ ও উদারপন্থী শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন একত্র করে বিভেদমূলক আইনগুলোর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। কারণ বিভেদমূলক নীতি শুধু কৃষ্ণাঙ্গ নয়, শ্বেতাঙ্গদেরও স্বার্থের পরিপন্থী এবং ধনী প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করে। ওয়ালেস ভার্জিনিয়ার নরফোক থেকে তাঁর প্রচার শুরু করেন। তবে ভার্জিনিয়ায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের একত্রে বড়ো জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ওয়ালেসও আলাদা আলাদা জমায়েতে বক্তৃতা দিতে অস্বীকার করেন। তাই ছোট ঘরোয়া সভার আয়োজন করা হয়। তবে প্রগতিশীল যে শ্বেতাঙ্গদের সভায় যোগ দেবার আশা করা হচ্ছিল, তাদের দেখা পাওয়া যায় না। প্রগতিশীল দলকে অনেকে ‘নিগ্রোদের দল’ হিসেবে চিহ্ণিত করত বলে শ্বেতাঙ্গদের প্রগতিশীল দলের প্রতি অনীহা ছিল। এর পর ওয়ালেস নর্থ ক্যারোলাইনা যান। তখন দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনা সবথেকে প্রগতিশীল ছিল --- অন্ততঃ সেখানে মিশ্র বর্ণের জমায়েত ও সভা করায় কোনও বাধা ছিল না।  ১৩০ জন ছাত্র তাঁর সভায় সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল, তিরিশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর ওয়ালেসের সমর্থনে জোগাড় হয়। আশা ছিল নর্থ ক্যারোলাইনা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রগতিশীল দলকে ভোটে জেতাতে পারে --- তাতে অন্ততঃ একটা বড়ো ধাক্কা দেওয়া যাবে। সভায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মিলে বহু হাজার লোক হয়। তবে ওয়ালেসের প্রচারের দলে নিউ ইয়র্ক থেকে অনেক কমিউনিস্টরা যোগ দিয়েছিলেন। প্রচারে ওয়ালেসের বিরোধীরা সেই প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে বেঁধে। ওয়ালেসের এ ব্যাপারে কোনও ধারণা ছিল না --- তাঁকে এসব আগে না জানানোয় তিনি অসন্তুষ্টও হন। শ্রমিক সংগঠন, মধ্যবিত্ত ও কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে মনে করে ওয়ালেসের ভোট কাটায় রিপাবলিকান দলের সুবিধা হয়ে গেলে শ্রমিক আন্দোলনের অনেক ক্ষতি হবে। ডুরহামের প্রভাবশালী কৃষ্ণাঙ্গ সংগঠন ট্রুম্যানকে সমর্থন জানায়। প্রগতিশীল দল ‘কমিউনিস্ট সহযোগী ও মস্কোর চর’ এই অভিযোগে ডুরহ্যাম, গ্রিন্সবোরো, বার্লিংটন এইসব শহরে ওয়ালেসের সভায় শারীরিক হামলাও হয়। টম্যাটো, ডিম এসব ছোড়া হয় --- পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে। মাত্র তিন বছর আগে যিনি  উপরাষ্ট্রপতি ও দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম মানুষ ছিলেন, তাঁর এই ধরণের হেনস্থা অভাবনীয় মনে হলেও আসলে সেই সময় বর্ণভেদকারী নিয়মনীতি দক্ষিণে এতই স্বাভাবিক ছিল যে এমনকি প্রগতিশীল দলের কোনও কোনও প্রার্থীও মনে করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য অন্তর্দেশীয় নীতিতে ঠিক হলেও  ওয়ালেসের বর্ণভেদবিরোধী চিন্তাধারা দক্ষিণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিপন্থী। ওয়ালেসের সভায় যোগ দেওয়া কেউ কেউ মন্তব্য করেন, ওয়ালেস তিরিশ বছর আগে এসে পড়েছেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওয়ালেস শেষমেশ মাত্র তিন শতাংশ ভোট পেয়ে পরাজিত হন ও রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে নিউ ইয়র্কে নিজের ফার্ম হাউসে বাকি জীবন কাটান। ১৯৬৫ সালের ১৮ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। মাঝে কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সমালোচনা করা ছাড়া আর রাজনীতিতে অংশ নেন নি। তবে ওয়ালেসের রাষ্ট্রপতিপদে লড়াই সাফল্য না পেলেও তাঁর দক্ষিণের রাজ্য সফর পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। এর কুড়ি বছর পরে ডঃ মার্টিন লুথার কিং এর নেতৃত্বে ষাটের দশকে যে সিভিল রাইটস আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার বীজ ছিল ওয়ালেসের সফরে।

১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রুম্যান জেতেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ট্রুম্যানের নীতির ব্যর্থতা প্রকট হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু বোমার পর হাইড্রোজেন বোমাও বানিয়ে ফেলায়। চীনেও কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে। কোরীয় যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় সরাসরি সঙ্ঘাত হয় ও আমেরিকা কোনও সামরিক বিজয় পেতে ব্যর্থ হয়। দেশে ট্রুম্যানের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচুর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সমীক্ষায় ভোটারদের কাছে সাঙ্ঘাতিক অপ্রিয় হয়ে ওঠা ট্রুম্যান ১৯৫২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষদিকে ট্রুম্যান উপলব্ধি করেছিলেন কি মারাত্মক পথে তিনি পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছেন, কিন্তু ততদিনে যে দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে গেছে, তাকে আর বোতলে পোরার ক্ষমতা ট্রুম্যানের বা আর কারোর ছিল না। অস্ত্রের জোরে পৃথিবীকে বশে রাখার ‘ট্রুম্যান ডক্ট্রিন’ যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আমেরিকার বিদেশনীতির মূলমন্ত্র হয়ে যায়। ট্রুম্যানের পরবর্তী মধ্যপন্থী রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারও সেই নীতিই মেনে চলেন, একসময় তিনি নিজেই যার বিরোধী ছিলেন। কমিউনিজমের প্রসার রোধের নামে কোরীয় ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের নিয়ন্ত্রনের জন্য একাধিক যুদ্ধ, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বামপন্থী প্রভাব রুখতে বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তাঁবেদার সামরিক শাসক বসানো --- গত সত্তর বছর ধরে চলে আসা এসব ঘটনা সেই ট্রুম্যান ডক্ট্রিনেরই ফলশ্রুতি।

ফিরে দেখলে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্মেলনে ওয়ালেসের বদলে ট্রুম্যানকে উপরাষ্ট্রপতিপদে মনোনয়ন দেবার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড়ই ঘুরিয়ে দেয়। এফ ডি আরের মৃত্যুতে ট্রুম্যানের বদলে ওয়ালেস যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তবে এফ ডি আরের সেই মেয়াদ ছাড়াও আরও চার বা আট বছর ওয়ালেস নির্বাচিত হতে পারতেন। তবে হয়তো বা ঠান্ডাযুদ্ধ আর অস্ত্রপ্রতিযোগিতা এড়ানো যেত, উপনিবেশ শাসন হয়তো দশ থেকে পনের বছর আগেই পৃথিবীতে শেষ হয়ে যেত, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুফলগুলো হয়তো সারা পৃথিবীতে আরও অনেক ভালোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যেত, সবুজ বিপ্লব হয়তো পৃথিবীতে অনাহার মুছে দিত, পরিবেশ বাঁচানোয় হয়তো আরও অনেক বিনিয়োগ করা যেত। জাপানে যে পরমাণুবোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো না, তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা কার্যকারী সুসম্পর্ক থাকলে তাদের উপরও চাপ থাকত আরও খোলা ব্যবস্থা রাখতে --- সেখানে বা পূর্ব ইউরোপে যে ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, তার অনেকই হয়তো এড়ানো যেত। স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চভ পুনর্মূল্যায়ণ ও সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমেরিকার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে গুটিয়ে যান। ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি থাকলে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে রাজি হতো। খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শুধু শত্রু হিসেবে দেখলে, ট্রুম্যান ডক্ট্রিনে হয়তো আমেরিকার কিছু লাভ হয়েছে। অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল সোভিয়েত অর্থনীতি সেই চাপ সামলাতে পারে নি। অর্থনীতিকে বাঁচানোর তাগিদে শেষমেশ গর্বাচভ আমেরিকাকে এতটাই কূটনৈতিক সুবিধা দিয়ে দেন যে সোভিয়েত কাঠামোটাই ভেঙ্গে যায়। পৃথিবী  একমেরু হয়ে পড়ে। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব পেতে আমেরিকার সাধারণ মানুষকেও অনেক প্রাণ এবং অর্থমূল্য দিতে হয় --- করের টাকার একটা বড়ো অংশ মানুষের কাজে না লেগে প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় হয়, ভিয়েতনাম সহ অনেক যুদ্ধে বহু আমেরিকান সৈন্য আহত বা নিহত হয়। ওয়ালেস রাষ্ট্রপতি হলে এইধরণের প্রতিযোগিতা এড়াতে পারতেন। তা ছাড়া আমেরিকাতে হয়তো এক দেড় দশক আগেই বর্ণবিভেদ লোপ করা যেত, নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরিতে বৈষম্য হয়তো বন্ধ করা যেত, শ্রমিকদের অধিকার হয়তো আরও মানা হতো, সকলের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য হয়তো অনেক বেশি বিনিয়োগ হতো। এফ ডি আরের যথাযোগ্য উত্তরসূরী হয়ে হয়তো এফ ডি আরের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা ও তাকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি পারতেন। হয়তো এর সবকিছু হতো না, তবে এর কিছু কিছু যে হতো, অন্ততঃ ওয়ালেস যে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন, তা আশা করা যায় অবশ্যই।

রাজনীতির কায়েমী স্বার্থ ওয়ালেসের চিন্তাকে অবাস্তব ও স্বপ্নদর্শী বলেছে, ওয়ালেসকে কমিউনিস্ট তকমা দিয়েছে। অথচ ওয়ালেস তাঁর যোগ্যতা বহুভাবে প্রমাণ করেছেন। ওয়ালেসের চিন্তাধারার বিশেষ গুরুত্ব না থাকলে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আমেরিকান রাষ্ট্রপতি এফ ডি আর তাঁর উপর এত ভরসা করতেন না। যিনি এক হাজার কোটি ডলারের এক সফল ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন, সেই হেনরি ওয়ালেস আমেরিকার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রেই আস্থাশীল ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের একটা কল্যাণকামী ভূমিকা, নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববোধ আর বিশ্বশান্তির প্রতি দায়বদ্ধতা। তিনি চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক অস্ত্রের জোরে নয়, মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতে, সেইভাবেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুক। তাঁর মত ছিল, “যারা কমিউনিজমের ভয়ে ভীত, তাদের আসলে গণতন্ত্রের উপরই আস্থা নেই”। ওয়ালেস আমেরিকার এক অন্য মুখ দেখতে চেয়েছিলেন, যা অনেক বেশি মানবিক, নৈতিক বলে বলীয়ান। দুঃখের বিষয়, এফ ডি আর ছাড়া তাঁকে বোঝার মতো প্রভাবশালী রাজনীতিকদের মধ্যে আর কেউ ছিল না। হেনরি ওয়ালেস যে সময়ের অনেক আগে জন্মেছিলেন।

 

আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।

তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।

তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

(আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে --- হুমায়ুন আজাদ)


----------
প্রথম প্রকাশিত ঃ সৃষ্টির একুশ শতক, নভেম্বর ২০২০


কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল 


রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২০

অবগাহন

 অবগাহন

-শুভাশিস ঘোষাল




জানি, থাকা যায়

আরও কিছু ক্ষণ নিরালায়

কবোষ্ণ জলে,

আরও কিছু ক্ষণ ছোঁয়া যায়

ঠোঁট, রাঙা কামনায়

পয়োধর তলে;

নিঃশ্বাসের গলানো ইস্পাত

দুর্মর ফেলা যায়

তূর্ণ গতি বলে।

তবুও এখনই সময়

ধারাস্নান সেরে ---

শিশিরে সম্পৃক্ত মাটি

পাতার পথ ধরে,

কৌমুদীরাতে কিংবা

গাঢ় তমিস্রায়,

পথ খুঁজে নিতে তারার

তৃষিত আলোয়।

বুটের নির্মম শব্দ আর

সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার ;

অসউইজ থেকে আসা

মৃতদের মিছিলের ভাষা

শুনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ---

বেয়নেট যদি ফেঁড়ে দেয়

তোমার আমার

হৃদপিন্ড আবার,

তবু মুখে মুখে ছড়াবে 

নিষিদ্ধ ইস্তেহার। 


----------
প্রথম প্রকাশিত ঃ অক্টোবর ২০২০,  দিগন্ত
বেঙ্গলি এসোসিয়েসন অফ নর্থ ক্যারোলাইনার শারদ ম্যাগাজিন


কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল 

শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০২০

আমেরিকার আসন্ন নির্বাচন—কিছু তথ্য ও সম্ভাব্য ফল

 আমেরিকার আসন্ন নির্বাচন—কিছু তথ্য ও সম্ভাব্য ফল

-শুভাশিস ঘোষাল

 

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ আর পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন আধুনিক গণতন্ত্র, তাই আমেরিকায় কে ক্ষমতায় আসবে তা সারা পৃথিবীর জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই দেখে নেওয়া যাক আমেরিকায় কখন কিভাবে ভোট হয়, ক্ষমতা কিভাবে বন্টন হয়, ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনীতিতে নবাগত এবং প্রথাবিরূদ্ধ একজন ২০১৬ সালে কি করে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটার রাষ্ট্রপতিপদে নির্বাচিত হয়ে গেলেন, এবারের ভোটে আর কারা প্রার্থী, আর কার জেতার সম্ভাবনা কেমন।

