শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আফগান সংকট --- আমেরিকার কুড়ি বছরের ব্যর্থ অভিযান

 আফগান সংকট --- আমেরিকার কুড়ি বছরের ব্যর্থ অভিযান

 -শুভাশিস ঘোষাল 

এই মুহুর্তে পৃথিবীর সর্বত্র আলোচ্য বিষয় হল আফগানিস্তান আবার তালিবানদের দখলে চলে যাওয়া ও তার ফলে উদ্ভূত মানবিক সংকট। তালিবানের শাসন থেকে নিষ্কৃতি পেতে কাতারে কাতারে মানুষ কাবুল এয়ারপোর্টে জড়ো হয়ে বিমানের অপেক্ষা করছেন বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বিমানে ঝুলে পড়ছেন, এরকম দৃশ্য দেখে মানুষ আঁতকে উঠেছে। কত সাংঘাতিক পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ এতো বড়ো ঝুঁকিও নিতে পারে, সেটা আন্দাজ করা যায়, কারণ মানুষ এর আগে তালিবানি শাসনের মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি আর নৃশংসতার পরিচয় পেয়েছে। আমেরিকার কুড়ি বছরের আফগানিস্তান অভিযানের শেষে তাহলে কি পাওয়া গেল? কেনই বা আমেরিকার আফগান নীতি এরকম শোচনীয় ব্যর্থ হল? কেন আফগান সরকারি বাহিনী আমেরিকার কাছ থেকে এত সাহায্য, প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র পেয়েও তালিবানদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ দিতে ব্যর্থ হল? আর সব ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠছে, আমেরিকার প্রশাসনের তরফে এতটা বিশৃংখলা কি এড়ানো যেত না? আমেরিকা সরে যাবার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন, রাশিয়া আর পাকিস্তান সেই শূণ্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসবে, ফলে এই অঞ্চলে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আইসিস ও অন্যান্য আরও চরমপন্থী জঙ্গি সংগঠন নতুন জমি পেয়ে যেতে পারে। আফগান সংকট ভারতবর্ষের জন্যও বিশেষ চিন্তার বিষয়, কারণ তালিবানের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা, বিশেষ করে কাশ্মীরে। ভারতীয় কোম্পানি আর কর্মীরা যারা আফগানিস্তানে নির্মান বা পরিষেবা শিল্পে নিযুক্ত ছিল, তারাও কাজ হারাবে। সব মিলে, পরিস্থিতি খুবই বিমর্ষকর।

আফগানিস্তানকে বলা হয় সাম্রাজ্যের কবরখানা। তার কারণ জারের রাশিয়ার রাজ্যবিস্তার আফগান সীমান্তে এসে থেমে গিয়েছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আফগানিস্তান দখল করতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়, আর গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সর্বশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তি আফগানিস্তানের মতো ছোট অনুন্নত দেশে অভিযান করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। কথাটা অবশ্য কিছুটা সরলীকরণ --- ব্রিটিশরা সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্য নিয়ে আফগানিস্তান অভিযান করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল অন্য। তবে পাহাড়ে ঘেরা দুর্গম জায়গা আর বিভিন্ন সশস্ত্র উপজাতীয় গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান জয় করা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার সাধ অপূর্ণ রেখেই মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে আফগানিস্তান সন্ত্রাসের ঘাঁটি হয়ে উঠল, কেন এত শক্তিশালী আমেরিকা অন্য দেশের কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়েও তালিবানদের রুখতে পারল না, আর কিভাবে আমেরিকার আফগানিস্তানে অভিযান পূর্বতন সোভিয়েত অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা বুঝতে গেলে আফগানিস্তানের ইতিহাসটা কিছুটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আফগানিস্তানের ইতিহাস চার হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। কাবুল উপত্যকাতেই সাড়ে তিন হাজার বছরের উপর মানুষ টানা বাস করছে, ভারতবর্ষেরও কোনও বর্তমান জনপদ এতটা প্রাচীন নয়। সিল্ক রুট ধরে চলা  বাণিজ্যপথে আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। আফগানিস্তানের ইতিহাসও অস্থিরতায় ভরা। অতি প্রাচীন যুগে পারস্য ও সিন্ধু-সভ্যতার মধ্যে অবস্থিত আফগানিস্তানের দুই দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল। আলেকজান্দার এই অঞ্চল দখল করেছিলেন। তারপর গ্রীকরা উত্তর আফগানিস্তানে ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্য গড়ে তোলে। মৌর্য ও কুষাণদের অধিকারে ছিল একসময় আফগানিস্তান, বৌদ্ধধর্ম প্রসারলাভ করেছিল। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে আরব বিজয়ের ফলে ইসলাম ধর্ম আফগানিস্তানে সর্বব্যাপী হয়। এরপর চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, বাবর এবং দিল্লীর থেকে ঘুরি আর  খিলজি সুলতানদের আক্রমণে পড়েছিল আফগানিস্তান। তবে বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর অধীনে থাকা এই অঞ্চলকে একটা দেশ হিসেবে একীকৃত করেছিলেন আহমেদ শাহ দুরানি, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝে। পাশতুন গোষ্ঠীর দুরানি পারস্য সম্রাট নাদির শাহের সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। নাদির শাহের মৃত্যুর তিনি দেশে ফিরে একে একে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দলে টানেন বা জয় করেন। তিনি ভারতবর্ষ অভিযানও করেন ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে যেতেন। তবে শিখদের সঙ্গে লড়াইয়ে পিছু হঠে আবার আফগানিস্তানের সীমানার মধ্যেই ফিরে আসেন। এই সময় জারের রাশিয়ার মধ্য এশিয়ায় প্রসারণ, ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও চীনের উপর ইংরেজ নিয়ন্ত্রণের ফলে আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়ে দেশটা বাকি পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধর্মীয় সূত্রে প্রায় সবাই সুন্নি মুসলমান হওয়ায় আর পাহাড়ে ঘেরা একটা অঞ্চলে আবদ্ধ হবার ফলে দেশ হিসেবে আফগানিস্তান ঐক্যবদ্ধ হয়। আর দেশে লড়াইমুখী রক্ষণশীল সংস্কৃতি গড়ে ওঠারও এটাই বড় কারণ।

