শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ

 প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ

২৯শে জুন, ১৮৯৩-- ২৮শে জুন, ১৯৭২

 

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার জনক, এক জীবনের পক্ষে এটা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য অবদান, তবে শুধু এইটুকু বললে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, দক্ষ নেতা সংগঠক, দেশ গড়ার কারিগর, সমাজসচেতন বিজ্ঞানী অসামান্য গবেষক। মহলানবীশের অপূর্ব সাংঠনিক ক্ষমতার তুলনা খুব কমই পাওয়া যায়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় ভারতীয় গবেষকরা পৃথিবীতে প্রথম সারিতে পড়েন, এটা মহলানবীশ এবং তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলি না থাকলে কিছুতেই সম্ভব হত না। মহলানবীশ যখন পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং তার প্রয়োগ করছেন, তখন ভারতবর্ষ তো বটেই, সারা পৃথিবীই পরিসংখ্যানবিদ্যা সম্পর্কে খুব কম জানত। কার্ল পিয়ার্সন বা স্যার রনাল্ড ফিশারের মতো আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতারা তখন সবে গবেষণা শুরু করেছেন। তৎকালীন বাংলা বা ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে শুধুমাত্র সরকারি কাজের অংশ মনে করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা কোনও হিসেবে স্বীকৃতি ছিল না। এমন একটি সময়ে পরাধীন দেশে প্রায় একার চেষ্টায় পরিসংখ্যানবিদ্যা চর্চার উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সফল হওয়া মহলানবীশের এক অনন্য কৃতিত্ব, আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার।

 

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ বাংলার নবজাগরণের শেষ প্রজন্মের সর্বশেষ জীবিত আইকন ছিলেন বলা যেতে পারে। কলকাতায় এক সচ্ছল উদারমনোভাবাপন্ন ব্রাহ্ম পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। প্রশান্তচন্দ্রের পিতামহ গুরুচরণ ভাগ্য অনুসন্ধানে কলকাতা শহরে চলে আসেন ধীরে ধীরে সফল ব্যবসা গড়ে তোলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং কোষাধক্ষ্য পরে সভাপতিও হয়েছিলেন। তাঁর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপের কেন্দ্র ছিল। বহু বাল্যবিধবাকে তিনি নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজেও বিধবাবিবাহ করেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্রের জেঠামশাই সুবোধচন্দ্র এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে মনোবিদ্যার অধ্যাপক পরে বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। পিতা প্রবোধচন্দ্র তাঁর পিতার ব্যবসায় প্রথমে যোগদান করে পরে নিজেও সফল ব্যবসা শুরু করেন। প্রশান্তচন্দ্রের মাতা নিরোদবাসিনী দেবী ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের ভগিনী। পরিবারের শিক্ষা, উদার চিন্তাধারা ব্যবসায়ী প্রেক্ষাপট প্রশান্তচন্দ্রের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

 

