শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ --- এক অপরিমেয় প্রতিভা

 


প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ --- এক অপরিমেয় প্রতিভা 

শুভাশিস ঘোষাল 


এ বছর অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের জন্মের একশ পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার (statistics) জনক, এক জীবনের পক্ষে এটা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য অবদান, তবে শুধু এইটুকু বললে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, দক্ষ নেতা ও সংগঠক, দেশ গড়ার কারিগর, সমাজসচেতন বিজ্ঞানী ও অসামান্য গবেষক। পরিসংখ্যানবিদ্যায় ভারতীয় গবেষকরা পৃথিবীতে প্রথম সারিতে পড়েন, এটা মহলানবীশ এবং তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলি না থাকলে কিছুতেই সম্ভব হত না।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৯শে জুন, কলকাতা শহরে। তিনি বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রজন্মের সর্বশেষ জীবিত আইকন ছিলেন বলা যেতে পারে। তাঁর পরেও এককভাবে অনেক উজ্জ্বল প্রতিভা জন্মেছেন, যেমন সত্যজিৎ রায়, তবে গোটা প্রজন্ম তেমনভাবে   চোখে পড়ে না। দীর্ঘ ঊনআশি বছরের বর্ণময় ব্যস্ত কর্মজীবনের শেষে তিন সপ্তাহ অসুস্থতার পরে কলকাতার এক নার্সিংহোমে ১৯৭২ সালের ২৮শে জুন তাঁর জীবনাবসান হয়।

মহলানবীশ ছিলেন এক সচ্ছল উদারমনোভাবাপন্ন ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। প্রশান্তচন্দ্রের পিতামহ গুরুচরণ ভাগ্য অনুসন্ধানে কলকাতা শহরে চলে আসেন ও ধীরে ধীরে সফল ব্যবসা গড়ে তোলেন। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের কোষাধক্ষ্য ও পরে সভাপতিও হয়েছিলেন। তাঁর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপের কেন্দ্র ছিল। বহু বাল্যবিধবাকে তিনি নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজেও বিধবাবিবাহ করেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্রের জেঠামশাই সুবোধচন্দ্র এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে মনোবিদ্যার অধ্যাপক ও পরে বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। পিতা প্রবোধচন্দ্র তাঁর পিতার ব্যবসায় প্রথমে যোগদান করে পরে নিজেও সফল ব্যবসা শুরু করেন। প্রশান্তচন্দ্রের মাতা নিরোদবাসিনী দেবী ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের ভগিনী। পরিবারের শিক্ষা, উদার চিন্তাধারা ও ব্যবসায়ী প্রেক্ষাপট প্রশান্তচন্দ্রের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় মহলানবীশের উৎসাহ শুরু হয় কিছুটা আকস্মিকভাবে। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল পদার্থবিদ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। প্রেসিডেন্সিতে সমসাময়িক ছাত্রদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন তাঁর পরের বছরে, আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দু বছর পরে। ১৯১৩ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে  লন্ডন যাত্রা করেন। ঘটনাচক্রে কেম্ব্রিজে বেড়াতে গিয়ে কিংস কলেজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন, ও এক ভারতীয় বন্ধুর পরামর্শ মেনে সেখানেই গণিতশাখায় ভর্তি হন।

কেম্ব্রিজে তাঁর সঙ্গে গণিতের বিরল প্রতিভা রামানুজনের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা দীর্ঘসময় একসাথে হাঁটতে বেরোতেন ও নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। রামানুজনের প্রতিভার বিচ্ছুরণ মহলানবীশের চিন্তাধারায় যথেষ্ট ছাপ ফেলেছিল। এ ছাড়াও কেম্ব্রিজ বাসকালে দার্শনিক লোয়েস ডিকিনসন ও বাট্রান্ড রাসেল এবং গণিতবিদ গডফ্রে হার্ডির সঙ্গে চিন্তাভাবনার  বুদ্ধিগত আদানপ্রদান মহলানবীশের চিন্তাধারায় উদারতা ও সার্বজনীনত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তবে বিমূর্ত গণিতে মহলানবীশের তেমন আগ্রহ গড়ে না ওঠায় তিনি পদার্থবিদ্যায় ফিরে আসেন। ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়ভাগ উত্তীর্ণ হবার পর সি টি আর উইলসনের সাথে কেম্ব্রিজে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য বরিষ্ঠ গবেষকের পদে নির্বাচিত হন।

ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে  গবেষকপদে যোগদানের আগে কিছু সময় হাতে থাকায় মহলানবীশ  ভারতবর্ষে ছুটি কাটাতে আসা মনস্থ করেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তাঁর যাত্রা পিছিয়ে যায়। সেই সময় তিনি কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে নানা বইপত্র পড়ছিলেন। কলেজের এক অধ্যাপক ম্যাকুলার সাথে সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ও ম্যাকুলা একটি বিজ্ঞানপত্রিকার কতগুলি সংখ্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেগুলি ছিল বিজ্ঞানের এক সদ্যজাত শাখা পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর কার্ল পিয়ার্সন প্রতিষ্ঠিত  বায়োমেট্রিকা পত্রিকার। সেখানে প্রকাশিত কিছু গবেষণাপত্র পড়ে মহলানবীশ এতটাই আগ্রহান্বিত হন যে বায়োমেট্রিকার তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবকটি সংখ্যা তিনি কিনে ফেলেন ও দেশে ফেরার পথে  জাহাজে পড়ে ফেলেন। তিনি এর ফলে পরিসংখ্যানবিদ্যার বিপুল সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন। পরিমাপ ও তার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের এই নতুন শাখা বহু ফলিত গবেষণার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। কলকাতা ফিরে তিনি আবহবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ববিদ্যার বেশ কিছু সমস্যার খোঁজ পান যাতে তিনি তাঁর এই নতুন অধিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। কেম্ব্রিজে পদার্থবিদ্যায় বরিষ্ঠ গবেষকের পদে যোগদানের পরিকল্পনা তিনি ত্যাগ করেন ও কলকাতাতেই থেকে যাওয়া মনস্থ করেন।

মহলানবীশ যখন পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং তার প্রয়োগ করছেন, তখন ভারতবর্ষ তো বটেই, সারা পৃথিবীই পরিসংখ্যানবিদ্যা সম্পর্কে খুব কম জানত। তার মাত্র দেড় দশক আগে কার্ল পিয়ার্সন ফ্রিকোয়েন্সি কাই-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত (chi-square statistic) আবিষ্কার করেছেন তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উপলব্ধ সংখ্যার মিল-অমিল পরিমাপ করতে। যাকে আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ্যার জনক বলা হয়, সেই স্যার রনাল্ড ফিশার তখনও প্রখ্যাত হন নি, সবে পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। তৎকালীন বাংলা বা ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে সরকারি বা কর্তৃপক্ষের কাজের অংশ মনে করা হতো। সরকারি নীতি চিন্তাভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরোধী ছিল, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি ছিল না। এমন একটি সময়ে পরাধীন দেশে পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সফল হওয়া মহলানবীশের এক অনন্য কৃতিত্ব, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার।

দেশে ফেরার পর মহলানবীশ প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।  আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, যিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সংস্কারের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯১৭ সালে  তাঁকে পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করার অনুরোধ করেন। এটাই ভারতবর্ষে প্রথম শিক্ষাব্যবস্থায় পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগ। আচার্য শীলের দার্শনিক চিন্তাভাবনা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করলেও মহলানবীশের আগ্রহ বেশী ছিল পরিসংখ্যানবিদ্যাতে। কুড়ির দশকে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণাগার  গড়ে তোলেন। ১৯৩১ সালে সেটি সরকারি নথিকরণ হয় ও প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারেই প্রথম ভারতের সংখ্যাতাত্ত্বিক সংস্থার (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট বা আই এস আই) পত্তন হয়, যা পরে মহীরুহে পরিণত হয়ে ভারতবর্ষ ও সারা বিশ্বে পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৩৩ সালে মহলানবীশ পরিসংখ্যানবিদ্যা সংক্রান্ত ভারতীয় পত্রিকা "সংখ্যা"র প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিসংখ্যানবিদ্যার অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন পত্রিকা। আমৃত্যু তিনি এর সম্পাদনা করেছেন।

তিরিশের দশকে মহলানবীশ তাঁর সবথেকে বিখ্যাত তাত্ত্বিক-প্রণালীগত কাজ মহলানবীশ ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাতের (D^2-statistic) উদ্ভাবন করেন, যদিও কুড়ির দশকের শেষ দিকেই তাঁর কাজে এর আভাস ছিল। কুড়ি আর তিরিশের দশকে ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রায় সমস্ত কাজ মহলানবীশ ও তাঁর ছাত্রদের দ্বারা হয়েছিল। রাজচন্দ্র বোস ও সমরেন্দ্রনাথ রায়, যাঁরা মূলতঃ তাত্ত্বিক গবেষণায় উৎসাহী ছিলেন, তাঁদের গবেষণাও মহলানবীশ ডি-স্কোয়ারের নিবেশন (distribution) সংক্রান্ত ছিল। রাজচন্দ্র বোসের পরীক্ষার নকশা (design of experiment) সংক্রান্ত অনন্য তাত্ত্বিক গবেষণাগুলিও সম্ভব হত না, যদি না মহলানবীশ ফিশারের পরীক্ষার নকশার পদ্ধতিগুলো ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বোসের আগ্রহ সঞ্চার না করতেন। পরে ১৯৫৯ সালে বোস ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী শ্রীখন্ডে এবং পার্কার বিখ্যাত গণিতবিদ অয়লারের গ্রীকো-ল্যাটিন স্কোয়ার (Graeco-Latin square) সংক্রান্ত প্রায় দুশ বছরের পুরোনো একটি গাণিতিক অনুমানকে (conjecture) ভুল প্রমাণ করেন।

মহলানবীশ ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত উদ্ভাবন করেন নৃতত্ত্বের একটি সমস্যার সমাধান করতে। তৎকালীন জুলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রধান নেলসন আন্নাডেল মহলানবীশকে অনুরোধ করেন তাদের কাছে থাকা ইঙ্গ-ভারতীয়দের মাথার খুলি সংক্রান্ত নানা পরিমাপের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে। প্রধান প্রশ্ন ছিল দুটি আলাদা শ্রেণীর লোকেদের বহুমাত্রিক গড় মাপের (multidimensional mean measurement) মধ্যে কোনো মূলগত তফাৎ আছে কি না। এখানে লক্ষ্যণীয় যে যদৃচ্ছতার (randomness) জন্য দুটি শ্রেণীর নমুনাভিত্তিক গড় মাপ (sample mean) সব সময়ের কিছু না কিছু আলাদা হবে। প্রশ্ন হল এইরকম বহুমাত্রিক সংখ্যার মধ্যে দূরত্ব হিসেব করা হবে কি করে, এবং কতটা দূরত্ব হলে বলা যাবে যে দুটি শ্রেণী উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। মহলানবীশ বুঝেছিলেন যে দূরত্বের মাপটা এককের উপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। তাঁর পদার্থবিদ্যার জ্ঞান নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে কাজে লেগেছিল।

মহলানবীশ প্রাথমিকভাবে ডি-স্কোয়ার গঠন করেছিলেন প্রতিটা মাপের গড় দূরত্বকে মাপের আদর্শচ্যুতি (standard deviation) দিয়ে ভাগ করে তাদের বর্গের যোগফল হিসেবে। কিন্তু তারপর তিনি উপলব্ধি করেন যে পারম্পর্যকে (correlation) হিসেবে আনা দরকার। যদি x হয় প্রথম শ্রেণীর পরিমাপ, y দ্বিতীয় শ্রেণীর পরিমাপ, আর S হয় সহভেদাঙ্ক (covariance) ম্যাট্রিক্স (matrix), তাহলে ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত হল ( x - y)'H(x - y), যেখানে x হল x  এর গড় মান, y হল  y এর গড় মান, x' এর অর্থ ভেক্টর রাশি x এর স্থানান্তর (transpose) আর H হল S এর বিপরীত (inverse) ম্যাট্রিক্স। ডি-স্কোয়ারের নমুনা নিবেশন (sampling distribution) ফিশারের এফ-সূত্র (Fisher's F-distribution) মেনে চলে, যা মহলানবীশ পিয়ার্সনের রেখাচিত্র পরিবারের (Pearson's family of distributions) সঙ্গে গড় ঘাত (moment) মিলিয়ে পেয়েছিলেন। এটা অবশ্য প্রকৃত গাণিতিক প্রমাণ নয়, তবে সূত্রটা নির্ভুল, যেটা পরে আই এস আইএর ভারতীয় গবেষকেরাই গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন। তা ছাড়া ডি-স্কোয়ার নির্ভর দুই শ্রেণীর গড়ের সমতা প্রকল্পের (hypothesis of equality) পরীক্ষার ক্ষমতা (power of test) হিসেব করতে ডি-স্কোয়ারের অকেন্দ্রীয় নিবেশন (non-central distribution) জানার দরকার হয়। আই এস আইয়ের গবেষকরা দেখিয়েছিলেন যে সেটা অকেন্দ্রীয় এফ-নিবেশন (non-central F-distribution) মেনে চলে।