জারের রাশিয়ার অগ্রগতিতে চিন্তিত হয়ে ব্রিটিশরা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আফগানিস্তান অভিযান করে, কারণ তাদের ভয় ছিল আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে রাশিয়া ভারতবর্ষ দখল করে ফেলতে পারে। এই অভিযানে ব্রিটিশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের বসানো তাঁবেদার শাসক ব্যর্থ হলে আবার পুরোনো শাসক দোস্ত মহম্মদকে গদি ফিরিয়ে দিতে হয়। বিদেশনীতি ছাড়া আর সব ব্যাপারে আফগানিস্তানের স্বশাসন মেনে নেওয়া হয়, ব্রিটিশ-ভারতবর্ষের সঙ্গে চিরস্থায়ী সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইন টানা হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে বাকি সময় তারা সদ্ভাব মেনে চলে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাইজার এবং অটোমানদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও তারা অক্ষশক্তিতে যোগ দেয় নি। আফগানিস্তান পুরোপুরি স্বাধীনতা পায় ১৯১৯ সালে। ১৯২৬ সালে সংবিধান চালু হয়। আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানের স্বাধীন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন, ও দেশের আধুনিকীকরণ ধীরে ধীরে শুরু করেন। তবে ১৯২৯ সালে গৃহযুদ্ধে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইতালিতে পালিয়ে যান। ১৯৩৩ সালে আফগানিস্তানের রাজা হিসেবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা পান মহম্মদ জাহির শাহ। তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর সময়ে আফগানিস্তান স্থিতিশীলতা পায়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গেই তিনি সুসম্পর্ক রেখে উভয় দেশের সাহায্যেই দেশের আধুনিকীকরণ করছিলেন। কাবুলে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তিনি বোরখা নিষিদ্ধ করেছিলেন ও স্কুল-কলেজে কো-এডুকেশন নীতির প্রচলন করেছিলেন। মেয়েরা বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পারত। রক্ষণশীল আফগানিস্তানে ইসলামী মৌলবাদীরা অবশ্য এতে অসন্তুষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু জাহির শাহ খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার মোটামুটি নির্বিঘ্নেই শাসন চালান। তবে অঘটন ঘটে ১৯৭৩ সালে, যখন ইতালিতে ছুটি কাটানোর সময় তার জ্ঞাতিভাই দাউদ খান তাঁকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, ও রাজতন্ত্র বাতিল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। তবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নয়, তাঁর মন্ত্রীরা সবাই মনোনীত হতেন। দায়ুদের স্বৈরাচারী শাসন অবশ্য জনপ্রিয় হচ্ছিল না। দেশে বামপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ও অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি মুজাহিদীনরা শক্তিশালী হতে থাকে। ব্যাঙ্ক জাতীকরণের মতো সমাজতান্ত্রিক সংস্কার করলেও দায়ুদের সোভিয়েত-বিরোধী মুসলিম দেশদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ও দেশের উত্তর অংশে সোভিয়েত সীমানার কাছাকাছি সামরিক  ঘাঁটিতে নেটোর বিশেষজ্ঞদের সফর সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুষ্ট করে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত অস্ত্রের সাহায্যে পিডিপিএ ‘সর (এপ্রিল) বিপ্লবের’ মাধ্যমে দায়ুদ খানকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে ও আফগান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কমিউনিস্ট নেতা নুর-মহম্মদ তারাকি রাষ্ট্রপতিপদে বসেন, ও ভূমি-সংস্কার সহ সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেন। তারাকির আশা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান এতে উপকৃত হবে ও কমিউনিস্টদের সমর্থন বাড়বে। স্থানীয় স্তরে উপজাতীয় শাসনে অভ্যস্ত রক্ষণশীল আফগান সমাজে এই ধরণের সংস্কার তেমন বোধগম্য হয় না, প্রভাবশালীরা রুষ্ট হয় তো বটেই।  দেশের উৎপাদনেরও কোনও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয় না। পিডিপিএ দলের ও সরকারের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর লড়াই,আর বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিনের ‘বিপ্লবের বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি সন্ত্রাসের নীতি’ তারাকির সরকারের জন্য বিশেষ বিড়ম্বনার কারণ হয়। ওদিকে সেই সুযোগে বিরোধী মুজাহিদীনদের শক্তি বাড়াতে থাকে। তারাকি সোভিয়েত নেতৃত্বের কাছে সাহায্য সামরিক প্রার্থণা করেন, কিন্তু সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ তাঁকে নিরস্ত করেন ও সোভিয়েত বাহিনীর আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে সামরিক হস্তক্ষেপ কাম্য নয় বলে জানান। ব্রেজনেভ তারাকিকে বলেন লোকের মন বুঝে সংস্কারের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে আর আমিনকে সামলাতে। কিন্তু তারাকি তা করতে ব্যর্থ হন, বরঞ্চ আমিন তাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন আর তারাকির প্রাণদন্ড দেন। আফগানিস্তানে তখন চুড়ান্ত বিশৃংখলা চলছিল, আর মুজাহিদীনরা শক্তিশালী হচ্ছিল। পিডিপিএর দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পরিস্থিতি দেখা দেয়।

আফগানিস্তানে যখন এইসব ঘটনা ঘটছিল, তখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডেমোক্র্যাটিক দলের জিমি কার্টার। তিনি নরমপন্থী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন। ঠান্ডা যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে এর চারবছর আগে ভিয়েতনামে কুড়ি বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার পর আমেরিকা সেখান থেকে খালি হাতে ফেরে। সেই যুদ্ধের ঘা তখনও দগদগে। আফগান সংকটে সোভিয়েতপন্থী সরকারের পতন হলে আমেরিকার বড় লাভ হয়। ইতিমধ্যে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসে। ইরানে আমেরিকান দূতাবাসে আমেরিকান কূটনীতিকদের বন্দী রাখা হয়েছিল। জ্বালানীর দামও অত্যধিক বেড়ে গেছিল, সামগ্রিকভাবে আমেরিকা তথা সারা পৃথিবীতে একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছিল। কার্টারের উপর পেন্টাগনের চাপ আসছিল আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করার জন্য। কার্টারের প্রশাসন তখন মুজাহিদীনদের অর্থসাহায্য দেওয়া শুরু করে। আমেরিকার ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে কিছুতেই নিজেদের সেনা পাঠাবে না। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হবে।