পরিসংখ্যানবিদ্যায় মহলানবীশের উৎসাহ শুরু হয় কিছুটা আকস্মিকভাবে। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল পদার্থবিদ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। প্রেসিডেন্সিতে মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে  লন্ডন যাত্রা করেন। ঘটনাচক্রে কেম্ব্রিজে বেড়াতে গিয়ে কিংস কলেজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন, এক ভারতীয় বন্ধুর পরামর্শ মেনে সেখানেই গণিতশাখায় ভর্তি হন। কেম্ব্রিজে তাঁর সঙ্গে গণিতের বিরল প্রতিভা রামানুজনের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা দীর্ঘসময় একসাথে হাঁটতে বেরোতেন নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। ছাড়াও কেম্ব্রিজ বাসকালে দার্শনিক লোয়েস ডিকিনসন বাট্রান্ড রাসেল এবং গণিতবিদ গডফ্রে হার্ডির সঙ্গে চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান মহলানবীশের চিন্তাধারায় উদারতা সার্বজনীনত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তবে বিমূর্ত গণিতে মহলানবীশের তেমন আগ্রহ গড়ে না ওঠায় তিনি পদার্থবিদ্যায় ফিরে আসেন। ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়ভাগ উত্তীর্ণ হবার পর সি টি আর উইলসনের সাথে কেম্ব্রিজে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য বরিষ্ঠ গবেষকের পদে নির্বাচিত হন। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে গবেষকপদে যোগদানের আগে কিছু সময় হাতে থাকায় মহলানবীশ  ভারতবর্ষে ছুটি কাটাতে আসা মনস্থ করেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে তাঁর যাত্রা পিছিয়ে যায়। সেই সময় তিনি কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে নানা বইপত্র পড়ছিলেন। কলেজের এক অধ্যাপক ম্যাকুলার সাথে সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় ম্যাকুলা একটি বিজ্ঞানপত্রিকার কতগুলি সংখ্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেগুলি ছিল বিজ্ঞানের এক সদ্যজাত শাখা পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর কার্ল পিয়ার্সন প্রতিষ্ঠিত  বায়োমেট্রিকা পত্রিকার। সেখানে প্রকাশিত কিছু গবেষণাপত্র পড়ে মহলানবীশ এতটাই আগ্রহান্বিত হন যে বায়োমেট্রিকার তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবকটি সংখ্যা তিনি কিনে নিয়ে  দেশে ফেরার পথে  জাহাজে পড়ে ফেলেন। তিনি এর ফলে উপলব্ধি করেন পরিমাপ তার বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের এই নতুন শাখা পরিসংখ্যানবিদ্যা বহু ফলিত গবেষণার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। কলকাতা ফিরে তিনি আবহবিজ্ঞান নৃতত্ত্ববিদ্যার বেশ কিছু সমস্যার খোঁজ পান যাতে তিনি তাঁর এই নতুন অধিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। কেম্ব্রিজে পদার্থবিদ্যায় বরিষ্ঠ গবেষকের পদে যোগদানের পরিকল্পনা তিনি ত্যাগ করেন প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপকপদে যোগ দেন। তাঁর নামাঙ্কিত ডি-স্কোয়ার পরিসংখ্যাত সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক গবেষণা করেছিলেন তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যায়। তবে ফলিত গবেষণায় তাঁর আগ্রহ ছিল আরও অনেক বেশি। নৃতত্ত্ব, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পাটের ফলন ও বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক, শিক্ষাক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির পরিমাপ ইত্যাদি বহু বিষয়ে তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যার সফল প্রয়োগ করেন।

 

