সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২

শেভ্রন বনাম স্টিভেন ডনজিগার --- বৃষ্টি-অরণ্যের জন্য অসম লড়াই

 শেভ্রন বনাম স্টিভেন ডনজিগার --- বৃষ্টি-অরণ্যের জন্য অসম লড়াই

-শুভাশিস ঘোষাল

 

গত বছর পয়লা অক্টোবর আমেরিকার খবরের কাগজে ছোট শিরোনামে লেখা একটা খবর থেকে জানা গেল স্টিভেন ডনজিগার নামে এক আইনজীবীর ছমাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। কোনও ফৌজদারি মামলা নয়, সেই আইনজীবী আদালতকে তাঁর কম্পিউটারে রাখা তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছেন তাই। কে সেই আইনজীবী? কার করা মামলার ভিত্তিতে আদালত কেন তাঁর কম্পিউটারে রাখা তথ্য দেখতে চাইছে? জানা গেল মামলাকারী একটি সুবৃহৎ আমেরিকান বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেভ্রন। তা শেভ্রনের এরকম ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্বেষের কারণ কী? আদালতই বা ডনজিগারকে এত কড়া শাস্তি দিচ্ছে কেন?

আসলে ইনি কোনও সাধারণ আইনজীবী নন, একজন পরিবেশ আন্দোলনকারী তারকা আইনজীবী, যিনি ২০১১  সালে শেভ্রনের বিরুদ্ধে ইকুয়েডরের আদালতে সাড়ে নশো কোটি ডলারের একটা মামলা যেতেন। তেল কোম্পানির গাফিলতির ফলে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল। ইকুয়েডরে আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যকে মারাত্মকভাবে দূষিত করার ও সেখানকার আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন করার জন্য আদালত এই আদেশ দেয়। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য ১৯৭০ সাল থেকে, যখন টেক্সাকো তেল কোম্পানি ইকুয়েডরের জাতীয় সংস্থা পেট্রোইকুয়েডরের সঙ্গে একযোগে ড্রিলিং করত আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যে। বর্জ্যদ্রব্য বিন্যস্ত করার সুরক্ষাবিধি অনুযায়ী মাটির গভীরে পুঁতে রাখার বদলে ওয়েস্ট পিটগুলো উপচে পড়া রুখতে তারা আমাজন বাস্তুতন্ত্রে বর্জ্য ঢেলেছে স্রেফ খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে। কুড়ি বছর ধরে টেক্সাকো অন্ততঃ ষোলশো কোটি গ্যালন বর্জ্য ছড়িয়েছে। তার ফলে সেখানে বসবাসকারী তিরিশ হাজার আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়েছে। এমনকি যেসব জায়গা তেলের দূষণের থেকে নিরাপদ মনে করা হয়, সেখানে পর্যন্ত মাটি খুড়লে বর্জ্য তেল পাওয়া যাচ্ছে। বেঞ্জিন ও পারদের মতো দূষিত পদার্থ জলে মিশে তা পানের অযোগ্য হয়ে গেছে। এখন সেখানে ঘরে ঘরে ক্যান্সার, বাচ্চাদের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে, গবাদি পশু মারা গিয়েছে অসংখ্য। এই ঘটনা আমাজনের চের্নোবিল বলে আখ্যায়িত হয়েছে। “পৃথিবীর ফুসফুস” আমাজন বৃষ্টি-অরণ্য শুধু ইকুয়েডর বা ব্রাজিলই নয়, সারা পৃথিবীর পরিবেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যচিত্র পরিচালক জো বার্লিংগার  ২০০৯ সালে  ‘Crude’ নামে একটা তথ্যচিত্র বানান এই ঘটনার উপর, তাতে ওই অঞ্চলের প্রকৃতির ক্ষতি ও অদিবাসীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে কুড়ি বছর ধরে কিছুই সুরাহা হয় না। পরিশুদ্ধির জন্য নামকোয়াস্তে চার কোটি ডলার খরচ করে টেক্সাকো হাত ধুয়ে ফেলে, বিপর্যয়ের কোনও রকম আইনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে।

এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ১৯৮৪ সালে ঘটা ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। ডাউ কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত মিক গ্যাস তৈরির কারখানা বসিয়েছিল ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। কারখানার সুরক্ষা ব্যবস্থাতেও অনেক গাফিলতি ছিল। একদিন দুর্ঘটনা ঘটে, গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে চার হাজার (অন্য হিসেব অনুযায়ী ষোল হাজার) লোক প্রাণ হারান, পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। আদালতে মামলায় এবং পরে আদালত-বহির্ভূত ফয়সালায় খুব সামান্য অর্থ খরচ করে ডাউ কেমিক্যাল পার পেয়ে যায়। তবে প্রচুর বেশি লোকের ক্ষতি হলেও এবং দুর্ঘটনার মূল কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব হলেও, এক্ষেত্রে অন্ততঃ যা ঘটেছে তা দুর্ঘটনা, ইকুয়েডরের ঘটনার মতো সচেতনভাবে বর্জ্য ফেলে দূষণ ছড়ানো নয়।

১৯৯৩ সালে পাঁচটি আমাজন আদিবাসী গোষ্ঠী সহ তিরিশ হাজার স্থানীয় অধিবাসী টেক্সাকোর বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগে নিউ ইয়র্কের আদালতে মামলা দায়ের করে। স্থানীয় অধিবাসীদের হয়ে মামলায় অংশগ্রহণ করেন স্টিভেন ডনজিগার ও গোল্ডম্যান পরিবেশ পুরস্কারজয়ী আইনজীবী পাবলো ফাহার্দো। তবে টেক্সাকো সেই মামলা নিউ ইয়র্ক থেকে ইকুয়েডরে সরিয়ে আনে, কারণ তাদের ধারণা ইকুয়েডরে বিচারব্যবস্থায় জুরি না থাকায় তাদের নিজেদের পক্ষে রায় পাবার সম্ভাবনা নিউ ইয়র্কের থেকে বেশি।

ইতিমধ্যে ২০০১ সালে টেক্সাকোকে কিনে নেয় শেভ্রন, ফলে মামলার দায় শেভ্রনের উপর বর্তায়। ২০০৬ সালে বামপন্থী অর্থনীতিবিদ রাফায়েল কোরিয়া ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর মামলাটি বিশেষ প্রচার পায় ও মানুষ সচেতন হয়। প্রচুর বিখ্যাত মানুষ এসে পরিবেশের ক্ষতি নিজের চোখে দেখে যান। শেভ্রনের পরিকল্পনা ছিল মামলা টানতে টানতে অভিযোগকারীদের নিঃস্ব করে দেওয়া, যা শেভ্রনের মতো বিরাট বহুজাতিক কোম্পানিরা সব সময় করে থাকে। সেই সঙ্গে শেভ্রন প্রচারকাজ শুরু করে নিজেদের বৈজ্ঞানিকদের দিয়ে নিজেদের সপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে। তাদের স্থির বিশ্বাস ছিল আদালতকে টাকা ঢেলে হাত করে দুর্নীতি অধ্যুষিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ ইকুয়েডরে হওয়া মামলাকে কব্জা করতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না। চিরকাল তারা সেভাবেই নিজেদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত আদায় করেছে।