আফগানিস্তানে অরাজকতা ও মুজাহিদীনদের প্রভাব বাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিচলিত করে। সোভিয়েত নেতৃত্বের আশংকা হয়, কাবুলে সরকারের পতন হলে ইসলামী মৌলবাদ সীমান্ত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে ছড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের ইসলামিক বিপ্লব, পাকিস্তানের ঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা আর সৌদি আরবের মুজাহিদীনদের অর্থ যোগানো সেই চিন্তাকে বাড়িয়ে তোলে। তা ছাড়া আমিন শিবির বদলে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন, এমন আশংকাও সোভিয়েত নেতৃত্বের ছিল। এই ধারণা অবশ্য অমূলক ছিল, কারণ আমিনই সোভিয়েত সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠাচ্ছিলেন বারবার। ব্রেজনেভ আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর ব্যাপারে বেশ যত্নবান ছিলেন। বিভিন্ন দেশে বামপন্থী গেরিলাদের সাহায্য যোগালেও ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত এলাকার বাইরে তিনি সরাসরি সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েন করেন নি কখনও। আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর দ্বিধা ছিল। কেজিবি প্রধান (পরে রাষ্ট্রপ্রধান) ইউরি আন্দ্রোপভ তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে দু-তিন মাসের মধ্যেই সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে এনে দেশে ফিরে আসতে পারবে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে ও দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আমিনকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়। প্রথমে বারবাক কারমালের ও পরে মহম্মদ নাজিবুল্লার নেতৃত্বে সোভিয়েত সেনা সহায়তায় পিডিপিএ সরকার চালায়। ব্যাপক মৃত্যুদন্ড দেওয়া বন্ধ হয়, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়, মুক্ত-ভাষণের অধিকার মেনে নেওয়া হয়, অধিগৃহীত জমিও বেশ কিছু ফেরত দেওয়া হয়। এই সময় আফগান সমাজ বেশ কিছুটা প্রগতিশীল ছিল, মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়তে পারত, চাকরি করতে পারত, ডাক্তারদেরও চল্লিশ শতাংশই ছিল মহিলা।

তবে সোভিয়েত নেতাদের যে হিসেব ছিল কয়েকমাসের মধ্যেই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের বাহিনী ফেরত চলে আসবে, তা শোচনীয়ভাবে ভুল প্রমাণ হয়। আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্রের সাহায্যে মুজাহিদীনরা সোভিয়েত বাহিনীকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে দুর্গম পাহাড়ে পালিয়ে যেত। সোভিয়েত সেনা তাদের নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৮০ সালে কার্টারকে হারিয়ে কট্টরপন্থী রনাল্ড রেগন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর আফগান মুজাহিদীনদের দেওয়া মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। মোট দুহাজার কোটি ডলারের অস্ত্রসাহায্য দেয় আমেরিকা। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জিয়া-উল-হকের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদীনদের হাতে সেইসব অস্ত্র পৌঁছে দিত। যুদ্ধ প্রলম্বিত হতেই থাকে। অনিচ্ছার যুদ্ধে আমেরিকা যেমন ভিয়েতনামে পাঁকে পড়ে গিয়ে বহুবছর  আটকে পড়েছিল, সোভিয়েত বাহিনীরও সেই দশা হয়। পরবর্তী দশ বছর তারা ব্যাপক নাজেহাল হয়। তাদের মোট পনের হাজারের মতো সৈন্য মারা যায়। সাধারণ আফগান নাগরিকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। অনুমান করা হয় মুজাহিদীন সহ পাঁচ থেকে কুড়ি লক্ষ আফগান প্রাণ হারিয়েছিল এই যুদ্ধে, আর শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত নাগরিকের সংখ্যা সব মিলে হতে পারে সত্তর লক্ষের মতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ফলে সারা পৃথিবীতেই নিন্দিত হয়। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের চেষ্টা করতে থাকেন। বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে সোভিয়েত আর মুজাহিদীন, এই দুই পক্ষই নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে অপরপক্ষকে জানিয়ে সামরিক হানা করত। অবশেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।

তবে আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নাজিবুল্লার নেতৃত্বাধীন পিডিপিএ সরকারকে সাহায্য পাঠায়। নাজিবুল্লাহ আরও তিন বছর ইসলামী মুজাহিদীনদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তবে ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙ্গে গেছে, অনুগত বাহিনীর অনেকে শিবির বদল করে মুজাহিদীনদের দলে যোগ দিয়েছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল হলে ১৯৯২ সালে নাজিবুল্লা ক্ষমতাভার ছেড়ে দেন ও কাবুলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অফিসে আশ্রয় নেন। রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্ততায় বুরহাউদ্দিন রাব্বানির নেতৃত্বে বিভিন্ন মুজাহিদীন গোষ্ঠী মিলিয়ে সরকার গঠন করা হয়। দেশের নাম দেওয়া হয় আফগান ইসলামিক রাষ্ট্র। তবে পাকিস্তানের মদতে চরমপন্থী নেতা গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার পুরো ক্ষমতাটাই নিজের হাতে চান, তাই গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও  নর্দার্ন অ্যাল্যায়েন্স নামক তাজিক, উজবেক ও অন্যান্য উত্তরাঞ্চলের উপজাতিদের মিলিত সামরিক সংগঠনের নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ, যিনি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, মধ্যস্ততা করে হেকমেতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান ও কিছুটা শান্তি ফেরে। কিন্তু আফগানিস্তানে তাদের প্রভাব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের চর সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আই এস আই) মুজাহিদীনদের একটা অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তালিবান নামে একটা চরমপন্থী মৌলবাদী ধর্মীয়-সামরিক বাহিনী তৈরি করে। তালিবান কথাটা পশতু ভাষায় ছাত্র বোঝায়, কারণ তারা পাকিস্তানের মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমেরিকা পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে জেনেও না জানার ভান করে থাকে, পাকিস্তানকে অর্থ ও সামরিক সাহায্য দেওয়া চলতেই থাকে। তালিবানরা এর পর সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে দেশের সিংহভাগ দখল করে ফেলে। কঠোর শরিয়তি আইন চালু হয়, স্কুল-কলেজ,  গান-বাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়, মেয়েদের প্রায় সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ব্যাপক লুঠ, নরহত্যা, প্রায় বিনা অপরাধে মধ্যযুগীয় বর্বর শাস্তিপ্রদান, অস্ত্র, মাদক ও আফিংএর চোরাচালান এসব চলতে থাকে। সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে দেখে বামিয়ানের বিখ্যাত প্রাচীন  বুদ্ধমূর্তি তালিবানরা ধ্বংস করে ফেলে। তালিবানি বাহিনীর বিরুদ্ধে নর্দার্ন অ্যাল্যায়েন্স প্রতিরোধ জারি করে দেশের উত্তরাংশকে তালিবানমুক্ত রাখতে সমর্থ হয়। ওদিকে তালিবানরা কাবুলের দিকে এগিয়ে আসছিল। কাবুলের পতন হবার উপক্রম হলে নাজিবুল্লাকে শহর ছেড়ে পালাতে বলা হয়, কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করার পর চুড়ান্ত অত্যাচারের পর তালিবানরা নাজিবুল্লাকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। তারা নিজেদের আফগানিস্তানের শাসক বলে দাবী করে ও দেশের নামকরণ করে আফগান ইসলামী আমিরশাহী। শুধু পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী তালিবানের সরকারকে স্বীকার করে। রাব্বানি নির্বাসিত সরকার চালাতে থাকেন  পৃথিবীর বাকি দেশগুলো রাব্বানির সরকারকেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়।