পরিসংখ্যানবিদ্যায় অসামান্য অবদান ছাড়াও যে কারণে মহলানবীশ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হল তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা নেতৃত্বগুণের জন্য। মহলানবীশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আই এস আই, যার প্রতিষ্ঠা প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি ছোট গবেষণাগারে, যার শুরু মাত্র ২৩৮ টাকার মূলধন নিয়ে, তা ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মহলানবীশের মৃত্যুর সময় আই এস আই এর বাৎসরিক আয়ব্যয় দাঁড়িয়েছিল দুকোটি টাকায়, দু হাজার কর্মী কাজ করত, কলকাতার মূল কেন্দ্র ছাড়াও আরও আটটি কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল --- বলা বাহুল্য এখন এই সংখ্যাগুলো আরও অনেকগুণ বেড়েছে। আই এস আই মডেল অনুসরণ করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেট্রুড কক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা কিনা তার আগে পর্যন্ত গণিত বিভাগের অন্তর্গত হত। মহলানবীশ ছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ বিজ্ঞানীরা মহলানবীশের জীবিতকালেই আই এস আই কাজ করেছেন। কুড়ি আর তিরিশের দশকে ভারতবর্ষে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রায় সমস্ত কাজ মহলানবীশ তাঁর ছাত্রদের দ্বারা হয়েছিল। এমনকি রাজচন্দ্র বোস সমরেন্দ্রনাথ রায়ের বেশ কিছু বিখ্যাত  তাত্ত্বিক গবেষণা মহলানবীশের গবেষণার ফলশ্রুতি। প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জে বি এস হল্ডেন ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বায়োমেট্রি বিভাগের প্রধান হিসেবে আই এস আই তে যোগ দেন। পঞ্চাশের দশকে আই এস আই এর দায়িত্ব আরও বাড়ে, ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গ্যানাইজেশনের যোগাড় করা তথ্য নথিকরণ সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার জন্য। দেশ স্বাধীন হবার পরে দেশীয় শিল্পের গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরামর্শ দেওয়ারও প্রয়োজন দেখা দেয়। কলকাতা দিল্লীতে পরিকল্পনা শাখা, সমাজতত্ত্ব জনতত্ত্ব, বৈদ্যুতিন বিভাগ এই সবেরও আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু, অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ কেন্দ্রীয় সরকারে প্রভাবশালী পিতাম্বর পন্থের সাথে মহলানবীশের ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। এরা সকলেই আই এস আই এর গড়ে ওঠায় বিশেষ সহযোগিতা করেন। পঞ্চাশের দশকে যন্ত্রগণক বিভাগ শুরু হয় ভারতবর্ষের প্রথম যন্ত্রগণক আই এস আইতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় আই এস আই অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়, যাতে আই এস আই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। তার ফলে আই এস আই স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং স্নাতক স্নাতকোত্তর উপাধি দেবার অধিকার পায়। প্রথম যুগের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ গণিতবিদ হয়েছিলেন। বিশিষ্ট ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ পামেলা রবিনসনের নেতৃত্বে ভূতত্ত্ববিভাগ শুরু হয় জীবাশ্মবিদ্যা গবেষণায় বিশেষ সাফল্যলাভ করে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গবেষকদলই ভারতবর্ষে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসোর জীবাশ্ম উদ্ধার করে। এডুইন হার্পার সাইকোমেট্রি শাখার প্রধান হন। যুগোস্লাভিয়া থেকে এসে ডি কোস্টিক ফোনেটিক্স বিভাগ খোলেন। এক সঙ্গে এতজন বিখ্যাত বিদেশী বিজ্ঞানীর একটি দেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একরকম অবিশ্বাস্য। আর বিজ্ঞানের এতগুলি শাখায় উৎসাহ দেওয়া মহলানবীশের বিস্তৃত চিন্তাধারা অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক। এই সূত্রে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠান চালানো স্বশাসন নিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধও হয়েছিল। সরকারের বক্তব্য ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আই এস আই এর কেবলমাত্র সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণাতেই জোর দেওয়া উচিৎ। মহলানবীশের মত ছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণার পরিসর অনেক বড়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সরতে হলে তিনি নির্দেশকের পদ ছেড়ে দিয়ে নতুন সংস্থা গড়বেন। সরকার মহলানবীশের মত মেনে নেন।

 

মহলানবীশের সময় আই এস আই সারা পৃথিবীতে কতটা গুরুত্ব পেত সেটা কারা সেসময় আই এস আই এসেছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। ফিশার মোট চারবার আই এস আই এসেছিলেন ১৯৬২ সালে ফিশারের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ও গণিতবিদদের মধ্যে আর যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা হলেন ডব্লু ডেমিং, ওয়াল্টার শুয়ার্ট,  উইলিয়াম হারউইটজ, ফ্র্যাঙ্ক ইয়েটস, জের্জি নেম্যান, আব্রাহাম ওয়াল্ডহ্যারল্ড হোটেলিং, জি কিটাগাওয়া, টি তাগিউচি, এন কল্মোগোরভ, নর্বার্ট ভিনার, ইউ ভি লিনিক জে এল ডুব প্রমুখ। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিশিষ্টদের মধ্যে এসেছিলেন নিলস বোর, ফ্রেডেরিক আইরিন জোলিএ কুরি, জে ডি বার্নাল, আর্থার লিন্ডার ইয়ান টিনবের্খেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা সত্যেন্দ্রনাথ বসু  আই এস আই এর উপদেষ্টা হিতাকাংক্ষী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু আই এস আই এর প্রেসিডেন্টও ছিলেন আট বছর। ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন সময়ে আই এস আই তে এসেছেন মহলানবীশের আমন্ত্রণে, যেমন চৌ এন লাই, হো চি মিন, আর্নেস্টো চে গ্বেভারা, আলেক্সি কোসিগিন লিন্ডন জনসন। চৌ এন লাই মহলানবীশকে চীনের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করারও অনুরোধ জানান। বলা বাহুল্য, মহলানবীশের প্রবল ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছাড়া এতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আই এস আই সম্পর্কে উৎসাহী করা সম্ভব ছিল না। মহলানবীশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি যেমন অনন্য ছিল, তেমন ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ভূমিকা দায়বদ্ধতা। মূলতঃ আফ্রিকা এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সরকারি পরিসংখ্যান পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য তিনি আই এস আই এর মধ্যে ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল এডুকেশন সেন্টার গঠন করেন, যা এখনও সেইসব দেশের সরকারি কর্মীদের পরিসংখ্যানবিদ্যায় তালিম দেয়। একটি সদ্য স্বাধীন হওয়া উন্নয়নশীল দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে শিক্ষার প্রসারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, এমন নজির সারা পৃথিবীতে দুর্লভ।