কিন্তু কিমাশ্চর্যম! ছোট্ট ইকুয়েডরের এক আদালত কিনা অগাধ অর্থ ও প্রভাবের অধিকারী শেভ্রনের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে বসে! চার হাজার পাতার রায়ে বিচারপতি জানান এই পরিবেশ বিপর্যয়ের দায়ভার পুরোপুরি শেভ্রনের। তাদের দু হাজার সাতশো কোটি ডলার  ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমাজন বাস্তুতন্ত্রকে পরিস্কার করা, আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের চিকিৎসা আর পুনর্বাসনে। পরে অবশ্য রায় পুনর্বিবেচনায় ক্ষতিপূরণের দায় কমিয়ে প্রথমে আঠারোশো কোটি, ও আবার পরে তাও কমিয়ে সাড়ে নশো কোটি ডলার করা হয়। আর এই রায় পেতে সওয়াল করেছিলেন স্টিভেন ডনজিগার । অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি  গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সাক্ষী সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি এবং তাঁর সহকারী আইনজীবীরা বহুদিন ধরে ধৈর্য ধরে ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের তালিম দিয়েছিলেন কী করে শেভ্রনের বাঘা বাঘা আইনজীবীদের জেরার জবাব দিতে হবে। বিচারের রায় জানার পর অধিবাসীরা ডনজিগারকে ঘিরে উচ্ছাসে-আবেগে ভেসে যায়।


চিত্র পরিচয়ঃ স্টিভেন ডনজিগার ক্ষতিগ্রস্ত আমাজনের আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলছেন।

 

এই লেখাটা এভাবেই শেষ করতে পারলে খুব ভালো হত। কিন্তু বাস্তবের পৃথিবীতে শেভ্রনের মতো বড়ো কোম্পানিদের এতো টাকা, এতো প্রভাব যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো কিছুকে তারা দাঁড়াতে দেয় না। সাড়ে নশো কোটি ডলার শেভ্রনের পক্ষেও অনেক টাকা। তা ছাড়া এভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হলে পৃথিবীর অন্যত্র তারা যে দূষণ করে থাকে, সেসব জায়গাতেও আওয়াজ উঠবে ক্ষতিপূরণের। আর সব থেকে বড় কথা, এই রায় তাদের আত্মাভিমানে এক বিরাট ঘা। স্রেফ এক আইনজীবী আর ছোট্ট ইকুয়েডরের এক আদালত কিনা তাদের নাকে খৎ দেওয়াবে? তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া ডনজিগারকে এমন শিক্ষা দিতে হবে যে ভবিষ্যতে আর কেউ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে।

এরপর শেভ্রন কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে বলে যে বাস্তুতন্ত্রকে পরিস্কার করার জন্য টেক্সাকো চার কোটি ডলার আগেই খরচা করেছে, তাই এই জরিমানার কোনো যুক্তি নেই। ইকুয়েডর থেকে তারা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে ও যাবতীয় সম্পদ তুলে নেয়। শেভ্রনের আইনজীবী রিকার্ডো ভেইগা দাবী করেন যে ডনজিগার সাক্ষ্যে জালিয়াতি করেছেন শেভ্রনের থেকে টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে। সাক্ষীদের ঘুষ দিয়ে জোগাড় করেছেন। ডনজিগার সেই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন। শেভ্রন এমনকি আমেরিকার সরকারের কাছে উমেদারী করে ইকুয়েডরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে, তবে সেই চেষ্টা ফলপ্রসু হয় নি।

ইকুয়েডরের আদালতে তারা বিচার পাবে না, এই বলে শেভ্রন সেই রায়ের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের আদালতে মামলা করে। এই মামলার বিচারকের নাম লুইস কাপ্লান। বিচারক হবার আগে তিনি বহুবছর কর্পোরেশনদের আইনজীবী হয়ে কাজ করেছেন। শেভ্রনে তাঁর বড়সড় বিনিয়োগও আছে। তিনি যে শেভ্রনের পক্ষপাতী, তা গোপন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন নি। বরঞ্চ মন্তব্য করেন “অর্থনীতিতে শেভ্রনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ”, যার মর্মার্থ হল তাদের শাস্তি দেওয়া মানে আমেরিকার অর্থনীতির ক্ষতি করা, তা তারা যাই করে থাকুক না কেন।। তিনি ‘Crude’ এর পরিচালক জো বার্লিংগারকে তার সমস্ত ফুটেজ জমা দিতে বলেন। ফুটেজে দেখা যায় ডনজিগার মন্তব্য করেছেন, “আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, কারণ আদালত শুধু আইন নয়, বাদী-বিবাদীপক্ষ কতটা শক্তিশালী, তাও দেখে।" শেভ্রন এই মামলায় আলবার্তো গুয়েরা নামক এক ইকুয়েডরীয় বিচারককে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপনা করে। গুয়েরা জানান, ডনজিগারের আইনি দল ইকুয়েডরের বিচারপতিদের ঘুষ দিয়েছে। এই দুই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে কাপ্লান ২০১৪ সালে রায় দেন যে ডনজিগার ইকুয়েডরে শেভ্রনের বিরুদ্ধে যে রায় পেয়েছেন, তা অবৈধপথে পাওয়া, তাই অসিদ্ধ। শেভ্রনের তাই ক্ষতিপূরণ দেবার কোনও দায় নেই আর।