এদিকে পৃথিবীর অন্যত্র অনেক মুসলিম দেশে আমেরিকার প্রতি বন্ধুভাব কমে আসে। ইসরায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমেরিকার প্রতি একধরণের অনুযোগ সবসময়ই ছিল মুসলিম সমাজে, কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে যৌথবাহিনী সাদ্দাম হুসেনের ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করে ও সেই উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের মাটিতে সৈন্য মোতায়েন করে। রক্ষণশীল মুসলিমদের কাছে সৌদি এক পবিত্রভূমি, ইসলাম ধর্মের জন্মস্থান, হজরত মুহম্মদের স্মৃতিবিজড়িত। ওসামা বিন লাদেন নামে এক ধনী সৌদি অভিজাত রক্ষণশীল মুসলিম নেতা, যিনি সোভিয়েত বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে আফগানিস্তানের মুজাহিদীনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন, বিদেশী সৈন্যের সৌদিভূমিতে অবস্থান নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন, কিন্তু সৌদি আরবের রাজা তার কথায় আমল দেন না। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সিনিয়র বলেছিলেন সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতা থেকে না হঠানো পর্যন্ত সৌদি মাটিতে আমেরিকার সৈন্য থাকাটা জরুরি। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের পরে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাদ্দামকে বুশ ক্ষমতা থেকে সরান না, আর সৌদি থেকেও সৈন্য সরান না। লাদেন এবার ক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমকে আমেরিকার বিরিদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে বলেন। সৌদি আরব লাদেনকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। লাদেন সুদানে আশ্রয় নেন। তবে সুদানও তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর হলে আর সুদানে তার ব্যবসা মার খাবার পর নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে লাদেন তালিবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আফগানিস্তানে আশ্রয় নেন ও ইসলামি জিহাদি সংগঠন আল-কায়েদা গড়ে তোলেন। এর পর একের পর এক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করতে থাকে তারা। ১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে বোমাবিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য তারা পায় ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, যখন আল-কায়েদা জঙ্গিরা চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে। তিন হাজার আমেরিকাবাসী সাধারণ মানুষ মারা যায় এই আক্রমণে। ভৌগলিকভাবে সুরক্ষিত আমেরিকায় এত বড় জঙ্গিহানা আগে কখনও ঘটেনি। সারা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে টেলিভিশনে দেখে সেই দৃশ্য। আমেরিকার নাগরিকেরা আগে কখনও এরকম বিপন্ন মনে করে নি নিজেদের। সর্বত্র দাবী ওঠে জঙ্গিদের ধ্বংস করে দিতে হবে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন তালিবানদের কাছে দাবী করে লাদেন ও তাদের সংগঠনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা ওমর সে দাবী অগ্রাহ্য করেন। প্রায় নজিরবিহীন ঐক্যমত্যে মার্কিন আইনসভার উভয় কক্ষই বুশকে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আফগানিস্তানে অভিযানের অনুমতি দেয়। সারা পৃথিবীর জনমতই বলতে গেলে আমেরিকার অভিযানের পক্ষে ছিল। ২৬ এ সেপ্টেম্বর আমেরিকা আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আমেরিকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তালিবানদের দৃশ্যমান ঘাঁটিগুলো সহজেই ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তালিবান আর আল-কায়েদাবাহিনী পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে টিঁকে থাকে। তালিবান বিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়েন্স কাবুলসহ দেশের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নেয়, তবে প্রত্যন্ত গ্রামে তালিবানরা ঘাঁটি গেড়ে থাকে। ২০০১ এর ডিসেম্বরে তোরা বোরা পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে মার্কিন বাহিনী লাদেনকে প্রায় ধরে ফেলেছিল, কিন্তু লাদেন তাদের হাত ফস্কে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়েন। পাকিস্তান কিছুই না জানার ভান করে, যদিও পরে এটা নিঃসংশয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আই এস আই এর ব্যবস্থাপনায়ই লাদেন আর মোল্লা ওমর পাকিস্তানে ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তানের সন্দেহজনক ভূমিকা দেখেও আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে সেরকম কিছু ব্যবস্থা নেয় না, তাদের সাহায্য পাঠানোও বন্ধ করে না। বরঞ্চ মার্কিন বিদেশসচিব ডনাল্ড রামসফেল্ড বলেন যে আফগানিস্তানে বড় কোনও সংঘাতের আর সম্ভাবনা নেই, তালিবান প্রায় শেষ হয়ে গেছে, মার্কিন সৈন্য শুধু আফগানিস্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখবে। বলা বাহুল্য, বাস্তবে তা ঘটেনি। খুব সম্ভবতঃ রামসফেন্ড নিজেও একথা বিশ্বাস করতেন না। আসলে বুশ-চিনি-রামসফেল্ডরা তখন তাদের পরবর্তী যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন ইরাকে, তাই আফগানিস্তানে কাজ প্রায় শেষ, এরকম একটা বার্তা দেশে দেওয়া দরকার ছিল ইরাক যুদ্ধে সমর্থন আদায় করার জন্য। রাষ্ট্রপতি বুশও বলেছিলেন আফগানিস্তানে জঙ্গিদের হঠানোর পর আমেরিকা সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে আর দেশ গড়ার কাজে হাত লাগাবে।