বহু ফলিত গবেষণায় মহলানবীশের ডি-স্কোয়ারের অপরিসীম গুরুত্ব। শুধু ডি-স্কোয়ারের জন্যই মহলানবীশ স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন। ফিশার মহলানবীশের এই কাজের বিশেষ প্রশংসা  করেছিলেন। তখনকার আর এক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ কার্ল পিয়ার্সন অবশ্য ডি-স্কোয়ারের কিছুটা সমালোচক ছিলেন, তবে মহলানবীশের মনের প্রসারতা যথেষ্ট ছিল যাতে পিয়ার্সনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা  অটুট ছিল। কেম্ব্রিজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক জ্যাক ট্রেভর আফ্রিকা থেকে আনা বেশ কিছু মানব  দেহের কাঠামোর উপর নেওয়া পরিমাপে মহলানবীশের পদ্ধতি অনুসরন করতে চেয়েছিলেন। মহলানবীশ ট্রেভরের অনুরোধে আর কে মুখার্জি ও পরে প্রখ্যাত হওয়া পরিসংখ্যানবিদ সি আর রাওকে কেম্ব্রিজে পাঠিয়েছিলেন ট্রেভরের সাথে একত্রে কাজ করার জন্য। মহলানবীশ নিজেও পরিমাপভিত্তিক নৃতত্বের উপর ফলিত গবেষণা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলার অন্য সম্প্রদায়ের নৃতাত্ত্বিক মিল বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্য জায়গার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের  মিলের থেকে বেশি। তবে তাঁর অন্য একটা সিদ্ধান্ত, যে কেবলমাত্র বাংলার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সঙ্গেই উত্তর ভারতের বর্ণহিন্দুদের বেশি মিল, পরবর্তী নমুনাতে সমর্থিত হয় নি। আর বাংলার ইঙ্গ-ভারতীয়দের সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বেশি নৃতাত্ত্বিক মিল, তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ খুব সম্ভবতঃ তাঁর নমুনার ত্রুটি। এখন মনে করা হয় মহলানবীশের  নমুনা  মূলতঃ উচ্চশ্রেণীয় ইঙ্গ-ভারতীয়দের থেকে নেওয়া হয়েছিল।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় মহলানবীশের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায়  (large-scale sample survey) গড়ের নমুনাজ বিচ্যুতির (sampling error) পরিমাপ অনুমান করতে  ইন্টারপেনিট্রেটিং সাবসাম্পেল (interpenetrating subsample) পদ্ধতির উদ্ভাবন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত সহজ। এতে নমুনাকে অন্ততঃ দুই ভাগে যদৃচ্ছভাবে আলাদা করে তাদের গড়ের পার্থক্য থেকে বিচ্যুতির অনুমান  করা যায়। ধরা যাক x একটি রাশি যার তাত্ত্বিক গড়কে (population mean) n খানি নমুনার ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই x এর গড়ের অনুমান করতে x এর নমুনা গড় (sample mean) ব্যবহার করা হয়, যাকে আমরা x বলব।  যদি নমুনাকে k খানি সমান ভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতি ভাগের গড়রাশিগুলিকে x(1),...,x(k) বলা হয়, তাহলে x এর গড়ের নমুনাজ বিচ্যুতিকে আন্দাজ করা যাবে (x(1)-x),...,(x(k)-x) এর বর্গের সমষ্টিকে k-1 দিয়ে ভাগ করে তার বর্গমূল নিয়ে। এটা অবশ্য মহলানবীশের পদ্ধতির অত্যন্ত সরলীকরণ করে বলা হল, কারণ বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায়  অনেকগুলি ধাপ থাকে। তা ছাড়া আলাদা আলাদা ভাগে সমসংখ্যক নমুনা না থাকলেও চলে।  মহলানবীশের ইন্টারপেনিট্রেটিং সাবস্যাম্পেল পদ্ধতিকে আধুনিককালের জ্যাকনাইফ (jackknife) ও বুটস্ট্র্যাপ (bootstrap) পদ্ধতির পূর্বসূরি বলা যেতে পারে। নমুনার বিভিন্ন অংশকে কাজে লাগিয়ে বিচ্যুতির অনুমান করার এরকম আধুনিক ধারণা মহলানবীশ তিরিশের দশকেই ভেবেছিলেন ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।

১৯২৫ সালে মহলানবীশ কৃষিক্ষেত্রে সমীক্ষায় সম্ভাব্য ভ্রান্তির (probable error) হিসেব করেন। কৃষি সমীক্ষার একটা বড় সমস্যা হল জমির উর্বরতার তফাৎ ফসলের ফলনশীলতার সঙ্গে বিভ্রান্তি (confounding) সৃষ্টি করে। মহলানবীশের পদ্ধতি ছিল কৃষিজমির একককে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে প্রতিটি পৃথক অংশে বিভিন্ন প্রজাতির ধানের ফলনের পরিমাপ করা যাতে জমির উর্বরতার প্রভাব হিসাব থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই পদ্ধতি তার মাত্র কয়েকবছর আগে ফিশার প্রবর্তন করেছিলেন, যা মহলানবীশের তখনও অজ্ঞাত ছিল। পদ্ধতিটি এখনও সমস্ত কৃষিপরীক্ষায় ব্যবহার হয়। এই সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র মহলানবীশ ছাপানোর পরে ফিশারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডে আবার গেলে তিনি ফিশারের সঙ্গে দেখাও করেন। ফিশারের আবিষ্কৃত বিভিন্ন পদ্ধতির সফল প্রয়োগ ভারতের কৃষিক্ষেত্রে তিনি করেছিলেন। ফিশার মোট চারবার আই এস আই এসেছিলেন ও ১৯৬২ সালে ফিশারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল।

বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষা যা এখনকার দিনে বহুল ব্যবহৃত, তার অনেকাংশই চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহলানবীশের গড়ে তোলা। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে পরিকাঠামো খুবই দুর্বল ছিল তখন এবং তথ্যকে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো, সেসব জায়গার উপযোগী করেই তিনি পদ্ধতিগুলিকে বানিয়েছিলেন। মহলানবীশ এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে উন্নয়নশীল দেশেও নমুনা সমীক্ষা যথাযথভাবে ব্যবহার করলে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভ করা যায় এবং তার থেকে উপলব্ধ জ্ঞান পরিকল্পনায় ব্যবহার করে অনেক উন্নতি করা যায়। ফিশার, হোটেলিং সহ বহু বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ মহলানবীশের পদ্ধতিগুলির ব্যবহারিক মূল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। হোটেলিং বলেছিলেন, "নমুনা সংগ্রহের এত ভাল পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও নেই, যা মহলানবীশের পদ্ধতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে"। মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন যে ফিশার প্রবর্তিত যদৃচ্ছকরণ (randomization) পদ্ধতি শুধুমাত্র পরীক্ষার নক্সা নয়, নমুনা সমীক্ষাতেও বিশেষভাবে কার্যকরী, সমীক্ষকের ব্যক্তিগত পক্ষপাত  (personal bias) দূর করতে। পদার্থবিদ্যার মত সঠিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েও জীববিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ও নৃতত্ত্বের মতো পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে যে বিপুল মাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থান্তর (natural variation) হয়, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ও সেইমতো পদ্ধতিগুলি তৈরি করেছিলেন। বিপুলায়তন নমুনা সমীক্ষায় সর্বোত্তম বরাদ্দ (optimal allocation) অনুমান করতে পাইলট সমীক্ষা (pilot survey) ব্যবহার করার প্রস্তাবও মহলানবীশ দিয়েছিলেন। পাইলট সমীক্ষা পরবর্তীকালে আব্রাহাম ওয়াল্ড প্রবর্তিত ক্রমিক বিশ্লেষনের (sequential analysis) পূর্বসূরী বলা যায়।

মহলানবীশ তাঁর জীবনের শেষের দিকে ১৯৬০ সালে ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস (fractile graphical analysis) নামক আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। ধরা যাক x ও y দুটি রাশি, যেখানে y এর মানগুলি 1, 2, ... ইত্যাদি এবং তাদের ছোট থেকে বড় পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়েছে, এবং তাদের পাশাপাশি সম্পর্কিত xএর মানগুলি দেওয়া রয়েছে x(1),x(2),... । এদের g সংখ্যক পরপর রাশিগুলি একত্র করে গড় করা হয় যদি, এবং সেই গড় মানগুলিকে রেখাচিত্রে পরপর সাজানো হয়, তাদের ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফ বলে। এই রেখাচিত্র দ্বিমাত্রিক নিবেশনের (two-dimensional joint distribution) অন্তর্নিহিত ধর্মকে বুঝতে সাহায্য করে। একাধিক দ্বিমাত্রিক নিবেশনকে এর দ্বারা তুলনা করা যেতে পারে। আধুনিক ব্যাখ্যায় ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফ হল, যখন x রাশি তার মানের t পর্যায়ে আছে, তখন  t এর বিভিন্ন মানের জন্য  y রাশির শর্তাধীন গড়ের (conditional expectation) অনুমান (estimate)। মহলানবীশ  মাথাপিছু মাসিক খরচ (x) ও খাদ্যদ্রব্যে খরচের অনুপাত (y), এই দুটি রাশির পারস্পরিক সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন ও বিভিন্ন সময়ে তাদের সম্পর্কের তুলনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির দরুন তাদের প্রত্যাগতির (regression) সরাসরি তুলনা তেমন অর্থপূর্ণ নয় মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন। ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস তার পরে খুব বেশি আর ব্যবহার হয় নি, তবে ইদানিংকালে এ ব্যাপারে আবার উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। লক্ষণীয় যে ফ্র্যাক্টাইল গ্রাফিকাল অ্যানালিসিস পদ্ধতি  ননপ্যারামেট্রিক রিগ্রেশন (nonparametric regression) পদ্ধতিরও আগে আবিষ্কৃত, যেটা ১৯৬৪ সালে প্রস্তাবিত হয়।

মহলানবীশ ছিলেন সমাজসচেতন এক বিজ্ঞানী। সব সময়ই তিনি এমন কিছু করতে চাইতেন যা সমাজের সরাসরি কাজে লাগবে, তাই ফলিত গবেষণায় মহলানবীশের বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। প্রযুক্তিবিদদের বিশেষজ্ঞ কমিটি বন্যা নিয়ন্ত্রনে একটি বড় জলাধার নির্মানের সুপারিশ করেন, যা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। মহলানবীশের কাছে মতামত চাইলে তিনি বিগত ৫০ বছরের বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য থেকে দেখান জলাধার বন্যা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। যা দরকার তা হল দ্রুত জলনিকাশী নালা। তেমনি উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ্ররা নদীর তলদেশের উচ্চতাবৃদ্ধির আশঙ্কা করে যখন বাঁধের উচ্চতাবৃদ্ধির সুপারিশ করেন, মহলানবীশ বিগত ৬০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত করেন যে নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় নি। নদীর উচ্চ অববাহিকায় বাঁধ দিলে বন্যানিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে সম্ভব। তাঁর বিশ্লেষণ স্বাধীনতার পরে মহানদীর উপর  হীরাকুঁদ বাঁধ নির্মানে বিশেষ কাজে লেগেছিল।

মহলানবীশ ১৯৩৭ সালে বাংলার সরকারে অনুরোধে বাংলায় পাটের ফলন ও বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক বুঝতে একটি সমীক্ষা করেছিলেন, যা ভারতবর্ষে বৃহদায়তন নমুনা সমীক্ষার প্রথম দিকের উদাহরণ। তিনি একটি রিপোর্ট তৈরি করেন হাওড়া ও হুগলি জেলায় সেচ ও জলনিকাশী ব্যবস্থার উপর। দামোদর নদের বন্যার জলকে সেচে পরিণত করতে পারলে ধানের ফলন বৃদ্ধি কতটা হবে তার হিসাবভিত্তিক অনুমান তিনি করেন, যা পরবর্তীকালে দামোদর অববাহিকায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনায় কাজে লাগে। এইসব হিসাব করতে মহলানবীশ যে ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সেই ধরনের হিসাব পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা পায় অপারেশন রিসার্চ নামে। ১৯৪০ সালে বাংলায় গ্রাম ও শহরে পরিবারপিছু খরচের সমীক্ষা ও বিশ্লেষণও তিনি করেছিলেন। শিক্ষাপদ্ধতির পরীক্ষায় তিনি বাংলায় সমষ্টিগত পরীক্ষার নকশা করেন যা আই এস আই তে ব্যবহার করা হত, এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিমাপ ও বিদ্যালয় শেষের পরীক্ষার ফলাফলের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করাতে কাজে লাগানো হত। এইধরণের কাজের জন্য আই এস আই তে একটি আলাদা বিভাগও প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মহলানবীশের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল রেখাচিত্র আর সংখ্যার সারি (table) দেখে সম্ভাব্য ভুল চিহ্নিত করা। তিনি সবসময় তথ্যরাশিকে (dataset) খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন, কারণ বহু সময়েই তাতে নথিকরণ (registration) ও প্রকাশ (tabulation) করার সময়ে অনবধানতাবশতঃ ভ্রম (non-sampling human error) ঢুকে যায়, যেটা অনেক সময়েই চিন্তা করলে ধরা পড়ে ও সম্ভাব্য সঠিক মান অনুমান করা যায়। তা না করলে ত্রুটিপূর্ণ তথ্যরাশি বিশ্লেষণ করে ভুল সিদ্ধান্ত করার সম্ভাবনা থাকে। একজন নৃতত্ত্ববিদ রিশলি  নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের একটি বড় তথ্যরাশি সংগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু অনেক  অনবধনতাবশতঃ ভ্রম থাকায় সেটা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অযোগ্য মনে করা হত। মহলানবীশ রিশলির তথ্যরাশি খুঁটিয়ে দেখে সম্ভাব্য সঠিক তথ্যরাশি পুনর্নির্মান করেছিলেন, যা ফিশারের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল।

তথ্যরাশি দেখে তার থেকে পরীক্ষাভিত্তিক সূত্র (empirical law) বের করার ব্যাপারেও মহলানবীশ বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জমির জরিপে একরভিত্তিক উৎপাদনের ভেদমানের (variance) একটি ঘাতের  সূত্র (power law) তিনি তথ্যরাশি থেকে বের করেছিলেন ও তার ভিত্তিতে প্রস্তাব করেছিলেন যে চার ফুট ব্যাসার্ধের একটি গোলাকার অঞ্চল থেকে সমীক্ষার জন্য ফসলের নমুনা সংগ্রহের। এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন যা সমীক্ষকরা  সঙ্গে করেই নিয়ে যেতে পারতেন। এর ফলে নমুনা সংগ্রহ আগের থেকে অনেক সহজ হয়ে যায়। এর আগে আরও অনেক বড় আয়তক্ষেত্র আকৃতির জায়গার প্রথমে সীমানা চিহ্নিত করতে হত ও তার থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হত যা অনেক বেশী শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ছিল। মহলানবীশের চিন্তাভাবনায় সবসময়ই গবেষণার সরাসরি প্রয়োগ প্রাধান্য পেত।