দেখা যাক এই রায়ের ভিত্তি কতটা জোরালো। ডনজিগারের ‘রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার’ যে মন্তব্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার হল, তাতে ভুল বা অনৈতিক কিছু নেই। অসাম্য, রাজনৈতিক জোর আর বৃহৎ পুঁজির সামনে দেশ-বিদেশের আদালতগুলি যে বেশিরভাগক্ষেত্রেই ক্রীড়নক মাত্র, তাতে বিন্দুমাত্র অতিকথন নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ফৌজদারি মামলাগুলোর রায় প্রায়ই বিসদৃশভাবে গরীব ও কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে যায়। তারা জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি হারে দোষী সাব্যস্ত হয় তো বটেই, একদম একই অভিযোগে শাস্তির মাত্রার বিরাট তফাৎও হয়। সাম্প্রতিককালে কাইল রিটেনহাউস বলে একটি সতের বছরের শ্বেতাংগ ছেলে পাশের রাজ্যে গিয়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের দুজনকে অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে গুলি চালিয়ে খুন করে এবং একজনকে মারাত্মকভাবে জখম করেও এই যুক্তিতে পার পেয়ে যায় যে সে নিজেকে বিপন্ন মনে করেছিল প্রতিবাদকারী জনতার সামনে। একদল উগ্র সমর্থককে উসকে আইনসভার উপর হামলা করিয়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের ফলাফলকে উলটে দেবার চেষ্টা করে সরাসরি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আদালতে অভিযুক্ত হলেও জেল হবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আমাজনের এই মামলায় যেখানে তিরিশ হাজারেরও বেশি প্রান্তিক মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত এবং আরও বহু মানুষের ভাগ্য জড়িত, সেখানে আর্থিকভাবে অসীম ক্ষমতাশালী এক কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে সমানে লড়তে হলে গণআন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছেই, কারণ সেটা কোনও সাধারণ মামলা নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সম্পর্কিত মামলা। এইভাবেই জনমতের চাপে আইন হয়েছে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন নিষিদ্ধ করার, রঙে আর পেট্রলে সীসার ব্যবহার বন্ধে, আর এখন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে ফসিল জ্বালানি পোড়ানো কমাতে। দ্বিতীয় অভিযোগটা অবশ্যই গুরুতর, তবে তা প্রমাণিতভাবে মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। গুয়েরা এই সাক্ষ্য দেবার জন্য শেভ্রনের কাছ থেকে কুড়ি লক্ষ ডলার নিয়েছিলেন, এবং পরে চাপের মুখে স্বীকার করেন যে তিনি টাকা নিয়ে ডনজিগারের বিরুদ্ধে মিথ্যে ঘুষের অভিযোগ করেছিলেন। অথচ এই একটিমাত্র সাক্ষীর অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারক কাপ্লান শেভ্রনকে অব্যাহতি তো দিলেনই, তার উপরে বেনজিরভাবে ডনজিগারকে ঘুষ দেওয়ায় অভিযুক্ত করলেন, যদিও এই মামলা ঘুষ সম্পর্কিতই ছিল না। ডনজিগারের আইনচর্চা করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালে কাপ্লানের রায় অনুমোদিত হয়।

শেভ্রন অবশ্য এখানেই থেমে রইল না। বিচারক যখন পকেটে, তখন ডনজিগারকে সম্পূর্ণ শায়েস্তা করতে হবে। ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ কর্পোরেশনের বেমানান প্রতিহিংসায় শেভ্রন কাপ্লানের এজলাশে আবেদন করে যে ডনজিগারকে তাঁর কম্প্যুটারের যাবতীয় তথ্য জমা দিতে। কাপ্লানও সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দেন আবেদনে। কিন্তু ডনজিগার আপত্তি জানিয়ে বলেন, এতে এক আইনজীবী আর তাঁর মক্কেলদের যোগাযোগের গোপনীয়তার অঙ্গীকার ক্ষুণ্ণ হবে, শেভ্রন অনৈতিকভাবে তথ্য পাবে। তিনি জানান, তিনি আদালতের এই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করছেন, তবে যদি মক্কেলের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার রীতিনীতি মানা হয়, তবে তিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের তাঁর কম্প্যুটার পরীক্ষা করতে দেবেন। 

এর পর সম্পূর্ণ নজিরবিহীন এক নির্দেশে কাপ্লান একটি বেসরকারি আইনী সংস্থাকে নিয়োগ করেন ডনজিগারকে আদালত অবমাননার ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করতে। যে সরকারি কৌঁসুলিকে  দায়িত্ব দেওয়া হয় চার্জশীট দিতে, তিনি যে আইনি-সংস্থায় আগে কাজ করেছেন, তারা শেভ্রনের হয়ে  মামলা লড়েছে। মামলাটি নিউ ইয়র্কের আর একটি জেলা আদালতে বিচারক লরেটা প্রেসকার এজলাসে দায়ের করা হয়। এই বিচারক ফেডারেশন সোসাইটি নামে শেভ্রনের অর্থপুষ্ট একটি সংস্থার উপদেষ্টাপদে আসীন ও শেভ্রনের দ্বারা আর্থিকভাবে উপকৃত। তা সত্ত্বেও তিনি এই মামলায় বিচারক নিযুক্ত হলেন ! আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপরতলায় প্রভাব খাটানো অন্য বেশিরভাগ দেশে গর্হিত দুর্নীতি বলে গণ্য হবে, কিন্তু আমেরিকায় ‘লবিইং’ নাম দিয়ে আইনসিদ্ধভাবে কর্পোরেশনগুলি তাদের প্রভাব খাটিয়ে চলে বছরের পর বছর। ফলে তাদের স্বার্থবিরোধী আইন বা রায় বেরোয় না। কাপ্লান, প্রেসকা এবং শেভ্রনের আইনজীবীদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছিল বলে প্রমাণ আছে। বিচারকের আসনে বসে প্রেসকার আচরণ খুবই দৃষ্টিকটু। মামলার শুনানির সময় তাঁকে খবরের কাগজ পড়তে দেখা গেছে। বার বার করে ডনজিগারের আইনজীবীদের চুপ করতে বলেছেন। রায় দেবার সময় অদ্ভুতভাবে জাতীয় পতাকায় মুখ ঢেকে রেখেছিলেন।  বোঝাই যাচ্ছে খুবই পরিকল্পনামত ডনজিগারকে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এই মামলাগুলো সাজানো হয়েছে। ডনজিগারও বিচারকের আচরণ দেখে প্রেসকার এজলাশে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন।  

তো প্রেসকা কী রায় দিলেন? আদালত অবমাননায় ডনজিগার দোষী, তাঁকে ছমাসের জেল হেফাজতে পাঠানো হবে। তার আগে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে, যতদিন না রায়ের এই আদেশ অনুমোদিত হয়। এ ছাড়াও আট লক্ষ ডলারের বেল বন্ড সই করতে হয়েছে তাঁকে। ২০২১ সালের অক্টোবরে ডনজিগারের কারাদন্ড অনুমোদন হয় ও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। অবশ্য ৪৫ দিন জেলে কাটানোর পর নিউ ইয়র্ক রাজ্যের কোভিড নীতির জন্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাকি মেয়াদ গৃহবন্দী কাটাচ্ছেন।

 


চিত্র পরিচয়ঃ জেলে যাবার আগে ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন স্টিভেন ডনজিগার।