এটা মোটামুটি সবারই জানা যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি-কেন্দ্রিক শাসন ক্ষমতা চলে --- ব্রিটেন বা ভারতবর্ষের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র নয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিয়ত সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রেখে চলতে হয়। রাষ্ট্রপতি ভোটারদের কাছ থেকে সরাসরি ভোট পেয়ে থাকেন, তাই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তাঁর  শাসনক্ষমতা থেকে যায়। তাই অন্যান্য পদের জন্য একই সঙ্গে নির্বাচন হলেও রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের গুরুত্বটাই সবথেকে বেশি। কিন্তু প্রচুর ক্ষমতা থাকলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে নিরংকুশ নয়। সংবিধান রচনার সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা বিশেষ যত্ন নিয়েছিলেন যাতে ক্ষমতায় বিকেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্য থাকে, কারণ তাঁরা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের এক তরফা ক্ষমতার বিরোধিতা করে এই দেশের পত্তন করেছিলেন। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে হলে বাকি অংশের কথাও কিছুটা বলা দরকার। খুব অল্প কথায় বলতে হলে শাসনক্ষমতা তিনভাগে বন্টিত। প্রথম ভাগ হল এক্সিকিউটিভ শাখা, যার প্রধান রাষ্ট্রপতি। তিনি তাঁর ক্যাবিনেটের সচিব ও উপদেষ্টাদের পরামর্শ নিয়ে সরকারকে চালান। এই ক্যাবিনেটে উপরাষ্ট্রপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল সহ মোট ষোলজন সদস্য থাকেন বিভিন্ন দফতরের ভার নিয়ে। এদের মধ্যে শুধু উপরাষ্ট্রপতি মানুষের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অংশীদারিত্বে, বাকিদের রাষ্ট্রপতি ভোটে জেতার পর নিজের পছন্দমতো বেছে নেন। দ্বিতীয়ভাগ লেজিস্টেটিভ শাখা কংগ্রেস বা আইনসভার দুটো কক্ষ থাকে --- হাউস (নিম্নকক্ষ) ও সেনেট (উচ্চকক্ষ), যাদের সদস্যরা প্রত্যেকেই সরাসরি নির্বাচিত হন। হাউসে মোট ৪৩৫ জন সদস্য থাকেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্যের সংখ্যা ঠিক হয়, রাজ্যের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভোটারদের এরা প্রতিনিধিত্ব করেন, প্রতি দু বছর অন্তর তাঁরা ভোটারদের মুখোমুখি হন। সেনেটে একশ জন সদস্য থাকেন, পঞ্চাশটা রাজ্যের প্রত্যেকটি থেকে দুজন করে, যদিও বিভিন্ন রাজ্যের জনসংখ্যায় আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। এরা একেকজন ছয় বছর করে নির্বাচিত হন ও সারা রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রতি দু বছরে এক তৃতীয়াংশ মেয়াদ শেষ করেন, ও সেই পদে নতুন করে নির্বাচন হয়  সারা রাজ্যের ভোটারদের সমর্থনের ভিত্তিতে। হাউসের প্রধান কাজ হল নতুন আইন প্রণয়ন করা সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে। যে কোনও সদস্য, যে রাজনৈতিক দলের বা নির্দল হোন, বিল এনে সমর্থন যাচাই করতে পারেন। সেই বিল পাস হলে সেনেটে যায় বিবেচনার জন্য। সেনেট তাতে সংশোধনী আনতে পারে। তারপর সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যায় অনুমোদনের জন্য, যাতে তা আইনে পরিণত হতে পারে। পছন্দ না হলে রাষ্ট্রপতি ভেটো দিয়ে বিলটিকে নাকচ করতে পারেন, যদি না সেনেটে তা দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতায় পাস হয়ে থাকে। তাই দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপতি চাইলেই কোনও আইন বানাতে পারেন না, এমন কি আইনসভার সাহায্য ছাড়া কোনও বিল পেশই করতে পারেন না। তবে বিশেষ ক্ষমতা বলে কিছু কিছু নির্দেশ জারি করতে পারেন সাময়িক ভিত্তিতে, যাকে বলে এক্সিকিউটিভ অর্ডার। তবে তা আদালতে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে সাংবিধানিক ত্রুটির কারণে আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে যেতে পারে। সেটা অবশ্য প্রবর্তিত যে কোনও আইনও হতে পারে, তবে আইনসভায় পাস হলে এক্তিয়ারের প্রশ্ন ওঠে না, শুধুমাত্র সংবিধান লঙ্ঘন হলেই আদালত আপত্তি জানাতে পারে। এ ছাড়া বাজেট পাস ও কোনও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার অধিকার একমাত্র আইনসভার আছে। রাষ্ট্রপতি ক্ষমতার অপব্যবহার করলে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ বিতর্কের পর হাউস তাঁকে ইম্পিচ (ভর্ৎসনা) করতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে, আর তারপর সেনেটকে তার উপর ভোটাভুটি করতে হয় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হবে কি না তাই জন্য। তবে অপসারণের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সেনেটারের সমর্থন লাগে। এ ছাড়া ক্ষমতার তৃতীয় স্তম্ভ হল জুডিশিয়াল শাখা বা বিচার-ব্যবস্থা । সুপ্রিম কোর্ট এবং অন্য কিছু উচ্চ আদালতের কোনও বিচারপতিপদ খালি হলে রাষ্ট্রপতি সেই পদে নাম প্রস্তাব করেন ও সেনেটে সমর্থন জোগাড় করতে পারলে তাঁকে পদে নিযুক্ত করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টে নয়জন বিচারপতি থাকেন, যাঁরা একবার নিয়োগ হলে সারাজীবনের জন্য পদ পান, যতক্ষণ কর্মক্ষম থাকেন। এঁদের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যদিও বিচারপতিরা নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ, কিন্তু সাংবিধানিক অধিকারের ব্যাখ্যা করতে তাদের অবস্থান উদারপন্থী না রক্ষণশীল, তা ভীষণভাবে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। সুপ্রিমকোর্টে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ব্যাখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে ঠিক হয়। ফলে প্রত্যেক রাষ্ট্রপতি চান তাঁর মেয়াদকালে নতুন কোনও নিয়োগের সুযোগ থাকলে তাঁর দলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে এমন কাউকে নিয়োগ করতে, বিশেষ করে তার তাৎপর্য অনেকসময় তিরিশ-চল্লিশ বছরও থাকতে পারে। তবে সেনেটে সমর্থন আদায় করতে না পারলে তাঁর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। প্রথাগতভাবে সেনেটে ষাটজন সদস্যের সমর্থন আদায় করতে হয়, তবে সেই প্রথাকে লংঘন করে সাধারণ গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে ইদানিং।

আর আমেরিকা যেহেতু একটি যুক্তরাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ছাড়াও রাজ্য এবং স্থানীয় সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেই ক্ষমতার বিভাজন খুবই স্পষ্ট --- বহু ব্যাপারে রাজ্যের সিদ্ধান্তের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও রকম ওজর-আপত্তি চলে না। এমন কি আইন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে অনেকসময় এতই আলাদা হয় যে এরা যে একই দেশের অন্তর্গত, তা মনেই হয় না।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের নির্ঘন্ট খুবই নিয়মানুসারি --- প্রতি দু বছরে নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার এক সঙ্গে কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের যাবতীয় নির্বাচন হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গঠন হবার পরপর ১৭৮৮ সাল থেকেই এরকম ব্যবস্থা চলে আসছে, যদিও সেই সময় দেশটা অনেক ছোট ছিল ও প্রতিনিধিসংখ্যা অনেক কম ছিল। আগেই বলেছি হাউসের প্রতিনিধি প্রতি দু বছর বাদে বাদেই হয়ে থাকে, রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যের গভর্নর চার বছর বাদে বাদে হয়ে থাকে। সেনেটর ছ বছরের জন্য নির্বাচিত হন ও এক রাজ্য থেকে দুজন করে থাকেন বলে, প্রতি তিনবারে একবার যে কোনও ভোট কেন্দ্রে সেনেটর নির্বাচন হয় না, বাকি দু বার হয়। এ ছাড়া রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের নানা প্রতিনিধি নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী নির্বাচকদের মুখোমুখি হন এই সময়ে। কোনও কারণে কারোর মেয়াদে ছেদ পড়লেও কয়েকটি পরিস্থিতি বাদে এই নির্ঘন্টের বাইরে নির্বাচন হয় না। যেমন মাঝপথে কোনও সেনেটরপদ খালি হলে সেই রাজ্যের গভর্নর যাকে খুশি নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রপতিপদ খালি হলে (মারা যাওয়া, পদত্যাগ বা পদ থেকে অপসারিত হবার কারণে) উপরাষ্ট্রপতি তাঁর জায়গায় বসেন, তিনিও না হতে পারলে হাউসের স্পিকার, এভাবে।

যদিও বলা হয় রাষ্ট্রপতি সরাসরি সাধারণের ভোটে নির্বাচিত, কিন্তু আসলে পদ্ধতিটা একটু জটিল। ফলাফলের জন্য এই ব্যবস্থাটা বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করেন ৫৩৮ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল, যাকে বলা হয় ইলেক্টোরাল কলেজ। এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অর্থাৎ ২৭০ জনের সমর্থন পেতে হয় তাঁকে নির্বাচিত হতে গেলে। এই প্রতিনিধিরা আসেন প্রতিটি রাজ্য থেকে এক নির্দিষ্ট সংখ্যায়। সে সংখ্যা হল সেই রাজ্য থেকে আইনসভার নিম্নকক্ষ হাউসে যতজন প্রতিনিধি আছেন, অর্থাৎ যতগুলি কংগ্রেসানাল ডিস্ট্রিক্ট আছে, তাদের সংখ্যা (যা মোটামুটি রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে হয়ে থাকে --- তবে অন্ততঃ একটি হতেই হয়) তার থেকে দুই বেশি (যেহেতু প্রতি রাজ্যের  থেকে আইনসভার উচ্চকক্ষে দুজন প্রতিনিধি সেনেটার থাকেন), মানে অন্ততঃ তিনজন। হাওয়াই, আলাস্কা, ৪৮টি লাগোয়া রাজ্য ও রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে কতজন করে প্রতিনিধি থাকেন তা নিচের মানচিত্রে দেখানো হয়েছে। ডিসি থেকে কংগ্রেসে কোনও প্রতিনিধি না থাকলেও ইলেক্টরাল কলেজে তিন জনের প্রতিনিধিত্ব থাকে। বলা বাহুল্য, এই সংখ্যাগুলো শুরু থেকে একই রকম নেই, প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার হিসেব অনুযায়ী পূনর্মুল্যায়ণ হয়। আমেরিকার অন্যান্য অংশ যেমন পুয়ের্তো রিকো, আমেরিকান ভার্জিন আইল্যান্ড, গুয়াম, আমেরিকান সামোয়া ইত্যাদি দ্বীপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতে পারে না। এদের নিজেদের শাসনব্যবস্থা আছে আর কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনও করও দিতে হয় না। প্রায় সমস্ত রাজ্যেই যে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বেশি ভোট পান, সেই রাজ্যের ইলেক্টরাল কলেজের সব সদস্যের ভোটের তিনি অধিকারী হন, যাকে বলে ‘উইনার টেক্স অল’ পদ্ধতি। যেমন সবথেকে বড় রাজ্য  ক্যালিফোর্নিয়ায় যিনি সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, তিনি এর ৫৫টি ইলেক্টোরাল ভোটের পুরোটাই পাবার অধিকারী, এমনকি মাত্র এক ভোটে জিতলেও। এর অবশ্য দুটো ব্যতিক্রম আছে। মেইন রাজ্যের চারটি ইলেক্টোরাল ভোটের দুটি দেওয়া হয় যিনি বেশি ভোট পান তাকে, আর বাকি দুটি মেইনের দুটি কংগ্রেসানাল ডিস্ট্রিক্টের বিজয়ী হিসেব করে, অর্থাৎ রাজ্যের বিজয়ী তিন বা চার ভোট পেতে পারেন। নেব্রাস্কা রাজ্যের পাঁচটি ইলেক্টোরাল ভোটের চারটি দেওয়া রাজ্যের বিজয়ীকে, আর পঞ্চমটি দেওয়া হয় দ্বিতীয় কংগ্রেসানাল ডিস্ট্রিক্টের বিজয়ীকে।




ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি থাকার ফলে, যে প্রার্থী সারা দেশে বেশি ভোট পাচ্ছেন, তিনি ইলেক্টোরাল ভোটে জয়ী নাও হতে পারেন --- মোট আটান্নবার রাষ্ট্রপতি ভোটে পাঁচবার এরকম হয়েছে। আরও ব্যাপার হল ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধিরা আসলে মানুষ, এইরকম নির্দেশ অনুযায়ী তাঁদের ভোট দেবার কথা। তবে কেউ কি অন্যরকম ভোট দিতে পারেন? প্রতিনিধিরা বিজয়ী প্রার্থীর পছন্দমতো নেওয়া হয়, তাই সেই সম্ভাবনা কম। তবে কেউ নির্দেশিকা লংঘন করে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী বা সম্পূর্ণ অন্য কাউকে ভোট দিতেই পারেন। এরকম সদস্যদের বলা হয় ‘বিশ্বাসহীন নির্বাচক’। বেশিরভাগ রাজ্যের নিয়মে নির্দেশ ভেঙ্গে ভোট দেওয়া অপরাধ বলে গণ্য হয়, রাজ্যে কখনও এলে গ্রেফতার হয়ে যাবেন, তবে তাঁর ভোট বহালই থাকবে। কোনও কোনও রাজ্য অবশ্য ভোটের অধিকার সম্পূর্ণভাবে ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধির উপর ছেড়ে দেয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বাসহীন ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনেই ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রাপ্যের থেকে ২টি কম আর হিলারি ক্লিন্টন তাঁর প্রাপ্যের থেকে ৫টি কম ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছিলেন। ইলেক্টোরাল ভোটের ব্যবধান বেশ অনেকটা থাকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার প্রভাব পড়েনি, তবে ব্যবধান কম থাকলে ভোটারদের সিদ্ধান্ত ইলেক্টোরাল কলেজে উলটে যেতেই পারে।