 

ভারতবর্ষের উন্নয়নে মহলানবীশের আর এক বিশাল অবদান দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়া। জহরলাল নেহরু তাঁকে ব্যাপারে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন। মহলানবীশের অর্থনীতিতে প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তাতে তাঁর চিন্তাধারায় কিছুটা প্রথাবিরোধিতা ছিল, যাতে হয়তো সুবিধাই হয়েছে নতুন চিন্তাভাবনা করতে। সমস্যার সমাধানে তিনি কিছু সহজ গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাব করেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি পরিকাঠামো ভারী শিল্পে জোর দিয়েছিলেন, কৃষিকে সাময়িকভাবে কিছুটা কম অগ্রাধিকার দিয়ে। মহলানবীশ পরিকল্পিত অর্থনীতি বৃহৎ সরকারি বিনিয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এই সময় ভিলাই, দুর্গাপুর, রৌরকেল্লা ইত্যাদি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতোত্তর ভারতের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তাকে  স্বাবলম্বী করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পিত অর্থনীতির সাফল্য নিঃসন্দেহে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অর্থনৈতিক উদারীকরণের আগে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার খুব বেশী না হলেও ভারতবর্ষে  কখনও তেমন কোনও অর্থনৈতিক সংকট না হওয়ার কারণ এই শক্ত বুনিয়াদ। পক্ষান্তরে  উপনিবেশিক শাসন থেকে ওই সময় মুক্ত হওয়া বহু দেশ তুলনায় অবস্থাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও একের পর এক সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে অপ্রস্তুত অবস্থায় বাজার অর্থনীতির পথ নিয়ে।

 

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে, বিশেষতঃ পরিসংখ্যানবিদ্যার চর্চায় আই এস আইএর কাজকর্মের বাইরেও মহলানবীশ বিশেষ ভূমিকা নেন। ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষে প্রথম পরিসংখ্যানবিদ্যার উপর সম্মেলন হয়।  স্যার রনাল্ড ফিশার সেই অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যায় স্নাতক স্নাতকোত্তর উপাধি দেওয়া শুরু হয় ১৯৪১ সাল থেকে। মহলানবীশ তখন সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। লক্ষ্যণীয়, তখন পৃথিবীর প্রায় কোথাওই আলাদা পরিসংখ্যানবিদ্যার বিভাগ ছিল না। তাঁর চেষ্টায় ১৯৪২ সালে পরিসংখ্যানবিদ্যা ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিতের শাখা হিসেবে। ১৯৪৫ সালেই তা পৃথক শাখার মর্যাদা লাভ করে। তাঁর মত ছিল দেশের উন্নতিতে বিজ্ঞানচর্চা এক অপরিহার্য শর্ত এবং তার জন্য সরকারি ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিবিদদের মতমত নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৬১ সালে ভারতবর্ষের সরকারি পরিসংখ্যানের কাজের জন্য ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল সার্ভিস শুরু করা হয়।

 