পরিসংখ্যানবিদ্যায় অসামান্য অবদান ছাড়াও যে কারণে মহলানবীশ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হল তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নেতৃত্বগুণের জন্য। মহলানবীশ আই এস আই এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আগেই বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি ছোট গবেষণাগারে যার প্রতিষ্ঠা, যার শুরু মাত্র ২৩৮ টাকার মূলধন নিয়ে, সেই আই এস আই  ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, মহলানবীশের মৃত্যুর সময় যার বাৎসরিক আয়ব্যয় দাঁড়িয়েছিল দুকোটি টাকায়, দু হাজার কর্মী কাজ করত, কলকাতার মূল কেন্দ্র ছাড়াও আরও আটটি কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল --- বলা বাহুল্য এখন এই সংখ্যাগুলো আরও অনেকগুণ বেড়েছে। অবশ্যই এই বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়েছিল। প্রথমে সরকার থেকে আড়াই হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যায়, যা ১৯৩৫ এ বেড়ে সাড়ে সাত হাজার হয়েছিল। বাংলার সরকারের থেকে ১৯৩৬ সালে পাঁচ হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যায়। ১৯৩৬ এ ব্রিটিশ সরকারের  প্রতিনিধি স্যার জন রাশেল ও ১৯৩৭ এ বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর সফরের পর কিছুটা আর্থিক অনুদান বাড়ে। চল্লিশের দশকে সি দেশমুখের ঐকান্তিক চেষ্টায় পরিস্থিতির  উন্নতি হয় ও আই এস আইএর কাজের পরিসর বাড়ে।

আই এস আই মডেল অনুসরণ করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেট্রুড কক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা কিনা তার আগে পর্যন্ত গণিত বিভাগের অন্তর্গত হত। মহলানবীশ ছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও বিজ্ঞানীরা মহলানবীশের জীবিতকালেই আই এস আই এ কাজ করেছেন, যথা সি আর রাও, রাজচন্দ্র বোস, সমরেন্দ্রনাথ রায়, রঘুরাজ বাহাদুর, গোপীনাথ কল্যাণপুর, এস এস বোস, জে এম সেনগুপ্ত, ডি বি লাহিড়ি, কে আর নায়ার, কে কিষেণ, অনিল ভট্টাচার্য, অজিত দাসগুপ্ত, জয়ন্ত কুমার ঘোষ প্রমুখ। প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীবনবিজ্ঞানী জে বি এস হল্ডেন ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বায়োমেট্রি বিভাগের প্রধান হিসেবে আই এস আই তে যোগ দেন। প্রথমদিকে আই এস আইতে যেসব কাজ হত তা হল ফসলের ফলন অনুমান করা, ভোগ্যপণ্যের খরচ বিশ্লেষণ, জনসাধারণের মতামত সমীক্ষা, নমুনা সমীক্ষার পরিকল্পনা, তথ্যের নথিকরণ এবং গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ্যায় গবেষণা। ১৯৩৮ সাল থেকে প্রশিক্ষণ ও শংসাপত্র দেওয়া শুরু হয়। আই এস আইএর কাজ তখন হত অনুদানভিত্তিক প্রকল্পে (grant-funded projects), যাতে চাকরির নিরাপত্তা কম ছিল। রাজচন্দ্র বোস ও সমরেন্দ্রনাথ রায় আই এস আই ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপকের পদে যোগ দেন, নায়ার ও অন্যান্যরা সরকারি চাকরি নেন। সি আর রাও গবেষণা ও প্রশিক্ষণের প্রধান অধ্যাপক হন। ১৯৫১ সালে আই এস আই বরাহনগরে  নতুন কেনা তিন একর জমিতে স্থানান্তরিত হয়। নতুন গ্রন্থাগার ও অন্যান্য ভবন তৈরি হয়। স্যার রনাল্ড ফিশার নতুন বিদ্যায়তনের উদবোধন করেন। প্রেসিডেন্সির পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণাগারও আই এস আই তে মিশে যায়।

পঞ্চাশের দশকে আই এস আই এর দায়িত্ব আরও বাড়ে, ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গ্যানাইজেশনের (National Sample Survey Organization) যোগাড় করা তথ্য নথিকরণ ও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার জন্য। দেশ স্বাধীন হবার পরে দেশীয় শিল্পের গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরামর্শ (statistical consulting) দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কলকাতা ও দিল্লীতে পরিকল্পনা শাখা, সমাজতত্ত্ব ও জনতত্ত্ব (demography) এর আলাদা বিভাগ কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হয়। বৈদ্যুতিন (electronics) গবেষণা বিভাগ খোলায় কারিগরিবিদ্যার অনেক অধ্যাপক যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু, অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ (যিনি আই এস আই এর প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন, কেম্ব্রিজে থাকাকালীনই যার সঙ্গে মহলানবীশের বিশেষ পরিচয়) ও কেন্দ্রীয় সরকারে প্রভাবশালী পিতাম্বর পন্থের সাথে মহলানবীশের ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। এরা সকলেই আই এস আই এর গড়ে ওঠায় বিশেষ সহযোগিতা করেন। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় আই এস আই অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়, যাতে আই এস আই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। তার ফলে আই এস আই স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উপাধি দেবার অধিকার পায়। প্রথম যুগের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও গণিতবিদ হয়েছিলেন যথা দেবব্রত বাসু, জি পি পাতিল, সুজিত মিত্র, যোগব্রত রায়, ভি এস বরদারাজন, কে আর পার্থসারথি, আর রঙ্গ রাও এবং শ্রীনিবাস বরধন (গণিতের এক সর্বোচ্চ সম্মান আবেল পুরষ্কার বিজেতা)। বিশিষ্ট ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ পামেলা রবিনসনের নেতৃত্বে ভূতত্ত্ববিভাগ (geology) শুরু হয় ও জীবাশ্মবিদ্যা (paleontology) গবেষণায় বিশেষ সাফল্যলাভ করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষকদলই ভারতবর্ষে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসোর জীবাশ্ম উদ্ধার করে। এডুইন হার্পার সাইকোমেট্রি শাখার প্রধান হন। যুগোস্লাভিয়া থেকে এসে ডি কোস্টিক ফোনেটিক্স বিভাগ খোলেন। এক সঙ্গে এতজন বিখ্যাত বিদেশী বিজ্ঞানীর একটি দেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একরকম অবিশ্বাস্য।

পঞ্চাশের দশকে যন্ত্রগণক বিভাগ শুরু হয় ও ভারতবর্ষের প্রথম যন্ত্রগণক (computer) আই এস আইতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা হয়। পরিসংখ্যানবিদ্যার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থায় এত বহুবিধ বিষয়ের গবেষণার সুযোগ থাকা একরকম অভাবনীয়। এতে মহলানবীশের বিস্তৃত চিন্তাধারা, অন্তর্দৃষ্টি ও সবরকমের বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ জন টুকির উক্তি স্মরণীয়, "পরিসংখ্যানবিদ হবার সবথেকে ভাল দিক হল যে সব বিষয়ের উঠোনেই খেলা করা যায়।" তাঁর উদারপন্থী মতের প্রতিষ্ঠার জন্য মহলানবীশ ত্যাগ স্বীকারেও রাজী ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠান চালানো ও স্বশাসন নিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আই এস আই এর কেবলমাত্র সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণাতেই জোর দেওয়া উচিৎ, যেমন ভারতবর্ষের অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান তখন করত। আই এস আই প্রচন্ডভাবেই সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। মহলানবীশের মত ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণার পরিসর অনেক বড়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সরতে হলে তিনি নির্দেশকের পদ ছেড়ে দিয়ে নতুন সংস্থা গড়বেন। সরকার মহলানবীশের মত মেনে নেন।

আই এস আই মহলানবীশের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিল। তিনি ভবনগুলির স্থাপত্যের নক্সাও করতেন। আই এস আই এ যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসতেন, তাঁদের জন্য তিনি তাজমহল দেখার একটি গাইডবই পর্যন্ত লিখেছিলেন। আই এস আই তখন সারা পৃথিবীতে কতটা গুরুত্ব পেত সেটা কারা সেসময় আই এস আই এসেছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। ফিশার তো বটেই, বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদদের মধ্যে সংখ্যাতাত্বিক মান নিয়ন্ত্রণের (statistical quality control) উদ্ভাবক ডব্লু ই ডেমিং ও ওয়াল্টার শুয়ার্ট, নমুনাতত্ত্বের (sampling theory) উইলিয়াম হারউইটজ ও ফ্র্যাঙ্ক ইয়েটস, সংখ্যাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের (statistical inference) জের্জি নেম্যান, আব্রাহাম ওয়াল্ড,  হ্যারল্ড হোটেলিং, পরীক্ষার নক্সা (design of experiments) বিশেষজ্ঞ জি কিটাগাওয়া ও টি তাগিউচি, সম্ভাবনাতত্ত্ব (probability theory) ও গণিতের শ্রেষ্ঠ গবেষকদের মধ্যে আধুনিক সম্ভাবনাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শেষ্ঠ গণিতবিদ এ এন কল্মোগোরভ, নর্বার্ট ভিনার (যিনি ছ মাস ছিলেন ও ভারতীয় গণিতবিদ পি মাসানির সাথে একসাথে বহুচলক সময়শ্রেণী (multivariate time series) ভবিষ্যৎ গণনার উপর গবেষণাপত্র লেখেন), ইউ ভি লিনিক ও জে এল ডুব প্রমুখ অনেকে মহলানবীশের আমন্ত্রণে একাধিকবারও এসেছিলেন। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিশিষ্টদের মধ্যে এসেছিলেন নিলস বোর, ফ্রেডেরিক ও আইরিন জোলিএ কুরি, জে ডি বার্নাল, আর্থার লিন্ডার ও অর্থনীতিবিদ ইয়ান টিনবের্খেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু , যারা মহলানবীশের সমবয়সী ছিলেন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ই যাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, আই এস আই এর উপদেষ্টা ও হিতাকাংক্ষী ছিলেন । সত্যেন্দ্রনাথ বসু আই এস আই এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন আট বছর। এ ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন সময়ে আই এস আই তে এসেছেন মহলানবীশের আমন্ত্রণে, যেমন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের অবিসংবাদী নেতা হো চি মিন, বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গ্বেভারা, সোভিয়েত  উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন, মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি (পরে রাষ্ট্রপতি) লিন্ডন জনসন। চৌ এন লাই মহলানবীশকে চীনের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করারও অনুরোধ জানান। বলা বাহুল্য, মহলানবীশের প্রবল ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছাড়া এতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আই এস আই সম্পর্কে উৎসাহী করা সম্ভব ছিল না।

মহলানবীশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি যেমন অনন্য ছিল, তেমন ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা। মূলতঃ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য তিনি আই এস আই এর মধ্যে ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল এডুকেশন সেন্টার (আইসেক) গঠন করেন, যা এখনও সেইসব দেশের সরকারি কর্মীদের পরিসংখ্যানবিদ্যায় তালিম দেয়। একটি সদ্য স্বাধীন হওয়া উন্নয়নশীল দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে শিক্ষার প্রসারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, এমন নজির সারা পৃথিবীতে দুর্লভ।

মহলানবীশ ১৯৪৯ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাতাত্বিক উপদেষ্টা ও জাতীয় আয় কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন। সেই সময় তিনি দেশের ম্যাক্রো-ইকনমিক সমস্যাগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। জাতীয় আয় হিসেব করার জন্য তথ্যের অভাব ছিল। সেই অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে মহলানবীশ ১৯৫০ সালে ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গ্যানাইজেশন গঠন করেন, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা দফতরের অন্তর্গত ছিল। সারা দেশে নমুনা সমীক্ষা করে ভারত সরকারকে  নানা পরিকল্পনা রূপায়ণে সাহায্য করা ছিল এর উদ্দেশ্য। মহলানবীশ উপলব্ধি করেছিলেন যে উন্নত দেশে করা সমীক্ষার পদ্ধতি ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। কুড়ি বছরের মধ্যে বেকারি কমানো ও জাতীয় আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে তিনি টু-সেক্টর মডেল (two-sector model) উদ্ভাবন করেন । এতে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগের ফলে সময়ের সাথে জাতীয় আয়ের পরিমানের সম্পর্কের এইরূপ একটি সমীকরণ দেন ---
                  Y(t)=Y(0)[1+I(0) ((p(1)b(1)+p(2)b(2))/(p(1)b(1)) (1+p(1)b(1))^t],
যেখানে  Y(t)  হল  t সময়ে জাতীয় আয়, I(0) শুরুর বিনিয়োগের পরিমাণ, p(1) ও p(2) হল যথাক্রমে  বিনিয়োগ ও ভোগ্যপণ্যে বিনিয়োগের অনুপাত,  b(1) ও b(2) হল সহগ (coefficient) যাদের পরিসংখ্যান থেকে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান করতে হবে। এই সমীকরণ ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি প্রস্তাব করেন অবশেষ অনুপাত (limiting rate) আঠারো শতাংশ করার জন্য উৎপাদন ক্ষেত্রে তিরিশ শতাংশ বিনিয়োগের, যা ভারত সরকার গ্রহণ করেন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। পরে  মহলানবীশ তাঁর টু-সেক্টর মডেলকে আরও উন্নত করে ফোর-সেক্টর মডেল (four-sector model) প্রস্তাব করেন, যাতে ভোগ্যপণ্যের  তিনটি  শ্রেণী --- শিল্পজাত, হস্তশিল্প ও কৃষিজাত এবং পরিষেবা সংক্রান্ত, আলাদা করে হিসাব করা হয়।