কথা হল, সরাসরি ভোটের বদলে ইলেক্টোরাল কলেজের মতো এরকম জটিল পদ্ধতি কেন? তার কারণ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করার সময় দেশটা ছিল আসলে কতগুলো দেশের সমষ্টি। যাতে ছোট রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব বড় রাজ্যের জনসংখ্যার চাপে ঢাকা পড়ে না যায়, তাই এরকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে তারা একযোগে ভোট দিতে পারে। আর দেশের প্রতিষ্ঠাতারা অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন, আধুনিক গণতন্ত্র পৃথিবীতে তখন এক সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা। তাঁদের চিন্তা ছিল জনসাধারণ রাষ্ট্রপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কতটা পরিপক্কতা দেখাতে পারবেন তাই নিয়ে। তাই ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থাটাকে তাঁরা একটা রক্ষাকবচ মনে করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এখন পরিস্থিতি একরকম নয়, তাই এই ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক আছে, যা চরমে ওঠে ২০১৬ সালের ভোটে হিলারি ক্লিন্টনের তুলনায় প্রায় ২৯ লক্ষ ভোট কম পেয়েও সাতাত্তরটি ইলেক্টোরাল ভোট বেশি পেয়ে ডনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায়। এ ছাড়াও এই ব্যবস্থার আরও কতগুলি দুর্বলতা আছে। দুই প্রধান দলের কোনও দল কোনও রাজ্যে প্রতিদ্বন্দী দলের থেকে মাত্রাতিরিক্ত শক্তিশালী হলে দু দলের কেউই সেই রাজ্যের ভোটারদের ভোট অর্জন করার জন্য কোনও প্রচার বা প্রচেষ্টা করে না, কারণ ‘উইনার টেক্স অল’ ব্যবস্থায় তা অলাভজনক। ভোটের নিট ফল নির্ভর করে হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলের দোদুল্যমান ভোটারদের সিদ্ধান্তের উপর। আর বিভিন্ন রাজ্যের ভোটারদের ভোটের ধার অনেক তফাৎ হতে পারে ইলেক্টোরাল কলেজের অনুপাতে। বিপুল জনসংখ্যার ক্যালিফোর্নিয়ার ভোটারদের এক এক জনের ভোটের গুরুত্ব অল্প জনসংখ্যার ওয়াইওমিং প্রদেশের এক এক জনের ভোটের থেকে অনেক কম। আর রাজ্যপ্রতি দুজন করে সেনেটর পেয়ে ছোট রাজ্যগুলি জনসংখ্যার তুলনায় বেশি প্রতিনিধিত্ব এমনিতেই পেয়ে গেছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা বদলানো সহজ কথা নয়। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ছাড়াও ৩৭টি রাজ্যকে অন্ততঃ রাজি হতে হবে ব্যবস্থার বদলে। যে দলের এখন রাজনৈতিক লাভ রয়েছে এই ব্যবস্থায়, তারা রাজি হবে না। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলে গেলে তারা যদি রাজি হয়, অন্যদল হয়তো তখন পিছিয়ে যাবে। সুতরাং এই পদ্ধতিই চলবে অদূর ভবিষ্যতে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল রয়েছে --- ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি। সাধারনভাবে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান  উদারপন্থী ও বামপন্থী এবং রিপাবলিকানদের অবস্থান রক্ষণশীল ও দক্ষিণপন্থী। তবে এই দলগুলির বিশাল ব্যপ্তির কারণে একই দলের মধ্যেও বিভিন্ন অবস্থানের সদস্য থাকেন। যেমন ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মধ্যপন্থী, নিও-লিবেরাল ও প্রগতিশীল বামপন্থী অংশ স্পষ্টভাবে রয়েছে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কতদূর এগোনো যায় সে ব্যাপারে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। মধ্যপন্থীরা যেমন মূলতঃ কর্পোরেশনদের সুবিধা দিতে আগ্রহী যদি কর্মীদের কিছু কিছু স্বার্থ দেখা হয়, নিও-লিবেরালরা সামাজিক উদারপন্থায় জোর দেয় ও মুক্ত-বাণিজ্যের সমর্থক, প্রগতিশীল বামপন্থীরা বড় ধরণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পক্ষপাতী যাতে কর্পোরেশনের ক্ষমতা কম হয়, ধনীদের অনেক বেশি কর দিতে হয় আর সাধারণ নাগরিকেরা আরও বেশি সামাজিক সুরক্ষা পায় সরকারের কাছ থেকে।  রিপাবলিকানদের মধ্যে তেমনই গোটা চারেক ভাগ রয়েছে --- ব্যবসাবন্ধু নীতির পক্ষপাতী একদল, ধর্মীয় অনুশাসনের পরিধি বাড়ানোর পক্ষপাতী এক দল, লিবারেটেরিয়ান মনোভাবাপন্ন একদল যাদের মতে সামাজিক বা অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে সরকারের নগণ্য ভূমিকা থাকবে এবং সবশেষে মেধাবিরোধী বিজ্ঞানবিরোধী শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যে বিশ্বাসী একধরণের লুম্পেন-শ্রেণী। এই বিভিন্নশ্রেণীর রাজনীতি যে পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণ পৃথক, তাও নয়। যেমন ধর্মীয় অনুশাসন বাড়ানোর পক্ষপাতীরা সাধারণভাবে বিজ্ঞানবিরোধী এবং অনেকসময় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে বিশ্বাসী। নির্বাচন লড়া খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, ভালোভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়ার জন্য অন্ততঃ একশ কোটি ডলার লাগে। কর্পোরেট রিপাবলিকান ও কর্পোরেট ডেমোক্র্যাটদের উভয়েই বড় বড় ব্যবসা, বিশেষকরে ওয়াল স্ট্রীটের বড় ব্যাঙ্ক থেকে তাদের নির্বাচন তহবিলে প্রচুর টাকা পেয়ে থাকে, ফলে তাদের অনেক সুবিধাও করে দেয়। নিয়মনীতি ও করের মাত্রা আর সামাজিক অবস্থান নিয়ে মতভেদ থাকলেও তাদের মূলনীতিগুলোয় ফারাক কম, বিশেষকরে বিদেশনীতির প্রশ্নে। প্রগতিশীল বামপন্থীদের কর্পোরেশন-বিরোধিতায় চড়া সুরের কারণে তাদের নির্বাচনী তহবিল পুরোপুরি সাধারণ মানুষের ছোট দানের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান দুই পার্টিই দেড়শ বছরের অধিক পুরোনো আর তাদের দৃষ্টিভঙ্গীরও প্রচুর বিবর্তন হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টি জন্মলগ্নে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির ছিল, প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন দাসপ্রথা বিলোপ করে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তি দেন, দক্ষিণের ডেমোক্র্যাটরা এর বিরোধী ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে রিপাবলিকানরা বড় ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে আর তিরিশের দশকে তীব্র মন্দার সময় ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নেতৃত্বে সরকারের সামাজিক বিনিয়োগ নীতি দুই দলের রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করে দেয়। তারপর ষাটের দশকে সামাজিক ন্যায়াধিকারের প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মার্টিন লুথার কিং এর নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠে, ও নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কার করে। আবার মন্দার পরে আশির দশকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রনাল্ড রেগনের নেতৃত্বে সামরিকখাতে প্রচুর ব্যয়বৃদ্ধি, কম কর ও বাণিজ্যিক উদারীকরণের নিও-কনজার্ভেটিভ ভাবধারা চালু হয় ও সামাজিক সুরক্ষা কমানো হতে থাকে, যা রিপাবলিকানদের আধুনিক মূলমন্ত্র হয়ে যায়। আবার এই শতাব্দীর থেকে, বিশেষ করে শেষ কয়েক বছরে, পরিবেশ-সামাজিক অধিকার-সামাজিক সুরক্ষা-যুদ্ধবিরোধিতা-কর্পোরেট ইত্যাদি প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান আগের তুলনায় এত বেশি বামপন্থী হয়েছে যে নব্বইএর দশকের ডেমোক্র্যাটিক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের নীতিগুলি অনেকটাই মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের মতো লাগবে। দুই প্রধান দলের বাইরে ছোট দলও আছে কয়েকটি, যেমন লিবারেটারিয়ান পার্টি, রিফর্ম পার্টি, কন্সটিটিউসন পার্টি, আর গ্রীন পার্টি। এদের মধ্যে গ্রীন পার্টি, যাদের পরিবেশ ও কর্পোরেট প্রশ্নে খুব দৃঢ় বামপন্থী অবস্থান, বাদে বাকিদের দক্ষিণপন্থী বলা যায়। দুই প্রধান দল ছাড়া বাকিদের পাওয়া ভোট শতাংশের হিসেবে খুবই কম, সব মিলে পাঁচ ছয় শতাংশের বেশি হয় না প্রায় কখনই। এরা মূলতঃ নীতিগত অবস্থান বোঝাতে কোনও কোনও নির্বাচনে লড়ে। এ ছাড়া নির্দল সদস্য হিসেবেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করা যায়, তবে নির্দল প্রতিনিধিদের সাধারণতঃ দুই প্রধান দলের কারুর একজনের সঙ্গে সংস্রব থাকে, তাদের সঙ্গেই একসাথে ভোট দিয়ে থাকে আইনসভায়।

আমেরিকায় কতগুলি বিষয় নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে মৌলিক বিতর্ক আছে, যেমন গর্ভপাতের অধিকার, বন্দুক সঙ্গে রাখা, সমকামী বিবাহ, মারিজুয়ানার বৈধকরণ, এবং অবশ্যই, করের মাত্রা কতদূর হওয়া উচিৎ তা নিয়ে। ভ্রূণহত্যা রক্ষণশীল খ্রীষ্টান রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে একটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। হাতিয়ার রাখার অধিকার সংবিধানে দেওয়া আছে, তবে বন্দুকবাজ-হামলা রোখার জন্য ডেমোক্র্যাটরা কড়া বাছাই-ব্যবস্থার পক্ষপাতী। সমকামী বিবাহ এখন অবশ্য সারা দেশেই স্বীকৃত। ডেমোক্র্যাটরা মারিজুয়ানার বৈধকরণ করতে আগ্রহী, বিশেষকরে চিকিৎসার কারণে। আর এর সাথে সামাজিক ন্যায়ও জড়িয়ে, কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক বেশি মাত্রায় শুধুমাত্র মারিজুয়ানা রাখা ও সেবনের অপরাধে দন্ডিত হয়। ধনীদের করের মাত্রা ডেমোক্র্যাটরা বাড়ানোর পক্ষপাতী, রিপাবলিকানরা বলে কর কমালে বেশি বৃদ্ধি হবে ও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও ডেমোক্র্যাটদের বামপন্থী প্রগতিশীল অংশের অনেকগুলো দাবী, যেমন ন্যুনতম মজুরি ১৫ ঘন্টায় ডলার করা, সবার জন্য স্বাস্থ্য, নিখরচায় সরকারি কলেজে পড়ার ব্যবস্থা বা ছাত্রঋণ মকুব করা, মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটির সুযোগ সব চাকরিতে, এবং বিশেষ করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিষ্ক্রমণ কমিয়ে সৌর, বায়ু ও অন্যান্য অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার অনেক বাড়ানোর জন্য সরকারি বিনিয়োগ, এখন পুরো ডেমোক্র্যাটিক দলেরই বক্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্টোদিকে রিপাবলিকানরা বলে এতে ব্যবসা এত খরচসাপেক্ষ হয়ে যাবে যে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন ও চাকরির সুযোগ অনেক সংকুচিত হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই বিষয়গুলি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, এবং বেশিরভাগ লোকে মোটামুটি এইসব বিষয়ে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে ভোট দিয়ে থাকে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থায় একটা খুব ভালো দিক হল, দলের প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হয় না, সাধারণের ভোটেই তা ঠিক করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলে নির্বাচনের প্রাইমারি, যা আমেরিকা ছাড়াও আর কয়েকটি হাতে গোনা দেশে চালু আছে। যে কোনও বৈধ ভোটার কোনও একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের ভোটার হিসাবে নাম নথিকরণ করতে পারেন, তাঁকে সেই দলের সদস্যও হতে হয় না। ভোটের প্রাইমারি পর্যায়ে, যা নির্বাচনের বছরে শুরুর দিকে হয়ে থাকে, নথিভুক্ত ভোটাররা ভোট দিয়ে প্রত্যেক পদের জন্য একাধিক প্রার্থীর মধ্যে থেকে সেই দলের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন, যিনি সাধারণ নির্বাচনের পর্যায়ে দলের প্রার্থী হন। ভোটাররা নিজেদের কোনও দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলেও নথিভুক্ত করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে প্রাইমারি পর্যায়ে প্রায় সব রাজ্যেই তিনি যে কোনও একটি দলের প্রাইমারিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আর কোনও দলের হয়ে নাম নথিভুক্ত করানো হলেও সাধারণ নির্বাচনে সেই দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই --- ভোট গোপন ব্যালটেই হয়।

সংবিধান অনুযায়ী একজন ব্যক্তি সর্বাধিক মোট দুবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারেন, শুধু যুদ্ধের মতো বিশেষ কোনও জরুরি কারণ না থাকলে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি রিপাবলিকান দলের ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন, তাই স্বাভাবিকভাবে তিনি রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হচ্ছেন এবারে। প্রথম মেয়াদের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি সাধারণতঃ প্রাইমারিতে তেমনভাবে প্রতিদ্বন্দিতার মুখোমুখি হন না। প্রাইমারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হচ্ছেন জোসেফ আর বাইডেন জুনিয়র, যিনি জো বাইডেন নামেই বেশি পরিচিত।