 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় ডনজিগার মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণের জোরে মামলার সুবিধাজনক রায় পেয়েছিলেন, তাহলেও এই অপরাধে ছমাসের বেশি কারাদন্ড হয় না, কারণ এটি একটি ‘মিসডেমিনার’ মাত্র, ‘ফেলোনি’ নয়। ডনজিগারকে দু বছরেরও বেশি গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে, যা এই ধরণের মামলায় আইন অনুমোদিত সর্বোচ্চ শাস্তির থেকে বেশি, অর্থাৎ এতদিন অন্তরীণ রাখার আদেশটাই বেআইনি।  নতুন করে তাঁর আর কারাদন্ড তো হয়ই না। তবে বিচারক প্রেসকা মানতেই চাননি যে গৃহবন্দী থাকাটাও একটা শাস্তি, কারণ তাঁর মতে “আইনের সবক শিখতে ডনজিগারের জেলে যাওয়া দরকার”।  আর মিসডেমিনারের জন্য আট লক্ষ ডলারের বেল বন্ড নজিরবিহীন। এতসব না সত্ত্বেও তবু এরকম ঘটল, আমেরিকারই মাটিতে, যে দেশ সংবিধানে “সকল মানুষের সমান অধিকার আর আইনের চোখে সবাই সমান, কেউই আইনের ঊর্দ্ধে নয়” এই নীতিগুলো জোর দিয়ে বলে। আসলে এই ধরণের নীতিগুলোকে মানা হয় ততক্ষণই, যতক্ষণ প্রভাবশালী শক্তির বিরুদ্ধে কিছু না যাচ্ছে। আমেরিকায় বিচারব্যবস্থার একটা খুব খারাপ দিক হল পার্টিজানশিপ --- বিচারকদের প্রতিটা রায়ই নির্ভর করে তিনি উদারপন্থী না রক্ষণশীল তার উপর। সাম্প্রতিককালে গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের রায় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক দল উভয়েই বিচারপতির মনোনয়নে এবং নিয়োগে সম্মতি ভোট দিতে নিজেদের লোককে দেখে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, বড় কর্পোরেশনগুলো তাদের বিপুল আর্থিক ক্ষমতার জোরে দুই তরফেরই প্রায় সব বিচারকদের এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরকে নিজেদের প্রভাবে এমন আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে তাদের স্বার্থবিরোধী রায় কোনও বিচারক প্রায় কখনোই দিতে পারেন না। একমাত্র প্রবল জনমতের চাপ এলে তবেই কর্পোরেট স্বার্থবিরোধী রায় পাওয়া সম্ভব হতে পারে। নিজের সম্ভাব্য শাস্তির কথা জেনেও মক্কেলের অধিকার রক্ষা করতে আদালতের অনৈতিক নির্দেশ না মানার এই দৃঢ়তা সহজ নয়।

আমেরিকায় বেশিরভাগ সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেল ডনজিগারের মামলা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে নি। “পুঁজিবাদের দৈনিক বাইবেল” বলে পরিচিত মাল্টি-বিলিয়নেয়ার রুপার্ট মার্ডকের সংবাদপত্র “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল” বেশ উল্লসিত “তাঁর প্রাপ্য শাস্তি পাওয়ায়”। তারা ডনজিগারকে জালিয়াত বলে চিহ্ণিত করেছে সেই প্রমাণিত মিথ্যা সাক্ষ্যকে ভিত্তি করে। দক্ষিণপন্থী ছোটখাটো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ডনজিগার দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী, উদারপন্থীদের চোখের মণি, বামপন্থী নৈরাজ্যবাদী বলে মুন্ডপাত করতে লেগেছে। বলা বাহুল্য, এইসব সংবাদ মাধ্যম কর্পোরেট দাক্ষিণ্যে চলে, এদের মালিকেরা সাধারণতঃ কোনও বড়সড় শিল্পপতি হয়ে থাকেন। এমনকি উদারপন্থী প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত, যার জন্য রক্ষণশীলদের ক্রমাগতঃ আক্রমণের লক্ষ্য যারা, সেই “নিউ ইয়র্ক টাইমস”ও সাত বছর ধরে চলা ডনজিগারের মামলা নিয়ে মাত্র দুটো প্রবন্ধ লিখেছে, এবং শেষ প্রবন্ধে প্রকারান্তরে “দুপক্ষই দোষী” ধরণের গা বাঁচানো মন্তব্য করেছে। তাদের মতে, ডনজিগার নাকি স্বীকার করেছেন যে তিনি ইকুয়েডরে মামলা পুরো সোজা পথে লড়েন নি, এবং তার ফলেই নাকি ইকুয়েডরের ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই প্রবন্ধে নিউ ইয়র্ক টাইমস স্পষ্ট করে বলে নি কী কারণে তারা এরকম মতামত পোষণ করে, তবে সেই প্রবন্ধ থেকে মনে হচ্ছে তারা ডনজিগারের বলা একটা কথা “ইকুয়েডরে আমাদের মামলা সাজানোতে দুয়েকটা ভুল হয়েছে, না হলে আমরা আরও ভালোভাবে ওই মামলা জিততে পারতাম” বোঝাতে চেয়েছে। এই কথা থেকে কিন্তু মনে হয় একজন মানুষের নিজের কাজের পর্যালোচনা করছেন, যেমন একজন লেখক, শিল্পী বা খেলোয়াড় করে থাকেন --- বেআইনি পথ নেবার স্বীকারোক্তি বলে মনে হয় না। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই রকম অবস্থান নেবার কারণ কী? আসলে তারাও তো কর্পোরেট সংস্থাই। অবশ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে ডনজিগারের প্রতি প্রতিহিংসায় শেভ্রন বড় বেশিদূর এগিয়েছে, যা আদপে ডনজিগারকেই নায়ক করে তুলবে।