তালিবান পরবর্তী আফগানিস্তানে প্রথমে হামিদ কার্জাইয়ের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানে প্রথম দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়। কার্জাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ও ২০০৯ সালে পুনর্নির্বাচিত হন। তবে কার্জাই সংস্কারের ব্যাপারে খুব সাবধানে চলতে থাকেন। তিনি তালিবানদের ভাই এবং দেশপ্রেমিক বলে সম্বোধন করেন, আফগানিস্তানের গঠনে তাদের ভূমিকা নিতে অনুরোধ করেন, জঙ্গিদের সাথে শান্তি-আলোচনা করেন, পাকিস্তান-আফগানিস্তান যমজ ভাই বলেন, মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, ক্রিমিয়ার উপর রাশিয়ার দাবী সমর্থন করেন। মার্কিন বাহিনীর হাতে আফগান নাগরিক হতাহত হবার জন্য তিনি অনেকবার উষ্মা  জানান। এসবের ফলে আমেরিকার ভ্রূকুঞ্চন হয়, তবে মোটের উপর আমেরিকার সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালোই ছিল। তবে কার্জাই সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল মানুষের। মার্কিন সাহায্যের ছিঁটেফোঁটাও সাধারণ আফগানদের কাছে পৌঁছচ্ছিল না, রাজনীতিক ও পদস্থ সরকারি কর্মচারিরা আত্মসাৎ করে ফেলছিল। আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি পরিবারই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সক্ষম মানুষদের প্রতি চারজনের একজনই কর্মহীন, দেশটা মূলতঃ আন্তর্জাতিক সাহায্যে চলে। আফগানিস্তানের মাটির নিচে মূল্যবান খনিজের বিরাট ভান্ডার (অনুমান করা হয় এক থেকে তিন লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের লিথিয়াম, তামা, সোনা, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি) আছে। কিন্তু রাস্তাঘাটের অভাব আর জঙ্গি উপদ্রবের জন্য সেগুলো তোলার তেমন ব্যবস্থা হয় নি আর ফলে কর্মসংস্থান বা সরকারি আয়ও হয় নি। ফলে এখনও আফগানিস্তান পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। বহু মানুষ বেআইনি আফিংএর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। টহলদার বাহিনী মাঝে মাঝে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়। ড্রাগের চোরাচালান বন্ধ করতে আমেরিকার প্রস্তাব ছিল বিমান থেকে ওষুধ ছড়িয়ে ব্যাপকহারে আফিংএর ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়া, কিন্তু কার্জাই সম্মতি দেন নি। ২০১০ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতায় খানিকটা উন্নতি হবার পর তা আবার কমতে থাকে। তবে সামাজিক ক্ষেত্রে তালিবানের সময়ের তুলনায় বেশ কিছু উন্নতি হয়। শিশুমৃত্যুর হার অর্ধেক হয়ে যায়, মেয়েদের স্বাক্ষরতার হার বেড়ে ৩৭% হয়। জন্মহার সাড়ে সাত থেকে কমে চার হয়, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের গর্ভধারণের প্রবণতা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। তবে বুশের রাষ্ট্রপতিত্বে লাদেন সহ অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীদের ধরা সম্ভব হয় না, তালিবানদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ ও গ্রামাঞ্চলে নতুন ঘাঁটি বাড়তে থাকে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয় না, সামগ্রিকভাবে দেশগঠনের প্রতিশ্রুতি শুধু কথার কথাই রয়ে যায়।

২০১১ সালে বারাক ওবামা আমেরিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার পর আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসের ঘাঁটি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সাময়িকভাবে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি বাড়িয়ে তিরিশ হাজার থেকে এক লক্ষের উপর নিয়ে যান। তাঁর বক্তব্য ছিল এরপর আফগান সরকারি সেনাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলার উপযুক্ত করে দিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেবে। ওবামার সময়ে আফগানিস্তানে আমেরিকার বিনিয়োগের প্রায় সবটাই মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা এবং আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে ব্যয় হয়। ফলে দেশের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে। আমেরিকা যে আর আফগানিস্তানের দেশ গঠনে তেমন উৎসাহী নয়, তা পুরো পরিষ্কার হয়ে যায়। ওবামার সময় সব থেকে বড় সাফল্য পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ সামরিক ঘাঁটিতে লুকিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন কম্যান্ডো বাহিনীর হত্যা করে আসা। মোল্লা ওমরকেও খতম করা সম্ভব হয়। এর ফলে ২০১২ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি র্নিবাচনের সময় ওবামা বেশ কিছুটা সুবিধা পান। বিতর্কের সময় তিনি একথা জোর দিয়ে বলেন যে শিগগিরিই আফগান বাহিনীকে স্বনির্ভর করে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করতে পারবে। ওবামা সেনার সংখ্যা অনেক কমিয়ে দশ হাজারের নিচে নিয়ে আসেন। তবে ইতিমধ্যে ইরাক থেকে আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নেবার পর সেখানে আইসিস জঙ্গি গোষ্ঠীর রমরমা দেখে তিনি আফগানিস্তান থেকে আর বাকি সৈন্য সরাতে সাহস করেন নি। একরকম স্থিতাবস্থা বজায় রেখে আমেরিকার নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি যথাসাধ্য কমিয়ে ওবামা তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের বাকি সময়টা কাটিয়ে দেন।