ভারতবর্ষের উন্নয়নে মহলানবীশের আর এক বিশাল অবদান দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়া। জহরলাল নেহরু তাঁকে এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন। মহলানবীশের অর্থনীতিতে প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তাতে তাঁর চিন্তাধারায় কিছুটা প্রথাবিরোধিতা ছিল, যাতে হয়তো সুবিধাই হয়েছে নতুন চিন্তাভাবনা করতে। সমস্যার সমাধানে তিনি কিছু সহজ গাণিতিক কাঠামো (mathematical model) প্রস্তাব করেন যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বিপুল প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এ দেশে বেকারি, দারিদ্র্য আর জনস্বাস্থ্যের সমস্যা।  দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি পরিকাঠামো ও ভারী শিল্পে জোর দিয়েছিলেন, কৃষিকে সাময়িকভাবে কিছুটা কম অগ্রাধিকার দিয়ে। মহলানবীশ পরিকল্পিত অর্থনীতি ও বৃহৎ সরকারি বিনিয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এই সময় ভিলাই, দুর্গাপুর, রৌরকেল্লা ইত্যাদি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতোত্তর ভারতের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তাকে  স্বাবলম্বী করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পিত অর্থনীতির সাফল্য নিঃসন্দেহে তাঁকে অনুপ্রেরিত করেছিল। অর্থনৈতিক উদারীকরণের আগে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার খুব বেশী না হলেও ভারতবর্ষে  কখনও তেমন কোনও অর্থনৈতিক সংকট না হওয়ার কারণ এই শক্ত বুনিয়াদ। পক্ষান্তরে  উপনিবেশিক শাসন থেকে ওই সময় মুক্ত হওয়া বহু দেশ তুলনায় অবস্থাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও একের পর এক সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে অপ্রস্তুত অবস্থায় বাজার অর্থনীতির পথ নিয়ে।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে, বিশেষতঃ পরিসংখ্যানবিদ্যার চর্চায় আই এস আইএর কাজকর্মের বাইরেও মহলানবীশ বিশেষ ভূমিকা নেন। ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর সম্মেলন হয়।  স্যার রনাল্ড ফিশার সেই অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উপাধি দেওয়া শুরু হয় ১৯৪১ সাল থেকে। মহলানবীশ তখন সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। লক্ষ্যণীয় তখন পৃথিবীর প্রায় কোথাওই আলাদা পরিসংখ্যানবিদ্যার বিভাগ ছিল না। তাঁর চেষ্টায় ১৯৪২ সালে পরিসংখ্যানবিদ্যা ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিতের শাখা হিসেবে। ১৯৪৫ সালেই তা পৃথক শাখার মর্যাদা লাভ করে। তাঁর মত ছিল দেশের উন্নতিতে বিজ্ঞানচর্চা এক অপরিহার্য শর্ত এবং তার জন্য সরকারি ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিবিদদের মতমত নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৬১ সালে ভারতবর্ষের সরকারি পরিসংখ্যানের কাজের জন্য ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল সার্ভিস শুরু করা হয়।

সারা জীবনে মহলানবীশ নানা সরকারি  ও শিক্ষাক্ষেত্রে দায়িত্ব সামলেছেন, অনেক সময় একসাথে বহু দায়িত্ব, যথা আই এস আই এর নির্দেশক (১৯৩১--১৯৭২), সংখ্যার সম্পাদক (১৯৩৩--১৯৭২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রধান (১৯৪১--১৯৪৫)। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা  ছাড়াও অধ্যক্ষ পদেও ছিলেন কিছুদিন (১৯৪৫--১৯৪৮)। এ ছাড়া কলকাতায় পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা আবহবিদ (১৯২২--১৯২৬), বাংলা ও ভারত সরকারের উপদেষ্টা (১৯৪৫--১৯৪৮, ১৯৪৯--১৯৭২), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (১৯৫৫--১৯৬৭), দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান (১৯৫৩--১৯৫৮), ন্যাশানাল সাম্পেল সার্ভের প্রধান (১৯৫০--১৯৭২), বিশ্বভারতীর কর্মসচিব (১৯২১--১৯৩১) ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দফতরের অধীনে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গ্যানাইজেশন গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। বেকারি ছিল দেশের এক প্রধান সমস্যা। বেকারির সমাধানে মহলানবীশ প্রস্তাবিত লেবার রিসার্ভ সার্ভিস নামক একটি নীতি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে কোনও ছাঁটাই হলে কোম্পানিদের লেবার রিসার্ভ সার্ভিসে কিছু টাকা জমা দিতে হত, ফলে কোম্পানিগুলি ছাঁটাইয়ের পথে যেত তখনই যদি এর ফলে তাদের লাভ জমা দেওয়া টাকার থেকে বেশী হত। জমার টাকা থেকে লেবার রিজার্ভ সার্ভিস ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিত, যাতে তারা আবার চাকরি পাবার উপযুক্ত হতে পারে। ট্রেনিং এর সময় সেইসব কর্মীদের টাকাও দেওয়া হত, তবে পূর্ণ  কর্মসংস্থানের থেকে কিছুটা কম হারে। ফলে তাদেরও উৎসাহ থাকত স্বাভাবিক চাকরিতে ফেরত যাবার। মহলানবীশের এই মডেলে যেমন বেকারি প্রতিরোধে কিছুটা পরিসর থাকত, তেমনি অর্থনীতির প্রসারের সাথে দক্ষ কর্মীর অভাবের সমস্যা কমানো যেত।

পরিসংখ্যানবিদ্যার বাইরেও মহলানবীশের বিস্তৃতক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল। তাঁর জীবনে পারিবারিক ঐতিহ্য, উদারতা ও শিক্ষার অপরিসীম ভূমিকা ছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর কাজে প্রগতিশীল মনোভাব প্রকাশ পেত। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতেও তিনি পিছপা হতেন না। যৌবনকালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সহকারি সচিব, কোষাধ্যক্ষ ও সবশেষে সভাপতিও হয়েছিলেন। হিন্দুসমাজের তুলনায় প্রগতিশীল হওয়া সত্বেও ব্রাহ্মসমাজেও গোঁড়ামি ছিল। ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার ও রবীন্দ্রনাথের উদারপন্থী চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন। সেখানে তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। তাঁরা দুজনে মিলে "কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই?" পুস্তিকা রচনা করে রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মসমাজের  নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রাহ্মদের হিন্দুবিবাহমতে রেজিস্ট্রেশন করার ব্যাপারেও তিনি আপত্তি জানান। এমনকি এজন্য নিজের বিবাহের সময়ও তাঁর ভাবী শ্বশুরমশাই সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। হেরম্বচন্দ্রের কন্যা নির্মলকুমারীকে (রানী) মহলানবীশ বিবাহ করতে চাইলে হেরম্বচন্দ্র সেই কারণে গররাজি হন। মহলানবীশের নিজের বাড়ির লোকেও এই বিবাহে অংশ নেন নি, যদিও কোনও বাধাও দেন নি তাঁরা। মামা নীলরতন সরকার তাঁর বিবাহ দেন নির্মলকুমারীর সাথে। এর কিছুদিনের মধ্যেই মহলানবীশ "ব্রাহ্মবিবাহ বিধি" বলে একটি বই লেখেন, যা ব্রাহ্ম আচারের একটা প্রামাণ্য বই।

মহলানবীশ রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাঁর বিবাহে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ও "বসন্ত" নাটকটি লিখে নবদম্পতিকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের গুলিচালনা ও হত্যাকান্ডের পর কবি অত্যন্ত মনোকষ্টে ছিলেন। এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদ করে তিনি তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেন। সেইসময় তাঁর এই প্রতিবাদে গান্ধিজী ও কংগ্রেসের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বকে তেমনভাবে পাশে না পেয়ে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন। মহলানবীশ সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ মানসিক সাহচর্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সচিব হিসেবে মহলানবীশ বহুদিন কাজ করেছেন। কবি নিজেও মাঝে মাঝে  প্রেসিডেন্সির গবেষণাগার পরিদর্শনে  আসতেন ও খোঁজখবর নিতেন। ১৯৪১ সালে বরাহনগরে মহলানবীশ আমগাছে ছাওয়া যে বাগানবাড়ি কিনেছিলেন, পরে যার লাগোয়া জমিতে আই এস আই এর নতুন বিদ্যায়তন গড়ে ওঠে, রবীন্দ্রনাথ তার নামকরণ করেছিলেন "আম্রপালি"। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা খুব মিলত। তাঁরা দুজনেই মনে করতেন ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁরা দুজনেই জাতীয়তাবাদের প্রচলিত রূপ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, কারণ তা যে উপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে, প্রকারান্তরে তাকেই সে অনুকরণ করে। মহলানবীশও রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন ও বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করেছিলেন। মহলানবীশের উদ্যোগে আই এস আই এ তাঁর বাসস্থান গুপ্তনিবাসে রবীন্দ্রনাথ অতিথি হয়েছিলেন ও নেহরুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। "জনগণমন" কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব নেহরু তখনই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

তবে প্রথাগত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হলেও মহলানবীশের দেশের মানুষের জন্য বিশেষ অনুভুতি ছিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি বর্মায় ব্রিটিশ শক্তির পতন হলে সৈন্যদের খোরাকির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার বাংলা থেকে চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে নেয় ন্যূন্যতম বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। চালের দাম হুহু করে বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কালোবাজারি মজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয় না। বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতবিদ্বেষী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল কান দেন নি। কুড়ি থেকে তিরিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায় বাংলায় মানুষের তৈরি এই কৃত্রিম অন্নাভাবে যা সম্পূর্ণ এড়ানো সম্ভব ছিল।  নৃতত্ত্ববিদ কে পি চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে মহলানবীশ একটি রিপোর্ট ও গবেষণাপত্র লেখেন ও লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটিতে আর্ল অফ মুন্সটারের সামনে পাঠ করেন। তথ্য সহযোগে তিনি এই দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেন কারুকে সরাসরি দোষারোপ না করেই। ব্রিটিশ সরকারের এই অমানবিক দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতির বিরুদ্ধে ব্রিটেনেই যথেষ্ট জনমত গড়ে ওঠে, যাতে মহলানবীশের রিপোর্টের বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্ত্রী রানী মহলানবীশের সাথে স্বাধীনতার পরে পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে তিনি কল্যানশ্রী প্রকল্প চালু করেছিলেন। এতে উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যদের হাতের কাজ শেখানো হত ও স্বনির্ভর হবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।

মহলানবীশ কখনও সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন নি বা কোনও রাজনৈতিক বক্তব্যও রাখেন নি কখনও। তবে তাঁর চিন্তাধারা যে অনেকটাই বামপন্থী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ও বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে করা তাঁর প্রস্তাবগুলি অনেকাংশেই সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে করা। আর পারিবারিক সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন মানবিকতা ও উদারপন্থী চিন্তাধারা।

 বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও মহলানবীশের বিশেষ টান ছিল। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসা ও নিজের লেখালিখি (ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথের উপরে) ছাড়াও কেম্ব্রিজে থাকার সময় মহলানবীশের উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চার একটা সমিতি করা হয়েছিল যা নিয়মিতভাবে মিলিত হত ও সংস্কৃতি চর্চা করত। এই সমিতিতে বাংলায় কথা বলা বাধ্যতামূলক ছিল --- ইংরাজি ভাষা ব্যবহার করলে জরিমানা নেওয়া হত। সেই যুগে, যখন শিক্ষিত বাঙালি প্রায়ই ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ করত, তখন এ ধরণের উদ্যোগ অভাবনীয়। এমনকি এ যুগেও, যখন বাংলার চর্চা সংকুচিত হচ্ছে, মহলানবীশের বাংলা ভাষা চর্চার উদ্যোগ স্মরণীয়।

উত্তরাধিকারসূত্রে মহলানবীশ রক্তে উদ্যোগপতিত্ব (entrepreneurship) পেয়েছিলেন। সংখ্যা পত্রিকার ছাপা তখন কলকাতায় যে মানের হত, মহলানবীশের সেটা পছন্দ ছিল না। সংখ্যা ভালভাবে ছাপানোর জন্য তিনি তাঁর কলকাতার বাড়িতে একা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার দেখাশুনো তিনি নিজেই করতেন। পরে তা  পরিসংখ্যানবিদ্যা সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্যও ব্যবহার হয়, ও স্ট্যাটিস্টিকাল পাবলিশিং সোসাইটি নামে খ্যাত হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটি উন্নতমানের ছাপার যন্ত্র উপহার পেলে তিনি ত্রৈকা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার অর্ধেক কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলির ইংরাজী অনুবাদ ছাপানো। এমনকি মহলানবীশ আই এস আই এ বানিজ্যিকভাবে যন্ত্রগণক  তৈরি করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যদিও সে চেষ্টা ফলপ্রসু হয় নি। এটি হয়তো মহলানবীশের একমাত্র উদ্যোগক্ষেত্রে ব্যর্থতার উদাহরণ। তবে ব্যর্থতা সত্ত্বেও এতেও মহলানবীশের পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য ও উদ্যোগপতির গুণ লক্ষ্য করা যায়।

মহলানবীশের অপূর্ব সাংঠনিক ক্ষমতার তুলনা খুব কমই পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মহলানবীশের বিশেষ বন্ধু আর এক দক্ষ সংগঠক অধ্যাপক বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার কথা মনে পড়ে। অভিজাত স্বচ্ছল পরিবারের মহলানবীশকে হয়তো মেঘনাদের মত তেমন সামাজিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয় নি, তবে পরিসংখ্যানবিদ্যার মত বিজ্ঞানের একটা পুরোপুরি নতুন শাখা, যার গুরুত্ব তখন সারা পৃথিবীতেই খুব কম লোকে বুঝত, তা তিনি পরাধীন দেশে প্রায় একার চেষ্টায় প্রচলন করেছিলেন ও ভারতবর্ষকে সারা পৃথিবীতে পরিসংখ্যানবিদ্যার গবেষণা ও প্রয়োগে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মহলানবীশের অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় আজ জীবনের প্রায় সব ব্যাপারেই পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগে। আর একসাথে এতগুলি প্রতিষ্ঠান ও পদের দায়িত্ব পালন করার দৃষ্টান্তও সারা পৃথিবীতে খুব কম আছে। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সংগঠক হিসেবে মহলানবীশের প্রায় এই অলৌকিক সাফল্যের ব্যাখ্যা ডঃ অশোক রুদ্র দেবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মহলানবীশ স্মারক বক্তৃতায় এই বলে যে তা ইতিহাসের বিরল অসাধারণত্ব, যা হয়তো পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়, তবে তার থেকে বিশেষ শিক্ষালাভ সম্ভব।

সারা জীবনে মহলানবীশ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন, যেমন ফেলো অফ দি ন্যাশানাল  সায়েন্স অ্যাকাডেমি (১৯৩৫), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েল্ডন গোল্ড মেডাল (১৯৪৪), লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (১৯৪৫), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি (১৯৫০),মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইকনমেট্রিক সোসাইটির ফেলো (১৯৫১), পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৫২), রয়্যাল সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো (১৯৫৪), কেম্ব্রিজ কিংস কলেজের ফেলো (১৯৫৯), ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি (১৯৫৭), দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারি গোল্ড মেডাল (১৯৫৭), সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সের বিদেশী সদস্য (১৯৫৮), আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৬১), দুর্গাপ্রসাদ খৈতান গোল্ড মেডাল (১৯৬১), ফেলো অফ দি ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স (১৯৬৩), চেকোস্লোভাক অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সেস গোল্ড মেডাল (১৯৬৩), শ্রীনিবাস রামানুজান গোল্ড মেডাল (১৯৬৮)। এ ছাড়া তিনি পদ্মবিভূষণ ও দেশিকোত্তম সম্মান পান ও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট হয়েছিলেন। বিশ্বব্যপী ঠান্ডা যুদ্ধের সেই কালে তিনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন যাঁরা বিশ্বের সর্বত্র আদরণীয় ছিলেন।

মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু লিখতে হলে তাঁর স্ত্রী রানী মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু না লিখলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা বিদুষী মহিলা ও মহলানবীশের যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপর "বাইশে শ্রাবণ" নামক একটি বই লিখেছিলেন কবির সাথের তাঁর ব্যক্তিগত আদানপ্রদানের স্মৃতি থেকে। স্বামীর সাথে রানীও নানা সমাজকল্যানের কাজে অংশ নিতেন। আই এস আই এর কাজকর্মে রানীর বিশেষ ভূমিকা ছিল। আই এস আই এর অতিথিনিবাস আম্রপালি তিনি নিজের মনের মত করে সাজিয়েছিলেন। আই এস আই এ প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা ও সৌন্দর্যায়নে তাঁদের দুজনেরই বিশেষ নজর ছিল। আই এস আই এ প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যারা পদার্পন করেছিলেন, মহলানবীশ দম্পতির আগ্রহে প্রত্যেকে বৃক্ষরোপণে অংশ নিয়েছিলেন। কর্মীদের কাছেও এই বৃক্ষরোপণ স্মরণীয় উৎসব ছিল। নিঃসন্তান এই দম্পতির কাছে আই এস আই এর ছাত্র ও কর্মীরাই সন্তানের তুল্য ছিল। তারাও মহলানবীশ দম্পতিকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। আই এস আই তে বহু অধ্যাপক থাকলেও প্রফেসর বলতে তখন শুধু মহলানবীশকেই বোঝাত। মহলানবীশ দম্পতির প্রতিষ্ঠিত আই এস আই ক্লাব এখনও ছাত্র ও কর্মীদের সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। মহলানবীশের জন্মদিন ২৯শে জুন এখনও প্রতিবছর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন হয়, যেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী সমস্ত কর্মী ও ছাত্ররা একসাথে মধ্যাহ্ণভোজ করেন।

সবশেষে মহলানবীশের নিজের বলা কথা দিয়ে শেষ করতে হয়। তিনি বলতেন যে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও গবেষণার সবসময় একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সারা জীবন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি তা বুঝিয়েছেন। তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যাকে শুধুমাত্র সম্ভাবনাতত্ত্বভিত্তিক নিয়মমাফিক তথ্যের বিশ্লেষণ কিংবা নিছক সরকারি সিদ্ধান্ত নেবার সহায়ক বলে মনে করেন নি। তিনি একে একটা সর্বব্যাপী স্বাভাবিক তথ্যভিত্তিক জ্ঞান আরোহনের বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছিলেন, যা কি না শেষমেষ মানবকল্যাণের নানা কাজে ব্যবহার হবে। গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ্যায় (mathematical statistics) যাতে গণিতের অগ্রবর্তী বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপক প্রয়োগ হয়, তাতে মহলানবীশ নিজে তেমন অংশ না নিলেও উৎসাহ দিয়েছেন গবেষণায়। তাঁর ভাবশিষ্য সি আর রাও, যিনি এখনও জীবিত এবং শতবর্ষের মুখে, সারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাণিতিক পরিসংখ্যানবিদ বলে মর্যাদা পান। মহলানবীশের সফল নেতৃত্বে বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলিতে কাজ করে বা প্রশিক্ষণ পেয়ে আরও অনেকে বহু নজরকাড়া গবেষণা করেছেন ও করছেন। উন্নত দেশে সাধারনতঃ সংস্থা থাকে, ব্যক্তি সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে তাকে দক্ষভাবে পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে দৃষ্টান্তকর কিছু করতে হলে  ব্যক্তির উদ্যোগকে অনেক বড় হতে হয়। মহলানবীশ ছিলেন সেই উদ্যোগীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।


তথ্যসূত্রঃ

C. R. Rao (1973). Prasantha Chandra Mahalanobis. Biographic Memoirs of Fellows of the Royal Society, Volume 19, Pages 454--492.

C. R. Rao (1973). Mahalanobis era in statistics. Sankhya, Series B, Volume 35, Pages 12--26.

C. R. Rao (1993). Statistics must have a purpose: the Mahalanobis dictum. Sankhya Series A, Volume 55, Pages 331--349.

J. K. Ghosh (1994). Mahalanobis and the art of science of statistics: the early days. Indian Journal of History of Science, Volume 29, Pages 89--98.

J. K. Ghosh, P. Maiti and A. Bera (1995) Indian Statistical Institute --- numbers and beyond (1931--1947). Unpublished report and address.

A. Rudra (1996): Prasanta Chandra Mahalanobis, A Biography, Oxford University Press. 

Reprography and Photography Unit of Indian Statistical Institute (2018). Prasanta Chandra Mahalanobis. Video documentary.


--------------------
-শুভাশিস ঘোষাল
 প্রকাশঃ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত "তিন বাঙালি বিজ্ঞানী" গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ হিসেবে, পৃষ্ঠা ৮২--১০২, কলকাতা বইমেলা ২০১৯ সাল। 




















মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯

রাজপেয়াদার রূপকথা

রাজপেয়াদার রূপকথা
-শুভাশিস ঘোষাল


-একটা রূপকথার গল্প বল না।
-বেশ, তবে শোনো, এক রাজপেয়াদার গল্প।
-যাঃ, রাজপেয়াদার আবার রূপকথা হয় না কি? রূপকথা তো হয়, রাজা, তার সাত রাণী, বীর রাজপুত্র, সুন্দরী রাজকন্যা, পক্ষীরাজ --- এই সবের।
-ঠিকই, তবে এও রাজারই গল্প। এই রাজা বড় সোজা, সুখে থাকে যত প্রজা। এই রাজা নিজেকে রাজপেয়াদা ভাবতে পছন্দ করেন।
-রাজপেয়াদা কেন?
-রাজপেয়াদার কাজটাই আসলে সবচেয়ে কঠিন আর গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের সমস্ত সম্পদ দেখভাল করা, কেউ যাতে লুঠ করে না পালাতে পারে দেখা, কত দায়িত্ব। একমাত্র এই রাজাই সে কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই উনি নিজেকে রাজা নয়, রাজপেয়াদা ভাবতেন।
-কিন্তু যা হোক, তিনি তো রাজা। তাই না?
-হ্যাঁ, তবে এই রাজ্যে কোটি কোটি প্রজারাই রাজা ঠিক করে প্রতি পাঁচ বছরে। তাই যারা রাজা হতে চায়, তাদের প্রজাদের কাছে প্রতি পাঁচ বছর বাদে বাদে আবেদন করতে হয়। তখন যে যত নত হতে পারে, প্রজারা তাকেই পছন্দ করে। রাজপেয়াদা হওয়া মানে খুব নত হওয়া, সবার সেবা করা, তাই প্রজারা অনেকে এই রাজাকেই বেশি ভালবাসে। অবশ্য একবার রাজা হয়ে গেলে তখন আর বাধা নেই কিছু। এই রাজার দেশভ্রমণের খুব শখ তো। তাই বছরে তিনশ দিন অন্যান্য দেশ সফরে যেতেন। পোশাকের ব্যাপারেও রাজার খুব দিলদরিয়া মেজাজ ছিল। দশ লাখ টাকার একটা সোনার বর্ম বানিয়েছিলেন, সেটা খুব পরতেন।
-এসব দেখলে লোকে যদি খারাপ ভাবত, যে রাজা অন্য রাজাদের মতই বিলাসিতা করছেন?
-না, তা ভাববে কেন? পাঁচ বছর পরে আবার নির্বাচনের সময় খুলে নিলেই হল। লোকের তো মনে থাকে না অত কথা।
-আচ্ছা, বুঝলাম।
-যা হোক, শোনো। রাজকোষে তো আগে চুরি হচ্ছিল, তাই এই রাজপেয়াদা কথাটা সবার পছন্দ হল। সবাই তাই তাকেই রাজা বানানো ঠিক করল।
-তা তারপর চুরি বন্ধ হয়ে গেল?
-না, ঠিক তা হল না, কিন্তু চোররা বেশ জব্দ হয়েছিল, এই রাজা, থুড়ি রাজপেয়াদার, বুদ্ধিতে।
-কি রকম, কি রকম?
-সে তো দুটো সিঁধেল চোর রাজকোষ থেকে দুটো বড় বড় বস্তা ভর্তি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। যতক্ষণে জানা গেল, সে চোররা তো পগার পার। সবাই তখন বললে, এ কেমন হল রাজামশাই? আপনি তো রাজপেয়াদাও বটে।
রাজা বললেন, রোসো। চোরদুটো পালিয়েছে ঠিকই, তবে এইস্যা টাইট দিচ্ছি বাছাধনদের যে চুরির টাকা ওদের ভোগ করতে হবে না আর।
এই বলে তিনি ঘোষণা করে দিলেন, বন্ধুরা (প্রজাদের তিনি এই নামেই সম্বোধন করতেন), আজ থেকে পাঁচশো আর হাজারের সব টাকা বাতিল। এবার চোরদুটো দু বস্তা কাগজ নিয়ে যা পারে করুক। জব্দ বলে জব্দ।
প্রজারা তো মহা খুশি। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর। এবার বোঝ ঠ্যালা।
কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই প্রজারা দেখল টাকার অভাবে তারাও জিনিষপত্র কিনতে পারছে না, মজুরিও পাচ্ছে না।
প্রজারা সে কথা রাজাকে জানাতেই তিনি বললেন, দুটো মাস দেখই না। সব ঠিক হয়ে যাবে। যে সব টাকা এর আগে এতদিন ধরে চুরি হয়েছে, সেগুলোও সুড়সুড় করে ফেরত আসবে। সেসব টাকা সব প্রজাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ টাকা এমনিই পেয়ে যাবে। সবাই খুব খুশি।
- এত কোটি লোকের প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ?
-হুঁ, তবেই বোঝো, এই রাজাকে লোকে ভালবাসবে না কেন? রাজা আরও বললেন, আমরা নতুন টাকা যা বানাবো না, একেবারে এডভান্স টেকনোলজি, রেডিওএক্টিভ চিপ বসানো। কালো টাকা মাটির দুহাজার ফুট নিচেও পুঁতে রাখ না কেন, বিপ বিপ সিগ্নাল দিয়ে জানান দেবে। তখন রাজপেয়াদা এসে ক্যাঁক করে ধরবে। সব চুরি চিরকালের মতো বন্ধ হবে।
-আচ্ছা, অতদিন আগে এতসব এডভান্স টেকনোলজি ছিল? আর অত নিচ থেকে সিগ্নাল পাঠাতে পারত?
-ছিল না মানে? যখন ইউরোপে লোকে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাচ্ছে, আর আমেরিকায় তো লোকে যায়ই নি, তখন থেকেই  ওই দেশে পুস্পক রথ কোনও জ্বালানি ছাড়াই আকাশে উড়ছে, হাতির মুন্ডু মানুষের দেহে লাগানো হচ্ছে, টেস্ট টিউবে একসাথে একশ ছেলে জন্ম নিচ্ছে, আর সামান্য রেডিওএক্টিভ চিপ আর কি ব্যাপার?
-ও আচ্ছা! তাহলে প্রত্যেকে দশ বিশ লাখ পেয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশি হল?
-না, মানে টাকা তো অত চট করে হাতে আসে না। সবাই ধৈর্য ধরেই ছিল। কিন্তু কাজ চালানোর মতো টাকা হাতে না পেয়ে লোকে একটু উশখুশ করতে লাগল। রাজা, মানে রাজপেয়াদার কানে সে কথা যেতেই তিনি বললেন, আরে রাজপেয়াদার কাজ কি এতই সোজা? দেখছ না, সীমান্তে কত হামলা হচ্ছে, এই সামান্য দুয়েকমাসের অসুবিধা নিয়ে অত ভাবছ কেন? টাকা এখন হাতে কম আছে যখন, তোমরা বরং মাংস খাওয়া ছেড়ে দাও। তাতে তো বেশ টাকা বাঁচে। নেহাত যদি খেতে হয়, মুরগি বা  ছাগল-ভেড়া খেও, গরু-টরু কদাপি নয়।
অনেকেই ভাবল, ঠিক কথা। মাংস না খেলেই তো হয়। আর গরু তো কিছুতেই নয়।
এদিকে হল কি, দেখা গেল চোরদুটো মোটেও কাগজের টাকা নিয়ে পালায় নি, সোনার মুদ্রা নিয়ে গেছে চালাকি করে। ভিতরের খবর ছিল বোধ হয় ওদের কাছে। উত্তরকুরু দেশে বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে, আরাম করছে। দেশে ফেরার নামও নেই।
-তবে কি হবে? কাগজের টাকা বাতিল করাটা তাহলে একেবারে মিথ্যে মিথ্যে হল?
-না তা কেন? চোরেদের অন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। হিমালয় থেকে মহা সাধু বাবা রামলক্ষণভরতশত্রুঘ্ন কে স্মরণ করা হল। বাবার এই একহাত দাড়ি, সমস্ত মন্ত্র তন্ত্র তাঁর নখদর্পণে। তিনি এসে যেই অভিশাপ ঝাড়লেন, অমনি শয়তান চোরদুটো ...
-কি, একেবারে দেশে আছড়ে পড়ল?
-না, শয়তানদুটোর সারা গা উটপাখির চামড়ায় ঢেকে গেল। সাধুর অভিশাপ বলে কথা। এমনকি মুখ বন্ধ হয়ে গেল এমন যে একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করতে পারল না। এবার সোনার টাকাই থাক আর রুপোর, কোন কাজে লাগবে তোদের? সব প্রজা চোরেদের শাস্তিতে খুব খুশি।
-বাঃ, তাহলে আবার রাজ্যে সুখশান্তি ফিরে এলো?
-হ্যাঁ, তবে আবার নির্বাচনের সময় চলে এল। পাঁচ বছর হয়ে গেছে তো ইতি মধ্যে।
-তাহলে? লোকে যে তখনও দশ-বিশ লাখ পায় নি। তারা আবার রাজাকে, মানে রাজপেয়াদাকে, আবার নির্বাচন করল?
-মানে সেটা ঠিক আমি জানতে পারিনি এখনও। নির্বাচনে তো আরও অনেকে রাজা হতে চাইছিল। তাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য একজনের নাম ছিল নেড়া।
-নেড়ার কি মাথা নেড়া?
-না তা ঠিক নয়, নেড়ার মুখে সব সময় একটা বোকাবোকা হাসি লেগে থাকত, অনেকটা সুকুমার রায়ের হজবরল-র নেড়ার মতো। তাই ওরকম নাম।
নেড়া বলেছিল, আমি প্রতি মাসে সবাইকে ছ হাজার করে দেব। রাজপেয়াদা আবার থোক টাকা দেবে দশ বিশ লাখ। সে এক জটিল অঙ্ক। লোকে তো সহজে মীমাংসা করতে পারে নি কে বেশি টাকা দেবে। তাই বহুদিন ধরে চলছিল নির্বাচন। আমার আর অত ধৈর্য থাকে নি ফলাফল জানার, তাই আর জানতে পারি নি।
-ধুর, এ কেমন গল্প? শেষটাই তো জানা হল না।