জো বাইডেনের জন্ম ৭৮ বছর আগে শ্বেতাঙ্গ-শ্রমজীবি অধ্যুষিত পেনসিলভ্যানিয়ার স্ক্র্যানটনে এক মধ্যবিত্ত ক্যাথলিক পরিবারে ও পাশের রাজ্য ডেলাওয়্যারে বেড়ে ওঠা, জিতলে তিনি প্রটেস্টান্ট-প্রধান আমেরিকায় প্রবীণতম ও জন কেনেডির পর দ্বিতীয় ক্যাথলিক রাষ্ট্রপতি হবেন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে রাজনীতি করা বাইডেন ডেমোক্র্যাট দলে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত। চল্লিশ বছর ধরে ডেলাওয়্যার থেকে সেনেটর নির্বাচিত ও আট বছর বারাক ওবামার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তাঁর এই নিয়ে তৃতীয়বার। প্রথম দুবার কলকে পান নি, তবে ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের সময় বারাক ওবামা দলের প্রার্থী হলে তাঁকে রানিং মেট হিসেবে বাছাই করেন উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য ওঁরা জিতে আসেন। এবারেও বাইডেনের প্রার্থীপদ পাওয়া একেবারেই নিষ্কন্টক হয় নি। প্রাইমারির প্রথমদিকে আইওয়া আর নিউ হ্যাম্পশায়ারে তিনি শোচনীয়ভাবে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান পান। তার পরে নেভাদাতেও দলের বামপন্থীদের প্রধান মুখ বার্নি স্যান্ডার্সের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে তাঁর বিদায় প্রায় আসন্ন হয়ে পড়ে। দলের নেতৃত্ব, যার প্রায় সবাই মধ্যপন্থী, দুটি কারণে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এক স্যান্ডার্সের উত্থান মানে কর্পোরেট সমর্থন হারানো, তহবিলে টান পড়া। স্যান্ডার্সের মতো জনপ্রিয় নেতা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তহবিল তুলতে পারলেও অন্যান্যপদে দলের প্রার্থীরা টাকার অভাবে লড়তে অসুবিধায় পড়বে। দ্বিতীয়তঃ স্যান্ডার্সের বামপন্থার ভয় দেখিয়ে, তাঁকে কম্যুনিস্ট চিহ্ণিত করে, ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা ফায়দা তুলবে। কিন্তু স্যান্ডার্সের জনপ্রিয়তাকে সামাল দেবার মতো মধ্যপন্থী কাউকে খাড়া করতে হলে বাইডেন ছাড়া গতি নেই, কারণ বাকিদের সারা দেশে, বিশেষ করে অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে, গ্রহণযোগ্যতা কম, যা বিপুল অভিজ্ঞতা ও প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার উপরাষ্ট্রপতি থাকার ফলে বাইডেনের একমাত্র আছে। এরপর কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত সাউথ ক্যারোলাইনায় ভালোভাবে জিতে বাইডেনের প্রার্থীপদ কিছুটা অক্সিজেন পায়। তখন নাটকীয়ভাবে একের পর এক মধ্যপন্থী প্রার্থীরা বাইডেনের সমর্থনে সরে দাঁড়ান ও তার ফলে স্যান্ডার্সবিরোধী মধ্যপন্থী ভোট একজোট হলে বাইডেন কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ প্রাইমারি জেতেন ও স্যান্ডার্স সরে দাঁড়ান। যদিও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিরা দলের প্রাইমারিতে সাধারণতঃ কোনও পক্ষ নেন না, তবে এক্ষেত্রে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ওবামার মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার গোপন উদ্যোগ ছাড়া এরকম ঘটা সম্ভব ছিল না।  বস্তুতঃ প্রথম দুটি প্রাইমারি হারার পর দলের প্রার্থীপদ পাবার আর কোনও নজির নেই। এই নির্বাচনে  ডনাল্ড ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরানোই ভোটারদের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কর্মসূচীর ব্যাপারে স্যান্ডার্সের দিকে সমর্থন থাকা সত্ত্বেও অনেকেই মনে করেছেন বাইডেনেরই ট্রাম্পকে হারানোর সম্ভাবনা সব থেকে বেশি, যেটা বাইডেনকে জিততে সাহায্য করেছে। অবশ্য হেরে গেলেও স্যান্ডার্সের নীতিগুলির বেশিরভাগই এখন ডেমোক্র্যাটিক দলে মূলধারায় গৃহীত হয়ে গেছে। বাইডেন তেমন ক্যারিস্মাটিক বা বাগ্মী নন, মাঝে মাঝেই উল্টোপাল্টা কথা বলে বা অদ্ভুত কোনও প্রতিক্রিয়া করে সংবাদে এসেছেন, বয়সের কারণে তাঁর স্মৃতিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর কিছু কিছু বিতর্কিত আইন বা বিষয়ে সমর্থন করে ভোট দেওয়া নিয়ে দলের, বিশেষকরে বামপন্থী অংশের, তাঁকে নিয়ে খানিকটা হতাশা আছে। ইরাকযুদ্ধ সমর্থন করে তাঁর ভোট দেওয়া, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে কাটছাঁট করতে রাজি হওয়া বা রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কিছু বর্ণবাদীদের সঙ্গে একযোগে স্কুলে বর্ণভেদ চালু রাখতে সাহায্য করার অনুযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে তাঁর সমর্থনে বলা যায় যে দীর্ঘ সময়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এবং বাইডেনেরও অবস্থান ধীরে ধীরে অনেক বেশি উদারপন্থী হয়েছে, পঞ্চাশ বছর আগের বাইডেনের সঙ্গে আজকের বাইডেনের তফাৎ আছে, জর্জ ডব্লিউ বুশের সরকারের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকযুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন হালে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জন কেরী, হিলারি ক্লিন্টন সহ বেশিররভাগ ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধিই (ওবামা বা স্যান্ডার্স উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম)। আর অন্ততঃ ভন্ডামি করেন নি, নিজের ছেলেকেও ইরাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন। আর বাইডেনের যে কোনও ব্যাপারে কোনও দৃঢ় অবস্থান না থাকায় বামপন্থী প্রগতিশীল থেকে মধ্যপন্থী রিপাবলিকান পর্যন্ত এক বিরাট অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দ হিসেবে, বা মন্দের ভালো হিসেবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুদলের বহু রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁর আছে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক।

উল্টোদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প একটি বর্ণময় চরিত্র, শুধু যাকে নিয়েই বেশ কয়েকটি বই লিখে ফেলা যায়। তাঁর বর্তমান বয়স ৭৪, জন্ম নিউ ইয়র্ক শহরে এক ধনী পরিবারে। তাঁর বাবা ব্রুকলিনে অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি বানাতেন। ডনাল্ড বাবার ব্যবসায় আসেন ও ম্যানহাটনে অভিজাত এলাকায় একটি পুরোনো হোটেলকে নতুন করে বানিয়ে হোটেল ব্যবসায় ট্রাম্প ব্র্যান্ড চালু করেন। কিন্তু তাঁর ব্যবসার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এই হোটেলের জন্য নিউ ইয়র্ক শহরের কাছ থেকে চল্লিশ বছর ধরে ১৬ কোটি ডলারের কর ছাড় পেয়েছিলেন, যা অনেকে অন্যায় সুবিধা বলে মনে করেন। বার বার ব্যবসা দেউলিয়া ঘোষণা করে পাওনাদারদের ফাঁকি দেওয়া, কন্ট্র্যাক্টরদের দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা না দেওয়া, ট্রাম্প ইউনিভার্সিটি নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ছাত্রদের প্রতারণা করা, ঠিকমত কর না দেওয়া বা অন্যায়ভাবে কর ছাড়ের সুবিধা নেওয়া, সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান খুলে সাধারণের দানের টাকার অপব্যবহার, নিজের সম্পদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেখিয়ে নাম কেনা, কলেজের ফলাফল চেপে রেখে নিজেকে সেরা ছাত্র দাবী করা, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেওয়া থেকে রক্ষা পেতে হাড়ের রোগ আছে বলে মিথ্যে ডাক্তারি শংসাপত্র জমা দেওয়া, বহু বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া, যৌন হেনস্থা করা, প্রতিপক্ষকে বিশ্রীভাবে রুচিহীন আক্রমণ করা ইত্যাদি নানা অভিযোগ তাঁর সম্বন্ধে। কখনও মামলার ভয় দেখিয়ে, কখনও টাকা দিয়ে আদালতের বাইরে সমঝোতা করে, কখনও বিতন্ডা করে, কখনও নীরব থেকে তিনি এইসব অভিযোগকে পাশ কাটিয়েছেন। তবে সবসময়ই প্রচারের আলোতে থেকেছেন, রিয়েলিটি টিভি স্টার হিসেবে নাম করেছেন। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল অনেকদিনই। তবে রিপাবলিকান পার্টিতে তাঁর আসা একেবারে হাল আমলে, অনেকদিন ডেমোক্র্যাট হিসেবে ও পরে নিরপেক্ষ হিসেবে ভোটার নথিকরণ করিয়েছিলেন, দুই দলকেই নির্বাচনী চাঁদা দিয়েছেন। এক সময় ভেবেছিলেন তৃতীয় কোনও পার্টির হয়ে রাষ্ট্রপতিপদের প্রার্থী হবেন, তবে ২০০০ সালে রিফর্ম পার্টির টিকিটে দাঁড়িয়ে রিপাবলিকান রাজনীতিক প্যাট বুখানানের শোচনীয় পরাজয় দেখে ওই রাস্তায় আর হাঁটেন নি। শোনা যায়, এক সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, আমি যদি কখনও রাষ্ট্রপতিপদের প্রার্থী হই, তবে রিপাবলিকান হয়ে দাঁড়াবো, কারণ ওদের ভোটারদের বোকা বানানো সবচেয়ে সহজ। এ হেন বিতর্কিত ও রাজনীতিতে অভিজ্ঞতাহীন ডনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানকে বুঝতে হলে আরও কয়েকবছর পিছনে ফিরে যেতে হবে।

২০০৮ সালে বারাক ওবামার রাজনৈতিক উত্থান হলে ট্রাম্প রাজনৈতিক শিরোনামে আসেন ওবামার জন্মের শংসাপত্র ও আমেরিকান নাগরিত্বের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে। জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক না হলে রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। অশ্বেতাঙ্গ ওবামাকে অযোগ্য প্রমাণ করার আগ্রহ বর্ণবাদী বহু রিপাবলিকানদের ছিল, ট্রাম্প তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে যান। জর্জ ডব্লিউ বুশের সরকারের যুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশে দেশে তাজবদলের নীতি এবং নিজের দেশে লাগামছাড়াভাবে কর হ্রাস, ঘাটতিবৃদ্ধি ও রক্ষাকবচ আইনগুলির গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটানোর কুফল হিসেবে ২০০৮ সালে আমেরিকা ও সারা বিশ্ব বিরাট মন্দায় পড়ে। বহু মানুষ রুটি-রুজি ও বাসস্থান হারান। পরিস্থিতির প্রতিকার করার আশা জাগিয়ে বারাক ওবামা বিপুল ভোটে জেতেন। কিন্তু ওবামার নির্বাচনের প্রতিক্রিয়াও হয়, বিশেষকরে অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে। এদের অনেকে একধরণের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে স্বচ্ছন্দ, কৃষ্ণাঙ্গ বা লাতিনোদের তুলনায় অনেক বেশি সামাজিক সুবিধা পেয়েও নিজেদের ‘যোগ্যতা সত্ত্বেও বঞ্চিত’ ভাবে, মনে করে তারাই একমাত্র কর্মঠ, অন্যরা তাদের করের টাকায় সামাজিক সুরক্ষার সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। এমনিতেই এদের মতে ডেমোক্র্যাটরা বেশি করের প্রবক্তা, যদিও যে উচ্চপর্যায়ের আয়ে ডেমোক্র্যাটরা বেশি কর চাপাতে চায়, সেই ধরণের আয় এদের প্রায় সকলেরই আয়ত্তের বাইরে। ওবামার কিছু নীতিও ভোটারদের অখুশি করে। ২০১০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের মধ্যে ‘টি পার্টি’ নামে আদ্যোপান্ত দক্ষিণপন্থী, শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী, যুক্তি ও বিজ্ঞান-বিরোধী, ধর্মীয় মদতপুষ্ট এক শ্রেণীর রাজনৈতিক উত্থান হয়। এমনিতে আমেরিকায় বহু লোকের ভোট দেবার তাগিদ থাকে না তেমন, ভোট পড়ার হার খুব বেশি হয় না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতে এক শ্রেণীর মানুষের দলে দলে ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট দেবার ফলে রিপাবলিকানরা হাউসে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পায় ও অনেক রাজ্যের ক্ষমতা হাতে পায়। অবশ্য মানুষের ক্ষোভের কিছু যুক্তিযুক্ত কারণও ছিল, যেমন মুক্তবাণিজ্যনীতির ফলে উৎপাদন শিল্পে কর্মসংকোচন। ২০১৪ তে ওবামা ব্যক্তিগত দক্ষতায় (তাঁর সময়ে মন্দার পর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়) পুনর্নির্বাচিত হলেও আইনসভায় ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতা কমই থাকে --- ওবামার শেষ দু বছরে সেনেটেও ক্ষমতা হারিয়ে ওবামা অনেকটাই হাত-পা বাঁধা হয়ে যান। এইরকম একটা পরিস্থিতে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর একের পর এক দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল কথা বলে, আমেরিকায় কাজের অভাবের জন্য অভিবাসীদের, বিশেষ করে মেক্সিকো ও লাতিন আমেরিকার দেশ থেকে আগতদের দায়ী করে তাঁর বক্তব্যগুলো অনেকের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পায়। মেক্সিকানরা অপরাধী, ধর্ষক, খুনী --- দলে দলে বেআইনি অনুপ্রবেশ করে কম পারিশ্রমিকে কাজ করে তারা বৈধ আমেরিকান নাগরিকদের রুটি-রুজি কেড়ে নিচ্ছে, একজন ঢুকলে আরও পাঁচজনকে দেশ থেকে নিয়ে আসছে, তারা অলস, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোর সুবিধা বেআইনিভাবে নিচ্ছে --- এইসব নানা উত্তেজক কথাবার্তা অনেককে প্রভাবিত করে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের মা এবং দুই স্ত্রী অভিবাসী হিসেবেই আমেরিকায় আসেন এবং নিজেদের পরিবারের লোককেও নিয়ে আসেন। দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেক ফারাক থাকায় স্বাভাবিকভাবেই মেক্সিকো থেকে বেশ কিছু আইনি ও বেআইনি অনুপ্রবেশ আছে, প্রচারের গুণে তা প্রধান সমস্যার তকমা পেয়ে যায়, বিশেষকরে অল্পশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে। অটোমেশন, উৎপাদনশিল্প একচেটিয়া চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া ও উত্তর আমেরিকার মুক্তবাণিজ্যচুক্তির জন্য এই শ্রেণীর বহু লোক কাজ হারিয়েছিলেন, তারা নিজেদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত মনে করেন। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ স্লোগান তোলা ট্রাম্প তাদের অনেকের কাছে পরিত্রাতা হয়ে ওঠেন। ট্রাম্প বলেন ক্ষমতায় এলে তিনি মেক্সিকো-সীমান্ত বরাবর একটা উঁচু পাঁচিল তুলবেন যাতে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকতে না পারে এবং তার খরচও মেক্সিকোর কাছ থেকে আদায় করবেন। দুই হাজার মাইলব্যপী সীমান্তজুড়ে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থাকায় আর লাগোয়া জমি ব্যক্তিগত মালিকানার অন্তর্গত হওয়ায় এরকম দেওয়াল তোলা খুব দুরুহ কাজ আর এর কার্যকারিতাও প্রশ্নাতীত নয়, তবে বিশেষ করে মেক্সিকোর খরচ বহন করা সম্পূর্ণ অলীক ব্যাপার। তবে তাও অনেকে বিশ্বাস করে, জনপ্রতিনিধিত্বের কোনরকম অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের মধ্যে তিনি অচিরেই সবথেকে আলোচিত নাম হয়ে যান। কেন্টাকি, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইত্যাদি পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিতে অলাভজনক হওয়ায় ও পরিবেশবিধির কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক কয়লাখনির শ্রমিকদের তিনি প্রতিশ্রুতি দেন পরিবেশবিধি শিথিল করে তিনি সেইসব হারানো কাজ ফিরিয়ে আনবেন। ‘ড্রেন দ্য সোয়াম্প’ --- ওয়াশিংটনে রাজনীতির ঘুঘুর বাসা তিনি ভাঙবেন।  এরপর রিপাবলিকান প্রাইমারির সময় একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কুরুচিকর বিদ্রুপ করেন, বিশেষকরে টেড ক্রুজের সঙ্গে তাঁর বাকবিতন্ডা নোংরামির স্তরও পেরিয়ে যায়, তবু তাঁর জনপ্রিয়তা অটুট থাকে। তাঁর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠেছে, তার সামান্য অংশও যদি একজন গড়-পড়তা রাজনীতিকের বিরুদ্ধে উঠত, তাহলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু যেমন একটি কাঁটা ফোটা ক্ষতিকর, অথচ কাঁটার বিছানায় কেউ কেউ শুয়ে থাকতে পারে, সেরকম অসংখ্য অভিযোগ ট্রাম্পকে তুলে ধরে রাখে ও নিখরচায় খবরের শিরোনামে তিনি থাকেন। একসময় ট্রাম্প এমন মন্তব্যও করেন যে তিনি যদি নিউ ইয়র্কের প্রকাশ্য রাস্তায় কাউকে গুলি করেও মারেন, তাহলেও তাঁর কোনও ভোট কমবে না। অনেক পরিচিত রাজনৈতিক মুখকে প্রাইমারিতে হারিয়ে রাজনীতিতে অর্বাচীন ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী মনোনীত হন। অত্যন্ত সুচতুরভাবে দলের গোঁড়া খৃষ্টান অংশকে খুশি করতে ইন্ডিয়ানার গভর্নর মাইক পেন্সকে তার রানিং মেট বাছেন। দলের ধর্মীয় অনুশাসনবাদী অংশ, বিশেষ করে ইভাঞ্জেলিকাল ক্রিশ্চানরা, ট্রাম্পের সমর্থনে বিশেষ করে এগিয়ে আসেন। আশ্চর্যের বিষয়, এরা যেখানে পারিবারিক মূল্যবোধের প্রবক্তা, তার পুরোপুরি বিপরীতে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে তিনটি বিয়ে ছাড়াও প্রচুর অনৈতিক সম্পর্কের ঘটনা রয়েছে, আর ট্রাম্পের চার্চে যাবারও কোনও অভ্যাস নেই। আসলে ট্রাম্পের মতো ক্যারিসম্যাটিক অথচ সম্পূর্ণ নীতিহীন লোক ‘গর্ভপাত পুরোপুরি বেআইনি করা’ ধরণের ধর্মীয় কর্মসূচী পূরণ করতে কাজে আসবে, তাঁরা বুঝতে পারেন।