তবে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা যাই হোক না কেন, ইউটিউবার আর ব্লগাররা কিন্তু ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরেছে। তাদের থেকে জানা গেছে কীভাবে একটা বিরাট কর্পোরেট সংস্থা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করার পর তাদের টাকার জোরে আদালতের সঙ্গে যোগসাজশে ডনজিগারের উপর প্রতিহিংসা নিচ্ছে। বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা ডনজিগারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে ও শেভ্রনের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার টাকা তুলেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের আইনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন ডনজিগারের কারাদন্ডের নির্দেশ খেয়ালখুশিমতো এবং বেআইনি --- বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনে বৃহৎ পুঁজির কুপ্রভাবে ঘটেছে। আমেরিকার সরকারের উচিৎ এই মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডনজিগারকে ছাড়িয়ে আনা। উনত্রিশজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ডনজিগারের মামলাকে আইনি হেনস্থা বলে উল্লেখ করে তাঁর মুক্তির দাবী জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলি শেভ্রনের করা মামলাকে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কৌশলী মামলা হিসেবে অভিহিত করেছে। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রগতিশীল অংশ আমেরিকার  অ্যাটর্নি জেনেরাল মেরিক গারল্যান্ডের কাছে চিঠি লিখে আদালতে বেনিয়ম হয়েছে উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানিয়েছে। ট্যুইটারে #freedonziger হ্যাশট্যাগে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে অনুরোধ করা হয়েছে তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে ডনজিগারকে মার্জনা করে কারাদন্ড থেকে অব্যহতি দিতে। তবে ডেমোক্র্যাটিক দলের হাতে প্রশাসন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের তরফ থেকে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।

স্টিভেন ডনজিগার হার্ভার্ড আইন বিভাগ থেকে পাশ করেছিলেন। এই বিখ্যাত আইন বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কর্পোরেট সংস্থার হয়ে কাজ করে আইনজীবীরা কোটি কোটি ডলার রোজগার করে থাকেন। কিন্তু ডনজিগার পরিবেশ ও ক্ষমতাহীন মানুষদের হয়ে কর্পোরেশনদের বিরুদ্ধে লড়ার কঠিন পথ বেছে নেন। ম্যানহাটনের একটা সাধারণ দুই কামরার ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করেন। জেলে যাবার আগে ছেলেকে আলিঙ্গন করে তাঁর বিদায় নেবার ছবি দেখে বহু মানুষ আপ্লুত হয়েছেন। জেলে যাবার সময় তিনি বলেছেন যে “যাই ঘটুক না কেন, আমি ঠিকই থাকব, এই পর্যায় পেরিয়ে আসব --- কিন্তু ইকুয়েডরের মানুষেরা বিচার পায় নি, তাদের সাহায্য করা দরকার।“

কিন্তু ইনসাফ কোথায়?


--------------------

লেখার তারিখঃ ২৩ জুলাই, ২০২২

প্রথম প্রকাশঃ চার নম্বর প্লাটফর্ম 



বুধবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

রাষ্ট্রপতি বাইডেনের এক বছর

রাষ্ট্রপতি বাইডেনের এক বছর

-শুভাশিস ঘোষাল

 

এক বছর আগে ২০ জানুয়ারি আমেরিকার রাষ্ট্রপতিপদে জো বাইডেন কাজ শুরু করেন। সময়টা খুব সহজ ছিল না। নভেম্বর ২০২০ তে নির্বাচনে পরাস্ত হবার পর পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প দু মাস ধরে  এক নাগাড়ে নির্বাচনের ফল নিয়ে মিথ্যা প্রচার গেছেন ও আদালতে ফল উল্টে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাই শুধু নয়, আমেরিকার গণতন্ত্রকেই এক বিরাট সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন ৬ই জানুয়ারি ২০২১ একদল সমর্থককে খেপিয়ে আইনসভার উপর হামলা করতে প্ররোচিত করে, যাতে সেখানে বাইডেনের জয়কে আনুষ্ঠানিক শংসাপত্র না দেওয়া হয়। এ হেন ট্রাম্প সাধারণ সৌজন্যবিধি মেনে পরবর্তী প্রশাসনের জন্য কোনও সহযোগিতা করেন নি স্বভাবতঃই, বরঞ্চ পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তার উপর দেশে তখন কোভিড সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল, প্রায় চার হাজারের মতো মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিদিনের এলোমেলো দিশাহীন কাজকর্মে দেশের মানুষ শংকিত। অর্থনীতিতেও অজস্র সমস্যা, বিশেষকরে কাজ হারানো মানুষদের তখন সাহায্য করা দরকার। সেখানে ট্রাম্পের বিপরীত চরিত্রের মানুষ বাইডেনের প্রথম কাজ ছিল প্রশাসনে নিয়মশৃংখলা ফিরিয়ে আনা, দেশের মানুষের আবার প্রশাসনের উপর ভরসা ফেরানো, কোভিড সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা, কাজ হারানো মানুষদের সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।

বাইডেন কাজ শুরু করেন দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সমর্থন পেয়ে, যা রাষ্ট্রপতিরা শুরুতে পেয়ে থাকেন। হোয়াইট হাউসের কাজকর্মে বিতর্ক আর সেই দিশেহারা ভাবটা বন্ধ হয়। দেশে টিকাকরণে ব্যাপক সাফল্য আসে, দশ কোটি লোককে তিনমাসের মধ্যে যে টিকা দেবার পরিকল্পনা ছিল, অনেক আগেই সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়। কোভিড সংক্রমণের দৈনিক সংখ্যা হুহু করে নেমে আসে, সেই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও। অর্থনীতিকে চাগাতে মার্চ মাসে প্রায় দু লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের কোভিড রিলিফ প্যাকেজ রাষ্ট্রপতি বাইডেন অনুমোদন করেন। কোভিডের ফলে ধুঁকতে থাকে আমেরিকান পরিবারগুলিকে সরাসরি অর্থসাহায্য করা হয়। কাজ হারানো মানুষদের প্রতি সপ্তাহে তিনশ ডলার করে বেকার ভাতা দেওয়ার মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর ফলে অনেক পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া থেকে বাঁচানো যায়। বিশেষ করে ‘সিঙ্গল প্যারেন্ট’রা, যারা কোভিডের জন্য বাচ্চা বাড়িতে থাকার ফলে কাজে যেতে পারছিলেন না, তারা বিশেষ উপকৃত হন। টিকা দেবার জন্য বাড়তি অর্থও বরাদ্দ করা হয়। বাইডেন আশ্বাস দেন গ্রীষ্মকাল থেকেই আবার মানুষের জীবন পুরো ছন্দে ফিরে আসবে।

তবে টিকাকরণের সাফল্য একসময় থমকে যায়, কারণ দেশের তিরিশ শতাংশেরও বেশি মানুষ টিকা নেবার ঘোর বিরোধী। আর্থিক পুরস্কার দিয়েও তাদের রাজি করানো যায় না। সেই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যম ও ছদ্মসংবাদগুলোর লাগাতার টিকাবিরোধী বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চলতে থাকে। এমন সময় আঘাত হানে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়ান্ট। দৈনিক আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা আবার বেড়ে যায়। গ্রীষ্মে যে জনজীবন পুরো স্বাভাবিক হতে পারে না, তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