------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, এপ্রিল ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

নরকের নবজাত মেঘ




নরকের নবজাত মেঘ
- শুভাশিস ঘোষাল
এক ।।
সুধীর বটব্যাল বেশ নামজাদা প্রোমোটার। এ অঞ্চলের প্রচুর ফ্ল্যাটবাড়ি তারই তোলা। খুব ছোট অবস্থা থেকে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছেন। সুধীরবাবুর ছিল জহুরীর চোখ। কোন বাড়ির লোকের পুরোনো ভিটে বেচে দেবার কত আগ্রহ, কততে ছাড়বে, কিভাবে জমির মালিককে বশ করা যাবে, কোন ফ্ল্যাটের কেমন চাহিদা হবে, কি ডিজাইন বাজারে খাবে - এসব হিসেবে তার ভুলচুক হয় না। আর মোটের উপর সৎ ভাবেই ব্যবসা চালিয়েছেন। সিমেন্ট, চিপ, রড, মার্বেল যাই হোক, মাল খারাপ দেন নি কখনও। ফ্ল্যাট যখন দেবেন বলেছেন, মোটামুটি কথা রেখেছেন। দাম কিছুটা বেশি চাইলেও লোকে চোখ বুঁজে ভরসা করতে পারত যে সুধীর বটব্যালের কাছে টাকা মার যাবে না। আরও তো কত প্রোমোটার লোকে দেখল। সস্তায় ফ্ল্যাট করে দেবে বলে টাকা নিয়ে আজ নয় কাল নয় করে ঘোরায় ডেলিভারির সময়, বছর গড়াতে না গড়াতেই এটা ওটা কাজ করে না, রং চটে যায়, দেওয়ালে ড্যাম্প। নাঃ, লোকে তাই সুধীরবাবুর উপরই ভরসা করে। তবে ইদানিং বয়স হয়েছে, শরীরটাও বেশ খারাপ। হার্টে দু দুটো অ্যাটাক হয়ে গেছে। পেসমেকার বসানো। ধকল তো জীবনে কম যায় নি। টানা দশ-বারো ঘন্টা করে রোদ-জল-ঝড়ে কাজ করেছেন বহুবছর। আর এ ব্যবসাই এমন যে টেনশন থাকবেই। জমি পাওয়া যাবে কি না, বাজারে ফ্ল্যাটের চাহিদা কেমন দাঁড়াবে, লোনের ব্যবস্থা কি হবে, কাউন্সিলর-এম এল এ-মন্ত্রী-মিউনিসিপাল অফিসার-থানার দারোগা ---- এদের হাত করে তো আছেই, সব থেকে বড় টেনশনের ব্যাপার হল মস্তানগুলোর সাথে ডিল করা। টাকাপয়সা ওদের দিতে সুধীরবাবু আপত্তি করেন নি তেমন, যখন চাহিদাটা ওরা মোটামুটি সম্ভবের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু ইদানিং ওদের বাড়াবাড়িটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাজনৈতিক মদত পাচ্ছে বেশি করে। সুধীরবাবু তো আর পাঁচটা প্রমোটারের মতো রদ্দি মাল দিয়ে বাড়ি বানিয়ে নাম খারাপ করতে পারবেন না --- ওকে ফ্ল্যাটের দাম বাড়াতে হবে। তবে তারও তো একটা মাত্রা আছে। খুব অসম্ভব বেশি দাম চাইলে খদ্দের কিনবে কেমন করে?
হার্ট অ্যাটাকগুলো হবার পরে ডাক্তারের কড়া নিষেধ। তাই বাধ্য হয়েই নিজে তৈরির সময় তদারকি ছাড়তে হয়েছে। ভাইপো মনোহরই ইদানিং কন্সট্রাকসনের দিকটা দেখে। ভাইপোকে অবশ্য তেমনভাবে ভরসা করা যায় না, তার ছ্যাঁচড়ামির কিছু কিছু পরিচয় সুধীরবাবু সময়ে সময়ে পেয়েছেন। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কি? সুধীরবাবু নিঃসন্তান, গত কয়েকবছর ধরে বিপত্নীকও বটেন। আক্ষেপ হয় বড়, এত কষ্ট করে ব্যবসাটা গড়ে তুললেন, একটা উপযুক্ত সন্তান যদি থাকত, তো তাকে তালিম দিয়ে তৈরি করতেন। একটা বেসিক সততা ছাড়া কোনও ব্যবসা টেঁকে না। মনোহরের সেই বেসিক সততাটাই নেই। শুধু লম্বা-চওড়া ভাষণ দিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তবে সুধীরবাবু মনোহরকে শুধু কনস্ট্রাকশন তদারকির কাজেই রেখেছেন। সেখানে তার অনেকদিনের বিশ্বস্ত মিস্তিরিরা আছে, মনোহর যা খুশি করতে পারবে না। মাল সাপ্লাইয়ের দিকটা এখনও সুধীরবাবু নিজে দেখেন। ফলে নিচুমানের জিনিস কিনে সেখান থেকে লাভ করার সুযোগটা এখনও মনোহরের আয়ত্তের বাইরে।
লোটন মস্তানটা ইদানিং খুব জ্বালাচ্ছে। প্রথম প্রথম ওর পেটোয়া সাপ্লায়ারের কাছ থেকে মাল কেনার জন্য জোরাজুরি করত। নরহরি প্রামাণিক --- সুধীরবাবু জানেন তাকে। সিমেন্টে মাটি মেশায় --- চুন, সুড়কি, রড --- সব খারাপ মানের দেয়। রেট সামান্য কম করে, লোটন তাই সুধীরবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওই মাল কিনলে আর দেখতে হবে না! সুধীরবাবু তাই সটান না বলে দিয়েছিলেন। লোটন শাসিয়েছিল, "জলে বাস করে কি কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা ভাল, কাকু? এ তল্লাটের সমস্ত প্রোমোটার আমার কথামতই মাল কেনে। দেখি আপনি কদিন ব্যবসা চালাতে পারেন।"
হুমকির কথা শুনে মনোহর বলেছিল, "কাকা, আমি থাকতে লোটন মস্তান তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। তবে সীতেশ সোমও কিন্তু ভাল রেট দেয়। দেখতে পারো ওর কাছ থেকে নিয়ে। বলাই মন্ডলের কাছ থেকে তো কতদিন ধরেই নিচ্ছ। ও তোমাকে হাতের পাঁচ ভেবেছে। দাম বেশি নিচ্ছে লোকটা।"
সুধীরবাবু মনোহরের কথায় পাত্তা দেন নি। সীতেশ সোমের জিনিস কেমন তিনি জানেন। নরহরির থেকে সামান্য ভাল। ও দিয়ে কাজ হবে না। মনোহরটা কমিশন খাওয়ার তাল করছে নির্ঘাত।
দুই ।।
মিউনিসিপালিটির একটা বড় প্রজেক্ট আছে। মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হবে। দশ কোটির মত টেন্ডার ভ্যালু হবে, সুধীরবাবু হিসেব করে দেখেছেন। এক কোটির কাছাকাছি লাভের সম্ভাবনা আছে, প্রজেক্টটা যদি পাওয়া যায়। এতবড় কাজে অবশ্য সুধীরবাবু হাত দেননি আগে। শুধু লাভের ব্যাপার নয়, চ্যালেঞ্জটা নেবার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। ফ্ল্যাটবাড়ি তো অনেক বানিয়েছেন --- এবার নতুন কিছু করলে হয়। কম্পিটিশন অবশ্য থাকবে ভালই টেন্ডারের জন্য। স্থানীয় প্রোমোটাররা মনে হয় না আর কেউ এত বড় প্রজেক্টে হাত দিতে সাহস করবে। আর এলাকায় ওদের তেমন সুনামও নেই। বড় কন্সট্রাকশন কোম্পানি কিছু টেন্ডার জমা দেবে নিশ্চয়ই, তবে ওদের ওভারহেড বেশি। বারো কোটির কমে বিড দেওয়া ওদের পক্ষে মুশকিল। সুতরাং ভাল চান্স আছে। তবে শরীরটা তো ভাল নেই। এত বড় কাজ নিজে তদারক করতে পারবেন না। মনোহরের ভরসায় এগোনো টা কি ঠিক হবে? সাতপাঁচ ভাবছিলেন সুধীরবাবু। মনোহরই কথাটা তুলল।
-কাকা, দেখেছ মিউনিসিপালিটির প্রজেক্টটা? বিড দিই আমরা? কাজ পেলে ভাল প্রফিট।
সুধীরবাবু দোনামনা করলেন।
-আমার শরীরটা তো ভাল যাচ্ছে না। অত ধকল নিতে পারব না।
-সে তুমি চিন্তা কোরো না কাকা। আমি আছি তো।
-তুই পুরোটা করতে পারবি? অনেক বড় কাজ কিন্তু।
-কাকা, তুমি কি ভাব বল তো? আমি নামাতে পারব না? টেন্ডারটা পাওয়াটাই আসল। মিউনিসিপালিটিতে লোক ফিট করছি।
অনিচ্ছাসত্বেও সুধীরবাবু সম্মতি দিলেন। কাজটা না পাক, টেন্ডার প্রসেসটা অন্ততঃ শিখতে পারবে মনোহর।
- দশ-সাড়ে দশের টেন্ডার দিস। এর খুব বেশি রেট দিলে কন্ট্রাক্ট পাবি না।
-আর একটু না বাড়ালে প্রফিট থাকবে না কাকা।
-আমাদের ছোট কোম্পানি। অন্ততঃ পাঁচ-দশ পার্সেন্ট কম রেট না থাকলে আমাদের দেবে না। বড় কোম্পানিগুলো এক্সপিরিয়েন্সে প্রেফারেন্স পাবে। দশেও আমাদের মডেস্ট প্রফিট থাকবে কাজটা ঠিক করে করলে। মাল খারাপ দিলে কিন্তু ইন্সপেকশনে আটকে যাবে। হেভি পেনাল্টি দিতে হবে।
-কাকা, তুমি মডেস্টিতেই আটকে রইলে। রেট সেফলি আরও দুই বাড়ানো যাবে। আমি ভিতরের খবর সব পেয়ে যাব। আর লোক ফিট করব, বিডে হেল্প করবে।
-তুই রহমত সাহেবকে চিনিস না। খুব কড়া টাইপের লোক। বেনিয়ম কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়লে ব্যান করে দেব।
-ওঃ কাকা, তুমি বৃথাই চিন্তা করছ। বেনিয়ম কিছু হবে না, শুধু ভিতরের খবরটা বের করে নেব।
যাক গে, মনোহর যা করে করুক। সুধীরবাবুর যখন আর আগ্রহ নেই, আর মাথা ঘামাতে যাবেন না। বরঞ্চ কো-অপারেটিভ হাউসিংএর সেই প্রজেক্টটা, যা ওর অনেকদিনের স্বপ্ন, তাতেই মন দেবেন। উদবাস্তু কলোনিতে বড় খাপছাড়াভাবে বিসদৃশভাবে ঘরগুলো উঠেছে। ঘিঞ্জি জায়গা, নোংরা গলিঘুঁজি, বাড়িগুলো ভাঙ্গাচোরা, করুণ অবস্থা। সবই একতলা, কোনোটা টালির চাল, কোনোটা টিনের, কোথাও দরমার বেড়া। তবে অনেকটা জমি জুড়ে কলোনি। যুদ্ধ আর দেশভাগের পরে যখন নিরাশ্রয় মানুষগুলো এখানে চলে আসে, ফাঁকা জায়গা পেয়ে ঝোপঝাড় কেটে যে যেমন পারে বসতি বানিয়েছিল। হাতে কারুরই টাকা ছিল না, আর পরিকল্পনার কোনো বালাই ছিল না --- তার ফলশ্রুতি শ্রীহীন বাড়িগুলো। কালে কালে, অনেক ভোট পার হবার পর, বাসিন্দারা পাট্টা পেয়েছে স্থায়ী বসবাসের। তবে পরিবেশ খারাপ বলে যারা একটু পয়সা করতে পারে, বাস অন্য জায়গায় উঠিয়ে নিয়ে যায়। যারা পারে না, পড়ে থাকে। রাস্তার কলের দখল নিয়ে ঝগড়া করতে করতে আরো তিরিক্ষি হয়।
সুধীরবাবু দেখেছেন হিসেব করে, ওরা যদি কো-অপারেটিভ করে বানিয়ে চারতলার বড় বিল্ডিংএ উঠে যায়, তবে অনেকটা জমি উদবৃত্ত হবে। সবাইকে এটাচড বাথ সহ ছিমছাম দুকামরার ফ্ল্যাট দিয়ে, আর হাউসিংএর সামনে বাগান করেও বাকি জমি যা থাকবে, তার বাজার দাম অন্ততঃ কুড়ি কোটি হবে। সেই জমিটা বিক্রি করে দিলে ওই টাকাতে সবার বাড়ি হয়ে যাবে আরামসে, তাও পরেও সবার হাতে কিছু থোক টাকা থাকবে। ওরা রাজি থাকলে সুধীরবাবু এই প্রজেক্টটা করে দেখতে চান। নিজের প্রফিটের জন্য নয় --- সেটা তেমন কিছু আসবে না, বরঞ্চ নিজেকেই টাকা ঢালতে হবে আগে। আসলে সুধীরবাবু নিজেও উদবাস্তু পরিবারে জন্মেছেন, ভাঙ্গা টালির ঘরে বড় হয়েছেন। টাকা রোজগার তো জীবনে হয়েছে অনেক। ওদের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগবে।
তবে সমস্যাও কম নয়। এক তো এতগুলো টাকার ঝুঁকি, তার থেকে বড় কথা, এতগুলো পরিবারকে বুঝিয়ে রাজি করানো। এতখানি জমির উপর অনেকেরই নজর আছে। এই অঞ্চলে জমির দাম যে হারে বেড়ে গেছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আর কলোনিটার জমি স্টেশনের রাস্তার লাগোয়া বলে কমার্শিয়াল ডেভেলপমেন্ট হতে পারে। সুধীরবাবু ওদের খুবই পরিচিত লোক, তবে প্রোমোটার বাড়ি ভেঙ্গে তৈরির প্রস্তাব দিলে লোকে সন্দেহের চোখে দেখে। শুরুতে তাইই হয়েছিল। তবে সুধীরবাবু হাল ছাড়েন নি। একটু একটু করে লোককে বুঝিয়েছেন, পাড়ায় বহু মিটিং করেছেন। আস্তে আস্তে ওরা অন্য প্রোমোটারদের দেওয়া প্রস্তাবের থেকে সুধীরবাবুর প্রস্তাব যে আলাদারকম, বুঝতে শুরু করেছে। কারুর কথায় ভরসা করতে পারাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুধীরবাবু যে আজেবাজে কিছু গছিয়ে দেবেন না, তা ওরা বোঝে। তবু এতগুলো পরিবাবের ব্যাপার, পুরো দু বছর লেগে গেল সবার সম্মতি পেতে।