২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটদের প্রাইমারিতে প্রার্থী ছিলেন হিলারি ক্লিন্টন ও বার্নি স্যান্ডার্স। প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি, সেনেটর ও সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসাবে কাজ করে হিলারি সবার কাছে খুব পরিচিত মুখ ও দলের প্রতিষ্ঠানের মুখ। তিনি ২০০৮ সালেও লড়াইতে ছিলেন কিন্তু ওবামার কাছে প্রাইমারি হেরে যান। উল্টোদিকে বার্নি স্যান্ডার্স বহু বছর ভার্মন্ট থেকে সেনেটার নির্বাচিত হলেও তিনি দলের মূল স্রোতের বাইরের বামপন্থী প্রগতিশীল অংশের মুখ, এমনকি পুরোপুরি দলের সদস্যও নন, স্বাধীন, কর্পোরেট আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমেরিকার রাজনীতিতে তিনি খুবই ব্যতিক্রমী, নিজেকে ডেমোক্র্যাটিক সোসালিস্ট বলেন। ধনী ও কর্পোরেশনদের যথাযথ পরিমানে কর দিতে বাধ্য করা, প্রাইভেট স্বাস্থ্যবিমা তুলে দিয়ে সবাইকে সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা মেডিকেয়ারের আওতায় নিয়ে আসা (যা বর্তমানে শুধু ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য), ঘন্টাপ্রতি মজুরি ন্যুনতম ১৫ ডলার করা, সরকারি কলেজে বিনামূল্যে পড়ার সুবিধা থাকা ও ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনো করার জন্য নেওয়া ঋণ মকুব করা ইত্যাদি দাবি তুলে বিশেষতঃ তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রচুর জনপ্রিয়তা পান। কর্পোরেট দান না নিয়ে তিনি সাধারণ সমর্থকদের দানে নির্বাচনী তহবিল গড়ে তোলেন। বস্তুতঃ তাঁর পাঁচদশকের রাজনীতিতে তিনি নীতির প্রশ্নে দৃঢ় থেকেছেন বরাবর বলে আর আপসহীন লড়াই করেছেন বলে সমর্থকদের বাইরেও বহু মানুষের তিনি শ্রদ্ধার পাত্র, আবার ভিয়েতনাম সহ আমেরিকার যুদ্ধকেন্দ্রিক বিদেশনীতির কঠোর সমালোচক বলে এবং ফিদেল কাস্ত্রো সরকারের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রশংসা করায় রিপাবলিকান তো বটেই, ডেমোক্র্যাটদেরও একাংশের কাছে কম্যুনিস্ট বলে আখ্যাত হন। বাস্তবে অবশ্য তিনি সোস্যাল ডেমোক্র্যাট, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলির ধাঁচে ধনীদের উচ্চ হারে কর বসিয়ে  সবার জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিবেশের অধিকার চান। পক্ষান্তরে হিলারি ওবামার মধ্যপন্থী নীতি ভিত্তি করেই চলতে চান। ওবামা অবশ্যই ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, তিনিও সাধারণ সমর্থকদের থেকেই নির্বাচনী তহবিল জোগাড় করে প্রচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু ওবামা আদপে মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট, যদিও রিপানলিকানরা তাঁকেও সোসালিস্ট কম্যুনিস্ট ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছিল। ওবামার প্রধান প্রকল্প ছিল সবার জন্য ন্যায্যমূল্যে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। আমেরিকায় চিকিৎসা ভীষণ ব্যয়বহুল, কিন্তু জটিল নিয়মকানুনের জন্য বহু মানুষের সুলভ বিমার সুযোগ নেই, বিশেষ করে যাদের স্বাস্থ্যসমস্যা রয়েছে। কিন্তু ওবামা কর্পোরেটদের সাথে আপসে এসে তাদের থেকে  তহবিল সংগ্রহ করেন, জিতে ট্রেজারি সেক্রেটারি করেন ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাঙ্কার টিম গাইথনারকে, মাঝে মাঝে মৃদু ভর্ৎসনা করলেও তাঁর সময়ে ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাপক মুনাফা করতে কোনও অসুবিধা হয় নি। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা অনেক কমলেও গরিবদের রোজগার তেমন বাড়ে না, ধনী-দরিদ্রের তফাৎ আরও বেড়েই যায়। ওবামা সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করেন যা ওবামাকেয়ার নামে প্রখ্যাত হয়, তবে জটিল নিয়ম ও সবাইকে বিমা কিনতে বাধ্য করা অনেকের পছন্দ হয় না, আদালতেও গড়ায় বিবাদ। প্রথম দু বছর আইনসভায় ডেমোক্র্যাটদের গরিষ্ঠতা থাকলেও নানা কারণে কর ব্যবস্থার সংস্কার করতে পারেন নি।   পূর্বসূরি বুশের যুদ্ধনীতি ব্যপকহারে না চালালেও তাঁর আমলে, বিশেষ করে লিবিয়ায়, একই তাজবদলের উদ্যোগে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে, যা ওবামার তড়িঘড়ি নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়াকে হাস্যকর করে তোলে। এ ব্যাপারে বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন ও ওয়াশিংটনের যুদ্ধোদ্যোগী লবির চাপ ওবামার উপর ছিল মনে করা হয়।  ঝটিতি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে আমেরিকান কূটনীতিক সহ কয়েকজনের প্রাণহানি হলে হিলারি বিশেষ করে দায়ী হন। এ ছাড়াও বিদেশ সচিব থাকা কালে গোপনীয় সরকারি কাজে ব্যক্তিগত ইমেল ব্যবহার করার অভিযোগ হিলারিকে বিব্রত করে। তবে স্যান্ডার্স সাড়া জাগালেও প্রাইমারিতে দলের মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন, দলের তরফে হিলারিকে অন্যায় সুবিধা দেবারও অভিযোগ ওঠে।

সাধারণ নির্বাচনে হিলারি ও ট্রাম্প যখন মুখোমুখি হন, তখন হিলারি জিতে রাষ্ট্রপতি হবার জন্য এগিয়ে ছিলেন। ইলেক্টোরাল কলেজে নিশ্চিন্ত ভোটের রাজ্যগুলির ভিত্তিতে ডেমোক্র্যাটদের কিছুটা সুবিধা থাকে, দোদুল্যমান রাজ্যগুলির থেকে আর কয়েকটি জেতার দরকার হয়, তার জন্য বেশ কয়েকরকম উপায় থাকে। তুলনায় রিপাবলিকানদের মোট নিশ্চিত ভোট কম, কিছু কিছু বিশেষ দোদুল্যমান রাজ্য তাদের না জিতলে চলবে না। কিন্তু অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও হিলারি ছিলেন ওয়াশিংটনের ক্ষমতাসীন লবির প্রতিনিধি, সমাজসেবা করলেও তাঁর ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনের বেনিয়ম করা ও ওয়াল স্ট্রিটের উপদেষ্টা হিসেবে টাকা করা ইত্যাদি কারণে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন না।  উল্টোদিকে তার বিতর্কিত অবস্থানের জন্য ও নানা কেলেঙ্কারির কারণে ট্রাম্পও যথেষ্ট নিন্দিত। যুদ্ধে শহীদের পরিবারের সঙ্গে পর্যন্ত বিতন্ডায় জড়িয়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের প্রথা মেনে নিজের ট্যাক্স-রিটার্ন দেখাতে অস্বীকার করেছেন। তবে ট্রাম্প যখন বলেন ‘ব্যবস্থাটা ভেঙ্গে পড়েছে, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বহু রাজনীতিকদের আমি টাকা দিই, আবার যখন দরকার পড়ে সুবিধা নিই’, তখন কথাগুলো বহু ভোটারের মনে ধরে, হিলারি অচলায়তনের প্রতীক কুটিল রাজনীতিক আর হাস্যকরভাবে ট্রাম্প প্রতিকারক হয়ে যান অনেকের কাছে। পূর্বাভাসে এগিয়ে থাকলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে হিলারির জয় ছিল সংশয়পূর্ণ। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতার অভাবে হিলারি কয়েকটি ভুল করেন। ভুল রানিং মেট বাছা, স্যান্ডার্সের সমর্থকদের ভোট জেতার যথেষ্ট চেষ্টা না করা, শ্বেতাঙ্গ-শ্রমজীবী অধ্যুষিত মিড ওয়েস্টের রাজ্যগুলি থেকে ভোট স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়ে সেখানে প্রচারে সময় এবং অর্থ বরাদ্দ না করা, কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো ভোটারদের ভোট দিতে উদ্দীপ্ত না করা, ইত্যাদি। ভোটের কিছুদিন আগে এফ বি আই এর তার ইমেলের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করা তাঁর বিরুদ্ধে যায়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাপা পড়ে সেটাই প্রধান আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে। মিশিগান, উইসকন্সিন ও পেনসিল্ভ্যানিয়ার মতো মিড ওয়েস্টের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য বহু বছর পর প্রথম রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প সামান্য ভোটের ব্যবধানে জেতেন। ওবামার শেষবারের জেতার রাজ্যগুলির মোট ছটা রাজ্য হাতছাড়া করে, সারা দেশে মোট ভোটে অনেকটা এগিয়ে থেকেও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে হিলারি হেরে যান। বেশ খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ৩০৪টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে যান। আর পার্টি-সমর্থকদের মধ্যে ট্রাম্পের  প্রভাব এতই বেড়ে যায় যে মধ্য-দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকান পার্টিকে হাইজ্যাক করে ট্রাম্প একধরণের যুক্তিহীন, বিজ্ঞান ও মেধাবিরোধী, বিদ্বেষবাদী, লুম্পেনদের পার্টি বানিয়ে ফেলেন। 