এরপর অগস্টমাসে আফগান সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিশ্রুতিমতো আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া শুরু করলে আফগান সরকারের পতন ঘটে। তালিবানরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, এক হৃদয়বিদারক মানবিক সংকট দেখা দেয়। বাইডেন সরকারের দেওয়া আশ্বাস ছিল যে আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী যথেষ্ট প্রস্তুত, তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ হয়। তবে আফগান সমস্যার জন্য বাইডেনকে দায়ী করা সমস্যার অতিসরলীকরণ। বাইডেন বরঞ্চ পূর্ববর্তী ওবামা ও ট্রাম্প সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি শেষপর্যন্ত পালন করার সাহস দেখিয়েছেন, ব্যাপারটার এখনেই নিষ্পত্তি করতে চেয়েছেন। এইসময় থেকে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে বাইডেনের অনুমোদন পড়তে থাকে। সেটা বাইডেনের পক্ষে সেই মুহুর্তে তেমন কোনও চিন্তার বিষয় ছিল না, কারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তো বটেই, মধ্যবর্তী নির্বাচনেরও অনেক দেরি। আমেরিকার সাধারণ মানুষ, যারা আফগানিস্তান দেশটা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানে না, তারা সেই দেশের বিশৃংখল অবস্থাকে বহুদিন বাদে হওয়া নির্বাচনে বিষয় করবে, এমনটা আমেরিকার রাজনীতিতে হয় না। তা ছাড়া আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানোতে সাধারণ মানুষের সমর্থনই ছিল। কাজেই এই অনুমোদন কমে যাওয়াকে সংবাদমাধমের প্রভাবে হওয়া একটা সাময়িক ব্যাপার বলে ধরে নেওয়া যেত।

কিন্তু বাইডেনের অনুমোদনে কোনও ঊর্ধগতি ফিরে আসে না, বরঞ্চ তা আরও পড়তে থাকে। সেটা সাধারণতঃ হয় অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হলে। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সেটা অবশ্য একটা ব্যতিক্রম ছিল, অর্থনীতি ভালো চললেও বিভাজনকারী বিতর্কিত ট্রাম্পের অনুমোদন কখনই প্রায় চল্লিশ শতাংশের উপরে  ওঠে নি। বাইডেন ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত চরিত্র নন, বরঞ্চ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে তিনি মধ্যপন্থী ও ‘বাইপার্টিজান’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর সময়ে অর্থনীতির হালকে খারাপ তো বলা যায়ই না, বরঞ্চ বেশিরভাগ পরিমাপ অনুযায়ী তা মাত্রাতিরিক্ত রকমের ভালো। গত পঞ্চাশ বছরে কোনও রাষ্ট্রপতির প্রথম বছরে দেশের অর্থনীতি এতটা শক্তিশালী অবস্থায় থাকে নি। অর্থনীতির বৃদ্ধি এই সময় ৫% হয়, যা আগামী বছরে ৫.৬% হবার আশা। একটা উন্নত অর্থনীতির জন্য সেটা খুবই ভালো, আধুনিক আমেরিকায় গড় বৃদ্ধির আড়াই গুণেরও বেশি। এই এক বছরে বেকারত্বের হার ৬.২% থেকে মাত্র ৩.৯% তে নেমে এসেছে। ঘন্টাপ্রতি মজুরিতে কাজ করা মানুষেরা এর সুফল পাচ্ছেন আয় বৃদ্ধিতে। শেয়ার বাজারে পাঁচশ প্রধান কোম্পানির শেয়ারদরের গড়ের সূচক S&P500 এই সময় প্রায় রেকর্ড পরিমান বৃদ্ধি হয়। আমেরিকান কোম্পানিদের রেকর্ড কম ঋণের অনুপাত ও রেকর্ড মুনাফা বৃদ্ধি এর কারণ। এছাড়াও উৎপাদন শিল্পে চাকরি, কোম্পানিতে কর্মচারিদের নিয়োগ এবং ডলারের মূল্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতি চোখে পড়ে। অবশ্য এটা ঠিক যে এই বৃদ্ধির কারণ মূলতঃ কৃত্রিমভাবে অর্থনীতিতে অর্থের যোগান দিয়ে চাহিদা বাড়ানো ও বাজারে খুব কম সুদের হার থাকা। এর ফলে যে জাতীয় ঋণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।



গত সত্তর বছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রপতির সময়ে আর্থিক বৃদ্ধির তুলনামূলক রেখচিত্র।

বিশেষজ্ঞদের হিসেবে অর্থনীতিতে জোয়ার চলছে, অথচ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে ষাট শতাংশ মানুষ মনে করছেন দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ, দেশ ভুল পথে চলছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে এর কারণ কী?

কোনও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর কিছুদিন একটা ‘হানিমুন পিরিয়ড’ চলে। তারপর লোকে রূঢ় বাস্তবে ফেরে, রাষ্ট্রপতিরও জনপ্রিয়তা কমে আসে, কারণ যেই ক্ষমতায় থাকে, আমেরিকার মানুষ তাকেই অপছন্দ করে। তবে এত হঠাৎ করে এই পতন যে এটাকেই শুধু কারণ হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। আফগানিস্তান সংকট থেকে বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা শুরু হলেও আফগানিস্তান কখনই আমেরিকান ভোটারদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না। কোভিড সমস্যা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাইডেনের উপর লোকে ট্রাম্পের থেকে অনেক বেশি আস্থা রেখেছিল কোভিড নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে। বাইডেন যথেষ্ট চেষ্টা করেন নি এমন কথা বলা যাবে না, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নি। কিছুক্ষেত্রে টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা বা মুখোশ পরার বিধি চাপানো অনেকেরই অপছন্দ হয়। তবে আসল কারণগুলোর প্রধান একটা হল যে মুদ্রাস্ফীতি এখন ৪.১% তে পৌঁছেছে। গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এমন উঁচুহারে মুদ্রাস্ফীতি আমেরিকার মানুষ দেখে নি। পেট্রল পাম্প, মুদিখানা বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলেই লোকে বুঝতে পারে আগের থেকে দাম অনেক বেড়ে গেছে, বাড়তি মজুরির টাকা তাতেই চলে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে কৃত্রিমভাবে অর্থ যোগানো যে এর মূল কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডেরাল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের এখনই সুদের হার বাড়ানো উচিৎ, একথা অনেকেই বলছেন, তবে মন্দার আশঙ্কায় পাওয়েল তা করছেন না। এ ছাড়া ‘সাপ্লাই-চেন’ সমস্যার জন্য অনেককিছু পাওয়া যাচ্ছে না। আমেরিকার মানুষ প্রাচুর্যে অভ্যস্ত, পয়সা দিলেই জিনিস পাওয়া যায় জানে। ‘সাপ্লাই-চেন’ সমস্যাটা বিশ্বজনীন হলেও দায়ভাগটা দেশের প্রশাসনের ঘাড়েই এসে পড়ে।