তা হোক, এসব ব্যাপারে ধৈর্য লাগে। এবার সইসাবুদগুলো করে ফেলতে হবে। মিউনিসিপালিটিতে গিয়ে প্রজেক্টটার ব্যাপারে একটু কথাও বলে রাখা দরকার, যাতে প্ল্যানটা তাড়াতাড়ি স্যাংশন হয়।
শীতলামন্দিরটা পেরিয়ে মিউনিসিপালিটির দিকে ঘুরতে লোটনের মুখোমুখি পড়লেন। "কাকু, একটু কথা ছিল, সঞ্জয়দার অফিসে আসবেন একবার?"
সঞ্জয় ধর প্রকৃতপক্ষে জমির দালাল। বস্তিবাড়ি বা অন্যান্য যে সব জমি একলপ্তে পাবার সম্ভাবনা আছে, সঞ্জয় সেসব জমিই হাতাতে চেষ্টা করে। লোটন, কাঁচা, চশমা --- এলাকার এসব মস্তানদের সঞ্জয় কাজে নামায়। জোরজার করে কমদামে জমি হাতায়। পুরোটাই পলিটিকাল কানেকশনের জোরে করে। অন্যান্য প্রোমোটাররা অনেকেই সঞ্জয়ের কাছ থেকে জমি নিয়ে বাড়ি বানায়। তবে সুধীরবাবুর সঞ্জয়ের জমির দরকার পড়ে নি কখনও। সরাসরি মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন। সঞ্জয়-লোটনদের তাই সুধীরবাবুর উপর রাগ সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সঞ্জয়ের অফিসটা সামনেই, তাই সুধীরবাবু না বললেন না। দেখাই যাক না ওরা কি বলে।
ঢুকতেই সঞ্জয় বলল, "আসুন দাদা, আসুন। কি খাবেন বলুন, গরম না ঠান্ডা?"
সুধীরবাবু বললেন, "ও সব কিছু লাগবে না। তুমি কি বলবে বল।"
সঞ্জয়ের একটা গুণ, বিশেষ ভণিতা করে না। বলল, "দাদা, ওই কলোনির জমিতে কো-অপারেটিভের বাড়ি বানিয়ে, ওদের সবাইকে ফ্ল্যাট দিয়ে কতটুকু প্রফিট থাকবে আপনার? এতো সমাজসেবা হয়ে যাচ্ছে। আপনি-আমি ব্যবসাদার, লাভের ব্যাপারটা তো আগে দেখব আমরা, তাই না?"
সঞ্জয় একটু থামল। সুধীরবাবু দেখলেন, সঞ্জয় তাকে আর নিজেকে এক শ্রেণীভুক্ত করতে উদ্গ্রীব।
সঞ্জয় বলতে থাকে, "আপনাকে অবশ্য অযাচিতভাবে এসব কথা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই আপনার ইচ্ছেমত প্রজেক্ট করবেন। তবে আপনি হলেন আমার দাদার মতো, আপনাকে দেখেই ব্যবসা করতে ভরসা পেয়েছি। না হলে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি, আর সবার মত একটা চাকরি জোটানোর চেষ্টা করতাম। কলোনির লোকেরা তো এতদিন জমি বেচতেই চাইছিল না। আপনি যে কি ম্যাজিক জানেন দাদা, ওদের কি করে রাজি করালেন ভাবছি। আমার কাছে শাসালো পার্টি আছে, ভালো দাম দেবে। আপনি কমিশন পাবেন যা, ও প্রজেক্টে আপনি যা প্রফিট করতে পারবেন, তার থেকে বেশি। এ ছাড়া মিউনিসিপালিটির মার্কেট কমপ্লেক্সের জন্য তো টেন্ডার দিচ্ছেন? সে ব্যাপারেও আমার পুরো মদত পাবেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদে উপর লেভেলে কানেকশন ভালই আছে দাদা, সেটা তো মানবেন?"
সুধীরবাবু একটু মনে মনে হাসেন, কথাটা ভুল বলে নি সঞ্জয়। দালালিও একটা ব্যবসা। বলতে গেলে সব থেকে সর্বব্যপী ব্যবসা। তবে সে ব্যবসা সুধীরবাবুর জন্য নয়, তিনি কিছু তৈরি করতে ভালবাসেন। তবে টেন্ডার দেবার প্ল্যানটা সঞ্জয়ের কানে এসেছে কোনোভাবে। নির্ঘাত মনোহরই বেফাঁস বলেছে কিছু কখনও।
-খবর তো সবই রাখ। তবে এটা তো বোঝো যে কলোনির লোকেরা জমি ছাড়তে রাজি হয়েছে একটা বিশেষ কারণে, আমার মুখের কথার জন্য নয়। যে কাজের জন্য জমি দেবে ওরা, সে কাজ না হলে ওরা দেবে কেন? আর জমি বিক্রির মধ্যস্ততা করাটা আমার পেশা নয়, তোমরা তো আছ তার জন্য।
দালালি কথাটা শুনতে খারাপ লাগে, তাই সুধীরবাবু মধ্যস্ততা কথাটা ব্যবহার করলেন।
-দাদা, ওরা জমি বেচতে একবার রাজি যখন হয়েছিল, চাপ দেওয়া যেত। পুরো জমিটা পেলে ভাল প্যাকেজ দিতাম, সে টাকা নিয়ে অন্য কোথাও ফ্ল্যাট কিনে নিতে পারত। বান্ধবনগরের দিকটা এখনও শস্তা আছে। ওখানে লাখ-পাঁচেক বাজেটে ছোট ফ্ল্যাট হয়ে যেত।
-না সঞ্জয়, ওরা যদি তোমার প্রস্তাবে রাজি হয় তো হবে, আমার বলার কি আছে। তবে এরকম কোনো প্রস্তাব আমি দিতে পারব না। আমি আমার প্রজেক্ট করার চেষ্টা করব, তুমি তোমারটা করার চেষ্টা কোরো।
সুধীরবাবু বেরিয়ে আসেন সঞ্জয়ের ওখান থেকে। মিউনিসিপালিটিতে সরকারবাবুর সাথে দেখাটা সেরা ফেলাটা প্রয়োজন।
তিন ।।
মনোহরের বন্ধু অমিতই প্ল্যানটা জুগিয়েছিল মনোহরকে। টেন্ডার সাবমিট করবে শুনে বলেছিল, "ও সব বড় প্রজেক্টের ঝঞ্ঝাটে যাবি কেন রে মনো? তোর কাকা যা ব্যবস্থা করেছে, টাকা তোর নিজের পকেটে ঢোকানোও মুশকিল। পয়সা কামানো নিয়ে কথা। তার জন্য অনেক সিধে রাস্তা আছে। কেজরিওয়ালের কোম্পানি টেন্ডার দেবে। তুই যদি তোর বিডটাকে ওদের থেকে বাড়িয়ে ওদের কথামতো দেখাস, ওরা তোকে হাশ মানি দেবে।"
কথাটা মনোহরের পছন্দ হয়। কাকার লাইনে উন্নতি করা শক্ত। বিশেষ করে মাল সাপ্লাইয়ের কন্ট্রোলটা না পেলে পয়সাটা সে বানাবে কি করে?
অমিত কেজরিওয়ালের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। ওর বাবা কেজরিওয়ালের কোম্পানিতে কাজ করে। ওরা বারো কোটির বিড দিত। মনোহর এগারো কোটির বিড দেবে ভেবেছিল। কেজরিওয়াল প্রস্তাব দিল, মনোহর ওর বিডটাকে তেরো করে দিক, কেজরিওয়াল তাহলে সাড়ে বারো দিয়েও পেয়ে যাবে কন্ট্র্যাক্ট। অন্য আর একটা বিড দেবে কেজরিওয়ালের একটা বেনামি ভুয়ো কোম্পানি। তিনটে টেন্ডার পড়লেই বিড আর ক্যান্সেল হবে না।
সেই মতই কাজ হয়। কেজরিওয়ালের কোম্পানি কন্ট্র্যাক্টটা পায়।
মনোহর পাঁচ লাখ পায়, অমিতও পায় কমিশন।
কাঁচা টাকা পেয়ে মনোহরের বেশ ফুরফুরে মেজাজ হয়। বন্ধুদের নিয়ে সে মদের আসর বসায়। একুশ বছরের এজড সিংগ্ল মল্ট হুইস্কি আনায় কলকাতা থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে। অমিত, অমিতের ভাই অনিল আর ওদের আর এক তুতো ভাই অরুণ এসে জোটে। অমিত করে দালালি, অনিল কি একটা ছোটখাটো দু'নম্বরি ব্যবসা করে। তবে সবথেকে রহস্যজনক হল অরুণ। সে যে কি করে, কখনও ভেঙ্গে বলে নি। তবে সেটা বোধ হয় কিছু হিসেব সংক্রান্ত। সকলে মিলে মনোহরকে প্রচুর তোল্লাই দেয়। স্তাবকতায় খুব খুশি হয়ে কল্পতরু হয়ে যায় মনোহর। দু হাতে টাকা ওড়ায়।
অনিলই জুয়াতে হাতেখড়ি করায় মনোহরের। ব্ল্যাকজ্যাক, তিনপাত্তি। সবেরই ঠেক আছে। ঘাঁতঘোঁতগুলো সব অনিলের জানা। প্রথম প্রথম অল্প স্টেকে খেলে মনোহর। বেশ কিছু জেতে, স্টেকও বাড়ায়। তারপর হারা শুরু হয়। মাঝে মধ্যে জিতলেও বেশিরভাগ সময়েই হারে। কিন্তু তাতে আরও রোখ চেপে যায়। পড়ে পাওয়া টাকায় টান পড়ে। তবু মনোহরের স্থির বিশ্বাস, সে খুব ভাল খেলে। আর খানিকটা টাকা ঢেলে খেলতে পারলে সে হারা টাকাগুলো উদ্ধার করতে পারবে।
সুধীরবাবু মনোহরকে বাঁধা টাকা মাসোহারা দেন। সে টাকা টুকটাক সাধ আহ্লাদ মেটানোর জন্য যথেষ্টর থেকে অনেক বেশি হলেও জুয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। টাকাপয়সার উপর সুধীরবাবুর তীক্ষ্ণ নজর। কিছু সরাতে গেলে ধরা পড়ার সমুহ সম্ভাবনা।
শুনে অরুণ বলে টাকাটা জোগাড় করা সমস্যা হবে না। “আরে, তোর কাকার অত সম্পত্তি, তোকে যে কোনও মহাজন সেধে টাকা ধার দেবে। আমার চেনা লোক আছে, কম সুদে টাকা পাইয়ে দেব।“
মাসিক দশ শতাংশ কড়ারে মনোহর অরুণের চেনা মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেয়। জুয়াতে তবু ভাগ্য ফেরে না। ধারের পরিমান বাড়তে থাকে। সুদের কিসব জটিল হিসেব, মনোহর কোনোমতে মাধ্যমিক উতরে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল --- ওর মাথায় সেসব জটিল অঙ্ক ঢোকে না। যখন ধার নিয়েছিল, হিসেব যে এত জটিল হয়, বোঝে নি। অরুণ বলে চিন্তা নেই, আমি হিসেব দেখছি। অরুণের কথা মত টাকা দেয় প্রতি মাসে। অঙ্কটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে, আসলও বেড়ে যাচ্ছে খালি।
সুধীরবাবু একবার মনোহরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন টেন্ডারের ব্যাপারে। মনোহর মিথ্যে করে বলেছিল, সে এগারোর টেন্ডার দিয়েছিল, কিন্তু কেজরিওয়াল সাড়ে দশের বিড দিয়ে কন্ট্র্যাক্ট পেয়ে যায়। সুধীরবাবু একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন, কেজরিওয়াল অত কমের বিড দিয়েছে শুনে।
যা হোক, ভালই হয়েছে মনোহর কন্ট্র্যাক্ট না পেয়ে, সুধীরবাবু ভাবলেন। শেষে কাজটা হাতে পেয়ে ডোবাতো হয়তো।
তবু মিউনিসিপালিটিতে গিয়ে যখন রহমত সাহেবের সাথে দেখা হল, একবার না জিজ্ঞাসা করে পারেন নি।
-স্যার, আমরা কন্ট্র্যাক্টটা পেলাম না! কেজরিওয়াল ওর থেকে কমে দিতে পারল?
রহমত সাহেব বললেন, "কি করে পাবেন বলুন তো সুধীরবাবু? আপনারা কোন আক্কেলে তের কোটির বিড দিলেন? অত মার্জিন রাখতে চাইলে কন্ট্র্যাক্ট পাওয়া যায় কখনও?"
তেরো কোটি! মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল সুধীরবাবুর। মনোহর তাহলে তাকে মিথ্যে বলেছে।
বাড়ি ফিরে মনোহরের উপর বকাঝকা করলেন খানিক। মনোহর বলল, "সত্যি বললে তো তুমি রাগ করতে, তাই বলি নি। তেরোর কমে পোষাতে পারতাম না। বেকার লস খেয়ে গেলে মুশকিল হত। না হয়ে ভালই হয়েছে।"
চার ।।
মনোহরের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফুর্তির টাকা তো দূরের কথা, কিস্তির টাকাও আর যোগাতে পারছে না। কাকার কাছে কিছু পেলে সমস্যা আর থাকত না। সে এখন বুঝে গেছে, জুয়া খেলে আর ভাগ্য ফেরাতে পারবে না। ধারের টাকাটা শোধ করে দিলেই সে আর জুয়াটুয়ার ধার মাড়াতো না। কিন্তু কাকার কাছে কিসের নাম করে টাকা চাইবে ভেবে পায় না। তারপর কাকার যদি সন্দেহ হয়, বা পাড়ায় কানাঘুষোয় কিছু জানতে পারে, তাহলে আর দেখতে হবে না। মনোহর খুব মনমরা হয়ে থাকে।