ট্রাম্পের রাষ্ট্র চালানো শুরু থেকেই বিতর্কিত। ব্যবসা চালানোর মতো রাষ্ট্র চালানো, অনর্গল মিথ্যা বলা,  হাস্যকরভাবে প্রত্যেক ব্যাপারে নিজের বড়াই করা ও আত্মমোহিত থাকা, নিজের মেয়ে-জামাইকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা, নীতিপ্রণয়নে নিজের পরিবারের ব্যবসার স্বার্থ দেখা, অভিবাসন নীতিতে পক্ষপাতমূলক আচরণ বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের বিপক্ষে, সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা ও পরিবারের শিশুদের বাবা-মাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, আমেরিকার অংশ পুয়ের্তো-রিকোর ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কেন্দ্রীয় সাহায্য না দেওয়া ও অন্যান্য রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় সাহায্য করার সময় দলবিচার করা, মিত্র রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে অকারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়া, বিশেষ করে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে অভদ্র ব্যবহার, পুতিনসহ একনায়ক রাষ্ট্রপ্রধানদের বিশেষ সমাদর করা, দেশের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সাংবাদিক সহ বহু লোকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অঙ্গভঙ্গি করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা, যা রাষ্ট্রপতির পদের সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। তিনি কাজে খুব কম সময় দেন, দিনে বহু দেরি করে কাজ শুরু করেন, ব্রিফিং শুনতে অনাগ্রহ দেখান, অধিকাংশ সময় টেলিভিশন দেখে ও ট্যুইট করে কাটান, বহু ঘন্টা গলফ খেলেছেন নিজের গলফকোর্সে ও তার জন্য তাঁকে নিরাপত্তা দিতে সরকারের টাকায় নিরাপত্তা রক্ষীদের থাকার জন্য চড়া হারে দাম নিয়েছেন। তবে যে অভিযোগ সবথেকে আলোড়ন তুলেছিল, তা হল নির্বাচনে জিততে তিনি রাশিয়ার সাহায্য নিয়েছেন --- পুতিনের নির্দেশে রাশিয়ান হ্যাকাররা ডেমোক্র্যাটদের গোপন তথ্য হাতায় ও সোস্যাল মিডিয়ায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারির সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। আর এক প্রাক্তন পর্ন-তারকার সঙ্গে যৌন-সংসর্গের খবর চাপতে সেই তারকার মুখ বন্ধ করার জন্য অবৈধভাবে নির্বাচনী তহবিল থেকে টাকা দেন। এইসব অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তও হয়, তাঁর সহযোগীদের অনেকে দোষী স্যব্যস্তও হন, তবে বর্তমানে রাষ্ট্রপতিপদে অধিষ্ঠিত কারুকে অভিযুক্ত করতে হলে যতটা প্রমাণ দিতে হয়, কমিশন মনে করে ততটা প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ট্রাম্প অবশ্য একে তাঁর নির্দোষ প্রমাণ বলে দাবী করেন, যদিও কমিশন তাঁকে নির্দোষ শংসাপত্রও দেয় নি। একের পর এক নিজের বাছাই করা লোকেদের সঙ্গেই তাঁর কাজ নিয়ে বিরোধ বেঁধেছে, তাঁদের অনেকেই তাঁকে নির্বোধ, অজ্ঞ, শিশুসুলভ, কাজে অমনোযোগী, আইন-ভঙ্গকারী, দুর্নীতিপরায়ণ --- এইসব বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন সম্প্রতি একটি গোটা বই লিখে তিনি বিদেশনীতি সম্পর্কে কেমন অজ্ঞ, অন্যদেশের একনায়কেরা তাঁকে কেমন ব্যবহার করেছেন আর তিনি আমেরিকার নিরাপত্তার পক্ষে কতটা বিপজ্জনক, সেসব জানিয়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের ভাইঝি মেরি ট্রাম্প তাঁর সাম্প্রতিক বইতে তিনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে কেমন প্রতারণা করেছেন নানাভাবে, যেমন ঠকিয়ে সম্পত্তি আত্মসাৎ করা, ভাড়াটে লোক দিয়ে কলেজের প্রবেশ পরীক্ষা নিজের নামে দেওয়ানো --- সেসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানকে ফোন করে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের একটি ইউক্রেনীয় কোম্পানিতে উপদেষ্টাপদে নিয়োগের তদন্ত করার অনুরোধ করেন ও ইউক্রেনকে সাহায্য করার শর্ত হিসেবে এই তদন্ত করার জন্য চাপ দেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। আমেরিকার ইতিহাসে তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি এই বছরের গোড়ার দিকে হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ভর্ৎসৃতও হন, তবে সেনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ  রিপাবলিকানরা তাঁর অপসারনে মত না দেওয়ায় তিনি পদে বহাল থাকেন।

ট্রাম্পের মেয়াদে হওয়া সবথেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল দেশের আয়কর ব্যবস্থার পরিমার্জন করে করের হার অনেকটা কমানো, যা বহুদিন ধরে রিপাবলিকানদের প্রধান লক্ষ্য। এতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকজনের কর সামান্য কমলেও কর্পোরেশন আর উচ্চ আয়ের লোকেরা ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। বস্তুতঃ আমেরিকায় কর্পোরেট করের মাত্রা অন্য অনেক উন্নত দেশের থেকে চড়া হলেও প্রচুর ফাঁক থাকার ফলে কোম্পানিরা কার্যক্ষেত্রে কমই কর দিয়ে থাকে। করের হার কমানোর সঙ্গে যে ফাঁকগুলো বুজানোর কথা ছিল তা করা হয় না। প্রথম দু বছরে হাউস, সেনেট এবং রাষ্ট্রপতিপদ সবই হাতে থাকায় এ ব্যাপারে তেমন কোনও বাধাও আসে নি। কিন্তু এর ফলে কোষাগারে অর্থের যোগান কমে যায় আর রাষ্ট্রের ঘাটতি আর ধারের পরিমাণ বহু বেড়ে যায়। তবে মূলতঃ ধনীশ্রেণীর স্বার্থে কাজ করলেও প্রজারঞ্জক নীতির জন্য তাঁর অনেক সমর্থক রয়েছে। চীন ছাড়াও বহু বন্ধুদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক বিরোধ বাধিয়ে আমদানি কর চাপানোয় অনেকেই খুশি হয়, তবে বাস্তবে লাভক্ষতির হিসেবটা অনেক জটিল। চীনের বেশ খানিকটা ক্ষতি হলেও চীন আমেরিকান কৃষিপণ্যের উপর পালটা আমদানিকর বসালে ট্রাম্প-সমর্থক কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোতে কৃষকরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারান। ফলে যে ক্ষতি, কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে তাদের অনুদান দিয়ে সামাল দেওয়া হয়। অনেক শিল্পে যে কাঁচামাল লাগে চীন থেকে আমদানি করতে, তার খরচও বেড়ে যায়। ওবামার স্বাস্থ্যবিমা আইন ‘ওবামাকেয়ার’ তিনি রদ করবেন ও অনেক ভালো বিমার ব্যবস্থা করবেন প্রতিশ্রুতি দিলেও ওবামাকেয়ার রদ করতে ব্যর্থ হন ও বিকল্প কোনও নীতিও প্রণয়ন করতে পারেন নি। মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল করার জন্য মেক্সিকো দূরে থাক, আমেরিকার কোষাগারের টাকাও জোগাড় করে উঠতে পারেন নি। সামাজিক কল্যাণখাতে নানা বরাদ্দ ছাঁটার ফলে গরীব মানুষের ক্ষতি হয়, বহু মানুষ নতুনকরে স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ হারান। বিশেষকরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় পরিবেশ আইন অনেক শিথিল করায়। এমনকি দায়িত্বহীনের মতো প্যারিস পরিবেশচুক্তি থেকে আমেরিকা নাম প্রত্যাহার করে নিলে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়। এর পর সামরিক বোঝাপড়া নিয়েও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে আর্থিক দায়িত্বের প্রশ্নে নানা বিরোধ হয়। ইরানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি থেকেও আমেরিকার একতরফা ভাবে পিছিয়ে আসে। ফলে সব মিলে আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্বের দায়বদ্ধতা নিয়ে সংশয় হয়। তবে এক হিসেবে দেখতে গেলে এগুলো তাঁর নির্বাচনের আগে বলা বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়, কাজেই সেই হিসেবে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। তাঁর সমর্থনে একটা কথা অবশ্য বলা যায় যে, ইরান বা ভেনেজুয়েলার সাথে টানাপোড়েনের সম্পর্ক ঘটলেও তাঁর আমলে নতুন করে কোনও যুদ্ধ বাঁধেনি। আর তাঁর সমর্থন ধরে রাখতে সবথেকে সাহায্য করেছে দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থা। বৃদ্ধির হার ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তাঁর প্রথম তিন বছরে ছিল গড়পড়তা ২.৫%, যা ওবামার মেয়াদের সময় থেকে সামান্য বেশি, তবে রেগন বা ক্লিন্টনের সময়ের থেকে বেশ খানিকটা কম। শেয়ার বাজারের বৃদ্ধি নিয়ে ট্রাম্প প্রায়ই অহঙ্কার করেন, যা তার প্রথম তিন বছরে বেড়েছিল মোট ৫২%, সেটাও ওবামার মেয়াদের তুলনায় বেশ খানিকটা কম।  আর শেয়ারের দাম চড়ার একটা বড় কারণ ছিল কোম্পানিগুলির ‘শেয়ার বাই ব্যাক’ করা, যা কি না কর ছাড়ের ফলে চাকরির সুযোগ বেশি সৃষ্টি হবে এই আশা মেটায় নি। নতুন চাকরির সৃষ্টি ওবামার শেষ তিন বছরের ৭৯ লক্ষের তুলনায় ট্রাম্পের ৬৭ লক্ষ কিছুটা কম, তবে মোটের উপর ভালই, ২০২০ এর  ফেব্রুয়ারির শেষে কর্মহীনতার হার ৪% এর নিচে নেমে আসে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ওবামা এক ভয়াবহ মন্দার সময় দায়িত্ব হাতে পেয়েছিলেন, যখন কর্মহীনতার হার ১০% ছুঁইছুঁই, সেখান থেকে তা ৫% এর নিচে নেমে এসেছিল। ওবামার সময়ে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতির সুবিধা ট্রাম্প পেয়েছেন, আর ট্রাম্পকে প্রথম তিন বছরে বড় কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নি --- যেটুকু যা, তাঁরই করা চীন ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যবিরোধ। তবে কারণ যাই হোক, লোকে ফলাফলই দেখে। শক্তিশালী অর্থনীতি ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিকে প্রায় নিশ্চিতভাবে জিতিয়ে দেয়। ট্রাম্প অর্থনীতিকে মূল প্রশ্ন রেখে নির্বাচনের মুখোমুখি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে স্বাভাবিকভাবে যা হয়, সেসব হিসেব ট্রাম্পের জন্য চলে না। কোনোমতে ভোটে জেতার পর ট্রাম্প শুধুমাত্র তাঁর সমর্থকদের খুশি করার চেষ্টাই করে গেছেন, ফলে নিজের গোঁড়া সমর্থকদের ধরে রাখলেও নতুন করে সমর্থক বাড়াতে পারেন নি, বরং অনেকের মোহমুক্তি ঘটেছে। আমেরিকায় শুধু ভোটের পূর্বাভাসই নয়, সারাক্ষণই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে নানা পেশাদার সংস্থা সমীক্ষা করে থাকে, তার একটা হল রাষ্ট্রপতির কাজ ভোটাররা কেমন অনুমোদন করছে। ট্রাম্প প্রথম থেকে কখনই ৫০% এ পৌঁছাতে পারেন নি, যা নজিরবিহীন। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পরে দেশের নানা জায়গায়  আইনসভা, গভর্নর ও অন্যান্য পদের নির্বাচনে ভোটাররা ব্যাপকহারে রিপাবলিকান প্রার্থীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্ন আলাদা --- ওবামার সময়ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা অনেক নির্বাচনেই হারেন, কিন্তু ওবামা জিতে ফেরেন।  ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন সম্ভাব্য বিভিন্ন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর কাল্পনিক মুখোমুখি লড়াইয়ে ভোটারদের পছন্দ জানা হয়, দেখা গেল ট্রাম্প তাঁদের বেশিরভাগের থেকেই সারা দেশে, প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর নির্ভর করে, ১-৫% শতাংশ পিছিয়ে। অবশ্য তার মানেই ইলেক্টরাল কলেজে হার নয়। আর সমীক্ষায় কিছুটা ভ্রান্তি থাকে, ফলে ৫% আসলে ৩% এ দাঁড়াতে পারে। আর যেটা হয়, অতদিন আগের মতামত বদলে যেতে পারে। বিশেষ করে ভোটের কাছাকাছি এসে যারা মনস্থির করেন, তারা সাধারনতঃ স্থিতাবস্থার পক্ষে ভোট দেন। প্রায় ৩% কম ভোট পেয়েও যে নির্বাচন জেতা যায়, তা তো ২০১৬ তেই দেখা গেছে, অংকের হিসেবে আরও অনেক কম পেলেও হয়। তবে করোনা ভাইরাস আসার আগেও মোট ভোট যে ট্রাম্প কম পাবেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীর তুলনায়, তা প্রায় নিশ্চিত ছিল --- কিন্তু ইলেক্টোরাল কলেজে তাঁর ভালই জেতার সম্ভাবনা ছিল।   