তবে বাইডেনের জন্য একটা সমস্যা তাঁর ভাবমূর্তি। যে মধ্যপন্থী ভাবমূর্তি তাঁকে জিততে সাহায্য করেছিল, এখন তা ই তাঁর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রগতিশীলরা মনে করেন বাইডেন বড্ড মধ্যপন্থী, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পালনে যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছেন না। মধ্যপন্থীরা মনে করেন তিনি অতিরিক্ত উদারপন্থী, সংস্কারের ব্যাপারে বেশি তাড়াহুড়ো করছেন, সরকারের খরচ অতিরিক্ত বাড়াচ্ছেন, জনজীবনে নাক গলাচ্ছেন। ট্রাম্পবিরোধী যে সব রিপাবলিকানরা তাঁকে নির্বাচনে সমর্থন করেছিল, ট্রাম্পকে সরানোর পর তাদেরও বাইডেন সম্পর্কে  উৎসাহ কমে গেছে। আর সাধারণ রিপাবলিকানদের তো কথাই নেই । সেই ওবামার সময় থেকেই জনমত খুব পার্টিজান হয়ে গেছে। এখন এক দলের সমর্থক অন্যদলের রাষ্ট্রপতির কোনও কাজই অনুমোদন করে না। তার উপরে ট্রাম্প, দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যম ও ছদ্মসংবাদ টানা প্রচার করে গেছে যে বাইডেন নির্বাচনে কারচুপি করে জিতেছেন (অনেক ভোট ডাকযোগে দেওয়া হওয়ায় এবং ভোটকেন্দ্রে দেওয়া ভোট আগে গোনায় শুরুতে ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন বলে), আসলে বৈধ জয়ী ট্রাম্প। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে রিপাবলিকান ভোটারদের ৬০%, অর্থাৎ মোট ভোটারের ২৭% এর কাছাকাছি মানুষ তা বিশ্বাস করে, যদিও আদালতে ট্রাম্পের করা সব আপত্তিই ভিত্তিহীন বলে খারিজ হয়ে গেছে। যারা বাইডেনের নির্বাচনের বৈধতাতেই বিশ্বাস করে না, তারা যে তাঁর কাজ অনুমোদন করবে না, তা বলাই বাহুল্য। সাধারণ ভোটারদের কাছে বাইডেনের ভাবমূর্তি অত্যধিক বয়স্ক ও অনাকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলে। চীনের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বাইডেনের নেতৃত্ব দুর্বল, ট্রাম্প বেশি একরোখা ছিলেন, সাধারণের মধ্যে এরকম একটা ধারণাও ছড়ানো হয়, বাস্তবে যদিও ট্রাম্পের বসানো শুল্কতে চীনের থেকে আমেরিকার অর্থনীতিরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাজের অনুমোদনে এই সব ধারণার প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া যা হয়েছে, প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবের তফাৎ। বাইডেনের নির্বাচনী ইস্তাহারে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’ শ্লোগানে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও করব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারসহ অনেক বড় বড় সরকারী বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঘোষণা ছিল, যেসব রূপায়িত হলে বাইডেনের প্রশাসন আধুনিককালের সবথেকে প্রগতিশীল প্রশাসন হতো। মুস্কিল হলো বাইডেনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যে সব প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তার অল্প কিছু বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে চালু করলেও উচ্চাকাংক্ষী পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলি আইনসভার অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। মার্কিন আইনসভার নিম্নকক্ষ, হাউসে, ডেমোক্র্যাট দলের অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। উচ্চকক্ষ সেনেটে সমান সমান--- উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের কাস্টিং ভোটে চুলচেরা গরিষ্ঠতা। বিল্ড ব্যাক বেটারের প্রকল্পগুলির জন্য  করব্যবস্থার সংস্কার করে অর্থের যোগান দিতে হবে, যাতে ধনী ও কর্পোরেশনদের উপর কর বাড়বে। এর জন্য সেনেটে রিপাবলিকানদের কয়েকজনের ভোটও দরকার, বা নিদেনপক্ষে সমস্ত ডেমোক্র্যাটদের এককাট্টা হয়ে ভোট দেবার দরকার। রিপাবলিকানদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাবার আশা নেই, কারণ তাদের রাজনীতি ওবামার সময় থেকেই পুরোপুরি বাধা দেবার পার্টিজান রাজনীতি হয়ে উঠেছে। ধনী ও কর্পোরেশনদের উপর বাড়তি করের প্রস্তাবে তো তারা পুরোপুরি বাধা দেবে। কিন্তু এ ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের নিজেদেরই ঐক্য নেই। দুই রক্ষণশীল সেনেটর ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার জো ম্যানসন আর অ্যারিজোনার কির্স্টেন সিনেমা প্রায় যে কোনও প্রস্তাবেই বাধা দিচ্ছেন নানা অজুহাতে। রক্ষণশীল দরিদ্র রাজ্য ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার অর্থনীতিতে ওখানকার কয়লা খনির গুরুত্ব আছে, আর ম্যানসন কোল প্ল্যান্ট থেকে প্রচুর অর্থও পান নির্বাচনী তহবিলে। সেই জন্য পরিবেশবান্ধব অপ্রচলিত শক্তির প্রসারের প্রকল্পগুলোতে বাধা দিচ্ছেন। তাঁর আর সিনেমার বাধায় বাইডেন প্রতিশ্রুত যে দুই হাজার ডলারের ‘স্টিমুলাস চেক’ আমেরিকান পরিবারদের দেবার কথা ছিল, তা কমিয়ে চোদ্দশ করতে হয়েছে। পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার আর ভোটের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার যে বিলগুলি হাউসে পাশ হয়ে গেছে, তাও এদের বাধায় আইনে পরিণত হতে পারে নি। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে বাইডেনের করা ‘ভ্যাক্সিন ম্যান্ডেট’, যা বড় কোম্পানিগুলোর কর্মচারীদের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, খারিজ হয়ে গেছে। পরিকাঠামো নির্মাণ বিলে যে সাড়ে তিন লক্ষ কোটি ডলার খরচ করার প্রস্তাব ছিল, তা কমিয়ে এক তৃতীয়াংশ করতে হয়েছে। অবস্থা যেরকম দাঁড়িয়েছে, তাতে এই দুজনকে বুঝিয়ে একটা বড়সড় কিছু প্রকল্প চালু করতে না পারলে বাইডেনের পক্ষে কোনোরকম উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দাবী করা দুরুহ হয়ে যাবে। তার প্রভাব আইনসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন, এমনকি তিন বছর বাদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও পড়তে পারে।

মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে বাইডেনের শাসনকালে সাফল্য আর ব্যর্থতা দুইই রয়েছে। অর্থনীতির গতি বাড়ানো ছাড়াও প্রায় দুলক্ষ কোটি ডলারের কোভিড রিলিফ বিল চালু, কুড়ি লক্ষ মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় ফিরিয়ে আনা, ছাত্রঋণের বেশ কিছু মকুব করা, প্যারিস পরিবেশচুক্তিতে আমেরিকাকে আবার ফিরিয়ে আনা, বন্ধুরাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আবার সহায়তা ও সুসম্পর্ক ফিরিয়ে এনে বাকি বিশ্বের কাছে আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো, এগুলো বাইডেনের সাফল্য। আবার কিছু ব্যাপারে তিনি স্পষ্টতঃই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। ট্রাম্পের সময় যেরকম মেক্সিকো সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থীদের খাঁচায় পুরে রাখা ধরণের অমানবিক আচরণের অভিযোগ ছিল, সেইরকম ঘটনা আবার ঘটেছে, যা বাইডেনের নির্বাচনী আশ্বাসের পরিপন্থী। সম্প্রতি হাইতিতে রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ফলে যে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, সেইজন্য চলে আসা শরণার্থীদের ক্যাম্পগুলোর করুণ অবস্থা প্রগতিশীলদের বিচলিত করেছে। আর এ ব্যাপারে উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের বিতর্কিত ভূমিকাও যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছে। উল্টোদিকে রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে এটা প্রতিপন্ন করা হচ্ছে যে সীমান্তে একটা অভূতপূর্ব সংকট চলছে, দলে দলে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা দেশে ঢুকে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাইডেনের যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল নানা দেশের যুদ্ধ থেকে আমেরিকা নিজের বাহিনী সরিয়ে নেবে, তা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে মানলেও সিরিয়া, ইরাক বা সোমালিয়ায় মানা হচ্ছে না। ইউক্রেন সমস্যায় রাশিয়ার সাথে সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান বার করাও বাইডেনের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। জাপান, অস্ট্রেলিয়া আর ভারতকে নিয়ে ‘কোয়াড অ্যালায়েন্স’ গড়ে তোলাতে চীনের সাথেও ভবিষ্যতে বিরোধ বাড়বে মনে করা হচ্ছে। তবে রাশিয়া আর চীনের সাথে বিরোধ থাকলে আমেরিকার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়।

অবশ্য কিছু ব্যর্থতা আর কম অনুমোদন মানেই সবকিছু শেষ নয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এখনও প্রায় তিন বছর বাকি, এর মধ্যে অনেককিছু পরিবর্তন হতে পারে। কোভিড সমস্যার প্রায় নিশ্চিতভাবেই সমাধান হয়ে যাবে ততদিনে। ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, ট্রাম্প --- এদের কাজের অনুমোদন অনেক সময়েই চল্লিশ শতাংশ বা তার কম ছিল। এদের প্রথম দুজন পুনর্নিবাচিত হয়েছেন, ট্রাম্প না পারলেও এবং মোট হিসেবে প্রচুর ভোটে হারলেও এক হিসেবে জয়ের বেশ কাছাকাছিই ছিলেন --- মাত্র তিন-চারটি বিশেষ রাজ্যে পনের-কুড়ি হাজার করে ভোট বাড়াতে পারলেই (যা দেশের মোট ভোটের অনুপাতে খুব অল্প) আবার নির্বাচিত হতে পারতেন। পুনর্নিবাচিত হবার জন্য বাইডেনের দরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ কর্মীদের আয় বাড়ানো, অর্থনীতিতে গতি বজায় রাখা, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মোটামুটি পালন এবং সঠিক কৌশলে প্রচার। বাইডেন যেসব ভোটারদের আস্থা হারিয়েছেন, তারা মূলতঃ প্রগতিশীল, ডেমোক্র্যাট বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক দলনিরপেক্ষ ভোটার। এদের সমর্থন ফিরে পাওয়াটা তুলনায় অনেক সহজ।   উল্টোদিকে ২০২৩-২০২৪ সাল নাগাদ যদি অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয় (এরকম পূর্বাভাষ আছে --- আমেরিকার অর্থনীতি এক দশকের উপর ধরে ভালো চলছে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক পর্যায়ে হওয়া স্বল্পসময়ের মন্দা বাদ দিলে --- মন্দার চক্র শুরু হতে পারে স্টিমুলাসের অর্থনীতির উপর লোকের বিশ্বাসে টাল খেলে বা ঋণ সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিলে), তাহলে বাইডেনের পরিণতি একমেয়াদের রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার বা জর্জ এইচ ডব্লু বুশের মতো হতে পারে।

ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থক আর ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে থাকা দলনিরপেক্ষ ভোটারদের মধ্যে ২০২৪ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাইডেনকে সরিয়ে অন্য কারুকে প্রার্থী করার ব্যাপারে আধাআধি বিভাজন রয়েছে। এমনিতেই বাইডেনের তখন বিরাশি বছর বয়স হবে, যা রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর ক্ষেত্রে রেকর্ড। প্রথম মেয়াদের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে না দাঁড়ালে প্রার্থী হিসেবে স্বভাবতঃই উপরাষ্ট্রপতির কথা মনে আসে। তবে উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের জনপ্রিয়তা খুব কম, তাঁর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতার ক্ষমতা আছে কিনা সন্দেহ। এ ছাড়া তাঁর নিজের অফিসেরই ছন্নছাড়া অবস্থা, কর্মীরা অনেকেই ইস্তফা দিয়েছেন। বিভিন্ন উদ্যোগে হ্যারিসের উপস্থিতি প্রায় কারুরই চোখে পড়ে না। হিলারি ক্লিন্টনেরও লড়াইয়ের ময়দানে ফেরার কথা শোনা যাচ্ছে, তবে হিলারিও প্রচুর মানুষের বিরাগভাজন ছিলেন, তাঁর জেতার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত নয়। ডেমোক্র্যাটদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেরকম জনপ্রিয় কোনও নেতাকে এখনও চোখে পড়ে নি। এদিকে সুযোগ বুঝে ট্রাম্প আবার ময়দানে ফেরার চেষ্টা করতে পারেন। এতে ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলেও, ট্রাম্পের প্রতি বহু মানুষের তীব্র বিরাগের কারণে, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ট্রাম্পের উপস্থিতি হয়তো বাইডেনকে আবার জিততে সাহায্যই করতে পারে। 

--------------------

লেখার তারিখঃ ২0 জানুয়ারি, ২০২২

প্রথম প্রকাশঃ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২