সারা জীবনে মহলানবীশ নানা সরকারি  শিক্ষাক্ষেত্রে দায়িত্ব সামলেছেন, অনেক সময় একসাথে বহু দায়িত্ব, যথা আই এস আই এর নির্দেশক (১৯৩১--১৯৭২), সংখ্যার সম্পাদক (১৯৩৩--১৯৭২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রধান (১৯৪১--১৯৪৫) প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা  ছাড়াও অধ্যক্ষ পদেও ছিলেন কিছুদিন (১৯৪৫--১৯৪৮) ছাড়া কলকাতায় পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা আবহবিদ (১৯২২--১৯২৬), বাংলা ভারত সরকারের উপদেষ্টা (১৯৪৫--১৯৪৮, ১৯৪৯--১৯৭২), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (১৯৫৫--১৯৬৭), দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান (১৯৫৩--১৯৫৮), ন্যাশানাল সাম্পেল সার্ভের প্রধান (১৯৫০--১৯৭২), বিশ্বভারতীর কর্মসচিব (১৯২১--১৯৩১) ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেছেন। একসাথে এতগুলি প্রতিষ্ঠান পদের দায়িত্ব পালন করার দৃষ্টান্তও সারা পৃথিবীতে খুব কম আছে। ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দফতরের অধীনে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গ্যানাইজেশন গঠনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। বেকারি ছিল দেশের এক প্রধান সমস্যা। বেকারির সমাধানে মহলানবীশ প্রস্তাবিত লেবার রিসার্ভ সার্ভিস নামক একটি নীতি কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে কোনও ছাঁটাই হলে কোম্পানিদের লেবার রিসার্ভ সার্ভিসে কিছু টাকা জমা দিতে হত, ফলে কোম্পানিগুলি ছাঁটাইয়ের পথে যেত তখনই যদি এর ফলে তাদের লাভ জমা দেওয়া টাকার থেকে বেশী হত। জমার টাকা থেকে লেবার রিজার্ভ সার্ভিস ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিত, যাতে তারা আবার চাকরি পাবার উপযুক্ত হতে পারে। ট্রেনিং এর সময় সেইসব কর্মীদের টাকাও দেওয়া হত, তবে পূর্ণ  কর্মসংস্থানের থেকে কিছুটা কম হারে। ফলে তাদেরও উৎসাহ থাকত স্বাভাবিক চাকরিতে ফেরত যাবার। মহলানবীশের এই মডেলে যেমন বেকারি প্রতিরোধে কিছুটা পরিসর থাকত, তেমনি অর্থনীতির প্রসারের সাথে দক্ষ কর্মীর অভাবের সমস্যা কমানো যেত।

 

পরিসংখ্যানবিদ্যার বাইরেও মহলানবীশের বিস্তৃতক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল। তাঁর জীবনে পারিবারিক ঐতিহ্য, উদারতা শিক্ষার অপরিসীম ভূমিকা ছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর কাজে প্রগতিশীল মনোভাব প্রকাশ পেত। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতেও তিনি পিছপা হতেন না। যৌবনকালে তিনি ব্রাহ্মসমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সহকারি সচিব, কোষাধ্যক্ষ সবশেষে সভাপতিও হয়েছিলেন। হিন্দুসমাজের তুলনায় প্রগতিশীল হওয়া সত্বেও ব্রাহ্মসমাজেও গোঁড়ামি ছিল। ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার রবীন্দ্রনাথের উদারপন্থী চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন। সেখানে তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়। তাঁরা দুজনে মিলে "কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই?" পুস্তিকা রচনা করে রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্মসমাজের  নেতৃত্বে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ব্রাহ্মদের হিন্দুবিবাহমতে রেজিস্ট্রেশন করার ব্যাপারেও তিনি আপত্তি জানান। এমনকি এজন্য নিজের বিবাহের সময়ও তাঁর ভাবী শ্বশুরমশাই সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। হেরম্বচন্দ্রের কন্যা নির্মলকুমারীকে (রানী) মহলানবীশ বিবাহ করতে চাইলে হেরম্বচন্দ্র সেই কারণে গররাজি হন। মহলানবীশের নিজের বাড়ির লোকেও এই বিবাহে অংশ নেন নি, যদিও কোনও বাধাও দেন নি তাঁরা। মামা নীলরতন সরকার তাঁর বিবাহ দেন নির্মলকুমারীর সাথে। এর কিছুদিনের মধ্যেই মহলানবীশ "ব্রাহ্মবিবাহ বিধি" বলে একটি বই লেখেন, যা ব্রাহ্ম আচারের একটা প্রামাণ্য বই।