২০১৬ সালের আমেরিকার নির্বাচনে প্রথাবিরুদ্ধ রাজনীতিক ডনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ঘটে। তাঁর ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির কথা হল মূলতঃ বাকি পৃথিবীর সমস্যাকে কোনও আমল না দেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্প দাবি করেন তিনি রাষ্ট্রপতি হলে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে আনবেন, কারণ এতে অনর্থক ব্যয় হচ্ছে করদাতাদের টাকার। আফগানিস্তানের কি অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতির পনের বছর গড়িয়ে গেছে। সাধারণ আমেরিকানদের আফগানিস্তান নিয়ে আর কোনও উৎসাহ না থাকাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে লাদেন নিহত হবার পর।  প্রতিটি সেনার মৃত্যু সেই অনীহা আরও বাড়ায়। জনমত তাই সেনা প্রত্যাহারের পক্ষেই ছিল। খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রাম্প নির্বাচিতও হয়ে যান। কিন্তু প্রত্যাহার নয়, ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথমে সেনা মোতায়েন আসলে বেড়ে দশ হাজারের উপর হয়ে যায়। তবে তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ট্রাম্প তালিবানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় এসে সেনার সংখ্যা কমিয়ে আড়াই হাজারের মতো করেন। ২০২১ সালের মে মাসের শেষে বাকি বাহিনীকেও ফিরিয়ে আনা হবে এই মর্মেও কথা হয়। অবশ্য তালিবান সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে আমেরিকায় খাতায় চিহ্ণিত বলে কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় না।

২০১৪ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আশরাফ গনি। পশ্চিমে শিক্ষিত ও বিশ্বব্যাঙ্কে কাজ করা উদারপন্থী গনি প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তানে শিকড়হীন। বহুদিন তিনি আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। তবু প্রথম পর্যায়ের ভোটে  পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটে তিনি গরিষ্ঠতা পান। তাঁর নির্বাচনও বিতর্কিত এবং আমেরিকার মধ্যস্ততায় জেতা, ফলে গনির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সাধারণ আফগানদের প্রশ্ন আছে। আমেরিকার ক্রীড়নক হিসেবেই অনেকের কাছে তিনি পরিচিত। ২০১৯ সালে আর এক বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। গনির আমলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি স্লথগতিতে চলে, দুর্নীতি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, সাধারণ আফগানদের দুর্দশা কমে না। গনি, তাঁর পরিবার এবং সাঙ্গপাঙ্গরা প্রচুর সম্পত্তি করেছেন, এরকম অভিযোগ সর্বত্র শোনা যায়। তালিবানদের প্রতি গনি নরম মনোভাব নিয়ে চলেন। তালিবানদের শক্তি বৃদ্ধি পায়, বিশেষকরে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে তালিবানরা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। সম্ভাব্য মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানি সরকারি বাহিনীকে স্বনির্ভর করার জন্য গনির কোনও তৎপরতা চোখে পড়ে নি।

২০২০ সালের নির্বাচনে দুই প্রধান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন দুজনেই ২০২১ সালের মধ্যেই পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দেন। কুড়িবছরব্যাপী আফগান যুদ্ধের খরচ ইতিমধ্যে মোট দু লক্ষ কোটি ডলারে ঠেকেছে। আমেরিকা সৈন্য হারিয়েছে আড়াই হাজারের মতো, আর হাজার চারেকের কাছাকাছি ঠিকাদার কোম্পানিদের হয়ে কাজ করতে যাওয়া আমেরিকান নাগরিক। নেটোভুক্ত সহযোগী দেশের সেনা হাজারের উপর, শ পাঁচেক ত্রাণকর্মী আর বাহাত্তরজন সাংবাদিক। সেনা, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ মিলে এক লক্ষের উপর আফগান মানুষ মারা গেছে। আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান যুদ্ধের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হলেও উপেক্ষা করার মতো নয় কিছুতেই। তবে এই যুদ্ধ আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের তেমন ব্যতিব্যস্ত করেনি, কারণ এর ফলে তাদের বেশি কর দিতে হয় নি, যেমন কোরীয় আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যাপকহারে বাড়ানো হয়েছিল উচ্চ আয়ের লোকেদের জন্য। বুশ বরঞ্চ করছাড় দিয়েছিলেন, বিশেষকরে ধনীদের জন্য। এর কারণ যুদ্ধের খরচ যুগিয়েছে ঋণ। তবে ঋণ এক সময় শোধ করতে হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে এইজন্য আমেরিকাকে সাড়ে ছয় লক্ষ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। যুদ্ধ ফেরত সেনাদের পুনর্বাসনে আরও দুলক্ষ কোটি ডলারের বোঝা চাপবে। অবশ্য শিগগিরি টাকা দিতে হচ্ছে না, তাই সাধারণ মানুষের এই আর্থিক বোঝা নিয়ে ভাবিত হবার কারণ ঘটেনি। তবে ইতিমধ্যে কোভিড সংক্রমণ ও অর্থনীতির উপর কোভিডের প্রভাব প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন জেতেন। তবে আগের দুই রাষ্ট্রপতির সময় যা হয় নি, এবারে সত্যি সত্যিই আমেরিকা সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়। মের মধ্যে না হলেও অগস্টের ৩১ তারিখের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হবে বলে বাইডেন জানান। তিনি এও বলেন “যে চিন্তার কারণ কিছু নেই, আফগান বাহিনীকে অনেক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসাহায্য দেওয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে যথেষ্ট সমর্থ। আমেরিকার পক্ষে চিরকাল অন্য দেশে সেনা রেখে দেওয়া সম্ভব নয়।'' তাঁর মতে "আফগানিস্তানের থেকে আরও অনেক বড়ো নিরাপত্তার সমস্যাগুলোকে আমেরিকার গুরুত্ব দিতে হবে। আফগানিস্তানকে গড়ে তোলাও আর আমেরিকার কাজ নয়। ছেড়ে চলে আসার কোনও আদর্শ সময়ও কখনই পাওয়া যাবে না। দ্রুতগতিতে সেনা প্রত্যাহারই এই পরিস্থিতিতে সেরা সমাধান।" জুলাই মাসের শুরু থেকে উল্লেখযোগ্যরকম সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়।