কিন্তু করোনা ভাইরাসের ফলে পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থনীতি হঠাৎ করে ভেঙ্গে পড়ে, বহু মানুষ কাজ হারান, পরিস্থিতি তিরিশের দশকের মহামন্দার মতো দাঁড়ায়। শেষ তিনমাসে গত বছরের তুলনায় জি ডি পি এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাম্প এই প্রথম কোনও বড় সমস্যার মুখোমুখি হলেন। এরকম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আমেরিকানরা সাধারনতঃ রাষ্ট্রপতির পাশে দাঁড়ান, ফলে ট্রাম্পের সুযোগ ছিল এই লড়াইয়ে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে ভোটারদের তার দিকে টেনে আনা। কিন্তু সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে, বিশেষজ্ঞদের মত না শুনে, কোভিডকে সাধারন ফ্লুর মতো প্রতিভাত করার চেষ্টা করে, যথাযথ চিকিৎসার সামগ্রী যোগান না দিয়ে, সিদ্ধান্ত নিতে অকারণে দেরি করে, পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে বৃদ্ধি কমলে তাঁর রাজনৈতিক অসুবিধা হবে। শেষমেশ বন্ধ করতেই হয়, বেকারত্ব হুহু করে বেড়ে যায়, শেয়ার বাজারেও ধ্বস নামে। আমেরিকা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে লজ্জাজনক প্রথমস্থান অধিকার করে। এত শক্তিশালী ধনী দেশের এত দুরবস্থায় পড়ার একটা প্রধান কারণ হল দু বছর আগে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে সংস্থা গঠন করা হয়েছিল জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়, ওবামার সময় যারা ইবোলা বা এইচ ওয়ান এন ওয়ান ভাইরাসদের প্রকোপ রুখে দিয়েছিল খুব সফলভাবে, ট্রাম্প তাকে প্রয়োজনীয় অর্থ না জুগিয়ে উঠিয়ে দেন। ফলে ভাইরাসের উপর নজরদারি করার কোনও ব্যবস্থা আর আমেরিকার কাছে থাকে না। তার উপরে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ট্রাম্প গভর্নরদের সঙ্গে বিবাদ করা, দায়িত্বহীনের মতো বিজ্ঞান অস্বীকার করে শুধু  সমর্থকদের চাগানো, জোর-জবরদস্তি করে তড়িঘড়ি ব্যবসা খুলতে গিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলা, ইত্যাদি কাজ করেছেন। অতিমারির মধ্যে বিশেষজ্ঞদের বারণ সত্ত্বেও টালসা শহরে ট্রাম্প একটি রাজনৈতিক সভা করেন। বলা হয়েছিল দশ লক্ষ লোক এই সভাতে যোগ দিতে আগ্রহী, তাই স্টেডিয়ামের বাইরেও বক্তৃতার ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কুড়ি হাজারের স্টেডিয়ামে মেরেকেটে ছ হাজার লোক জড়ো হওয়াতে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়া পরিষ্কার হয়ে যায়। এখানে ট্রাম্পের বক্তৃতাও বিপর্যয়কর হয়, তিনি কবুলও করেন যে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর জন্য কোভিড পরীক্ষা কমানোর উমেদারি করেছেন। সরকার থেকে যে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়, তা কাজ হারানো মানুষের থেকেও বড় কোম্পানিদের কাছে বেশি পৌছায়, অথচ দেশের ঋণের পরিমান সাংঘাতিক বেড়ে যায়। তবে অর্থের যোগান বাড়ানোয় শেয়ার বাজার আগের ক্ষতি প্রায় পুরোটাই উশুল করে ফেলে। ব্যবসা-বাণিজ্য আবার খোলার ফলে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা কমলেও এখনও গত দশকের মন্দার তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। এ ছাড়া এর মধ্যে একটা ঘটনা বিশেষ আলোড়ন তোলে --- মিনিয়াপোলিস শহরে মামুলি অপরাধে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে এক পুলিস অফিসার হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে থাকার ফলে সে মারা যায়। পুলিশের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এরকম অন্যায়-অমানবিক ব্যবহারে বহু মানুষ গর্জে ওঠে। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা, প্রতিবাদে সামিল হয়। গুলি চালানোর হুমকি দেওয়া, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো, চার্চের সামনে বাইবেল হাতে ট্রাম্পের ছবি তোলার জন্য কাঁদানে গ্যাস ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে হঠিয়ে দেওয়া --- এগুলি ভোটারদের মনে বিশেষ রেখাপাত করে। এরকম পরিস্থিতিতে জনসমর্থন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে যায়, তবে ট্রাম্পের মতো বিভাজনকারী প্রথাবিরোধী রাজনীতিকের ক্ষেত্রে অনেক হিসেব মেলে না। তাই বর্তমান পরিস্থিতি আরও খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন।

আমেরিকায় বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ভীষণ প্রকট। ডেমোক্র্যাটদের শক্তি যেমন পশ্চিম উপকূলের বা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে, বা বড় শহরে বা অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বা নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাধারনতঃ অনেক বেশি, আবার উল্টোটা সত্যি গ্রামীণ শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে। স্থানীয় ধরনের নির্বাচনে কিছু কিছু অন্যধরনের ফল হলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর্যায়ে কিছু কিছু রাজ্য কিভাবে ভোট দেবে তা জানাই থাকে। যারা খুব নিশ্চিতভাবে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেয় তাদের ব্লু স্টেট বলে, আর রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে রেড স্টেট বলে। যেমন পশ্চিমের রাজ্যগুলি হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন, ওয়াশিংটন, মাঝে ইলিনয়, উত্তর পূর্বে নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ডেলাওয়্যার, মেরিল্যান্ড ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি এবং (নিউ হ্যাম্পসায়ার ও মেইনের দ্বিতীয় কংগ্রেসানাল ডিস্ট্রিক্ট বাদ দিয়ে) পুরো নিউ ইংল্যান্ড ডেমোক্র্যাটদের জন্য নিশ্চিত, অর্থাৎ আশা করা যায় জয়ের ব্যবধান ১৫% বা অধিক। এর থেকে মোট ১৮৫টি ইলেক্টোরাল ভোট তাদের বাঁধা। উল্টোদিকে দেশের মধ্যভাগে বা দক্ষিণের বেশিরভাগ রাজ্যগুলি রিপাবলিকানদের জন্য নিশ্চিত। তার থেকে ১০৬টি ভোট পাওয়া যায় সাধারনতঃ, তবে এবারের প্রাপ্ত সমীক্ষা অনুযায়ী এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮। সুতরাং নিশ্চিত রাজ্যের ভিত্তিতে ডেমোক্র্যাটরা বেশ কিছুটা এগিয়ে শুরু করেন, সে প্রার্থী যেই হোক না কেন। এর পরের ধাপে আসে সম্ভাব্য জয়ের রাজ্যগুলি, যেখানে ব্যবধান বহুদিন ধরেই অন্ততঃ ৫%। এগুলি পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নয়, অন্যরকম ফল হবার সম্ভাবনা এখানে বড় জোর ১০%। বাইডেন আরও ৯৩টি ভোট পেতে চলেছেন এখান থেকে, যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে। ফলে শুধু নিশ্চিত আর সম্ভাব্য রাজ্যগুলো মিলিয়েই বাইডেন ২৭৮ ভোট পেয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে এদের মধ্যে রাস্টবেল্টের মিশিগান-উইসকন্সিন-পেনসিল্ভ্যানিয়াতে এক শতাংশের কম ব্যবধানে হিলারি হেরেছিলেন, বাইডেনের সেগুলি ছিনিয়ে আনার প্রবল সম্ভাবনা। বাকিগুলি নেভাদা, কলোরাডো, নিউ মেক্সিকো, মিনেসোটা, ভার্জিনিয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ার হিলারি জিতেছিলেন, তবে এক্ষেত্রেও বাইডেন জয়ের ব্যবধান বাড়াতে পারেন। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এরকম সম্ভাব্য রাজ্যগুলি মিলে ৫৫টি ভোট আনবে, সুতরাং এখানেও ট্রাম্প পিছিয়ে পড়ছেন। আগের বার এই সমস্ত সম্ভাব্য রাজ্য ট্রাম্প ভালোভাবেই জিতেছিলেন। এর পরের ধাপের রাজ্যগুলি, যেখানে সমীক্ষা ও আগের ভোটের ধরন মিলিয়ে মনে করা হচ্ছে জয়ের ব্যবধান অন্ততঃ ১% হবে, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে বাইডেন এগিয়ে আছেন অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা ও নর্থ ক্যারোলিনা, সব মিলে যাতে আছে ৫৫টি ইলেক্টোরাল ভোট, ট্রাম্প এগুলি সবই জিতেছিলেন গতবার। তবে ব্যবধান অল্প ও সমীক্ষার ভ্রান্তির হিসেব মাথায় থাকলে এই ফলাফলগুলি বদলে যেতেই পারে। ফ্লোরিডায় যেমন জয়ের ব্যবধান সাধারনতঃ ১-২% এর মধ্যেই থাকে, নর্থ ক্যারোলাইনাতে রিপাবলিকানরাই বেশি সময় অল্প ব্যবধানে জয়ী হন, আর অ্যারিজোনাতে শেষ কুড়ি বছরে কোনও ডেমোক্র্যাট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতেন নি। তবে জনসংখ্যার পুনর্বিন্যাসের ফলে অনেক অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী দক্ষিণের এই রাজ্যগুলিতে বাস করা শুরু করছেন, ফলে তাতে ডেমোক্র্যাটদের সুবিধা হচ্ছে। ট্রাম্পের জন্য বড় দুঃসংবাদ এই যে গতবার ভালোভাবে জেতা রাজ্যগুলির মধ্যে ওহাইয়ো, আইওয়া, জর্জিয়া ও টেক্সাসে ট্রাম্প সমীক্ষায় মাত্র চুলচেরা ব্যবধানে এগিয়ে, বা কোনও কোনও সমীক্ষায় পিছিয়েও থাকছেন। ফলে এইসব রাজ্যগুলিতে শেষমেশ জিতলেও তাঁর জয় খুব সহজ হবে না। জেতার জন্য সময় এবং অর্থও ব্যয় করতে হবে। এদের মধ্যে ওহাইয়ো আর আইওয়াতে ওবামা দুবার জিতেছিলেন, কিন্তু জর্জিয়া আর টেক্সাস বরাবরের রেড স্টেট। ওহাইয়ো, জর্জিয়া, টেক্সাস, নর্থ ক্যারোলাইনা বা ফ্লোরিডার মতো বড় রাজ্য একটা হারালেই ট্রাম্প বা অন্য কোনও রিপাবলিকান প্রার্থীর জেতা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। বাইডেনের সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা রাস্তা খোলা আছে। এই সব কটা রাজ্য হারিয়ে শুধু রাস্টবেল্টের তিনটি রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেই তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে যাবেন, কারণ হিলারির জেতা কোনও রাজ্যেই এখনও ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় আসতে পারেন নি। অন্যভাবে বাইডেন ফ্লোরিডা জিতে আর যে কোনও একটা রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেই হবে। সুতরাং এই মুহুর্তে বাইডেন ব্যাপকভাবে এগিয়ে, বিভিন্ন হিসেব অনুযায়ী তাঁর দেশব্যপী সমর্থন ট্রাম্পের থেকে চার থেকে পনের শতাংশ বেশি, গড়ে সাত-আট শতাংশের মতো। সাত শতাংশ বিশাল ব্যবধান, এই ব্যবধানে ২০০৮ সালে ওবামা প্রায় ২০০ টি ইলেক্টোরাল ভোট বেশি জেতেন প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাকেনের বিরুদ্ধে। মূলতঃ লড়াই যেসব রাজ্যগুলোয়, যাদের ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়, তারও সিংহভাগে বাইডেন ভালোভাবে এগিয়ে। মনে করা হচ্ছে বাইডেনের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশ হতে পারে। তবে এই সম্ভাবনার হিসেব করা কঠিন কাজ, কারণ বিভিন্ন রাজ্যের ফলাফল পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, বিশেষতঃ একই অঞ্চলের রাজ্যগুলি অনেকটা একইভাবে ভোট দেয়। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার অভাব অন্যান্য পদের নির্বাচনেও রিপাবলিকানদের ক্ষতি করছে। হাউস প্রায় নিশ্চিতভাবেই ডেমোক্র্যাটদের হাতে থাকছে, যা ২০১৮ সালে তারা পুনরুদ্ধার করে। সেনেটের নির্বাচনে অতটা না হলেও ডেমোক্র্যাটরাই সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে, বিশেষকরে বাইডেন জিতলে ৫০-৫০ আসন থাকলেও ডেমোক্র্যাটরা সেনেট নিয়ন্ত্রণ করবে উপরাষ্ট্রপতির ভোটে।

একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে ২০১৬এর নির্বাচনে হিলারিও কিন্তু সমীক্ষাগুলোতে সাধারণতঃ এগিয়ে ছিলেন, তাই অনেকে মনে করেন যে সমীক্ষাগুলির ফলাফল নির্ভরযোগ্য নয়। ট্রাম্প সেই জিতে যাবেন, কারণ এরকম অনেক সমর্থক আছেন যারা লজ্জায় মুখে প্রকাশ করেন না, কিন্তু মনে মনে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। এমনকি ট্রাম্প নিজেও এরকম ‘সাইলেন্ট মেজোরিটি’ ভোটাররা তাঁকে জেতাবে আশা পোষণ করেন। বাস্তবে ২০১৬ ও ২০২০ এর পরিস্থিতির অনেক তফাৎ আছে। প্রথম কথা, ২০১৬ সালে সমীক্ষার হিসেব খুব ভুল ছিল না, একমাত্র উইসকন্সিন বাদে বাকি হারগুলো সমীক্ষার ভ্রান্তির পরিমাপের মধ্যেই ছিল। সারা দেশ মিলে হিলারির ৩% এগিয়ে থাকাও প্রায় মিলে গেছে, তিনি ২.১% বেশি ভোট পান। এই সামান্য কমাটাও মূলতঃ ঘটে শেষ দু সপ্তাহে, হিলারির বিরুদ্ধে এফ বি আইয়ের তদন্ত শুরু করার কথা প্রকাশ পেলে। বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষার মানে ফারাক থাকে, তবে সমীক্ষার উপর নির্ভর করে বহুবছর ধরেই ফলাফলের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, হঠাৎ করে সেটা সম্পূর্ণ ভুল হবার কারণ ছিল না। আর এবার ট্রাম্পের থেকে বাইডেনের সমর্থনের ফারাক হিলারির তুলনায় অনেক বেশি, ফলে আগের বারের মতো এক শতাংশ ভোট ট্রাম্পের দিকে চলে গেলেও বাইডেনের তেমন ক্ষতি হবে না। সাইলেন্ট মেজোরিটি ভোটারদের অস্তিত্বের সপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি, এরকম থাকার কোনও কারণও নেই। ট্রাম্প গত প্রায় চার বছর রাষ্ট্রপতি রয়েছেন, তাঁকে সমর্থন করায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। আর কোনও কোনও উদারপন্থী এলাকায় কেউ সহকর্মীদের কাছে ট্রাম্পের সমর্থনে মুখ না খুলতে পারেন, কিন্তু গোপন সমীক্ষাতে সমর্থনের কথা জানাতে কেন অনীহা হবে, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। বাইডেন প্রায়ই পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটারের সমর্থন জোগাড় করছেন সমীক্ষায়, যা হিলারি কখনোই প্রায় পান নি, আর এবারে তেমন উল্লেখযোগ্য তৃতীয় দলের প্রার্থীও উপস্থিত নেই লড়াইতে, যিনি কিছু ভোট কেটে নিতে পারেন। মনস্থির না করতে পারা ভোটারের সংখ্যাও এবারে অনেক কম। ফলে ট্রাম্পকে এগোতে গেলে বাইডেন সমর্থকদের মধ্যে থেকেই  সমর্থন আদায় করতে হবে, যা অনেক কঠিন কাজ। এ ছাড়া একটা বড় পার্থক্য হল, যে সব ভোটারেরা দুই প্রার্থীর কারুকেই তেমন পছন্দ করেন না, তারা বিশাল সংখ্যায় বাইডেনকে তুলনায় এগিয়ে রাখছেন, যা হিলারির ক্ষেত্রে উলটো ছিল। আর ২০১৬ তে ট্রাম্প ছিলেন আনকোরা প্রার্থী, তাঁর কাজ কেমন দেখার সুযোগ লোকের ছিল না। এখন লোকে তাকে প্রায় চার বছর ধরে দেখছে। এতে অবশ্য সুবিধা বা অসুবিধা দুইই আছে, তবে ট্রাম্পের কাজের অনুমোদন করা ভোটারের সংখ্যা বরাবর মাত্র চল্লিশ শতাংশের মতো, যা ঐতিহাসিকভাবেই খুব কম --- এত কম অনুমোদনে কেউ পুনর্নির্বাচিত হন না। বর্তমান অনুমোদনের ভিত্তিতে যদি ভোট হতো, তবে ট্রাম্প মাত্র ১২৫ টির মতো ইলেক্টোরাল ভোট পেতেন। তবে বাস্তবে অতটা কম হতে পারে না, মানুষ হিসেবে অপছন্দ করেও, বা কাজ অনুমোদন না করেও অন্যান্য হিসেব, যেমন ধর্মীয় কারণ বা করের প্রশ্ন মাথায় রেখে, অনেক লোকে ভোট দেয়। সমীক্ষাতে নানারকম প্রশ্নে অনুমোদন জানতে চাওয়া হয়, তার মধ্যে অর্থনীতির প্রশ্নে ট্রাম্প বাইডেনের তুলনায় সামান্য কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, করোনা ভাইরাস ও জাতিগত সমস্যা মোকাবিলার প্রশ্নে ট্রাম্প ভীষণভাবে পিছিয়ে। ট্রাম্পের সহযোগীদের অনেকে দুর্নীতি ও আইনভঙ্গের কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন, অনেকের জেলও হয়েছে, ট্রাম্পের নিজেরও নানা বেনিয়ম প্রকাশ হয়েছে --- ফলে ওয়াশিংটনকে দুর্নীতিমুক্ত করার স্লোগান ভীষণভাবে হাস্যকর হয়ে গেছে। বাইডেন মোটর শিল্পকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিলেন বারো বছর আগে, ফলে রাস্টবেল্টে তাঁর অনেক সমর্থন রয়েছে, পেনসিলভ্যানিয়ার ভূমিপুত্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা বাইডেনের সঙ্গে অনেক শ্রমজীবিরা একাত্ম বোধ করেন, যা হিলারির ক্ষেত্রে একেবারেই ছিল না। ওবামার উপরাষ্ট্রপতি বাইডেনকে ভোট দেবার ব্যাপারে কৃষ্ণাঙ্গদের উৎসাহও বেশি অনেক, বিশেষ করে জামাইক্যান ও তামিল বংশোদ্ভুত ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর কমলা হ্যারিসকে রানিং মেট করার ফলে তিনি মহিলা ও অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ভোট দিতে উদ্দীপ্ত করতে পারেন। কমলা ভালো বাগ্মী ও কমবয়সী হবার ফলে বাইডেনের প্রচারে খুব কাজে লাগতে পারেন। একজন মহিলাকে এবং (সম্ভবতঃ) অশ্বেতাঙ্গকে উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থী করার প্রতিশ্রুতি বাইডেন প্রাইমারির সময়ই দিয়েছিলেন।  অবশ্য বিতর্কের সময় বাইডেনের বহুকাল আগের নেওয়া কিছু নীতি কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল বলে কমলা বলেছিলেন, তাই সম্পর্ক খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে কমলাকে বাছা ছাড়া বাইডেনের তেমন বিকল্প ছিল না, কারণ সারা দেশে পরিচিতি আছে, তুলনায় কম বয়সী ও রাষ্ট্রপতি হবার জন্য প্রস্তুত এমন অশ্বেতাঙ্গ মধ্যপন্থী মহিলা রাজনীতিক কমলা ছাড়া অন্য কারুকে ভাবা মুস্কিল। ট্রাম্প ও তাঁর অনুগামী কয়েকজন অবশ্য কমলা জন্মসূত্রে আমেরিকান কি না তা নিয়ে বিতর্ক তুলতে চেয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড শহরে জন্মানো কমলার জন্মসূত্রে আমেরিকান হওয়া নিয়ে বিতর্কের কোনও জায়গা নেই। বলা বাহুল্য, বর্ণবাদের কারণেই এরকম বিতর্ক জোর করে চাগানো হচ্ছে। ডেমোক্র্যাটিক দলের বামপন্থী অংশেরও হিলারির তুলনায় বাইডেনের উপর অনেক বেশি আস্থা রয়েছে, স্যান্ডার্সের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। প্রগতিশীলদের বেশ কিছু ধ্যানধারণা বাইডেন গ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে উচ্চ আয়ের মানুষদের সর্বোচ্চ করের হার বাড়িয়ে ৩৯.৬% করা (যা আগে ছিল), বার্ষিক চার লক্ষ ডলারের উপর আয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর চাপানো, বার্ষিক দশ লক্ষ ডলারের উপর ডিভিডেন্ট আয় কে সাধারণ আয় হিসেবে করযোগ্য করা আর  অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারে কুড়ি হাজার কোটি ডলার সরকারি বিনিয়োগ করে ২০৫০ সালের মধ্যে ফসিল নির্ভর জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-শিশুদের যত্ন-পরিকাঠামোয় ব্যাপক বিনিয়োগ, সবার জন্য মেডিকেয়ারে রাজি না হলেও ষাটোর্দ্ধদের মেডিকেয়ারের আওতায় নিয়ে আসা (এখন ৬৫ বছর হতে হয়) ইত্যাদি। এইসব কর্মসূচী রূপায়িত হলে বাইডেনের সরকার নিঃসন্দেহে আমেরিকায় আধুনিককালের সব থেকে প্রগতিশীল সরকার হবে। পক্ষান্তরে ট্রাম্প একাধিক সাক্ষাৎকারে তাঁর গত চারবছরের সাফল্য ও ভবিষ্যতের কর্মসূচী সম্বন্ধে অর্থবহ কিছু বলতে ব্যর্থ হয়েছেন। নির্বাচনী তহবিলের বেশ খানিকটা টাকা প্রচারে ব্যবহার না করে তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু লোক আত্মসাৎ করেছেন, এমন কথাও শোনা গেছে। তাঁর নির্বাচনী প্রচারের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দিতে হয়েছে।  আমেরিকানদের মারার জন্য পুতিন তালিবানদের ঘুষ দিয়েছেন অথচ তা জেনেও ট্রাম্প চুপ ছিলেন, এরকম মারাত্মক অভিযোগও উঠেছে। চীনকে তিনি অনুনয় করেছেন আমেরিকার কৃষিপণ্য কিনে তাঁকে ভোটে সুবিধা করে দেবার জন্য, সাক্ষীরা এমন জানিয়েছেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিকান রাজনীতিক ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাইডেনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। ট্রাম্পের ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরেছে, তাঁর প্রধান সমর্থক কলেজে-না-পড়া-শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা পর্যন্ত আগের থেকে অনেক কম সমর্থন করছেন, বাকি সব শ্রেণীর মধ্যে তিনি অনেক পিছিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত ভোটাররাও, যারা অনেক বেশি নিয়মিত ভোটার, ট্রাম্পের থেকে বাইডেনকে বেশি চাইছেন। যেসব রাজ্যে বাইডেন এগিয়ে আছেন, তাই থেকে বাইডেন ৩৩০ থেকে ৩৬০ মতো ইলেক্টোরাল ভোট পেতে পারেন, ট্রাম্প ২০০ এর নিচে নেমে যেতে পারেন। আর যেসব রাজ্য জেতার তাঁর বাস্তব সম্ভাবনা আছে, সবকটি তাঁর ঝুলিতে এলে, বিশেষ করে টেক্সাসের মতো বিশাল রিপাবলিকান সমর্থক রাজ্য জিতলে, বাইডেন ৪০০ ইলেক্টোরাল ভোট ছাড়িয়ে আধুনিককালের মানদন্ডে নতুন ইতিহাস গড়বেন।

৩ নভেম্বর নির্ধারিত নির্বাচনের আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি আছে। এর মধ্যে কি ট্রাম্প পাশার দান উল্টোতে পারেন? এটা ঠিক যে নির্বাচন এগিয়ে এলে লোকে মনস্থির করা শুরু করলে লড়াই আরও খানিকটা জমাটি হয়ে ওঠে, স্থিতাবস্থা রাখার কথা ভেবে অনেকেই ক্ষমতাসীনকে সমর্থন করেন। সেটা সামান্য লক্ষ্য করাও গেছে সমীক্ষার ফলে। তবে গত ছমাসের উপর বাইডেন তাঁর ব্যবধান মোটামুটি একই জায়গায় ধরে রেখেছেন। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির ও অর্থনীতির অলৌকিক উন্নতি না হলে বাইডেনের যেরকম ব্যবধান বর্তমানে রয়েছে, তাকে টপকানো ট্রাম্পের পক্ষে দুঃসাধ্য। জুয়াড়িদের হিসেবেও বাইডেন এগিয়ে। ট্রাম্পের ইলেক্টোরাল কলেজ জেতার পথটা খুবই সংকীর্ণ, বড়জোর ২৭০-২৮০ ভোট জোগাড় করতে পারেন। মিশিগান জেতা আর সম্ভব নয় মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্প সেখানে প্রচারও বন্ধ করে দিয়েছেন, পেনসিলভ্যানিয়াও প্রায় তাই। বাকি ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’গুলো সবই জিততে হবে। ট্রাম্প এতটাই ভীত যে কোভিডের অজুহাতে নির্বাচন পিছানোর কথাও বলেছেন, যা গৃহযুদ্ধ-অতিমারি-বিশ্বযুদ্ধ-নাগরিক অধিকার আন্দোলন কোনও কারণেই গত আড়াইশো বছর ধরে বন্ধ হয় নি। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন বন্ধ করার কোনও এক্তিয়ারও নেই। তবে একটা গোলমাল হবার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, অবৈধ ভোট পড়েছে এইসব দাবী যে ট্রাম্প তুলবেন তা পরিষ্কার। ২০১৬তে জিতেও তিনি এসব কথা বলেছিলেন। কোভিডের কারণে এবার বহু মানুষ ডাকযোগে ভোট দিতে চান। এমনতিতেই ডাকযোগে ভোট একটা চালু প্রথা --- তবে সবার জন্যই সে সুবিধা দেবার দাবী উঠেছে ও বেশিরভাগ রাজ্য তাতে রাজি। সেক্ষেত্রে গণনাতেও অনেক সময় লাগবে, নির্বাচনের রাতে ফলাফল জানা হবে না। সব ব্যালট ঠিকমতো সময়ে পৌছাবে কি না, সে নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। বিশেষকরে ট্রাম্প পোস্টাল পরিষেবাকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে অনীহা দেখিয়েছেন, বলেছেন ডাকযোগে ভোট হলে ব্যাপক কারচুপি হবে। অবৈধ ভোটারের ভোট দেবার ঘটনা আমেরিকায় খুবই কম, কড়া শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, আর ডাকযোগে ভোট হলে বেশি কারচুপি হবার কোনও প্রমাণ নেই। বরঞ্চ যা হয়ে থাকে, তা হল এলাকা হিসেবে বৈধ ভোটারদের নানাভাবে ভোট দিতে অসুবিধার সৃষ্টি করা। এমনিতে ভোট হয় কাজের দিনে, মজুরিতে ক্ষতি স্বীকার করে অনেক গরিব মানুষ ভোট দিতে যান না। কৃষ্ণাঙ্গ এলাকায় কম বুথ রেখে ভোট দেওয়াকে সময়সাপেক্ষ করা, অকারণ হেনস্থা বা মামুলি কারণে ধরপাকড় করা, বা পরিচয়পত্র (অর্থনৈতিক কারণে গরিব নাগরিকদের অনেকেরই যা থাকে না) দেখানো বাধ্যতামূলক করারও চেষ্টা চলছে। বলা বাহুল্য, ভোটের হার কমিয়ে সংখ্যালঘু ভোট কমাতে পারলে রিপাবলিকানদের সুবিধা হয়। মানুষ ব্যাপকহারে ভোট দিলে ডেমোক্র্যাটরা অনেক বেশি জেতে। ডাকযোগে ভোট দিতে না পারলে কোভিডের ভয়ে অনেকেই ভোট দিতে আসবে না, বিশেষকরে যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো শ্রমজীবী মানুষেরা, যারা কোভিডে অনেক বেশি হারে ক্ষতিগ্রস্ত। এই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনমতের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না হলে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের জয়ের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 


==========

লেখার তারিখঃ অগস্ট ২১, ২০২০

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

লেখাটি কিছুটা সংক্ষিপ্তরূপে "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকার সেপ্টেম্বর.২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।