 

মহলানবীশ রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাঁর বিবাহে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন "বসন্ত" নাটকটি লিখে নবদম্পতিকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের গুলিচালনা হত্যাকান্ডের পর কবি অত্যন্ত মনোকষ্টে ছিলেন। এই বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদ করে তিনি তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেন। সেইসময় তাঁর এই প্রতিবাদে গান্ধিজী কংগ্রেসের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বকে তেমনভাবে পাশে না পেয়ে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন। মহলানবীশ সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ মানসিক সাহচর্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সচিব হিসেবে মহলানবীশ বহুদিন কাজ করেছেন। কবি নিজেও মাঝে মাঝে  প্রেসিডেন্সির গবেষণাগার পরিদর্শনে  আসতেন খোঁজখবর নিতেন। ১৯৪১ সালে বরাহনগরে মহলানবীশ আমগাছে ছাওয়া যে বাগানবাড়ি কিনেছিলেন, পরে যার লাগোয়া জমিতে আই এস আই এর নতুন বিদ্যায়তন গড়ে ওঠে, রবীন্দ্রনাথ তার নামকরণ করেছিলেন "আম্রপালি" রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা খুব মিলত। তাঁরা দুজনেই মনে করতেন ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁরা দুজনেই জাতীয়তাবাদের প্রচলিত রূপ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, কারণ তা যে উপনিবেশিকতার বিরোধিতা করে, প্রকারান্তরে তাকেই সে অনুকরণ করে। মহলানবীশও রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন বিশ্বশান্তির জন্য কাজ করেছিলেন। মহলানবীশের উদ্যোগে আই এস আই তাঁর বাসস্থান গুপ্তনিবাসে রবীন্দ্রনাথ অতিথি হয়েছিলেন নেহরুর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। "জনগণমন" কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব নেহরু তখনই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

 

তবে প্রথাগত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হলেও মহলানবীশের দেশের মানুষের জন্য বিশেষ অনুভুতি ছিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি বর্মায় ব্রিটিশ শক্তির পতন হলে সৈন্যদের খোরাকির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার বাংলা থেকে চাল অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে নেয় ন্যূন্যতম বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। চালের দাম হুহু করে বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। কালোবাজারি মজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয় না। বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী ভারতবিদ্বেষী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল কান দেন নি। কুড়ি থেকে তিরিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায় বাংলায় মানুষের তৈরি এই কৃত্রিম অন্নাভাবে, যা সম্পূর্ণ এড়ানো সম্ভব ছিল।  নৃতত্ত্ববিদ কে পি চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে মহলানবীশ একটি রিপোর্ট গবেষণাপত্র লেখেন লন্ডনে রয়্যাল সোসাইটিতে আর্ল অফ মুন্সটারের সামনে পাঠ করেন। তথ্য সহযোগে তিনি এই দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেন কারুকে সরাসরি দোষারোপ না করেই। ব্রিটিশ সরকারের এই অমানবিক দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতির বিরুদ্ধে ব্রিটেনেই যথেষ্ট জনমত গড়ে ওঠে, যাতে মহলানবীশের রিপোর্টের বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্ত্রী রানী মহলানবীশের সাথে স্বাধীনতার পরে পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে তিনি কল্যানশ্রী প্রকল্প চালু করেছিলেন। এতে উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্যদের হাতের কাজ শেখানো হত স্বনির্ভর হবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।

 