কিন্তু এর পরে যা হয় তা একরকম দুঃস্বপ্ন। তালিবানেরা বিদ্যুৎগতিতে বিনা বাধায় একের পর এক এলাকা দখল করতে থাকে, আফগান প্রশাসন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ উপন্যাসে বর্ণনা পাওয়া যায় সেই সময়ের আফগান রাজা আমানুল্লাহ খানের প্রশাসন দুর্বৃত্ত বাচায়ে সকাওয়ের বাহিনীর আক্রমণের সামনে কিভাবে পালিয়ে বেঁচেছিল। তবে আমানুল্লাহ পরে রাজ্য উদ্ধার করেছিলেন, এক্ষেত্রে সেরকম সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। ৬ থেকে ১৬ অগস্টের মধ্যে তালিবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১০০% করে ফেলে, রাজধানী কাবুলেরও পতন হয়। তবে এর ঠিক আগেই রাষ্ট্রপতি গনি প্রচুর টাকাপয়সা বোঝাই করে হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন বাকি দেশবাসীকে ফেলে রেখে। গনি অবশ্য টাকাপয়সা সঙ্গে নেবার কথা অস্বীকার করেছেন আর বলেছেন নাজিবুল্লার মতো পরিণতি এড়াতেই তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। উপরাষ্ট্রপতি আমরুল্লাহ সালেহ এদিকে বলেছেন, গনি চলে যাবার পর তিনি দায়িত্বভার নিয়েছেন, লড়াই জারি থাকবে। তবে সেই কথায় ভরসা করছে, এমন লোক পাওয়া দুর্লভ। মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান যারা বিমানে জায়গা পেয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে, তাদের বাদ দিয়ে বাকি মানুষ চুড়ান্ত আশংকায় দিন কাটাচ্ছে। প্রতিবেশী এবং ইউরোপের দেশগুলো আবার একটা বড়ো শরণার্থী সমস্যার আশংকা করছে।

কথা হচ্ছে, আমেরিকা কি সেনা প্রত্যাহার আরও সুশৃংখলভাবে করতে পারত আর সাধারণ মানুষকে দেশ ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে পারত? বিশেষকরে দূতাবাসকর্মী, দোভাষী সহ যারা আমেরিকানদের এতদিন সহায়তা দিল, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কি আমেরিকার কর্তব্য ছিল না? যখন সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনে কাবুল বিমানবন্দরে চুড়ান্ত বিশৃঙ্খলা চোখের সামনে দেখতে পারছে, তাতে বিদেশে আমেরিকার ভাবমূর্তির কেমন ক্ষতি হল? এত তাড়াতাড়ি তালিবানরা সব এলাকা দখল করে ফেলল কিভাবে? মার্কিন গোয়েন্দাদের হিসেব এত ভুল হল কি করে? আফগান বাহিনীকে এতদিন দেওয়া প্রশিক্ষণ এরকম নিরর্থক হয়ে গেল কেন? আসন্ন আফগান শরণার্থীর ঢেউএর অনেকটা কি আমেরিকার নিজের দেশে নেওয়া উচিৎ নয়? আফগান বাহিনীকে আমেরিকার যোগানো অস্ত্রভান্ডারের কতটা তালিবানদের হাতে পড়ল? পুরোপুরি সেনা না ফিরিয়ে এনে কিছু অল্পসংখ্যক সেনা কি রেখেই দেওয়া যেত না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ব্যাপারে ঐক্যমত্য হওয়া অসম্ভব। তবে মনে হয় এইধরণের পশ্চাদপশরণের সময় সুশৃংখলা আশা করাটা অলীক ব্যাপার, যখন খুব অল্প সময় হাতে আর এত মানুষকে সরাতে হবে। সাহায্যকারী আফগানদের তালিবানদের নাগালের মধ্যে ফেলে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক, বিশেষকরে তাদের জীবনের ঝুঁকি আছে যেহেতু। তবে এরকম পরিস্থিতিতে সব দেশই নিজেদের নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেয়। এখনও বহু আমেরিকান নাগরিক আফগানিস্তানে আটকা পড়ে রয়েছে। বাইডেন অবশ্য আরও দশদিন প্রত্যাহারের সময়সীমা বাড়িয়েছেন, যাতে আরও অনেক লোককে সরিয়ে ফেলা যায়। সাহায্যকারী আফগানদেরও নিরাপদে সরিয়ে আনা হবে বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। সরকারি আফগান বাহিনী ছিল তিন লক্ষের মতো, আর আমেরিকার হিসেব ছিল তালিবানরা ষাট হাজারের মতো হবে। তবে দুর্নীতির আফগানিস্তানে সরকারি হিসেব শুধু খাতায়-কলমে, অনেক সৈন্যই অস্তিত্বহীন, বা বসে বসে বেতন ভোগ করে। অন্যদিকে কর্মহীন যুবকদের মধ্যে টাকা ছড়িয়ে দলে টানা তালিবানদের তেমন অসুবিধার নয়, যে টাকা তারা তোলা আদায় বা বেআইনি মাদক ব্যবসা করে জোগাড় করেছে, বা কট্টর মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেয়েছে। আমেরিকার সৈন্য সরে যাবার পরে যে শূণ্যতা তৈরি হবে তা আন্দাজ করে তালিবানরা আগে থেকেই প্রস্তুতি চালিয়েছিল স্থানীয় শাসকদের দলে টেনে। গনির শিকড়হীন শাসন তাদের সাফল্য পেতে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে রক্ষণশীল এলাকায়। আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গেছে ৭৩% মানুষ সাহায্যকারী আফগানদের উদ্ধার করা উচিৎ মনে করেন, আর ৬৫% মানুষ আফগান শরণার্থীদের আমেরিকায় আশ্রয় দেবায় সম্মতি জানিয়েছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকরাও দাবী তুলেছেন শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার। অস্ত্র বেহাত হওয়াটা অবশ্যই চিন্তার, আর এ ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য জানানো হবে না তা নিশ্চিত। তবে অত্যাধুনিক অস্ত্রতে সাধারণতঃ অনেক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, হাতে পেলেই তা ব্যবহার করা যায় না। আর সেনা ফেরানোর ব্যাপারে বাইডেন যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তিনি মেনে চলেছেন। তাঁর পূর্বসূরীদের মতো তিনি টালবাহানা করে কাটাতে পারতেন, তাতে এতটা বিতর্কের মধ্যে তাঁকে পড়তে হত না। কারণ যে রাষ্ট্রপতি শেষে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন, তার উপর যাবতীয় দুর্ভোগের বড় দায়টা এসে পড়ে, যেমন ভিয়েতনামের যুদ্ধের শেষে জেরাল্ড ফোর্ডের হয়েছিল। তা জেনেও বাইডেনের এই দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। তবে কথা হচ্ছে এত মানুষের ভাগ্য যেখানে বিপন্ন, সেখানে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে চলাটা কি বেশি কাম্য? অল্প সৈন্য রেখে দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা কি ভাল হত না, কোরিয়া-জাপানে যেমন সত্তর বছর ধরে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে যখন সৈন্যদের প্রাণহানি ঘটে নি? মনে হয় অল্প সৈন্যের ঘাঁটি রাখলে তাদের জীবন বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। মনে রাখতে হবে কোরিয়ার মতো স্থিতাবস্থা নয়, আফগানিস্তানে পুরোপুরি যুদ্ধ চলছে। আর অল্প সৈন্য দিয়ে দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব হত না, শুধু সামরিক ঘাঁটিগুলোরই হয়তো নিরাপত্তা দেওয়া যেত। তালিবানরা ওদিকে সেনা সরে যাবে এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমেরিকান সৈন্য ছেড়ে আফগান বাহিনীর উপর বেশি আক্রমণ চালিয়েছে। আমেরিকার সৈন্য থেকে গেলে তালিবানরা আবার আক্রমণ শানাতো, সেনা মারা যেত, তা প্রায় নিশ্চিত। যখন আফগান সমস্যার কোনও প্রকৃত সমাধান দেখা যাচ্ছে না, যখনই সেনা সরুক একই পরিস্থিতি হবার কথা, বাইডেন ব্যাপারটার এখানেই ইতি ঘটাতে চেয়েছেন। ট্রাম্প অবশ্য দাবী করেছেন, তাঁর পরিকল্পনা আরও অনেক সুষ্ঠু ছিল, বাইডেন ব্যাপারটা ঠিক সামলাতে পারেন নি। রিপাবলিকানরাও বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা অবশ্য সেরকম বলবেন প্রত্যাশিত, কারণ তাতে তাদের রাজনৈতিক লাভ বই ক্ষতি নেই। তবে ট্রাম্পের দাবী বিশ্বাসযোগ্য নয় মোটেই। বাইডেন মোটামুটিভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের করে যাওয়া ব্যবস্থাই অনুসরণ করছেন, বরং আর একটু সময়সীমা বাড়িয়েছেন। বিদেশনীতির ব্যাপারে ট্রাম্প কখনই তেমন সড়গড় নন, এমনকি বিশেষজ্ঞদের ব্রিফিং শুনতেও আগ্রহী ছিলেন না রাষ্ট্রপতি থাকার সময়। কোভিড ও জাতিগত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করায় ট্রাম্পের প্রশাসনের অপদার্থতার পরিচয় ও মানুষ পেয়েছে। ট্রাম্প চার বছর সময় পেয়েও সেনা প্রত্যাহারে তাঁর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন নি, কাজেই ট্রাম্পের আরও ভালভাবে সেনা প্রত্যাহারের দাবীকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়েই দিতে হয়।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা যে পরিকল্পনা মতো হয় নি তাতে সন্দেহ নেই। এতে  বাইডেনের রাজনৈতিক সমর্থনেও কিছুটা ভাঁটা লক্ষ্য করা গেছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর অনুমোদন এই প্রথম ৫০% এর নিচে নেমে এসেছে। ৫১% তাঁর আফগানিস্তান পরিচালনা অনুমোদন করছেন না যেখানে মাত্র ৩১% অনুমোদন করছেন। তবে এই মুহুর্তে সেটা নিয়ে বাইডেনের ভাবিত হবার তেমন প্রয়োজন নেই, কারণ এক্ষুনি কোনও নির্বাচন হচ্ছে না। ২০২২ মধ্যবর্তী নির্বাচনে আইনসভার নিম্নকক্ষের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটরা হয়তো এমনিতেই হারাবে। ২০২৪ সালে তাঁর পুনর্নির্বাচনের সময় বিদেশের মাটিতে হওয়া একটা সংকটকে ভোটাররা একটা বড় বিষয় করবে, আমেরিকার রাজনীতিতে তেমনটা বিশেষ হয় না। বরং ততদিনে স্মৃতি ফিকে হয়ে গেলে, আর সন্ত্রাসবাদের সমস্যা যদি আমেরিকার মাটিতে তেমন মাথাচাড়া দিয়ে না বসে, তাহলে বাইডেন যুদ্ধ শেষ করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের কৃতিত্ব দাবী করতে পারবেন।