রাস্তায় হঠাৎ লোটনের মুখোমুখি হয় সেদিন। সঙ্গে কাঁচা আর চশমা। তিনজনে মিলে মাল টানছিল সন্ধেবেলায়, চড়কতলায় বুড়ো অশ্বত্থ গাছটার তলায় বাঁধানো বেদীতে বসে। জায়গাটা খানিকটা অন্ধকার আর নির্জন। আর লোটনদের এড়াতেই আরো বেশি করে লোকজন ওইখানদিয়ে খুব একটা যাতায়াত করে না, মেয়েরা তো নয়ই।
লোটনই ডাকে তাকে, “এই মনো, শালা শোন এদিকে।“ তিনজনেরই চোখ লাল, মুখ দিয়ে ভক ভক করে বাংলুর গন্ধ উঠে আসছে। মনোহর এই কয়েকমাসে দামি দামি হুইস্কি খেয়ে একটা রুচি গড়ে তুলেছে, বাংলুর গন্ধটা তার অসহ্য মনে হয়।
-তোর কাকাটা কিন্তু বহুত হারামিগিরি করছে। লোকজনকে ঢপ ঢাপ খাইয়ে কলোনির জমিটা হাতাতে চাইছে। সবাইকে নাকি ফ্ল্যাট করে দেবে। তোর কাকা কি দানছত্র খুলে বসল না কি? হরসোবর্ধন? শালা সঞ্জয়দা অত ভাল প্যাকেজ দিচ্ছে, তবু মালগুলো তোর কাকার ঢপ খেয়ে গেল। কিছুতেই কোনও কথা শোনে না আর। দুই একটা পেটো ফেটো মেরে দিলে বা আগুন লাগিয়ে দিলেই সুড়সুড় করে কাজ হয়ে যেত, কিন্তু সঞ্জয়দা আবার শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই তোকে বলছি, কাকাকে বুঝিয়ে ঠিক পথে ফিরিয়ে আন। নইলে কিন্তু ওর ভুড়ি ফাঁসিয়ে দেবো। শালার উপর আমার বহুত খার আছে। আমি বারণ করা সত্বেও বিল্ডিং এর মাল কিনছে শালা সব বলাইয়ের কাছ থেকে, নরহরির কাছ থেকে না নিয়ে। আর কাকাকে আটকাতে না পারলে তুইও পার পাবি না। পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।
মনোহর বিনা বাক্যব্যয়ে সরে আসে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। লোটনদের সাথে গায়ের জোরে তার পেরে ওঠার কোনও প্রশ্ন নেই, আর তা ছাড়া ওদের কাছে হাতিয়ারও থাকে। কাকা মনোহরের কথায় কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা ছেড়ে দেবে, সেটা সম্পূর্ণ অলীক ব্যাপার। লোটন যে শুধু মুখে হুমকি দেয় নি, সেটা মনোহর ওর চোখে ঘৃণা দেখেই বুঝেছে। লোটন আগেও এক আধটা খুনের কেসে জড়িয়েছিল, সঞ্জয় ধর ওর কানেকশন ধরে ছাড়িয়ে এনেছে। তাহলে কি পুলিশকে খবর দিয়ে বাড়িতে পাহারাদার বসাবে? কিন্তু থানায় সঞ্জয় ধরের জোর অনেক, মনোহরের মুখের কথায় ওরা সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেবে না। লোটন যে সঞ্জয়ের কাজ করে, তা সবাই জানে। উলটে বরঞ্চ মনোহরের নামেই জুয়াটুয়ার কোনও কেস খাইয়ে দেবে। পুলিশ তো সবই খোঁজ রাখে।
বাড়িতে অবশ্য পাহারা বসানো বাড়ানো যায়। অনেক বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সি এখন বাড়ির নিরাপত্তার ভার নেয়। এখন একটা বুড়ো দারোয়ান আছে বটে, অনেকদিনের পুরোনো লোক, তবে সে আজকাল রাতের বেলায় ভাল দেখে না, বন্দুক টন্দুক চালানোর তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু কাকাকে কো-অপারেটিভ প্রজেক্ট থেকে আটকাতে না পারলে লোটনরা তাকেও যে পেটাতে ছাড়বে না, সেটা মনোহর ভালই বুঝতে পারে।
কি করবে সাত পাঁচ ভাবছিল মনোহর। কথাটা হঠাৎ বিদ্যুৎঝলকের মতো তার মাথায় খেলে।
ভেবে দেখলে সঞ্জয়-লোটনদের সঙ্গে তার নিজেরও স্বার্থ খুব আলাদা নয়। কাকা বসে আছে বিরাট সম্পত্তির উপর --- সে সম্পত্তির কিছুটাও যদি সে পেত, তার হেসেখেলে দিন চলে যেত। কাকা তো তেমন কিছু ভোগ করে না, আর আপন বলতে শুধু মনোহর, তাও কাকা বেঁচে থাকতে টাকাগুলো পাওয়া আটকে আছে। মনোহরের এটা খুব অবিচার মনে হয়, যে টাকা সেই পাবে কাকার অবর্তমানে, সে টাকা সে দরকারের সময় সে পাবে না কেন? কাকা এখন সবে ষাট পেরিয়েছে, হয়তো দুর্বল হার্ট নিয়েও বেঁচে থাকবে অনেকদিন। এতদিন ধরে চিকিৎসায় যে টাকাটা খরচ হবে, সেও তো মনোহরের পাওনা টাকা থেকেই। তার উপর কাকার ভীমরতি ধরেছে। কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা তো শিওর মানি লুজিং প্রজেক্ট। কাকা যদি এরকম করতে করতে সব উড়িয়ে দেয়, তাহলে মনোহরের কি হবে?
কাকা মরলে সব দিক থেকেই সুবিধা। পাঁচ-দশ বছর তো বটেই, বাকি জীবনটাই হয়তো পায়ের উপর পা তুলে কেটে যাবে।
কিন্তু তা বলে কাকাকে খুন! যে কাকা তাকে বড় করল বাবা মা মারা যাবার পর ছোটবেলায়।
ধুর, মনোহর খুন করবে কোথায়? করলে সে তো লোটনরা করবে। লোটনের সাথে মনোহরের কোনও ষড়যন্ত্র হয় নি, এমনকি কোনও যোগাযোগও নেই, বরঞ্চ একরকম বৈরিতারই সম্পর্ক বলা যায়। মনোহরকে কারুর সন্দেহ করার কিছু নেই। আর আইনতঃ সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কিন্তু তাকে উত্তেজিত হলে চলবে না। বাড়িতে রাধুনি-চাকর-মালি-ড্রাইভার-দরোয়ান নিয়ে অনেক লোক। তারা যেন কিছু আঁচ না করতে পারে। কাকা তো নয়ই।
দিন দুয়েক যাবার পর মনোহর পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। উত্তেজনায় বুক ধড়াস ধড়াসটা আর করছে না তার। এখন কাকার শরীর বেশি খারাপ বলে বেরোনোর সময় কাকা গাড়ি করেই যায়, সঙ্গে চাকর ড্রাইভার থাকে। প্রকাশ্য দিনে এত লোকের মাঝে লোটনরা কাকাকে মারতে পারবে না মনে হয়। সঞ্জয় ধর ওদের অতটা বেপরোয়া হতে দেবে না। তাহলে নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে মারতে আসবে। কাকা তো রাতে আর বাড়ির বাইরে বেরোয় না। তাহলে কি শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ওরা চেষ্টা করবে। কিন্তু কাকার ঘরে জানলা তো বন্ধই থাকে, এসি চালিয়ে শোয়। তাহলে কি জানলার ছিটকিনিটা একটু খুলে দেবে? আর ভাবতে পারে না মনোহর। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
একটু পরে ধাতস্থ হয় সে। তাকে পারতেই হবে। এ ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।
এখন মনোহর রোজই সবার অলক্ষ্যে জানলার ছিটকিনিটা খুলে দেয়। প্রথম দিন এত উত্তেজিত হয়েছিল যে নিজের ঘরে এসে একটু হুইস্কি খেয়েছিল। ঘুম আসে নি, মটকা মেরে পড়েছিল। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল। এখন সে সম্পূর্ণ নির্বিকার। দিব্যি ঘরে এসে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। সে জানে লোটনরা সুযোগ খুঁজবেই, আজ হোক কাল হোক, ঠিক কাজ সারতে আসবে। ছিটকিনিটা যে সে খুলেছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই, কেউ সেই প্রসঙ্গ তুলবে বলে মনে হয় না। আর তুললেও, যে চাকরটা ঝাড়পোঁচ করে, সে একটা ভুলোমন, সবাই ওকেই দোষ দেবে। মনোহর পুরোপুরি সেফ।
পাঁচ ।।
লোটন গুলিটা করেছিল জানলা আলগা করেই। সে তুখোড় বন্দুকবাজ, পাঁচ-দশ হাত দূর থেকে গুলি ফস্কানোর প্রশ্নই নেই। নাইটল্যাম্পের হাল্কা আলোই তার নিশানা করার পক্ষে যথেষ্ট। গুলিটা সুধীরবাবু মাথাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। ইন্সট্যান্ট ডেথ। মুখটা বীভৎস হয়ে গেছে, তাকানো যাচ্ছে না।
তবে লোটনদের কাজটা নির্বিঘ্নে হয় না। দারোয়ানটা পুরোপুরি ঘুমোয় নি, ঝিমোচ্ছিল। গুলির শব্দে সে উঠে দৌড়ে গিয়ে টর্চ মারে। লোটনরা তখন পাঁচিল টপকে পালাচ্ছিল। সে দেখে ফেলে। রাস্তার কুকুরগুলোও চিৎকার করতে থাকে। প্রতিবেশীরা কয়েকজন ওদের পালাতে দেখে।
সবচেয়ে কেঁদেছিল মনোহর। লোটন-সঞ্জয়দের সে দেখে নেবে বলে। থানায় অভিযোগ-পিটিশন জমা পড়ে। লোটন-কাঁচা-চশমারা এলাকা ছেড়ে পালায়। লোকজন সঞ্জয়ের বাড়ি চড়াও হয়। ভয়ে সে গা ঢাকা দেয়।
তিনদিন পর বর্ধমান জেলায় একটা চুল্লুর ঠেক থেকে লোটন ধরা পড়ে। কাঁচা আর চশমাও যথাক্রমে মেটিয়াবুরুজ আর কালিঘাটের বেশ্যাখানা থেকে ধরা পড়ে। সঞ্জয় কোর্টে আত্মসমর্পণ করে। জামিন পায়, তবে এলাকায় ঢুকতে সাহস করে না। কলকাতার নিউ টাউনে তার একটা ফ্ল্যাট আছে, সেখানেই থাকে।
মনোহরকে কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না। সে মনে মনে হাসে। খুন করে লোটন-সঞ্জয়রা শুধু আক্রোশ মিটিয়েছে, কিন্তু নিজেরা পুরোপুরি ফেঁসে গেছে। লোটনরা তো বটেই, সঞ্জয়েরও বড় রকমের জেলমেয়াদ হওয়ার কথা। আর ছাড়া যদি পায়ও সঞ্জয়, এলাকায় আর বাছাধনকে ব্যবসা করতে হচ্ছে না।
কলোনির লোকেরা মিটিং করে। সুধীরবাবুর স্মৃতিতে বিরাট শোকসভা হয়। মনোহর মঞ্চেই কেঁদে ফেলে। বয়স্ক লোকেরা এসে তাকে সান্ত্বনা দেয়। সুধীরবাবুর স্বপ্ন তারা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। সুধীরবাবুর লেগাসি এখন মনোহরের। কো-অপারেটিভের প্রজেক্টটা করতেই হবে, যত বাধাই আসুক। জমি হস্তান্তরের কাগজপত্র তারা শিগগিরি মনোহরের হাতে তুলে দেবে।
কেজরিওয়ালেরও কলোনির জমিটার উপর আগ্রহ আছে, অমিত বলছিল মনোহরকে। কেজরিওয়ালের সাথে কথা বলতে হবে, মনোহর ভাবে। জমিটা পেয়ে কেজরিওয়ালের হাতে তুলে দিলে কত কমিশন পাওয়া যাবে সে সব ব্যাপারে। অল্পে স্বল্পে ছাড়বে না সে, ভালরকম দাঁও মারতে হবে। কলোনির লোকেদের সময়মতো কিছু ভুজুং-ভাজাং দিতে হবে। প্রমোটারি ব্যবসাটায় খাটুনি অনেক, ঝুঁকি বেশি। তার থেকে অনেক সহজে অনেক বেশি রোজগার জমির দালালিতে। সঞ্জয় এখন ফুটে গেছে, ওর জায়গাটা মনোহর দখল করবে। কাকার লাইন তার জন্য নয়।
আজ আনন্দে খুব মদ খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই শোকের আবহাওয়ায় আজ বারে যাওয়া যাবে না, লোকে দেখে ফেললে পরিণতি ভাল হবে না। সে বাড়িতে ফেরে, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। দামি হুইস্কির বোতলটা খোলে। বরফ নেয় গ্লাসে, হুইস্কি ঢেলে একটা পরিতৃপ্তির চুমুক দেয়।
------------
প্রথম প্রকাশ, ফেসবুক, এপ্রিল ২০১৯
কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল
নামকরণে জীবনানন্দের পংক্তি ধার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
এটা কিন্তু নিতান্তই সাদামাটা একটা ক্রাইম আর মোটিভের গল্প। এর মধ্যে মাসদুয়েক আগের সীমান্ত হামলার ঘটনার কোনও রূপক খুঁজলে নিজ দায়িত্বে খুঁজবেন, লেখক দায়ী নয়।