মহলানবীশ কখনও সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন নি বা কোনও রাজনৈতিক বক্তব্যও রাখেন নি কখনও। তবে তাঁর চিন্তাধারা যে অনেকটাই বামপন্থী আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে করা তাঁর প্রস্তাবগুলি অনেকাংশেই সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে করা। আর পারিবারিক সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন মানবিকতা উদারপন্থী চিন্তাধারা।

 

 বাংলা ভাষা সংস্কৃতির প্রতিও মহলানবীশের বিশেষ টান ছিল। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসা নিজের লেখালিখি (ব্রাহ্মসমাজ রবীন্দ্রনাথের উপরে) ছাড়াও কেম্ব্রিজে থাকার সময় মহলানবীশের উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চার একটা সমিতি করা হয়েছিল যা নিয়মিতভাবে মিলিত হত সংস্কৃতি চর্চা করত। এই সমিতিতে বাংলায় কথা বলা বাধ্যতামূলক ছিল --- ইংরাজি ভাষা ব্যবহার করলে জরিমানা নেওয়া হত। সেই যুগে, যখন শিক্ষিত বাঙালি প্রায়ই ইংরেজের অন্ধ অনুকরণ করত, তখন ধরণের উদ্যোগ অভাবনীয়। এমনকি যুগেও, যখন বাংলার চর্চা সংকুচিত হচ্ছে, মহলানবীশের বাংলা ভাষা চর্চার উদ্যোগ স্মরণীয়।

 

উত্তরাধিকারসূত্রে মহলানবীশ রক্তে উদ্যোগপতিত্ব পেয়েছিলেন। সংখ্যা পত্রিকার ছাপা তখন কলকাতায় যে মানের হত, মহলানবীশের সেটা পছন্দ ছিল না। সংখ্যা ভালভাবে ছাপানোর জন্য তিনি তাঁর কলকাতার বাড়িতে একা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার দেখাশুনো তিনি নিজেই করতেন। পরে তা  পরিসংখ্যানবিদ্যা সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্যও ব্যবহার হয় এবং স্ট্যাটিস্টিকাল পাবলিশিং সোসাইটি নামে খ্যাত হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটি উন্নতমানের ছাপার যন্ত্র উপহার পেলে তিনি ত্রৈকা প্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন, যার অর্ধেক কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলির ইংরাজী অনুবাদ ছাপানো। এমনকি মহলানবীশ আই এস আই বানিজ্যিকভাবে যন্ত্রগণক  তৈরি করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যদিও সে চেষ্টা ফলপ্রসু হয় নি। এটি হয়তো মহলানবীশের একমাত্র উদ্যোগক্ষেত্রে ব্যর্থতার উদাহরণ। তবে ব্যর্থতা সত্ত্বেও এতেও মহলানবীশের পারিবারিক ব্যবসার ঐতিহ্য উদ্যোগপতির গুণ লক্ষ্য করা যায়।

 

সারা জীবনে মহলানবীশ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন, যেমন ফেলো অফ দি ন্যাশানাল  সায়েন্স অ্যাকাডেমি (১৯৩৫), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েল্ডন গোল্ড মেডাল (১৯৪৪), লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (১৯৪৫), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি (১৯৫০),মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইকনমেট্রিক সোসাইটির ফেলো (১৯৫১), পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৫২), রয়্যাল সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো (১৯৫৪), কেম্ব্রিজ কিংস কলেজের ফেলো (১৯৫৯), ইন্টারন্যাশানাল স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি (১৯৫৭), দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারি গোল্ড মেডাল (১৯৫৭), সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সের বিদেশী সদস্য (১৯৫৮), আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিকাল আসোসিয়েসনের ফেলো (১৯৬১), দুর্গাপ্রসাদ খৈতান গোল্ড মেডাল (১৯৬১), ফেলো অফ দি ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স (১৯৬৩), চেকোস্লোভাক অ্যাকাডেমি অফ সাইন্সেস গোল্ড মেডাল (১৯৬৩), শ্রীনিবাস রামানুজান গোল্ড মেডাল (১৯৬৮) ছাড়া তিনি পদ্মবিভূষণ দেশিকোত্তম সম্মান পান বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট হয়েছিলেন। বিশ্বব্যপী ঠান্ডা যুদ্ধের সেই কালে তিনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন যাঁরা বিশ্বের সর্বত্র আদরণীয় ছিলেন।