যেহেতু তালিবানরাই কাবুলে ক্ষমতায় থাকছে অদূর ভবিষ্যতে, এই মুহুর্তে শুধু এটুকুই আশা করা যেতে পারে যে শাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ও  দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে তারা কিছুটা পরিণত শাসকের ভূমিকা নেবে, দেশের অর্থনীতিকে গড়ে তোলার স্বার্থে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলবে, আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মোটামুটি মেনে চলবে, সেরকম কঠোর শরিয়তি অনুশাসনী চালাবে না। শুধু বন্দুকের উপর ভিত্তি করে শাসন যে টানা চালানো যাবে না, সেটা হয়তো তারা বুঝবে। চীন বা রাশিয়া হয়তো তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, কারণ আফগানিস্তানে তাদের ব্যবসায়ী লক্ষ্য রয়েছে। তালিবানরা আগের তুলনায় কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে। শরিয়ত মেনে মেয়েদের স্কুলে শিক্ষা তারা অনুমোদন করবে, বোরখা না পরে শুধু হিজাব পরলেই চলবে। তবে বলা বাহুল্য, তালিবানদের উপর খুব ভরসা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আইসিসের মতো আরও চরম সংগঠনের বৃদ্ধি হবার আশংকাও রয়েছে।

তাহলে আমেরিকার আফগানিস্তান অভিযানের শেষে কুড়ি বছর পরে একরকম শূণ্যই পাওয়া গেল। এক সময় কমিউনিস্টদের হঠানোর জন্য যে মুজাহিদীনদের সাহায্য করা তারা শুরু করে, তার ফলে আজ ইসলামী জঙ্গিবাদ এত শক্তিশালী আফগানিস্তানের মাটিতে। সেই সিদ্ধান্তের কুফল এখন আমেরিকার নিজেরই বড় সমস্যা। ফলে বলা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়ে যে ভুল করেছিল, আমেরিকার এই ভুলও সেই মাপেরই। 


==========

লেখার তারিখঃ অগস্ট ২৭, ২০২১

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল

লেখাটি "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।