 

মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু লিখতে হলে তাঁর স্ত্রী রানী মহলানবীশ সম্পর্কে কিছু না লিখলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা বিদুষী মহিলা মহলানবীশের যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপর "বাইশে শ্রাবণ" নামক একটি বই লিখেছিলেন কবির সাথের তাঁর ব্যক্তিগত আদানপ্রদানের স্মৃতি থেকে। স্বামীর সাথে রানীও নানা সমাজকল্যানের কাজে অংশ নিতেন। আই এস আই এর কাজকর্মে রানীর বিশেষ ভূমিকা ছিল। আই এস আই এর অতিথিনিবাস আম্রপালি তিনি নিজের মনের মত করে সাজিয়েছিলেন। আই এস আই প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা সৌন্দর্যায়নে তাঁদের দুজনেরই বিশেষ নজর ছিল। আই এস আই প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যারা পদার্পন করেছিলেন, মহলানবীশ দম্পতির আগ্রহে প্রত্যেকে বৃক্ষরোপণে অংশ নিয়েছিলেন। কর্মীদের কাছেও এই বৃক্ষরোপণ স্মরণীয় উৎসব ছিল। নিঃসন্তান এই দম্পতির কাছে আই এস আই এর ছাত্র কর্মীরাই সন্তানের তুল্য ছিল। তারাও মহলানবীশ দম্পতিকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। আই এস আই তে বহু অধ্যাপক থাকলেও প্রফেসর বলতে তখন শুধু মহলানবীশকেই বোঝাত। মহলানবীশ দম্পতির প্রতিষ্ঠিত আই এস আই ক্লাব এখনও ছাত্র কর্মীদের সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। মহলানবীশের জন্মদিন ২৯শে জুন এখনও প্রতিবছর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন হয়, যেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী সমস্ত কর্মী ছাত্ররা একসাথে মধ্যাহ্ণভোজ করেন।

 

সবশেষে মহলানবীশের নিজের বলা কথা দিয়ে শেষ করতে হয়। তিনি বলতেন যে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গবেষণার সবসময় একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সারা জীবন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি তা বুঝিয়েছেন। তিনি পরিসংখ্যানবিদ্যাকে শুধুমাত্র সম্ভাবনাতত্ত্বভিত্তিক নিয়মমাফিক তথ্যের বিশ্লেষণ কিংবা নিছক সরকারি সিদ্ধান্ত নেবার সহায়ক বলে মনে করেন নি। তিনি একে একটা সর্বব্যাপী স্বাভাবিক তথ্যভিত্তিক জ্ঞান আরোহনের বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছিলেন, যা কি না শেষমেষ মানবকল্যাণের নানা কাজে ব্যবহার হবে। মহলানবীশের অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় আজ জীবনের প্রায় সব ব্যাপারেই পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগে। মহলানবীশের সফল নেতৃত্বে বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলিতে কাজ করে বা প্রশিক্ষণ পেয়ে আরও অনেকে বহু নজরকাড়া গবেষণা করেছেন করছেন। মহলানবীশ গবেষক অশোক রুদ্রের ভাষায়, মহলানবীশ হলেন ইতিহাসের এক বিরল অসাধারণত্ব। উন্নত দেশে সাধারনতঃ সংস্থা থাকে, ব্যক্তি সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করে তাকে দক্ষভাবে পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে দৃষ্টান্তকর কিছু করতে হলে  ব্যক্তির উদ্যোগকে অনেক বড় হতে হয়। মহলানবীশ ছিলেন সেই উদ্যোগীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

 

 ----------------------------------

প্রবন্ধটি ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ প্রকাশিত ‘তিন বাঙালি বিজ্ঞানী’ বইয়ে আমার একটি প্রবন্ধের সংক্ষিপ্তরূপ। 


জুন ২০২০

কপিরাইটঃ শুভাশিস ঘোষাল